বিদ্যুৎ সরকার
দেবব্রত বিশ্বাস ওরফে জর্জ। সংগীতজনের কাছে তিনি পরিচিত ‘জর্জ দা’ নামে। কিশোরগঞ্জে থাকাকালে আরও দুটো নাম ছিল তাঁর—দেবু এবং খোকা। সেখানে পরিচিতদের অনেকেই এই দুই নামের কোনো একটি দিয়েই চিনতেন বা ডাকতেন তাঁকে। পরে পড়ালেখার উদ্দেশ্যে পূর্ববঙ্গ ছেড়ে কলকাতায় যাওয়ায় তাঁর দেবু ও খোকা নাম ধীরে ধীরে মানুষ ভুলে যায়। কলকাতার মানুষের কাছে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন পিতা দেবেন্দ্রকিশোর বিশ্বাসের ইংরেজপ্রীতির নিদর্শন হিসেবে পাওয়া জর্জ নামে। ১৯১১ সালের ২২ আগস্ট তাঁর জন্মের কয়েক দিন আগে ইংল্যান্ডের রাজা হন পঞ্চম জর্জ। ইংরেজদের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও অতিভক্তি বশত তাঁর বাবা-মা আদর করে তাঁকে ডাকতেন জর্জ নামে। দেবব্রত বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত এই জর্জ থেকে ‘জর্জ দা’ নামেই সংগীত সমাজে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
দেবব্রত বিশ্বাসের বাবা ছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্ম। সিনেমা, থিয়েটার, যাত্রাগানের প্রতি তাঁর ছিল ঘোর অমত। তবে ব্রাহ্ম হওয়ায় বাড়িতে প্রতি সন্ধ্যায় প্রার্থনা হিসেবে মায়ের সঙ্গে দেবব্রত বিশ্বাস গাইতেন ব্রহ্মসংগীত। এই প্রার্থনা থেকেই তাঁর গাওয়ার শুরু। এ ছাড়া মায়ের কাছ থেকে শুনে শুনে আরও কিছু গান শিখে নিয়েছিলেন তিনি। ময়মনসিংহ ব্রাহ্মসমাজের মাঘোৎসবের গানের দলে প্রতি বছর মায়ের সঙ্গে থাকতেন তিনিও। বাড়িতে হারমোনিয়াম, অর্গান ছিল। বলা যায়, শৈশব থেকেই তিনি পেয়েছিলেন সংগীত-সহায়ক এক পরিবেশ।
স্কুলে পড়ার সময় কংগ্রেস ভলান্টিয়ার হয়ে সমবয়সী কয়েকজনকে নিয়ে দেশাত্মবোধক গানও গেয়েছেন বিভিন্ন স্বদেশি সভায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহের কনক দাস ছিলেন তার মাসি (বড় মামির বোন)। তাঁর সঙ্গে অনুষ্ঠানে গানও গেয়েছেন দেবব্রত বিশ্বাস। ১৯২৮-২৯ সালে কলকাতায় কলেজে পড়াকালীন সুর সাগর হিমাংশু দত্ত, শৈলেশ দত্তগুপ্ত, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় ও সন্তোষ সেনগুপ্তের মতো সংগীতগুণীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। বিশেষ করে হিমাংশু দত্তের কাছ থেকে এ সময় বেশ কিছু গান শিখে নেন দেবব্রত বিশ্বাস। পরে সেই গানগুলো ১৯৩৩ সালে শান্তিনিকেতনের সংগীতভবনের অধ্যক্ষ হেমেন্দ্রলাল রায়কে শুনিয়ে তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা লাভ করেছিলেন তিনি। কাজী নজরুল ইসলামও সেনোলা রেকর্ড কোম্পানির হয়ে তাঁকে দিয়ে দুটি গান রেকর্ড করিয়েছিলেন। বোঝা যায়, সংগীত সম্পর্কে যেখানে যখনই সুযোগ পেয়েছেন, শিখে নিয়েছেন।
তবে মাঝেমধ্যে দেশাত্মবোধক ও আধুনিক গান গাইলেও রবি ঠাকুরের গানের প্রতিই ছিল তাঁর অতলান্ত ভালোবাসা। বিশেষ করে মায়ের কাছে শেখা ও কলকাতায় ব্রাহ্মমন্দিরে শোনা ব্রহ্মসংগীতগুলো সব সময় তাঁকে আলোড়িত করেছে। এ গান সম্পর্কে তিনি বলছেন, ‘সেই সব আধ্যাত্মিক গানগুলোর মধ্যে কী যেন একটা মাধুর্য ছিল, যা আমার হৃদয়কে অত্যন্ত গভীরভাবে নাড়া দিত।’ বড় হতে হতে রবীন্দ্রসংগীত হয়ে ওঠে তাঁর যাপিত জীবনের আশ্রয়। সেটা আরও পাকাপোক্ত হয় ১৯৩৫ সালের দিকে ইন্দিরা দেবীর সান্নিধ্যে এসে। এ ছাড়া অনাদিকুমার দস্তিদারের কাছ থেকেও অনেক গান শেখেন তিনি। সিনেমার গানের প্রয়োজনে তিনি পঙ্কজ মল্লিকের সাহচর্য পেয়েছেন। শেখার ব্যাপারে দেবব্রত বিশ্বাস ছিলেন মুক্তমনা। যখন যেখানে যার কাছে সুযোগ পেয়েছেন, শিখেছেন তিনি।
সংগীত, বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কে অভিজ্ঞ এবং জনপ্রিয় হওয়ার পরেও বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের কাছ থেকে তিনি হয়েছিলেন বৈষম্যের শিকার। এক প্রকার ব্রাত্য করেই রাখা হয়েছিল তাঁকে। বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারত, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে নামী-অনামী অনেক শিল্পীই বহু প্রচারিত বিভিন্ন গণমাধ্যমে কিংবা বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলে প্রাণভরে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন। ভাব ও সুরের সমন্বয় সেখানে যে সব সময় রক্ষা হয়, তা জোর গলায় বলা যায় না। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড কেউ বের করতে চাইলে তাঁকে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের অনুমোদন নিতে হতো। কোনো শিল্পীর সুর-বাজনা-গায়নভঙ্গি একটু এদিক-ওদিক হলেই তাঁর রেকর্ডটি প্রকাশের অনুমতি দিতে বোর্ড কার্পণ্য করত।
তবে এই কৃপণতার মাত্রা সবার ক্ষেত্রে এক রকম ছিল না। বলা যায়, সবচেয়ে বেশি ছিল দেবব্রত বিশ্বাসের প্রতি। কেউ কেউ সঠিকভাবে না গেয়েও রেকর্ড বের করার অনুমতি পেয়ে যেতেন। কিন্তু দেবব্রত বিশ্বাস সহজে অনুমতি পেতেন না। কারণ তিনি রবীন্দ্রসংগীতের গায়নে অনুভূতি সঞ্জাত নতুনত্ব আনার চেষ্টা করতেন। ফলে, গানের কথা অনুযায়ী ভাব সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে সৃষ্ট মিউজিক ব্যবহার করতেন তিনি। এ জন্য শান্তিনিকেতনি সুর ও পরিবেশনারীতির কিছু ব্যত্যয়ও ঘটাতেন দেবব্রত।
রবীন্দ্রনাথের সংগীতচিন্তা সম্পর্কে দেবব্রত বিশ্বাসের ছিল সুস্পষ্ট ধারণা। ভরাট কণ্ঠ, নতুন গায়নভঙ্গি ও বাণীবাহিত ভাবকে শ্রুতিনন্দনভাবে উপস্থাপনার কারণে শ্রোতারা তাঁকে ভালোবেসেছিল অকৃত্রিম হৃদয়াবেগ দিয়েই। সে সময় দেবব্রত বিশ্বাসের জনপ্রিয়তার একটা প্রমাণ পাওয়া যায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কথায়। তিনি আমার গানের স্বরলিপি বইয়ে জানাচ্ছেন, ‘শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীতে আমার ধারণা জর্জদারই হাইয়েস্ট। একবার ওঁর বিক্রির স্টেটমেন্ট দেখেছিলুম। ভাবা যায় না। শুধু রবীন্দ্রসংগীত বেচে এত টাকা। না, না ওই জর্জদারই ম্যাক্সিমাম। তারপর আমার।’
সংগীতানুরাগীদের কাছে প্রিয় হলেও বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে দেবব্রত বিশ্বাসের ভাবনাকে গ্রহণ করতে পারেনি। এ নিয়ে ১৯৬৪ সাল থেকে তাঁর সঙ্গে বোর্ডের বিবাদ শুরু হয়। এ সময় তাঁর গাওয়া চারটি রবীন্দ্রসংগীতের (১. শুধু যাওয়া আসা, ২. এসেছিলে তবু আস নাই, ৩. মেঘ বলেছে যাব যাব, ৪. গোধূলিগগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা) রেকর্ড মিউজিক বোর্ড প্রকাশ করতে বাধা দেয়। শান্তিদেব ঘোষ যে গানকে প্রকাশযোগ্য বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, বোর্ডের কর্মকর্তারা সে মতও গ্রহণ করেননি।
এর পর থেকে মাঝে মাঝেই দেবব্রত বিশ্বাস বোর্ড কর্মকর্তাদের বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়েছেন। বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের এই খবরদারিমূলক আচরণের প্রতিবাদে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা অবস্থাতেই তিনি রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড বন্ধ করে দেন। অনেকের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি সংগীত থেকে ধীরে-ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নেন। ১৯৭১ সালের পর কোনো রবীন্দ্রসংগীত তিনি আর রেকর্ড করেননি। এ কারণে কারও-কারও কাছে তিনি পেয়েছেন অতি-অভিমানী কিংবা চরম জেদির তকমা। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, এই অতি-অভিমান কিংবা চরম জেদের মূলে রয়েছে শিল্পীর স্বাধীনতা ও অধিকার আদায় এবং তাকে সমুন্নত রাখার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা।
রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কে যথেষ্ট না জানা, অনভিজ্ঞ ও কম বয়সী সনদধারী কিছু মানুষের ক্ষমতাচর্চা ও ঈর্ষাজাত সিদ্ধান্ত তিনি মেনে নিতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর কাছে শুধু গাওয়ার বিষয় ছিল না। দৈনন্দিন যাপনে তা ছিল আত্মচেতনা ও সম্মানবোধকে শাণিত করার মন্ত্র।
শুধু শ্রোতার কাছেই নন, শিল্পীদের কাছেও তিনি ছিলেন শ্রদ্ধেয়, বরণীয়। দেবব্রত বিশ্বাসের প্রতি বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের সে আচরণ অন্যান্য শিল্পীকেও ব্যথিত করেছিল–লজ্জিতও। মান্না দে তাঁর আত্মজীবনী জীবনের জলসাঘরে জানাচ্ছেন, ‘কিছু সুরহীন মানুষ রবীন্দ্রসংগীতের অভিভাবক সেজে রবীন্দ্রসংগীতকে আটকে রেখেছেন তাঁদের নিজস্ব আঙিনায়, নিজস্ব বেড়াজালে। কখনো তাকে হয়ে উঠতে দেননি জনগণের সংগীত। প্রাণের গানকে আবদ্ধ রেখেছেন প্রাণহীন এক বিচিত্র স্বঘোষিত রাবীন্দ্রিক ঢঙে। এ অন্যায়, এ ঘোরতর এক অন্যায়। প্রাণ ঢেলে হৃদয়ের সুরে আবেগমথিত কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন জর্জদা। আহা! কী গান গাইতেন উনি। এক-একটা গানের এক-একটা জায়গায় ওঁর সুর লাগানো শুনে বুকের ভেতর একটা ভালো লাগার অনুভূতি আমার চোখে আবেগ আপ্লুত জল এনে দিত। সেই জর্জদার গান গাওয়া ওরা বন্ধ করে দিল।’
শিল্পীর অর্থনৈতিক অধিকার নিয়েও সচেতন ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস। সে সময় অন্যান্য কণ্ঠশিল্পীরা বাদ্যযন্ত্রীদের খরচ নিজের কাঁধে নিয়ে এইচএমভি ও কলাম্বিয়াতে রেকর্ড করে রয়্যালটি পেতেন মাত্র পাঁচ শতাংশ। দেবব্রত বিশ্বাস সেখানে দশ শতাংশ রয়্যালটি ও বাদ্যযন্ত্রীদের খরচ কোম্পানিকে বহনের দাবি করেন। জনমানসে গ্রহণযোগ্যতার কারণে কোম্পানি তাঁকে এক হাজার কপি বিক্রি হওয়ার শর্তে এই দাবি মেনে নেয়। উল্লেখ্য, তাঁর এক শ’র বেশি গানের মধ্যে এমন কোনো গান নেই যে তিনি রয়্যালটি পাননি। বলা যায়, বিত্ত ও চিত্ত সংকীর্ণতার বেড়াজাল ছিঁড়ে রবীন্দ্রসংগীতকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য তিনজনের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। অন্য দুজন হলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
এই প্রতিবাদী চেতনা তিনি মূলত পেয়েছিলেন আইপিটিএ তথা ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে। সাম্যবাদে আস্থাবান এ শিল্পী ১৯৪০ এর দশকের শুরুতে আইপিটিএর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের গান, বিশেষত তাঁর স্বদেশপ্রেমমূলক গানগুলো গাওয়া শুরু করেন। দেবব্রত বিশ্বাসের দরাজ কণ্ঠ ও স্বতন্ত্র গায়কির কারণে শ্রোতারা আবিষ্কার করলেন নতুন এক রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রসংগীত যে এভাবে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেও গাওয়া যেতে পারে, তা দেবব্রত বিশ্বাসের আগে কোনো শিল্পী কল্পনা করেননি।
এ সম্পর্কে হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলছেন, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের সবল উদ্দীপক ধারার সঙ্গে গণসঙ্গীতকে মিশিয়ে দিলেন জর্জদা। রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পর্কে আমাদের অর্থাৎ গণসঙ্গীত গাইয়েদের মনোভাবকে সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করলেন যেমন, তেমনি রবীন্দ্রসংগীতকে মোহান্তদের বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও মন্দিরের বেদি থেকে গণসঙ্গীতের প্রান্তরে নামিয়ে আনলেন। এই দুই ধারার সমন্বয়ে জর্জদা যেমন শ্রেষ্ঠ গণসঙ্গীত শিল্পী, তেমনি শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রসংগীত গায়ক। এখানেই জর্জদার যুগান্তকারী ভূমিকা। এখানেই তিনি মহান গণসঙ্গীতশিল্পী।’ এ সময় ‘নবান্ন’, ‘রক্তকরবী’র মতো অবিস্মরণীয় নাটকে অভিনয়ও করেন তিনি।
জন্মভূমি পূর্ববাংলার প্রতি তাঁর ছিল গভীর মমত্ববোধ ও ভালোবাসা। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বক্তব্য থেকে জানা যায়, পূর্ববাংলাকে দেবব্রত বিশ্বাস বলতেন ‘মা’ আর পশ্চিমবঙ্গকে বলতেন ‘বিমাতা’। মায়ের রাতারাতি বিদেশ হয়ে যাওয়াকে তিনি কোনো দিন মেনে নিতে পারেননি। আমৃত্যু বয়ে বেড়িয়েছেন দেশভাগের সেই ক্ষত। হয়েছেন যন্ত্রণায় কাতর। তবে দেশভাগ তাঁকে মর্মাহত করলেও জন্মভূমির প্রতি দায়িত্ববোধ সম্পর্কে তিনি ছিলেন সচেতন। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ ও সহানুভূতি আদায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য তিনি সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিঠি দিয়ে দুটি গান লিখে স্বরলিপিসহ পাঠানোর অনুরোধ জানান।
বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসার এ কথা জানা যায় তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত’ থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘আমার জন্মভূমি পূর্ববঙ্গের অর্থাৎ বাংলাদেশের আমার ভাই-বোনেরা জীবন-মরণ পণে যে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন সেই লড়াইকে তিনি সমর্থন করেন কিনা জানতে চাইলাম। যদি সেই লড়াই-এর প্রতি তাঁর সামান্য একটু সমর্থন থাকে তাহলে ওদের মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে দুটি গান আমায় লিখে পাঠাতে অনুরোধ জানালাম, যাতে সেই গান দুটির রেকর্ড প্রকাশ করে এবং নানা অনুষ্ঠানে গেয়ে এপার বাংলার জনসাধারণকে বাংলাদেশের আমার ভাইবোনদের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি একটু সহানুভূতিশীল করে তুলতে পারি।’ সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কথা রেখেছিলেন। কয়েক দিন পরে দুটো গান লিখে ও স্বরলিপি করে তিনি পাঠিয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে।
শান্তিনিকেতনি গায়ন পদ্ধতি অনুসরণ না করে সুর কাঠামো বজায় রেখে আত্মোপলব্ধি দিয়ে স্বাধীনভাবে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার কারণে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের কাছে তিনি ব্রাত্য হয়েছেন বটে। কিন্তু সংগীতামোদী মানুষের কাছে পেয়েছেন অফুরান ভালোবাসা। এখনো রবীন্দ্রসংগীতের অন্যতম জনপ্রিয় ও অনুসরণীয় শিল্পী তিনি। তাঁর ভরাট গলায় গাওয়া ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’, ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’, ‘মহারাজ একি সাজে’ কিংবা ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘মেঘে ঢাকা তারা’ সিনেমায় গাওয়া ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’সহ অসংখ্য গান আজও শ্রোতাকে মুগ্ধ করে। শিল্পীর স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্য আমৃত্যু চেষ্টা তাঁকে শিল্পীদের মণিকোঠায় স্থান করে দিয়েছে।
১৯৮০ সালের ১৮ আগস্ট তাঁর চলে যাওয়া বাংলার সংগীতানুরাগী সাধারণ মানুষকেও করেছিল শোকাহত। তাঁর মৃত্যু নিয়ে তাঁর এক সময়ের কক্ষসঙ্গী ও শিল্পী সন্তোষ সেনগুপ্ত লিখছেন, “আমাদের দুর্ভাগ্য, সারা দেশের দুর্ভাগ্য যে দেবব্রত বিশ্বাস আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। কিন্তু কী সে যাওয়া-কী সে মহিমান্বিত নিষ্ক্রমণ-অগণিত জনতার আকুল ক্রন্দনধ্বনি-আকুল হাহাকার যেন তারই গানের রূপ নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। ”
বিদ্যুৎ সরকার: শিক্ষক ও সংগীত শিল্পী
দেবব্রত বিশ্বাস ওরফে জর্জ। সংগীতজনের কাছে তিনি পরিচিত ‘জর্জ দা’ নামে। কিশোরগঞ্জে থাকাকালে আরও দুটো নাম ছিল তাঁর—দেবু এবং খোকা। সেখানে পরিচিতদের অনেকেই এই দুই নামের কোনো একটি দিয়েই চিনতেন বা ডাকতেন তাঁকে। পরে পড়ালেখার উদ্দেশ্যে পূর্ববঙ্গ ছেড়ে কলকাতায় যাওয়ায় তাঁর দেবু ও খোকা নাম ধীরে ধীরে মানুষ ভুলে যায়। কলকাতার মানুষের কাছে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন পিতা দেবেন্দ্রকিশোর বিশ্বাসের ইংরেজপ্রীতির নিদর্শন হিসেবে পাওয়া জর্জ নামে। ১৯১১ সালের ২২ আগস্ট তাঁর জন্মের কয়েক দিন আগে ইংল্যান্ডের রাজা হন পঞ্চম জর্জ। ইংরেজদের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও অতিভক্তি বশত তাঁর বাবা-মা আদর করে তাঁকে ডাকতেন জর্জ নামে। দেবব্রত বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত এই জর্জ থেকে ‘জর্জ দা’ নামেই সংগীত সমাজে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
দেবব্রত বিশ্বাসের বাবা ছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্ম। সিনেমা, থিয়েটার, যাত্রাগানের প্রতি তাঁর ছিল ঘোর অমত। তবে ব্রাহ্ম হওয়ায় বাড়িতে প্রতি সন্ধ্যায় প্রার্থনা হিসেবে মায়ের সঙ্গে দেবব্রত বিশ্বাস গাইতেন ব্রহ্মসংগীত। এই প্রার্থনা থেকেই তাঁর গাওয়ার শুরু। এ ছাড়া মায়ের কাছ থেকে শুনে শুনে আরও কিছু গান শিখে নিয়েছিলেন তিনি। ময়মনসিংহ ব্রাহ্মসমাজের মাঘোৎসবের গানের দলে প্রতি বছর মায়ের সঙ্গে থাকতেন তিনিও। বাড়িতে হারমোনিয়াম, অর্গান ছিল। বলা যায়, শৈশব থেকেই তিনি পেয়েছিলেন সংগীত-সহায়ক এক পরিবেশ।
স্কুলে পড়ার সময় কংগ্রেস ভলান্টিয়ার হয়ে সমবয়সী কয়েকজনকে নিয়ে দেশাত্মবোধক গানও গেয়েছেন বিভিন্ন স্বদেশি সভায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহের কনক দাস ছিলেন তার মাসি (বড় মামির বোন)। তাঁর সঙ্গে অনুষ্ঠানে গানও গেয়েছেন দেবব্রত বিশ্বাস। ১৯২৮-২৯ সালে কলকাতায় কলেজে পড়াকালীন সুর সাগর হিমাংশু দত্ত, শৈলেশ দত্তগুপ্ত, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় ও সন্তোষ সেনগুপ্তের মতো সংগীতগুণীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। বিশেষ করে হিমাংশু দত্তের কাছ থেকে এ সময় বেশ কিছু গান শিখে নেন দেবব্রত বিশ্বাস। পরে সেই গানগুলো ১৯৩৩ সালে শান্তিনিকেতনের সংগীতভবনের অধ্যক্ষ হেমেন্দ্রলাল রায়কে শুনিয়ে তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা লাভ করেছিলেন তিনি। কাজী নজরুল ইসলামও সেনোলা রেকর্ড কোম্পানির হয়ে তাঁকে দিয়ে দুটি গান রেকর্ড করিয়েছিলেন। বোঝা যায়, সংগীত সম্পর্কে যেখানে যখনই সুযোগ পেয়েছেন, শিখে নিয়েছেন।
তবে মাঝেমধ্যে দেশাত্মবোধক ও আধুনিক গান গাইলেও রবি ঠাকুরের গানের প্রতিই ছিল তাঁর অতলান্ত ভালোবাসা। বিশেষ করে মায়ের কাছে শেখা ও কলকাতায় ব্রাহ্মমন্দিরে শোনা ব্রহ্মসংগীতগুলো সব সময় তাঁকে আলোড়িত করেছে। এ গান সম্পর্কে তিনি বলছেন, ‘সেই সব আধ্যাত্মিক গানগুলোর মধ্যে কী যেন একটা মাধুর্য ছিল, যা আমার হৃদয়কে অত্যন্ত গভীরভাবে নাড়া দিত।’ বড় হতে হতে রবীন্দ্রসংগীত হয়ে ওঠে তাঁর যাপিত জীবনের আশ্রয়। সেটা আরও পাকাপোক্ত হয় ১৯৩৫ সালের দিকে ইন্দিরা দেবীর সান্নিধ্যে এসে। এ ছাড়া অনাদিকুমার দস্তিদারের কাছ থেকেও অনেক গান শেখেন তিনি। সিনেমার গানের প্রয়োজনে তিনি পঙ্কজ মল্লিকের সাহচর্য পেয়েছেন। শেখার ব্যাপারে দেবব্রত বিশ্বাস ছিলেন মুক্তমনা। যখন যেখানে যার কাছে সুযোগ পেয়েছেন, শিখেছেন তিনি।
সংগীত, বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কে অভিজ্ঞ এবং জনপ্রিয় হওয়ার পরেও বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের কাছ থেকে তিনি হয়েছিলেন বৈষম্যের শিকার। এক প্রকার ব্রাত্য করেই রাখা হয়েছিল তাঁকে। বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারত, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে নামী-অনামী অনেক শিল্পীই বহু প্রচারিত বিভিন্ন গণমাধ্যমে কিংবা বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলে প্রাণভরে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন। ভাব ও সুরের সমন্বয় সেখানে যে সব সময় রক্ষা হয়, তা জোর গলায় বলা যায় না। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড কেউ বের করতে চাইলে তাঁকে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের অনুমোদন নিতে হতো। কোনো শিল্পীর সুর-বাজনা-গায়নভঙ্গি একটু এদিক-ওদিক হলেই তাঁর রেকর্ডটি প্রকাশের অনুমতি দিতে বোর্ড কার্পণ্য করত।
তবে এই কৃপণতার মাত্রা সবার ক্ষেত্রে এক রকম ছিল না। বলা যায়, সবচেয়ে বেশি ছিল দেবব্রত বিশ্বাসের প্রতি। কেউ কেউ সঠিকভাবে না গেয়েও রেকর্ড বের করার অনুমতি পেয়ে যেতেন। কিন্তু দেবব্রত বিশ্বাস সহজে অনুমতি পেতেন না। কারণ তিনি রবীন্দ্রসংগীতের গায়নে অনুভূতি সঞ্জাত নতুনত্ব আনার চেষ্টা করতেন। ফলে, গানের কথা অনুযায়ী ভাব সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে সৃষ্ট মিউজিক ব্যবহার করতেন তিনি। এ জন্য শান্তিনিকেতনি সুর ও পরিবেশনারীতির কিছু ব্যত্যয়ও ঘটাতেন দেবব্রত।
রবীন্দ্রনাথের সংগীতচিন্তা সম্পর্কে দেবব্রত বিশ্বাসের ছিল সুস্পষ্ট ধারণা। ভরাট কণ্ঠ, নতুন গায়নভঙ্গি ও বাণীবাহিত ভাবকে শ্রুতিনন্দনভাবে উপস্থাপনার কারণে শ্রোতারা তাঁকে ভালোবেসেছিল অকৃত্রিম হৃদয়াবেগ দিয়েই। সে সময় দেবব্রত বিশ্বাসের জনপ্রিয়তার একটা প্রমাণ পাওয়া যায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কথায়। তিনি আমার গানের স্বরলিপি বইয়ে জানাচ্ছেন, ‘শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীতে আমার ধারণা জর্জদারই হাইয়েস্ট। একবার ওঁর বিক্রির স্টেটমেন্ট দেখেছিলুম। ভাবা যায় না। শুধু রবীন্দ্রসংগীত বেচে এত টাকা। না, না ওই জর্জদারই ম্যাক্সিমাম। তারপর আমার।’
সংগীতানুরাগীদের কাছে প্রিয় হলেও বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে দেবব্রত বিশ্বাসের ভাবনাকে গ্রহণ করতে পারেনি। এ নিয়ে ১৯৬৪ সাল থেকে তাঁর সঙ্গে বোর্ডের বিবাদ শুরু হয়। এ সময় তাঁর গাওয়া চারটি রবীন্দ্রসংগীতের (১. শুধু যাওয়া আসা, ২. এসেছিলে তবু আস নাই, ৩. মেঘ বলেছে যাব যাব, ৪. গোধূলিগগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা) রেকর্ড মিউজিক বোর্ড প্রকাশ করতে বাধা দেয়। শান্তিদেব ঘোষ যে গানকে প্রকাশযোগ্য বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, বোর্ডের কর্মকর্তারা সে মতও গ্রহণ করেননি।
এর পর থেকে মাঝে মাঝেই দেবব্রত বিশ্বাস বোর্ড কর্মকর্তাদের বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়েছেন। বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের এই খবরদারিমূলক আচরণের প্রতিবাদে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা অবস্থাতেই তিনি রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড বন্ধ করে দেন। অনেকের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি সংগীত থেকে ধীরে-ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নেন। ১৯৭১ সালের পর কোনো রবীন্দ্রসংগীত তিনি আর রেকর্ড করেননি। এ কারণে কারও-কারও কাছে তিনি পেয়েছেন অতি-অভিমানী কিংবা চরম জেদির তকমা। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, এই অতি-অভিমান কিংবা চরম জেদের মূলে রয়েছে শিল্পীর স্বাধীনতা ও অধিকার আদায় এবং তাকে সমুন্নত রাখার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা।
রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কে যথেষ্ট না জানা, অনভিজ্ঞ ও কম বয়সী সনদধারী কিছু মানুষের ক্ষমতাচর্চা ও ঈর্ষাজাত সিদ্ধান্ত তিনি মেনে নিতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর কাছে শুধু গাওয়ার বিষয় ছিল না। দৈনন্দিন যাপনে তা ছিল আত্মচেতনা ও সম্মানবোধকে শাণিত করার মন্ত্র।
শুধু শ্রোতার কাছেই নন, শিল্পীদের কাছেও তিনি ছিলেন শ্রদ্ধেয়, বরণীয়। দেবব্রত বিশ্বাসের প্রতি বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের সে আচরণ অন্যান্য শিল্পীকেও ব্যথিত করেছিল–লজ্জিতও। মান্না দে তাঁর আত্মজীবনী জীবনের জলসাঘরে জানাচ্ছেন, ‘কিছু সুরহীন মানুষ রবীন্দ্রসংগীতের অভিভাবক সেজে রবীন্দ্রসংগীতকে আটকে রেখেছেন তাঁদের নিজস্ব আঙিনায়, নিজস্ব বেড়াজালে। কখনো তাকে হয়ে উঠতে দেননি জনগণের সংগীত। প্রাণের গানকে আবদ্ধ রেখেছেন প্রাণহীন এক বিচিত্র স্বঘোষিত রাবীন্দ্রিক ঢঙে। এ অন্যায়, এ ঘোরতর এক অন্যায়। প্রাণ ঢেলে হৃদয়ের সুরে আবেগমথিত কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন জর্জদা। আহা! কী গান গাইতেন উনি। এক-একটা গানের এক-একটা জায়গায় ওঁর সুর লাগানো শুনে বুকের ভেতর একটা ভালো লাগার অনুভূতি আমার চোখে আবেগ আপ্লুত জল এনে দিত। সেই জর্জদার গান গাওয়া ওরা বন্ধ করে দিল।’
শিল্পীর অর্থনৈতিক অধিকার নিয়েও সচেতন ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস। সে সময় অন্যান্য কণ্ঠশিল্পীরা বাদ্যযন্ত্রীদের খরচ নিজের কাঁধে নিয়ে এইচএমভি ও কলাম্বিয়াতে রেকর্ড করে রয়্যালটি পেতেন মাত্র পাঁচ শতাংশ। দেবব্রত বিশ্বাস সেখানে দশ শতাংশ রয়্যালটি ও বাদ্যযন্ত্রীদের খরচ কোম্পানিকে বহনের দাবি করেন। জনমানসে গ্রহণযোগ্যতার কারণে কোম্পানি তাঁকে এক হাজার কপি বিক্রি হওয়ার শর্তে এই দাবি মেনে নেয়। উল্লেখ্য, তাঁর এক শ’র বেশি গানের মধ্যে এমন কোনো গান নেই যে তিনি রয়্যালটি পাননি। বলা যায়, বিত্ত ও চিত্ত সংকীর্ণতার বেড়াজাল ছিঁড়ে রবীন্দ্রসংগীতকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য তিনজনের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। অন্য দুজন হলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
এই প্রতিবাদী চেতনা তিনি মূলত পেয়েছিলেন আইপিটিএ তথা ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে। সাম্যবাদে আস্থাবান এ শিল্পী ১৯৪০ এর দশকের শুরুতে আইপিটিএর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের গান, বিশেষত তাঁর স্বদেশপ্রেমমূলক গানগুলো গাওয়া শুরু করেন। দেবব্রত বিশ্বাসের দরাজ কণ্ঠ ও স্বতন্ত্র গায়কির কারণে শ্রোতারা আবিষ্কার করলেন নতুন এক রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রসংগীত যে এভাবে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেও গাওয়া যেতে পারে, তা দেবব্রত বিশ্বাসের আগে কোনো শিল্পী কল্পনা করেননি।
এ সম্পর্কে হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলছেন, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের সবল উদ্দীপক ধারার সঙ্গে গণসঙ্গীতকে মিশিয়ে দিলেন জর্জদা। রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পর্কে আমাদের অর্থাৎ গণসঙ্গীত গাইয়েদের মনোভাবকে সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করলেন যেমন, তেমনি রবীন্দ্রসংগীতকে মোহান্তদের বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও মন্দিরের বেদি থেকে গণসঙ্গীতের প্রান্তরে নামিয়ে আনলেন। এই দুই ধারার সমন্বয়ে জর্জদা যেমন শ্রেষ্ঠ গণসঙ্গীত শিল্পী, তেমনি শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রসংগীত গায়ক। এখানেই জর্জদার যুগান্তকারী ভূমিকা। এখানেই তিনি মহান গণসঙ্গীতশিল্পী।’ এ সময় ‘নবান্ন’, ‘রক্তকরবী’র মতো অবিস্মরণীয় নাটকে অভিনয়ও করেন তিনি।
জন্মভূমি পূর্ববাংলার প্রতি তাঁর ছিল গভীর মমত্ববোধ ও ভালোবাসা। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বক্তব্য থেকে জানা যায়, পূর্ববাংলাকে দেবব্রত বিশ্বাস বলতেন ‘মা’ আর পশ্চিমবঙ্গকে বলতেন ‘বিমাতা’। মায়ের রাতারাতি বিদেশ হয়ে যাওয়াকে তিনি কোনো দিন মেনে নিতে পারেননি। আমৃত্যু বয়ে বেড়িয়েছেন দেশভাগের সেই ক্ষত। হয়েছেন যন্ত্রণায় কাতর। তবে দেশভাগ তাঁকে মর্মাহত করলেও জন্মভূমির প্রতি দায়িত্ববোধ সম্পর্কে তিনি ছিলেন সচেতন। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ ও সহানুভূতি আদায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য তিনি সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিঠি দিয়ে দুটি গান লিখে স্বরলিপিসহ পাঠানোর অনুরোধ জানান।
বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসার এ কথা জানা যায় তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত’ থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘আমার জন্মভূমি পূর্ববঙ্গের অর্থাৎ বাংলাদেশের আমার ভাই-বোনেরা জীবন-মরণ পণে যে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন সেই লড়াইকে তিনি সমর্থন করেন কিনা জানতে চাইলাম। যদি সেই লড়াই-এর প্রতি তাঁর সামান্য একটু সমর্থন থাকে তাহলে ওদের মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে দুটি গান আমায় লিখে পাঠাতে অনুরোধ জানালাম, যাতে সেই গান দুটির রেকর্ড প্রকাশ করে এবং নানা অনুষ্ঠানে গেয়ে এপার বাংলার জনসাধারণকে বাংলাদেশের আমার ভাইবোনদের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি একটু সহানুভূতিশীল করে তুলতে পারি।’ সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কথা রেখেছিলেন। কয়েক দিন পরে দুটো গান লিখে ও স্বরলিপি করে তিনি পাঠিয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে।
শান্তিনিকেতনি গায়ন পদ্ধতি অনুসরণ না করে সুর কাঠামো বজায় রেখে আত্মোপলব্ধি দিয়ে স্বাধীনভাবে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার কারণে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের কাছে তিনি ব্রাত্য হয়েছেন বটে। কিন্তু সংগীতামোদী মানুষের কাছে পেয়েছেন অফুরান ভালোবাসা। এখনো রবীন্দ্রসংগীতের অন্যতম জনপ্রিয় ও অনুসরণীয় শিল্পী তিনি। তাঁর ভরাট গলায় গাওয়া ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’, ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’, ‘মহারাজ একি সাজে’ কিংবা ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘মেঘে ঢাকা তারা’ সিনেমায় গাওয়া ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’সহ অসংখ্য গান আজও শ্রোতাকে মুগ্ধ করে। শিল্পীর স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্য আমৃত্যু চেষ্টা তাঁকে শিল্পীদের মণিকোঠায় স্থান করে দিয়েছে।
১৯৮০ সালের ১৮ আগস্ট তাঁর চলে যাওয়া বাংলার সংগীতানুরাগী সাধারণ মানুষকেও করেছিল শোকাহত। তাঁর মৃত্যু নিয়ে তাঁর এক সময়ের কক্ষসঙ্গী ও শিল্পী সন্তোষ সেনগুপ্ত লিখছেন, “আমাদের দুর্ভাগ্য, সারা দেশের দুর্ভাগ্য যে দেবব্রত বিশ্বাস আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। কিন্তু কী সে যাওয়া-কী সে মহিমান্বিত নিষ্ক্রমণ-অগণিত জনতার আকুল ক্রন্দনধ্বনি-আকুল হাহাকার যেন তারই গানের রূপ নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। ”
বিদ্যুৎ সরকার: শিক্ষক ও সংগীত শিল্পী
ভারতে এক জুনিয়র আইনজীবীর ওভারটাইম কাজের পরদিন অফিসে দেরিতে হবে জানিয়ে একটি বার্তা পাঠান সিনিয়র আইনজীবীকে। বার্তাটি সহজভাবে নেননি সিনিয়র আইনজীবী। তিনি প্রকাশ্য জুনিয়র আইনজীবীর সমালোচনা করেছেন। এতে দেশটিতে কর্মস্থলের সংস্কৃতি নিয়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে।
৪ ঘণ্টা আগেচলতি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সিডনি, মেলবোর্ন ও অ্যাডিলেডে কয়েকটি কনসার্ট করেছেন। ফিরেই ব্যস্ত হয়েছেন দেশের মঞ্চে। ১৫ নভেম্বর সেনা প্রাঙ্গণে গেয়েছেন ‘ঢাকা রেট্রো’ কনসার্টে। এবার জেমস জানালেন নতুন খবর।
৭ ঘণ্টা আগেচার দশকের বেশি সময় ধরে সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন আমির খান। মনপ্রাণ দিয়ে এত দিন শুধু কাজই করে গেছেন মিস্টার পারফেকশনিস্ট। কাজের ব্যস্ততায় পরিবারের দিকে খেয়াল রাখার তেমন সুযোগ পাননি। ফলে সন্তানদের সঙ্গে তাঁর এক ধরনের দূরত্ব রয়ে গেছে। এই দূরত্ব দূর করতে উদ্যোগী হয়েছেন আমিরকন্যা ইরা খান। বাবাকে নিয়ে মানস
৮ ঘণ্টা আগেসত্যজিৎ রায়, ‘পথের পাঁচালী’, অপু ও দুর্গা—যেন ইতিহাসের একই সুতোয় বাঁধা। সত্যজিৎ রায় যেমন মনে গেঁথে আছে সিনেমাপ্রেমী মানুষের মনে, তেমনি আছে কিশোরী দুর্গা। সেই কিশোরী চরিত্রটিতে যিনি অভিনয় করেছিলেন তিনি উমা। পুরো নাম উমা দাশগুপ্ত। ওই একটি মাত্র সিনেমাতেই অভিনয় করেছিলেন তিনি, আর তাতেই পেয়েছেন জগৎজোড়া..
১১ ঘণ্টা আগে