সৈয়দ আজিজুল হক
‘সোনার বাংলা’র সুবর্ণজয়ন্তী—এই শিরোনামের রয়েছে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা। প্রথমত এর মানে হলো ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্নের সুবর্ণজয়ন্তী। একটি স্বাধীন দেশের জন্য আমাদের যে দীর্ঘ সংগ্রাম, যার পরিণতিতে ৯ মাসের বিপুল রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে গোটা জাতির যে সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার, তার পেছনে আমাদের হৃদয়ে প্রোথিত ছিল ‘সোনার বাংলা’ গড়ার এক সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন। আমাদের জাতীয় সংগীতের মধ্যে প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে সেই স্বপ্ন। এই স্বপ্নই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের মূল চারটি স্তম্ভরূপে বিধৃত: গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা আর সমাজতন্ত্র। সংবিধানের এই চার মূলনীতিকেই আমরা অভিহিত করে থাকি মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার চেতনা নামে, যার প্রতিটিই পাকিস্তানি রাষ্ট্রাদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত।
গত ৫০ বছরের ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাব, প্রথম ৯ মাস তো গেছে ভয়ংকর যুদ্ধে, তারপর এই স্বাধীন দেশেই বিভিন্ন মেয়াদে ২৫ বছর শাসনক্ষমতায় ছিল এমন শক্তি, স্বাধীনতার প্রকৃত চেতনায় যাদের ছিল কমবেশি অনাস্থা আর অবিশ্বাস। সংবিধানের মূলনীতিতে হস্তক্ষেপ, কাটাছেঁড়াসহ পরিবর্তন সাধন, পাঠ্যবইসহ সর্বত্র স্বাধীনতার ঘোষণাসহ ইতিহাস-বিকৃতি, স্বাধীনতার স্থপতিসহ মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের মূল ভূমিকায় অধিষ্ঠিত জাতীয় চার নেতাকে অস্বীকার, বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যিক ধারার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন প্রভৃতির মাধ্যমে এই শক্তি দেশের যুব-মানসসহ জাতীয় চেতনায় প্রোথিত করেছে অসুস্থতার মারাত্মক সব বীজ। সুবর্ণজয়ন্তীর এই শুভলগ্নে এসব নেতিবাচক উপাদানের দিকে নজর দেওয়ার চেয়ে ইতিবাচক অর্জনগুলোই আগে স্মরণ করা দরকার।
চুলচেরা পরিসংখ্যানগত হিসাব দাখিল ছাড়াই আমরা দৃষ্টি আকর্ষণীয় কিছু পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করতে পারি। যেমন—যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটেছে ধান, সবজি, ফল, মাছসহ সামগ্রিক খাদ্যোৎপাদনের ক্ষেত্রে। স্বাধীনতা-পূর্বকালের উৎপাদনের পরিমাণের সঙ্গে তুলনা করে পরবর্তীকালে দ্বিগুণেরও বেশি জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মানুষের ক্রয়ক্ষমতাসহ ভোগ বৃদ্ধির কথা বিবেচনায় নিলে এ ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার অবিশ্বাস্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইলিশ উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধির দিকটিও এক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন নিঃসন্দেহে। খাদ্যোৎপাদন ছাড়া অন্যদিকে দৃষ্টি দিলেও উজ্জ্বলভাবে প্রতীয়মান হবে সাফল্যের খতিয়ান। উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে মাতৃমৃত্যুর হার, শিশুমৃত্যুর হার; আর বেড়েছে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার ক্ষেত্রে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়ার হার, বেড়েছে বিশুদ্ধ পানি পানের পাশাপাশি পাকা টয়লেট ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা; বেড়েছে বৃক্ষরোপণের মানসিকতা। প্রভূত উন্নতি ঘটেছে যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষেত্রে; বিশাল দুই নদীবক্ষে সেতুবন্ধসহ প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও বিস্তৃত হয়েছে পাকা রাস্তার সীমা; স্থলযান চলাচলের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হওয়ার ফলে বিপুলভাবে বেড়েছে জীবনের গতি। বেড়েছে মাথাপিছু আয়, কমেছে দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতার হার আর বেড়েছে গড় আয়ু। রেকর্ড ছাড়িয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়। শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও বেড়েছে শিক্ষার হার, বিশেষভাবে বেড়েছে নারী শিক্ষার হার ও শিক্ষালাভের আগ্রহ। পুরো দক্ষিণ এশিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সাফল্যের এসব প্রবণতা তাৎপর্যপূর্ণ।
এখন যদি আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দিকে তাকাই; চারটি মূলনীতির কথাই যদি ধরি, এর সবগুলোই আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত অনুশীলন ও প্রাত্যহিক জীবনাচরণের সঙ্গে নিগূঢ়ভাবে সম্পর্কিত। স্বাধীনতা-উত্তরকালেও আমাদের নতুন করে সংগ্রাম করতে হয়েছে গণতন্ত্রের জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, কার্যকর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান আমরা গড়তে পারিনি। নিশ্চিত করা যায়নি বিচার বিভাগের সর্বময় স্বাধীনতা, আইনের শাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিসহ সুশাসন। ফলে সমাজে সীমাহীনভাবে বেড়েছে দুর্নীতি আর দুর্বৃত্তায়ন। ফৌজি নেতাদের পনেরো বছরের শাসন গণতন্ত্র ধ্বংসে ও ধর্মের রাজনীতিকীকরণে যে ভূমিকা রেখেছে, তার কুফল থেকে মুক্ত হওয়া দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি প্রয়োগের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সব ধর্মের প্রতি সমদৃষ্টি প্রয়োগসহ সবার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির এক উদারনীতি অনুশীলিত হচ্ছে। ফলে প্রতিটি ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যেই ব্যাপকভাবে বেড়েছে ধর্মাচার, কিন্তু বাড়েনি নৈতিকতা; সেই সঙ্গে বেড়েছে ধর্মান্ধতা আর পরধর্মবিদ্বেষ। অসাম্প্রদায়িক চেতনাঋদ্ধ বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই অন্ধত্বতাড়িত বিদ্বেষপরায়ণতা অন্তরায়ের এক প্রশস্ত দেয়াল সৃষ্টি করেছে। অর্থনীতিতে বৈষম্য হ্রাসই ছিল কাম্য; কিন্তু হয়েছে উল্টো। ধনবৈষম্য এমনই ক্রমবর্ধমান যে দ্রুত ধনী হওয়ার তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ‘ঈর্ষণীয়ভাবে’ শীর্ষে। সীমাহীন শোষণ, লুটপাট আর দুর্নীতির আশ্রয়েই চরিতার্থ হচ্ছে ধনলিপ্সা, সমাজে প্রকট হয়ে উঠেছে বৈষম্যের তীব্রতা, মানুষে মানুষে ব্যবধান, উঁচু-নিচুর ভেদ।
স্বাধীনতার চেতনা হিসেবে সংবিধানের মূলনীতি আর তার বাস্তব রূপের মধ্যে ব্যবধান ব্যাপক। নিয়ম রক্ষার পরিবর্তে নিয়ম ভঙ্গ করার মধ্যেই অনেকে বাহাদুরি খুঁজে পান। আইনপ্রণেতা কিংবা আইন রক্ষাকারী প্রায়শ আইন ভঙ্গকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বস্তুগত ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রচারণায় আত্মিক আর মানবিক বিকাশের গল্প গল্পই থেকে যায়। উপরিকাঠামোগত উন্নতির লক্ষ্যে বেশির ভাগ কার্যক্রমই অধিকাংশের দ্বারা আদৃত হয় না। প্রতিযোগিতা হয় খারাপ দৃষ্টান্তের মধ্যে; নিরুৎসাহিত হয় শুভ, কল্যাণ কিংবা ভালোর প্রতিযোগিতা। সবকিছু বিবেচনার মাপকাঠি হয় রাজনীতি, ক্ষমতা। সততা, নিষ্ঠা, ত্যাগধর্মিতা আর সেবাপরায়ণতার পরিবর্তে অসততা, চাতুর্য, ভোগবাদিতা আর স্বার্থলোলুপতার ব্যাপক বিস্তার সমাজকে গ্রাস করে চলে। অর্থলোভ, পদলোভ আর পদক-পুরস্কারের লোভে উন্মত্ত হয়ে মানুষ ভুলে যায় আত্মমর্যাদার মাপকাঠি। ফলে শান্তি হয়ে ওঠে সুদূর পরাহত। পরিবর্তে একধরনের অসহিষ্ণুতা মারাত্মক ব্যাধির রূপ নেয়। বিরোধীপক্ষকে নির্মূল করার বাসনায়ই আমরা ক্রমশ শক্তি ক্ষয় করি।
কথা ও কাজের ব্যবধানও হয়ে উঠেছে ব্যাপক। মুখে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে ভেতরে সাম্প্রদায়িক তৎপরতায়ই অনেকে নিয়োজিত থাকেন; ফলে প্রকৃত ও নীরব অসাম্প্রদায়িকের পরিসর সংকুচিত হতে থাকে। পাকিস্তানপন্থী আর ভারতপন্থীতে ভাগ হয়ে থাকে দেশ; প্রকৃত বাংলাদেশপন্থীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। দেশপ্রেম আর এই স্বাধীন ভূখণ্ডের প্রতি অঙ্গীকারের অভাব প্রকট হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার পক্ষশক্তি ও বিরোধীশক্তির বিভাজনের বাস্তবতায় প্রকৃত সত্যের দেখা মেলা কখনো কখনো কঠিন হয়ে পড়ে। এই পক্ষ-বিপক্ষের হুংকারে প্রকৃত অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ বেদনায় বিমর্ষ হয়ে থাকেন।
তবে এই বিমর্ষতাই শেষ কথা নয়। আশার আলো আমরা দেখতে পাই পরার্থপর শুভবোধসম্পন্ন মানুষের মধ্যে; একই সঙ্গে তরুণ, শ্রমজীবী, ব্রাত্য আর নিম্নবর্গের মধ্যে। প্রথমোক্তদের আপাতত সংখ্যালঘু মনে হলেও তাদের পেছনে রয়েছে শেষোক্ত সংখ্যাগুরু এক বিশাল জনসমষ্টি। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য যাদের অবদানই মুখ্য। যারা বায়ুকে বিষাক্ত করছে এবং আলোকে করছে নির্বাপিত, সেই অন্ধকারের শক্তির পতন অনিবার্য। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকারী ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মরণজয়ী সংগ্রামে অবতীর্ণ এই জাতির মধ্যে রয়েছে এক অপরাহত শক্তি, রয়েছে গভীর অসাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গি আর অপার মানবিক চেতনা। সেই চেতনার জাগরণ অবশ্যম্ভাবী। বিভিন্ন ঘটনার অভিঘাতে মাঝেমধ্যেই তার প্রকাশ আমরা লক্ষ করি। বৈচিত্র্যের মধ্যে আছে সৌন্দর্য, কিন্তু বিভক্তির মধ্যে নেই কোনো কল্যাণ; ঐক্যের শক্তিই আসল। দেশের স্বার্থের প্রশ্নে জনগণের মধ্যে ঐক্যের মনোভাব থাকা বাঞ্ছনীয়। ক্ষমতা আর স্বার্থের মোহ আমাদের সংকীর্ণ করে; পক্ষান্তরে, জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আসে উদারতা, মানবিকতা।
বৃহত্তর মানবস্বার্থে ত্যাগের আদর্শ সৃষ্টির বিকল্প নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যেই আছে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের নির্দেশনা। ওর মধ্যেই আছে দেশপ্রেমের ঠিকানা, আছে দেশের সামগ্রিক কল্যাণের বার্তা। যথাযথভাবে এটা উপলব্ধি করাই জরুরি। মানুষকে অর্থলিপ্সা আর ভোগবিলাসের পথ থেকে বের করে মনুষ্যত্ববোধে দীক্ষা দিতে হলে ক্ষমতামত্ত রাজনীতি সুফল না–ও দিতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সাংস্কৃতিক বিপ্লব সাধন। রাজনীতি সবকিছুর সমাধান নয়, ক্ষমতাদর্পী রাজনীতি তো নয়ই।
সৈয়দ আজিজুল হক
অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
‘সোনার বাংলা’র সুবর্ণজয়ন্তী—এই শিরোনামের রয়েছে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা। প্রথমত এর মানে হলো ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্নের সুবর্ণজয়ন্তী। একটি স্বাধীন দেশের জন্য আমাদের যে দীর্ঘ সংগ্রাম, যার পরিণতিতে ৯ মাসের বিপুল রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে গোটা জাতির যে সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার, তার পেছনে আমাদের হৃদয়ে প্রোথিত ছিল ‘সোনার বাংলা’ গড়ার এক সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন। আমাদের জাতীয় সংগীতের মধ্যে প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে সেই স্বপ্ন। এই স্বপ্নই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের মূল চারটি স্তম্ভরূপে বিধৃত: গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা আর সমাজতন্ত্র। সংবিধানের এই চার মূলনীতিকেই আমরা অভিহিত করে থাকি মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার চেতনা নামে, যার প্রতিটিই পাকিস্তানি রাষ্ট্রাদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত।
গত ৫০ বছরের ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাব, প্রথম ৯ মাস তো গেছে ভয়ংকর যুদ্ধে, তারপর এই স্বাধীন দেশেই বিভিন্ন মেয়াদে ২৫ বছর শাসনক্ষমতায় ছিল এমন শক্তি, স্বাধীনতার প্রকৃত চেতনায় যাদের ছিল কমবেশি অনাস্থা আর অবিশ্বাস। সংবিধানের মূলনীতিতে হস্তক্ষেপ, কাটাছেঁড়াসহ পরিবর্তন সাধন, পাঠ্যবইসহ সর্বত্র স্বাধীনতার ঘোষণাসহ ইতিহাস-বিকৃতি, স্বাধীনতার স্থপতিসহ মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের মূল ভূমিকায় অধিষ্ঠিত জাতীয় চার নেতাকে অস্বীকার, বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যিক ধারার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন প্রভৃতির মাধ্যমে এই শক্তি দেশের যুব-মানসসহ জাতীয় চেতনায় প্রোথিত করেছে অসুস্থতার মারাত্মক সব বীজ। সুবর্ণজয়ন্তীর এই শুভলগ্নে এসব নেতিবাচক উপাদানের দিকে নজর দেওয়ার চেয়ে ইতিবাচক অর্জনগুলোই আগে স্মরণ করা দরকার।
চুলচেরা পরিসংখ্যানগত হিসাব দাখিল ছাড়াই আমরা দৃষ্টি আকর্ষণীয় কিছু পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করতে পারি। যেমন—যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটেছে ধান, সবজি, ফল, মাছসহ সামগ্রিক খাদ্যোৎপাদনের ক্ষেত্রে। স্বাধীনতা-পূর্বকালের উৎপাদনের পরিমাণের সঙ্গে তুলনা করে পরবর্তীকালে দ্বিগুণেরও বেশি জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মানুষের ক্রয়ক্ষমতাসহ ভোগ বৃদ্ধির কথা বিবেচনায় নিলে এ ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার অবিশ্বাস্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইলিশ উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধির দিকটিও এক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন নিঃসন্দেহে। খাদ্যোৎপাদন ছাড়া অন্যদিকে দৃষ্টি দিলেও উজ্জ্বলভাবে প্রতীয়মান হবে সাফল্যের খতিয়ান। উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে মাতৃমৃত্যুর হার, শিশুমৃত্যুর হার; আর বেড়েছে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার ক্ষেত্রে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়ার হার, বেড়েছে বিশুদ্ধ পানি পানের পাশাপাশি পাকা টয়লেট ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা; বেড়েছে বৃক্ষরোপণের মানসিকতা। প্রভূত উন্নতি ঘটেছে যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষেত্রে; বিশাল দুই নদীবক্ষে সেতুবন্ধসহ প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও বিস্তৃত হয়েছে পাকা রাস্তার সীমা; স্থলযান চলাচলের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হওয়ার ফলে বিপুলভাবে বেড়েছে জীবনের গতি। বেড়েছে মাথাপিছু আয়, কমেছে দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতার হার আর বেড়েছে গড় আয়ু। রেকর্ড ছাড়িয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়। শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও বেড়েছে শিক্ষার হার, বিশেষভাবে বেড়েছে নারী শিক্ষার হার ও শিক্ষালাভের আগ্রহ। পুরো দক্ষিণ এশিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সাফল্যের এসব প্রবণতা তাৎপর্যপূর্ণ।
এখন যদি আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দিকে তাকাই; চারটি মূলনীতির কথাই যদি ধরি, এর সবগুলোই আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত অনুশীলন ও প্রাত্যহিক জীবনাচরণের সঙ্গে নিগূঢ়ভাবে সম্পর্কিত। স্বাধীনতা-উত্তরকালেও আমাদের নতুন করে সংগ্রাম করতে হয়েছে গণতন্ত্রের জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, কার্যকর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান আমরা গড়তে পারিনি। নিশ্চিত করা যায়নি বিচার বিভাগের সর্বময় স্বাধীনতা, আইনের শাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিসহ সুশাসন। ফলে সমাজে সীমাহীনভাবে বেড়েছে দুর্নীতি আর দুর্বৃত্তায়ন। ফৌজি নেতাদের পনেরো বছরের শাসন গণতন্ত্র ধ্বংসে ও ধর্মের রাজনীতিকীকরণে যে ভূমিকা রেখেছে, তার কুফল থেকে মুক্ত হওয়া দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি প্রয়োগের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সব ধর্মের প্রতি সমদৃষ্টি প্রয়োগসহ সবার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির এক উদারনীতি অনুশীলিত হচ্ছে। ফলে প্রতিটি ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যেই ব্যাপকভাবে বেড়েছে ধর্মাচার, কিন্তু বাড়েনি নৈতিকতা; সেই সঙ্গে বেড়েছে ধর্মান্ধতা আর পরধর্মবিদ্বেষ। অসাম্প্রদায়িক চেতনাঋদ্ধ বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই অন্ধত্বতাড়িত বিদ্বেষপরায়ণতা অন্তরায়ের এক প্রশস্ত দেয়াল সৃষ্টি করেছে। অর্থনীতিতে বৈষম্য হ্রাসই ছিল কাম্য; কিন্তু হয়েছে উল্টো। ধনবৈষম্য এমনই ক্রমবর্ধমান যে দ্রুত ধনী হওয়ার তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ‘ঈর্ষণীয়ভাবে’ শীর্ষে। সীমাহীন শোষণ, লুটপাট আর দুর্নীতির আশ্রয়েই চরিতার্থ হচ্ছে ধনলিপ্সা, সমাজে প্রকট হয়ে উঠেছে বৈষম্যের তীব্রতা, মানুষে মানুষে ব্যবধান, উঁচু-নিচুর ভেদ।
স্বাধীনতার চেতনা হিসেবে সংবিধানের মূলনীতি আর তার বাস্তব রূপের মধ্যে ব্যবধান ব্যাপক। নিয়ম রক্ষার পরিবর্তে নিয়ম ভঙ্গ করার মধ্যেই অনেকে বাহাদুরি খুঁজে পান। আইনপ্রণেতা কিংবা আইন রক্ষাকারী প্রায়শ আইন ভঙ্গকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বস্তুগত ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রচারণায় আত্মিক আর মানবিক বিকাশের গল্প গল্পই থেকে যায়। উপরিকাঠামোগত উন্নতির লক্ষ্যে বেশির ভাগ কার্যক্রমই অধিকাংশের দ্বারা আদৃত হয় না। প্রতিযোগিতা হয় খারাপ দৃষ্টান্তের মধ্যে; নিরুৎসাহিত হয় শুভ, কল্যাণ কিংবা ভালোর প্রতিযোগিতা। সবকিছু বিবেচনার মাপকাঠি হয় রাজনীতি, ক্ষমতা। সততা, নিষ্ঠা, ত্যাগধর্মিতা আর সেবাপরায়ণতার পরিবর্তে অসততা, চাতুর্য, ভোগবাদিতা আর স্বার্থলোলুপতার ব্যাপক বিস্তার সমাজকে গ্রাস করে চলে। অর্থলোভ, পদলোভ আর পদক-পুরস্কারের লোভে উন্মত্ত হয়ে মানুষ ভুলে যায় আত্মমর্যাদার মাপকাঠি। ফলে শান্তি হয়ে ওঠে সুদূর পরাহত। পরিবর্তে একধরনের অসহিষ্ণুতা মারাত্মক ব্যাধির রূপ নেয়। বিরোধীপক্ষকে নির্মূল করার বাসনায়ই আমরা ক্রমশ শক্তি ক্ষয় করি।
কথা ও কাজের ব্যবধানও হয়ে উঠেছে ব্যাপক। মুখে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে ভেতরে সাম্প্রদায়িক তৎপরতায়ই অনেকে নিয়োজিত থাকেন; ফলে প্রকৃত ও নীরব অসাম্প্রদায়িকের পরিসর সংকুচিত হতে থাকে। পাকিস্তানপন্থী আর ভারতপন্থীতে ভাগ হয়ে থাকে দেশ; প্রকৃত বাংলাদেশপন্থীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। দেশপ্রেম আর এই স্বাধীন ভূখণ্ডের প্রতি অঙ্গীকারের অভাব প্রকট হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার পক্ষশক্তি ও বিরোধীশক্তির বিভাজনের বাস্তবতায় প্রকৃত সত্যের দেখা মেলা কখনো কখনো কঠিন হয়ে পড়ে। এই পক্ষ-বিপক্ষের হুংকারে প্রকৃত অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ বেদনায় বিমর্ষ হয়ে থাকেন।
তবে এই বিমর্ষতাই শেষ কথা নয়। আশার আলো আমরা দেখতে পাই পরার্থপর শুভবোধসম্পন্ন মানুষের মধ্যে; একই সঙ্গে তরুণ, শ্রমজীবী, ব্রাত্য আর নিম্নবর্গের মধ্যে। প্রথমোক্তদের আপাতত সংখ্যালঘু মনে হলেও তাদের পেছনে রয়েছে শেষোক্ত সংখ্যাগুরু এক বিশাল জনসমষ্টি। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য যাদের অবদানই মুখ্য। যারা বায়ুকে বিষাক্ত করছে এবং আলোকে করছে নির্বাপিত, সেই অন্ধকারের শক্তির পতন অনিবার্য। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকারী ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মরণজয়ী সংগ্রামে অবতীর্ণ এই জাতির মধ্যে রয়েছে এক অপরাহত শক্তি, রয়েছে গভীর অসাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গি আর অপার মানবিক চেতনা। সেই চেতনার জাগরণ অবশ্যম্ভাবী। বিভিন্ন ঘটনার অভিঘাতে মাঝেমধ্যেই তার প্রকাশ আমরা লক্ষ করি। বৈচিত্র্যের মধ্যে আছে সৌন্দর্য, কিন্তু বিভক্তির মধ্যে নেই কোনো কল্যাণ; ঐক্যের শক্তিই আসল। দেশের স্বার্থের প্রশ্নে জনগণের মধ্যে ঐক্যের মনোভাব থাকা বাঞ্ছনীয়। ক্ষমতা আর স্বার্থের মোহ আমাদের সংকীর্ণ করে; পক্ষান্তরে, জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আসে উদারতা, মানবিকতা।
বৃহত্তর মানবস্বার্থে ত্যাগের আদর্শ সৃষ্টির বিকল্প নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যেই আছে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের নির্দেশনা। ওর মধ্যেই আছে দেশপ্রেমের ঠিকানা, আছে দেশের সামগ্রিক কল্যাণের বার্তা। যথাযথভাবে এটা উপলব্ধি করাই জরুরি। মানুষকে অর্থলিপ্সা আর ভোগবিলাসের পথ থেকে বের করে মনুষ্যত্ববোধে দীক্ষা দিতে হলে ক্ষমতামত্ত রাজনীতি সুফল না–ও দিতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সাংস্কৃতিক বিপ্লব সাধন। রাজনীতি সবকিছুর সমাধান নয়, ক্ষমতাদর্পী রাজনীতি তো নয়ই।
সৈয়দ আজিজুল হক
অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪