স্বকৃত নোমান
বাংলাদেশে অবকাঠামোতে উন্নয়ন হচ্ছে, কোনো সন্দেহ নেই। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে এমন উন্নয়ন আর হয়নি। নিজ অর্থায়নে সরকার পদ্মা সেতু করছে, ঢাকা শহরে নানা উড়ালসেতু করেছে, মেট্রোরেল করছে, সারা দেশে রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ হচ্ছে। উন্নয়নে উন্নয়নে সত্যিকার অর্থেই দেশটার চেহারা পাল্টে যাচ্ছে। চারদিকে উন্নয়নের ছাপ। মানুষের আয়-রোজগারও বেড়েছে।
বছরে মাথাপিছু আয় এখন ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৭৩ টাকা। বিদ্যুৎ–সংকট ছিল অন্যতম প্রধান সংকট। সেই সংকটও কেটেছে। আগের মতো দেশে এখন লোডশেডিংও নেই। বিদ্যুৎ যায় না বললেই চলে। সুতরাং উন্নয়নের ব্যাপারে সরকারের প্রশংসা করা যায়। কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে কি সভ্য নাগরিক গড়ে তোলা যায়? একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিই কি সব? এ উন্নতি সাধিত হলেই কি দেশ সভ্যতার উচ্চতর মার্গে পৌঁছাতে পারে? না, শুধু অর্থনৈতিক উন্নতির মাধ্যমে কোনোভাবেই সভ্য দেশ গড়ে তোলা যায় না। সভ্য নাগরিক গড়ে না তুললে যেকোনো মুহূর্তে দেশ রসাতলের দিকে ধাবিত হতে পারে। জনগণের মনন গঠনের জন্য, সভ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন শিল্প–সাহিত্য–সংস্কৃতি-জ্ঞান-বিজ্ঞান ও রাজনীতির সম-উন্নয়ন। বাংলাদেশে এখন রাজনীতির চর্চা কতটা আছে, তা রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয়ই জানেন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশও স্তিমিত। নাগরিকদের সভ্য হয়ে ওঠার কোনো মাধ্যমের সচলতা দেখা যাচ্ছে না। ফলে জনগণের মনন ধাবিত হচ্ছে মধ্যযুগের দিকে, যখন রক্তপাতই ছিল একমাত্র সমাধান, যখন মানবতা ছিল অধরা। অথচ মানুষের ইতিহাস প্রগতির ইতিহাস, এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস।
বাংলাদেশের মানুষের মনন যে ক্রমেই অধঃগতির দিকে যাচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মনন যে এভাবে অধঃগতির দিকে ধাবিত হচ্ছে, তার লাগাম টেনে ধরার উপায় কী? উপায় আমরা খুঁজে নিতে পারি ইউরোপীয় রেনেসাঁস থেকে। চতুর্দশ শতকে রেনেসাঁসের সূচনালগ্নে ইতালি ছিল বেশ কিছু নগর-রাষ্ট্রে বিভক্ত। এমন অনেক অঞ্চল ছিল, যেগুলো তখন বৃহত্তর কোনো নগর কর্তৃক শাসিত হচ্ছিল। সব নগর-রাষ্ট্রেরই একটি করে নিজস্ব সরকারব্যবস্থা ছিল। মিলান, ভেনিস, ফেরেরার পাশাপাশি এমনই একটি বড় নগর-রাষ্ট্র হলো ফ্লোরেন্স। ফ্লোরেন্সে প্রচলিত ছিল প্রজাতন্ত্রী সরকার ব্যবস্থা, ঠিক প্রাচীন রোমের মতো। অর্থাৎ নাগরিকেরা নিজেরাই তাদের নেতা নির্বাচন করার সুযোগ পেত।
চতুর্দশ শতকের শেষ দিকে ফ্লোরেন্স পরিণত হয় একটি ধনী নগরীতে। ধনবান বণিকদের যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ ছিল শিল্প ও শিল্পীদের পেছনে খরচ করার জন্য। যার ফলে তখনকার শিল্পী ও চিন্তাবিদদের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হয়। শিল্প ক্রমেই উন্নত থেকে উন্নততর হতে থাকে, আর নতুন নতুন যুগান্তকারী সব চিন্তাভাবনা ও ধারণার উন্মেষ ঘটতে থাকে। তারা গ্রিক ও রোমানদের রেখে যাওয়া কাজ ও নিদর্শন নিয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে অধ্যয়ন করতে গিয়ে উপলব্ধি করে যে, জীবন মানেই কেবল যুদ্ধ-বিগ্রহ নয়, জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যেরও উপস্থিতি থাকতে পারে এবং জীবনটাকে মানুষ চাইলে নিজেদের মতো করে উপভোগও করতে পারে। জীবনে অন্য কিছু নয়, মনুষ্যত্বকেই দিতে হবে সর্বাধিক প্রাধান্য। এই ভাবনা থেকে মানুষের মনে এক নতুন ধারণার উন্মেষ ঘটে যে, তাদের শিক্ষিত হয়ে উঠতে হবে। শিল্প, সংগীত, বিজ্ঞান প্রভৃতি সব মানুষের জীবনেই এক ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবে।
পঞ্চদশ শতকে ফ্লোরেন্সের ক্ষমতায় আসে মেডিসি পরিবার। তারা ছিল প্রচুর ধনসম্পদের মালিক। বিভিন্ন শিল্পী-সাহিত্যিককে নিজস্ব তহবিল থেকে পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে তারা শিল্প-সাহিত্যের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে থাকে। এভাবে মানবতাবাদী আন্দোলনও বেগবান হয়। আন্দোলনটি প্রথমে ফ্লোরেন্স নগরীর গণ্ডি পেরিয়ে ইতালির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নগর-রাষ্ট্র যেমন ভেনিস, মিলান, বলগনা, ফেরেরা ও রোমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ইতালি থেকে ফ্রান্স পর্যন্তও পৌঁছে যায়। পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে সমগ্র পশ্চিম ও উত্তর ইউরোপে মানবতাবাদী আন্দোলন বিস্তার লাভ করে। যদিও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে রেনেসাঁসের অভিজ্ঞতা এসেছিল ইতালির অনেক পরে, কিন্তু তবু এর প্রভাব ছিল সমান বৈপ্লবিক। এর মধ্য দিয়ে মধ্যযুগের অবসান ঘটে শিল্প–সংস্কৃতি রাজনীতি ও অর্থনীতি এক নবজন্ম লাভ করে। এ সময়ই সৃষ্টি হয় অসংখ্য ধ্রুপদি দর্শন, সাহিত্য ও শিল্প, যার মাধ্যমে মানবসভ্যতা পৌঁছে যায় এক নতুন উচ্চতায়। ইউরোপীয় রেনেসাঁসের মাধ্যমে মানবতাবাদের বিকাশ এমনি এমনি ঘটেনি, তার পেছনে ছিল জ্ঞানমার্গ তথা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সংগীত-দর্শনসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখার বিকাশ।
এই বিকাশ সাধনের পেছনে ছিল শাসক ও ধনিকশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা। বাংলাদেশের জনসাধারণকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, তাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির রুচি উন্নয়নের জন্য, তাদের মধ্যে মানবিক বোধ প্রতিষ্ঠা ও প্রগতিবোধ জাগ্রত করার জন্য প্রয়োজন জ্ঞানমার্গের বিকাশ। আর এই বিকাশ ততক্ষণ সাধিত হবে না, যতক্ষণ না শাসক ও ধনিকশ্রেণি এর পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসবে। জ্ঞানমার্গের বিকাশ যে শাসক ও ধনিকশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতায় হয়, তার প্রমাণ নেওয়ার জন্য ইউরোপে যাওয়ার দরকার নেই, ভারতবর্ষ থেকেও নেওয়া যায়। মগধে গুপ্তদের শাসনামলে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের যে চর্চা শুরু হয়, পাল ও সেন আমলে সেই ধারা অব্যাহত ছিল। বাংলায় পালদের আমলে দেশীয় ভাষা হিসেবে প্রথম বাংলা চর্চা শুরু হয়। বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের উদ্ভব ও প্রসার ঘটে বৌদ্ধ আমলে, বিশেষ করে স্বাধীন পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায়। সেন আমলে বাংলা ভাষার চর্চা না হলেও এর নিজস্ব সত্তা লোপ পায়নি। পরবর্তী সময়ে হুসেন শাহ, গৌড়ের সামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ এবং অপরাপর মুসলিম শাসকেরা বাংলায় ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে সাহিত্যে এক নতুন যুগ সৃষ্টি করেছিলেন। সাহিত্যচর্চায় সুলতানরা বাংলার সব ধর্মের মানুষকে সমানভাবে উদ্বুদ্ধ ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।
ওদিকে আরাকান রাজসভার অমাত্যবর্গ কবি-সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে সমৃদ্ধ করেছিলেন বাংলা সাহিত্যকে। খ্রিষ্টীয় সতেরো শ শতকে আরাকান রাজসভার কবিদের হাতেই বাংলা সাহিত্য পরিপুষ্ট হয়েছিল, যার ফলাফল হয়েছিল বহুমুখী ও দীর্ঘস্থায়ী। আরাকান অমাত্যসভার পৃষ্ঠপোষকতায় যেসব কবি-সাহিত্যিক সাহিত্য চর্চা করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে কবি দৌলত কাজী, কোরেশী মাগন ঠাকুর, আলাওল, মরদন, আবদুল করিম খোন্দকার, আবদুল করিম, আবুল হোসেন, কাজী আবদুল করিম, ইসমাইল সাকেব, কাজী মোহাম্মদ হোসেন, নসরুল্লাহ খান প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
শাসক ও ধনিকশ্রেণির সেই পৃষ্ঠপোষকতা কি এখন আছে? নেই। রাজনীতিকেরা এখন সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য প্রার্থনাগৃহ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। কেউ কখনো একটি পাঠাগার নির্মাণ করেন না, নাটক–থিয়েটার–সাহিত্য–সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞের পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন মনে করেন না। জনগণের মেধার বিকাশ, আত্ম–উন্নয়ন ও প্রগতির দিকে ধাবিত করার কোনো প্রয়োজন তাঁরা অনুভব করেন না।
গণমাধ্যমও জনগণকে প্রগতির দিকে ধাবিত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের গণমাধ্যমের যেটুকু বিকাশ, তার পেছনে ধনিকশ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা গণমাধ্যমের মধ্য দিয়ে সমাজ-প্রগতির চেয়ে নিজস্ব সম্পদের পাহারাদার হিসেবে গণমাধ্যমকে অধিকতর ব্যবহার করছে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান বিকাশের ক্ষেত্রে শাসকদের মতো তারাও কোনো ভূমিকা রাখতে অনাগ্রহী।
আমাদের পুঁজিপতিরা চাইলেই পারেন প্রতিটি জেলায় একটি করে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করতে। তাঁরা চাইলেই পারেন, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক দর্শন-জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা করতে। এক শ ধনবান যদি পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসতেন, তাতে নিঃসন্দেহে আমাদের জ্ঞানমার্গ উৎকর্ষ লাভ করত, যেমন লাভ করেছিল ইউরোপীয় রেনেসাঁসে বণিকশ্রেণি ও মেডিসি পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায়, যেমন লাভ করেছিল সুলতানদের এবং আরাকান রাজসভার অমাত্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায়।
বাংলাদেশ যে সাংস্কৃতিক দিক থেকে একটি ভয়াবহ সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে, এটা বুঝতে পারছে না ক্ষমতাসীন দল, বুঝতে পারছে না বুদ্ধিজীবী শ্রেণিও। শাসকশ্রেণি তো কথায় কথায় উন্নয়ন আর উন্নয়ন ছাড়া কিছুই বলতে পারে না। বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ কার্যত নিশ্চুপ। তারা বুঝতে পারছে না অর্থনীতির এই বিকাশ যেকোনো মুহূর্তে যে রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে, দেশ পড়ে যেতে পারে ঘোর সংকটে। যে সংকটে পড়েছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক ও সিরিয়া।
যতই উন্নয়নের কথা বলা হোক না কেন, যতই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা বলা হোক না কেন, বাংলাদেশ ভালো নেই। এক ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত বাংলাদেশ। এক গভীর সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। এ সংকটের কারণ চিহ্নিত করা না গেলে, এ সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের না করলে, ক্ষমতাসীন দল সতর্ক না হলে বাংলাদেশ যে খাদে পতিত হবে, তা থেকে ওঠা সহজ হবে না।
স্বকৃত নোমান, কথাসাহিত্যিক
বাংলাদেশে অবকাঠামোতে উন্নয়ন হচ্ছে, কোনো সন্দেহ নেই। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে এমন উন্নয়ন আর হয়নি। নিজ অর্থায়নে সরকার পদ্মা সেতু করছে, ঢাকা শহরে নানা উড়ালসেতু করেছে, মেট্রোরেল করছে, সারা দেশে রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ হচ্ছে। উন্নয়নে উন্নয়নে সত্যিকার অর্থেই দেশটার চেহারা পাল্টে যাচ্ছে। চারদিকে উন্নয়নের ছাপ। মানুষের আয়-রোজগারও বেড়েছে।
বছরে মাথাপিছু আয় এখন ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৭৩ টাকা। বিদ্যুৎ–সংকট ছিল অন্যতম প্রধান সংকট। সেই সংকটও কেটেছে। আগের মতো দেশে এখন লোডশেডিংও নেই। বিদ্যুৎ যায় না বললেই চলে। সুতরাং উন্নয়নের ব্যাপারে সরকারের প্রশংসা করা যায়। কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে কি সভ্য নাগরিক গড়ে তোলা যায়? একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিই কি সব? এ উন্নতি সাধিত হলেই কি দেশ সভ্যতার উচ্চতর মার্গে পৌঁছাতে পারে? না, শুধু অর্থনৈতিক উন্নতির মাধ্যমে কোনোভাবেই সভ্য দেশ গড়ে তোলা যায় না। সভ্য নাগরিক গড়ে না তুললে যেকোনো মুহূর্তে দেশ রসাতলের দিকে ধাবিত হতে পারে। জনগণের মনন গঠনের জন্য, সভ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন শিল্প–সাহিত্য–সংস্কৃতি-জ্ঞান-বিজ্ঞান ও রাজনীতির সম-উন্নয়ন। বাংলাদেশে এখন রাজনীতির চর্চা কতটা আছে, তা রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয়ই জানেন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশও স্তিমিত। নাগরিকদের সভ্য হয়ে ওঠার কোনো মাধ্যমের সচলতা দেখা যাচ্ছে না। ফলে জনগণের মনন ধাবিত হচ্ছে মধ্যযুগের দিকে, যখন রক্তপাতই ছিল একমাত্র সমাধান, যখন মানবতা ছিল অধরা। অথচ মানুষের ইতিহাস প্রগতির ইতিহাস, এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস।
বাংলাদেশের মানুষের মনন যে ক্রমেই অধঃগতির দিকে যাচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মনন যে এভাবে অধঃগতির দিকে ধাবিত হচ্ছে, তার লাগাম টেনে ধরার উপায় কী? উপায় আমরা খুঁজে নিতে পারি ইউরোপীয় রেনেসাঁস থেকে। চতুর্দশ শতকে রেনেসাঁসের সূচনালগ্নে ইতালি ছিল বেশ কিছু নগর-রাষ্ট্রে বিভক্ত। এমন অনেক অঞ্চল ছিল, যেগুলো তখন বৃহত্তর কোনো নগর কর্তৃক শাসিত হচ্ছিল। সব নগর-রাষ্ট্রেরই একটি করে নিজস্ব সরকারব্যবস্থা ছিল। মিলান, ভেনিস, ফেরেরার পাশাপাশি এমনই একটি বড় নগর-রাষ্ট্র হলো ফ্লোরেন্স। ফ্লোরেন্সে প্রচলিত ছিল প্রজাতন্ত্রী সরকার ব্যবস্থা, ঠিক প্রাচীন রোমের মতো। অর্থাৎ নাগরিকেরা নিজেরাই তাদের নেতা নির্বাচন করার সুযোগ পেত।
চতুর্দশ শতকের শেষ দিকে ফ্লোরেন্স পরিণত হয় একটি ধনী নগরীতে। ধনবান বণিকদের যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ ছিল শিল্প ও শিল্পীদের পেছনে খরচ করার জন্য। যার ফলে তখনকার শিল্পী ও চিন্তাবিদদের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হয়। শিল্প ক্রমেই উন্নত থেকে উন্নততর হতে থাকে, আর নতুন নতুন যুগান্তকারী সব চিন্তাভাবনা ও ধারণার উন্মেষ ঘটতে থাকে। তারা গ্রিক ও রোমানদের রেখে যাওয়া কাজ ও নিদর্শন নিয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে অধ্যয়ন করতে গিয়ে উপলব্ধি করে যে, জীবন মানেই কেবল যুদ্ধ-বিগ্রহ নয়, জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যেরও উপস্থিতি থাকতে পারে এবং জীবনটাকে মানুষ চাইলে নিজেদের মতো করে উপভোগও করতে পারে। জীবনে অন্য কিছু নয়, মনুষ্যত্বকেই দিতে হবে সর্বাধিক প্রাধান্য। এই ভাবনা থেকে মানুষের মনে এক নতুন ধারণার উন্মেষ ঘটে যে, তাদের শিক্ষিত হয়ে উঠতে হবে। শিল্প, সংগীত, বিজ্ঞান প্রভৃতি সব মানুষের জীবনেই এক ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবে।
পঞ্চদশ শতকে ফ্লোরেন্সের ক্ষমতায় আসে মেডিসি পরিবার। তারা ছিল প্রচুর ধনসম্পদের মালিক। বিভিন্ন শিল্পী-সাহিত্যিককে নিজস্ব তহবিল থেকে পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে তারা শিল্প-সাহিত্যের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে থাকে। এভাবে মানবতাবাদী আন্দোলনও বেগবান হয়। আন্দোলনটি প্রথমে ফ্লোরেন্স নগরীর গণ্ডি পেরিয়ে ইতালির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নগর-রাষ্ট্র যেমন ভেনিস, মিলান, বলগনা, ফেরেরা ও রোমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ইতালি থেকে ফ্রান্স পর্যন্তও পৌঁছে যায়। পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে সমগ্র পশ্চিম ও উত্তর ইউরোপে মানবতাবাদী আন্দোলন বিস্তার লাভ করে। যদিও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে রেনেসাঁসের অভিজ্ঞতা এসেছিল ইতালির অনেক পরে, কিন্তু তবু এর প্রভাব ছিল সমান বৈপ্লবিক। এর মধ্য দিয়ে মধ্যযুগের অবসান ঘটে শিল্প–সংস্কৃতি রাজনীতি ও অর্থনীতি এক নবজন্ম লাভ করে। এ সময়ই সৃষ্টি হয় অসংখ্য ধ্রুপদি দর্শন, সাহিত্য ও শিল্প, যার মাধ্যমে মানবসভ্যতা পৌঁছে যায় এক নতুন উচ্চতায়। ইউরোপীয় রেনেসাঁসের মাধ্যমে মানবতাবাদের বিকাশ এমনি এমনি ঘটেনি, তার পেছনে ছিল জ্ঞানমার্গ তথা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সংগীত-দর্শনসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখার বিকাশ।
এই বিকাশ সাধনের পেছনে ছিল শাসক ও ধনিকশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা। বাংলাদেশের জনসাধারণকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, তাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির রুচি উন্নয়নের জন্য, তাদের মধ্যে মানবিক বোধ প্রতিষ্ঠা ও প্রগতিবোধ জাগ্রত করার জন্য প্রয়োজন জ্ঞানমার্গের বিকাশ। আর এই বিকাশ ততক্ষণ সাধিত হবে না, যতক্ষণ না শাসক ও ধনিকশ্রেণি এর পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসবে। জ্ঞানমার্গের বিকাশ যে শাসক ও ধনিকশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতায় হয়, তার প্রমাণ নেওয়ার জন্য ইউরোপে যাওয়ার দরকার নেই, ভারতবর্ষ থেকেও নেওয়া যায়। মগধে গুপ্তদের শাসনামলে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের যে চর্চা শুরু হয়, পাল ও সেন আমলে সেই ধারা অব্যাহত ছিল। বাংলায় পালদের আমলে দেশীয় ভাষা হিসেবে প্রথম বাংলা চর্চা শুরু হয়। বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের উদ্ভব ও প্রসার ঘটে বৌদ্ধ আমলে, বিশেষ করে স্বাধীন পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায়। সেন আমলে বাংলা ভাষার চর্চা না হলেও এর নিজস্ব সত্তা লোপ পায়নি। পরবর্তী সময়ে হুসেন শাহ, গৌড়ের সামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ এবং অপরাপর মুসলিম শাসকেরা বাংলায় ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে সাহিত্যে এক নতুন যুগ সৃষ্টি করেছিলেন। সাহিত্যচর্চায় সুলতানরা বাংলার সব ধর্মের মানুষকে সমানভাবে উদ্বুদ্ধ ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।
ওদিকে আরাকান রাজসভার অমাত্যবর্গ কবি-সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে সমৃদ্ধ করেছিলেন বাংলা সাহিত্যকে। খ্রিষ্টীয় সতেরো শ শতকে আরাকান রাজসভার কবিদের হাতেই বাংলা সাহিত্য পরিপুষ্ট হয়েছিল, যার ফলাফল হয়েছিল বহুমুখী ও দীর্ঘস্থায়ী। আরাকান অমাত্যসভার পৃষ্ঠপোষকতায় যেসব কবি-সাহিত্যিক সাহিত্য চর্চা করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে কবি দৌলত কাজী, কোরেশী মাগন ঠাকুর, আলাওল, মরদন, আবদুল করিম খোন্দকার, আবদুল করিম, আবুল হোসেন, কাজী আবদুল করিম, ইসমাইল সাকেব, কাজী মোহাম্মদ হোসেন, নসরুল্লাহ খান প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
শাসক ও ধনিকশ্রেণির সেই পৃষ্ঠপোষকতা কি এখন আছে? নেই। রাজনীতিকেরা এখন সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য প্রার্থনাগৃহ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। কেউ কখনো একটি পাঠাগার নির্মাণ করেন না, নাটক–থিয়েটার–সাহিত্য–সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞের পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন মনে করেন না। জনগণের মেধার বিকাশ, আত্ম–উন্নয়ন ও প্রগতির দিকে ধাবিত করার কোনো প্রয়োজন তাঁরা অনুভব করেন না।
গণমাধ্যমও জনগণকে প্রগতির দিকে ধাবিত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের গণমাধ্যমের যেটুকু বিকাশ, তার পেছনে ধনিকশ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা গণমাধ্যমের মধ্য দিয়ে সমাজ-প্রগতির চেয়ে নিজস্ব সম্পদের পাহারাদার হিসেবে গণমাধ্যমকে অধিকতর ব্যবহার করছে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান বিকাশের ক্ষেত্রে শাসকদের মতো তারাও কোনো ভূমিকা রাখতে অনাগ্রহী।
আমাদের পুঁজিপতিরা চাইলেই পারেন প্রতিটি জেলায় একটি করে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করতে। তাঁরা চাইলেই পারেন, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক দর্শন-জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা করতে। এক শ ধনবান যদি পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসতেন, তাতে নিঃসন্দেহে আমাদের জ্ঞানমার্গ উৎকর্ষ লাভ করত, যেমন লাভ করেছিল ইউরোপীয় রেনেসাঁসে বণিকশ্রেণি ও মেডিসি পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায়, যেমন লাভ করেছিল সুলতানদের এবং আরাকান রাজসভার অমাত্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায়।
বাংলাদেশ যে সাংস্কৃতিক দিক থেকে একটি ভয়াবহ সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে, এটা বুঝতে পারছে না ক্ষমতাসীন দল, বুঝতে পারছে না বুদ্ধিজীবী শ্রেণিও। শাসকশ্রেণি তো কথায় কথায় উন্নয়ন আর উন্নয়ন ছাড়া কিছুই বলতে পারে না। বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ কার্যত নিশ্চুপ। তারা বুঝতে পারছে না অর্থনীতির এই বিকাশ যেকোনো মুহূর্তে যে রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে, দেশ পড়ে যেতে পারে ঘোর সংকটে। যে সংকটে পড়েছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক ও সিরিয়া।
যতই উন্নয়নের কথা বলা হোক না কেন, যতই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা বলা হোক না কেন, বাংলাদেশ ভালো নেই। এক ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত বাংলাদেশ। এক গভীর সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। এ সংকটের কারণ চিহ্নিত করা না গেলে, এ সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের না করলে, ক্ষমতাসীন দল সতর্ক না হলে বাংলাদেশ যে খাদে পতিত হবে, তা থেকে ওঠা সহজ হবে না।
স্বকৃত নোমান, কথাসাহিত্যিক
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪