বিনায়ক সেন
এক. কেন ‘অর্থনৈতিক দর্শন’?
বঙ্গবন্ধুর ‘অর্থনৈতিক দর্শন’ শব্দটা কারও কারও কাছে কষ্টকল্পিত মনে হতে পারে। এ তো জানা কথাই যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোনো প্রথাগত অর্থে ‘তাত্ত্বিক’ ছিলেন না, যেরকমটা আমরা সচরাচর ভাবতে অভ্যস্ত মার্কস, লেনিন, গান্ধী বা মাও সে তুংয়ের ক্ষেত্রে। কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি গতিধারা নিয়ে বঙ্গবন্ধু নানা সময়েই গভীরভাবে ভেবেছেন। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, নয়া চীন ভ্রমণের স্মৃতিচারণা, তাঁর নেতৃত্বে প্রণীত বাহাত্তরের সংবিধানের ধারা-উপধারা, স্বাধীনতার আগে ও পরের বিভিন্ন ভাষণের সংগ্রহ প্রকাশের পর এখন আস্তে আস্তে একটি চিন্তাশীল মনের প্রতিকৃতি আমাদের সামনে ফুটে উঠছে, যা আগে ততটা দৃষ্টিগোচর হয়নি।
এই লেখাগুলো থেকে বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনের কয়েকটি মৌলিক দিক শনাক্ত করা যায়। এসব দিকের শুধু ঐতিহাসিক মূল্যই রয়েছে তা নয়, বর্তমানের উন্নয়নধারার গতিমুখ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এদের পদ্ধতিগত মূল্য অপরিসীম। সাম্প্রতিক এক দশকে উন্নয়নের নৈতিক দিক, উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচারের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক, অর্থাৎ ‘আইডিয়া অব জাস্টিস’ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। পজিটিভ বনাম নর্মাটিভ সায়েন্সের মধ্যে কৃত্রিম দেয়াল তুলে যারা উটপাখির মতো নিজস্ব সীমিত মাইক্রো অথবা ম্যাক্রো অর্থনৈতিক বলয়ে সংখ্যাতাত্ত্বিক গবেষণা চালিয়ে গেছেন, তাঁরা এখন পড়েছেন বিপাকে। অর্থশাস্ত্রীয় গবেষণা ও নীতি প্রণয়নে আগের মতো আর নিছক ‘টেকনোক্রেটিক’ সমাধানের মধ্যে নিজেকে গণ্ডিবদ্ধ বা পরিতৃপ্ত করা যাচ্ছে না। টান দিতে হচ্ছে দারিদ্র্য, জিডিপি বা বৈষম্যের পরিমাপের পেছনের তত্ত্বাগত বিবেচনা ও মৌল অনুমান নিয়েই। প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে উন্নয়নের অগ্রাধিকার নির্বাচনের পেছনের নৈতিক বিবেচনাবোধ নিয়ে।
এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়। সমগ্র বিশ্বেই একটি আত্মসমীক্ষা চলছে ইকোনমিকস ও এথিক্স নিয়ে। অমর্ত্য সেন ‘আইডিয়া অব জাস্টিস’ নিয়ে লিখেছেন, মাইকেল স্যান্ডেল লিখেছেন ‘দা টিরানি অব মেরিট’ তথাকথিত মেরিটক্রেসি-শাসিত সমাজের অন্ধকার দিকের কথা। এমনকি জাতিসংঘ ঘোষিত ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস’ (এসডিজি) এমন কতগুলো ‘কনসেপ্ট’ নিয়ে এসেছে, যার সূচক নির্মাণের জন্য প্রয়োজন প্রচুর নৈতিক আলোচনা। অন্যদিকে, এমন কিছু সূচক এর তালিকায় এসেছে, যা ‘ফলাফলের’ চেয়ে গুরুত্ব দেয় ‘প্রক্রিয়ার’ ওপরে। এসব কিছুর জন্যই আমাদের অর্থনৈতিক দর্শনের প্রতি হাত বাড়াতে হয়। এবং এই সূত্রেই বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনকে পুনরুদ্ধার ও পাঠ করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়েই গড়ে উঠেছে বর্তমান লেখাটির সংক্ষিপ্ত উপজীব্য।
দুই. বঙ্গবন্ধুর ‘সুযোগের সমতার’ সমাজ
বঙ্গবন্ধু ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটিকে নিজস্ব আদলে ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৭২ সালের ৭ জুন এক ভাষণে তিনি তাঁর অর্থও নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন এভাবে: ‘এ সমাজতন্ত্র হলো বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র, তার অর্থ হলো শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বণ্টন।’ সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহ, গণচীন প্রভৃতি দেশে যে সমাজতন্ত্র গড়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে এর গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। এসব দেশে গণতন্ত্র নেই। আর বঙ্গবন্ধুর কথা হলো, ‘দুনিয়ায় আমি বাংলার মাটি থেকে দেখাতে চাই যে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে আমি সমাজতন্ত্রকে কায়েম করব।’ কেননা, ‘আমি ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি।’ এ জন্যই তিনি বলেছেন, আমাদের সংবিধানের মূল স্তম্ভ যে ‘সমাজতন্ত্র’, তাকে ‘আমি দুনিয়া থেকে ভাড়া করে আনতে চাই না।’
প্রথাগত সমাজতন্ত্রের মডেল যেমন তিনি অনুসরণ করতে চান না, তেমনি তিনি উদ্গ্রীব নন সুইডেন-নরওয়ে স্টাইলের ‘স্ক্যান্ডিনেভিয়ান সোশ্যালিজমের’ প্রতি। এমনকি আগ্রহী নন ব্রিটেনের লেবার পার্টির সোশ্যালিজমের প্রতিও। কেননা, তিনি জানেন যে এসব দেশের মাথা পিছু আয়, কর-জিডিপির অনুপাত, ট্যাক্সিং-স্পেনডিং পাওয়ার আমাদের দেশের চেয়ে অনেক ওপরে। ৭২ সালে এই তুলনামূলক ব্যবধান ছিল আরও বেশি মাত্রায় প্রকট। একটি পশ্চাৎপদ কৃষিপ্রধান দেশে গণতন্ত্র অক্ষুণ্ন রেখে সমাজতন্ত্র নির্মাণের পথ যে ইউরোপের চেয়ে আলাদা হবে, তা তার অজানা ছিল না।
অনেকেই মনে করে থাকেন যে বঙ্গবন্ধু ওপরের কথাগুলো বুঝি ১৯৭২ সালেই এসে প্রথমে বলেছেন। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর কিছুকাল স্থবির হয়েছিল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আইয়ুবের আমলে। সেখান থেকে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ ১৯৬৪ সালে। সেই পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁরই নেতৃত্বে প্রণীত হয় পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের নতুন করে নির্মিত ঘোষণা ও কর্মসূচি। এ সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করে তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবর সংসদে বলেছিলেন: ‘১৯৬৪ সালের মার্চ মাসের ৬, ৭, ৮ তারিখে ঢাকার গ্রিন রোডের আমবাগানে যে কাউন্সিল অধিবেশন [হয়েছিল], তাতে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে পরিষ্কার ভাষায় এ দেশের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। এই সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য বিভিন্ন ধাপে জাতীয়করণের মাধ্যমে অগ্রসর হওয়ার বিধান আওয়ামী লীগের ইশতেহারে গৃহীত হয়। তারপর থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরবচ্ছিন্নভাবে এ দেশে সমাজতন্ত্রের কথা বলে এসেছেন। আগে সমাজতন্ত্রের কথা মানুষ পরিষ্কারভাবে বুঝত না।’
সমাজতন্ত্র সম্পর্কে পরিষ্কার বুঝের জন্য দুটি কথা ব্যাখ্যা করা জরুরি। প্রথমত, সমাজতন্ত্র শব্দটিকে বঙ্গবন্ধু জাতীয়করণ তথা রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানার নামান্তর বলে মনে করেননি। বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র ছিল ‘just and egalitarian society’র সমাজ। ন্যায়ানুগ ও সমতাবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে মানুষের মধ্যে ‘সুযোগের সমতা’ (বা ‘ইকুয়ালিটি অব অপরচুনিটি’) প্রতিষ্ঠা করে। এবং এটা করতে হবে গণতন্ত্রের নিয়মকানুন, প্রথা-মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে; কোনো একনায়কতন্ত্র বা অসহিষ্ণুপনা প্রদর্শনের মধ্যে দিয়ে নয়। দ্বিতীয়ত, সমাজতন্ত্র সম্পর্কে ক্ষমতায় যাওয়ার আগে এক কথা আর ক্ষমতায় যাওয়ার পরে আরেক কথা—এ রকম দ্বৈত সত্তা বঙ্গবন্ধুর ছিল না। নইলে সত্তরের নির্বাচনের আগে পাকিস্তানের বৈরী পরিবেশের ভেতরে বাস করে তিনি সমাজতন্ত্রের কথা তুলতে পারতেন না জনরায়ের জন্য।
এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের ১০ অক্টোবর রেডিও পাকিস্তান থেকে প্রচারিত লিখিত ভাষণে পূর্ব বাংলার জনগণের উদ্দেশে বলেছিলেন: ‘আমাদের বিশ্বাস, শাসনতান্ত্রিক এই কাঠামোর মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশে একটা সামাজিক বিপ্লব ঘটানো সম্ভব এবং অন্যায়, অবিচার ও শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।’ নির্বাচনের আগেই তিনি বলেন ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা বিলোপ, জায়গিরদারি-জমিদারি-সরদারি প্রভৃতি সামন্তবাদী মালিকানার অবসান, কৃষিব্যবস্থাকে প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণ, ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে সরকারি খাসজমির বণ্টন, চাষিদের মধ্যে বহুমুখী সমবায় গঠন, বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা, মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বার সবার জন্য খোলা রাখা, প্রতি ইউনিয়নে একটি করে পল্লি চিকিৎসাকেন্দ্র এবং প্রতি থানা সদরে একটি করে হাসপাতাল করার কথা। ‘১৯৪৭ সালের পর বাংলাদেশে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার পরিসংখ্যান একটা ভয়াবহ সত্য’—এই একটি কথার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের চিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছিলেন সেদিন।
বঙ্গবন্ধু সেদিনের প্রাক-নির্বাচনী ভাষণে জাতীয়করণের গুরুত্বও তুলে ধরেছিলেন, তবে সেটা ব্যক্তিমালিকানাকে বাদ দিয়ে নয়। সেদিন তিনি বলেছিলেন: ‘জাতীয়করণের নামে ব্যাংক ও বিমা কোম্পানিগুলোকে অর্থনীতির মূল চাবিকাঠিগুলো জনগণের মালিকানায় আনা অত্যাবশ্যক বলে আমরা বিশ্বাস করি। [তবে] বেসরকারি পর্যায়ে এর নিজস্ব ভূমিকা পালন করার সুযোগ রয়েছে। একচেটিয়াবাদ ও কার্টেল প্রথা সম্পূর্ণভাবে বিলোপ সাধন করতে হবে।’
এ ছাড়া প্রাক-নির্বাচনী বক্তৃতায় দলের অসাম্প্রদায়িক নীতির কথা তিনি জোরের সঙ্গে তুলে ধরেন। পাকিস্তানের বৈরী পরিবেশে সেটি নির্বাচনী বক্তৃতায় আনার মতো দৃঢ় মেরুদণ্ড ও সৎসাহস তাঁর ছিল: ‘সকল নাগরিকের সমান অধিকারে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের নিশ্চয় জানা আছে যে, আমরা সব সময়ই সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করে আসছি। সংখ্যালঘুরা অন্যান্য নাগরিকের মতোই সমান অধিকার ভোগ করবে। আইনের সমান রক্ষাকবচ সর্বক্ষেত্রেই পাবে।’
এ কথা প্রযোজ্য উপজাতীয় এলাকার ক্ষেত্রেও। এই সৎসাহসের প্রতি অমর্ত্য সেন সম্প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, ভারত এই সেক্যুলার নীতি থেকে হালের বছরগুলোতে ক্রমশ সরে আসছে। বঙ্গবন্ধুকে তিনি শুধু ‘Friend of Bengal’ না বলে গোটা ‘বিশ্বেরই বন্ধু’ বলে অভিহিত করতে চেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন Friend of the World —এভাবে আমরা তাঁকে নতুনভাবে চিনতে পারি।
তিন. বঙ্গবন্ধুর ‘সুষম বণ্টনের সমাজ’ এবং এসডিজি
এবারে বোধকরি বঙ্গবন্ধুর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের’ অর্থ কিছুটা হলেও স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। আগেই বলেছি, সমাজতন্ত্র মানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাভিত্তিক সমাজ নয়। সমাজতন্ত্রকে এমনকি শুধু সম্পত্তির ওপরে মালিকানার নিরিখে বিচার করা বলে না। মালিকানার বিচার সমাজতন্ত্রের একটি মূল দিক, তবে একমাত্র দিক নয়, প্রধানতম দিকও নয়। এর কারণ, সমাজতন্ত্র প্রতিশ্রুতি দেয় প্রত্যেক নাগরিককে ‘সুযোগের সমতা’ অধিকারের। সুযোগের সমতা বা equality of opportunity সমাজতন্ত্রের মৌলিক শর্তের একটি অবশ্যপূরণীয় শর্ত।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রণীত বাহাত্তরের সংবিধানের সুবিখ্যাত ১৩ নং অনুচ্ছেদে আমরা পাই সামাজিক মালিকানার কথা, তথা জনগণের মালিকানার কথা। সেটা বলতে শুধু জাতীয়করণকৃত কলকারখানা বা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়নি। সেখানে রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায়ী মালিকানা ও ব্যক্তিমালিকানার সমন্বয়ে মিশ্র মালিকানা ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর চোখে সামাজিক মালিকানার অর্থ মালিকানার উপরিউক্ত তিনটি ফরম। আসল কথা হচ্ছে, মালিকানা সে রাষ্ট্রীয় হোক বা ব্যক্তিমালিকানাই হোক, তা উদ্দেশ্য সিদ্ধির ‘উপায়’মাত্র। উপায় ও উদ্দেশ্যের মধ্যে গুলিয়ে ফেললে সমাজতন্ত্রের চরিত্রে বিকৃতি দেখা দিতে বাধ্য। মালিকানা সম্পর্কের বিশুদ্ধতা রক্ষার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জনকল্যাণ। সে জন্যই বঙ্গবন্ধুর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ কী তা বোঝার জন্য পরিণামবাদী (Consequentialist) দৃষ্টিভঙ্গিকে আশ্রয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজতন্ত্রকে কার্যকর করতে হলে তাকে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের ভাষায় কথা বলতে হবে, ‘অধিকারের ভাষায়’ কথা বলতে শিখতে হবে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ বঙ্গবন্ধুর সংবিধানের ১৯ ও ২০ নম্বর অনুচ্ছেদ।
১৯ নং অনুচ্ছেদের ১ নং ধারায় বলা হয়েছে ‘সুযোগের সমতার’ কথা, আর এর ২ নং ধারায় বলা হয়েছে ‘সুষম বণ্টনের কথা’। ১ নং ধারায় বলা হয়েছে: ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।’ আজকে যেটা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস-এর ১ নং (No Poverty), ২ নং (Zero Hunger), ৩ নং (Good Health & Well-being), ৪ নং (Quality Education), ৫ নং (Gender Equality), ৬ নং (Clean Water and Sanitation), ৭ নং (Affordable & Clean Energy), এবং ৮ নং (Decent Work & Economic Growth) লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তা পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের ইশতেহার, ’৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহার এবং ’৭২ সালের সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদে প্রতিফলিত হয়েছে। ১৫ নং অনুচ্ছেদে নাগরিকদের ‘মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা’ পূরণের অঙ্গীকার করা হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল ‘পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে’ প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা এবং এর মাধ্যমে ‘অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা’ করার কথা। শুধু বিষয়টাকে মৌলিক প্রয়োজনের মধ্যেই সীমিত রাখা হয়নি। সেখানে আরও বলা ছিল ‘কর্মের অধিকার’ নিশ্চিত করার কথা এবং ‘যুক্তিসংগত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার’ প্রদানের গুরুত্ব। যাঁরা পিছিয়ে পড়ে থাকবেন দারিদ্র্যের বিষ-বৃত্তের ভেতরে, তাঁদের প্রতি রাষ্ট্র সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
হাল আমলের তথাকথিত ‘সোশ্যাল প্রোটেকশন’ কর্মসূচির বহু আগেই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটতম সহকর্মীদের চিন্তায় এসেছিল পেছনে পড়ে থাকা জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করার কথা, যার সংজ্ঞা ছিল নিম্নরূপ: ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতৃপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্যলাভের অধিকার।’
শুধু ‘সুযোগের সমতার’ অধিকার নয়, আরও বেশি কিছু ছিল বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনে। তিনি বুঝেছিলেন যে ইকুয়ালিটি অব অপরচুনিটি সুষম বণ্টনের সমাজের দিকে এগোনোর একটি প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত বটে, কিন্তু যথেষ্ট পূর্বশর্ত নয়। সমাজের একটি মুষ্টিমেয় অংশই উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ লাভ করে দরিদ্র দশা থেকে সচ্ছল দশায় উন্নীত হতে পারবে। সবার ক্ষেত্রে অদৃষ্ট সমান প্রসন্ন হয় না, সবার ন্যাচারাল ব্যুৎপত্তি বা প্রতিভাও সমান নয়। কিন্তু তাই বলে কি যারা দীনের চেয়ে দীন, যারা আজীবন কায়িক শ্রমের ভেতরে, খেটে খাওয়া মানুষ যাদের বলি, তাদের কাজের কি মূল্যায়ন করা হবে না? তারা কি ফ্রন্টলাইন বা অ্যাসেনশিয়াল ওয়ার্কার্স হিসেবে স্বীকৃত ও সম্মানিত হবে না? তাদের কি সমান ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা (Common Good) পাওয়ার অধিকার নেই?
বঙ্গবন্ধু এই লক্ষ্যে বিশেষ করে ১৪ নং অনুচ্ছেদের প্রস্তাব করেছিলেন: ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।’ এবং তার জন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে মেহনতি মানুষকে সহায়তা করতে হবে, দেখভাল করতে হবে। আজকের Universal Basic Income-এর ধারণার পূর্ব ছায়াও আমরা এখানে দেখতে পাই। অন্যত্র ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রকারান্তরে তিনি উল্লেখ করলেন ‘equality of outcomes’-এর কথা। এটি এসডিজির ১০ নং লক্ষ্যমাত্রা ‘বৈষম্য হ্রাস করার’ সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। সেদিন তিনি বলেছিলেন: ‘এই সরকার ন্যায়ভিত্তিক ও গ্রামীণ জীবনের মধ্যকার বৈষম্য সম্পর্কে সচেতন। সেই সব ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার, যাঁরা পাট চাষিদের উপার্জিত অর্থ দিয়ে মানুষ হয়েছেন, তাঁদের গ্রামে ফিরে যেতে হবে। আমি ইতিমধ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে গ্রামে কাজ করার জন্য ৫০০ ডাক্তার নিযুক্ত করেছি। বাংলাদেশে মানুষ মানুষে ব্যক্তিত্বে বৈষম্য থাকবে না। সম্পদের বণ্টনব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে এবং উচ্চতর আয় ও নিম্নতর উপার্জনের ক্ষেত্রে যে আকাশচুম্বী বৈষম্য এত দিন ধরে বিরাজ করছিল, সেটা দূর করার ব্যবস্থাদি উদ্ভাবনের জন্য আমি একটি বিশেষ কমিটি গঠন করার কথা বিবেচনা করছি।’
বঙ্গবন্ধুর এই উপলব্ধিই বাহাত্তরের সংবিধানের ১৯ (২) ধারায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ’ করার জন্য এবং নাগরিকদের মধ্যে ‘সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত’ করার জন্য ‘সর্বত্র সুষম সুযোগ-সুবিধা’ প্রদানে রাষ্ট্রের তরফে ‘কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ’ করার কথা। পরিশেষে, ২০ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল শ্রম অনুযায়ী বণ্টনের কথা: ‘প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্য অনুসারে এবং প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী’ এই নীতির ভিত্তিতে ‘প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন।’ অর্থাৎ, নারী-পুরুষ, জাতি-বর্ণনির্বিশেষে সমান কর্মের জন্য অসমান পারিশ্রমিক সাংবিধানিকভাবে অগ্রহণযোগ্য বলে পরিগণিত হবে। এখানে এসডিজির ৫ নং লক্ষ্যমাত্রা (Gender Equality) এবং ৮ নং (Decent Work & Economic Growth)-এর সাদৃশ্য দৃশ্যমান।
৪. দুটো অভিযোগের উত্তরে
সবশেষে, বঙ্গবন্ধুর উপরিউক্ত অর্থনৈতিক দর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে দুটো অভিযোগের কথা তুলতে চাই। একটি অভিযোগ বেশি শোনা যায় ‘বামপন্থী’ অবস্থান থেকে, আরেকটি ‘ডানপন্থী’ অবস্থান থেকে। ‘বামপন্থী’ অভিযোগের মর্মার্থ হলো, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রণীত ১৫ নং ধারার ‘মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা’, ১৭ নং ধারার ‘অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা’, ১৮ নং ধারার ‘জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা’, ১৯ নং ধারার ‘সুযোগের সমতা’ এবং ২০ নং ধারার ‘কর্মের অধিকার ও সম্মান’—এ সবই সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার ‘মূলনীতির’ অধ্যায়ে সন্নিবেশিত কেবল। এসব ‘ভালো ভালো’ কথা সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ে স্থান পায়নি। তাদের যুক্তি হচ্ছে, মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে স্থান পেলে এসব বাস্তবায়নের পেছনে রাষ্ট্রের সচেষ্ট দায়বদ্ধতা থাকত। বঙ্গবন্ধু (ও তাঁর নিকটতম সহকর্মীরা) এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন। পাল্টা যুক্তি তাঁরা দিয়েছিলেন ১৯৭২ সালেই গণপরিষদে সংবিধান নিয়ে বিতর্ক চলাকালীন। তাঁদের যুক্তি ছিল, ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ে যেসব অধিকার দেওয়া আছে, সেগুলোর আশু বাস্তবায়ন না ঘটলে বা ব্যত্যয় ঘটলে তার জন্য নাগরিকেরা অবিলম্বে কোর্টের দ্বারস্থ হতে পারেন। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য ইত্যাদি সুবিধা আশু-ভিত্তিতে রাষ্ট্রের পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলেই এসব উন্নয়ন-ধারাকে রাষ্ট্রের ‘মৌলিক নীতিমালার’ ভেতরে রাখা হয়েছে ‘ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়নযোগ্য অধিকার’ হিসেবে বা যাকে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান ওসমানী বলেছেন ‘progressively realizable rights’ বলে। প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের সক্ষমতা বাড়তে থাকলে এসব অধ্যায়কে ‘মৌলিক অধিকার’ হিসেবে চিহ্নিত করা সহজতর হবে।
এবার আসি ‘ডানপন্থী’ অভিযোগের বিষয়ে। ইতিপূর্বে আমি বলেছি, বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’কে কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানার দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞায়িত করতে চাননি। তিনি নাগরিকের কল্যাণ, স্বাধীনতা ও ‘অধিকারের’ দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে আত্মস্থ করেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা বিধান করা এবং ক্রমান্বয়ে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা (যেটা এখন এসডিজির ১০ নং লক্ষ্যমাত্রায় বিধৃত হয়েছে)। ডানপন্থীদের অভিযোগ হলো, তাহলে ১৯৭২ সালে এত তড়িঘড়ি করে ‘জাতীয়করণ’ করা হলো কেন এবং কেনই বা ব্যক্তি-পুঁজির বিনিয়োগের সীমা বেঁধে দেওয়া হলো? এ নিয়ে নানাজনই লিখেছেন আগে, সম্প্রতি আমিও লিখেছি। এখানে পাল্টা যুক্তি হচ্ছে ত্রিবিধ। প্রথমত, জাতীয়করণকৃত বেশির ভাগ কলকারখানার বা পরিসম্পদের মালিকানা ছিল অবাঙালি শিল্পপতিদের হাতে। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পরপরই বা চলাকালীনই দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে তাঁদের ব্যাংক-অ্যাকাউন্ট থেকে টাকাপয়সা সব তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। বাংলাদেশেও বাইশ পরিবারের মতো অর্থনৈতিক সম্পদ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটুক, সেটি বঙ্গবন্ধু কখনোই চাননি। এ জন্যই প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যক্তি-পুঁজিকে সর্বতো উপায়ে সহায়তা দেওয়া হয়, কিন্তু বৃহৎ ব্যক্তি-পুঁজির বিকাশকে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। কালক্রমে (১৯৭৪ সালেই) বৃহৎ ব্যক্তি পুঁজির ‘সিলিং’ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, যা তখনকার দিনের বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তার বিকাশের জন্য যথেষ্ট পরিসরই দিয়েছিল। তৃতীয়ত, গত চার দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তাদের একটি বড় অংশ ‘রপ্তানিমূলক’ শিল্পে এবং সাম্প্রতিক দশকে ‘অভ্যন্তরীণ চাহিদামুখীন’ শিল্পে বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সুস্থ ব্যক্তি খাতের বিকাশের পথে বিনিয়োগের সিলিং-জনিত প্রতিবন্ধকতা কৃত্রিমভাবে আরোপ করার প্রয়োজনীয়তাও অনেক আগেই নিঃশেষিত হয়েছে। কিন্তু তার মানে কি এই যে, ব্যক্তি-পুঁজির ওপরে রাষ্ট্রের ‘নজরদারির’ প্রয়োজনীয়তাও সেই সঙ্গে লুপ্ত হয়ে গেছে? ‘মার্কেট-ফ্রেন্ডলি’ হওয়া এবং ‘বিজনেস-ফ্রেন্ডলি’ হওয়া তো সমার্থক শব্দ নয়। ২০১০-এর দশকের অভিজ্ঞতা এখানে মিশ্র তথ্য-প্রমাণ দিচ্ছে।
ব্যক্তি খাতের সাফল্যের পাশাপাশি সরকারি অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যক্তি খাতের দায়দেনাও (Default) বিস্তর এবং ক্রমবর্ধমান। যে হারে ব্যক্তি খাতের প্রবৃদ্ধি ঘটেছে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটেছে ২০১০-এর দশকে, সেই হারে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়েনি। ফলে সামাজিক কল্যাণের ক্ষেত্রে বা Common Goods সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের যে ভূমিকা প্রত্যাশিত ছিল, তা এখনো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আসেনি।
‘মার্কেট ইকোনমি’ হওয়ার পাশাপাশি আমরা যেন অতিদ্রুত ‘মার্কেট সোসাইটিতে’ পরিণত হচ্ছি। মার্কেট ইকোনমি আরও শক্তিশালী হওয়া দরকার এ দেশে, কোনো সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে আমরা যেন উত্তরোত্তর কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত না হয়ে কেবল মার্কেট সোসাইটিতে রূপান্তরিত না হই। শেষোক্ত সমাজে সবকিছু, সব মূল্যবোধই, শেষ পর্যন্ত ‘কেনাবেচার’ সামগ্রীতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে সেটা বিদ্যাদান, চিকিৎসাসেবা থেকে শুরু করে ‘সামাজিক উদ্যোগ’, এমনকি আইনশৃঙ্খলা কার্যক্রম পর্যন্ত। এ ধরনের সমাজ শেষাবধি মানুষের বাসযোগ্য ভূমি থাকে না। বঙ্গবন্ধুর দর্শনে এ ধরনের ডিস্টোপিয়ান ‘মার্কেট-সোসাইটির’ কোনো স্থান ছিল না। এ জন্যই তাঁকে জনগণের তদারকি, জনগণের মালিকানা ও জনস্বার্থের প্রয়োজনে সংবিধানের ৪৭ নং অনুচ্ছেদ যুক্ত করতে হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান নৈয়ায়িক দার্শনিক জন রাউলস, অমর্ত্য সেন ও মাইকেল স্যান্ডেলের অনুবর্তী। আমাদের সমাজের স্বভাবত ধর্মবিহিত মূল্যবোধ এই অবস্থানের প্রতিই সমর্থন জানায়।
বিনায়ক সেন
অর্থনীতিবিদ
এক. কেন ‘অর্থনৈতিক দর্শন’?
বঙ্গবন্ধুর ‘অর্থনৈতিক দর্শন’ শব্দটা কারও কারও কাছে কষ্টকল্পিত মনে হতে পারে। এ তো জানা কথাই যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোনো প্রথাগত অর্থে ‘তাত্ত্বিক’ ছিলেন না, যেরকমটা আমরা সচরাচর ভাবতে অভ্যস্ত মার্কস, লেনিন, গান্ধী বা মাও সে তুংয়ের ক্ষেত্রে। কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি গতিধারা নিয়ে বঙ্গবন্ধু নানা সময়েই গভীরভাবে ভেবেছেন। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, নয়া চীন ভ্রমণের স্মৃতিচারণা, তাঁর নেতৃত্বে প্রণীত বাহাত্তরের সংবিধানের ধারা-উপধারা, স্বাধীনতার আগে ও পরের বিভিন্ন ভাষণের সংগ্রহ প্রকাশের পর এখন আস্তে আস্তে একটি চিন্তাশীল মনের প্রতিকৃতি আমাদের সামনে ফুটে উঠছে, যা আগে ততটা দৃষ্টিগোচর হয়নি।
এই লেখাগুলো থেকে বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনের কয়েকটি মৌলিক দিক শনাক্ত করা যায়। এসব দিকের শুধু ঐতিহাসিক মূল্যই রয়েছে তা নয়, বর্তমানের উন্নয়নধারার গতিমুখ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এদের পদ্ধতিগত মূল্য অপরিসীম। সাম্প্রতিক এক দশকে উন্নয়নের নৈতিক দিক, উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচারের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক, অর্থাৎ ‘আইডিয়া অব জাস্টিস’ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। পজিটিভ বনাম নর্মাটিভ সায়েন্সের মধ্যে কৃত্রিম দেয়াল তুলে যারা উটপাখির মতো নিজস্ব সীমিত মাইক্রো অথবা ম্যাক্রো অর্থনৈতিক বলয়ে সংখ্যাতাত্ত্বিক গবেষণা চালিয়ে গেছেন, তাঁরা এখন পড়েছেন বিপাকে। অর্থশাস্ত্রীয় গবেষণা ও নীতি প্রণয়নে আগের মতো আর নিছক ‘টেকনোক্রেটিক’ সমাধানের মধ্যে নিজেকে গণ্ডিবদ্ধ বা পরিতৃপ্ত করা যাচ্ছে না। টান দিতে হচ্ছে দারিদ্র্য, জিডিপি বা বৈষম্যের পরিমাপের পেছনের তত্ত্বাগত বিবেচনা ও মৌল অনুমান নিয়েই। প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে উন্নয়নের অগ্রাধিকার নির্বাচনের পেছনের নৈতিক বিবেচনাবোধ নিয়ে।
এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়। সমগ্র বিশ্বেই একটি আত্মসমীক্ষা চলছে ইকোনমিকস ও এথিক্স নিয়ে। অমর্ত্য সেন ‘আইডিয়া অব জাস্টিস’ নিয়ে লিখেছেন, মাইকেল স্যান্ডেল লিখেছেন ‘দা টিরানি অব মেরিট’ তথাকথিত মেরিটক্রেসি-শাসিত সমাজের অন্ধকার দিকের কথা। এমনকি জাতিসংঘ ঘোষিত ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস’ (এসডিজি) এমন কতগুলো ‘কনসেপ্ট’ নিয়ে এসেছে, যার সূচক নির্মাণের জন্য প্রয়োজন প্রচুর নৈতিক আলোচনা। অন্যদিকে, এমন কিছু সূচক এর তালিকায় এসেছে, যা ‘ফলাফলের’ চেয়ে গুরুত্ব দেয় ‘প্রক্রিয়ার’ ওপরে। এসব কিছুর জন্যই আমাদের অর্থনৈতিক দর্শনের প্রতি হাত বাড়াতে হয়। এবং এই সূত্রেই বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনকে পুনরুদ্ধার ও পাঠ করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়েই গড়ে উঠেছে বর্তমান লেখাটির সংক্ষিপ্ত উপজীব্য।
দুই. বঙ্গবন্ধুর ‘সুযোগের সমতার’ সমাজ
বঙ্গবন্ধু ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটিকে নিজস্ব আদলে ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৭২ সালের ৭ জুন এক ভাষণে তিনি তাঁর অর্থও নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন এভাবে: ‘এ সমাজতন্ত্র হলো বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র, তার অর্থ হলো শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বণ্টন।’ সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহ, গণচীন প্রভৃতি দেশে যে সমাজতন্ত্র গড়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে এর গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। এসব দেশে গণতন্ত্র নেই। আর বঙ্গবন্ধুর কথা হলো, ‘দুনিয়ায় আমি বাংলার মাটি থেকে দেখাতে চাই যে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে আমি সমাজতন্ত্রকে কায়েম করব।’ কেননা, ‘আমি ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি।’ এ জন্যই তিনি বলেছেন, আমাদের সংবিধানের মূল স্তম্ভ যে ‘সমাজতন্ত্র’, তাকে ‘আমি দুনিয়া থেকে ভাড়া করে আনতে চাই না।’
প্রথাগত সমাজতন্ত্রের মডেল যেমন তিনি অনুসরণ করতে চান না, তেমনি তিনি উদ্গ্রীব নন সুইডেন-নরওয়ে স্টাইলের ‘স্ক্যান্ডিনেভিয়ান সোশ্যালিজমের’ প্রতি। এমনকি আগ্রহী নন ব্রিটেনের লেবার পার্টির সোশ্যালিজমের প্রতিও। কেননা, তিনি জানেন যে এসব দেশের মাথা পিছু আয়, কর-জিডিপির অনুপাত, ট্যাক্সিং-স্পেনডিং পাওয়ার আমাদের দেশের চেয়ে অনেক ওপরে। ৭২ সালে এই তুলনামূলক ব্যবধান ছিল আরও বেশি মাত্রায় প্রকট। একটি পশ্চাৎপদ কৃষিপ্রধান দেশে গণতন্ত্র অক্ষুণ্ন রেখে সমাজতন্ত্র নির্মাণের পথ যে ইউরোপের চেয়ে আলাদা হবে, তা তার অজানা ছিল না।
অনেকেই মনে করে থাকেন যে বঙ্গবন্ধু ওপরের কথাগুলো বুঝি ১৯৭২ সালেই এসে প্রথমে বলেছেন। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর কিছুকাল স্থবির হয়েছিল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আইয়ুবের আমলে। সেখান থেকে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ ১৯৬৪ সালে। সেই পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁরই নেতৃত্বে প্রণীত হয় পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের নতুন করে নির্মিত ঘোষণা ও কর্মসূচি। এ সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করে তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবর সংসদে বলেছিলেন: ‘১৯৬৪ সালের মার্চ মাসের ৬, ৭, ৮ তারিখে ঢাকার গ্রিন রোডের আমবাগানে যে কাউন্সিল অধিবেশন [হয়েছিল], তাতে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে পরিষ্কার ভাষায় এ দেশের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। এই সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য বিভিন্ন ধাপে জাতীয়করণের মাধ্যমে অগ্রসর হওয়ার বিধান আওয়ামী লীগের ইশতেহারে গৃহীত হয়। তারপর থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরবচ্ছিন্নভাবে এ দেশে সমাজতন্ত্রের কথা বলে এসেছেন। আগে সমাজতন্ত্রের কথা মানুষ পরিষ্কারভাবে বুঝত না।’
সমাজতন্ত্র সম্পর্কে পরিষ্কার বুঝের জন্য দুটি কথা ব্যাখ্যা করা জরুরি। প্রথমত, সমাজতন্ত্র শব্দটিকে বঙ্গবন্ধু জাতীয়করণ তথা রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানার নামান্তর বলে মনে করেননি। বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র ছিল ‘just and egalitarian society’র সমাজ। ন্যায়ানুগ ও সমতাবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে মানুষের মধ্যে ‘সুযোগের সমতা’ (বা ‘ইকুয়ালিটি অব অপরচুনিটি’) প্রতিষ্ঠা করে। এবং এটা করতে হবে গণতন্ত্রের নিয়মকানুন, প্রথা-মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে; কোনো একনায়কতন্ত্র বা অসহিষ্ণুপনা প্রদর্শনের মধ্যে দিয়ে নয়। দ্বিতীয়ত, সমাজতন্ত্র সম্পর্কে ক্ষমতায় যাওয়ার আগে এক কথা আর ক্ষমতায় যাওয়ার পরে আরেক কথা—এ রকম দ্বৈত সত্তা বঙ্গবন্ধুর ছিল না। নইলে সত্তরের নির্বাচনের আগে পাকিস্তানের বৈরী পরিবেশের ভেতরে বাস করে তিনি সমাজতন্ত্রের কথা তুলতে পারতেন না জনরায়ের জন্য।
এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের ১০ অক্টোবর রেডিও পাকিস্তান থেকে প্রচারিত লিখিত ভাষণে পূর্ব বাংলার জনগণের উদ্দেশে বলেছিলেন: ‘আমাদের বিশ্বাস, শাসনতান্ত্রিক এই কাঠামোর মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশে একটা সামাজিক বিপ্লব ঘটানো সম্ভব এবং অন্যায়, অবিচার ও শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।’ নির্বাচনের আগেই তিনি বলেন ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা বিলোপ, জায়গিরদারি-জমিদারি-সরদারি প্রভৃতি সামন্তবাদী মালিকানার অবসান, কৃষিব্যবস্থাকে প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণ, ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে সরকারি খাসজমির বণ্টন, চাষিদের মধ্যে বহুমুখী সমবায় গঠন, বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা, মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বার সবার জন্য খোলা রাখা, প্রতি ইউনিয়নে একটি করে পল্লি চিকিৎসাকেন্দ্র এবং প্রতি থানা সদরে একটি করে হাসপাতাল করার কথা। ‘১৯৪৭ সালের পর বাংলাদেশে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার পরিসংখ্যান একটা ভয়াবহ সত্য’—এই একটি কথার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের চিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছিলেন সেদিন।
বঙ্গবন্ধু সেদিনের প্রাক-নির্বাচনী ভাষণে জাতীয়করণের গুরুত্বও তুলে ধরেছিলেন, তবে সেটা ব্যক্তিমালিকানাকে বাদ দিয়ে নয়। সেদিন তিনি বলেছিলেন: ‘জাতীয়করণের নামে ব্যাংক ও বিমা কোম্পানিগুলোকে অর্থনীতির মূল চাবিকাঠিগুলো জনগণের মালিকানায় আনা অত্যাবশ্যক বলে আমরা বিশ্বাস করি। [তবে] বেসরকারি পর্যায়ে এর নিজস্ব ভূমিকা পালন করার সুযোগ রয়েছে। একচেটিয়াবাদ ও কার্টেল প্রথা সম্পূর্ণভাবে বিলোপ সাধন করতে হবে।’
এ ছাড়া প্রাক-নির্বাচনী বক্তৃতায় দলের অসাম্প্রদায়িক নীতির কথা তিনি জোরের সঙ্গে তুলে ধরেন। পাকিস্তানের বৈরী পরিবেশে সেটি নির্বাচনী বক্তৃতায় আনার মতো দৃঢ় মেরুদণ্ড ও সৎসাহস তাঁর ছিল: ‘সকল নাগরিকের সমান অধিকারে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের নিশ্চয় জানা আছে যে, আমরা সব সময়ই সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করে আসছি। সংখ্যালঘুরা অন্যান্য নাগরিকের মতোই সমান অধিকার ভোগ করবে। আইনের সমান রক্ষাকবচ সর্বক্ষেত্রেই পাবে।’
এ কথা প্রযোজ্য উপজাতীয় এলাকার ক্ষেত্রেও। এই সৎসাহসের প্রতি অমর্ত্য সেন সম্প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, ভারত এই সেক্যুলার নীতি থেকে হালের বছরগুলোতে ক্রমশ সরে আসছে। বঙ্গবন্ধুকে তিনি শুধু ‘Friend of Bengal’ না বলে গোটা ‘বিশ্বেরই বন্ধু’ বলে অভিহিত করতে চেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন Friend of the World —এভাবে আমরা তাঁকে নতুনভাবে চিনতে পারি।
তিন. বঙ্গবন্ধুর ‘সুষম বণ্টনের সমাজ’ এবং এসডিজি
এবারে বোধকরি বঙ্গবন্ধুর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের’ অর্থ কিছুটা হলেও স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। আগেই বলেছি, সমাজতন্ত্র মানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাভিত্তিক সমাজ নয়। সমাজতন্ত্রকে এমনকি শুধু সম্পত্তির ওপরে মালিকানার নিরিখে বিচার করা বলে না। মালিকানার বিচার সমাজতন্ত্রের একটি মূল দিক, তবে একমাত্র দিক নয়, প্রধানতম দিকও নয়। এর কারণ, সমাজতন্ত্র প্রতিশ্রুতি দেয় প্রত্যেক নাগরিককে ‘সুযোগের সমতা’ অধিকারের। সুযোগের সমতা বা equality of opportunity সমাজতন্ত্রের মৌলিক শর্তের একটি অবশ্যপূরণীয় শর্ত।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রণীত বাহাত্তরের সংবিধানের সুবিখ্যাত ১৩ নং অনুচ্ছেদে আমরা পাই সামাজিক মালিকানার কথা, তথা জনগণের মালিকানার কথা। সেটা বলতে শুধু জাতীয়করণকৃত কলকারখানা বা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়নি। সেখানে রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায়ী মালিকানা ও ব্যক্তিমালিকানার সমন্বয়ে মিশ্র মালিকানা ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর চোখে সামাজিক মালিকানার অর্থ মালিকানার উপরিউক্ত তিনটি ফরম। আসল কথা হচ্ছে, মালিকানা সে রাষ্ট্রীয় হোক বা ব্যক্তিমালিকানাই হোক, তা উদ্দেশ্য সিদ্ধির ‘উপায়’মাত্র। উপায় ও উদ্দেশ্যের মধ্যে গুলিয়ে ফেললে সমাজতন্ত্রের চরিত্রে বিকৃতি দেখা দিতে বাধ্য। মালিকানা সম্পর্কের বিশুদ্ধতা রক্ষার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জনকল্যাণ। সে জন্যই বঙ্গবন্ধুর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ কী তা বোঝার জন্য পরিণামবাদী (Consequentialist) দৃষ্টিভঙ্গিকে আশ্রয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজতন্ত্রকে কার্যকর করতে হলে তাকে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের ভাষায় কথা বলতে হবে, ‘অধিকারের ভাষায়’ কথা বলতে শিখতে হবে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ বঙ্গবন্ধুর সংবিধানের ১৯ ও ২০ নম্বর অনুচ্ছেদ।
১৯ নং অনুচ্ছেদের ১ নং ধারায় বলা হয়েছে ‘সুযোগের সমতার’ কথা, আর এর ২ নং ধারায় বলা হয়েছে ‘সুষম বণ্টনের কথা’। ১ নং ধারায় বলা হয়েছে: ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।’ আজকে যেটা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস-এর ১ নং (No Poverty), ২ নং (Zero Hunger), ৩ নং (Good Health & Well-being), ৪ নং (Quality Education), ৫ নং (Gender Equality), ৬ নং (Clean Water and Sanitation), ৭ নং (Affordable & Clean Energy), এবং ৮ নং (Decent Work & Economic Growth) লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তা পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের ইশতেহার, ’৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহার এবং ’৭২ সালের সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদে প্রতিফলিত হয়েছে। ১৫ নং অনুচ্ছেদে নাগরিকদের ‘মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা’ পূরণের অঙ্গীকার করা হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল ‘পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে’ প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা এবং এর মাধ্যমে ‘অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা’ করার কথা। শুধু বিষয়টাকে মৌলিক প্রয়োজনের মধ্যেই সীমিত রাখা হয়নি। সেখানে আরও বলা ছিল ‘কর্মের অধিকার’ নিশ্চিত করার কথা এবং ‘যুক্তিসংগত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার’ প্রদানের গুরুত্ব। যাঁরা পিছিয়ে পড়ে থাকবেন দারিদ্র্যের বিষ-বৃত্তের ভেতরে, তাঁদের প্রতি রাষ্ট্র সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
হাল আমলের তথাকথিত ‘সোশ্যাল প্রোটেকশন’ কর্মসূচির বহু আগেই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটতম সহকর্মীদের চিন্তায় এসেছিল পেছনে পড়ে থাকা জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করার কথা, যার সংজ্ঞা ছিল নিম্নরূপ: ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতৃপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্যলাভের অধিকার।’
শুধু ‘সুযোগের সমতার’ অধিকার নয়, আরও বেশি কিছু ছিল বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনে। তিনি বুঝেছিলেন যে ইকুয়ালিটি অব অপরচুনিটি সুষম বণ্টনের সমাজের দিকে এগোনোর একটি প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত বটে, কিন্তু যথেষ্ট পূর্বশর্ত নয়। সমাজের একটি মুষ্টিমেয় অংশই উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ লাভ করে দরিদ্র দশা থেকে সচ্ছল দশায় উন্নীত হতে পারবে। সবার ক্ষেত্রে অদৃষ্ট সমান প্রসন্ন হয় না, সবার ন্যাচারাল ব্যুৎপত্তি বা প্রতিভাও সমান নয়। কিন্তু তাই বলে কি যারা দীনের চেয়ে দীন, যারা আজীবন কায়িক শ্রমের ভেতরে, খেটে খাওয়া মানুষ যাদের বলি, তাদের কাজের কি মূল্যায়ন করা হবে না? তারা কি ফ্রন্টলাইন বা অ্যাসেনশিয়াল ওয়ার্কার্স হিসেবে স্বীকৃত ও সম্মানিত হবে না? তাদের কি সমান ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা (Common Good) পাওয়ার অধিকার নেই?
বঙ্গবন্ধু এই লক্ষ্যে বিশেষ করে ১৪ নং অনুচ্ছেদের প্রস্তাব করেছিলেন: ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।’ এবং তার জন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে মেহনতি মানুষকে সহায়তা করতে হবে, দেখভাল করতে হবে। আজকের Universal Basic Income-এর ধারণার পূর্ব ছায়াও আমরা এখানে দেখতে পাই। অন্যত্র ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রকারান্তরে তিনি উল্লেখ করলেন ‘equality of outcomes’-এর কথা। এটি এসডিজির ১০ নং লক্ষ্যমাত্রা ‘বৈষম্য হ্রাস করার’ সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। সেদিন তিনি বলেছিলেন: ‘এই সরকার ন্যায়ভিত্তিক ও গ্রামীণ জীবনের মধ্যকার বৈষম্য সম্পর্কে সচেতন। সেই সব ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার, যাঁরা পাট চাষিদের উপার্জিত অর্থ দিয়ে মানুষ হয়েছেন, তাঁদের গ্রামে ফিরে যেতে হবে। আমি ইতিমধ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে গ্রামে কাজ করার জন্য ৫০০ ডাক্তার নিযুক্ত করেছি। বাংলাদেশে মানুষ মানুষে ব্যক্তিত্বে বৈষম্য থাকবে না। সম্পদের বণ্টনব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে এবং উচ্চতর আয় ও নিম্নতর উপার্জনের ক্ষেত্রে যে আকাশচুম্বী বৈষম্য এত দিন ধরে বিরাজ করছিল, সেটা দূর করার ব্যবস্থাদি উদ্ভাবনের জন্য আমি একটি বিশেষ কমিটি গঠন করার কথা বিবেচনা করছি।’
বঙ্গবন্ধুর এই উপলব্ধিই বাহাত্তরের সংবিধানের ১৯ (২) ধারায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ’ করার জন্য এবং নাগরিকদের মধ্যে ‘সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত’ করার জন্য ‘সর্বত্র সুষম সুযোগ-সুবিধা’ প্রদানে রাষ্ট্রের তরফে ‘কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ’ করার কথা। পরিশেষে, ২০ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল শ্রম অনুযায়ী বণ্টনের কথা: ‘প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্য অনুসারে এবং প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী’ এই নীতির ভিত্তিতে ‘প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন।’ অর্থাৎ, নারী-পুরুষ, জাতি-বর্ণনির্বিশেষে সমান কর্মের জন্য অসমান পারিশ্রমিক সাংবিধানিকভাবে অগ্রহণযোগ্য বলে পরিগণিত হবে। এখানে এসডিজির ৫ নং লক্ষ্যমাত্রা (Gender Equality) এবং ৮ নং (Decent Work & Economic Growth)-এর সাদৃশ্য দৃশ্যমান।
৪. দুটো অভিযোগের উত্তরে
সবশেষে, বঙ্গবন্ধুর উপরিউক্ত অর্থনৈতিক দর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে দুটো অভিযোগের কথা তুলতে চাই। একটি অভিযোগ বেশি শোনা যায় ‘বামপন্থী’ অবস্থান থেকে, আরেকটি ‘ডানপন্থী’ অবস্থান থেকে। ‘বামপন্থী’ অভিযোগের মর্মার্থ হলো, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রণীত ১৫ নং ধারার ‘মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা’, ১৭ নং ধারার ‘অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা’, ১৮ নং ধারার ‘জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা’, ১৯ নং ধারার ‘সুযোগের সমতা’ এবং ২০ নং ধারার ‘কর্মের অধিকার ও সম্মান’—এ সবই সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার ‘মূলনীতির’ অধ্যায়ে সন্নিবেশিত কেবল। এসব ‘ভালো ভালো’ কথা সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ে স্থান পায়নি। তাদের যুক্তি হচ্ছে, মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে স্থান পেলে এসব বাস্তবায়নের পেছনে রাষ্ট্রের সচেষ্ট দায়বদ্ধতা থাকত। বঙ্গবন্ধু (ও তাঁর নিকটতম সহকর্মীরা) এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন। পাল্টা যুক্তি তাঁরা দিয়েছিলেন ১৯৭২ সালেই গণপরিষদে সংবিধান নিয়ে বিতর্ক চলাকালীন। তাঁদের যুক্তি ছিল, ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ে যেসব অধিকার দেওয়া আছে, সেগুলোর আশু বাস্তবায়ন না ঘটলে বা ব্যত্যয় ঘটলে তার জন্য নাগরিকেরা অবিলম্বে কোর্টের দ্বারস্থ হতে পারেন। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য ইত্যাদি সুবিধা আশু-ভিত্তিতে রাষ্ট্রের পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলেই এসব উন্নয়ন-ধারাকে রাষ্ট্রের ‘মৌলিক নীতিমালার’ ভেতরে রাখা হয়েছে ‘ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়নযোগ্য অধিকার’ হিসেবে বা যাকে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান ওসমানী বলেছেন ‘progressively realizable rights’ বলে। প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের সক্ষমতা বাড়তে থাকলে এসব অধ্যায়কে ‘মৌলিক অধিকার’ হিসেবে চিহ্নিত করা সহজতর হবে।
এবার আসি ‘ডানপন্থী’ অভিযোগের বিষয়ে। ইতিপূর্বে আমি বলেছি, বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’কে কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানার দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞায়িত করতে চাননি। তিনি নাগরিকের কল্যাণ, স্বাধীনতা ও ‘অধিকারের’ দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে আত্মস্থ করেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা বিধান করা এবং ক্রমান্বয়ে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা (যেটা এখন এসডিজির ১০ নং লক্ষ্যমাত্রায় বিধৃত হয়েছে)। ডানপন্থীদের অভিযোগ হলো, তাহলে ১৯৭২ সালে এত তড়িঘড়ি করে ‘জাতীয়করণ’ করা হলো কেন এবং কেনই বা ব্যক্তি-পুঁজির বিনিয়োগের সীমা বেঁধে দেওয়া হলো? এ নিয়ে নানাজনই লিখেছেন আগে, সম্প্রতি আমিও লিখেছি। এখানে পাল্টা যুক্তি হচ্ছে ত্রিবিধ। প্রথমত, জাতীয়করণকৃত বেশির ভাগ কলকারখানার বা পরিসম্পদের মালিকানা ছিল অবাঙালি শিল্পপতিদের হাতে। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পরপরই বা চলাকালীনই দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে তাঁদের ব্যাংক-অ্যাকাউন্ট থেকে টাকাপয়সা সব তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। বাংলাদেশেও বাইশ পরিবারের মতো অর্থনৈতিক সম্পদ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটুক, সেটি বঙ্গবন্ধু কখনোই চাননি। এ জন্যই প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যক্তি-পুঁজিকে সর্বতো উপায়ে সহায়তা দেওয়া হয়, কিন্তু বৃহৎ ব্যক্তি-পুঁজির বিকাশকে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। কালক্রমে (১৯৭৪ সালেই) বৃহৎ ব্যক্তি পুঁজির ‘সিলিং’ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, যা তখনকার দিনের বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তার বিকাশের জন্য যথেষ্ট পরিসরই দিয়েছিল। তৃতীয়ত, গত চার দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তাদের একটি বড় অংশ ‘রপ্তানিমূলক’ শিল্পে এবং সাম্প্রতিক দশকে ‘অভ্যন্তরীণ চাহিদামুখীন’ শিল্পে বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সুস্থ ব্যক্তি খাতের বিকাশের পথে বিনিয়োগের সিলিং-জনিত প্রতিবন্ধকতা কৃত্রিমভাবে আরোপ করার প্রয়োজনীয়তাও অনেক আগেই নিঃশেষিত হয়েছে। কিন্তু তার মানে কি এই যে, ব্যক্তি-পুঁজির ওপরে রাষ্ট্রের ‘নজরদারির’ প্রয়োজনীয়তাও সেই সঙ্গে লুপ্ত হয়ে গেছে? ‘মার্কেট-ফ্রেন্ডলি’ হওয়া এবং ‘বিজনেস-ফ্রেন্ডলি’ হওয়া তো সমার্থক শব্দ নয়। ২০১০-এর দশকের অভিজ্ঞতা এখানে মিশ্র তথ্য-প্রমাণ দিচ্ছে।
ব্যক্তি খাতের সাফল্যের পাশাপাশি সরকারি অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যক্তি খাতের দায়দেনাও (Default) বিস্তর এবং ক্রমবর্ধমান। যে হারে ব্যক্তি খাতের প্রবৃদ্ধি ঘটেছে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটেছে ২০১০-এর দশকে, সেই হারে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়েনি। ফলে সামাজিক কল্যাণের ক্ষেত্রে বা Common Goods সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের যে ভূমিকা প্রত্যাশিত ছিল, তা এখনো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আসেনি।
‘মার্কেট ইকোনমি’ হওয়ার পাশাপাশি আমরা যেন অতিদ্রুত ‘মার্কেট সোসাইটিতে’ পরিণত হচ্ছি। মার্কেট ইকোনমি আরও শক্তিশালী হওয়া দরকার এ দেশে, কোনো সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে আমরা যেন উত্তরোত্তর কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত না হয়ে কেবল মার্কেট সোসাইটিতে রূপান্তরিত না হই। শেষোক্ত সমাজে সবকিছু, সব মূল্যবোধই, শেষ পর্যন্ত ‘কেনাবেচার’ সামগ্রীতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে সেটা বিদ্যাদান, চিকিৎসাসেবা থেকে শুরু করে ‘সামাজিক উদ্যোগ’, এমনকি আইনশৃঙ্খলা কার্যক্রম পর্যন্ত। এ ধরনের সমাজ শেষাবধি মানুষের বাসযোগ্য ভূমি থাকে না। বঙ্গবন্ধুর দর্শনে এ ধরনের ডিস্টোপিয়ান ‘মার্কেট-সোসাইটির’ কোনো স্থান ছিল না। এ জন্যই তাঁকে জনগণের তদারকি, জনগণের মালিকানা ও জনস্বার্থের প্রয়োজনে সংবিধানের ৪৭ নং অনুচ্ছেদ যুক্ত করতে হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান নৈয়ায়িক দার্শনিক জন রাউলস, অমর্ত্য সেন ও মাইকেল স্যান্ডেলের অনুবর্তী। আমাদের সমাজের স্বভাবত ধর্মবিহিত মূল্যবোধ এই অবস্থানের প্রতিই সমর্থন জানায়।
বিনায়ক সেন
অর্থনীতিবিদ
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪