কুদ্দুস আফ্রাদ
করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যমে একধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে সাংবাদিকদের চাকরি সুরক্ষাসহ নিরাপত্তা। কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর অন্য পেশাজীবীরা যতটা সুরক্ষায় অবস্থান করে পেশার দায়িত্ব পালন অব্যাহত রেখেছেন, সে তুলনায় সাংবাদিকদের নিরাপত্তা খুবই সামান্য। তার মধ্যে আবার হুটহাট ছাঁটাই বা বেতন কমিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও লক্ষ করা যাচ্ছে। এসব কারণে সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিকদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। করোনার বর্তমান পরিস্থিতির বাইরেও বিগত কয়েক দশক ধরে নানা কারণে সংবাদমাধ্যম বা মিডিয়ায় একধরনের অস্থিরতা চলছে। এই অস্থিরতার অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে ইলেকট্রনিক ডিভাইস সাংবাদিকতা বা ডিজিটাল মিডিয়া। তার সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে উন্মুক্ত (সম্পাদনাবিহীন) সংবাদমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। যদিও গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যমের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বড় চ্যালেঞ্জ নয়; চ্যালেঞ্জ হচ্ছে উপযুক্ত সময়ে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ দ্রুত সরবরাহ বা প্রচার করা। বিশ্বাসহীন সংবাদের প্রতি মানুষের আগ্রহ সাময়িক এবং ব্যাপ্তিকালও খুব দীর্ঘায়িত হয় না। তবে উত্তেজনা বাড়াতে এ ধরনের সংবাদের জুড়ি নেই। গত এক যুগ ধরে মূলত এসব বিষয় নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে, গবেষণা হয়েছে, চিন্তার চালাচালিও হয়েছে বিস্তর। এখনো হচ্ছে। তার মধ্যেই সংবাদপত্র এগিয়ে যাচ্ছে, টিকেও রয়েছে। আধুনিক বিশ্বে, যেখানে সমস্ত কিছু ডিজিটালাইজেশনের আওতায় চলে গেছে, সেখানেও সংবাদপত্রের ডিজিটাল ভার্সনের পাশাপাশি প্রিন্ট এডিশন চলছে। তবে প্রিন্টের প্রচার-প্রভাব কিছুটা শ্লথ হয়েছে বটে।
সত্যি কথা হচ্ছে, সংবাদপত্রের প্রিন্ট এডিশনের প্রভাব এখন আর আগের মতো একচ্ছত্র নেই। না হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। ইলেকট্রনিক ডিভাইসের বিভিন্ন আঙ্গিকে সংবাদ এখন বিনা মূল্যে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে পাঠক বা দর্শকের দোরগোড়ায়। এসব সংবাদের বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্যতা থাকুক আর না-ই থাকুক, পাঠক ও দর্শকের কাছে সংবাদের দ্রুত উপস্থিতিটা বড় করে দেখা হচ্ছে। তা ছাড়া এই সংবাদ পাওয়ার জন্য বাড়তি টাকাও খরচ করতে হচ্ছে না। যেমন—অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও টেলিভিশন। এ দুই মাধ্যমেই টেক্সট ও ভিজ্যুয়াল সংবাদ পাওয়া যায় বিনা মূল্যে। তবে সমস্যা হলো, এ দুই মাধ্যমেই প্রিন্টের মতো বিস্তারিত সংবাদের অনুপস্থিতি পাঠক ও দর্শকের তুষ্টি পূরণে অক্ষম।
মনকাড়া প্রেজেন্টেশনেরও অভাব রয়েছে। পর্যালোচনামূলক সংবাদও থাকে কম। তার পরেও ভিজ্যুয়াল সংবাদমাধ্যমের কারণে একধরনের চাপের মুখে পড়েছে প্রিন্ট ভার্সন। প্রিন্ট ভার্সনের সার্কুলেশন কমে গেছে। কমে গেছে বিজ্ঞাপনও। বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বাবদ আয় কমে যাওয়ার কারণে মোটা বেতনের অভিজ্ঞ সাংবাদিকের সংখ্যাও হ্রাস করা হয়েছে সংবাদপত্র থেকে। ফলে একটি সংবাদপত্রের পাঠকেরা অভিজ্ঞতালব্ধ বিচক্ষণ সংবাদকর্মীর সেবা থেকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনিভাবে সুসময়-দুঃসময়ে রাষ্ট্র বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত দিকনির্দেশনা থেকে।
একটি ঘটনার কথা বলি। বছর দশেক আগের ঘটনা। ভারতের এক বনেদি সংবাদগোষ্ঠীর কর্ণধার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে ঢাকায় এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার ঘণ্টা দেড়েক একান্ত আলোচনা হয়েছিল। সেই এক-দেড় ঘণ্টায় সংবাদপত্র নিয়ে তাঁর কিছু চিন্তা তিনি শেয়ার করেছিলেন। তিনি জানালেন, তাঁর পরিবারের ব্যবসা বলতে ‘সংবাদ বিক্রি’ করা ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসা নেই। কিছুটা হাস্যরস করে আমাকে বলেছিলেন, ‘আমরা খবর বেচে ভাত খাই। সাংবাদিকদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করি।’ তাদের গ্রুপে বাংলা-ইংরেজি দুটি দৈনিকসহ ১৮-২০টি গণমাধ্যম রয়েছে। তার মধ্যে সংবাদপত্রের (প্রিন্ট) ব্যবসাই মুখ্য। বছর বিশেক আগে যখন ডিজিটালের ঢেউ দক্ষিণ এশিয়ায় মাত্র স্পর্শ করেছে, তখনই তিনি শঙ্কিত হয়ে পড়েন। কেননা, বেশ দাপটের সঙ্গেই পৌনে এক শতক ধরে তাঁরা সংবাদপত্রের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ডিজিটাল, বিশেষ করে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের আগমনে তিনি শঙ্কিত হন তাঁদের দীর্ঘদিনের সংবাদপত্রের ব্যবসা নিয়ে। এই অবস্থায় ডিজিটালের নতুন দুনিয়ায় তাঁদের ব্যবসা ও প্রভাব ধরে রাখতে তিনিও সিদ্ধান্ত নিলেন সেই পথে পা বাড়ানোর। প্রথমে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের ব্যবসা বুঝতে তিনি এক টিভি ব্যবসায়ীর পার্টনার হন। সেই টিভি চ্যানেল তখন পর্যন্ত সংবাদ প্রচারে যায়নি, কেবল বিনোদন অনুষ্ঠান প্রচারেই সীমাবদ্ধ ছিল। সংবাদগোষ্ঠীর নতুন এই পার্টনারকে সঙ্গে পেয়ে ওই টিভি চ্যানেল সংবাদ প্রচারে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেয়। শুরু হয় সংবাদ প্রচার। তিনিও পরীক্ষা চালাতে থাকেন টিভিতে কী ধরনের নিউজ প্রচার হবে আর সংবাদপত্রের কন্টেইনে কী পরিবর্তন করতে হবে।
পরবর্তী দু-তিন বছরেই তিনি নিশ্চিত হলেন যে দুটোই চলবে, যদি দক্ষ হাতে পরিচালনা করা সম্ভব হয়। তিনি দেখলেন, প্রিন্ট ভার্সনের দালিলিক মূল্য রয়েছে, যা ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিকে ততটা নেই। আবার এটাও দেখেছেন, ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক ভার্সনে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয়, যা প্রিন্ট ভার্সনের ক্ষেত্রে বিলম্ব ঘটে। সংবাদগোষ্ঠীর ওই কর্ণধার বললেন, প্রিন্টের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া খুবই শক্তিশালী হয়। তাঁর আশঙ্কা ছিল, এক-দুই দশক পরে প্রিন্ট সংবাদের ভেল্যু কমে আসবে। কিন্তু তিনি দেখলেন, কন্টেইন পরিবর্তন, অনুসন্ধানী ও ডেপ্থ নিউজ বাড়ানোর পর প্রিন্টের ভেল্যু আরও বেড়ে গেছে। তাঁর মতে, সেই সঙ্গে লেখার চিরাচরিত শৈলী ও মেকআপে আধুনিকতা ও সংবাদ বাছাইয়ে দক্ষতা দেখানো সম্ভব হলে প্রিন্ট ভার্সনের অপরিহার্যতা থেকেই যাবে। সংবাদগোষ্ঠীর ওই কর্ণধার পরে অবশ্য সংবাদপত্রের পাশাপাশি নিজেই চার–পাঁচটি স্যাটেলাইট টিভি, রেডিও ও ডিজিটাল নিউজ পোর্টালের ব্যবসায় নেমে পড়েন। তবে সাম্প্রতিক করোনাভাইরাসের দুর্যোগে তাঁদের অনেক সংবাদপ্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে হয়েছেন বলে শুনেছি।
আরেকটি ঘটনার কথা বলি। বছর চারেক আগের কথা। কলকাতা প্রেসক্লাবে সেখানকার একজন বিশিষ্ট সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁকে আমি যতটা জানি, বার্তা বিভাগে কলকাতায় যে কজন দাপুটে সাংবাদিক রয়েছেন, তিনি তাঁদের একজন হিসেবে সমাদৃত। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, ঢাকায় কীভাবে অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো টিকে রয়েছে কিংবা এসব নিউজ পোর্টালের আয়-ব্যয় কেমন ইত্যাদি। আমার জবাব ঠিক নয়, ধারণা শুনে তিনি জানালেন যে কলকাতায় এসব সম্ভব নয়। তাঁর কথা, কলকাতায় বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী একাধিক সংবাদপত্র, টেলিভিশন, নিউজ পোর্টালে লগ্নি করলেও কোনোটিই শেষমেশ টিকে থাকতে পারেনি। বরং সংবাদগোষ্ঠীর কাগজই হোক আর টেলিভিশন, তারাই টিকে আছে। পরে জেনেছি, তিনি নিজেও একটি নিউজ পোর্টাল করেছিলেন, কিন্তু সেটি বেশিকাল স্থায়িত্ব পায়নি।
এ দুটি ঘটনার প্রসঙ্গ এ জন্যই এখানে টানা হলো, গণমাধ্যম পরিচালনায় মূলত বড় বিনিয়োগ করা হলেই টিকিয়ে রাখা যায় না। দরকার অভিজ্ঞতার এবং অভিজ্ঞতালব্ধ একঝাঁক চিন্তাশীল সাংবাদিকের যৌথ টিমওয়ার্কের। ডিজিটাল যুগে সংবাদপত্র সংকুচিত হয়েছে বটে, কিন্তু দক্ষ সম্পাদকের নেতৃত্বে যদি নিউজ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়, নতুনত্ব থাকে, তাহলেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। তা ডিজিটাল হোক আর ননডিজিটাল, সংবাদপত্র এগোবেই। কেননা, সংবাদ হচ্ছে মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও চিন্তা-বিশ্লেষণের শক্তি। সংবাদ হচ্ছে জীবনের চালিকাশক্তি।
কুদ্দুস আফ্রাদ
সাংবাদিক
করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যমে একধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে সাংবাদিকদের চাকরি সুরক্ষাসহ নিরাপত্তা। কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর অন্য পেশাজীবীরা যতটা সুরক্ষায় অবস্থান করে পেশার দায়িত্ব পালন অব্যাহত রেখেছেন, সে তুলনায় সাংবাদিকদের নিরাপত্তা খুবই সামান্য। তার মধ্যে আবার হুটহাট ছাঁটাই বা বেতন কমিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও লক্ষ করা যাচ্ছে। এসব কারণে সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিকদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। করোনার বর্তমান পরিস্থিতির বাইরেও বিগত কয়েক দশক ধরে নানা কারণে সংবাদমাধ্যম বা মিডিয়ায় একধরনের অস্থিরতা চলছে। এই অস্থিরতার অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে ইলেকট্রনিক ডিভাইস সাংবাদিকতা বা ডিজিটাল মিডিয়া। তার সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে উন্মুক্ত (সম্পাদনাবিহীন) সংবাদমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। যদিও গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যমের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বড় চ্যালেঞ্জ নয়; চ্যালেঞ্জ হচ্ছে উপযুক্ত সময়ে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ দ্রুত সরবরাহ বা প্রচার করা। বিশ্বাসহীন সংবাদের প্রতি মানুষের আগ্রহ সাময়িক এবং ব্যাপ্তিকালও খুব দীর্ঘায়িত হয় না। তবে উত্তেজনা বাড়াতে এ ধরনের সংবাদের জুড়ি নেই। গত এক যুগ ধরে মূলত এসব বিষয় নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে, গবেষণা হয়েছে, চিন্তার চালাচালিও হয়েছে বিস্তর। এখনো হচ্ছে। তার মধ্যেই সংবাদপত্র এগিয়ে যাচ্ছে, টিকেও রয়েছে। আধুনিক বিশ্বে, যেখানে সমস্ত কিছু ডিজিটালাইজেশনের আওতায় চলে গেছে, সেখানেও সংবাদপত্রের ডিজিটাল ভার্সনের পাশাপাশি প্রিন্ট এডিশন চলছে। তবে প্রিন্টের প্রচার-প্রভাব কিছুটা শ্লথ হয়েছে বটে।
সত্যি কথা হচ্ছে, সংবাদপত্রের প্রিন্ট এডিশনের প্রভাব এখন আর আগের মতো একচ্ছত্র নেই। না হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। ইলেকট্রনিক ডিভাইসের বিভিন্ন আঙ্গিকে সংবাদ এখন বিনা মূল্যে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে পাঠক বা দর্শকের দোরগোড়ায়। এসব সংবাদের বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্যতা থাকুক আর না-ই থাকুক, পাঠক ও দর্শকের কাছে সংবাদের দ্রুত উপস্থিতিটা বড় করে দেখা হচ্ছে। তা ছাড়া এই সংবাদ পাওয়ার জন্য বাড়তি টাকাও খরচ করতে হচ্ছে না। যেমন—অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও টেলিভিশন। এ দুই মাধ্যমেই টেক্সট ও ভিজ্যুয়াল সংবাদ পাওয়া যায় বিনা মূল্যে। তবে সমস্যা হলো, এ দুই মাধ্যমেই প্রিন্টের মতো বিস্তারিত সংবাদের অনুপস্থিতি পাঠক ও দর্শকের তুষ্টি পূরণে অক্ষম।
মনকাড়া প্রেজেন্টেশনেরও অভাব রয়েছে। পর্যালোচনামূলক সংবাদও থাকে কম। তার পরেও ভিজ্যুয়াল সংবাদমাধ্যমের কারণে একধরনের চাপের মুখে পড়েছে প্রিন্ট ভার্সন। প্রিন্ট ভার্সনের সার্কুলেশন কমে গেছে। কমে গেছে বিজ্ঞাপনও। বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বাবদ আয় কমে যাওয়ার কারণে মোটা বেতনের অভিজ্ঞ সাংবাদিকের সংখ্যাও হ্রাস করা হয়েছে সংবাদপত্র থেকে। ফলে একটি সংবাদপত্রের পাঠকেরা অভিজ্ঞতালব্ধ বিচক্ষণ সংবাদকর্মীর সেবা থেকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনিভাবে সুসময়-দুঃসময়ে রাষ্ট্র বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত দিকনির্দেশনা থেকে।
একটি ঘটনার কথা বলি। বছর দশেক আগের ঘটনা। ভারতের এক বনেদি সংবাদগোষ্ঠীর কর্ণধার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে ঢাকায় এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার ঘণ্টা দেড়েক একান্ত আলোচনা হয়েছিল। সেই এক-দেড় ঘণ্টায় সংবাদপত্র নিয়ে তাঁর কিছু চিন্তা তিনি শেয়ার করেছিলেন। তিনি জানালেন, তাঁর পরিবারের ব্যবসা বলতে ‘সংবাদ বিক্রি’ করা ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসা নেই। কিছুটা হাস্যরস করে আমাকে বলেছিলেন, ‘আমরা খবর বেচে ভাত খাই। সাংবাদিকদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করি।’ তাদের গ্রুপে বাংলা-ইংরেজি দুটি দৈনিকসহ ১৮-২০টি গণমাধ্যম রয়েছে। তার মধ্যে সংবাদপত্রের (প্রিন্ট) ব্যবসাই মুখ্য। বছর বিশেক আগে যখন ডিজিটালের ঢেউ দক্ষিণ এশিয়ায় মাত্র স্পর্শ করেছে, তখনই তিনি শঙ্কিত হয়ে পড়েন। কেননা, বেশ দাপটের সঙ্গেই পৌনে এক শতক ধরে তাঁরা সংবাদপত্রের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ডিজিটাল, বিশেষ করে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের আগমনে তিনি শঙ্কিত হন তাঁদের দীর্ঘদিনের সংবাদপত্রের ব্যবসা নিয়ে। এই অবস্থায় ডিজিটালের নতুন দুনিয়ায় তাঁদের ব্যবসা ও প্রভাব ধরে রাখতে তিনিও সিদ্ধান্ত নিলেন সেই পথে পা বাড়ানোর। প্রথমে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের ব্যবসা বুঝতে তিনি এক টিভি ব্যবসায়ীর পার্টনার হন। সেই টিভি চ্যানেল তখন পর্যন্ত সংবাদ প্রচারে যায়নি, কেবল বিনোদন অনুষ্ঠান প্রচারেই সীমাবদ্ধ ছিল। সংবাদগোষ্ঠীর নতুন এই পার্টনারকে সঙ্গে পেয়ে ওই টিভি চ্যানেল সংবাদ প্রচারে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেয়। শুরু হয় সংবাদ প্রচার। তিনিও পরীক্ষা চালাতে থাকেন টিভিতে কী ধরনের নিউজ প্রচার হবে আর সংবাদপত্রের কন্টেইনে কী পরিবর্তন করতে হবে।
পরবর্তী দু-তিন বছরেই তিনি নিশ্চিত হলেন যে দুটোই চলবে, যদি দক্ষ হাতে পরিচালনা করা সম্ভব হয়। তিনি দেখলেন, প্রিন্ট ভার্সনের দালিলিক মূল্য রয়েছে, যা ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিকে ততটা নেই। আবার এটাও দেখেছেন, ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক ভার্সনে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয়, যা প্রিন্ট ভার্সনের ক্ষেত্রে বিলম্ব ঘটে। সংবাদগোষ্ঠীর ওই কর্ণধার বললেন, প্রিন্টের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া খুবই শক্তিশালী হয়। তাঁর আশঙ্কা ছিল, এক-দুই দশক পরে প্রিন্ট সংবাদের ভেল্যু কমে আসবে। কিন্তু তিনি দেখলেন, কন্টেইন পরিবর্তন, অনুসন্ধানী ও ডেপ্থ নিউজ বাড়ানোর পর প্রিন্টের ভেল্যু আরও বেড়ে গেছে। তাঁর মতে, সেই সঙ্গে লেখার চিরাচরিত শৈলী ও মেকআপে আধুনিকতা ও সংবাদ বাছাইয়ে দক্ষতা দেখানো সম্ভব হলে প্রিন্ট ভার্সনের অপরিহার্যতা থেকেই যাবে। সংবাদগোষ্ঠীর ওই কর্ণধার পরে অবশ্য সংবাদপত্রের পাশাপাশি নিজেই চার–পাঁচটি স্যাটেলাইট টিভি, রেডিও ও ডিজিটাল নিউজ পোর্টালের ব্যবসায় নেমে পড়েন। তবে সাম্প্রতিক করোনাভাইরাসের দুর্যোগে তাঁদের অনেক সংবাদপ্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে হয়েছেন বলে শুনেছি।
আরেকটি ঘটনার কথা বলি। বছর চারেক আগের কথা। কলকাতা প্রেসক্লাবে সেখানকার একজন বিশিষ্ট সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁকে আমি যতটা জানি, বার্তা বিভাগে কলকাতায় যে কজন দাপুটে সাংবাদিক রয়েছেন, তিনি তাঁদের একজন হিসেবে সমাদৃত। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, ঢাকায় কীভাবে অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো টিকে রয়েছে কিংবা এসব নিউজ পোর্টালের আয়-ব্যয় কেমন ইত্যাদি। আমার জবাব ঠিক নয়, ধারণা শুনে তিনি জানালেন যে কলকাতায় এসব সম্ভব নয়। তাঁর কথা, কলকাতায় বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী একাধিক সংবাদপত্র, টেলিভিশন, নিউজ পোর্টালে লগ্নি করলেও কোনোটিই শেষমেশ টিকে থাকতে পারেনি। বরং সংবাদগোষ্ঠীর কাগজই হোক আর টেলিভিশন, তারাই টিকে আছে। পরে জেনেছি, তিনি নিজেও একটি নিউজ পোর্টাল করেছিলেন, কিন্তু সেটি বেশিকাল স্থায়িত্ব পায়নি।
এ দুটি ঘটনার প্রসঙ্গ এ জন্যই এখানে টানা হলো, গণমাধ্যম পরিচালনায় মূলত বড় বিনিয়োগ করা হলেই টিকিয়ে রাখা যায় না। দরকার অভিজ্ঞতার এবং অভিজ্ঞতালব্ধ একঝাঁক চিন্তাশীল সাংবাদিকের যৌথ টিমওয়ার্কের। ডিজিটাল যুগে সংবাদপত্র সংকুচিত হয়েছে বটে, কিন্তু দক্ষ সম্পাদকের নেতৃত্বে যদি নিউজ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়, নতুনত্ব থাকে, তাহলেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। তা ডিজিটাল হোক আর ননডিজিটাল, সংবাদপত্র এগোবেই। কেননা, সংবাদ হচ্ছে মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও চিন্তা-বিশ্লেষণের শক্তি। সংবাদ হচ্ছে জীবনের চালিকাশক্তি।
কুদ্দুস আফ্রাদ
সাংবাদিক
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪