ড. মুহাম্মদ আজাদ খান
বাংলাদেশের ইতিহাস–ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁতশিল্পের ইতিহাস। তাঁতশিল্প আর তাঁতের শাড়ির ইতিহাস অতিপ্রাচীন। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কুটিরশিল্প বা লোকশিল্পও এটি। টাঙ্গাইল জেলার তাঁতশিল্প সেই সর্ববৃহৎ শিল্পেরই অংশীদার।
তাঁতশিল্পের ইতিহাস অনুসন্ধানে দেখা যায়, মেরোক্কো দেশীয় পর্যটক ইবনে বতুতা এবং চীনা পর্যটক হিউয়েন সাংয়ের ভ্রমণকাহিনিতে এ অঞ্চলের তাঁতশিল্প, কাপড় বুনন এবং তুলা থেকে সুতা তৈরির উল্লেখ আছে। গবেষক জেমস টেলরের লেখায় মির্জাপুর অঞ্চলে তুলা চাষ এবং তুলা থেকে সুতা কাটার কথা উল্লেখ আছে। বাপ্তা হাম্মাম ও নানাবিধ পাঁচমিশালী কাপড় বোনা হতো তুলার সুতায়। আর প্রাচীনকাল থেকে টাঙ্গাইল অঞ্চলের দক্ষ কারিগরেরা তাদের বংশপরম্পরায় তৈরি করছেন নানা জাতের কাপড়। টাঙ্গাইলের তাঁতিরা মসলিন শাড়ি বুনতেন বলে শোনা যায়। দিল্লির মোগল দরবার থেকে ব্রিটেনের রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত এই মসলিনের সমাদর ছিল। ব্রিটিশ বণিকদের ষড়যন্ত্র আর ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের অভিঘাতের শিকার হয়েছে মসলিন। কিন্তু তার সার্থক উত্তরাধিকার হয়ে আজও টিকে রয়েছে টাঙ্গাইলের জামদানি, বেনারসি ও তাঁতের শাড়ি। তাঁতশিল্প টাঙ্গাইলের অতিপ্রাচীন ঐতিহ্য, হাজার বছরের ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত।
বর্তমানে তাঁতশিল্পের বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে সুতা, বুনন ও কাপড়ে। টাঙ্গাইলের সফট সিল্ক ও কটন শাড়ি এখন সবার নজর কেড়েছে এর বুনন ও ডিজাইনের কারণে। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো পাড় বা কিনারের কারুকাজ। আবার তাঁতিরা তাঁতের শাড়ি ছাড়াও হালআমলের নানা রং ও ডিজাইনের থ্রিপিস, লুঙ্গি, গামছা, চাদর, ওড়না ইত্যাদি তৈরিতে সিদ্ধহস্ত।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, সনাতন ধর্মাবলম্বী বসাক সম্প্রদায় আদি তাঁতি, অর্থাৎ আদিকাল থেকেই এরা তন্তুবায় গোত্রের লোক। এরা সিন্ধু অববাহিকা থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শীদাবাদে আসে। মুর্শীদাবাদ থেকে রাজশাহী, রাজশাহী থেকে ঢাকার ধামরাই। এখানে আবহাওয়া, তাঁতের কাজ, কাঁচামাল ইত্যাদি ভালো হওয়ায় তারা পার্শ্ববর্তী এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই তাঁতিরা টাঙ্গাইলে এসে বসতি স্থাপন এবং কাজ শুরু করে। টাঙ্গাইলে বংশানুক্রমে যুগের পর যুগ তারা তাঁত বুনে আসছে। দক্ষিণ টাঙ্গাইল ও দেলদুয়ারের বেশির ভাগ এলাকাজুড়ে বসাক শ্রেণির তাঁতিদের বসবাস। কালের পরিক্রমায় বসাক ছাড়াও অন্যান্য সম্প্রদায়ের, বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরাও তাঁতশিল্পের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে এবং তারা বসাক তাঁতিদের মতোই দক্ষ হয়ে ওঠে। মুসলমান তাঁতিদের বলা হয় জোলা। আবার সনাতন যুগী বা যুঙ্গীরা তাঁতশিল্পে জড়িত। যুগীরা ক্ষৌম, গামছা, মশারি তৈরি করে প্রায় স্বাধীনভাবেই ব্যবসা চালায়। ক্ষৌম বস্ত্র বা মোটা কাপড় বোনার কাজে এদের একচেটিয়া অধিকার ছিল। এরা এখন বিলুপ্তপ্রায় বা পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় জড়িত। টাঙ্গাইলের কালিহাতী ও গোপালপুর এলাকায় জোলা ও যুগী সম্প্রদায়ের বসতি বিদ্যমান। এখন তাঁতশিল্পে হস্তচালিত তাঁতের সংখ্যা হাতে গোনা আর ব্যাপক সংখ্যায় শক্তিচালিত তাঁতের দেখা মেলে প্রায় সর্বত্রই।
টাঙ্গাইল জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে টাঙ্গাইল সদর, দেলদুয়ার, কালিহাতী, নাগরপুর, সখীপুর উপজেলা হচ্ছে তাঁতবহুল এলাকা। তাছাড়া ভূঞাপুর ও গোপালপুর উপজেলায়ও তাঁতশিল্প রয়েছে।
টাঙ্গাইল সদরের তাঁতবহুল গ্রামগুলো হচ্ছে বাজিতপুর, সুরুজ, বার্থা, ব্রাহ্মণকুশিয়া, ঘারিন্দা, গোসাইজোয়াইর, তারটিয়া, চণ্ডী, নলুয়া, দেওজান, এনায়েতপুর, বেলতা, গড়াসিন, সন্তোষ, নলসুন্দা, কাগমারী প্রভৃতি। কালিহাতী উপজেলার বল্লা, রামপুর প্রভৃতি। দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল, নলসুন্দা, চণ্ডী, বিষ্ণুপুর প্রভৃতি। এসব গ্রামে দিনরাত শোনা যায় মাকুর খটখট শব্দ। পাশাপাশি তাঁতিদের ব্যতিব্যস্ত নিরন্তর হাতে নিপুণ শাড়ি বোনার দৃশ্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। টাঙ্গাইলের তাঁতের সঙ্গে প্রায় পাঁচ লাখ লোকের জীবন জড়িত। আর সারা টাঙ্গাইলে তাঁত রয়েছে লক্ষাধিক। এই লক্ষাধিক তাঁতের সব কটিতেই আবার টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরি হয় না। টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী শাড়ি তৈরি হয় এরকম তাঁতের সংখ্যা ২০ হাজারেরও কম। আর এই ঐতিহ্যবাহী শাড়ি তৈরি হয় প্রধানত বাজিতপুর, পাথরাইল, নলসুন্দা, চণ্ডী, বিষ্ণপুর ও বিন্নাফৈর গ্রামে।
টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি তৈরি করতে হাতের কাজ করা হয় খুব দরদ দিয়ে, গভীর মনোসংযোগের সঙ্গে অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও সুদৃশ্যভাবে। পুরুষেরা তাঁত বোনে; আর চরকাকাটা, রং করা, জরির কাজে সহযোগিতা করে বাড়ির নরীরা।
টাঙ্গাইলের শাড়ির বৈশিষ্ট্য হলো পাড় বা কিনারের কারুকাজ। টাঙ্গাইলের শাড়ি বোনার তাঁত দুই ধরনের— (১) চিত্তরঞ্জন (মিহি) তাঁত, (২) পিটলুম (খটখটি) তাঁত। এ দুই ধরনের তাঁতেই তৈরি করা হয় নানা রং ও ডিজাইনের নানা নামের শাড়ি। যেমন—জামদানি বা সফ্ট সিল্ক, হাফ সিল্ক, টাঙ্গাইল বি.টি, বালুচরি, জরিপাড়, হাজারবুটি, সূতিপাড়, কটকি, স্বর্ণচূড়, ইককাত, আনারকলি, দেবদাস, কুমকুম, সানন্দা, নীলাম্বরী, ময়ুরকণ্ঠী এবং সাধারণ মানের শাড়ি।
শাড়ির বিভিন্ন নাম ও মান, হাতের কাজ, শাড়ির জমিনের রংভেদে দামও ভিন্ন রকম। সর্বনিম্ন ২০০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে জামদানি বা সফ্ট সিল্কের দাম সবচেয়ে বেশি। জামদানি শাড়ি তৈরি হয় আন্তর্জাতিক মানসম্পন্নভাবে। এই শাড়ি তৈরির জন্য তাঁতিরা ১০০ কাউন্টের জাপানি সুতা ব্যবহার করে থাকে। অবশ্য অন্যান্য শাড়ি তৈরি করতেও ১০০ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হলেও মাঝে মাঝে নারায়ণগঞ্জের সংযোগ শিল্পে প্রস্তুতকৃত ৮০, ৮২ ও ৮৪ কাউন্টের সুতাও ব্যবহার করে থাকে।
ভারতভাগের পূর্বে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির বাজার বসত কলকাতায়। এখনো এর প্রভাব আছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে টাঙ্গাইল তাঁতের প্রধান হাট হচ্ছে টাঙ্গাইলের বাজিতপুর এবং পরে করটিয়া। বাজিতপুর হাট টাঙ্গাইল মূল শহর থেকে দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত আর করটিয়া আট কিলোমিটার দক্ষিণে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কসংলগ্ন। বাজিতপুরে সপ্তাহের প্রতি সোম ও শুক্রবার হাট বসে আর করটিয়ার হাট বুধ-বৃহস্পতিবার। ভোররাত থেকে এখানে হাট শুরু হয়ে সকাল ৯-১০টা পর্যন্ত চলে। এই হাটের বেশির ভাগ ক্রেতাই মহাজন শ্রেণির। মহাজনদের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবেও এই হাট থেকে অনেকে পছন্দের শাড়ি কিনে নিয়ে যান।
ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশ, জাপান, সৌদি আরব, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যসহ পশ্চিম বাংলায় টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির ব্যাপক কদর থাকলেও এই শাড়ি আন্তর্জাতিক বাজারে মার খাচ্ছে নানা কারণে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—১. দামের জন্য (টাঙ্গাইল শাড়ি উৎপাদনে খরচ বেশি পড়ে যায়); ২. ভারতীয় শাড়ির আগ্রাসন (ভারতের শাড়ি দামে সস্তা); ৩. টাঙ্গাইল শাড়ির বিপণনব্যবস্থা মহাজনি চক্রের হাতে বন্দী; ৪. গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশ ও সাশ্রয়ী দাম। তাঁতশিল্পে সরকারের নীতিসহায়তা, আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা নেই বললেই চলে।
ঐতিহ্যপূর্ণ কারিগরি জ্ঞান ও নিষ্ঠা ছাড়া আসল টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরি করা যায় না। আসল টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরির জন্য এর তাঁতি বা কারিগরদের ‘শিল্পী’ হয়ে উঠতে হয়। টাঙ্গাইলে সেই শিল্পী তাঁতি আছেন। তাই টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প ও তাঁতের শাড়ির এত সুখ্যাতি এখনো বজায় আছে।
ড. মুহাম্মদ আজাদ খান
অধ্যাপক, কুমুদিনী সরকারি কলেজ
বাংলাদেশের ইতিহাস–ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁতশিল্পের ইতিহাস। তাঁতশিল্প আর তাঁতের শাড়ির ইতিহাস অতিপ্রাচীন। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কুটিরশিল্প বা লোকশিল্পও এটি। টাঙ্গাইল জেলার তাঁতশিল্প সেই সর্ববৃহৎ শিল্পেরই অংশীদার।
তাঁতশিল্পের ইতিহাস অনুসন্ধানে দেখা যায়, মেরোক্কো দেশীয় পর্যটক ইবনে বতুতা এবং চীনা পর্যটক হিউয়েন সাংয়ের ভ্রমণকাহিনিতে এ অঞ্চলের তাঁতশিল্প, কাপড় বুনন এবং তুলা থেকে সুতা তৈরির উল্লেখ আছে। গবেষক জেমস টেলরের লেখায় মির্জাপুর অঞ্চলে তুলা চাষ এবং তুলা থেকে সুতা কাটার কথা উল্লেখ আছে। বাপ্তা হাম্মাম ও নানাবিধ পাঁচমিশালী কাপড় বোনা হতো তুলার সুতায়। আর প্রাচীনকাল থেকে টাঙ্গাইল অঞ্চলের দক্ষ কারিগরেরা তাদের বংশপরম্পরায় তৈরি করছেন নানা জাতের কাপড়। টাঙ্গাইলের তাঁতিরা মসলিন শাড়ি বুনতেন বলে শোনা যায়। দিল্লির মোগল দরবার থেকে ব্রিটেনের রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত এই মসলিনের সমাদর ছিল। ব্রিটিশ বণিকদের ষড়যন্ত্র আর ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের অভিঘাতের শিকার হয়েছে মসলিন। কিন্তু তার সার্থক উত্তরাধিকার হয়ে আজও টিকে রয়েছে টাঙ্গাইলের জামদানি, বেনারসি ও তাঁতের শাড়ি। তাঁতশিল্প টাঙ্গাইলের অতিপ্রাচীন ঐতিহ্য, হাজার বছরের ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত।
বর্তমানে তাঁতশিল্পের বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে সুতা, বুনন ও কাপড়ে। টাঙ্গাইলের সফট সিল্ক ও কটন শাড়ি এখন সবার নজর কেড়েছে এর বুনন ও ডিজাইনের কারণে। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো পাড় বা কিনারের কারুকাজ। আবার তাঁতিরা তাঁতের শাড়ি ছাড়াও হালআমলের নানা রং ও ডিজাইনের থ্রিপিস, লুঙ্গি, গামছা, চাদর, ওড়না ইত্যাদি তৈরিতে সিদ্ধহস্ত।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, সনাতন ধর্মাবলম্বী বসাক সম্প্রদায় আদি তাঁতি, অর্থাৎ আদিকাল থেকেই এরা তন্তুবায় গোত্রের লোক। এরা সিন্ধু অববাহিকা থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শীদাবাদে আসে। মুর্শীদাবাদ থেকে রাজশাহী, রাজশাহী থেকে ঢাকার ধামরাই। এখানে আবহাওয়া, তাঁতের কাজ, কাঁচামাল ইত্যাদি ভালো হওয়ায় তারা পার্শ্ববর্তী এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই তাঁতিরা টাঙ্গাইলে এসে বসতি স্থাপন এবং কাজ শুরু করে। টাঙ্গাইলে বংশানুক্রমে যুগের পর যুগ তারা তাঁত বুনে আসছে। দক্ষিণ টাঙ্গাইল ও দেলদুয়ারের বেশির ভাগ এলাকাজুড়ে বসাক শ্রেণির তাঁতিদের বসবাস। কালের পরিক্রমায় বসাক ছাড়াও অন্যান্য সম্প্রদায়ের, বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরাও তাঁতশিল্পের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে এবং তারা বসাক তাঁতিদের মতোই দক্ষ হয়ে ওঠে। মুসলমান তাঁতিদের বলা হয় জোলা। আবার সনাতন যুগী বা যুঙ্গীরা তাঁতশিল্পে জড়িত। যুগীরা ক্ষৌম, গামছা, মশারি তৈরি করে প্রায় স্বাধীনভাবেই ব্যবসা চালায়। ক্ষৌম বস্ত্র বা মোটা কাপড় বোনার কাজে এদের একচেটিয়া অধিকার ছিল। এরা এখন বিলুপ্তপ্রায় বা পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় জড়িত। টাঙ্গাইলের কালিহাতী ও গোপালপুর এলাকায় জোলা ও যুগী সম্প্রদায়ের বসতি বিদ্যমান। এখন তাঁতশিল্পে হস্তচালিত তাঁতের সংখ্যা হাতে গোনা আর ব্যাপক সংখ্যায় শক্তিচালিত তাঁতের দেখা মেলে প্রায় সর্বত্রই।
টাঙ্গাইল জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে টাঙ্গাইল সদর, দেলদুয়ার, কালিহাতী, নাগরপুর, সখীপুর উপজেলা হচ্ছে তাঁতবহুল এলাকা। তাছাড়া ভূঞাপুর ও গোপালপুর উপজেলায়ও তাঁতশিল্প রয়েছে।
টাঙ্গাইল সদরের তাঁতবহুল গ্রামগুলো হচ্ছে বাজিতপুর, সুরুজ, বার্থা, ব্রাহ্মণকুশিয়া, ঘারিন্দা, গোসাইজোয়াইর, তারটিয়া, চণ্ডী, নলুয়া, দেওজান, এনায়েতপুর, বেলতা, গড়াসিন, সন্তোষ, নলসুন্দা, কাগমারী প্রভৃতি। কালিহাতী উপজেলার বল্লা, রামপুর প্রভৃতি। দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল, নলসুন্দা, চণ্ডী, বিষ্ণুপুর প্রভৃতি। এসব গ্রামে দিনরাত শোনা যায় মাকুর খটখট শব্দ। পাশাপাশি তাঁতিদের ব্যতিব্যস্ত নিরন্তর হাতে নিপুণ শাড়ি বোনার দৃশ্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। টাঙ্গাইলের তাঁতের সঙ্গে প্রায় পাঁচ লাখ লোকের জীবন জড়িত। আর সারা টাঙ্গাইলে তাঁত রয়েছে লক্ষাধিক। এই লক্ষাধিক তাঁতের সব কটিতেই আবার টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরি হয় না। টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী শাড়ি তৈরি হয় এরকম তাঁতের সংখ্যা ২০ হাজারেরও কম। আর এই ঐতিহ্যবাহী শাড়ি তৈরি হয় প্রধানত বাজিতপুর, পাথরাইল, নলসুন্দা, চণ্ডী, বিষ্ণপুর ও বিন্নাফৈর গ্রামে।
টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি তৈরি করতে হাতের কাজ করা হয় খুব দরদ দিয়ে, গভীর মনোসংযোগের সঙ্গে অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও সুদৃশ্যভাবে। পুরুষেরা তাঁত বোনে; আর চরকাকাটা, রং করা, জরির কাজে সহযোগিতা করে বাড়ির নরীরা।
টাঙ্গাইলের শাড়ির বৈশিষ্ট্য হলো পাড় বা কিনারের কারুকাজ। টাঙ্গাইলের শাড়ি বোনার তাঁত দুই ধরনের— (১) চিত্তরঞ্জন (মিহি) তাঁত, (২) পিটলুম (খটখটি) তাঁত। এ দুই ধরনের তাঁতেই তৈরি করা হয় নানা রং ও ডিজাইনের নানা নামের শাড়ি। যেমন—জামদানি বা সফ্ট সিল্ক, হাফ সিল্ক, টাঙ্গাইল বি.টি, বালুচরি, জরিপাড়, হাজারবুটি, সূতিপাড়, কটকি, স্বর্ণচূড়, ইককাত, আনারকলি, দেবদাস, কুমকুম, সানন্দা, নীলাম্বরী, ময়ুরকণ্ঠী এবং সাধারণ মানের শাড়ি।
শাড়ির বিভিন্ন নাম ও মান, হাতের কাজ, শাড়ির জমিনের রংভেদে দামও ভিন্ন রকম। সর্বনিম্ন ২০০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে জামদানি বা সফ্ট সিল্কের দাম সবচেয়ে বেশি। জামদানি শাড়ি তৈরি হয় আন্তর্জাতিক মানসম্পন্নভাবে। এই শাড়ি তৈরির জন্য তাঁতিরা ১০০ কাউন্টের জাপানি সুতা ব্যবহার করে থাকে। অবশ্য অন্যান্য শাড়ি তৈরি করতেও ১০০ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হলেও মাঝে মাঝে নারায়ণগঞ্জের সংযোগ শিল্পে প্রস্তুতকৃত ৮০, ৮২ ও ৮৪ কাউন্টের সুতাও ব্যবহার করে থাকে।
ভারতভাগের পূর্বে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির বাজার বসত কলকাতায়। এখনো এর প্রভাব আছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে টাঙ্গাইল তাঁতের প্রধান হাট হচ্ছে টাঙ্গাইলের বাজিতপুর এবং পরে করটিয়া। বাজিতপুর হাট টাঙ্গাইল মূল শহর থেকে দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত আর করটিয়া আট কিলোমিটার দক্ষিণে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কসংলগ্ন। বাজিতপুরে সপ্তাহের প্রতি সোম ও শুক্রবার হাট বসে আর করটিয়ার হাট বুধ-বৃহস্পতিবার। ভোররাত থেকে এখানে হাট শুরু হয়ে সকাল ৯-১০টা পর্যন্ত চলে। এই হাটের বেশির ভাগ ক্রেতাই মহাজন শ্রেণির। মহাজনদের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবেও এই হাট থেকে অনেকে পছন্দের শাড়ি কিনে নিয়ে যান।
ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশ, জাপান, সৌদি আরব, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যসহ পশ্চিম বাংলায় টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির ব্যাপক কদর থাকলেও এই শাড়ি আন্তর্জাতিক বাজারে মার খাচ্ছে নানা কারণে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—১. দামের জন্য (টাঙ্গাইল শাড়ি উৎপাদনে খরচ বেশি পড়ে যায়); ২. ভারতীয় শাড়ির আগ্রাসন (ভারতের শাড়ি দামে সস্তা); ৩. টাঙ্গাইল শাড়ির বিপণনব্যবস্থা মহাজনি চক্রের হাতে বন্দী; ৪. গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশ ও সাশ্রয়ী দাম। তাঁতশিল্পে সরকারের নীতিসহায়তা, আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা নেই বললেই চলে।
ঐতিহ্যপূর্ণ কারিগরি জ্ঞান ও নিষ্ঠা ছাড়া আসল টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরি করা যায় না। আসল টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরির জন্য এর তাঁতি বা কারিগরদের ‘শিল্পী’ হয়ে উঠতে হয়। টাঙ্গাইলে সেই শিল্পী তাঁতি আছেন। তাই টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প ও তাঁতের শাড়ির এত সুখ্যাতি এখনো বজায় আছে।
ড. মুহাম্মদ আজাদ খান
অধ্যাপক, কুমুদিনী সরকারি কলেজ
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪