সুখেন্দু সেন
সুনামগঞ্জ নাম নিলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক মোহময় ছবি। উত্তরে মেঘালয়ের পাদদেশে জল-পাহাড়ের সঘন মিতালি। দক্ষিণ, পশ্চিম, পূর্ব বরাবর ১৩৩টি ছোট–বড় হাওরের সমন্বয়ে দিগন্তবিস্তৃত অপার জলরাশি। বর্ষায় বুকভরা ঢেউয়ের নাচন, বসন্ত–গ্রীষ্মে সবুজ আর সোনালি ফসলের প্লাবন। ছয় মাস জলাশ্রয়ী আর ছয় মাস স্থলাশ্রয়ী—জল–ডাঙার যাপিত জীবনের বৈচিত্র্য নিয়ে হাওরপারের মানুষ ঢেউ আর আফালের সঙ্গে লড়াই করে। পাহাড়ি ঢল, অকালবানের কবল থেকে স্বপ্নের ফসল রক্ষার সংগ্রাম করে। তবু মানুষ গান গায় প্রাণ খুলে। জলজ্যোৎস্নার মুগ্ধ মোহে কবিতা লেখে।
প্রাগৈতিহাসিক প্রাগজ্যোতিষপুরের অন্তর্গত লাউড় রাজ্য। খাসিয়া পাহাড়ের রহস্যময় গিরিখাত বেয়ে স্বচ্ছ ধারা নেমে এসে ‘রেণুকা’ নদী নামে বয়ে চলেছে লাউড় রাজ্যের বুক চিরে। সেই নদীর তীরে তীরে বঙ্গ সংস্কৃতির ঐতিহ্যের চিহ্নসূত্র অঙ্কিত হয়ে আছে। আছে বাংলা মহাভারতের প্রথম রচয়িতা আদি কবি সঞ্জয়সহ আরও অনেকের জন্মগৌরব। কালের অভিঘাতে সেই লাউড় রাজ্য আজ ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে। এ রাজ্যের রাজধানী ছিল একসময়ের সমৃদ্ধ জনপদ বর্তমান তাহিরপুর উপজেলার হলহলিয়া নামক স্থানে। এ থেকেই বোঝা যায়, পুরো সুনামগঞ্জ জেলা একসময় লাউড় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রেণুকা নদীও তার পূর্ব নাম হারিয়ে বাংলা কাব্যের আদিধারা বহন করে প্রাক–চৈতন্য যুগ ছুঁয়ে বর্তমান পরিচয় জাদুকাটা নদীর তীর ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সুরমা, কালনী, বৌলাই, রক্তি, কংস, সোমেশ্বরীর তীরে তীরে।
বৈষ্ণব কবি রাধারমণ, মরমি কবি হাসন রাজা, বাউল শাহ আবদুল করিম, দুরবিন শাহের জন্ম ও কৃতী হাওরপারের সীমা পেরিয়ে বিশ্ব পরিমণ্ডলে পরিব্যাপ্ত। কত শত লোককবি, নাগরিক কবির প্রাণের আকুতি ঢেউ তোলে সবুজের ভাঁজে ভাঁজে, শীত–গ্রীষ্মের হিম তাপে, বৃষ্টির ছন্দে। আউল–বাউল, বৈষ্ণব, পীর–ফকিরালি, সুফি, মরমি, পুঁথি, পাঁচালি, লোককথা, বারো মাসে তেরো পার্বণ, ব্রতাচার, সাধন–ভজনের বিচিত্র ভাবধারার মিলিত স্রোত একাকার হয়ে এ জেলার ভাবজগৎ সমৃদ্ধ করেছে। লোকসংস্কৃতির তীর্থভূমি আর ভাটি বাংলার সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে নিজ পরিচয়কে করে তুলেছে সুস্পষ্ট।
প্রকৃতির কাছ থেকেই আহরিত হয়েছে এই অঞ্চলের মন–মানবিকতার এমন ছন্দ আর বৈচিত্র্যময় জীবনধারা। কাদামাটি মনের মানুষও কঠোর সংগ্রামী হয়, কখনো কখনো হয়ে ওঠে বিদ্রোহীও। ভৌগোলিক প্রান্তিকতা আর যোগাযোগবিচ্ছিন্নতার কারণে ব্রিটিশ যুগের বিপ্লবীদের আনাগোনা এবং পাকিস্তান যুগে নিষিদ্ধ কমিউনিস্টদের বিচরণক্ষেত্র ছিল এই দুর্গম ভাটি এলাকা। তখন থেকেই রাজনীতিসচেতন ভাটির মানুষ। প্রগতিশীলতা ও সম্প্রীতির স্পর্শ–গৌরব লেগে আছে ভাটি মনে। আন্দোলন–সংগ্রামেও নিয়েছে অগ্রণী ভূমিকা। কৃষক বিদ্রোহ, নানকার আন্দোলনসহ গহিন ভাটির গ্রাম বেহেলী থেকে আসামের রাজধানী শিলং পর্যন্ত দীর্ঘ পদযাত্রায় অংশ নিয়েছেন এই জনপদের কৃষকেরা। ভাষা আন্দোলনে রেখেছেন গৌরবজনক ভূমিকা আর মুক্তিযুদ্ধে রচনা করেছেন অজস্র বীরত্বগাথা। ভাসান পানিতে মাছ ধরার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সয়েছেন জেল–জুলুম। প্রান্তিক অবস্থানে থেকেও ফসল রক্ষার দাবিতে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে সফল কর্মসূচি হাওর বাঁচাও আন্দোলনের মাধ্যমে সাড়া জাগিয়েছে দেশজুড়ে।
প্রকৃতি দুহাত উজাড় করে দিয়েছে অপার সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের এই বিপুল ভান্ডারকে। আবার ভৌগোলিক ও পরিবেশগত কারণেই এ জেলা দেশের অন্যতম পিছিয়ে পড়া অঞ্চল। বন্যা, উজানের পাহাড়ি এলাকায় হওয়া অতিবৃষ্টিজনিত ঢল, পলি ভরাট নদী, ভূমিধস ছাড়াও মানবসৃষ্ট সংকট বন নিধন, অনুপযুক্ত পানি নিষ্কাশন, অপরিকল্পিত বাঁধ ও সড়ক নির্মাণ, পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এখানকার মানুষকে প্রায়ই ঝুঁকিতে ফেলে।
দেশের অন্য হাওর অঞ্চলের তুলনায় বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে জাতীয়ভাবে বোরো ফসলহানির ৫০ শতাংশের বেশি হয় সুনামগঞ্জ জেলায়। এখানকার মোট ফসলি জমির ৭৩ দশমিক ৫ শতাংশ একফসলি। ফসল ফলানোর প্রবণতাও জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক কম। যদিও সরকারের বিভিন্ন সহযোগিতা, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রকৃতির উদারতায় চলতি বোরো মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার বেশি উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। অন্যবারের তুলনায় ৪ হাজার ৩০ হেক্টর বেশি জমি আবাদ হওয়ায় উৎপাদিত ধানের পরিমাণ ১৫ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। নিরুপদ্রবে ফসল তোলায় স্বস্তি এসেছে কৃষকের মনেও। এই স্বস্তি স্থায়ী হবে যদি ফসলের ন্যায্যমূল্য কৃষকের হাতে আসে। অভ্যন্তরীণ জলাভূমি থেকে মাছ উৎপাদনের দিক থেকে সুনামগঞ্জ জেলা দেশের অষ্টম স্থানে রয়েছে। বছরে গড়ে প্রায় ৯৭ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয় এই এলাকায়।
প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে জেলাটির গায়ে এখনো অনুন্নত জেলার তকমা জড়িয়ে আছে। প্রাচীন এই জনপদ সিলেট জেলার প্রথম মহকুমা হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১৮৭৭ সালে। জেলায় রূপান্তরিত হয় ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ। কিন্তু এখনো এই অনুন্নত জেলার তকমা গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি সুনামগঞ্জ। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ যোগাযোগব্যবস্থা।
প্রান্তিক জেলা শহরের উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন। অন্য জেলা শহরের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম সিলেট–সুনামগঞ্জ সড়কটি সাবেকি হালেই রয়ে গেছে। বর্তমান সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। উন্নয়নের অনেক তোড়জোড় দৃশ্যমান। সদিচ্ছাও স্পষ্ট। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ এ বছরই চালু হলো। প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থাপিত হওয়ার পথে। উন্নয়নকে কেন্দ্রীভূত না করে ছড়িয়ে দিলে একই সঙ্গে আলোকিত হবে পুরো জেলা।
শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নই নয়, ভাটি এলাকার ছয় মাস বর্ষাকালীন অলস সময়কে কাজে লাগাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে সব শ্রেণি–পেশার মানুষের জন্য। তবে উন্নয়নের উৎসাহে প্রকৃতিবিরোধী কোনো কিছু করা হবে আত্মঘাতী। হাওরের প্রাণস্পন্দন রুদ্ধ করে অপ্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণ, অপরিকল্পিত সড়ক নির্মাণ স্বাভাবিক পানির প্রবাহ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনগত কারণে ঋতুর চরিত্র ও বৃষ্টির ধরন বদলে গেছে। অল্প সময়ে অধিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সীমান্তের ওপারে কাছাকাছি বলতে গেলে ঘাড়ের ওপর বিশ্বের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা মওশন্ডরাম ও চেরাপুঞ্জির অবস্থান থাকায় এবং একই সঙ্গে পাহাড় ও এর পাদদেশে বনাঞ্চল কমে যাওয়ায় সহজেই পাহাড়ি ঢল নিচে নেমে আসে। ফলে বানের প্রথম আঘাতটাই লাগে এখানে। প্রতিবছর বন্যার ঝুঁকিতে থাকে সমতলের সুনামগঞ্জ। গত বছরই পরপর তিনবার প্লাবিত হয়েছে সুনামগঞ্জের জনপদ। অবশ্য আগে থেকেই বানের আভাস পাওয়ায় ফসল ঘরে তুলতে পেরেছিলেন কৃষকেরা।
এটা এখন দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট যে করোনাকালে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে কৃষি। এর একটি বড় অংশই এই হাওর এলাকার অবদান। প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণের ফল পুরো বিশ্ব ভোগ করছে। তাই প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে নয়, প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্য রেখেই দুর্যোগ মোকাবিলা জরুরি। সুরমাসহ ২৬টি ছোট–বড় নদী সুনামগঞ্জের জীবনরেখা। এর মধ্যে অনেক নদী মরে গেছে। এসব নদী খনন করে জাগাতে হবে। তাহলেই বানের কবল থেকে রক্ষা পাবে ফসল; কমে আসবে জনদুর্ভোগ।
আমাদের আছে প্রকৃতির বিচিত্র সম্ভার। আছে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। আছে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা আর সম্পদ ও সম্ভাবনা। ভূগোলের রূপময়তা আর ইতিহাসের গৌরব মিলেমিশে দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র হতে পারে উত্তর–পূর্বের এই প্রান্তিক জেলা। হিজল মায়ার জলভরা টাঙ্গুয়ার হাওর, টেকেরঘাটের শহীদ সিরাজ লেক, বড়গোপ টিলার (বারেকের টিলা) জিরো পয়েন্ট থেকে সামনে মেঘে ঢাকা মেঘপাহাড়, মাঝে রহস্যময় শূন্যতা রেখে দূরে দেখা ঝরনা, নিচে বিস্তৃত বালুকাবেলা, ঝিরঝির বয়ে চলা জাদুকাটা, প্রাগৈতিহাসের সাক্ষী লাউড়ের গড়, অদ্বৈত বাড়ি, শাহ আরেফিনের মাজার, দিগন্তে আবির ছড়ানো শিমুল বাগান, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সীমান্ত এলাকা টেকেরঘাট থেকে বাঁশতলা পর্যন্ত—এই এলাকা শুকনো–বর্ষা সব মৌসুমেই পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে। হাওরের জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ, প্রতিবেশ রক্ষা করে সুষম ও সমন্বিত উদ্যোগে জাগতে পারে সুনামগঞ্জের প্রাণ। গানে, কবিতায়, মাছে, ধানে, শিক্ষায়, কর্মে, পর্যটনে আলোকিত সুনামগঞ্জ আলো ছড়াতেই পারে।
সুখেন্দু সেন,
আহ্বায়ক, হাওর বাঁচাও আন্দোলন, সুনামগঞ্জ
সুনামগঞ্জ নাম নিলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক মোহময় ছবি। উত্তরে মেঘালয়ের পাদদেশে জল-পাহাড়ের সঘন মিতালি। দক্ষিণ, পশ্চিম, পূর্ব বরাবর ১৩৩টি ছোট–বড় হাওরের সমন্বয়ে দিগন্তবিস্তৃত অপার জলরাশি। বর্ষায় বুকভরা ঢেউয়ের নাচন, বসন্ত–গ্রীষ্মে সবুজ আর সোনালি ফসলের প্লাবন। ছয় মাস জলাশ্রয়ী আর ছয় মাস স্থলাশ্রয়ী—জল–ডাঙার যাপিত জীবনের বৈচিত্র্য নিয়ে হাওরপারের মানুষ ঢেউ আর আফালের সঙ্গে লড়াই করে। পাহাড়ি ঢল, অকালবানের কবল থেকে স্বপ্নের ফসল রক্ষার সংগ্রাম করে। তবু মানুষ গান গায় প্রাণ খুলে। জলজ্যোৎস্নার মুগ্ধ মোহে কবিতা লেখে।
প্রাগৈতিহাসিক প্রাগজ্যোতিষপুরের অন্তর্গত লাউড় রাজ্য। খাসিয়া পাহাড়ের রহস্যময় গিরিখাত বেয়ে স্বচ্ছ ধারা নেমে এসে ‘রেণুকা’ নদী নামে বয়ে চলেছে লাউড় রাজ্যের বুক চিরে। সেই নদীর তীরে তীরে বঙ্গ সংস্কৃতির ঐতিহ্যের চিহ্নসূত্র অঙ্কিত হয়ে আছে। আছে বাংলা মহাভারতের প্রথম রচয়িতা আদি কবি সঞ্জয়সহ আরও অনেকের জন্মগৌরব। কালের অভিঘাতে সেই লাউড় রাজ্য আজ ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে। এ রাজ্যের রাজধানী ছিল একসময়ের সমৃদ্ধ জনপদ বর্তমান তাহিরপুর উপজেলার হলহলিয়া নামক স্থানে। এ থেকেই বোঝা যায়, পুরো সুনামগঞ্জ জেলা একসময় লাউড় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রেণুকা নদীও তার পূর্ব নাম হারিয়ে বাংলা কাব্যের আদিধারা বহন করে প্রাক–চৈতন্য যুগ ছুঁয়ে বর্তমান পরিচয় জাদুকাটা নদীর তীর ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সুরমা, কালনী, বৌলাই, রক্তি, কংস, সোমেশ্বরীর তীরে তীরে।
বৈষ্ণব কবি রাধারমণ, মরমি কবি হাসন রাজা, বাউল শাহ আবদুল করিম, দুরবিন শাহের জন্ম ও কৃতী হাওরপারের সীমা পেরিয়ে বিশ্ব পরিমণ্ডলে পরিব্যাপ্ত। কত শত লোককবি, নাগরিক কবির প্রাণের আকুতি ঢেউ তোলে সবুজের ভাঁজে ভাঁজে, শীত–গ্রীষ্মের হিম তাপে, বৃষ্টির ছন্দে। আউল–বাউল, বৈষ্ণব, পীর–ফকিরালি, সুফি, মরমি, পুঁথি, পাঁচালি, লোককথা, বারো মাসে তেরো পার্বণ, ব্রতাচার, সাধন–ভজনের বিচিত্র ভাবধারার মিলিত স্রোত একাকার হয়ে এ জেলার ভাবজগৎ সমৃদ্ধ করেছে। লোকসংস্কৃতির তীর্থভূমি আর ভাটি বাংলার সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে নিজ পরিচয়কে করে তুলেছে সুস্পষ্ট।
প্রকৃতির কাছ থেকেই আহরিত হয়েছে এই অঞ্চলের মন–মানবিকতার এমন ছন্দ আর বৈচিত্র্যময় জীবনধারা। কাদামাটি মনের মানুষও কঠোর সংগ্রামী হয়, কখনো কখনো হয়ে ওঠে বিদ্রোহীও। ভৌগোলিক প্রান্তিকতা আর যোগাযোগবিচ্ছিন্নতার কারণে ব্রিটিশ যুগের বিপ্লবীদের আনাগোনা এবং পাকিস্তান যুগে নিষিদ্ধ কমিউনিস্টদের বিচরণক্ষেত্র ছিল এই দুর্গম ভাটি এলাকা। তখন থেকেই রাজনীতিসচেতন ভাটির মানুষ। প্রগতিশীলতা ও সম্প্রীতির স্পর্শ–গৌরব লেগে আছে ভাটি মনে। আন্দোলন–সংগ্রামেও নিয়েছে অগ্রণী ভূমিকা। কৃষক বিদ্রোহ, নানকার আন্দোলনসহ গহিন ভাটির গ্রাম বেহেলী থেকে আসামের রাজধানী শিলং পর্যন্ত দীর্ঘ পদযাত্রায় অংশ নিয়েছেন এই জনপদের কৃষকেরা। ভাষা আন্দোলনে রেখেছেন গৌরবজনক ভূমিকা আর মুক্তিযুদ্ধে রচনা করেছেন অজস্র বীরত্বগাথা। ভাসান পানিতে মাছ ধরার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সয়েছেন জেল–জুলুম। প্রান্তিক অবস্থানে থেকেও ফসল রক্ষার দাবিতে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে সফল কর্মসূচি হাওর বাঁচাও আন্দোলনের মাধ্যমে সাড়া জাগিয়েছে দেশজুড়ে।
প্রকৃতি দুহাত উজাড় করে দিয়েছে অপার সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের এই বিপুল ভান্ডারকে। আবার ভৌগোলিক ও পরিবেশগত কারণেই এ জেলা দেশের অন্যতম পিছিয়ে পড়া অঞ্চল। বন্যা, উজানের পাহাড়ি এলাকায় হওয়া অতিবৃষ্টিজনিত ঢল, পলি ভরাট নদী, ভূমিধস ছাড়াও মানবসৃষ্ট সংকট বন নিধন, অনুপযুক্ত পানি নিষ্কাশন, অপরিকল্পিত বাঁধ ও সড়ক নির্মাণ, পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এখানকার মানুষকে প্রায়ই ঝুঁকিতে ফেলে।
দেশের অন্য হাওর অঞ্চলের তুলনায় বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে জাতীয়ভাবে বোরো ফসলহানির ৫০ শতাংশের বেশি হয় সুনামগঞ্জ জেলায়। এখানকার মোট ফসলি জমির ৭৩ দশমিক ৫ শতাংশ একফসলি। ফসল ফলানোর প্রবণতাও জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক কম। যদিও সরকারের বিভিন্ন সহযোগিতা, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রকৃতির উদারতায় চলতি বোরো মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার বেশি উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। অন্যবারের তুলনায় ৪ হাজার ৩০ হেক্টর বেশি জমি আবাদ হওয়ায় উৎপাদিত ধানের পরিমাণ ১৫ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। নিরুপদ্রবে ফসল তোলায় স্বস্তি এসেছে কৃষকের মনেও। এই স্বস্তি স্থায়ী হবে যদি ফসলের ন্যায্যমূল্য কৃষকের হাতে আসে। অভ্যন্তরীণ জলাভূমি থেকে মাছ উৎপাদনের দিক থেকে সুনামগঞ্জ জেলা দেশের অষ্টম স্থানে রয়েছে। বছরে গড়ে প্রায় ৯৭ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয় এই এলাকায়।
প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে জেলাটির গায়ে এখনো অনুন্নত জেলার তকমা জড়িয়ে আছে। প্রাচীন এই জনপদ সিলেট জেলার প্রথম মহকুমা হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১৮৭৭ সালে। জেলায় রূপান্তরিত হয় ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ। কিন্তু এখনো এই অনুন্নত জেলার তকমা গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি সুনামগঞ্জ। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ যোগাযোগব্যবস্থা।
প্রান্তিক জেলা শহরের উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন। অন্য জেলা শহরের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম সিলেট–সুনামগঞ্জ সড়কটি সাবেকি হালেই রয়ে গেছে। বর্তমান সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। উন্নয়নের অনেক তোড়জোড় দৃশ্যমান। সদিচ্ছাও স্পষ্ট। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ এ বছরই চালু হলো। প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থাপিত হওয়ার পথে। উন্নয়নকে কেন্দ্রীভূত না করে ছড়িয়ে দিলে একই সঙ্গে আলোকিত হবে পুরো জেলা।
শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নই নয়, ভাটি এলাকার ছয় মাস বর্ষাকালীন অলস সময়কে কাজে লাগাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে সব শ্রেণি–পেশার মানুষের জন্য। তবে উন্নয়নের উৎসাহে প্রকৃতিবিরোধী কোনো কিছু করা হবে আত্মঘাতী। হাওরের প্রাণস্পন্দন রুদ্ধ করে অপ্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণ, অপরিকল্পিত সড়ক নির্মাণ স্বাভাবিক পানির প্রবাহ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনগত কারণে ঋতুর চরিত্র ও বৃষ্টির ধরন বদলে গেছে। অল্প সময়ে অধিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সীমান্তের ওপারে কাছাকাছি বলতে গেলে ঘাড়ের ওপর বিশ্বের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা মওশন্ডরাম ও চেরাপুঞ্জির অবস্থান থাকায় এবং একই সঙ্গে পাহাড় ও এর পাদদেশে বনাঞ্চল কমে যাওয়ায় সহজেই পাহাড়ি ঢল নিচে নেমে আসে। ফলে বানের প্রথম আঘাতটাই লাগে এখানে। প্রতিবছর বন্যার ঝুঁকিতে থাকে সমতলের সুনামগঞ্জ। গত বছরই পরপর তিনবার প্লাবিত হয়েছে সুনামগঞ্জের জনপদ। অবশ্য আগে থেকেই বানের আভাস পাওয়ায় ফসল ঘরে তুলতে পেরেছিলেন কৃষকেরা।
এটা এখন দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট যে করোনাকালে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে কৃষি। এর একটি বড় অংশই এই হাওর এলাকার অবদান। প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণের ফল পুরো বিশ্ব ভোগ করছে। তাই প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে নয়, প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্য রেখেই দুর্যোগ মোকাবিলা জরুরি। সুরমাসহ ২৬টি ছোট–বড় নদী সুনামগঞ্জের জীবনরেখা। এর মধ্যে অনেক নদী মরে গেছে। এসব নদী খনন করে জাগাতে হবে। তাহলেই বানের কবল থেকে রক্ষা পাবে ফসল; কমে আসবে জনদুর্ভোগ।
আমাদের আছে প্রকৃতির বিচিত্র সম্ভার। আছে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। আছে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা আর সম্পদ ও সম্ভাবনা। ভূগোলের রূপময়তা আর ইতিহাসের গৌরব মিলেমিশে দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র হতে পারে উত্তর–পূর্বের এই প্রান্তিক জেলা। হিজল মায়ার জলভরা টাঙ্গুয়ার হাওর, টেকেরঘাটের শহীদ সিরাজ লেক, বড়গোপ টিলার (বারেকের টিলা) জিরো পয়েন্ট থেকে সামনে মেঘে ঢাকা মেঘপাহাড়, মাঝে রহস্যময় শূন্যতা রেখে দূরে দেখা ঝরনা, নিচে বিস্তৃত বালুকাবেলা, ঝিরঝির বয়ে চলা জাদুকাটা, প্রাগৈতিহাসের সাক্ষী লাউড়ের গড়, অদ্বৈত বাড়ি, শাহ আরেফিনের মাজার, দিগন্তে আবির ছড়ানো শিমুল বাগান, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সীমান্ত এলাকা টেকেরঘাট থেকে বাঁশতলা পর্যন্ত—এই এলাকা শুকনো–বর্ষা সব মৌসুমেই পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে। হাওরের জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ, প্রতিবেশ রক্ষা করে সুষম ও সমন্বিত উদ্যোগে জাগতে পারে সুনামগঞ্জের প্রাণ। গানে, কবিতায়, মাছে, ধানে, শিক্ষায়, কর্মে, পর্যটনে আলোকিত সুনামগঞ্জ আলো ছড়াতেই পারে।
সুখেন্দু সেন,
আহ্বায়ক, হাওর বাঁচাও আন্দোলন, সুনামগঞ্জ
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪