ডা. শুভাগত চৌধুরী
গত ৫০ বছরে স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে নানা উল্লেখযোগ্য অর্জন। এ জন্য পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যে রোল মডেল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন শিশুস্বাস্থ্য উন্নতিতে নজরকাড়া। স্বাধীনতার সময় শিশুমৃত্যুর হার ছিল ১৪ দশমিক ১। এখন তা ২.১। অর্থাৎ শিশুমৃত্যুর হার কমেছে ৮৫ শতাংশ।
বঙ্গবন্ধু প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বাস্তবায়নের যে রূপরেখা দিয়েছিলেন, তাতে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ইউনিয়ন সাবসেন্টারের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা থানা পর্যায়ে প্রসারিত হয়েছে। আর বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে তা কমিউনিটি ক্লিনিকে পর্যবসিত হয়েছে। এসবের মাধ্যমে করোনাকালে দ্রুত মানুষকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত আটটি মেডিকেল কলেজ, একটি স্নাতকোত্তর মেডিকেল ইনস্টিটিউট, ৩৭টি যক্ষ্মা ক্লিনিক, ১৫১টি গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ৯১টি মাতৃ ও শিশুকল্যাণকেন্দ্রের মাধ্যমে জনগণকে সেবা দেওয়া শুরু করে ৫০ বছরে সংখ্যা শুধু বাড়েইনি, এসেছে নতুন নতুন সাফল্য।
সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি শিশুস্বাস্থ্য রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। ১৯৭৯ সালে শুরু হয় ইপিআই কর্মসূচি। ১৯৯৫ সালে পোলিও নির্মূল এবং মা ও নবজাতকের ধনুষ্টঙ্কার নির্মূল কর্মসূচি শুরু হয়।
২০০৩ সালে শুরু হয় হেপাটাইটিস বি টিকা দেওয়া। ২০১২ সালে এমআর টিকা এবং হামের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া শুরু হয়। ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থো থেকে পোলিও নির্মূল সনদ পায় বাংলাদেশ।
২০১৯ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ টিকার ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্যের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ হিসেবে পুরস্কৃত করে।
দেশে মাতৃমৃত্যুর হার ১৬৫। অর্থাৎ এক লাখ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে ১৬৫ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। এসব মৃত্যুর প্রধান কারণ প্রসবজনিত রক্তক্ষরণ। বাকি হলো খিঁচুনি। তবে এ মৃত্যুহার আরও কমানো উচিত।
বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যেও বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হলো ওআরএস উদ্ভাবন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ভারতেআশ্রয়নেওয়াবাংলাদেশের শরণার্থীদের জীবন রক্ষায় এর ব্যবহার ব্যাপক হয়েছিল। উদ্ভাবনের পর থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বের ৮ কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করেছে ওআরএস বা মুখে খাবার স্যালাইন। কলেরা, ডায়রিয়ায় মুখে খাবার স্যালাইন হলো মহৌষধ।
মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা স্বাস্থ্য। তাই এটি পাওয়া উচিত সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ‘কম খরচে ভালো স্বাস্থ্য’র জন্য বাংলাদেশ রোল মডেল। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমানো মানুষকে টিকার আওতায় আনা, যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ দূরীকরণ, গড় আয়ু বৃদ্ধি (নারীদের ৭৫ ও পুরুষের ৭১ গড় প্রত্যাশিত আয়ু) স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দেশের বড় সাফল্য।
দেশে–বিদেশে চিন্তাভাবনা থেকে জন্ম নিয়েছে ‘ইউনিভার্সেল হেলথ কেয়ার’ বা ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা’। আর এ জন্য সবাই একমত সরকারকে স্বাস্থ্য খাতে খরচ বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট এবার একটু বাড়ালেও সার্কের অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যে বাজেট বরাদ্দ সর্বনিম্ন (মাথাপিছু সরকারের ব্যয় সর্বনিম্ন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)।
‘হেলথ অ্যান্ড ওয়েলনেস’ হবে নতুন অঙ্গীকার। তৃণমূলে সরকারি সেবা যাবে বিনা খরচে ওষুধ ও কিছু পরীক্ষার ব্যবস্থা নিয়ে।
নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ বা অসংক্রামক রোগ দেশে যেমন বাড়ছে, তেমনি রোগ নিবারণ পদ্ধতির সম্প্রসারণ ও রোগ নির্ণয়ের ওপর গুরুত্ব বাড়বে। বাড়া উচিত।
আমাদের দেশে চালু করা উচিত স্বাস্থ্যবিমা। এতে গরিব মানুষ বেশি উপকার পাবে।
জাতীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের ক্ষমতা ও ব্যাপ্তি যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি আরও কয়েকটি জরুরি স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্র তৈরি করা প্রয়োজন। জনগণের সুস্বাস্থ্য ও কুশলে থাকা একটি বড় বিষয়। এ জন্য বায়ুদূষণ, পরিবেশদূষণ, নগরায়ণের সুপরিকল্পনা, গণপরিবহন এসব বিষয় থাকবে ভাবনায় আর এ জন্য কেবল স্বাস্থ্য খাতই নয়, প্রয়োজন বহু মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় বা মাল্টিসেক্টরাল অ্যাপ্রোচ।
আমাদের এক ঘাটতির দিক হলো স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা ও ব্যবস্থাপনার সংকট। সে সঙ্গে কেনাকাটাসহ কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি।
আমাদের গবেষণার ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে। এত দিন এই ক্ষেত্রটি ছিল অনাদরে। আশার বিষয়, প্রধানমন্ত্রী এবার চিকিৎসা গবেষণা খাতে গুরুত্ব অনুধাবন করে কিছু অর্থ বরাদ্দ দিয়েছেন।
মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দেশে কম, এদের বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ হেলথ ল্যাবের মূল প্রাণশক্তি এরা। অথচ এরা বেশ অবহেলিত। দক্ষ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বাড়ানোর জন্য আরও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা উচিত।
আর তথ্য-উপাত্ত আরও ডিজিটালাইজড করা উচিত। আমাদের তথ্য সংরক্ষণের সুবিধা থাকলেও ব্যবস্থাপনা দুর্বল। দেশে ৪টি শক্তিশালী ভাইরোলজি ল্যাব, মলিকুলার বায়োলজি ও জেনেটিক ল্যাব গড়ে তোলা উচিত। এক–একটি শক্তিশালী ল্যাব দেশের চার-পাঁচটি অঞ্চলে গড়ে তুললে ভালো।
বাংলাদেশে রয়েছে বিশাল ওষুধের বাজার। বাংলাদেশের ওষুধের বিরাট চাহিদা রয়েছে বিশ্বের নানা দেশে। ওষুধ নিয়ে গবেষণা ও ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা, সেই সঙ্গে উৎপাদন হলো সময়ের দাবি। কেবল তা-ই নয়, সংক্রামক রোগ, অসংক্রামক রোগ ছাড়াও দেশে অবহেলিত স্বাস্থ্য এপিডেমিওলজি, মানসিক স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে চাই গবেষণা।
চিকিৎসা গবেষণার বড় একটি চ্যালেঞ্জ হলো গবেষণার পেছনের মানুষ। তাঁদের গবেষণামুখী করতে হলে নিজের তাগিদ যেমন দরকার, তেমনি সরকারি আনুকূল্য, অর্থ বরাদ্দ আর অবিরাম গবেষণার জন্য উৎসাহিত করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত। গবেষণার ফল যেন দেশের নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলে, তা–ও দেখা উচিত।
আমাদের দেশে প্রতিবছর আনুমানিক ১০ হাজারের মতো শিক্ষার্থী বের হয়; এরা সেরাদের সেরা, চোখে তাদের জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বপ্ন ও দায়িত্ব। চিকিৎসা শিক্ষার মান, কারিকুলামের সময়োপযোগী মূল্যায়ন, নবায়ন, দক্ষ ও জনগণের সেবার জন্য প্রস্তুত চিকিৎসক তৈরি করা দরকার। তাঁরা কেবল যে জ্ঞানে ও হাতের কাজে দক্ষ হবেন তা নয়, তাঁরা লোকসমাজের সেবার মানসিকতা নিয়ে পেশাদারি চিকিৎসক হবেন। এ জন্য কমিউনিকেশন স্কিলে বেশি জোর দিতে হবে। তাদের জন্য বিশেষ আর্থিক বিবেচনা ও প্রণোদনা দরকার।
সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ বাড়ানো ও চিকিৎসক বাড়ানো জনবল সমস্যার সমাধান নয়, চাই মানসম্পন্ন চিকিৎসক। তাই এমন চিকিৎসক তৈরিতে যে যে শর্ত পূরণ দরকার, তা কঠোরভাবে দেখা উচিত।
আমাদের দেশে স্নাতকোত্তর শিক্ষা এখন স্নাতক প্রতিষ্ঠানেও হচ্ছে কিন্তু তা স্নাতকোত্তর শিক্ষার জন্য উপযোগী কি না, তার পুনর্মূল্যায়ন দরকার। গত সরকারের আমলে মেডিকেল কলেজে স্নাতকোত্তর শিক্ষা ঢালাওভাবে চালু হয়েছে। এর উপযোগিতা ও মূল্যায়ন এখন প্রয়োজন।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, এর বড় রকমের সংস্কার দরকার। এই অর্থবছরে প্রস্তাবিত মোট বাজেটের ৭ দশমিক ২ শতাংশ অর্থাৎ ২৯ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে সংস্কার প্রস্তাবে তেমন চমক নেই।
সন্তান জন্মের সময় নবজাতক ও মায়ের মৃত্যুঝুঁকি শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি। অসমতা ও বৈষম্যের চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ জননীতি ও স্বাস্থ্য জরিপে। প্রয়োজনীয় কৌশল গ্রহণ করে নারী–পুরুষ, ধনী–দরিদ্র এবং শিশুদের বৈষম্য দূর করা সম্ভব। স্বাস্থ্যকে জনগণের অধিকার হিসেবে বিবেচনা করলে সমাধানের উপায় সন্ধান সহজ হবে। সামাজিক সুরক্ষার সীমাবদ্ধতায় ৯ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যজনিত ব্যয় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়, ৫ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ নেমে যায় দারিদ্র্যসীমার নিচে, ৭ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে সম্পদ বিক্রি করে। এসব মানুষের অপুষ্ট, ক্লিষ্ট, ক্ষীণ কণ্ঠস্বর আমাদের ওপরতলায় পৌঁছালে তবেই সুবাতাস বইবে স্বাস্থ্য কুশলের অঙ্গনে।
ডা. শুভাগত চৌধুরী
সাবেক অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, ডিন, চিকিৎসা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক পরিচালক, ল্যাব সার্ভিস, বারডেম
গত ৫০ বছরে স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে নানা উল্লেখযোগ্য অর্জন। এ জন্য পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যে রোল মডেল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন শিশুস্বাস্থ্য উন্নতিতে নজরকাড়া। স্বাধীনতার সময় শিশুমৃত্যুর হার ছিল ১৪ দশমিক ১। এখন তা ২.১। অর্থাৎ শিশুমৃত্যুর হার কমেছে ৮৫ শতাংশ।
বঙ্গবন্ধু প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বাস্তবায়নের যে রূপরেখা দিয়েছিলেন, তাতে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ইউনিয়ন সাবসেন্টারের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা থানা পর্যায়ে প্রসারিত হয়েছে। আর বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে তা কমিউনিটি ক্লিনিকে পর্যবসিত হয়েছে। এসবের মাধ্যমে করোনাকালে দ্রুত মানুষকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত আটটি মেডিকেল কলেজ, একটি স্নাতকোত্তর মেডিকেল ইনস্টিটিউট, ৩৭টি যক্ষ্মা ক্লিনিক, ১৫১টি গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ৯১টি মাতৃ ও শিশুকল্যাণকেন্দ্রের মাধ্যমে জনগণকে সেবা দেওয়া শুরু করে ৫০ বছরে সংখ্যা শুধু বাড়েইনি, এসেছে নতুন নতুন সাফল্য।
সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি শিশুস্বাস্থ্য রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। ১৯৭৯ সালে শুরু হয় ইপিআই কর্মসূচি। ১৯৯৫ সালে পোলিও নির্মূল এবং মা ও নবজাতকের ধনুষ্টঙ্কার নির্মূল কর্মসূচি শুরু হয়।
২০০৩ সালে শুরু হয় হেপাটাইটিস বি টিকা দেওয়া। ২০১২ সালে এমআর টিকা এবং হামের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া শুরু হয়। ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থো থেকে পোলিও নির্মূল সনদ পায় বাংলাদেশ।
২০১৯ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ টিকার ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্যের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ হিসেবে পুরস্কৃত করে।
দেশে মাতৃমৃত্যুর হার ১৬৫। অর্থাৎ এক লাখ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে ১৬৫ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। এসব মৃত্যুর প্রধান কারণ প্রসবজনিত রক্তক্ষরণ। বাকি হলো খিঁচুনি। তবে এ মৃত্যুহার আরও কমানো উচিত।
বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যেও বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হলো ওআরএস উদ্ভাবন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ভারতেআশ্রয়নেওয়াবাংলাদেশের শরণার্থীদের জীবন রক্ষায় এর ব্যবহার ব্যাপক হয়েছিল। উদ্ভাবনের পর থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বের ৮ কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করেছে ওআরএস বা মুখে খাবার স্যালাইন। কলেরা, ডায়রিয়ায় মুখে খাবার স্যালাইন হলো মহৌষধ।
মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা স্বাস্থ্য। তাই এটি পাওয়া উচিত সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ‘কম খরচে ভালো স্বাস্থ্য’র জন্য বাংলাদেশ রোল মডেল। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমানো মানুষকে টিকার আওতায় আনা, যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ দূরীকরণ, গড় আয়ু বৃদ্ধি (নারীদের ৭৫ ও পুরুষের ৭১ গড় প্রত্যাশিত আয়ু) স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দেশের বড় সাফল্য।
দেশে–বিদেশে চিন্তাভাবনা থেকে জন্ম নিয়েছে ‘ইউনিভার্সেল হেলথ কেয়ার’ বা ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা’। আর এ জন্য সবাই একমত সরকারকে স্বাস্থ্য খাতে খরচ বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট এবার একটু বাড়ালেও সার্কের অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যে বাজেট বরাদ্দ সর্বনিম্ন (মাথাপিছু সরকারের ব্যয় সর্বনিম্ন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)।
‘হেলথ অ্যান্ড ওয়েলনেস’ হবে নতুন অঙ্গীকার। তৃণমূলে সরকারি সেবা যাবে বিনা খরচে ওষুধ ও কিছু পরীক্ষার ব্যবস্থা নিয়ে।
নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ বা অসংক্রামক রোগ দেশে যেমন বাড়ছে, তেমনি রোগ নিবারণ পদ্ধতির সম্প্রসারণ ও রোগ নির্ণয়ের ওপর গুরুত্ব বাড়বে। বাড়া উচিত।
আমাদের দেশে চালু করা উচিত স্বাস্থ্যবিমা। এতে গরিব মানুষ বেশি উপকার পাবে।
জাতীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের ক্ষমতা ও ব্যাপ্তি যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি আরও কয়েকটি জরুরি স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্র তৈরি করা প্রয়োজন। জনগণের সুস্বাস্থ্য ও কুশলে থাকা একটি বড় বিষয়। এ জন্য বায়ুদূষণ, পরিবেশদূষণ, নগরায়ণের সুপরিকল্পনা, গণপরিবহন এসব বিষয় থাকবে ভাবনায় আর এ জন্য কেবল স্বাস্থ্য খাতই নয়, প্রয়োজন বহু মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় বা মাল্টিসেক্টরাল অ্যাপ্রোচ।
আমাদের এক ঘাটতির দিক হলো স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা ও ব্যবস্থাপনার সংকট। সে সঙ্গে কেনাকাটাসহ কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি।
আমাদের গবেষণার ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে। এত দিন এই ক্ষেত্রটি ছিল অনাদরে। আশার বিষয়, প্রধানমন্ত্রী এবার চিকিৎসা গবেষণা খাতে গুরুত্ব অনুধাবন করে কিছু অর্থ বরাদ্দ দিয়েছেন।
মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দেশে কম, এদের বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ হেলথ ল্যাবের মূল প্রাণশক্তি এরা। অথচ এরা বেশ অবহেলিত। দক্ষ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বাড়ানোর জন্য আরও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা উচিত।
আর তথ্য-উপাত্ত আরও ডিজিটালাইজড করা উচিত। আমাদের তথ্য সংরক্ষণের সুবিধা থাকলেও ব্যবস্থাপনা দুর্বল। দেশে ৪টি শক্তিশালী ভাইরোলজি ল্যাব, মলিকুলার বায়োলজি ও জেনেটিক ল্যাব গড়ে তোলা উচিত। এক–একটি শক্তিশালী ল্যাব দেশের চার-পাঁচটি অঞ্চলে গড়ে তুললে ভালো।
বাংলাদেশে রয়েছে বিশাল ওষুধের বাজার। বাংলাদেশের ওষুধের বিরাট চাহিদা রয়েছে বিশ্বের নানা দেশে। ওষুধ নিয়ে গবেষণা ও ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা, সেই সঙ্গে উৎপাদন হলো সময়ের দাবি। কেবল তা-ই নয়, সংক্রামক রোগ, অসংক্রামক রোগ ছাড়াও দেশে অবহেলিত স্বাস্থ্য এপিডেমিওলজি, মানসিক স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে চাই গবেষণা।
চিকিৎসা গবেষণার বড় একটি চ্যালেঞ্জ হলো গবেষণার পেছনের মানুষ। তাঁদের গবেষণামুখী করতে হলে নিজের তাগিদ যেমন দরকার, তেমনি সরকারি আনুকূল্য, অর্থ বরাদ্দ আর অবিরাম গবেষণার জন্য উৎসাহিত করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত। গবেষণার ফল যেন দেশের নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলে, তা–ও দেখা উচিত।
আমাদের দেশে প্রতিবছর আনুমানিক ১০ হাজারের মতো শিক্ষার্থী বের হয়; এরা সেরাদের সেরা, চোখে তাদের জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বপ্ন ও দায়িত্ব। চিকিৎসা শিক্ষার মান, কারিকুলামের সময়োপযোগী মূল্যায়ন, নবায়ন, দক্ষ ও জনগণের সেবার জন্য প্রস্তুত চিকিৎসক তৈরি করা দরকার। তাঁরা কেবল যে জ্ঞানে ও হাতের কাজে দক্ষ হবেন তা নয়, তাঁরা লোকসমাজের সেবার মানসিকতা নিয়ে পেশাদারি চিকিৎসক হবেন। এ জন্য কমিউনিকেশন স্কিলে বেশি জোর দিতে হবে। তাদের জন্য বিশেষ আর্থিক বিবেচনা ও প্রণোদনা দরকার।
সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ বাড়ানো ও চিকিৎসক বাড়ানো জনবল সমস্যার সমাধান নয়, চাই মানসম্পন্ন চিকিৎসক। তাই এমন চিকিৎসক তৈরিতে যে যে শর্ত পূরণ দরকার, তা কঠোরভাবে দেখা উচিত।
আমাদের দেশে স্নাতকোত্তর শিক্ষা এখন স্নাতক প্রতিষ্ঠানেও হচ্ছে কিন্তু তা স্নাতকোত্তর শিক্ষার জন্য উপযোগী কি না, তার পুনর্মূল্যায়ন দরকার। গত সরকারের আমলে মেডিকেল কলেজে স্নাতকোত্তর শিক্ষা ঢালাওভাবে চালু হয়েছে। এর উপযোগিতা ও মূল্যায়ন এখন প্রয়োজন।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, এর বড় রকমের সংস্কার দরকার। এই অর্থবছরে প্রস্তাবিত মোট বাজেটের ৭ দশমিক ২ শতাংশ অর্থাৎ ২৯ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে সংস্কার প্রস্তাবে তেমন চমক নেই।
সন্তান জন্মের সময় নবজাতক ও মায়ের মৃত্যুঝুঁকি শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি। অসমতা ও বৈষম্যের চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ জননীতি ও স্বাস্থ্য জরিপে। প্রয়োজনীয় কৌশল গ্রহণ করে নারী–পুরুষ, ধনী–দরিদ্র এবং শিশুদের বৈষম্য দূর করা সম্ভব। স্বাস্থ্যকে জনগণের অধিকার হিসেবে বিবেচনা করলে সমাধানের উপায় সন্ধান সহজ হবে। সামাজিক সুরক্ষার সীমাবদ্ধতায় ৯ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যজনিত ব্যয় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়, ৫ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ নেমে যায় দারিদ্র্যসীমার নিচে, ৭ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে সম্পদ বিক্রি করে। এসব মানুষের অপুষ্ট, ক্লিষ্ট, ক্ষীণ কণ্ঠস্বর আমাদের ওপরতলায় পৌঁছালে তবেই সুবাতাস বইবে স্বাস্থ্য কুশলের অঙ্গনে।
ডা. শুভাগত চৌধুরী
সাবেক অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, ডিন, চিকিৎসা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক পরিচালক, ল্যাব সার্ভিস, বারডেম
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪