দেউলিয়া ঝুঁকিতে বিশ্বের ৭ অর্থনীতি, বাংলাদেশের পরিস্থিতি কী

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ২১: ৪৫

জাতিসংঘের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ২০২২ সালে বলেছিলেন, ৫০টি দরিদ্র দেশ দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। দেউলিয়া হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে— উচ্চ মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি সংকট এবং ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা। ইউএনডিপি প্রধান আচিম স্টেইনারের বিবৃতি আজও প্রাসঙ্গিক, কারণ বেশ কয়েকটি দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে, আবার অনেকেই দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। 

ভারতীয় সম্প্রচার মাধ্যম সিএনবিসি টিভি১৮ দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছে। এই তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশও। 

পাকিস্তান 
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পাকিস্তানকে আপাতত দেউলিয়া অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছে কিন্তু দেশটির অর্থনীতি এখনো ভঙ্গুর। ২০২৩ সালে আইএমএফের দেওয়া ৩ মার্কিন বিলিয়ন ডলারের ঋণসহায়তা দেশটিকে দেউলিয়া এড়াতে পারে, তবে রাজনৈতিক সংকটে থাকা দেশটির এ বছর আরও একটি ঋণসহায়তা প্রয়োজন। 

সর্বশেষ আইএমএফ ৭ বিলিয়ন ডলারের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ সাহারা মরুভূমিতে এক বিন্দু জলের মতোই। কারণ দেশটির মোট আয়কর রাজস্বের অন্তত ৬০ শতাংশ পুরোনো ঋণ পরিশোধেই যাবে। ২০২৪ সালের মে মাসে আইএমএফ অনুমান করেছিল, ২০২৯ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের অন্তত ১২৩ বিলিয়ন ডলারের বাহ্যিক অর্থ সহায়তার প্রয়োজন হবে। দেশের জিডিপি ২০২২ সালে ৩৭৫ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৩-২৪ সালে ৩৭৪ দশমিক ৯০৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। 

অর্থনীতি নিম্নমুখী হওয়া সত্ত্বেও আগস্টে দেশটির মুদ্রাস্ফীতি ৯৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের আগে পাকিস্তানের জনগণকে আরও অর্থকষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। ২০২২ সালের এপ্রিলের পর প্রথমবারের মতো দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে উঠেছে, তবে এর মধ্যে আইএমএফের ১ বিলিয়ন ডলারের ট্রাঞ্চ রয়েছে। কিন্তু এই রিজার্ভ পাকিস্তানের তিন মাসের আমদানি ব্যয়ও মেটাতে পারবে না। 

শ্রীলঙ্কা
শ্রীলঙ্কার মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলারে নেমে এলে ২০২২ সালের এপ্রিলে ৮৩ বিলিয়ন ডলারের দেউলিয়ায় পড়ে দ্বীপরাষ্ট্রটি। তবে পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে। দেশটির ফরেক্স রিজার্ভ এখন ৫ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। 

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি ছিল ৬৭ শতাংশ, যা ২০২৪ সালের আগস্টে কমে মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ হয়েছে। ২০১৭ সালে দেশটির জিডিপি প্রায় ৯৪ বিলিয়ন ছিল। কিন্তু সেটি ২০২৩ সালে হঠাৎ কমে ৮৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে নামে। তবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুনে শ্রীলঙ্কার জিডিপি বেড়েছে। 

২০২২ এবং ২০২৩ সালে অর্থনীতি ৯ দশমিক ৫ শতাংশ সংকোচনের পরে স্থিতিশীল হয়েছে। যা হোক, ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য এবং ঋণের বাধ্যবাধকতার কারণে দেশটি স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরতে জটিলতার মধ্যে পড়তে পারে। দুই বছর আগে শ্রীলঙ্কার ঋণ খেলাপি হয়েছে। সেপ্টেম্বরে দেশটি ১২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পুনর্গঠনের জন্য ঋণদাতাদের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে। ঋণদাতারা চুক্তির অংশ হিসাবে ২৭ শতাংশ নেবে। 

বাংলাদেশ 
বাংলাদেশের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫৬ বিলিয়ন ডলার, যা ২০০৮ সালের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি। এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের মতো বিশ্বব্যাপী রেটিং এজেন্সিগুলো বাংলাদেশকে ‘জাঙ্ক’ বা আস্তাকুঁড় হিসাবে চিহ্নিত করেছে। সর্বশেষ রাজনৈতিক সংকট ও ক্ষমতার পটপরিবর্তনের আগেও বাংলাদেশের ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধের সক্ষমতা নিম্নগামী ছিল। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ৩২ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক গত কয়েক বছরে টাকার অবমূল্যায়ন করেছে, কিন্তু এই পদক্ষেপ এখনো পর্যন্ত কোনো কাজে আসেনি। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ধারণা করছে, খাদ্যদ্রব্যর দাম বৃদ্ধির কারণে ২০২৫ সালে মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ১ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ঋণখেলাপি বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকে তারল্য সংকটের আশঙ্কাও রয়েছে। এখনই কোনো ঋণ সংকট না থাকলেও অর্থনীতির অবনতি ঘটছে এবং এর দ্রুত সমাধান প্রয়োজন। আইএমএফ অনুমোদিত ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কিছুটা শক্তি দিয়েছে, যা পরিশোধ করতে ২০২৬ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে। 

ভেনেজুয়েলা 
ইতিহাসের এক সময়ে ল্যাটিন আমেরিকার সবচেয়ে ধনী দেশ ছিল ভেনেজুয়েলা। তবে নিকোলাস মাদুরোর নিয়ন্ত্রণমূলক শাসন ব্যবস্থায় দেশটি দেউলিয়া হয়ে গেছে। দেশটি ২০১৭ সালে খেলাপি শুরু করে। বর্তমানে মোট ঋণ ১৫৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। জিডিপি ২০১২ সালে ৩৭২ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন থেকে কমে ২০২৪ সালে ১০৩ দশমিক ৩৩ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। 

মাদুরো চলতি বছরের জুলাই মাসে বিতর্কিত নির্বাচনে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। এর প্রভাব পড়ে অর্থনীতির ওপর। দেশটির অর্থনীতি গত বছর ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল এবং এই বছর ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। দেশটির এই অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা আংশিকভাবে দায়ী। তেলসমৃদ্ধ দেশটি ঋণ পুনর্গঠনের জন্যও আলোচনায় রয়েছে। 

ভেনেজুয়েলার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, মুদ্রাস্ফীতি ক্রমহ্রাসমান হলেও দেশটির ৮২ শতাংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে। এক বছরের আগের তুলনায় দ্রব্যমূল্যর দাম ২৫ শতাংশ বেড়েছে। 

আর্জেন্টিনা 
দক্ষিণ আমেরিকার দেশটি একবিংশ শতাব্দীতে এরই মধ্যে তিনবার ঋণখেলাপি করেছে। পাওনাদারদের কাছে আর্জেন্টিনার ৪০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি পাওনা রয়েছে। সর্বশেষ ২০২৩ সালসহ অতীতে দেশটি বেশ কয়েকটি ঋণ পুনর্গঠন করেছে। প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের মিলির সংস্কারকালে আট মাসে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি ৩০০ শতাংশ থেকে ২৩৬ শতাংশে নেমেছে। কিন্তু এটি এখনো স্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতি হারের চেয়ে অনেক বেশি। দেশটির অর্থনীতিও ধীরে ধীরে বড় হতে শুরু করেছে। তবে দারিদ্র্যের মাত্রা ৫২ দশমিক ৩ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। অক্সফোর্ড ইকোনমিকস বলছে, অনিশ্চিত অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ২০২৫ এবং ২০২৭ সালে আর্জেন্টিনার আবারও দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা ৭৫ শতাংশ। 

জাম্বিয়া
দক্ষিণ আফ্রিকার দেশটি ২০২০ সালে ইউরো বন্ড ঋণে খেলাপি করেছে। চলতি বছর ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন বাহ্যিক ঋণ পুনর্গঠনের জন্য প্রথম দেশ হয়ে উঠেছে জাম্বিয়া। কিন্তু দেশটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। দেশটির আন্তর্জাতিক বকেয়া স্টক ২০২৩ সালের মধ্যে জিডিপির ২৬ শতাংশে পৌঁছেছে। আইএমএফের ভাষ্যমতে, এটি টেকসই নয়। এ ছাড়াও দেশটি এখনো কমপক্ষে ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন বাণিজ্যিক ঋণ পুনর্গঠন করতে পারেনি। আইএমএফ বলছে, বাণিজ্যিক ঋণ পুনর্গঠনে ব্যর্থতা এবং ২০২৪ সালের ঋণ পুনর্গঠন চুক্তির কিছু ধারা জাম্বিয়াকে আরেকটি খেলাপির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে। 

ঘানা
আফ্রিকার দেশটির মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪ বিলিয়ন ডলার, যা মোট জিডিপির ৭০ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশটি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক ঋণে খেলাপি করে অর্থনীতিকে সংকটে ফেলেছে। ঋণের খরচ ও মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। ঘানার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের ৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ২০২৩ সালে ৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। 

দেশটির অর্থনীতি এখন পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত জিডিপি বৃদ্ধির গড় ৫ দশমিক ৮ শতাংশ ছিল। ২০২২ সাল থেকে মুদ্রাস্ফীতি সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। আইএমএফ বলছে, ২০২৩ সালের মে মাসে অনুমোদিত ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণসহায়তা দেশটির অর্থনীতিকে সাহায্য করেছে। সম্প্রতি ২৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পুনর্গঠন চুক্তিতে পৌঁছানোর পর দেশটির সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলে মনে হচ্ছে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চুক্তির অংশ হিসেবে ঋণদাতারা ঋণের ৪০ শতাংশ ছেড়ে দেবে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত