উমর ফারুক
‘শোবার ঘরের সামনে একটুখানি খোলা ছাদ আছে, সেইখানে একটা শতরঞ্জি পাতিয়া রমেশ শয়ন করিল এবং নানা কথা ভাবিতে ভাবিতে ও হাতপাখার বাতাস খাইতে খাইতে গভীর রাত্রে ঘুমাইয়া পড়িল।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসের এই অংশ পাঠ করলে শতরঞ্জির নন্দন ও বিস্তার নিয়ে আর যা–ই হোক সংশয় থাকে না। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই শতরঞ্জি বহুজনকে নিজের গড়ন ও নকশায় মোহিত করার সঙ্গে সঙ্গে বহু লোকের জীবনের রংও বদলে দিয়েছে।
ময়না বেগমের কথাই ধরা যাক। আনুমানিক পঞ্চাশোর্ধ্ব এই নারী স্বামী হারিয়েছেন ২০০৮ সালে। চার ছেলে, দুই মেয়ের মধ্যে এক ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। অন্যদের কেউ প্রতিষ্ঠিত, আর কেউবা পড়ালেখা করছে। ঘাঘট নদীর গা ঘেঁষে রংপুর নগরী। ঘাঘট এখন যৌবন হারিয়ে মৌসুমি নদী। বর্ষায় থইথই করে জল, শীতে শুষ্ক। এই নদীর পারেই নিসবেতগঞ্জ গ্রাম, যেখানে বাড়ি ময়না বেগমের। একদিন যাওয়া হলো এই ময়না বেগমের বাড়ি।
নিসবেতগঞ্জ গ্রামে ঢুকতেই তাঁতের দেখা মিলল। চারদিকের ব্যস্ত মানুষদের পাশ কাটিয়ে পিচঢালা পথ ধরে একসময় পৌঁছে গেলাম ময়না বেগমের বাড়িতে। বাড়ির বাইরে শিশুরা ঘুড়ি বানাতে ব্যস্ত। ভেতরে তাঁতের শব্দ। আমাদের স্বাগত জানাতে ময়না আপা বেরিয়ে এলেন। বাড়িতে ঢুকেই চোখে পড়ল, আঙিনাজুড়ে সারি সারি তাঁত। কয়েকজন নারীকে কর্মব্যস্ত দেখা গেল; কেউ তাঁতে, কেউবা সুতায়।
গল্পে গল্পে অনেক কিছু জানা গেল। ময়না বেগম স্মৃতিচারণা করতে শুরু করলেন—সেই ১৯৮৪ সালের কথা। বিসিক, রংপুর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেছিলেন শতরঞ্জি তৈরির কাজ। সেই শুরু, তারপর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। সংকট আর সম্ভাবনার মধ্যে চলতে চলতে আজ তিনি প্রতিষ্ঠিত। তাঁর কাছেই এখন কাজ করছেন প্রায় ৫০ জন নারী। অসংখ্য বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা অসহায় নারীর সহায় হয়ে উঠতে পেরেছেন তিনি। এ জন্য তিনি আনন্দিত। একে একে জানালেন ৩৬ বছরে তাঁর অগ্রগতির কথা। ময়না বেগমের জীবনের বদলে যাওয়াকে একটি মাত্র শব্দ দিয়ে প্রকাশ করতে হলে, সেই শব্দটি হবে—শতরঞ্জি। এই শতরঞ্জি তাঁর জীবনে এনেছে নতুন রং, যা দিয়ে তিনি রাঙাচ্ছেন আরও বহু মানুষের জীবন। বদলে দিতে পেরেছেন আরও অনেকের জীবন ও জীবিকা।
শুধু ময়না বেগম নন, শতরঞ্জি বদলে দিয়েছে রংপুরকেই। প্রায় অর্ধলক্ষ পরিবারের জীবন ও জীবিকার সন্ধান দিয়েছে এই শিল্প। বিশ্বের প্রায় অর্ধশত দেশে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশকে। শুরুটা অষ্টাদশ শতকের চল্লিশের দশকের। তৎকালীন ব্রিটিশ নাগরিক নিসবেত রংপুর জেলার কালেক্টর ছিলেন। সে সময় রংপুরের পীরপুর গ্রামে তৈরি হতো ডোরাকাটা, রং-বেরঙের মোটা মোটা সুতায় তৈরি গালিচা, যার নাম শতরঞ্জি।
কালেক্টর নিসবেত এসব শতরঞ্জি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। পরে তিনি শতরঞ্জির গুণগত মান উন্নয়নে কাজ করেন। এই শিল্পের প্রচার ও প্রসারে এগিয়ে আসেন। উৎপাদিত পণ্যের ব্যাপক পরিচিতির ব্যবস্থা করেন। মূলত সেই থেকে আজকের শতরঞ্জির বর্ণিল পথচলা শুরু। পথপরিক্রমায় পীরপুর হয়ে ওঠে নিসবেতগঞ্জ। সারা দেশে রংপুরকে যেমন, তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পরিচিতি বাড়ায় এই নিসবেতগঞ্জের শতরঞ্জি।
শতরঞ্জিশিল্প আজ প্রায় ৫০ হাজার পরিবারে হাসি ফুটিয়েছে। হতদরিদ্র, অসহায় মানুষ সুযোগ পেয়েছে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের। সেই সঙ্গে এই শিল্প সুনাম কুড়িয়েছে সারা বিশ্বে। দেশের প্রতিটি প্রান্তে আজ কদর বেড়েছে শতরঞ্জির। রপ্তানি হচ্ছে পৃথিবীর অন্তত অর্ধশত দেশে। একসময় মোগল সম্রাট আকবরও শতরঞ্জির রূপ ও গুণে মুগ্ধ হয়েছিলেন বলে কথিত আছে। তাঁর দরবারেও নাকি ব্যবহৃত হতো শতরঞ্জি। এটা স্থানীয় ভাষ্য হলেও যুগে যুগে এই শতরঞ্জি যে বহু জমিদার ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের অতিথিশালা, আড্ডাশালা ও ভোজনালয়ের শ্রী বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু তা–ই নয়, শতরঞ্জির বিশ্বভ্রমণ হালের কোনো ঘটনা নয়। বাংলাপিডিয়া জানাচ্ছে, ব্রিটিশ শাসনামলেই সমগ্র ভারত তো বটেই শ্রীলঙ্কা, আজকের মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ নানা দেশে প্রচুর শতরঞ্জি বিক্রি হতো।
আজ সময় অনেকটা বদলে গেছে। রংপুরের শতরঞ্জি এশিয়ার সীমানা ডিঙিয়ে রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। ফলে শতরঞ্জি উৎপাদনের পরিসরও বেড়েছে। এর উৎপাদন এখন শুধু নিসবেতগঞ্জে সীমাবদ্ধ নেই; ছড়িয়ে পড়েছে পুরো রংপুরে। কারুপণ্য, নীড় শতরঞ্জি, শতরঞ্জিপল্লি ও চারুশী নামের কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে এই শিল্পের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিচিতি ব্যাপকভাবে প্রসারের জন্য কাজ করছে। নিসবেতগঞ্জ এলাকার প্রতিটি বাড়ির আঙিনা ও বাড়ির ছাদ এখন শতরঞ্জি তৈরির কারখানা। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো, বর্তমানে বাংলাদেশে হস্তশিল্প থেকে রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৬০ শতাংশই আসছে রংপুরের শতরঞ্জি থেকে।
ব্যক্তি এবং স্থানীয় উদ্যোগে এই শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও এগিয়ে চলেছে। এই শিল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল পাটের সুতলি বা সুতা। বর্তমানে এই সুতলির দাম বেড়ে যাওয়ায় শতরঞ্জি ব্যবসা খানিকটা মুনাফা হারিয়েছে। ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব। করোনাকালে অন্য খাতের মতো এই খাতও হোঁচট খেয়েছে।
বর্তমান সময়ে সবচেয়ে দিশেহারা খাত ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। অথচ সারা দেশে এমন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত মানুষের সংখ্যা কয়েক কোটি। শতরঞ্জিও ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতে অন্তর্ভুক্ত এবং সেই সূত্রে সংকটাপন্ন। সমাজের দরিদ্র ও অসহায় মানুষকে সম্পৃক্ত করে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নিজের যে সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছে এ শিল্প, তা এর দিকে আরও মনোযোগ দাবি করে। বিশেষত নিম্নবিত্ত শ্রেণির জীবনমান উন্নয়নে এ খাত যেভাবে ভূমিকা রেখে চলেছে, তাতে তা সরকারের কাছে অধিকতর যত্ন ও অগ্রাধিকার প্রত্যাশা করে। এ কথা সত্য যে, এই খাতের সমৃদ্ধির জন্য সরকারি উদ্যোগ ও প্রণোদনা আছে, তবে তা কতটুকু পর্যাপ্ত, সে বিষয়টি আজ প্রশ্নাতীত নয়।
শেষ কথা হলো, যেহেতু শতরঞ্জি আমাদের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে সমৃদ্ধ করছে, যেহেতু এই খাতে সমাজের অবহেলিত, দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে, যেহেতু এই খাতের উৎপাদিত পণ্য সারা দেশ ও বিশ্বে আমাদের পরিচিতি বাড়িয়েছে এবং যেহেতু এই খাত আমাদের বৈদেশিক আয়কে মোটাতাজা করছে, সেহেতু এ খাতের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে অধিকতর দৃশ্যমান উদ্যোগ আবশ্যক। আমরা আশা করি, এই খাতের সমৃদ্ধির মাধ্যমে রংপুর তথা বৃহত্তর রংপুরের বেকার সমস্যা ও অর্থনৈতিক সংকটের নিরসন সম্ভব।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। রংপুরের মানুষের উন্নয়নে শতরঞ্জিশিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই খাতের ব্যাপক সম্ভাবনাকে বিবেচনায় নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে এ অঞ্চল ও গোটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই
খাত আরও বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমরা মনে করি।
উমর ফারুক
সহযোগী অধ্যাপক, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়
‘শোবার ঘরের সামনে একটুখানি খোলা ছাদ আছে, সেইখানে একটা শতরঞ্জি পাতিয়া রমেশ শয়ন করিল এবং নানা কথা ভাবিতে ভাবিতে ও হাতপাখার বাতাস খাইতে খাইতে গভীর রাত্রে ঘুমাইয়া পড়িল।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসের এই অংশ পাঠ করলে শতরঞ্জির নন্দন ও বিস্তার নিয়ে আর যা–ই হোক সংশয় থাকে না। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই শতরঞ্জি বহুজনকে নিজের গড়ন ও নকশায় মোহিত করার সঙ্গে সঙ্গে বহু লোকের জীবনের রংও বদলে দিয়েছে।
ময়না বেগমের কথাই ধরা যাক। আনুমানিক পঞ্চাশোর্ধ্ব এই নারী স্বামী হারিয়েছেন ২০০৮ সালে। চার ছেলে, দুই মেয়ের মধ্যে এক ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। অন্যদের কেউ প্রতিষ্ঠিত, আর কেউবা পড়ালেখা করছে। ঘাঘট নদীর গা ঘেঁষে রংপুর নগরী। ঘাঘট এখন যৌবন হারিয়ে মৌসুমি নদী। বর্ষায় থইথই করে জল, শীতে শুষ্ক। এই নদীর পারেই নিসবেতগঞ্জ গ্রাম, যেখানে বাড়ি ময়না বেগমের। একদিন যাওয়া হলো এই ময়না বেগমের বাড়ি।
নিসবেতগঞ্জ গ্রামে ঢুকতেই তাঁতের দেখা মিলল। চারদিকের ব্যস্ত মানুষদের পাশ কাটিয়ে পিচঢালা পথ ধরে একসময় পৌঁছে গেলাম ময়না বেগমের বাড়িতে। বাড়ির বাইরে শিশুরা ঘুড়ি বানাতে ব্যস্ত। ভেতরে তাঁতের শব্দ। আমাদের স্বাগত জানাতে ময়না আপা বেরিয়ে এলেন। বাড়িতে ঢুকেই চোখে পড়ল, আঙিনাজুড়ে সারি সারি তাঁত। কয়েকজন নারীকে কর্মব্যস্ত দেখা গেল; কেউ তাঁতে, কেউবা সুতায়।
গল্পে গল্পে অনেক কিছু জানা গেল। ময়না বেগম স্মৃতিচারণা করতে শুরু করলেন—সেই ১৯৮৪ সালের কথা। বিসিক, রংপুর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেছিলেন শতরঞ্জি তৈরির কাজ। সেই শুরু, তারপর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। সংকট আর সম্ভাবনার মধ্যে চলতে চলতে আজ তিনি প্রতিষ্ঠিত। তাঁর কাছেই এখন কাজ করছেন প্রায় ৫০ জন নারী। অসংখ্য বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা অসহায় নারীর সহায় হয়ে উঠতে পেরেছেন তিনি। এ জন্য তিনি আনন্দিত। একে একে জানালেন ৩৬ বছরে তাঁর অগ্রগতির কথা। ময়না বেগমের জীবনের বদলে যাওয়াকে একটি মাত্র শব্দ দিয়ে প্রকাশ করতে হলে, সেই শব্দটি হবে—শতরঞ্জি। এই শতরঞ্জি তাঁর জীবনে এনেছে নতুন রং, যা দিয়ে তিনি রাঙাচ্ছেন আরও বহু মানুষের জীবন। বদলে দিতে পেরেছেন আরও অনেকের জীবন ও জীবিকা।
শুধু ময়না বেগম নন, শতরঞ্জি বদলে দিয়েছে রংপুরকেই। প্রায় অর্ধলক্ষ পরিবারের জীবন ও জীবিকার সন্ধান দিয়েছে এই শিল্প। বিশ্বের প্রায় অর্ধশত দেশে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশকে। শুরুটা অষ্টাদশ শতকের চল্লিশের দশকের। তৎকালীন ব্রিটিশ নাগরিক নিসবেত রংপুর জেলার কালেক্টর ছিলেন। সে সময় রংপুরের পীরপুর গ্রামে তৈরি হতো ডোরাকাটা, রং-বেরঙের মোটা মোটা সুতায় তৈরি গালিচা, যার নাম শতরঞ্জি।
কালেক্টর নিসবেত এসব শতরঞ্জি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। পরে তিনি শতরঞ্জির গুণগত মান উন্নয়নে কাজ করেন। এই শিল্পের প্রচার ও প্রসারে এগিয়ে আসেন। উৎপাদিত পণ্যের ব্যাপক পরিচিতির ব্যবস্থা করেন। মূলত সেই থেকে আজকের শতরঞ্জির বর্ণিল পথচলা শুরু। পথপরিক্রমায় পীরপুর হয়ে ওঠে নিসবেতগঞ্জ। সারা দেশে রংপুরকে যেমন, তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পরিচিতি বাড়ায় এই নিসবেতগঞ্জের শতরঞ্জি।
শতরঞ্জিশিল্প আজ প্রায় ৫০ হাজার পরিবারে হাসি ফুটিয়েছে। হতদরিদ্র, অসহায় মানুষ সুযোগ পেয়েছে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের। সেই সঙ্গে এই শিল্প সুনাম কুড়িয়েছে সারা বিশ্বে। দেশের প্রতিটি প্রান্তে আজ কদর বেড়েছে শতরঞ্জির। রপ্তানি হচ্ছে পৃথিবীর অন্তত অর্ধশত দেশে। একসময় মোগল সম্রাট আকবরও শতরঞ্জির রূপ ও গুণে মুগ্ধ হয়েছিলেন বলে কথিত আছে। তাঁর দরবারেও নাকি ব্যবহৃত হতো শতরঞ্জি। এটা স্থানীয় ভাষ্য হলেও যুগে যুগে এই শতরঞ্জি যে বহু জমিদার ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের অতিথিশালা, আড্ডাশালা ও ভোজনালয়ের শ্রী বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু তা–ই নয়, শতরঞ্জির বিশ্বভ্রমণ হালের কোনো ঘটনা নয়। বাংলাপিডিয়া জানাচ্ছে, ব্রিটিশ শাসনামলেই সমগ্র ভারত তো বটেই শ্রীলঙ্কা, আজকের মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ নানা দেশে প্রচুর শতরঞ্জি বিক্রি হতো।
আজ সময় অনেকটা বদলে গেছে। রংপুরের শতরঞ্জি এশিয়ার সীমানা ডিঙিয়ে রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। ফলে শতরঞ্জি উৎপাদনের পরিসরও বেড়েছে। এর উৎপাদন এখন শুধু নিসবেতগঞ্জে সীমাবদ্ধ নেই; ছড়িয়ে পড়েছে পুরো রংপুরে। কারুপণ্য, নীড় শতরঞ্জি, শতরঞ্জিপল্লি ও চারুশী নামের কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে এই শিল্পের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিচিতি ব্যাপকভাবে প্রসারের জন্য কাজ করছে। নিসবেতগঞ্জ এলাকার প্রতিটি বাড়ির আঙিনা ও বাড়ির ছাদ এখন শতরঞ্জি তৈরির কারখানা। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো, বর্তমানে বাংলাদেশে হস্তশিল্প থেকে রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৬০ শতাংশই আসছে রংপুরের শতরঞ্জি থেকে।
ব্যক্তি এবং স্থানীয় উদ্যোগে এই শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও এগিয়ে চলেছে। এই শিল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল পাটের সুতলি বা সুতা। বর্তমানে এই সুতলির দাম বেড়ে যাওয়ায় শতরঞ্জি ব্যবসা খানিকটা মুনাফা হারিয়েছে। ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব। করোনাকালে অন্য খাতের মতো এই খাতও হোঁচট খেয়েছে।
বর্তমান সময়ে সবচেয়ে দিশেহারা খাত ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। অথচ সারা দেশে এমন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত মানুষের সংখ্যা কয়েক কোটি। শতরঞ্জিও ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতে অন্তর্ভুক্ত এবং সেই সূত্রে সংকটাপন্ন। সমাজের দরিদ্র ও অসহায় মানুষকে সম্পৃক্ত করে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নিজের যে সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছে এ শিল্প, তা এর দিকে আরও মনোযোগ দাবি করে। বিশেষত নিম্নবিত্ত শ্রেণির জীবনমান উন্নয়নে এ খাত যেভাবে ভূমিকা রেখে চলেছে, তাতে তা সরকারের কাছে অধিকতর যত্ন ও অগ্রাধিকার প্রত্যাশা করে। এ কথা সত্য যে, এই খাতের সমৃদ্ধির জন্য সরকারি উদ্যোগ ও প্রণোদনা আছে, তবে তা কতটুকু পর্যাপ্ত, সে বিষয়টি আজ প্রশ্নাতীত নয়।
শেষ কথা হলো, যেহেতু শতরঞ্জি আমাদের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে সমৃদ্ধ করছে, যেহেতু এই খাতে সমাজের অবহেলিত, দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে, যেহেতু এই খাতের উৎপাদিত পণ্য সারা দেশ ও বিশ্বে আমাদের পরিচিতি বাড়িয়েছে এবং যেহেতু এই খাত আমাদের বৈদেশিক আয়কে মোটাতাজা করছে, সেহেতু এ খাতের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে অধিকতর দৃশ্যমান উদ্যোগ আবশ্যক। আমরা আশা করি, এই খাতের সমৃদ্ধির মাধ্যমে রংপুর তথা বৃহত্তর রংপুরের বেকার সমস্যা ও অর্থনৈতিক সংকটের নিরসন সম্ভব।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। রংপুরের মানুষের উন্নয়নে শতরঞ্জিশিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই খাতের ব্যাপক সম্ভাবনাকে বিবেচনায় নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে এ অঞ্চল ও গোটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই
খাত আরও বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমরা মনে করি।
উমর ফারুক
সহযোগী অধ্যাপক, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪