সাগর জামান
চির গর্বের শহর মাগুরা সংস্কৃতিচর্চা ও লালনের ক্ষেত্রে কখনো পিছিয়ে ছিল না। বরং বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে এ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে। সাবেক মহকুমা ও আজকের জেলা মাগুরার সে ঐতিহ্য আপন গরিমায় এখনো সমুজ্জ্বল। স্থানীয় বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান এ তৎপরতায় বিশেষ অবদান রেখেছেন। মাগুরা থিয়েটার, যা বর্তমানে মাগুরা টাউন হল নামে পরিচিত হয়েছে, তা ছিল মাগুরার সাংস্কৃতিক চর্চার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।
স্থানীয় বিজ্ঞ আইনজীবীদের উৎসাহ, পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রত্যক্ষ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠান তখন নিত্য উপহার দিত রকমারি নাটক ও অনুষ্ঠানাদি। সে চর্চা চলছে দীর্ঘদিন। সে স্বর্ণযুগের অভিনেতাদের মধ্যে হরিশচন্দ্র দত্ত, দুর্গাদাস গাঙ্গুলি, ভোলানাথ শিকদার, প্রশান্ত কুমার, নরেশ চক্রবর্তী, পবিত্র দাশগুপ্ত, জগবন্ধু হালদারসহ অনেকেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। এ ছাড়া খান জিয়াউল হক, আ. ছামাদ কাঠু মিয়া, সমরেশ রায় চৌধুরী, পুলিশ কর্মকর্তা কাঞ্চন ঘোষাল, সদরুল আলম পানু, আমিনুল ইসলাম চাঁদু, আবু জোহা পিকুল, কামরুল হুদা নীহার, কাজী কাওহার ওরফে কাজীর বেটা, শান্তিপদ শিকদার (আঠারখাদা), আ. মান্নান, মরহুম তাতো ভাই প্রমুখ ছিলেন টাউন হল রঙ্গমঞ্চের প্রাণ ও শক্তি।
মাগুরার পার্শ্ববর্তী নিজনান্দুয়ালী গ্রামের মরহুম শাহজাহান সরদারের প্রচেষ্টায় নতুন বাজার এলাকায় যাত্রার আঙ্গিকে অভিনয় প্রদর্শনী সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে চাঙা রাখতে সহায়ক ছিল। পূজা–পার্বণ বা বিভিন্ন উৎসব ঘিরে আঠারখাদা, নিজনান্দুয়ালী, নতুন বাজারে বিরাট আয়োজনে মাতিয়ে তুলত শাহজাহান সরদারের সরস্বতী অপেরা। মাখনলাল অধিকারী, শান্তিপদ শিকদার, নতুন বাজারের ডি এন কুরী, সুধীর ঘোষ, আঠারখাদার নিমুদাসহ আরও অনেকের সফল অভিনয় আজও স্মৃতি হয়ে আছে। তাঁদের অনেকেই পরে টাউন হলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন।
মাগুরা শহরের জামরুলতলা নামক স্থানও ছিল নাট্য প্রদর্শনীর অন্যতম স্থান। প্রয়াত কালীপদ বৈদ্য, সবদার মোল্লা, তারাপদ ভৌমিক ওরফে তারা কুরী, রণজিৎ কুমার মহরার, শিবুপদ ওরফে শিবুরাণী, শামসুল বারী প্রমুখ প্রাণবন্ত অভিনয়ে দর্শক মাতিয়ে রাখতেন।
মাগুরা জেলা সদরের সরকারি বালিকা বিদ্যালয়টি যখন মহকুমা মাগুরা শহরের একমাত্র বালিকা বিদ্যালয় ছিল, তখনকার সাংস্কৃতিক তৎপরতায় এ প্রতিষ্ঠানের ছিল গৌরবময় ভূমিকা। নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি শুধু শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে ‘রামের সুমতি’, ‘বিন্দুর ছেলে’ ইত্যাদি নাটকের সফল মঞ্চায়ন সে সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ছিল দুঃসাহসিক বিজয়। লক্ষ্মীরানী সাহা, আকলীমা খাতুন, দীপালি, জলি, পলি, বিজলি, বুলু, নাজমা ছিলেন এই বিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম সৈনিক। বিজলির নাচ বর্তমান মাগুরার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আলতাফ হোসেনের স্ত্রী জলির (প্রয়াত) অভিনয় ও সংগীত, মরহুম সৈয়দ আতর আলীর মেয়ে বুলু ও পুত্রবধূ নাজমার আবৃত্তি ও অভিনয়ের কথা আজও বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে মুখে ফেরে।
ষাটের দশকে জাতীয় জীবনের নানা টানাপোড়েনের কারণে মাগুরার বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীরা ভীষণভাবে আলোড়িত হন। এ সময় মাগুরা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মহাবিদ্যালয় সাংস্কৃতিক চর্চার প্রধান কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়। অধ্যাপক অসিত বরণ ঘোষ, অধ্যাপক এবাদত হোসেন ও কাজী সাইফুজ্জামানের চেষ্টায় সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের বিভিন্ন বিভাগ সমৃদ্ধ হতে থাকে। নববর্ষ উদ্যাপন, বসন্তবরণ, ২৫ বৈশাখ, ১১ জ্যৈষ্ঠ স্মরণ–প্রভৃতির মাধ্যমে নিজেদের স্বরূপ অন্বেষণে মাগুরাবাসী সচেতন থেকেছেন। তখনকার ছাত্র সংসদের ভূমিকা ছিল গৌরবময়। এসব কাজে অধ্যাপক অসিত বরণ ঘোষের সহযোদ্ধা ছিলেন অধ্যাপক আবদুল আলিম, অধ্যাপক আসাদুজ্জামান, অধ্যাপক আবদুল আলিম, অধ্যাপক আবদুস সেলিম, অধ্যাপক সেকেন্দার আলী প্রমুখ।
এ সময়ের আগে মাগুরা আরও একজন গুণীজনকে পেয়েছিল। তিনি তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক আসাফউদ্দৌলা। তাঁর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সরকারি প্রতিষ্ঠান আর্ট কাউন্সিল ও ললিতকলা গড়ে ওঠে। পরে ললিতকলার নাম নিয়ে স্থানীয় সংস্কৃতিসেবীদের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই ‘আখেলী ললিতকলা’ ও ‘মাগুরা ললিতকলা বিদ্যাপীঠ’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান যাত্রা করে।
স্বাধীনতা-উত্তর সত্তরেরর দশকে মাগুরার সাংস্কৃতিক পরিসর নতুন করে জেগে ওঠে। সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী লেখক—সবার চেষ্টায় এ দুই প্রতিষ্ঠান একীভূত হয়। সবার সম্মতিতে এর নাম দেওয়া হয় ‘মাগুরা ললিতকলা শিল্পী সংস্থা’। এ সময় সম্ভাবনাময় শিল্পীদের পদচারণে মুখর ছিল মাগুরা। শিল্পী না হয়েও আলী তারেক এ সংস্থার জন্য করেছেন প্রাণান্ত পরিশ্রম।
আশির দশকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপিত হলো শিল্পকলা পরিষদ, পরে নাম হয় শিল্পকলা একাডেমি। নোমানী ময়দানে শিল্পকলা একাডেমির জন্য জায়গা বরাদ্দ হয়। ভবন নির্মিত হলে ললিতকলা শিল্পী সংস্থার শিল্পীরা শিল্পকলায় মিশে গেলেন। আসাদুজ্জামান, খান জিয়াউল হক, চণ্ডী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, শতদল রায়, ধীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মধু বাবু, আবু জাফর, নজরুল ইসলাম টগর, ফকরুল ইসলাম তুরাণ, মোসাদ্দেক আলী মিন্টু, চৌধুরী ফেন্সি খালেদা বিউটি, সবিতা চট্টোপাধ্যায়, গৌর শিকদার, লীনা, রানি, শরিফ আমিরুল হাসান বুলু, মোস্তফা মাকুল, আলী তারেক সাইদুর রহমান, মিহির লাল কুরী ও নাজমুল হাসান লাভেন শিল্পকলা একাডেমিকে গতিশীল করতে এগিয়ে আসেন। শিল্পকলা একাডেমি প্রাথমিক সময়ে একটি নাটক ও কয়েকটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপহার দিয়েছিল। কর্তৃত্বের পালাবদলে শিল্পকলা একাডেমি ক্রমেই প্রাণহীন নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
মাগুরার সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে মাগুরা প্রেসক্লাব গৌরবময় ভূমিকা রেখেছে। এ ক্ষেত্রে দীপক রায় চৌধুরী, খান গোলাম মোস্তফা মাকুল, শরীফ আমিরুল হাসান বুলু, অধ্যাপক সাইদুর রহমান, অধ্যাপক মিহির লাল কুরীর ভূমিকা স্মরণযোগ্য।
মহকুমা আমলে নাট্যকর্মে একসময় উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন জাহিদুল ইসলাম বাকু। তাঁর উদ্যোগ ও আয়োজনে মঞ্চস্থ হয়েছে একাধিক নাটক। মাগুরার সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে আরও সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে সাংবাদিক শরীফ আমিরুল হাসান বুলু নৃত্যকলায় শিল্পী সৃষ্টিতে ছিলেন তৎপর। এ ক্ষেত্রে তাঁকে সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়েছে। হাফিজ খান, বীথি, রীতা খান প্রমুখ ছিলেন এ তৎপরতার অন্যতম সহযোগী। শুধু তা–ই নয়, তাঁর প্রচেষ্টার ফসল মাগুরার আসাফউদ্দৌলা বাহার আজ বাংলাদেশ আনসারের সাংস্কৃতিক দলের অন্যতম নৃত্যশিল্পী।
১৯৮৫ সালের ৮ জানুয়ারি বিবেক মজুমদার, রোমিও জালালী, মিয়া ওয়াহিদ কামাল বাবলু, ভোলানাথ শিকদার প্রমুখের চেষ্টায় গড়ে ওঠে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। কিন্তু পাঁচ বছরের মাথায় নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব শুরু হলে ভেঙে যায় সংগঠনটি। এ সময় বিবেক মজুমদারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে প্রত্যয় সাংস্কৃতিক সংসদ। অন্যদিকে বিকাশ মজুমদার, আসাদ, আশিস বিশ্বাস প্রমুখের চেষ্টায় আবার গড়ে ওঠে উদীচী। একই দশকে আলোড়ন সৃষ্টি করা আরেক সংগঠন মাগুরা জেলা সাহিত্য সংসদ। খান গোলাম মোস্তফা মাকুল, বিবেক মজুমদার, আমির হোসেন খানের গড়ে তোলা এ সংগঠন অসংখ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
মাগুরা জেলার মহম্মদপুর থানার প্রয়াত নরেন্দ্রনাথ সিংহ দীর্ঘদিন ভারতে থেকে অবশেষে মাগুরায় ফিরে আসেন। শহরের ঋষিপাড়ায় তিনি স্থাপন করেন ‘মাগুরা সংগীত একাডেমি’। মাগুরার একসময়ের সংস্কৃতিমনা পুলিশ সুপার জহুরুল হক তাঁর কার্যকালে প্রতিবছর পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে মাগুরায় আয়োজন করতেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। সবাই অপেক্ষায় থাকতেন সেই অনুষ্ঠান উপভোগের জন্য। স্থানীয় ও বহিরাগত শিল্পীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানের বিশাল আয়োজন হতো কালেক্টরেট ভবনের উত্তর দিকের চত্বরে। ওই প্রাঙ্গণের উত্তরের ভবনগুলো (বর্তমানে আদালত) পুলিশ লাইনসের ব্যারাক হিসেবে তখন ব্যবহার হতো।
১৯৯৩ সালের ১৫ আগস্ট নজরুল ইসলাম টগর, শামীম আহমেদ খানের উদ্যোগে মাগুরায় গঠিত হয় বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক পরিষদ। মাগুরার নাট্যাঙ্গনের ভূমিকা বেশ জোরালো হয় নব্বইয়ের দশকে। ডায়মন্ড থিয়েটারের আবুবাসার আখন্দ, মাগুরা থিয়েটারের এম এইচ রহমান শিবলু, অনন্যার উজ্জ্বল, নবান্ন থিয়েটারের রূপম ও থিয়েটার ইউনিটের শফিক এ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন। মাগুরা কালেক্টরেট ক্লাবও নাটক মঞ্চায়নের ধারা অব্যাহত রেখেছে। জেলায় ব্যান্ড সংগীতের যাত্রা হয় পারফেক্ট ব্যান্ডগোষ্ঠীর হাত ধরে। মাগুরার সাংস্কৃতিক অঙ্গন সব সময় গতিশীল। উত্থান-পতন তো সব ক্ষেত্রেই থাকে। এ ক্ষেত্রেও ছিল এবং আছে। কিন্তু বারবারই শিল্পী ও শিল্পপ্রেমীরা ফের জাগিয়ে তুলেছেন মাগুরার সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে।
সাগর জামান, কবি ও লেখক
চির গর্বের শহর মাগুরা সংস্কৃতিচর্চা ও লালনের ক্ষেত্রে কখনো পিছিয়ে ছিল না। বরং বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে এ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে। সাবেক মহকুমা ও আজকের জেলা মাগুরার সে ঐতিহ্য আপন গরিমায় এখনো সমুজ্জ্বল। স্থানীয় বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান এ তৎপরতায় বিশেষ অবদান রেখেছেন। মাগুরা থিয়েটার, যা বর্তমানে মাগুরা টাউন হল নামে পরিচিত হয়েছে, তা ছিল মাগুরার সাংস্কৃতিক চর্চার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।
স্থানীয় বিজ্ঞ আইনজীবীদের উৎসাহ, পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রত্যক্ষ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠান তখন নিত্য উপহার দিত রকমারি নাটক ও অনুষ্ঠানাদি। সে চর্চা চলছে দীর্ঘদিন। সে স্বর্ণযুগের অভিনেতাদের মধ্যে হরিশচন্দ্র দত্ত, দুর্গাদাস গাঙ্গুলি, ভোলানাথ শিকদার, প্রশান্ত কুমার, নরেশ চক্রবর্তী, পবিত্র দাশগুপ্ত, জগবন্ধু হালদারসহ অনেকেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। এ ছাড়া খান জিয়াউল হক, আ. ছামাদ কাঠু মিয়া, সমরেশ রায় চৌধুরী, পুলিশ কর্মকর্তা কাঞ্চন ঘোষাল, সদরুল আলম পানু, আমিনুল ইসলাম চাঁদু, আবু জোহা পিকুল, কামরুল হুদা নীহার, কাজী কাওহার ওরফে কাজীর বেটা, শান্তিপদ শিকদার (আঠারখাদা), আ. মান্নান, মরহুম তাতো ভাই প্রমুখ ছিলেন টাউন হল রঙ্গমঞ্চের প্রাণ ও শক্তি।
মাগুরার পার্শ্ববর্তী নিজনান্দুয়ালী গ্রামের মরহুম শাহজাহান সরদারের প্রচেষ্টায় নতুন বাজার এলাকায় যাত্রার আঙ্গিকে অভিনয় প্রদর্শনী সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে চাঙা রাখতে সহায়ক ছিল। পূজা–পার্বণ বা বিভিন্ন উৎসব ঘিরে আঠারখাদা, নিজনান্দুয়ালী, নতুন বাজারে বিরাট আয়োজনে মাতিয়ে তুলত শাহজাহান সরদারের সরস্বতী অপেরা। মাখনলাল অধিকারী, শান্তিপদ শিকদার, নতুন বাজারের ডি এন কুরী, সুধীর ঘোষ, আঠারখাদার নিমুদাসহ আরও অনেকের সফল অভিনয় আজও স্মৃতি হয়ে আছে। তাঁদের অনেকেই পরে টাউন হলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন।
মাগুরা শহরের জামরুলতলা নামক স্থানও ছিল নাট্য প্রদর্শনীর অন্যতম স্থান। প্রয়াত কালীপদ বৈদ্য, সবদার মোল্লা, তারাপদ ভৌমিক ওরফে তারা কুরী, রণজিৎ কুমার মহরার, শিবুপদ ওরফে শিবুরাণী, শামসুল বারী প্রমুখ প্রাণবন্ত অভিনয়ে দর্শক মাতিয়ে রাখতেন।
মাগুরা জেলা সদরের সরকারি বালিকা বিদ্যালয়টি যখন মহকুমা মাগুরা শহরের একমাত্র বালিকা বিদ্যালয় ছিল, তখনকার সাংস্কৃতিক তৎপরতায় এ প্রতিষ্ঠানের ছিল গৌরবময় ভূমিকা। নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি শুধু শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে ‘রামের সুমতি’, ‘বিন্দুর ছেলে’ ইত্যাদি নাটকের সফল মঞ্চায়ন সে সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ছিল দুঃসাহসিক বিজয়। লক্ষ্মীরানী সাহা, আকলীমা খাতুন, দীপালি, জলি, পলি, বিজলি, বুলু, নাজমা ছিলেন এই বিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম সৈনিক। বিজলির নাচ বর্তমান মাগুরার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আলতাফ হোসেনের স্ত্রী জলির (প্রয়াত) অভিনয় ও সংগীত, মরহুম সৈয়দ আতর আলীর মেয়ে বুলু ও পুত্রবধূ নাজমার আবৃত্তি ও অভিনয়ের কথা আজও বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে মুখে ফেরে।
ষাটের দশকে জাতীয় জীবনের নানা টানাপোড়েনের কারণে মাগুরার বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীরা ভীষণভাবে আলোড়িত হন। এ সময় মাগুরা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মহাবিদ্যালয় সাংস্কৃতিক চর্চার প্রধান কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়। অধ্যাপক অসিত বরণ ঘোষ, অধ্যাপক এবাদত হোসেন ও কাজী সাইফুজ্জামানের চেষ্টায় সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের বিভিন্ন বিভাগ সমৃদ্ধ হতে থাকে। নববর্ষ উদ্যাপন, বসন্তবরণ, ২৫ বৈশাখ, ১১ জ্যৈষ্ঠ স্মরণ–প্রভৃতির মাধ্যমে নিজেদের স্বরূপ অন্বেষণে মাগুরাবাসী সচেতন থেকেছেন। তখনকার ছাত্র সংসদের ভূমিকা ছিল গৌরবময়। এসব কাজে অধ্যাপক অসিত বরণ ঘোষের সহযোদ্ধা ছিলেন অধ্যাপক আবদুল আলিম, অধ্যাপক আসাদুজ্জামান, অধ্যাপক আবদুল আলিম, অধ্যাপক আবদুস সেলিম, অধ্যাপক সেকেন্দার আলী প্রমুখ।
এ সময়ের আগে মাগুরা আরও একজন গুণীজনকে পেয়েছিল। তিনি তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক আসাফউদ্দৌলা। তাঁর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সরকারি প্রতিষ্ঠান আর্ট কাউন্সিল ও ললিতকলা গড়ে ওঠে। পরে ললিতকলার নাম নিয়ে স্থানীয় সংস্কৃতিসেবীদের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই ‘আখেলী ললিতকলা’ ও ‘মাগুরা ললিতকলা বিদ্যাপীঠ’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান যাত্রা করে।
স্বাধীনতা-উত্তর সত্তরেরর দশকে মাগুরার সাংস্কৃতিক পরিসর নতুন করে জেগে ওঠে। সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী লেখক—সবার চেষ্টায় এ দুই প্রতিষ্ঠান একীভূত হয়। সবার সম্মতিতে এর নাম দেওয়া হয় ‘মাগুরা ললিতকলা শিল্পী সংস্থা’। এ সময় সম্ভাবনাময় শিল্পীদের পদচারণে মুখর ছিল মাগুরা। শিল্পী না হয়েও আলী তারেক এ সংস্থার জন্য করেছেন প্রাণান্ত পরিশ্রম।
আশির দশকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপিত হলো শিল্পকলা পরিষদ, পরে নাম হয় শিল্পকলা একাডেমি। নোমানী ময়দানে শিল্পকলা একাডেমির জন্য জায়গা বরাদ্দ হয়। ভবন নির্মিত হলে ললিতকলা শিল্পী সংস্থার শিল্পীরা শিল্পকলায় মিশে গেলেন। আসাদুজ্জামান, খান জিয়াউল হক, চণ্ডী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, শতদল রায়, ধীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মধু বাবু, আবু জাফর, নজরুল ইসলাম টগর, ফকরুল ইসলাম তুরাণ, মোসাদ্দেক আলী মিন্টু, চৌধুরী ফেন্সি খালেদা বিউটি, সবিতা চট্টোপাধ্যায়, গৌর শিকদার, লীনা, রানি, শরিফ আমিরুল হাসান বুলু, মোস্তফা মাকুল, আলী তারেক সাইদুর রহমান, মিহির লাল কুরী ও নাজমুল হাসান লাভেন শিল্পকলা একাডেমিকে গতিশীল করতে এগিয়ে আসেন। শিল্পকলা একাডেমি প্রাথমিক সময়ে একটি নাটক ও কয়েকটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপহার দিয়েছিল। কর্তৃত্বের পালাবদলে শিল্পকলা একাডেমি ক্রমেই প্রাণহীন নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
মাগুরার সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে মাগুরা প্রেসক্লাব গৌরবময় ভূমিকা রেখেছে। এ ক্ষেত্রে দীপক রায় চৌধুরী, খান গোলাম মোস্তফা মাকুল, শরীফ আমিরুল হাসান বুলু, অধ্যাপক সাইদুর রহমান, অধ্যাপক মিহির লাল কুরীর ভূমিকা স্মরণযোগ্য।
মহকুমা আমলে নাট্যকর্মে একসময় উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন জাহিদুল ইসলাম বাকু। তাঁর উদ্যোগ ও আয়োজনে মঞ্চস্থ হয়েছে একাধিক নাটক। মাগুরার সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে আরও সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে সাংবাদিক শরীফ আমিরুল হাসান বুলু নৃত্যকলায় শিল্পী সৃষ্টিতে ছিলেন তৎপর। এ ক্ষেত্রে তাঁকে সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়েছে। হাফিজ খান, বীথি, রীতা খান প্রমুখ ছিলেন এ তৎপরতার অন্যতম সহযোগী। শুধু তা–ই নয়, তাঁর প্রচেষ্টার ফসল মাগুরার আসাফউদ্দৌলা বাহার আজ বাংলাদেশ আনসারের সাংস্কৃতিক দলের অন্যতম নৃত্যশিল্পী।
১৯৮৫ সালের ৮ জানুয়ারি বিবেক মজুমদার, রোমিও জালালী, মিয়া ওয়াহিদ কামাল বাবলু, ভোলানাথ শিকদার প্রমুখের চেষ্টায় গড়ে ওঠে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। কিন্তু পাঁচ বছরের মাথায় নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব শুরু হলে ভেঙে যায় সংগঠনটি। এ সময় বিবেক মজুমদারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে প্রত্যয় সাংস্কৃতিক সংসদ। অন্যদিকে বিকাশ মজুমদার, আসাদ, আশিস বিশ্বাস প্রমুখের চেষ্টায় আবার গড়ে ওঠে উদীচী। একই দশকে আলোড়ন সৃষ্টি করা আরেক সংগঠন মাগুরা জেলা সাহিত্য সংসদ। খান গোলাম মোস্তফা মাকুল, বিবেক মজুমদার, আমির হোসেন খানের গড়ে তোলা এ সংগঠন অসংখ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
মাগুরা জেলার মহম্মদপুর থানার প্রয়াত নরেন্দ্রনাথ সিংহ দীর্ঘদিন ভারতে থেকে অবশেষে মাগুরায় ফিরে আসেন। শহরের ঋষিপাড়ায় তিনি স্থাপন করেন ‘মাগুরা সংগীত একাডেমি’। মাগুরার একসময়ের সংস্কৃতিমনা পুলিশ সুপার জহুরুল হক তাঁর কার্যকালে প্রতিবছর পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে মাগুরায় আয়োজন করতেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। সবাই অপেক্ষায় থাকতেন সেই অনুষ্ঠান উপভোগের জন্য। স্থানীয় ও বহিরাগত শিল্পীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানের বিশাল আয়োজন হতো কালেক্টরেট ভবনের উত্তর দিকের চত্বরে। ওই প্রাঙ্গণের উত্তরের ভবনগুলো (বর্তমানে আদালত) পুলিশ লাইনসের ব্যারাক হিসেবে তখন ব্যবহার হতো।
১৯৯৩ সালের ১৫ আগস্ট নজরুল ইসলাম টগর, শামীম আহমেদ খানের উদ্যোগে মাগুরায় গঠিত হয় বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক পরিষদ। মাগুরার নাট্যাঙ্গনের ভূমিকা বেশ জোরালো হয় নব্বইয়ের দশকে। ডায়মন্ড থিয়েটারের আবুবাসার আখন্দ, মাগুরা থিয়েটারের এম এইচ রহমান শিবলু, অনন্যার উজ্জ্বল, নবান্ন থিয়েটারের রূপম ও থিয়েটার ইউনিটের শফিক এ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন। মাগুরা কালেক্টরেট ক্লাবও নাটক মঞ্চায়নের ধারা অব্যাহত রেখেছে। জেলায় ব্যান্ড সংগীতের যাত্রা হয় পারফেক্ট ব্যান্ডগোষ্ঠীর হাত ধরে। মাগুরার সাংস্কৃতিক অঙ্গন সব সময় গতিশীল। উত্থান-পতন তো সব ক্ষেত্রেই থাকে। এ ক্ষেত্রেও ছিল এবং আছে। কিন্তু বারবারই শিল্পী ও শিল্পপ্রেমীরা ফের জাগিয়ে তুলেছেন মাগুরার সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে।
সাগর জামান, কবি ও লেখক
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪