বিদ্যুৎ সরকার
ফলের নির্যাস আস্বাদনে বাঙালি যতটা আগ্রহী, গাছের পরিচর্যায় ঠিক ততটা নয়। সে জন্যই বোধ হয়, নামমাত্র অনেক কিছুই বর্তমানের উদ্যাপন অনুষঙ্গ হিসেবে আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠলেও বিস্মৃতির অতলে ধীরে-ধীরে হারিয়ে যায় গৌরবময় অতীত ও তার স্রষ্টারা। হাতে গোনা কয়েকজনের ক্ষেত্রে ‘স্মরণ’ নামের আয়োজন কিছু আশা জাগায় বটে। কিন্তু বাদ থেকে যান এমন অনেকে, যাঁদের প্রতিভা ও প্রচেষ্টার স্বাক্ষর আজও বহন করে চলেছে বাঙালি জাতি। তেমনই এক প্রতিভার নাম কমল দাশগুপ্ত। বিস্মৃতপ্রায়। কিন্তু অদম্য সৃজনক্ষমতায় তিনি মিশে থাকেন আমাদের সুর সত্তায়, সংগীতায়োজনে—সর্বোপরি গানে-গানে। তাই ভুলতে ভুলতে আবার তাঁকে ঠিকই আমাদের মনে করতে হয়। খুঁজে নিতে হয় কমল দাশগুপ্তের ঠিকুজি; তাঁর জীবনের নানান উত্থান-পতন।
১৯১২ সালের ২৮ জুলাই জন্ম হয় কমল দাশগুপ্তের। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল নড়াইল জেলার কালিয়া থানার বেন্দা গ্রামে। তাঁর মায়ের নাম প্রমোদিনী দাশগুপ্ত। শৈশব থেকেই কমল দাশগুপ্ত পেয়েছিলেন সংগীতময় পরিবেশ। বাবা তারাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত ধ্রুপদে ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। কাকা কিরণ দাশগুপ্তের তবলাবাদক হিসেবে ছিল বেশ সুনাম। ছোট ভাই সুবল দাশগুপ্তও ছিলেন সুরস্রষ্টা, গায়ক। আর বড়দা বিমল দাশগুপ্ত, যিনি ১৯২২ সাল থেকে ওস্তাদ জমিরউদ্দিন খাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেন এবং সংগীত শিক্ষক হিসেবে গ্রামোফোন কোম্পানি লিমিটেডে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর কাছেই কমল দাশগুপ্তের সংগীতশিক্ষার হাতেখড়ি। বিমল দাশগুপ্ত তাঁকে মাঝে মাঝে কোম্পানির মহড়া কক্ষে নিয়ে যেতেন রেকর্ডের গানে কীভাবে সুর দেওয়া হয়, সে সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। এই নিয়ে যাওয়ার আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল। সে সময় জাদুকর হিসেবে বিমল দাশগুপ্তের ছিল বেশ নামডাক। বাবার মৃত্যুর পর পুরো সংসারের দায়িত্ব পড়ে তাঁর ওপর। তাই অর্থের প্রয়োজনে অনেক সময় রেকর্ডিং থাকলেও জাদু দেখানোর জন্য তাঁকে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেতে হতো। বড়দার এই অনুপস্থিতিতে গানে সুর দিতেন কমল দাশগুপ্ত। এমনকি শিল্পীদের সেই গান তুলিয়েও দিতেন তিনি। এভাবেই তাঁর সুরসৃষ্টির জগতে প্রবেশ।
কমল দাশগুপ্তের সুরে প্রথম রেকর্ড বের হয় ১৯৩২ সালের এপ্রিল মাসে। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে ‘মাস্টার কমল’ নামে তাঁর নিজের লেখা ও সুরে গাওয়া রেকর্ড বের হয়। কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘বলেছিলে তুমি তীর্থে আসিবে’, ‘তুমি হাতখানি যবে রাখো মোর’, ‘গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়’ গানগুলো তাঁর সুর করা ও গাওয়া। অর্থাৎ, চাইলে তিনি গীতিকার কিংবা কণ্ঠশিল্পীও হতে পারতেন। কিন্তু তিনি উপলব্ধি করেছিলেন সুর সৃজনেই তাঁর সাবলীলতা। সুরের মাধ্যমেই তিনি নিজেকে সবচেয়ে বেশি প্রকাশ করতে সক্ষম। ফলে কমল দাশগুপ্তের সুর করা অসংখ্য গান এখনো সংগীতানুরাগী বাঙালি গুনগুন করে গায়। তাঁর কালজয়ী গানগুলোর মধ্য রয়েছে ‘এমনই বরষা ছিল সেদিন’, ‘সাঁঝের তারকা আমি পথ হারায়ে’, ‘মেনেছি গো হার মেনেছি’, ‘তুমি কি এখন দেখিছ স্বপন’, ‘ভুলি নাই ভুলি নাই’, ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে’, ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়’, ‘জেগে আছি একা জেগে আছি কারাগারে’, ‘পৃথিবী আমারে চায়’, ‘দুটি পাখি দুটি তীরে’, ‘ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখে’, ‘এই কি গো শেষ দান’, ‘সেদিন নিশীথে বরিষন শেষে’।
কমল দাশগুপ্ত সেই বিরলপ্রজ শিল্পীদের একজন, যাঁদের নিজের প্রতিভা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস থাকে তুঙ্গে। তাঁর সুর কালোত্তীর্ণ বলেই ‘কত দিন দেখিনি তোমায়’ গানটি ১৯৮৪ সালে এসে মান্না দে পুনরায় রেকর্ড করেন, যা শ্রোতারা এখনো তন্ময় হয়ে শোনে। বলা জরুরি, প্রণব রায়ের লেখা গানটির মূল শিল্পী কিন্তু কমল দাশগুপ্ত নিজেই। কিংবা বলা যায় কুমার শানুর গাওয়া ‘এই কি গো শেষ দান’ গানের কথা। তাঁর সুর করা এ রকম অসংখ্য গান এখনো শিল্পীরা নতুনভাবে রেকর্ড করে চলেছেন। সুরের সজীবতা না থাকলে এত বছর পরও সেসব গান আবার রেকর্ড করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতো না।
কমল দাশগুপ্তের সুর দক্ষতার প্রতি কাজী নজরুল ইসলামের ছিল অগাধ বিশ্বাস। তাই আধুনিক গানের এই অসামান্য গীতিকার নিজের লেখা গানের খাতা অবলীলায় তাঁর কাছে দিয়ে দিতেন সুর করার জন্য। কমল দাশগুপ্তও সে বিশ্বাসের প্রতিদান দিতেন শ্রুতিমধুর, অবিস্মরণীয় সব সুর সৃষ্টির মাধ্যমে। আর সে কারণেই নজরুল ইসলাম বাদে সবচেয়ে বেশি নজরুল সংগীতের সুরকার কমল দাশগুপ্ত। ‘আমার ভুবন কান পেতে রয়’, ‘আমি যার নূপুরের ছন্দ’, ‘ওরে নীল যমুনার জল’, ‘মোর না মিটিতে আশা’, ‘যবে তুলসীতলায় প্রিয় সন্ধ্যাবেলায়’, ‘সাঁঝের পাখিরা ফিরিল কুলায়’, ‘আসিল রে প্রিয় আসিল রে’, ‘মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে’ ইত্যাদি অসংখ্য অবিস্মরণীয় নজরুলগীতির সুরস্রষ্টা তিনি। তবে শুধু নজরুলগীতি কিংবা বেসিক গান নয়, অসংখ্য সিনেমায় সংগীত পরিচালক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের পুরস্কার। এর মধ্যে বিশেষভাবে স্মরণ করা যায় ‘গরমিল’, ‘দম্পতি’, ‘শেষ উত্তর’, ‘যোগাযোগ’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রের কথা। ‘শেষ উত্তর’ সিনেমায় নায়িকা-গায়িকা কানন দেবীর গাওয়া ‘আমি বনফুল গো’, ‘লাগুক দোলা’, ‘যদি আপনার মনের মাধুরী মিশায়ে’ ইত্যাদি গানের সুর এখনো শ্রোতাদের হৃদয়স্পর্শী।
ধারণা করা হয়, প্রায় সাত হাজার গানে কমল দাশগুপ্ত সুরারোপ করেছেন। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে যূথিকা রায়, জগন্ময় মিত্র, সত্য চৌধুরী, রবীন মজুমদার, কানন দেবী, ফিরোজা বেগম, তালাত মাহমুদ, সন্তোষ সেনগুপ্ত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীরা তাঁর সুরারোপিত গানে কণ্ঠ দিতে পেরে নিজেদের ধন্য মনে করেছেন। গানের কথার মর্ম অনুধাবন করে সুর সৃজনের অসামান্য ক্ষমতা ছিল কমল দাশগুপ্তের। তা ছাড়া কোন সুর কোন শিল্পীর কণ্ঠে বেশি মানাবে, সে সম্পর্কে তাঁর ছিল খুব স্বচ্ছ ধারণা। কথা ও সুর অনুযায়ী ইন্টারল্যুড-প্রিলিউড সৃজনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। ফলে একটানা কাজ করে গেলেও তাঁর সুর সৃষ্টিতে কোনো ক্লিষ্টতার ছাপ পড়েনি।
এমনই যার সৃজনক্ষমতা, তাঁর জীবনের শেষাংশের দিনগুলো মোটেও সুখকর ছিল না। চল্লিশের দশকের টালমাটাল বৈশ্বিক ও দৈশিক পরিস্থিতির কারণে কমল দাশগুপ্তের জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। যে ব্যাংকে তিনি সারা জীবনের আয় গচ্ছিত রেখেছিলেন, সেই নাথ ব্যাংক (সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ বইয়ে বলছেন পাইওনিয়ার ব্যাংক) দেউলিয়া হয়ে যায়। কয়েক বছরের মধ্যে মা ও ছোট ভাই সুবল দাশগুপ্তকেও হারান তিনি। একদিকে প্রিয়জন হারানোর বেদনা, অন্যদিকে চরম অর্থকষ্ট—সব মিলিয়ে কমল দাশগুপ্ত মানসিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। এ রকম চরম দুর্দিনে এইচএমভিও তাঁর সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করে।
দুর্ভাগ্যপীড়িত, আশাহত, নিঃসম্বল কমল দাশগুপ্ত এ সময় জীবনসঙ্গী হিসেবে পান ফিরোজা বেগমকে। ১৯৫৫ সালে তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এর চার বছর পর ধর্মান্তরিত হলে তাঁর নাম হয় কাজী কামালউদ্দিন। চরম আর্থিক দৈন্য ও প্রাপ্য সম্মান না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসতে বাধ্য হন কমল দাশগুপ্ত। কিন্তু তাতেও তাঁর দুঃখ-বেদনা এতটুকু কমেনি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সংগীতজগতে কোথাও তাঁকে এতটুকু স্থান দেওয়া হয়নি। কলকাতা-ঢাকা দুই জায়গাতেই তিনি শেষ জীবনে চরম উপেক্ষা ও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। অর্থকষ্ট থেকে মুক্তির জন্য শেষ জীবনে মুদি দোকানও দিয়েছিলেন তিনি। ভাবতে অবাক লাগে, যে কমল দাশগুপ্ত ১৯৪৬ সালে আয়কর হিসেবে দিয়েছিলেন ৩৭ হাজার টাকা, চড়তেন দামি গাড়ি; শেষ জীবনে হাসপাতালে একটা বেডও জোটেনি তাঁর কপালে। চরম অবহেলায় ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই মারা যান তিনি।
শেষ করছি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা দিয়ে, ‘কাজী নজরুল ইসলামের পর যদি বাংলা গানের বাণিজ্যিক খতিয়ান নেওয়া হয়, তাহলে সর্বাগ্রে আসা উচিত কমল দাশগুপ্তর নাম। সে যুগে হিট আধুনিক গানের সুরকার বললেই বোঝাত কমল দাশগুপ্ত।’ বাংলা গানে এমনই যার অবদান, তাঁর প্রাপ্য সম্মান কি আমরা আজও দিতে পেরেছি?
ফলের নির্যাস আস্বাদনে বাঙালি যতটা আগ্রহী, গাছের পরিচর্যায় ঠিক ততটা নয়। সে জন্যই বোধ হয়, নামমাত্র অনেক কিছুই বর্তমানের উদ্যাপন অনুষঙ্গ হিসেবে আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠলেও বিস্মৃতির অতলে ধীরে-ধীরে হারিয়ে যায় গৌরবময় অতীত ও তার স্রষ্টারা। হাতে গোনা কয়েকজনের ক্ষেত্রে ‘স্মরণ’ নামের আয়োজন কিছু আশা জাগায় বটে। কিন্তু বাদ থেকে যান এমন অনেকে, যাঁদের প্রতিভা ও প্রচেষ্টার স্বাক্ষর আজও বহন করে চলেছে বাঙালি জাতি। তেমনই এক প্রতিভার নাম কমল দাশগুপ্ত। বিস্মৃতপ্রায়। কিন্তু অদম্য সৃজনক্ষমতায় তিনি মিশে থাকেন আমাদের সুর সত্তায়, সংগীতায়োজনে—সর্বোপরি গানে-গানে। তাই ভুলতে ভুলতে আবার তাঁকে ঠিকই আমাদের মনে করতে হয়। খুঁজে নিতে হয় কমল দাশগুপ্তের ঠিকুজি; তাঁর জীবনের নানান উত্থান-পতন।
১৯১২ সালের ২৮ জুলাই জন্ম হয় কমল দাশগুপ্তের। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল নড়াইল জেলার কালিয়া থানার বেন্দা গ্রামে। তাঁর মায়ের নাম প্রমোদিনী দাশগুপ্ত। শৈশব থেকেই কমল দাশগুপ্ত পেয়েছিলেন সংগীতময় পরিবেশ। বাবা তারাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত ধ্রুপদে ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। কাকা কিরণ দাশগুপ্তের তবলাবাদক হিসেবে ছিল বেশ সুনাম। ছোট ভাই সুবল দাশগুপ্তও ছিলেন সুরস্রষ্টা, গায়ক। আর বড়দা বিমল দাশগুপ্ত, যিনি ১৯২২ সাল থেকে ওস্তাদ জমিরউদ্দিন খাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেন এবং সংগীত শিক্ষক হিসেবে গ্রামোফোন কোম্পানি লিমিটেডে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর কাছেই কমল দাশগুপ্তের সংগীতশিক্ষার হাতেখড়ি। বিমল দাশগুপ্ত তাঁকে মাঝে মাঝে কোম্পানির মহড়া কক্ষে নিয়ে যেতেন রেকর্ডের গানে কীভাবে সুর দেওয়া হয়, সে সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। এই নিয়ে যাওয়ার আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল। সে সময় জাদুকর হিসেবে বিমল দাশগুপ্তের ছিল বেশ নামডাক। বাবার মৃত্যুর পর পুরো সংসারের দায়িত্ব পড়ে তাঁর ওপর। তাই অর্থের প্রয়োজনে অনেক সময় রেকর্ডিং থাকলেও জাদু দেখানোর জন্য তাঁকে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেতে হতো। বড়দার এই অনুপস্থিতিতে গানে সুর দিতেন কমল দাশগুপ্ত। এমনকি শিল্পীদের সেই গান তুলিয়েও দিতেন তিনি। এভাবেই তাঁর সুরসৃষ্টির জগতে প্রবেশ।
কমল দাশগুপ্তের সুরে প্রথম রেকর্ড বের হয় ১৯৩২ সালের এপ্রিল মাসে। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে ‘মাস্টার কমল’ নামে তাঁর নিজের লেখা ও সুরে গাওয়া রেকর্ড বের হয়। কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘বলেছিলে তুমি তীর্থে আসিবে’, ‘তুমি হাতখানি যবে রাখো মোর’, ‘গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়’ গানগুলো তাঁর সুর করা ও গাওয়া। অর্থাৎ, চাইলে তিনি গীতিকার কিংবা কণ্ঠশিল্পীও হতে পারতেন। কিন্তু তিনি উপলব্ধি করেছিলেন সুর সৃজনেই তাঁর সাবলীলতা। সুরের মাধ্যমেই তিনি নিজেকে সবচেয়ে বেশি প্রকাশ করতে সক্ষম। ফলে কমল দাশগুপ্তের সুর করা অসংখ্য গান এখনো সংগীতানুরাগী বাঙালি গুনগুন করে গায়। তাঁর কালজয়ী গানগুলোর মধ্য রয়েছে ‘এমনই বরষা ছিল সেদিন’, ‘সাঁঝের তারকা আমি পথ হারায়ে’, ‘মেনেছি গো হার মেনেছি’, ‘তুমি কি এখন দেখিছ স্বপন’, ‘ভুলি নাই ভুলি নাই’, ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে’, ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়’, ‘জেগে আছি একা জেগে আছি কারাগারে’, ‘পৃথিবী আমারে চায়’, ‘দুটি পাখি দুটি তীরে’, ‘ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখে’, ‘এই কি গো শেষ দান’, ‘সেদিন নিশীথে বরিষন শেষে’।
কমল দাশগুপ্ত সেই বিরলপ্রজ শিল্পীদের একজন, যাঁদের নিজের প্রতিভা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস থাকে তুঙ্গে। তাঁর সুর কালোত্তীর্ণ বলেই ‘কত দিন দেখিনি তোমায়’ গানটি ১৯৮৪ সালে এসে মান্না দে পুনরায় রেকর্ড করেন, যা শ্রোতারা এখনো তন্ময় হয়ে শোনে। বলা জরুরি, প্রণব রায়ের লেখা গানটির মূল শিল্পী কিন্তু কমল দাশগুপ্ত নিজেই। কিংবা বলা যায় কুমার শানুর গাওয়া ‘এই কি গো শেষ দান’ গানের কথা। তাঁর সুর করা এ রকম অসংখ্য গান এখনো শিল্পীরা নতুনভাবে রেকর্ড করে চলেছেন। সুরের সজীবতা না থাকলে এত বছর পরও সেসব গান আবার রেকর্ড করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতো না।
কমল দাশগুপ্তের সুর দক্ষতার প্রতি কাজী নজরুল ইসলামের ছিল অগাধ বিশ্বাস। তাই আধুনিক গানের এই অসামান্য গীতিকার নিজের লেখা গানের খাতা অবলীলায় তাঁর কাছে দিয়ে দিতেন সুর করার জন্য। কমল দাশগুপ্তও সে বিশ্বাসের প্রতিদান দিতেন শ্রুতিমধুর, অবিস্মরণীয় সব সুর সৃষ্টির মাধ্যমে। আর সে কারণেই নজরুল ইসলাম বাদে সবচেয়ে বেশি নজরুল সংগীতের সুরকার কমল দাশগুপ্ত। ‘আমার ভুবন কান পেতে রয়’, ‘আমি যার নূপুরের ছন্দ’, ‘ওরে নীল যমুনার জল’, ‘মোর না মিটিতে আশা’, ‘যবে তুলসীতলায় প্রিয় সন্ধ্যাবেলায়’, ‘সাঁঝের পাখিরা ফিরিল কুলায়’, ‘আসিল রে প্রিয় আসিল রে’, ‘মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে’ ইত্যাদি অসংখ্য অবিস্মরণীয় নজরুলগীতির সুরস্রষ্টা তিনি। তবে শুধু নজরুলগীতি কিংবা বেসিক গান নয়, অসংখ্য সিনেমায় সংগীত পরিচালক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের পুরস্কার। এর মধ্যে বিশেষভাবে স্মরণ করা যায় ‘গরমিল’, ‘দম্পতি’, ‘শেষ উত্তর’, ‘যোগাযোগ’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রের কথা। ‘শেষ উত্তর’ সিনেমায় নায়িকা-গায়িকা কানন দেবীর গাওয়া ‘আমি বনফুল গো’, ‘লাগুক দোলা’, ‘যদি আপনার মনের মাধুরী মিশায়ে’ ইত্যাদি গানের সুর এখনো শ্রোতাদের হৃদয়স্পর্শী।
ধারণা করা হয়, প্রায় সাত হাজার গানে কমল দাশগুপ্ত সুরারোপ করেছেন। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে যূথিকা রায়, জগন্ময় মিত্র, সত্য চৌধুরী, রবীন মজুমদার, কানন দেবী, ফিরোজা বেগম, তালাত মাহমুদ, সন্তোষ সেনগুপ্ত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীরা তাঁর সুরারোপিত গানে কণ্ঠ দিতে পেরে নিজেদের ধন্য মনে করেছেন। গানের কথার মর্ম অনুধাবন করে সুর সৃজনের অসামান্য ক্ষমতা ছিল কমল দাশগুপ্তের। তা ছাড়া কোন সুর কোন শিল্পীর কণ্ঠে বেশি মানাবে, সে সম্পর্কে তাঁর ছিল খুব স্বচ্ছ ধারণা। কথা ও সুর অনুযায়ী ইন্টারল্যুড-প্রিলিউড সৃজনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। ফলে একটানা কাজ করে গেলেও তাঁর সুর সৃষ্টিতে কোনো ক্লিষ্টতার ছাপ পড়েনি।
এমনই যার সৃজনক্ষমতা, তাঁর জীবনের শেষাংশের দিনগুলো মোটেও সুখকর ছিল না। চল্লিশের দশকের টালমাটাল বৈশ্বিক ও দৈশিক পরিস্থিতির কারণে কমল দাশগুপ্তের জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। যে ব্যাংকে তিনি সারা জীবনের আয় গচ্ছিত রেখেছিলেন, সেই নাথ ব্যাংক (সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ বইয়ে বলছেন পাইওনিয়ার ব্যাংক) দেউলিয়া হয়ে যায়। কয়েক বছরের মধ্যে মা ও ছোট ভাই সুবল দাশগুপ্তকেও হারান তিনি। একদিকে প্রিয়জন হারানোর বেদনা, অন্যদিকে চরম অর্থকষ্ট—সব মিলিয়ে কমল দাশগুপ্ত মানসিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। এ রকম চরম দুর্দিনে এইচএমভিও তাঁর সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করে।
দুর্ভাগ্যপীড়িত, আশাহত, নিঃসম্বল কমল দাশগুপ্ত এ সময় জীবনসঙ্গী হিসেবে পান ফিরোজা বেগমকে। ১৯৫৫ সালে তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এর চার বছর পর ধর্মান্তরিত হলে তাঁর নাম হয় কাজী কামালউদ্দিন। চরম আর্থিক দৈন্য ও প্রাপ্য সম্মান না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসতে বাধ্য হন কমল দাশগুপ্ত। কিন্তু তাতেও তাঁর দুঃখ-বেদনা এতটুকু কমেনি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সংগীতজগতে কোথাও তাঁকে এতটুকু স্থান দেওয়া হয়নি। কলকাতা-ঢাকা দুই জায়গাতেই তিনি শেষ জীবনে চরম উপেক্ষা ও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। অর্থকষ্ট থেকে মুক্তির জন্য শেষ জীবনে মুদি দোকানও দিয়েছিলেন তিনি। ভাবতে অবাক লাগে, যে কমল দাশগুপ্ত ১৯৪৬ সালে আয়কর হিসেবে দিয়েছিলেন ৩৭ হাজার টাকা, চড়তেন দামি গাড়ি; শেষ জীবনে হাসপাতালে একটা বেডও জোটেনি তাঁর কপালে। চরম অবহেলায় ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই মারা যান তিনি।
শেষ করছি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা দিয়ে, ‘কাজী নজরুল ইসলামের পর যদি বাংলা গানের বাণিজ্যিক খতিয়ান নেওয়া হয়, তাহলে সর্বাগ্রে আসা উচিত কমল দাশগুপ্তর নাম। সে যুগে হিট আধুনিক গানের সুরকার বললেই বোঝাত কমল দাশগুপ্ত।’ বাংলা গানে এমনই যার অবদান, তাঁর প্রাপ্য সম্মান কি আমরা আজও দিতে পেরেছি?
ভারতে এক জুনিয়র আইনজীবীর ওভারটাইম কাজের পরদিন অফিসে দেরিতে হবে জানিয়ে একটি বার্তা পাঠান সিনিয়র আইনজীবীকে। বার্তাটি সহজভাবে নেননি সিনিয়র আইনজীবী। তিনি প্রকাশ্য জুনিয়র আইনজীবীর সমালোচনা করেছেন। এতে দেশটিতে কর্মস্থলের সংস্কৃতি নিয়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে।
৮ ঘণ্টা আগেচলতি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সিডনি, মেলবোর্ন ও অ্যাডিলেডে কয়েকটি কনসার্ট করেছেন। ফিরেই ব্যস্ত হয়েছেন দেশের মঞ্চে। ১৫ নভেম্বর সেনা প্রাঙ্গণে গেয়েছেন ‘ঢাকা রেট্রো’ কনসার্টে। এবার জেমস জানালেন নতুন খবর।
১১ ঘণ্টা আগেচার দশকের বেশি সময় ধরে সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন আমির খান। মনপ্রাণ দিয়ে এত দিন শুধু কাজই করে গেছেন মিস্টার পারফেকশনিস্ট। কাজের ব্যস্ততায় পরিবারের দিকে খেয়াল রাখার তেমন সুযোগ পাননি। ফলে সন্তানদের সঙ্গে তাঁর এক ধরনের দূরত্ব রয়ে গেছে। এই দূরত্ব দূর করতে উদ্যোগী হয়েছেন আমিরকন্যা ইরা খান। বাবাকে নিয়ে মানস
১১ ঘণ্টা আগেসত্যজিৎ রায়, ‘পথের পাঁচালী’, অপু ও দুর্গা—যেন ইতিহাসের একই সুতোয় বাঁধা। সত্যজিৎ রায় যেমন মনে গেঁথে আছে সিনেমাপ্রেমী মানুষের মনে, তেমনি আছে কিশোরী দুর্গা। সেই কিশোরী চরিত্রটিতে যিনি অভিনয় করেছিলেন তিনি উমা। পুরো নাম উমা দাশগুপ্ত। ওই একটি মাত্র সিনেমাতেই অভিনয় করেছিলেন তিনি, আর তাতেই পেয়েছেন জগৎজোড়া..
১৫ ঘণ্টা আগে