ডা. জাহেদ উর রহমান
একটি নতুন পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করার জন্য বাংলাদেশের ইতিহাসে বর্তমান সময়ের চেয়ে খুব বেশি প্রতিকূল সময় ইতিহাসে কি আর ছিল? অবশ্য সংখ্যার হিসাব বলে এটাই হয়তো পত্রিকা বের করার জন্য সবচেয়ে মোক্ষম সময়। পত্রিকার জন্য এক অতি উর্বর ভূমি বাংলাদেশ, ঢাকা এবং অন্যান্য জেলা মিলিয়ে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ১ হাজার ৩০০। জানি এর মধ্যে প্রকাশিত হয় খুব ছোট একটি ভগ্নাংশই।
পত্রিকা প্রকাশনার আছে নানা উদ্দেশ্য। কিন্তু একটি দৈনিক পত্রিকা, যেটা স্রেফ তার অস্তিত্ব আছে এটুকু না বুঝিয়ে যদি সত্যিকারভাবে একটি পত্রিকা হয়ে উঠতে চায়, তাহলে সেটা খুব পুঁজিঘন একটি শিল্প। এই কারণেই গভীরভাবে তলিয়ে দেখতে গেলে দেখব, প্রতিটি মূল ধারার মিডিয়া জন্ম নেয় তার বুকে একধরনের ধ্বংসের বীজ নিয়ে।
একটা দৈনিক পত্রিকা শুরু করার সময় খুব বড় পরিমাণ বিনিয়োগ তো লাগেই, সঙ্গে দরকার হয় বিরাট অঙ্কের পরিচলন ব্যয়। এই বিপুল ব্যয় করেও কোনো কোনো পত্রিকার মালিক ব্যবসা না করতে চাইতেই পারেন; তাঁর উদ্দেশ্য থাকতে পারে মিডিয়াকে সমাজে তাঁর প্রভাব তৈরি কিংবা তাঁরই অন্য কোনো ব্যবসার সুবিধা অর্জন কিংবা রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করা। কিন্তু এই কলামের আলোচনার সুবিধার্থে আমরা ধরে নিচ্ছি একজন পুঁজিপতি মিডিয়ায় বিনিয়োগ করছেন একটা সত্যিকার মিডিয়া তৈরি করার জন্য। এত টাকা কেউ বিনিয়োগ করেন মুনাফার জন্য, সেটা বোঝার জন্য ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। আর এটাও আমরা জানি, মুনাফা আর আপস চলে হাত ধরাধরি করে। তাই প্রশ্ন আসবেই, একটা প্রথাগত মিডিয়া, যেটা স্রেফ একটা ব্যবসা, তার পক্ষে কতটা শক্তিশালী ভূমিকা রাখা সম্ভব?
আমাদের দেশের মূল ধারার পত্রিকা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মালিক বড় বড় ব্যবসায়ী, শিল্পগোষ্ঠী, যাঁদের আছে অন্য অনেক ব্যবসা, আছে রাজনৈতিক ‘কানেকশন’। তাই বহু গুরুত্বপূর্ণ খবর তাঁদের নিজের ব্যবসার বিরুদ্ধে যেতে পারে; যেতে পারে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে। সংবাদ ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে যাওয়া মানেও ব্যবসার ক্ষতির আশঙ্কা বাড়া। সার্বিক বিবেচনায় যে কারও মনে হতেই পারে অতিসংবেদনশীল সংবাদের ক্ষেত্রে অনেক ভালো হচ্ছে ‘খামোশ’ হয়ে থাকা। কিন্তু এটাই বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট তৈরি করে একটি পত্রিকার ক্ষেত্রে, যা ধীরে ধীরে সেই পত্রিকার মৃত্যু ঘটায়।
তাহলে কি এটা সমাধান যে কেউ শুধু মিডিয়াকেই তাঁর ব্যবসা হিসেবে নির্ধারণ করবেন? তবেই তাঁর পক্ষে তাঁর অন্য সব ব্যবসার সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত হবে না? এমনকি কেউ যদি শুধু একটা পত্রিকা নিয়েই ব্যবসা করতে চান, তাঁর পক্ষেও খুব কঠিন মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সব সংবেদনশীল খবর নিয়ে আসতে। কারণ, তিনি ব্যবসা করছেন, তাঁরও বিজ্ঞাপন লাগবে। অতিগুরুত্বপূর্ণ খবরে বিজ্ঞাপনদাতা অসন্তুষ্ট হতে পারেন। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। মোবাইল ফোন চালু হওয়ার পর থেকে ফোন কোম্পানিগুলো দেশের জনগণকে রাজস্ববঞ্চিত করে এই দেশের কিছু দুর্নীতিবাজ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা তারা বানিয়েছে অবৈধ ভিওআইপি থেকে। দেশের মূলধারার মিডিয়াগুলো বছরের পর বছর চুপ হয়ে ছিল কয়েক কোটি টাকার বিজ্ঞাপন হাতছাড়া হয়ে যাবে এই ভয়ে।
একটি প্রথাগত ছাপা পত্রিকা এই মুহূর্তে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে ইন্টারনেটভিত্তিক সংবাদ সংস্থা এবং সোশ্যাল মিডিয়ার; পরিভাষিকভাবে যাদের আমরা এখন বলছি ‘নিউ মিডিয়া’। এই মিডিয়ায় বিনিয়োগ, পরিচলন ব্যয় খুব কম, তাই হারানোর ভয়ও কম। তাদের পক্ষে সাহসী/আপসহীন হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ এদের পরিবেশিত সংবাদ এবং বিশ্লেষণ লুফে নিচ্ছে। ইউটিউব এবং ফেসবুক চ্যানেলে কিছু ব্যক্তির বলা নানা কথা লাখ লাখ মানুষ বিশ্বাস করছে এবং সেগুলো ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা পালন করছে। এসব মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে খুব বড় প্রশ্ন আছে, কিন্তু সমাজের খুব উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ এই ব্যাপারগুলো নিয়ে ওয়াকিবহাল নন এখনো।
ওদিকে মানুষের জন্য ইন্টারনেটভিত্তিক এসব মিডিয়ায় যুক্ত হয়ে যাওয়া খুব সহজ এখন। আমরা এই মুহূর্তে বাস করছি যোগাযোগপ্রযুক্তির অবিশ্বাস্য রকম প্রসারের মধ্যে। মাত্র হাজার চারেক টাকায় একটি নতুন স্মার্টফোন পাওয়া যায়, যেটি দিয়ে কিছু ডেটা কিনে যেকোনো মানুষ সংযুক্ত হয়ে যেতে পারে সমগ্র পৃথিবীর সঙ্গে।
তবে সংবাদমাধ্যম, সেটা যেমনই হোক, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জটির মুখোমুখি হচ্ছে, সেটা হলো বর্তমান বাংলাদেশের সরকারের ধরন। বৈশ্বিক নানা প্রতিষ্ঠানের কারও দৃষ্টিতে বাংলাদেশ স্বৈরতান্ত্রিক, কারও দৃষ্টিতে আংশিক মুক্ত, আবার কারও বিবেচনায় বাংলাদেশে চলছে হাইব্রিড রেজিম। সরকারের পছন্দ না হলে সংবাদমাধ্যমের ওপর নেমে আসতে পারে দমন-নিপীড়ন। অতি বিতর্কিত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট তো আছেই, কিছুদিন আগে দেখা গেল স্বাধীন বাংলাদেশের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কখনো ব্যবহার না হওয়া অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টও ব্যবহৃত হতে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ক্রমেই পিছিয়ে যাওয়া বাংলাদেশকে (সর্বশেষ অবস্থান ১৫২) দেখে বোঝা যায় এই দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতি সরকারি বাধা কত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার আর সব দেশ তো বটেই, আফগানিস্তান, মিয়ানমার, সাব-সাহারান আফ্রিকার অনেক দেশেও গণমাধ্যম আমাদের চেয়ে মুক্ত। এসব বিবেচনাতেই শুরুতেই প্রশ্ন করেছিলাম একটা দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে প্রতিকূল সময় কি না। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, এটাই সবচেয়ে প্রতিকূল সময়।
সব প্রতিকূলতার সঙ্গে এই মুহূর্তে দেশের প্রায় সব দৈনিক পত্রিকা এবং মূল ধারার মিডিয়া নানা রকম অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে বিশ্বাসযোগ্যতার চরম সংকটে আছে। কারও বিরুদ্ধে আছে কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারের কাছে নতজানু হয়ে মিডিয়া চালানোর অভিযোগ, কারও বিরুদ্ধে আছে মালিক ব্যবসায়ী কিংবা শিল্পগোষ্ঠীটির স্বার্থের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার অভিযোগ। সাম্প্রতিক অতীতে কয়েকটি ঘটনা এই দেশের মূল ধারার মিডিয়ার জন্য খুব শক্ত বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট তৈরি করেছে।
একটা অদ্ভুত কারণে আমাদের দেশে অনেকের মনে মিডিয়া সম্পর্কে একটা ভ্রান্ত ধারণা কাজ করে। তাঁরা মিডিয়াকে শুধুই একটি জনসেবামূলক কাজ বা চ্যারিটি বলে মনে করেন। আমাদের আসলে জানতে হবে আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় সংবাদ একটি পণ্য; আর মিডিয়া একটি ব্যবসা। একটি পণ্যকে ভিত্তি করে যখন একটি ব্যবসা দাঁড়ায় তখন তার মধ্যে কিছু বিচ্যুতি, কিছু স্খলন খুব স্বাভাবিক। অত্যন্ত বিকশিত গণতন্ত্রের আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোর পত্রিকা নিয়ে এই অভিযোগ আছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলের গাজা আক্রমণ নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ার একপেশে সংবাদ প্রচারের অভিযোগ খুব জোরেশোরে উচ্চারিত হয়েছে।
কিছু বিচ্যুতি, কিছু স্খলন থাকলেও পশ্চিমের বিকশিত শক্তিশালী মিডিয়াগুলো জানে পণ্য হিসেবে কেমন সংবাদ/বিশ্লেষণ জনগণ চায়; নিজেদের তারা গড়ে তোলে সেই অনুযায়ী। সঠিক সংবাদ/বিশ্লেষণ তারা খুঁজে আনে ভালোভাবে এবং সেটাকে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেয় চমৎকার কৌশলে।
অত্যন্ত প্রতিকূল একটা সময়ে একটি দৈনিক ‘আজকের পত্রিকা’ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। আগেই বলেছি, পত্রিকা কোনো চ্যারিটি নয়। যাত্রা শুরুর এই সময়ে আমার চাওয়া একটি চমৎকার পেশাগত এবং বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পত্রিকাটি চলবে। ‘আজকের পত্রিকা’ অসাধারণ সব খবর-পণ্য খুঁজে বের করবে এবং সেগুলো সফলতার সঙ্গে বিক্রি করতে পারবে ভোক্তার কাছে। এটা করতে পারলেই ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে এই রাষ্ট্রের জন্য এক অভূতপূর্ব কাজ করা হয়ে যাবে–নানা কারণে ভীষণ নড়বড়ে হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রের অঘোষিত চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যমকে আবার শক্তিশালী করে তোলার একটি সবল স্তম্ভ হয়ে উঠবে ‘আজকের পত্রিকা’।
ডা. জাহেদ উর রহমান
শিক্ষক, অ্যাকটিভিস্ট
একটি নতুন পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করার জন্য বাংলাদেশের ইতিহাসে বর্তমান সময়ের চেয়ে খুব বেশি প্রতিকূল সময় ইতিহাসে কি আর ছিল? অবশ্য সংখ্যার হিসাব বলে এটাই হয়তো পত্রিকা বের করার জন্য সবচেয়ে মোক্ষম সময়। পত্রিকার জন্য এক অতি উর্বর ভূমি বাংলাদেশ, ঢাকা এবং অন্যান্য জেলা মিলিয়ে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ১ হাজার ৩০০। জানি এর মধ্যে প্রকাশিত হয় খুব ছোট একটি ভগ্নাংশই।
পত্রিকা প্রকাশনার আছে নানা উদ্দেশ্য। কিন্তু একটি দৈনিক পত্রিকা, যেটা স্রেফ তার অস্তিত্ব আছে এটুকু না বুঝিয়ে যদি সত্যিকারভাবে একটি পত্রিকা হয়ে উঠতে চায়, তাহলে সেটা খুব পুঁজিঘন একটি শিল্প। এই কারণেই গভীরভাবে তলিয়ে দেখতে গেলে দেখব, প্রতিটি মূল ধারার মিডিয়া জন্ম নেয় তার বুকে একধরনের ধ্বংসের বীজ নিয়ে।
একটা দৈনিক পত্রিকা শুরু করার সময় খুব বড় পরিমাণ বিনিয়োগ তো লাগেই, সঙ্গে দরকার হয় বিরাট অঙ্কের পরিচলন ব্যয়। এই বিপুল ব্যয় করেও কোনো কোনো পত্রিকার মালিক ব্যবসা না করতে চাইতেই পারেন; তাঁর উদ্দেশ্য থাকতে পারে মিডিয়াকে সমাজে তাঁর প্রভাব তৈরি কিংবা তাঁরই অন্য কোনো ব্যবসার সুবিধা অর্জন কিংবা রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করা। কিন্তু এই কলামের আলোচনার সুবিধার্থে আমরা ধরে নিচ্ছি একজন পুঁজিপতি মিডিয়ায় বিনিয়োগ করছেন একটা সত্যিকার মিডিয়া তৈরি করার জন্য। এত টাকা কেউ বিনিয়োগ করেন মুনাফার জন্য, সেটা বোঝার জন্য ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। আর এটাও আমরা জানি, মুনাফা আর আপস চলে হাত ধরাধরি করে। তাই প্রশ্ন আসবেই, একটা প্রথাগত মিডিয়া, যেটা স্রেফ একটা ব্যবসা, তার পক্ষে কতটা শক্তিশালী ভূমিকা রাখা সম্ভব?
আমাদের দেশের মূল ধারার পত্রিকা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মালিক বড় বড় ব্যবসায়ী, শিল্পগোষ্ঠী, যাঁদের আছে অন্য অনেক ব্যবসা, আছে রাজনৈতিক ‘কানেকশন’। তাই বহু গুরুত্বপূর্ণ খবর তাঁদের নিজের ব্যবসার বিরুদ্ধে যেতে পারে; যেতে পারে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে। সংবাদ ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে যাওয়া মানেও ব্যবসার ক্ষতির আশঙ্কা বাড়া। সার্বিক বিবেচনায় যে কারও মনে হতেই পারে অতিসংবেদনশীল সংবাদের ক্ষেত্রে অনেক ভালো হচ্ছে ‘খামোশ’ হয়ে থাকা। কিন্তু এটাই বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট তৈরি করে একটি পত্রিকার ক্ষেত্রে, যা ধীরে ধীরে সেই পত্রিকার মৃত্যু ঘটায়।
তাহলে কি এটা সমাধান যে কেউ শুধু মিডিয়াকেই তাঁর ব্যবসা হিসেবে নির্ধারণ করবেন? তবেই তাঁর পক্ষে তাঁর অন্য সব ব্যবসার সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত হবে না? এমনকি কেউ যদি শুধু একটা পত্রিকা নিয়েই ব্যবসা করতে চান, তাঁর পক্ষেও খুব কঠিন মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সব সংবেদনশীল খবর নিয়ে আসতে। কারণ, তিনি ব্যবসা করছেন, তাঁরও বিজ্ঞাপন লাগবে। অতিগুরুত্বপূর্ণ খবরে বিজ্ঞাপনদাতা অসন্তুষ্ট হতে পারেন। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। মোবাইল ফোন চালু হওয়ার পর থেকে ফোন কোম্পানিগুলো দেশের জনগণকে রাজস্ববঞ্চিত করে এই দেশের কিছু দুর্নীতিবাজ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা তারা বানিয়েছে অবৈধ ভিওআইপি থেকে। দেশের মূলধারার মিডিয়াগুলো বছরের পর বছর চুপ হয়ে ছিল কয়েক কোটি টাকার বিজ্ঞাপন হাতছাড়া হয়ে যাবে এই ভয়ে।
একটি প্রথাগত ছাপা পত্রিকা এই মুহূর্তে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে ইন্টারনেটভিত্তিক সংবাদ সংস্থা এবং সোশ্যাল মিডিয়ার; পরিভাষিকভাবে যাদের আমরা এখন বলছি ‘নিউ মিডিয়া’। এই মিডিয়ায় বিনিয়োগ, পরিচলন ব্যয় খুব কম, তাই হারানোর ভয়ও কম। তাদের পক্ষে সাহসী/আপসহীন হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ এদের পরিবেশিত সংবাদ এবং বিশ্লেষণ লুফে নিচ্ছে। ইউটিউব এবং ফেসবুক চ্যানেলে কিছু ব্যক্তির বলা নানা কথা লাখ লাখ মানুষ বিশ্বাস করছে এবং সেগুলো ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা পালন করছে। এসব মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে খুব বড় প্রশ্ন আছে, কিন্তু সমাজের খুব উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ এই ব্যাপারগুলো নিয়ে ওয়াকিবহাল নন এখনো।
ওদিকে মানুষের জন্য ইন্টারনেটভিত্তিক এসব মিডিয়ায় যুক্ত হয়ে যাওয়া খুব সহজ এখন। আমরা এই মুহূর্তে বাস করছি যোগাযোগপ্রযুক্তির অবিশ্বাস্য রকম প্রসারের মধ্যে। মাত্র হাজার চারেক টাকায় একটি নতুন স্মার্টফোন পাওয়া যায়, যেটি দিয়ে কিছু ডেটা কিনে যেকোনো মানুষ সংযুক্ত হয়ে যেতে পারে সমগ্র পৃথিবীর সঙ্গে।
তবে সংবাদমাধ্যম, সেটা যেমনই হোক, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জটির মুখোমুখি হচ্ছে, সেটা হলো বর্তমান বাংলাদেশের সরকারের ধরন। বৈশ্বিক নানা প্রতিষ্ঠানের কারও দৃষ্টিতে বাংলাদেশ স্বৈরতান্ত্রিক, কারও দৃষ্টিতে আংশিক মুক্ত, আবার কারও বিবেচনায় বাংলাদেশে চলছে হাইব্রিড রেজিম। সরকারের পছন্দ না হলে সংবাদমাধ্যমের ওপর নেমে আসতে পারে দমন-নিপীড়ন। অতি বিতর্কিত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট তো আছেই, কিছুদিন আগে দেখা গেল স্বাধীন বাংলাদেশের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কখনো ব্যবহার না হওয়া অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টও ব্যবহৃত হতে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ক্রমেই পিছিয়ে যাওয়া বাংলাদেশকে (সর্বশেষ অবস্থান ১৫২) দেখে বোঝা যায় এই দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতি সরকারি বাধা কত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার আর সব দেশ তো বটেই, আফগানিস্তান, মিয়ানমার, সাব-সাহারান আফ্রিকার অনেক দেশেও গণমাধ্যম আমাদের চেয়ে মুক্ত। এসব বিবেচনাতেই শুরুতেই প্রশ্ন করেছিলাম একটা দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে প্রতিকূল সময় কি না। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, এটাই সবচেয়ে প্রতিকূল সময়।
সব প্রতিকূলতার সঙ্গে এই মুহূর্তে দেশের প্রায় সব দৈনিক পত্রিকা এবং মূল ধারার মিডিয়া নানা রকম অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে বিশ্বাসযোগ্যতার চরম সংকটে আছে। কারও বিরুদ্ধে আছে কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারের কাছে নতজানু হয়ে মিডিয়া চালানোর অভিযোগ, কারও বিরুদ্ধে আছে মালিক ব্যবসায়ী কিংবা শিল্পগোষ্ঠীটির স্বার্থের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার অভিযোগ। সাম্প্রতিক অতীতে কয়েকটি ঘটনা এই দেশের মূল ধারার মিডিয়ার জন্য খুব শক্ত বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট তৈরি করেছে।
একটা অদ্ভুত কারণে আমাদের দেশে অনেকের মনে মিডিয়া সম্পর্কে একটা ভ্রান্ত ধারণা কাজ করে। তাঁরা মিডিয়াকে শুধুই একটি জনসেবামূলক কাজ বা চ্যারিটি বলে মনে করেন। আমাদের আসলে জানতে হবে আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় সংবাদ একটি পণ্য; আর মিডিয়া একটি ব্যবসা। একটি পণ্যকে ভিত্তি করে যখন একটি ব্যবসা দাঁড়ায় তখন তার মধ্যে কিছু বিচ্যুতি, কিছু স্খলন খুব স্বাভাবিক। অত্যন্ত বিকশিত গণতন্ত্রের আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোর পত্রিকা নিয়ে এই অভিযোগ আছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলের গাজা আক্রমণ নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ার একপেশে সংবাদ প্রচারের অভিযোগ খুব জোরেশোরে উচ্চারিত হয়েছে।
কিছু বিচ্যুতি, কিছু স্খলন থাকলেও পশ্চিমের বিকশিত শক্তিশালী মিডিয়াগুলো জানে পণ্য হিসেবে কেমন সংবাদ/বিশ্লেষণ জনগণ চায়; নিজেদের তারা গড়ে তোলে সেই অনুযায়ী। সঠিক সংবাদ/বিশ্লেষণ তারা খুঁজে আনে ভালোভাবে এবং সেটাকে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেয় চমৎকার কৌশলে।
অত্যন্ত প্রতিকূল একটা সময়ে একটি দৈনিক ‘আজকের পত্রিকা’ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। আগেই বলেছি, পত্রিকা কোনো চ্যারিটি নয়। যাত্রা শুরুর এই সময়ে আমার চাওয়া একটি চমৎকার পেশাগত এবং বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পত্রিকাটি চলবে। ‘আজকের পত্রিকা’ অসাধারণ সব খবর-পণ্য খুঁজে বের করবে এবং সেগুলো সফলতার সঙ্গে বিক্রি করতে পারবে ভোক্তার কাছে। এটা করতে পারলেই ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে এই রাষ্ট্রের জন্য এক অভূতপূর্ব কাজ করা হয়ে যাবে–নানা কারণে ভীষণ নড়বড়ে হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রের অঘোষিত চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যমকে আবার শক্তিশালী করে তোলার একটি সবল স্তম্ভ হয়ে উঠবে ‘আজকের পত্রিকা’।
ডা. জাহেদ উর রহমান
শিক্ষক, অ্যাকটিভিস্ট
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪