গুঞ্জন রহমান
হ্যাপী আখান্দ্ (জিয়া হাসান আখন্দ্ হ্যাপী, ১২ অক্টোবর ১৯৬০-২৮ ডিসেম্বর ১৯৮৭) নামটা আমি প্রথম শুনি ফিডব্যাকের ‘মেলা’ অ্যালবামে। সেই অ্যালবামে পালকি শিরোনামে একটা গান আছে, যেটা আসলে হ্যাপী আখান্দ্কে নিয়ে লেখা। গানের শুরুতে ছোট্ট একটি সংলাপ আছে, যা থেকে জানা যায়, হ্যাপী আখান্দের অকালপ্রয়াণের কষ্ট থেকেই তাঁর সহকর্মী, গুণমুগ্ধ বন্ধুরা এই গান করছেন তাঁকে উৎসর্গ করে। ‘...শিল্পীর মৃত্যু নেই। আমাদের বিশ্বাস হ্যাপী আখান্দের মৃত্যু নেই। অন্য সুরের ভুবনে বর বেশে এ যেন হ্যাপীর পালকি চড়ে মহাপ্রস্থান! কানে এখনো বাজে, তার শেষ যাওয়ার সুর...’—এভাবে হ্যাপীর কথা বলেছিলেন ফিডব্যাক ব্যান্ডে তাঁর সহকর্মী বন্ধুরা।
নামটা দেরিতে শুনলেও তাঁর গান অনেক আগেই শোনা হয়ে গিয়েছিল সিনেমার বদৌলতে। আমার আব্বু-আম্মু সিনেমাপাগল মানুষ ছিলেন। নতুন সিনেমা এলেই সিনেমা হলে গিয়ে দেখতেন তাঁরা। ছোটকালে বাবা-মায়ের সঙ্গে আমিও সাথ ধরতাম। তখনই প্রথম ‘ঘুড্ডি’ ছবিতে শুনি ‘কে বাঁশি বাজায় রে’। কিন্তু, সেই সময়ের যা রীতি, নায়ক-নায়িকা আর প্রধান চরিত্রগুলো ছাড়া বাকি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের খোঁজ কে রাখে? তাই নায়িকার ভাইয়ের চরিত্র রূপায়ণকারী, যে গিটার বাজিয়ে বোনকে গান শোনাতে শোনাতে গেয়ে ফেলে এক কালজয়ী গানের মুখটুকু, ওই শিল্পীই যে তুমুল আলোচিত হ্যাপী আখান্দ্, তা তখন কীভাবে জানব? খুব সম্ভবত তখনো আমি সেভাবে পড়তে শিখিনি। তাই সিনেমার স্ক্রিনে হ্যাপী আখান্দের নাম পড়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। আর সিনেমায় দেখারও আগে, ওই সিনেমারই আরেক সুপার হিট গান ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ পিকনিক সং হিসেবে সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল। তখন ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ ছাড়া বন্ধুদের আড্ডা অকল্পনীয়। ‘কে বাঁশি বাজায় রে’ হ্যাপীর নিজেরই লেখা ও সুর করা। ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ অবশ্য তাঁর লেখা বা সুর করা নয়, এর গীতিকার এস এম হেদায়েত এবং সুরকার লাকী আখান্দ। কিন্তু গানটা নির্মিত হয় হ্যাপী আখান্দের সংগীতায়োজনে। গাওয়ার সময় হ্যাপী ও লাকী দুই ভাই-ই গেয়েছেন একসঙ্গে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ১৯৭৫ সালে এই গান তাঁর সংগীত পরিচালনায় পরিবেশিত হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনে। বিটিভির তৎকালীন প্রযোজক ও পরবর্তীতে পরিচালক সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকি সেই পরিবেশনা শুনে মুগ্ধ হন। তাই যখন তিনি ‘ঘুড্ডি’ ছবিটি তৈরি করতে শুরু করেন, ছবির সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব দেন লাকী আখান্দকে; অবশ্যই ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানটিসহ।
হ্যাপীর রেকর্ড করা গানের সংখ্যা কিন্তু খুব বেশি নয়। মাত্র ২৭ বছরের ক্যারিয়ারে পাঁচ-ছয়টি গানের বেশি রেকর্ড তিনি করতে পারেননি। পারার কথাও নয়। এখনকার মতো তখন গান প্রকাশের এত মাধ্যম যেমন ছিল না, তেমনি ছিল না রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থাও। হাতে গোনা অল্প কয়েকটি স্টুডিও, যেখানে সিনেমা, টিভি, রেডিও, রেকর্ড—সব মাধ্যমের জন্য রেকর্ডিং চলছে অবিরাম। এত এত গুণী মিউজিশিয়ানের মাঝে সময় বের করে নিজেদের একটা শিফট নিতে পারা চাট্টিখানি কথা নয়। এই ভিড় ঠেলে কোনো শিল্পীরই পর্যাপ্ত গান তখন রেকর্ড করা যেত না।
বড় ভাই লাকী তখন পুরোদস্তুর সংগীত পরিচালক। তিনি বিটিভির নিয়মিত তালিকাভুক্ত শিল্পী ও সংগীত পরিচালক, সিনেমাতেও ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, রেডিও তো আছেই। নিজের গান করার চেয়ে লাকী বরং অন্য শিল্পীদের জন্যই গান করেন বেশি। বড় ভাইকে দেখে সেই চর্চাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেলেন হ্যাপী। তিনিও নিজে গাওয়ার চেয়ে অন্যদের গান কম্পোজ করতেই বেশি মনোযোগী হলেন। তাঁর সংগীতায়োজনে সবচেয়ে বেশি গান করেছেন ফিরোজ সাঁই। সাঁইজির বিখ্যাত মাইজভান্ডারি ক্ল্যাসিক গান—‘ইশকুল খুইলাছে রে মওলা’র সংগীতায়োজন হ্যাপীর করা। ফেরদৌস ওয়াহিদের বিখ্যাত ‘এমন একটা মা দে না’ গানেরও সংগীত পরিচালক হ্যাপী আখান্দ। এভাবে অনেক শিল্পীর অনেক বিখ্যাত গান তিনি করেছেন। আরেকটি গানের কথা মনে পড়ছে, সোলস ব্যান্ডের তৎকালীন লিড ভোকালিস্ট কুমার বিশ্বজিতের জন্য তিনি কম্পোজ করেছিলেন ‘তোকে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’ গানটি। পরে অবশ্য বিশ্বজিৎ সেই গানটি তাঁর নিজের সলো অ্যালবামে প্রকাশ করেন। সোলসও বহুদিন গানটি স্টেজে পারফর্ম করেছে।
হ্যাপীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছিলেন তাঁর সমবয়সী ব্যান্ড তারকা মাকসুদুল হক, যিনি শুরুতে বলা পালকি গানটি সৃষ্টি করেছিলেন হ্যাপীর স্মৃতির উদ্দেশে। ইউটিউব আবিষ্কারেরও অনেক আগে একটি ভিডিও দেখেছিলাম এক সাইটে, এখন সেটি আর খুঁজে পেলাম না কোথাও। সেই ভিডিওতে মাকসুদ হ্যাপীর ইন্টারকনে পিয়ানো বাজানোর ঘটনা স্মরণ করেন। হোটেল ইন্টারকনের অধুনালুপ্ত চাম্বেলি হাউসে একটি গ্র্যান্ড পিয়ানো ছিল, যা সাধারণত ইন্টারকনের কমিশন্ড মিউজিশিয়ান এবং বিদেশি অতিথিদের কেউ বাজাতে পারতেন, সর্বসাধারণের সেই পিয়ানো বাজানোর অনুমতি নেই।
ফিডব্যাক তখন ইন্টারকনের রেসিডেন্ট ব্যান্ড হিসেবে নিয়মিত বাজায়। হ্যাপীর প্রতিষ্ঠা করা মাইলস ব্যান্ডও এনলিস্ট হয়েছে। তাই বলে সেই হাইলি ডিস্টিংগুইশড গ্র্যান্ড পিয়ানোতে হাত দেওয়ার অনুমতি এঁদের কারও নেই। কিন্তু সেটা মানতে পারতেন না সদ্য কৈশোর পেরোনো হ্যাপী। প্রায়ই তিনি বলতেন, একদিন আমি ওই পিয়ানো বাজাবই। এবং সত্যিই তিনি একদিন বসে গেলেন কাছেপিঠে কেউ নেই দেখে। মাকসুদ বলছেন, ‘আমি তাকে বাধা দেওয়ার আগেই সে এগিয়ে গেল এবং বসে পড়ল পিয়ানোর সামনে। স্ট্যান্ডে একটা খাতা ছিল, স্টাফ নোটেশন লেখা। সেটা খুলেই হ্যাপী বাজাতে শুরু করল।’ এর পর যা হলো, তা অভাবনীয়। প্রথম কিছুক্ষণ কেউ খেয়াল করল না, কে বাজাচ্ছে, কারণ এতটাই নিখুঁত ছিল সে বাজনা যে, কারও সন্দেহ হয়নি যে, নিয়মিত পিয়ানো বাদকের বাইরে অন্য কেউ বাজাচ্ছে। কিন্তু একটু পরই যখন বাজনা শুনে লোকজন জড়ো হতে শুরু করল, তখন কর্তৃপক্ষের টনক নড়ল। কিন্তু তারা কেউ হ্যাপীকে থামাতে গেলেন না। কারণ, ততক্ষণে সমঝদার শ্রোতারা তন্ময় হয়ে গেছেন হ্যাপির বাদনে। বয়স্ক এক বিদেশি ভদ্রলোক মাকসুদের কাছে জানতে চাইলেন, ‘যে ছেলেটি বাজাচ্ছে, তুমি কি তাকে চেনো?’ মাকসুদ ‘হ্যাঁ’ বলতেই, তিনি বললেন, ‘অনেক বছরের সাধনা ছাড়া গ্র্যান্ড পিয়ানোর রিডে এভাবে আঙুল চালানো যায় না।’ মাকসুদ তাঁকে বললেন যে, ‘ওর নাম হ্যাপী এবং ও আজই প্রথম গ্র্যান্ড পিয়ানোতে হাত দিল। এর আগে সে কিবোর্ড বাজিয়েছে। কিন্তু অরিজিনাল পিয়ানো বলতে যা বোঝায়, মানে এখন যেটা বাজাচ্ছে, সেটাতে হাত দেওয়ার সুযোগ তার কোনো দিন হয়নি!’ বলাই বাহুল্য, সেই বিদেশি বিশ্বাস করলেন না। কারণ, স্টাফ নোটেশন দেখে দেখে হ্যাপী তাঁর সুনিপুণ হাতে বাজাচ্ছিলেন কোনো কালজয়ী শিল্পীর অমর সৃষ্টি (মাকসুদ বলেছিলেন সেটি কোনো বিখ্যাত সুরস্রষ্টার সৃষ্টিকর্ম, এত দিন পর আমার এখন তা মনে পড়ছে না)।
হ্যাপী মাত্র ১২ বছর বয়সে যোগ দেন ‘উইন্ডি সাইড অব কেয়ার’ নামক বাংলাদেশের প্রথম ব্যান্ডে। এই ব্যান্ড সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তান আমলে, পাকিস্তানিদেরই হাতে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে সেই ব্যান্ডের বাংলাদেশি সদস্যদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তাকে আবারও গড়ে তোলেন হ্যাপী। সেই সময়ে বড় ভাই লাকীর সঙ্গে কলকাতার এইচএমভি স্টুডিওতে রেকর্ডিংয়ে অংশ নেন হ্যাপী। মাত্র ১২ বছর বয়সে। তিনি সেখানে তবলা বাজিয়েছিলেন। তবলার শুধু বাঁয়া বা ডুগি ব্যবহার করে তিনি ড্রামবিট দিচ্ছিলেন, যার অভিনব কায়দায় অবাক হয়ে রেকর্ডিং চলার সময়েই রেকর্ডিং রুমে ঢুকে পড়েছিলেন বিখ্যাত সংগীত পরিচালক কলিম শরাফিও। রেকর্ডিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে শুনেছিলেন তাঁর বাজানো। এর কিছুদিন পর লাকী আবারও কলকাতা গেলে হ্যাপীর কণ্ঠে রেকর্ড করা এবং তাঁর সংগীতায়োজনে ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানটির রেকর্ড নিয়ে যান। সেই রেকর্ড বাজানো হয় বিখ্যাত শিল্পী বনশ্রী সেনগুপ্তার বাসায়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিখ্যাত শিল্পী মান্না দে এবং সংগীত পরিচালক আর ডি বর্মণ। তাঁরা মুগ্ধ হন এইটুকু ছেলের এত পরিণত সৃষ্টিকর্ম শুনে। তাঁরা আমন্ত্রণ জানান হ্যাপীকে কলকাতায় বাজানোর জন্য। হ্যাপী কলকাতা যান ১৯৭৫ সালে, বীরভূমের দুর্গাপুরে কনসার্টে অংশ নেন, যে কনসার্টের মূল আকর্ষণ ছিলেন আশা ভোসলে এবং আর ডি বর্মণ। তাঁদের উপস্থিতিতে মঞ্চে উঠে হ্যাপী গেয়ে শোনান টানা ১১টি গান। আশা ভোসলের গান শুনতে আসা দর্শক বিমোহিত হয়ে শোনেন হ্যাপীর গান। পরে স্টেজে উঠে আশা ও আর ডি বর্মণ আশীর্বাদ করেন ছোট্ট হ্যাপীকে। আর হ্যাপী পেয়ে যান তাঁর এক অন্ধ ভক্তকে, যিনি পরে বিখ্যাত হন অনেক সাড়া জাগানো সব অ্যালবামের সংগীতায়োজন করে; নাম মধু মুখোপাধ্যায়। হ্যাপী আখন্দের এই ছাত্রের কম্পোজিশনেই প্রকাশ পায় সুমন চট্টোপাধ্যায় ও নচিকেতার প্রথম দিককার সব অ্যালবাম।
বাংলাদেশের পপ-রক ঘরানার পাশ্চাত্য সংগীতের সবচেয়ে প্রতিভাবান শিল্পী ছিলেন হ্যাপী আখান্দ্। তাঁর বড় ভাই লাকী আখান্দ শুধু নয়, সমসাময়িক সব শিল্পীই দাবি করেন, তিনি আসলে সংগীতের একজন প্রডিজি ছিলেন। সময়ের অনেক আগে জন্মে যাওয়া অসামান্য এক প্রতিভা, যার বিকাশের উপযুক্ত সময়টা আসার আগেই তাঁকে চলে যেতে হয় অন্য সুরের ভুবনে। হ্যাপীর অকালমৃত্যু মেনে নিতে পারেননি লাকী। দিনের পর দিন তিনি সেই শোকে মুহ্যমান থেকেছেন, দূরে থেকেছেন সংগীত থেকে। এও আমাদের বাংলা গানের আরেক ক্ষতি। হ্যাপীর চলে যাওয়ায় আমরা হ্যাপীর সৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়েছি যেমন, তেমনি বঞ্চিত হয়েছি লাকীর সৃষ্টি থেকেও। বাংলা গানের অসামান্য এই আখান্দ ভ্রাতৃদ্বয় যদি পূর্ণ আয়ুষ্কালের শেষ পর্যন্ত একসঙ্গে কাজ করে যেতে পারতেন, নিঃসন্দেহে আমাদের গান আরও অনেক অনেক সমৃদ্ধ হতো।
আজ ২৮ ডিসেম্বর হ্যাপী আখান্দের ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। যেখানেই থাকুন তিনি, ভালো থাকুন, শান্তিতে থাকুন। তাঁর সুরেলা স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
হ্যাপী আখান্দ্ (জিয়া হাসান আখন্দ্ হ্যাপী, ১২ অক্টোবর ১৯৬০-২৮ ডিসেম্বর ১৯৮৭) নামটা আমি প্রথম শুনি ফিডব্যাকের ‘মেলা’ অ্যালবামে। সেই অ্যালবামে পালকি শিরোনামে একটা গান আছে, যেটা আসলে হ্যাপী আখান্দ্কে নিয়ে লেখা। গানের শুরুতে ছোট্ট একটি সংলাপ আছে, যা থেকে জানা যায়, হ্যাপী আখান্দের অকালপ্রয়াণের কষ্ট থেকেই তাঁর সহকর্মী, গুণমুগ্ধ বন্ধুরা এই গান করছেন তাঁকে উৎসর্গ করে। ‘...শিল্পীর মৃত্যু নেই। আমাদের বিশ্বাস হ্যাপী আখান্দের মৃত্যু নেই। অন্য সুরের ভুবনে বর বেশে এ যেন হ্যাপীর পালকি চড়ে মহাপ্রস্থান! কানে এখনো বাজে, তার শেষ যাওয়ার সুর...’—এভাবে হ্যাপীর কথা বলেছিলেন ফিডব্যাক ব্যান্ডে তাঁর সহকর্মী বন্ধুরা।
নামটা দেরিতে শুনলেও তাঁর গান অনেক আগেই শোনা হয়ে গিয়েছিল সিনেমার বদৌলতে। আমার আব্বু-আম্মু সিনেমাপাগল মানুষ ছিলেন। নতুন সিনেমা এলেই সিনেমা হলে গিয়ে দেখতেন তাঁরা। ছোটকালে বাবা-মায়ের সঙ্গে আমিও সাথ ধরতাম। তখনই প্রথম ‘ঘুড্ডি’ ছবিতে শুনি ‘কে বাঁশি বাজায় রে’। কিন্তু, সেই সময়ের যা রীতি, নায়ক-নায়িকা আর প্রধান চরিত্রগুলো ছাড়া বাকি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের খোঁজ কে রাখে? তাই নায়িকার ভাইয়ের চরিত্র রূপায়ণকারী, যে গিটার বাজিয়ে বোনকে গান শোনাতে শোনাতে গেয়ে ফেলে এক কালজয়ী গানের মুখটুকু, ওই শিল্পীই যে তুমুল আলোচিত হ্যাপী আখান্দ্, তা তখন কীভাবে জানব? খুব সম্ভবত তখনো আমি সেভাবে পড়তে শিখিনি। তাই সিনেমার স্ক্রিনে হ্যাপী আখান্দের নাম পড়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। আর সিনেমায় দেখারও আগে, ওই সিনেমারই আরেক সুপার হিট গান ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ পিকনিক সং হিসেবে সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল। তখন ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ ছাড়া বন্ধুদের আড্ডা অকল্পনীয়। ‘কে বাঁশি বাজায় রে’ হ্যাপীর নিজেরই লেখা ও সুর করা। ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ অবশ্য তাঁর লেখা বা সুর করা নয়, এর গীতিকার এস এম হেদায়েত এবং সুরকার লাকী আখান্দ। কিন্তু গানটা নির্মিত হয় হ্যাপী আখান্দের সংগীতায়োজনে। গাওয়ার সময় হ্যাপী ও লাকী দুই ভাই-ই গেয়েছেন একসঙ্গে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ১৯৭৫ সালে এই গান তাঁর সংগীত পরিচালনায় পরিবেশিত হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনে। বিটিভির তৎকালীন প্রযোজক ও পরবর্তীতে পরিচালক সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকি সেই পরিবেশনা শুনে মুগ্ধ হন। তাই যখন তিনি ‘ঘুড্ডি’ ছবিটি তৈরি করতে শুরু করেন, ছবির সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব দেন লাকী আখান্দকে; অবশ্যই ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানটিসহ।
হ্যাপীর রেকর্ড করা গানের সংখ্যা কিন্তু খুব বেশি নয়। মাত্র ২৭ বছরের ক্যারিয়ারে পাঁচ-ছয়টি গানের বেশি রেকর্ড তিনি করতে পারেননি। পারার কথাও নয়। এখনকার মতো তখন গান প্রকাশের এত মাধ্যম যেমন ছিল না, তেমনি ছিল না রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থাও। হাতে গোনা অল্প কয়েকটি স্টুডিও, যেখানে সিনেমা, টিভি, রেডিও, রেকর্ড—সব মাধ্যমের জন্য রেকর্ডিং চলছে অবিরাম। এত এত গুণী মিউজিশিয়ানের মাঝে সময় বের করে নিজেদের একটা শিফট নিতে পারা চাট্টিখানি কথা নয়। এই ভিড় ঠেলে কোনো শিল্পীরই পর্যাপ্ত গান তখন রেকর্ড করা যেত না।
বড় ভাই লাকী তখন পুরোদস্তুর সংগীত পরিচালক। তিনি বিটিভির নিয়মিত তালিকাভুক্ত শিল্পী ও সংগীত পরিচালক, সিনেমাতেও ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, রেডিও তো আছেই। নিজের গান করার চেয়ে লাকী বরং অন্য শিল্পীদের জন্যই গান করেন বেশি। বড় ভাইকে দেখে সেই চর্চাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেলেন হ্যাপী। তিনিও নিজে গাওয়ার চেয়ে অন্যদের গান কম্পোজ করতেই বেশি মনোযোগী হলেন। তাঁর সংগীতায়োজনে সবচেয়ে বেশি গান করেছেন ফিরোজ সাঁই। সাঁইজির বিখ্যাত মাইজভান্ডারি ক্ল্যাসিক গান—‘ইশকুল খুইলাছে রে মওলা’র সংগীতায়োজন হ্যাপীর করা। ফেরদৌস ওয়াহিদের বিখ্যাত ‘এমন একটা মা দে না’ গানেরও সংগীত পরিচালক হ্যাপী আখান্দ। এভাবে অনেক শিল্পীর অনেক বিখ্যাত গান তিনি করেছেন। আরেকটি গানের কথা মনে পড়ছে, সোলস ব্যান্ডের তৎকালীন লিড ভোকালিস্ট কুমার বিশ্বজিতের জন্য তিনি কম্পোজ করেছিলেন ‘তোকে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’ গানটি। পরে অবশ্য বিশ্বজিৎ সেই গানটি তাঁর নিজের সলো অ্যালবামে প্রকাশ করেন। সোলসও বহুদিন গানটি স্টেজে পারফর্ম করেছে।
হ্যাপীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছিলেন তাঁর সমবয়সী ব্যান্ড তারকা মাকসুদুল হক, যিনি শুরুতে বলা পালকি গানটি সৃষ্টি করেছিলেন হ্যাপীর স্মৃতির উদ্দেশে। ইউটিউব আবিষ্কারেরও অনেক আগে একটি ভিডিও দেখেছিলাম এক সাইটে, এখন সেটি আর খুঁজে পেলাম না কোথাও। সেই ভিডিওতে মাকসুদ হ্যাপীর ইন্টারকনে পিয়ানো বাজানোর ঘটনা স্মরণ করেন। হোটেল ইন্টারকনের অধুনালুপ্ত চাম্বেলি হাউসে একটি গ্র্যান্ড পিয়ানো ছিল, যা সাধারণত ইন্টারকনের কমিশন্ড মিউজিশিয়ান এবং বিদেশি অতিথিদের কেউ বাজাতে পারতেন, সর্বসাধারণের সেই পিয়ানো বাজানোর অনুমতি নেই।
ফিডব্যাক তখন ইন্টারকনের রেসিডেন্ট ব্যান্ড হিসেবে নিয়মিত বাজায়। হ্যাপীর প্রতিষ্ঠা করা মাইলস ব্যান্ডও এনলিস্ট হয়েছে। তাই বলে সেই হাইলি ডিস্টিংগুইশড গ্র্যান্ড পিয়ানোতে হাত দেওয়ার অনুমতি এঁদের কারও নেই। কিন্তু সেটা মানতে পারতেন না সদ্য কৈশোর পেরোনো হ্যাপী। প্রায়ই তিনি বলতেন, একদিন আমি ওই পিয়ানো বাজাবই। এবং সত্যিই তিনি একদিন বসে গেলেন কাছেপিঠে কেউ নেই দেখে। মাকসুদ বলছেন, ‘আমি তাকে বাধা দেওয়ার আগেই সে এগিয়ে গেল এবং বসে পড়ল পিয়ানোর সামনে। স্ট্যান্ডে একটা খাতা ছিল, স্টাফ নোটেশন লেখা। সেটা খুলেই হ্যাপী বাজাতে শুরু করল।’ এর পর যা হলো, তা অভাবনীয়। প্রথম কিছুক্ষণ কেউ খেয়াল করল না, কে বাজাচ্ছে, কারণ এতটাই নিখুঁত ছিল সে বাজনা যে, কারও সন্দেহ হয়নি যে, নিয়মিত পিয়ানো বাদকের বাইরে অন্য কেউ বাজাচ্ছে। কিন্তু একটু পরই যখন বাজনা শুনে লোকজন জড়ো হতে শুরু করল, তখন কর্তৃপক্ষের টনক নড়ল। কিন্তু তারা কেউ হ্যাপীকে থামাতে গেলেন না। কারণ, ততক্ষণে সমঝদার শ্রোতারা তন্ময় হয়ে গেছেন হ্যাপির বাদনে। বয়স্ক এক বিদেশি ভদ্রলোক মাকসুদের কাছে জানতে চাইলেন, ‘যে ছেলেটি বাজাচ্ছে, তুমি কি তাকে চেনো?’ মাকসুদ ‘হ্যাঁ’ বলতেই, তিনি বললেন, ‘অনেক বছরের সাধনা ছাড়া গ্র্যান্ড পিয়ানোর রিডে এভাবে আঙুল চালানো যায় না।’ মাকসুদ তাঁকে বললেন যে, ‘ওর নাম হ্যাপী এবং ও আজই প্রথম গ্র্যান্ড পিয়ানোতে হাত দিল। এর আগে সে কিবোর্ড বাজিয়েছে। কিন্তু অরিজিনাল পিয়ানো বলতে যা বোঝায়, মানে এখন যেটা বাজাচ্ছে, সেটাতে হাত দেওয়ার সুযোগ তার কোনো দিন হয়নি!’ বলাই বাহুল্য, সেই বিদেশি বিশ্বাস করলেন না। কারণ, স্টাফ নোটেশন দেখে দেখে হ্যাপী তাঁর সুনিপুণ হাতে বাজাচ্ছিলেন কোনো কালজয়ী শিল্পীর অমর সৃষ্টি (মাকসুদ বলেছিলেন সেটি কোনো বিখ্যাত সুরস্রষ্টার সৃষ্টিকর্ম, এত দিন পর আমার এখন তা মনে পড়ছে না)।
হ্যাপী মাত্র ১২ বছর বয়সে যোগ দেন ‘উইন্ডি সাইড অব কেয়ার’ নামক বাংলাদেশের প্রথম ব্যান্ডে। এই ব্যান্ড সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তান আমলে, পাকিস্তানিদেরই হাতে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে সেই ব্যান্ডের বাংলাদেশি সদস্যদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তাকে আবারও গড়ে তোলেন হ্যাপী। সেই সময়ে বড় ভাই লাকীর সঙ্গে কলকাতার এইচএমভি স্টুডিওতে রেকর্ডিংয়ে অংশ নেন হ্যাপী। মাত্র ১২ বছর বয়সে। তিনি সেখানে তবলা বাজিয়েছিলেন। তবলার শুধু বাঁয়া বা ডুগি ব্যবহার করে তিনি ড্রামবিট দিচ্ছিলেন, যার অভিনব কায়দায় অবাক হয়ে রেকর্ডিং চলার সময়েই রেকর্ডিং রুমে ঢুকে পড়েছিলেন বিখ্যাত সংগীত পরিচালক কলিম শরাফিও। রেকর্ডিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে শুনেছিলেন তাঁর বাজানো। এর কিছুদিন পর লাকী আবারও কলকাতা গেলে হ্যাপীর কণ্ঠে রেকর্ড করা এবং তাঁর সংগীতায়োজনে ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানটির রেকর্ড নিয়ে যান। সেই রেকর্ড বাজানো হয় বিখ্যাত শিল্পী বনশ্রী সেনগুপ্তার বাসায়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিখ্যাত শিল্পী মান্না দে এবং সংগীত পরিচালক আর ডি বর্মণ। তাঁরা মুগ্ধ হন এইটুকু ছেলের এত পরিণত সৃষ্টিকর্ম শুনে। তাঁরা আমন্ত্রণ জানান হ্যাপীকে কলকাতায় বাজানোর জন্য। হ্যাপী কলকাতা যান ১৯৭৫ সালে, বীরভূমের দুর্গাপুরে কনসার্টে অংশ নেন, যে কনসার্টের মূল আকর্ষণ ছিলেন আশা ভোসলে এবং আর ডি বর্মণ। তাঁদের উপস্থিতিতে মঞ্চে উঠে হ্যাপী গেয়ে শোনান টানা ১১টি গান। আশা ভোসলের গান শুনতে আসা দর্শক বিমোহিত হয়ে শোনেন হ্যাপীর গান। পরে স্টেজে উঠে আশা ও আর ডি বর্মণ আশীর্বাদ করেন ছোট্ট হ্যাপীকে। আর হ্যাপী পেয়ে যান তাঁর এক অন্ধ ভক্তকে, যিনি পরে বিখ্যাত হন অনেক সাড়া জাগানো সব অ্যালবামের সংগীতায়োজন করে; নাম মধু মুখোপাধ্যায়। হ্যাপী আখন্দের এই ছাত্রের কম্পোজিশনেই প্রকাশ পায় সুমন চট্টোপাধ্যায় ও নচিকেতার প্রথম দিককার সব অ্যালবাম।
বাংলাদেশের পপ-রক ঘরানার পাশ্চাত্য সংগীতের সবচেয়ে প্রতিভাবান শিল্পী ছিলেন হ্যাপী আখান্দ্। তাঁর বড় ভাই লাকী আখান্দ শুধু নয়, সমসাময়িক সব শিল্পীই দাবি করেন, তিনি আসলে সংগীতের একজন প্রডিজি ছিলেন। সময়ের অনেক আগে জন্মে যাওয়া অসামান্য এক প্রতিভা, যার বিকাশের উপযুক্ত সময়টা আসার আগেই তাঁকে চলে যেতে হয় অন্য সুরের ভুবনে। হ্যাপীর অকালমৃত্যু মেনে নিতে পারেননি লাকী। দিনের পর দিন তিনি সেই শোকে মুহ্যমান থেকেছেন, দূরে থেকেছেন সংগীত থেকে। এও আমাদের বাংলা গানের আরেক ক্ষতি। হ্যাপীর চলে যাওয়ায় আমরা হ্যাপীর সৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়েছি যেমন, তেমনি বঞ্চিত হয়েছি লাকীর সৃষ্টি থেকেও। বাংলা গানের অসামান্য এই আখান্দ ভ্রাতৃদ্বয় যদি পূর্ণ আয়ুষ্কালের শেষ পর্যন্ত একসঙ্গে কাজ করে যেতে পারতেন, নিঃসন্দেহে আমাদের গান আরও অনেক অনেক সমৃদ্ধ হতো।
আজ ২৮ ডিসেম্বর হ্যাপী আখান্দের ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। যেখানেই থাকুন তিনি, ভালো থাকুন, শান্তিতে থাকুন। তাঁর সুরেলা স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
সিনেমার গল্প চুড়ান্ত হওয়ার পর প্রথমে মান্নাকেই ভেবেছিলেন কাজী হায়াৎ। তবে প্রযোজক ডিপজলের সঙ্গে সে সময় মান্নার দূরত্ব চলছিল। তাই মান্নাকে নিতে রাজি ছিলেন না ডিপজল। ভাবা হচ্ছিল, রুবেল কিংবা হুমায়ূন ফরীদির কথা।
৪ ঘণ্টা আগেপুরোনো ভিডিও এডিট করে মিথ্যা ক্যাপশন জুড়ে দেওয়ায় বিব্রত অভিনেত্রী। মিম বলেন, ‘জুয়েলারি শোরুমের ভিডিওটি জোড়াতালি দিয়ে অনেকেই লিখছেন, আমি মবের শিকার হয়েছি। আমাকে উদ্বোধনে বাধা দেওয়া হয়েছে। আসলে তেমন কোনো কিছু আমার সঙ্গে ঘটেনি।’
৪ ঘণ্টা আগেবিদেশে তুমুল অভ্যর্থনা পেলেও নিজের দেশ ভারতেই কনসার্ট করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়লেন দিলজিৎ। তেলেঙ্গানা সরকার নোটিশ পাঠিয়ে তাঁকে সতর্ক করেছে, মাদকদ্রব্যের প্রচার করা হয়, এমন কোনো গান তিনি যেন কনসার্টে না করেন।
৬ ঘণ্টা আগেচার দশকের ক্যারিয়ার আমির খানের। বলিউডের মাসালা সিনেমার ভিড়ে খানিকটা অন্য ধরনের কাজের কথা উঠলেই আসে তাঁর নাম। নিজের কাজ নিয়ে এতটাই খুঁতখুঁতে থাকেন যে আমিরের আরেক নাম হয়ে গেছে মিস্টার পারফেকশনিস্ট। তবে তাঁর এই সাফল্যের পালে বেশ বড়সড় ধাক্কা লাগে ‘লাল সিং চাড্ডা’র সময়।
৭ ঘণ্টা আগে