নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে, আরে লাল লাল নীল নীল বাত্তি দেইখ্যা নয়ন জুড়াইছে…’ ১৯৭৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘অশিক্ষিত’ নামের বাংলা সিনেমার তুমুল জনপ্রিয় গান। ৪৪ বছর আগের জনপ্রিয় সেই গানে গ্রাম থেকে আসা অশিক্ষিত নায়ক রাজ্জাক আর নায়িকা অঞ্জনাকে রঙিন ঢাকার রূপ দেখে বিমোহিত হতে দেখা যায়। তখনকার পথঘাট, দালানকোঠা, ঝাড়বাতি, গাড়িসহ সুন্দর নাগরিক জীবনের হাতছানি ছিল ওই গানে। রাজ্জাক-অঞ্জনা তখনকার ঢাকা শহরে এসে নিজেদের বদলে দেওয়ার মনোবাসনা প্রকাশ করেছিলেন!
সেই ঢাকা এখন আরও রঙিন, আরও উন্নত, বিচিত্র সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধার তিলোত্তমা মহানগরী। বলা যায়, অনেকটাই বদলে গেছে এর সবকিছু। কিন্তু চার দশক পরও গ্রাম থেকে বা দেশের অন্য শহর থেকে ঢাকায় মানুষ আসা থামেনি। বরং বেড়েছে কয়েক গুণ। আর এখানে ওই ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার মতো শুধু নিরক্ষর মানুষই আসছে না; ভাগ্য বদলের আশায়, জীবন বদলে দিতে, কাজের সন্ধানে শিক্ষিত মানুষেরও লম্বা মিছিল এই শহরে। আর এভাবে মানুষের ভাগ্য ফেরানোর অন্যতম আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে ঢাকা শহর।
গতকাল বুধবার প্রকাশিত সরকারের জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ কার্যক্রমের প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, দেশের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে শুধু ঢাকা জেলাতেই বাস ১ কোটি ৪৭ লাখ মানুষের। এর মধ্যে ঢাকা শহরে ১ কোটি ৩ লাখ। এক দশকে ঢাকায় মানুষ বেড়েছে ৩৩ লাখ ৮ হাজার। ঢাকা ও এর আশপাশের চার জেলায় জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৫৮ লাখ। এই শহর এবং আশপাশের ৪টি জেলা যে আসলে ডাল-ভাত সংস্থানের কেন্দ্র, তা বোঝা যায় প্রতি ঈদে বা যেকোনো উৎসবে। লাখ লাখ মানুষের ঢাকা ছাড়া ও ফিরে আসার চিত্রই বলে দেয় এ রঙিন ঢাকা ছাড়া আদতে তাদের কোনো গতি নেই।
প্রশ্ন উঠেছে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও দেশের সব অঞ্চলের মানুষ কেন শুধু ঢাকাতেই আসছে? তথ্য-উপাত্ত বলছে, আসলে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা। সরকারি অফিস-আদালত সবই ঢাকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের ২০১৩ সালের সবশেষ অর্থনৈতিক শুমারি বলছে, দেশের মোট অর্থনৈতিক স্থাপনার সংখ্যা ছিল ৭৮ লাখ ১৮ হাজার ৫৬৫টি। এর মধ্যে শুধু ঢাকা জেলায় এই সংখ্যা ৩৭ লাখ ১৬ হাজার ৮৪৮ টি। এর মধ্যে শহরে ২৪ লাখ ৫৬ হাজার ৯৪৮টি আর গ্রামে ১২ লাখ ৫৯ হাজার ৯০০টি। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ঢাকার আশপাশের জেলা ধরলে এই সংখ্যা আরও বড় হবে। অর্থনৈতিক স্থাপনার বেশির ভাগই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, পাইকারি ব্যবসা, গাড়ির গ্যারেজ, আবাসন, খাদ্য, পরিবহন, বিভিন্ন শিল্প-কারখানা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠান অন্যতম।
বোঝাই যাচ্ছে, সারা দেশে যেসব অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম হয়, তার সিংহভাগই হয় শুধু ঢাকা ঘিরে। বিবিএসের গতকালের ঘোষিত জনশুমারির ফলাফলেও সেই চিত্রই ধরা পড়েছে। তথ্য বলছে, ঘনত্বের বিচারে ঢাকা সবার ওপরে। দেশের প্রতি এক শ জনের ৯ জন বাস করে রাজধানী ঢাকায়। ঢাকার মধ্যে দক্ষিণ সিটিতে বাস করে ৪২ লাখ ৯৯ হাজার ৩৪৫ জন। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৯ হাজার ৩৫৩ জন, যা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ঘনত্ব। উত্তর সিটিতে ৫৯ লাখ ৭৯ হাজার ৫৩৭ জন মানুষের বাস, ঘনত্ব ৩০ হাজার ৪৭৪ জন। এক দশকে ঢাকায় মানুষ বেড়েছে ৩৩ লাখ ৮ হাজার জন।
রাজধানীমুখী মানুষের এ স্রোত ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকার আশপাশের চার জেলাতেও। গাজীপুরে বাস করে ৫২ লাখ ৬৩ হাজার ৪৭৪ জন, নারায়ণগঞ্জে ৩৯ লাখ ৯ হাজার ১৩৮ জন, নরসিংদীতে ২৫ লাখ ৮৪ হাজার মানুষের বাস। সব মিলিয়ে ঢাকার চার জেলাতে বাস করে ২ কোটি ৬৪ লাখ ৯১ হাজার মানুষ। যা দেশের মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশের বেশি। অথচ দেশে মানুষের গড় ঘনত্ব ১ হাজার ১১৯ জন।
গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট ও এশিয়ান ফাউন্ডেশনের অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছিলেন, সারা দেশের সম্পদের ভাগাভাগি ঢাকা শহরে হয়। গ্রামের মানুষ তাদের ভাগ চায়।
সব ক্ষেত্রে ঢাকা নির্ভরতার নেতিবাচক দিক উঠে আসছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তথ্যেও। গত ডিসেম্বরে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর বার্ষিক সম্মেলনে বলা হয়, দেশের প্রায় ৮ শতাংশ চাকরিই ঢাকাকেন্দ্রিক। আর গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জসহ বৃহত্তর ঢাকায় রয়েছে দেশের ৪০ শতাংশ চাকরি। রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সার্বিকভাবে নগর উন্নয়নকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই ক্ষতির পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ থেকে ১০ শতাংশ।
লন্ডনভিত্তিক ম্যাগাজিন দা ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) গত জুনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের বাস অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার স্থান সপ্তম। বাসযোগ্য ১৭২ শহরের তালিকায় রাজধানী ঢাকার অবস্থান ১৬৬ তম।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মানুষকে জীবিকার জন্য কিছু না কিছু করে খেতে হবে। এ জন্য সবাই ঢাকামুখী হচ্ছে। কারণ দেশের সবকিছু দুটি শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে যে সেবাই পাওয়া যায় তার সবই ঢাকা কেন্দ্রিক। এতে বাড়তি মানুষ ম্যানেজ করার জন্য যে সেবা দরকার, অপরিকল্পিতভাবে সেগুলোর ব্যবস্থা করতে গিয়ে ঢাকা আবাস যোগ্যতা হারাচ্ছে। অন্য কোনা শহর বা এলাকা সেভাবে উন্নত হচ্ছে না। কারণ সেখানে সহায়ক অবকাঠামো নেই। শিল্প গড়ে ওঠার জন্য বন্দরের পাশাপাশি বিভিন্ন সেবা থাকতে হয়। এর একটি চট্টগ্রামে, অপরটি ঢাকায়। ফলে কোনো এলাকায় কেউ শিল্প করতে চাইলেও কর্মীদের সেখানে থাকার মতো সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে না। ফলে সবকিছু ঢাকা কেন্দ্রিকই হচ্ছে। এটা একটা চক্রের মতো।
চলতি শুমারির প্রতিবেদন বলছে, গত এক দশকে দেশে জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২ কোটি ১১ লাখ ১৫ হাজার। বৃদ্ধির হাত ১.২২ শতাংশ, যা গত ৫ দশকের মধ্যের সবচেয়ে কম। দেশের মোট জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪। আর নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬। প্রথমবারের মতো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দেশে হিজড়া রয়েছেন ১২ হাজার ৬২৯ জন।
জনসংখ্যা অনুপাতে সাক্ষরতার হার বেড়েছে। এক দশকে ৫১ দশমিক ৭৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ হয়েছে। যার মধ্যে অঞ্চলভেদে গ্রামাঞ্চলে ৭১ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ৮১ দশমিক ২৮ শতাংশ। অন্যদিকে নারী-পুরুষ লিঙ্গভিত্তিক বিবেচনায় পুরুষের সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ, নারী শিক্ষার হার ৭২ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং তৃতীয় লিঙ্গের সাক্ষরতার হার ৫৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
শুমারিতে দেখা গেছে, ৫ বছরের বেশি মানুষের ৫৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ মোবাইল ব্যবহার করে। ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৩৭ দশমিক ০১ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। পাঁচ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৩০ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
বৈবাহিক অবস্থার দিক দিয়ে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে গড়ে অবিবাহিত ২৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ। বিবাহিত ৬৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। বিধবা কিংবা বিপত্নীক ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। তালাকপ্রাপ্ত শূন্য দশমিক ৪২ শতাংশ। আলাদা থাকেন শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ।
মোট জনসংখ্যার মধ্যে গুটি কয়েক শহরেই বাস করে ৫ কোটি মানুষ। আর গ্রামে বাস করেন ১১ কোটি। দেশে মোট প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ২৩ লাখ ৬১ হাজার ৬০৪ জন। যা মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এর মধ্যে ১৩ লাখ ৩৪ হাজার ১০৫ জন পুরুষ, আর ১ লাখ ২৭ হাজার ৪৯৯ জন নারী। মোট বস্তিবাসী ১৮ লাখ ৪৮৬ জন, ভাসমান মানুষের সংখ্যা ২২ হাজার ১৮৫ জন। দেশে মোট পরিবারের সংখ্যা ৪ কোটি ১০ লাখ। ১.২৩ শতাংশ মানুষ টয়লেট ব্যবহার করে না। দশমিক ৭৫ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পায় না।
দেশে জনসংখ্যার ৯১ দশমিক ০৪ শতাংশ মুসলমান, ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ হিন্দু, দশমিক ৬২ শতাংশ বৌদ্ধ, দশমিক ৩০ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যান্য দশমিক ১২ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১১ সালে এই হার ছিল যথাক্রমে ৯০ দশমিক ৩৯ শতাংশ, ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ, দশমিক ৬২ শতাংশ, দশমিক ৩১ শতাংশ ও দশমিক ১৪ শতাংশ।
গতকাল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ এর প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ করা হয়। প্রথমবারের মতো ডিজিটাল পদ্ধতিতে স্মার্ট ট্যাবের মাধ্যমে তথ্য নেওয়া হয় এবং তা মাত্র এক মাসের ব্যবধানে প্রকাশ করা হয়। ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এতে সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। অনুষ্ঠানে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলমসহ বিবিএসের কর্মকর্তারা বক্তব্য রাখেন।
‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে, আরে লাল লাল নীল নীল বাত্তি দেইখ্যা নয়ন জুড়াইছে…’ ১৯৭৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘অশিক্ষিত’ নামের বাংলা সিনেমার তুমুল জনপ্রিয় গান। ৪৪ বছর আগের জনপ্রিয় সেই গানে গ্রাম থেকে আসা অশিক্ষিত নায়ক রাজ্জাক আর নায়িকা অঞ্জনাকে রঙিন ঢাকার রূপ দেখে বিমোহিত হতে দেখা যায়। তখনকার পথঘাট, দালানকোঠা, ঝাড়বাতি, গাড়িসহ সুন্দর নাগরিক জীবনের হাতছানি ছিল ওই গানে। রাজ্জাক-অঞ্জনা তখনকার ঢাকা শহরে এসে নিজেদের বদলে দেওয়ার মনোবাসনা প্রকাশ করেছিলেন!
সেই ঢাকা এখন আরও রঙিন, আরও উন্নত, বিচিত্র সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধার তিলোত্তমা মহানগরী। বলা যায়, অনেকটাই বদলে গেছে এর সবকিছু। কিন্তু চার দশক পরও গ্রাম থেকে বা দেশের অন্য শহর থেকে ঢাকায় মানুষ আসা থামেনি। বরং বেড়েছে কয়েক গুণ। আর এখানে ওই ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার মতো শুধু নিরক্ষর মানুষই আসছে না; ভাগ্য বদলের আশায়, জীবন বদলে দিতে, কাজের সন্ধানে শিক্ষিত মানুষেরও লম্বা মিছিল এই শহরে। আর এভাবে মানুষের ভাগ্য ফেরানোর অন্যতম আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে ঢাকা শহর।
গতকাল বুধবার প্রকাশিত সরকারের জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ কার্যক্রমের প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, দেশের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে শুধু ঢাকা জেলাতেই বাস ১ কোটি ৪৭ লাখ মানুষের। এর মধ্যে ঢাকা শহরে ১ কোটি ৩ লাখ। এক দশকে ঢাকায় মানুষ বেড়েছে ৩৩ লাখ ৮ হাজার। ঢাকা ও এর আশপাশের চার জেলায় জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৫৮ লাখ। এই শহর এবং আশপাশের ৪টি জেলা যে আসলে ডাল-ভাত সংস্থানের কেন্দ্র, তা বোঝা যায় প্রতি ঈদে বা যেকোনো উৎসবে। লাখ লাখ মানুষের ঢাকা ছাড়া ও ফিরে আসার চিত্রই বলে দেয় এ রঙিন ঢাকা ছাড়া আদতে তাদের কোনো গতি নেই।
প্রশ্ন উঠেছে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও দেশের সব অঞ্চলের মানুষ কেন শুধু ঢাকাতেই আসছে? তথ্য-উপাত্ত বলছে, আসলে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা। সরকারি অফিস-আদালত সবই ঢাকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের ২০১৩ সালের সবশেষ অর্থনৈতিক শুমারি বলছে, দেশের মোট অর্থনৈতিক স্থাপনার সংখ্যা ছিল ৭৮ লাখ ১৮ হাজার ৫৬৫টি। এর মধ্যে শুধু ঢাকা জেলায় এই সংখ্যা ৩৭ লাখ ১৬ হাজার ৮৪৮ টি। এর মধ্যে শহরে ২৪ লাখ ৫৬ হাজার ৯৪৮টি আর গ্রামে ১২ লাখ ৫৯ হাজার ৯০০টি। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ঢাকার আশপাশের জেলা ধরলে এই সংখ্যা আরও বড় হবে। অর্থনৈতিক স্থাপনার বেশির ভাগই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, পাইকারি ব্যবসা, গাড়ির গ্যারেজ, আবাসন, খাদ্য, পরিবহন, বিভিন্ন শিল্প-কারখানা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠান অন্যতম।
বোঝাই যাচ্ছে, সারা দেশে যেসব অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম হয়, তার সিংহভাগই হয় শুধু ঢাকা ঘিরে। বিবিএসের গতকালের ঘোষিত জনশুমারির ফলাফলেও সেই চিত্রই ধরা পড়েছে। তথ্য বলছে, ঘনত্বের বিচারে ঢাকা সবার ওপরে। দেশের প্রতি এক শ জনের ৯ জন বাস করে রাজধানী ঢাকায়। ঢাকার মধ্যে দক্ষিণ সিটিতে বাস করে ৪২ লাখ ৯৯ হাজার ৩৪৫ জন। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৯ হাজার ৩৫৩ জন, যা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ঘনত্ব। উত্তর সিটিতে ৫৯ লাখ ৭৯ হাজার ৫৩৭ জন মানুষের বাস, ঘনত্ব ৩০ হাজার ৪৭৪ জন। এক দশকে ঢাকায় মানুষ বেড়েছে ৩৩ লাখ ৮ হাজার জন।
রাজধানীমুখী মানুষের এ স্রোত ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকার আশপাশের চার জেলাতেও। গাজীপুরে বাস করে ৫২ লাখ ৬৩ হাজার ৪৭৪ জন, নারায়ণগঞ্জে ৩৯ লাখ ৯ হাজার ১৩৮ জন, নরসিংদীতে ২৫ লাখ ৮৪ হাজার মানুষের বাস। সব মিলিয়ে ঢাকার চার জেলাতে বাস করে ২ কোটি ৬৪ লাখ ৯১ হাজার মানুষ। যা দেশের মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশের বেশি। অথচ দেশে মানুষের গড় ঘনত্ব ১ হাজার ১১৯ জন।
গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট ও এশিয়ান ফাউন্ডেশনের অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছিলেন, সারা দেশের সম্পদের ভাগাভাগি ঢাকা শহরে হয়। গ্রামের মানুষ তাদের ভাগ চায়।
সব ক্ষেত্রে ঢাকা নির্ভরতার নেতিবাচক দিক উঠে আসছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তথ্যেও। গত ডিসেম্বরে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর বার্ষিক সম্মেলনে বলা হয়, দেশের প্রায় ৮ শতাংশ চাকরিই ঢাকাকেন্দ্রিক। আর গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জসহ বৃহত্তর ঢাকায় রয়েছে দেশের ৪০ শতাংশ চাকরি। রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সার্বিকভাবে নগর উন্নয়নকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই ক্ষতির পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ থেকে ১০ শতাংশ।
লন্ডনভিত্তিক ম্যাগাজিন দা ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) গত জুনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের বাস অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার স্থান সপ্তম। বাসযোগ্য ১৭২ শহরের তালিকায় রাজধানী ঢাকার অবস্থান ১৬৬ তম।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মানুষকে জীবিকার জন্য কিছু না কিছু করে খেতে হবে। এ জন্য সবাই ঢাকামুখী হচ্ছে। কারণ দেশের সবকিছু দুটি শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে যে সেবাই পাওয়া যায় তার সবই ঢাকা কেন্দ্রিক। এতে বাড়তি মানুষ ম্যানেজ করার জন্য যে সেবা দরকার, অপরিকল্পিতভাবে সেগুলোর ব্যবস্থা করতে গিয়ে ঢাকা আবাস যোগ্যতা হারাচ্ছে। অন্য কোনা শহর বা এলাকা সেভাবে উন্নত হচ্ছে না। কারণ সেখানে সহায়ক অবকাঠামো নেই। শিল্প গড়ে ওঠার জন্য বন্দরের পাশাপাশি বিভিন্ন সেবা থাকতে হয়। এর একটি চট্টগ্রামে, অপরটি ঢাকায়। ফলে কোনো এলাকায় কেউ শিল্প করতে চাইলেও কর্মীদের সেখানে থাকার মতো সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে না। ফলে সবকিছু ঢাকা কেন্দ্রিকই হচ্ছে। এটা একটা চক্রের মতো।
চলতি শুমারির প্রতিবেদন বলছে, গত এক দশকে দেশে জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২ কোটি ১১ লাখ ১৫ হাজার। বৃদ্ধির হাত ১.২২ শতাংশ, যা গত ৫ দশকের মধ্যের সবচেয়ে কম। দেশের মোট জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪। আর নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬। প্রথমবারের মতো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দেশে হিজড়া রয়েছেন ১২ হাজার ৬২৯ জন।
জনসংখ্যা অনুপাতে সাক্ষরতার হার বেড়েছে। এক দশকে ৫১ দশমিক ৭৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ হয়েছে। যার মধ্যে অঞ্চলভেদে গ্রামাঞ্চলে ৭১ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ৮১ দশমিক ২৮ শতাংশ। অন্যদিকে নারী-পুরুষ লিঙ্গভিত্তিক বিবেচনায় পুরুষের সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ, নারী শিক্ষার হার ৭২ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং তৃতীয় লিঙ্গের সাক্ষরতার হার ৫৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
শুমারিতে দেখা গেছে, ৫ বছরের বেশি মানুষের ৫৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ মোবাইল ব্যবহার করে। ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৩৭ দশমিক ০১ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। পাঁচ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৩০ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
বৈবাহিক অবস্থার দিক দিয়ে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে গড়ে অবিবাহিত ২৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ। বিবাহিত ৬৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। বিধবা কিংবা বিপত্নীক ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। তালাকপ্রাপ্ত শূন্য দশমিক ৪২ শতাংশ। আলাদা থাকেন শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ।
মোট জনসংখ্যার মধ্যে গুটি কয়েক শহরেই বাস করে ৫ কোটি মানুষ। আর গ্রামে বাস করেন ১১ কোটি। দেশে মোট প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ২৩ লাখ ৬১ হাজার ৬০৪ জন। যা মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এর মধ্যে ১৩ লাখ ৩৪ হাজার ১০৫ জন পুরুষ, আর ১ লাখ ২৭ হাজার ৪৯৯ জন নারী। মোট বস্তিবাসী ১৮ লাখ ৪৮৬ জন, ভাসমান মানুষের সংখ্যা ২২ হাজার ১৮৫ জন। দেশে মোট পরিবারের সংখ্যা ৪ কোটি ১০ লাখ। ১.২৩ শতাংশ মানুষ টয়লেট ব্যবহার করে না। দশমিক ৭৫ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পায় না।
দেশে জনসংখ্যার ৯১ দশমিক ০৪ শতাংশ মুসলমান, ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ হিন্দু, দশমিক ৬২ শতাংশ বৌদ্ধ, দশমিক ৩০ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যান্য দশমিক ১২ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১১ সালে এই হার ছিল যথাক্রমে ৯০ দশমিক ৩৯ শতাংশ, ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ, দশমিক ৬২ শতাংশ, দশমিক ৩১ শতাংশ ও দশমিক ১৪ শতাংশ।
গতকাল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ এর প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ করা হয়। প্রথমবারের মতো ডিজিটাল পদ্ধতিতে স্মার্ট ট্যাবের মাধ্যমে তথ্য নেওয়া হয় এবং তা মাত্র এক মাসের ব্যবধানে প্রকাশ করা হয়। ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এতে সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। অনুষ্ঠানে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলমসহ বিবিএসের কর্মকর্তারা বক্তব্য রাখেন।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে