এম ইদ্রিছ আলী
একদিকে গারো পাহাড়, অন্যদিকে ভাওয়াল গড়। মাঝপথে সমতলের বুক চিরে বয়ে চলা লোহিতসাগর খ্যাত পৌরাণিক কিংবদন্তির নদ পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের উর্বর পললে গড়ে ওঠা দেশের প্রাচীন জেলা ময়মনসিংহ। উঁচু পাহাড়, বিস্তৃত বনে ফলমূল-বৃক্ষের প্রাচুর্য, মিঠাপানির নদ-নদী-হাওরের কলতান আর বিচিত্র মাটির গঠন। এসব অনুমান
করা স্বাভাবিক যে এই অঞ্চলে জনবসতির গোড়াপত্তন বহু পুরোনো।
মজা করে বলা হতো—‘হাওর, জঙ্গল, মহিষের শিং/ এই নিয়ে ময়মনসিং।’ নক্ষত্রবলয়ে আবর্তিত দুনিয়ায় বিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। একদা শিক্ষানগরী ময়মনসিংহ এখন শিল্প-সংস্কৃতির নগরী। প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল রেখে এগিয়ে চলা বাংলাদেশে আমরা এখন হয়তো মজা করেই বলতে পারি—‘শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি/ এই নিয়ে ময়মনসিংহের পরিচিতি।’
মানুষের শ্রমে সমৃদ্ধ কৃষির পাশাপাশি এখানকার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষায় ঋদ্ধতার ইতিহাস সুপ্রাচীন। মহুয়া, মলুয়া, কমলা, সখিনা, বিনোদ, নদের চাঁদ, দস্যু কেনারাম, হুমরা বাইদার মাতৃস্থান লোকজ সংস্কৃতির স্বর্ণখনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ। এই জনপদের কবি দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা মহাকবি চন্দ্রাবতী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস স্বীকৃত প্রথম বাঙালি মহিলা কবি। সেই মধ্যযুগেই এখানকার সাহিত্য-সংস্কৃতি-ধর্মের সীমাবদ্ধতার গণ্ডি পেরিয়ে ষোলো আনা বাঙালিয়ানায় ঋদ্ধ হয়ে প্রেম-ভালোবাসা, সমাজবাস্তবতার স্বরূপ চিত্রায়ণে সফলতার ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়।
চন্দ্র কুমার দে সংগৃহীত দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত এই জনপদের পোড়খাওয়া সরল মানুষের অপার দরদে সৃষ্ট লোকজ সংস্কৃতি ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ স্থানিকতার বেষ্টনী ভেঙে সেই কবেই আলোড়ন তুলেছে ফোক দুনিয়ায়। সেই আলোড়নের ঢেউ আজও আন্দোলিত করে বাঙালি হৃদয়। রূপকথার গল্প ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র কথাই–বা কী করে ভুলি! এ যে সংস্কৃতির উর্বর ভূমি ময়মনসিংহ থেকেই সংগ্রহ করেছেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার।
বাংলার বারো ভূঁইয়ার একজন ঈসা খাঁর সঙ্গে দিল্লীশ্বরের সেনাপতি মান সিংহের যুদ্ধ। তরবারি ভেঙে যাওয়ার পরও শত্রু সেনাপতিকে হত্যা না করে তরবারি সংগ্রহের সুযোগ দেওয়া থেকে নতুন সম্পর্ক, নতুন প্রাপ্তি। পিতার জেলে বন্দী প্রাণপ্রিয় স্বামীকে মুক্ত করতে পিতারই সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে পুরুষবেশে রণাঙ্গনে কন্যা সখিনা বীরাঙ্গনা। যুদ্ধে মন ভাঙা চক্রান্তের বলি সখিনার চিরনিদ্রার স্থল কেল্লাতাজপুরের মাজার। এসব নিয়ে উদারতা-বদান্যতা-বীরত্বগাথার ঐতিহাসিক সত্যে রস লাগিয়ে রচিত শৈল্পিক পালা, কবিতা, প্রবন্ধ সাহিত্য ময়মনসিংহের সাহিত্যধারার পরিচায়ক।
ব্রিটিশ ভারতের প্রভাবশালী জমিদারদের আবাস ছিল ময়মনসিংহ। মুক্তাগাছা ও গৌরীপুরের জমিদাররা শাসন-তোষণের পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা রেখে গেছেন। প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ একসময় মুক্তাগাছায় থেকে সংগীত চর্চা করেছেন। এলাকা থেকে বিতাড়িত স্বভাবকবি গোবিন্দ দাসের আশ্রয়স্থল ছিল ময়মনসিংহ। ‘মহাশ্মশান’-এর মহাকবি কায়কোবাদও সাহিত্য চর্চা করেছেন মুক্তাগাছায় থেকে।
ব্রিটিশ আমলেই কলকাতাকেন্দ্রিক আধুনিক একটি সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির আবহ গড়ে ওঠে এই অঞ্চলে। এ সময় পূর্ববাংলায় একমাত্র অত্যাধুনিক ঘূর্ণমান রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হয় ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহে আসেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আসানসোলের রুটির দোকান থেকে মননশীল এক দারোগার সঙ্গ পেয়ে ময়মনসিংহের ত্রিশালে আসেন দুখু মিয়া, অর্থাৎ কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ব্রিটিশ আমল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ পর্যন্ত নাট্যচর্চায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে জমিদারদের প্রতিষ্ঠিত অমরাবতী নাটমন্দির। বর্তমানে বহুরূপী নাট্য সংস্থাসহ একাধিক সংগঠন সক্রিয় থেকে নাট্যাঙ্গনে রেখে যাচ্ছে বলিষ্ঠ পদচারণ। তৎকালে পূর্ব বাংলায় (আসামসহ) সবচেয়ে ধনাঢ্য জমিদার মহারাজা শশীকান্ত আচার্যের নামে অপূর্ব নির্মাণশৈলীতে ময়মনসিংহ শহরের প্রতিষ্ঠিত দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা ‘শশী লজ’ শৈল্পিক কর্মের বড় পরিচয়। আবার অতীতের ধারাবাহিকতায় বর্তমানেও ভিন্নতর শিল্পমনের পরিচয় মেলবে বাকৃবির বোটানিক্যাল গার্ডেনে।
শিল্পকর্মে ভাস্মর এই জনপদের কৃতী সন্তান শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। ব্রহ্মপুত্রের তীরে জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা সবার জন্য আকর্ষণের। ফুটন্ত সকাল, দুরন্ত দুপুর কিংবা পড়ন্ত বিকেলে নদ থেকে ভেসে আসা বাতাসে তনুমনে শীতলতার পরশ বোলাতে জয়নুল উদ্যানে বসা অথবা পায়চারি চলতে পারে অনায়াসে।
কবি নির্মলেন্দু গুণ, বুদ্ধিজীবী যতীন সরকারসহ বাংলা সাহিত্যের বহু প্রতিষ্ঠিত লেখক-কবি-সাহিত্যিকের নানা স্মৃতিবিজড়িত ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ, বীক্ষণ সাহিত্য আসরসহ বেশ কিছু সংগঠন সাহিত্যচর্চায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছে। সাহিত্য, রাজনীতি, সাংবাদিকতায় আলো ছড়ানো আলোকিত মানুষ কেদার নাথ মজুমদার, আবুল মনসুর আহমেদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, মাহ্ফুজ আনামসহ বহু গুণীকে জন্ম দিয়েছে ময়মনসিংহ।
একসময় ময়মনসিংহে মূলত উত্তরের পাহাড়ে কোচ, গারো, হাজং ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠীর বাস ছিল। এখনো মুসলমান-হিন্দু বাঙালির পাশাপাশি গারো, কোচ, হাজংসহ বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর সহাবস্থান এখানকার কৃষ্টিকে করেছে বৈচিত্র্যময়। হালুয়াঘাটে গারো অধ্যুষিত এলাকায় প্রতিষ্ঠিত আদিবাসী কালচারাল একাডেমি, মুক্তাগাছায় গারোদের সংস্কৃতি রক্ষা, চর্চা ও বিকাশ প্রত্যাশায় প্রতিষ্ঠার অপেক্ষায় থাকা প্রস্তাবিত গারো সাংস্কৃতিক একাডেমি ময়মনসিংহের বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সৃষ্টিশীলতার পাশাপাশি উৎপাদনেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক সময়ে মৎস্য, কৃষি, পশুপালন, ক্ষুদ্র-কুটির শিল্প, ভারী শিল্প—সব দিক থেকেই এগোচ্ছে এই জেলা। একসময়ের ধু-ধু নিষ্ফলা মাঠে এখন সবুজ ফসলের সমারোহ। গ্রামে গ্রামে গড়ে ওঠা পোলট্রি, গরুর ফার্ম, ফিশারিসহ বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক কৃষিকাজ গ্রামীণ অর্থনীতিতে অকল্পনীয় ইতিবাচক বিবর্তন ঘটিয়েছে।
ময়মনসিংহ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার মাছ দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে, তা গ্রামের
দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গ্রামে এখন কুঁড়েঘর বা টিনের ঘরের জায়গায় প্রতিনিয়ত পাকা ঘর তৈরি হচ্ছে। বহুতল ভবনও এখন ময়মনসিংহের অধিকাংশ গ্রামেই চোখে পড়ে।
জেলার ভালুকা, ত্রিশাল, গৌরীপুরসহ কিছু অঞ্চলে গড়ে ওঠা ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোও দেশে অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখছে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মতো সৃষ্টিশীল কর্মের চাকা গতিশীল রাখতেই অর্থনীতিতে সচ্ছলতা বজায় রাখা বাঞ্ছনীয়। এখানকার মজবুত গ্রামীণ অর্থনীতি জাতীয় অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করতে বড় ভূমিকা রাখছে।
সব দিক দিয়ে এগিয়ে চলেছে ময়মনসিংহ।
এম ইদ্রিছ আলী, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক
একদিকে গারো পাহাড়, অন্যদিকে ভাওয়াল গড়। মাঝপথে সমতলের বুক চিরে বয়ে চলা লোহিতসাগর খ্যাত পৌরাণিক কিংবদন্তির নদ পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের উর্বর পললে গড়ে ওঠা দেশের প্রাচীন জেলা ময়মনসিংহ। উঁচু পাহাড়, বিস্তৃত বনে ফলমূল-বৃক্ষের প্রাচুর্য, মিঠাপানির নদ-নদী-হাওরের কলতান আর বিচিত্র মাটির গঠন। এসব অনুমান
করা স্বাভাবিক যে এই অঞ্চলে জনবসতির গোড়াপত্তন বহু পুরোনো।
মজা করে বলা হতো—‘হাওর, জঙ্গল, মহিষের শিং/ এই নিয়ে ময়মনসিং।’ নক্ষত্রবলয়ে আবর্তিত দুনিয়ায় বিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। একদা শিক্ষানগরী ময়মনসিংহ এখন শিল্প-সংস্কৃতির নগরী। প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল রেখে এগিয়ে চলা বাংলাদেশে আমরা এখন হয়তো মজা করেই বলতে পারি—‘শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি/ এই নিয়ে ময়মনসিংহের পরিচিতি।’
মানুষের শ্রমে সমৃদ্ধ কৃষির পাশাপাশি এখানকার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষায় ঋদ্ধতার ইতিহাস সুপ্রাচীন। মহুয়া, মলুয়া, কমলা, সখিনা, বিনোদ, নদের চাঁদ, দস্যু কেনারাম, হুমরা বাইদার মাতৃস্থান লোকজ সংস্কৃতির স্বর্ণখনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ। এই জনপদের কবি দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা মহাকবি চন্দ্রাবতী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস স্বীকৃত প্রথম বাঙালি মহিলা কবি। সেই মধ্যযুগেই এখানকার সাহিত্য-সংস্কৃতি-ধর্মের সীমাবদ্ধতার গণ্ডি পেরিয়ে ষোলো আনা বাঙালিয়ানায় ঋদ্ধ হয়ে প্রেম-ভালোবাসা, সমাজবাস্তবতার স্বরূপ চিত্রায়ণে সফলতার ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়।
চন্দ্র কুমার দে সংগৃহীত দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত এই জনপদের পোড়খাওয়া সরল মানুষের অপার দরদে সৃষ্ট লোকজ সংস্কৃতি ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ স্থানিকতার বেষ্টনী ভেঙে সেই কবেই আলোড়ন তুলেছে ফোক দুনিয়ায়। সেই আলোড়নের ঢেউ আজও আন্দোলিত করে বাঙালি হৃদয়। রূপকথার গল্প ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র কথাই–বা কী করে ভুলি! এ যে সংস্কৃতির উর্বর ভূমি ময়মনসিংহ থেকেই সংগ্রহ করেছেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার।
বাংলার বারো ভূঁইয়ার একজন ঈসা খাঁর সঙ্গে দিল্লীশ্বরের সেনাপতি মান সিংহের যুদ্ধ। তরবারি ভেঙে যাওয়ার পরও শত্রু সেনাপতিকে হত্যা না করে তরবারি সংগ্রহের সুযোগ দেওয়া থেকে নতুন সম্পর্ক, নতুন প্রাপ্তি। পিতার জেলে বন্দী প্রাণপ্রিয় স্বামীকে মুক্ত করতে পিতারই সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে পুরুষবেশে রণাঙ্গনে কন্যা সখিনা বীরাঙ্গনা। যুদ্ধে মন ভাঙা চক্রান্তের বলি সখিনার চিরনিদ্রার স্থল কেল্লাতাজপুরের মাজার। এসব নিয়ে উদারতা-বদান্যতা-বীরত্বগাথার ঐতিহাসিক সত্যে রস লাগিয়ে রচিত শৈল্পিক পালা, কবিতা, প্রবন্ধ সাহিত্য ময়মনসিংহের সাহিত্যধারার পরিচায়ক।
ব্রিটিশ ভারতের প্রভাবশালী জমিদারদের আবাস ছিল ময়মনসিংহ। মুক্তাগাছা ও গৌরীপুরের জমিদাররা শাসন-তোষণের পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা রেখে গেছেন। প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ একসময় মুক্তাগাছায় থেকে সংগীত চর্চা করেছেন। এলাকা থেকে বিতাড়িত স্বভাবকবি গোবিন্দ দাসের আশ্রয়স্থল ছিল ময়মনসিংহ। ‘মহাশ্মশান’-এর মহাকবি কায়কোবাদও সাহিত্য চর্চা করেছেন মুক্তাগাছায় থেকে।
ব্রিটিশ আমলেই কলকাতাকেন্দ্রিক আধুনিক একটি সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির আবহ গড়ে ওঠে এই অঞ্চলে। এ সময় পূর্ববাংলায় একমাত্র অত্যাধুনিক ঘূর্ণমান রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হয় ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহে আসেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আসানসোলের রুটির দোকান থেকে মননশীল এক দারোগার সঙ্গ পেয়ে ময়মনসিংহের ত্রিশালে আসেন দুখু মিয়া, অর্থাৎ কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ব্রিটিশ আমল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ পর্যন্ত নাট্যচর্চায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে জমিদারদের প্রতিষ্ঠিত অমরাবতী নাটমন্দির। বর্তমানে বহুরূপী নাট্য সংস্থাসহ একাধিক সংগঠন সক্রিয় থেকে নাট্যাঙ্গনে রেখে যাচ্ছে বলিষ্ঠ পদচারণ। তৎকালে পূর্ব বাংলায় (আসামসহ) সবচেয়ে ধনাঢ্য জমিদার মহারাজা শশীকান্ত আচার্যের নামে অপূর্ব নির্মাণশৈলীতে ময়মনসিংহ শহরের প্রতিষ্ঠিত দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা ‘শশী লজ’ শৈল্পিক কর্মের বড় পরিচয়। আবার অতীতের ধারাবাহিকতায় বর্তমানেও ভিন্নতর শিল্পমনের পরিচয় মেলবে বাকৃবির বোটানিক্যাল গার্ডেনে।
শিল্পকর্মে ভাস্মর এই জনপদের কৃতী সন্তান শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। ব্রহ্মপুত্রের তীরে জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা সবার জন্য আকর্ষণের। ফুটন্ত সকাল, দুরন্ত দুপুর কিংবা পড়ন্ত বিকেলে নদ থেকে ভেসে আসা বাতাসে তনুমনে শীতলতার পরশ বোলাতে জয়নুল উদ্যানে বসা অথবা পায়চারি চলতে পারে অনায়াসে।
কবি নির্মলেন্দু গুণ, বুদ্ধিজীবী যতীন সরকারসহ বাংলা সাহিত্যের বহু প্রতিষ্ঠিত লেখক-কবি-সাহিত্যিকের নানা স্মৃতিবিজড়িত ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ, বীক্ষণ সাহিত্য আসরসহ বেশ কিছু সংগঠন সাহিত্যচর্চায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছে। সাহিত্য, রাজনীতি, সাংবাদিকতায় আলো ছড়ানো আলোকিত মানুষ কেদার নাথ মজুমদার, আবুল মনসুর আহমেদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, মাহ্ফুজ আনামসহ বহু গুণীকে জন্ম দিয়েছে ময়মনসিংহ।
একসময় ময়মনসিংহে মূলত উত্তরের পাহাড়ে কোচ, গারো, হাজং ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠীর বাস ছিল। এখনো মুসলমান-হিন্দু বাঙালির পাশাপাশি গারো, কোচ, হাজংসহ বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর সহাবস্থান এখানকার কৃষ্টিকে করেছে বৈচিত্র্যময়। হালুয়াঘাটে গারো অধ্যুষিত এলাকায় প্রতিষ্ঠিত আদিবাসী কালচারাল একাডেমি, মুক্তাগাছায় গারোদের সংস্কৃতি রক্ষা, চর্চা ও বিকাশ প্রত্যাশায় প্রতিষ্ঠার অপেক্ষায় থাকা প্রস্তাবিত গারো সাংস্কৃতিক একাডেমি ময়মনসিংহের বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সৃষ্টিশীলতার পাশাপাশি উৎপাদনেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক সময়ে মৎস্য, কৃষি, পশুপালন, ক্ষুদ্র-কুটির শিল্প, ভারী শিল্প—সব দিক থেকেই এগোচ্ছে এই জেলা। একসময়ের ধু-ধু নিষ্ফলা মাঠে এখন সবুজ ফসলের সমারোহ। গ্রামে গ্রামে গড়ে ওঠা পোলট্রি, গরুর ফার্ম, ফিশারিসহ বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক কৃষিকাজ গ্রামীণ অর্থনীতিতে অকল্পনীয় ইতিবাচক বিবর্তন ঘটিয়েছে।
ময়মনসিংহ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার মাছ দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে, তা গ্রামের
দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গ্রামে এখন কুঁড়েঘর বা টিনের ঘরের জায়গায় প্রতিনিয়ত পাকা ঘর তৈরি হচ্ছে। বহুতল ভবনও এখন ময়মনসিংহের অধিকাংশ গ্রামেই চোখে পড়ে।
জেলার ভালুকা, ত্রিশাল, গৌরীপুরসহ কিছু অঞ্চলে গড়ে ওঠা ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোও দেশে অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখছে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মতো সৃষ্টিশীল কর্মের চাকা গতিশীল রাখতেই অর্থনীতিতে সচ্ছলতা বজায় রাখা বাঞ্ছনীয়। এখানকার মজবুত গ্রামীণ অর্থনীতি জাতীয় অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করতে বড় ভূমিকা রাখছে।
সব দিক দিয়ে এগিয়ে চলেছে ময়মনসিংহ।
এম ইদ্রিছ আলী, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪