তৌহিদুল হক
মানুষ এগিয়ে যায় একটি লক্ষ্য পুঁজি করে। সময়ের চাপে, সম্পর্কের চাহনিতে এবং মানুষের এগিয়ে যাওয়া বা পরিবর্তনের সহজাত প্রভাব মানুষকে এগিয়ে রাখে। পরস্পর মিলিত হয় সমাজবন্ধনীর বন্ধনে। সম্পর্ক হয়, হয় অনুভূতির উর্বর ব্যাপ্তি। মানুষের জন্য মানুষের মায়া বাড়ে। সমাজ, সম্পর্ক কিংবা রাষ্ট্রের গাঁথুনি মায়ার বন্ধনে শাসিত। কোথাও দায়িত্ববোধের আবার কোথাও আবেগের কোমল পরশ। বাংলাদেশের চলমান সমাজ বাস্তবতা ও এর অনুশীলনের প্রেক্ষাপট পরস্পর সম্পর্কযুক্ত উপাদানের সম্মিলিত মিলনে মানুষকে একত্র করে। যেখানে দেশীয় উপলব্ধি তৈরির এক মনুষ্য প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। আমাদের জীবনপ্রক্রিয়া সমবেত ধারায় পরিচালিত। রক্তের সম্পর্ক কিংবা আইনসিদ্ধ আত্মীয়দের ক্রমাগত চালচলন মানুষের চিন্তার জগতে এক বিরাট প্রভাব রাখে। মানুষ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে পরিচিত হয়ে জীবনের পরিচয় পাল্টে দিতে চায়। এ খেলা সব সমাজে চলমান। বাংলাদেশের সমাজ পরিচালনায় পরস্পর আবেগ, চোখের জলে আঁকড়ে ধরার অন্তর্নিহিত ব্যাকুলতা কিংবা মেলামেশায় ভালো লাগার এক অপরিমেয় অনুভূতি তৈরি হয়। একটি সমাজের মানুষকে মোটাদাগে পরিবর্তনে এই অনুভূতির কোনো বিকল্প নেই। সবার সঙ্গে সবার প্রীতির পরম্পরা এবং এই অনুভূতির প্রয়োগে মানসজগতে স্বস্তির বাতাস অনুভূত হয়। এটাই সমাজের সম্পদ, মানুষের ভবিষ্যৎ। সমষ্টিগত প্রেরণা মানুষকে সব অসুবিধা বা প্রতিবন্ধকতা দূর করে এক জায়গায় জড়ো করে। যার নাম মনুষ্যত্ব কিংবা বেঁচে থাকার নির্মল বায়ু। যা আস্থার, বিশ্বাসের বা দায়িত্বের গণ্ডিতে এক মোহনীয় সংসার।
বিচ্ছিন্নতাবোধ মানুষের জীবনে কিংবা রাষ্ট্রের পরিমণ্ডলে এক অখণ্ডনীয় অসুবিধা জাগ্রত করে। মানুষকে দাঁড় করায় মানুষের বিরুদ্ধে। মানুষকে খেপিয়ে তোলে সমাজ ও রাষ্ট্রের চলতি নিয়ম ও সম্প্রীতির ওপর। মানুষকে বিচ্ছিন্ন চিন্তাধারা যুগে যুগে সর্বধ্বংসী মহামারির মধ্যে ফেলে বারবার পরীক্ষা করেছে। ইতিহাসের পর্যালোচনায় সেসব ঘটনা মানুষকে কতটা ‘মানুষ’ করতে পেরেছে, তা সময়ব্যাপী আলোচনার দাবি রাখে। সমাজ সৃষ্টি এবং মানুষের সমাজ সম্পৃক্ততার গল্পে যে বিষয়টি সবচেয়ে এগিয়ে, তা হলো মানুষের বাঁচার প্রেরণায় সবার সম্পৃক্তি ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সর্বকণ্ঠ সোচ্চার করা। মানুষ শৃঙ্খলার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে উন্নত সমাজ ও পরিশীলিত ভবিষ্যতের স্বপ্নে কাজে নেমেছে। কাজের চলমানতায়, কাজের গভীরতায় ও শৃঙ্খলার মনুষ্য পরীক্ষায় আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল এক স্বাপ্নিক সময়। সমাজতাত্ত্বিক ও সংস্কৃতির জাগরণে তা ‘সভ্যতা’ নামে পরিচিত। সমাজকাঠামো যেসব দেশ বা সমাজ কাঙ্ক্ষি ধারায় পরিচালিত করতে পেরেছে, তারাই সভ্যতার চাদরে আবৃত হয়েছে। সবার জন্য কল্যাণ ও সুবিধার বন্দোবস্ত করতে পেরেছে। সেসব দেশে মানুষের জীবন হয়েছে বসন্তের চূড়ান্তে কড়া হলদে রঙের পাতার মতো, সমুদ্রের পাশে এসে মিলে যাওয়া পানির কম্পনের মতো। কল্যাণধারা ও শৃঙ্খলার বেষ্টনীতে নিজেদের জড়িত করা খুবই অপরিহার্য।
বাংলাদেশের সমাজ বিনির্মাণে ও এ কাজে সমবেত দায়িত্ব আজ বিচ্ছিন্নতার অসুখে কাতর। ব্যক্তিস্বার্থপরতার প্রবল চপেটাঘাত সমাজে বেশি লক্ষণীয়। শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, নারী হারাচ্ছে যত্নের সতীত্ব এবং বিশ্বাস-অবিশ্বাসের এক দোলাচলে চলছে বাংলাদেশের সমাজজীবন। অধিক জনসংখ্যার দেশে সামাজিক অস্থিরতা ও অপরিপক্বতা থাকবে। তবে তার মাত্রা দিনে দিনে আমরা ছাড়িয়ে যাচ্ছি। খুঁজে পাচ্ছি না ঠিকানা, আমাদের আদি উৎস। জীবনের কল্পিত ক্যানভাস কিংবা সম্পর্কে আস্থার প্রলেপ। পরস্পর অবিশ্বাস আর দায়িত্ববোধের অবক্ষয় আমাদের নিয়ে যাচ্ছে চূড়ান্ত পরীক্ষার আসরে। সম্মিলিত ও সৎ প্রচেষ্টা ব্যতীত ফিরে আসা কঠিন। কারণ, মানুষের মধ্যে ভোগবাদের সর্বোচ্চ লোভ দৃষ্টিগোচর হলে সমাজ টিকে থাকে না। এটি সমাজ বিশ্লেষণের এক গভীরতর উপলব্ধি।
সমাজে ক্রিয়াশীল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের মধ্যে দেশীয় আমেজে দায়িত্ব পালনের সুযোগ সৃষ্টি করে, মানুষকে প্রস্তুত করে। মানুষকে উদার মানবিকতার শিক্ষণে এক সম্ভাবনায় সমবেত করে। সময়ের পরিক্রমায় হোক অথবা মানুষের কাছে মানুষের প্রত্যাশার ব্যাপ্তিতে হোক, মানুষকে হতে হবে পরস্পর প্রীতির সংগীতে উদ্বুদ্ধ। মানুষের প্রেরণা, সমাজ ও রাষ্ট্রের আদর্শিক ভাবধারায় পরিবর্তনের সূচনা করে। এমনটি বাংলাদেশের সমাজে লক্ষ করা যাচ্ছে না। তবে মাঝে মাঝে জেগে ওঠে মানুষ। যা উদাহরণ হতে পারে তবে বিশেষ। এর মাধ্যমে সমাজের ভিতরকার কাঠামোতে প্রত্যাশিত পরিবর্তনের ঢেউ লাগবে বলে মনে হয় না।
অথচ বাংলাদেশে ইতিহাসসংশ্লিষ্ট সমাজ বিশ্লেষণে গভীরভাবে উপলব্ধি হয় যে, এই দেশটি নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা ও রাষ্ট্রিক অমানবিক সিদ্ধান্ত ও আচরণের বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়াই করেছে। আদর্শিক প্রেরণায় জীবনকে তুচ্ছ মনে করে মানুষ সমাজ ও দেশের তরে সর্বস্ব ত্যাগের জন্য প্রস্তুত ছিল। স্বপ্ন একটাই। সেটি হলো, দেশের সর্বত্র এবং মানুষের মূল্যায়নে সমতা ও অবস্থানগত যোগ্যতার সর্বোচ্চ চর্চা হবে। স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে এই সময়ের সমাজ কিংবা দেশ একাত্ম হতে পারছে না। আমরা স্বাধীনতার বছর হিসেবে সংখ্যার বিচারে যত বড় হচ্ছি, মূল অবস্থান থেকে তত দূরে সরে যাচ্ছি। একটি বৈষম্যহীন আদর্শিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় যে সিদ্ধান্তগুলো এবং পরিবেশ প্রয়োজন, তার সবটাই আমাদের আছে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ক্ষমতাকেন্দ্রিক মনোভাব, দুর্নীতির অনুশীলনে আমাদের সম্পৃক্ততা ও দক্ষতার প্রমাণ এবং মানুষের মধ্যকার মনস্তাত্ত্বিক অসংলগ্নতা আমাদের ‘আমাদের’ হতে দিচ্ছে না।
স্বাধীনতার সাল থেকে পঞ্চাশ বছর বয়স্ক দেশটি সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। এখনো প্রতিনিয়ত মানুষ তুচ্ছ কারণে জড়িয়ে যাচ্ছে বিবাদে কিংবা কোনো কারণ ছাড়াই ক্ষতি করছে অন্যের সম্মান, অবস্থান এবং সম্পদ। এর মধ্যে কেউ কেউ আনন্দ পায়। বিষাদের আনন্দ, কষ্ট দিয়ে আনন্দের জোয়ার মানবজাতি কিংবা আমাদের জাতিগত বিপর্যয়ের উদাহরণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ ক্ষেত্রে পরিত্রাণের সুযোগ থাকলেও ‘সংকটকেন্দ্রিক বাণিজ্য’ চলমান সমাজ ও সভ্যতার সবচেয়ে বড় শত্রু। মানুষের অশ্রুর মূল্য নেই, মানুষের অশ্রু বিক্রি হয় আজ টাকায় অথবা ধার দেয় চড়া সুদে। মানুষ সামাজিকতার পরিধি পেরিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে নিষ্ঠুরতার গহ্বরে, মানুষ হারিয়ে ফেলছে নিজস্বতার ঠিকানা।
বাংলাদেশের অবস্থান ও প্রাকৃতিক পরিমণ্ডল এক সম্ভাবনাময় দেশের ইঙ্গিত সব সময়ই প্রকাশ করছে। আমরা ধরি ধরি করে ধরতে পারছি না। রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের জায়গা থেকে সমাজের ও মানুষের প্রত্যাশিত পরিবর্তনের ক্ষেত্রগুলো নির্ধারণ করা সঠিকভাবে সম্ভব হচ্ছে না। সবাই নিজের স্বার্থের মিছিলে এগিয়ে থাকছে, তবে ব্যতিক্রম আছে, তা সংখ্যায় অল্প। আমাদের সমাজ জীবন ও পরস্পর পরিচর্যার আকাশে ঘন মেঘ পুঞ্জীভূত। প্রচণ্ড দমকা বাতাস আর ঝড়ের অপেক্ষায়। মেঘ হলে বৃষ্টি হয়, কেটে যায় অস্বস্তির অপ্রত্যাশিত কষ্ট। সমাজের নিয়মের ক্ষেত্রেও তাই। সংকটই সম্ভাবনার সুযোগ সৃষ্টি করে। তবে সেই সুযোগ অনুভব করার মতো ক্ষমতা ও মানসিকতা থাকা চাই। দক্ষিণা বাতাসের উপস্থিতি শরীরজুড়ে শীতল প্রলেপ জাগিয়ে তোলে। মানুষের আরামের অন্দরে সংযোজন ঘটায় নতুন উপকরণের। প্রকৃতিলব্ধ নিয়মের ব্যাখ্যায়নে মানুষের জীবন ও বসবাসের ঠিকানায় সমাজের রূপান্তর প্রয়োজন। একা হেঁটে অনেক দূরে যাওয়া যায়, দ্রুত হাঁটাও যায়। কিন্তু সমষ্টিগত বসবাসে হাঁটার মধ্যে ছন্দের উপস্থিতি অপরিহার্য। যা সমাজে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে, মানুষকে বিদ্রোহী করে মানুষের প্রয়োজনে এবং মানুষ দাম দিতে শেখে মানুষের।
সমাজব্যবস্থার রূপান্তর ব্যতীত আমরা যা যা চাই, তার কোনো কিছুই আমাদের কাছে ধরা দেবে না। মানুষগুলোকেই তৈরি করতে হবে, এগিয়ে যাওয়ার জন্য সম্ভাবনার সুযোগ সৃষ্টিতে প্রস্তুত মানুষের খুব দরকার। সামাজিক ক্ষেত্রগুলোতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং রাষ্ট্রের শিক্ষণ ও সেবার জায়গায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের আদর্শিক অবস্থান ও ন্যায়পরায়ণতার শাসনে নিজেদের শাসন করার মানসিকতা থাকা চাই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন আসবে। তবে পরিকল্পিত পরিবর্তন জীবনের সঙ্গে একনিষ্ঠ করতে না পারলে সামাজিক সংকট লেগেই থাকবে। মানুষ বিরুদ্ধাচরণ করবে মানুষের, নিয়মের এবং এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রসিদ্ধ রীতির। এর থেকে মুক্তি চাই, বেরিয়ে আসতে চাই। প্রয়োজন নিজেদের সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাসগত ঐতিহ্যে নিজেদের প্রস্তুত করা। আদর্শিক কাঠামো ও পরস্পর সহযোগিতার পরিবেশ আমাদের আরও উন্নত জীবনের বাস্তবিক ঠিকানায় পৌঁছে দেবে এবং মানুষ খুঁজে পাবে স্বাচ্ছন্দ্যে ভরপুর এক সংগীতময় জীবন। যেখানে প্রতিযোগিতার বিপরীতে সহযোগিতা-সহমর্মিতার পতাকা বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়বে। এ জীবন বাঙালির, এ জীবন বাংলাদেশের।
তৌহিদুল হক
কবি ও সহকারী অধ্যাপক, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মানুষ এগিয়ে যায় একটি লক্ষ্য পুঁজি করে। সময়ের চাপে, সম্পর্কের চাহনিতে এবং মানুষের এগিয়ে যাওয়া বা পরিবর্তনের সহজাত প্রভাব মানুষকে এগিয়ে রাখে। পরস্পর মিলিত হয় সমাজবন্ধনীর বন্ধনে। সম্পর্ক হয়, হয় অনুভূতির উর্বর ব্যাপ্তি। মানুষের জন্য মানুষের মায়া বাড়ে। সমাজ, সম্পর্ক কিংবা রাষ্ট্রের গাঁথুনি মায়ার বন্ধনে শাসিত। কোথাও দায়িত্ববোধের আবার কোথাও আবেগের কোমল পরশ। বাংলাদেশের চলমান সমাজ বাস্তবতা ও এর অনুশীলনের প্রেক্ষাপট পরস্পর সম্পর্কযুক্ত উপাদানের সম্মিলিত মিলনে মানুষকে একত্র করে। যেখানে দেশীয় উপলব্ধি তৈরির এক মনুষ্য প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। আমাদের জীবনপ্রক্রিয়া সমবেত ধারায় পরিচালিত। রক্তের সম্পর্ক কিংবা আইনসিদ্ধ আত্মীয়দের ক্রমাগত চালচলন মানুষের চিন্তার জগতে এক বিরাট প্রভাব রাখে। মানুষ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে পরিচিত হয়ে জীবনের পরিচয় পাল্টে দিতে চায়। এ খেলা সব সমাজে চলমান। বাংলাদেশের সমাজ পরিচালনায় পরস্পর আবেগ, চোখের জলে আঁকড়ে ধরার অন্তর্নিহিত ব্যাকুলতা কিংবা মেলামেশায় ভালো লাগার এক অপরিমেয় অনুভূতি তৈরি হয়। একটি সমাজের মানুষকে মোটাদাগে পরিবর্তনে এই অনুভূতির কোনো বিকল্প নেই। সবার সঙ্গে সবার প্রীতির পরম্পরা এবং এই অনুভূতির প্রয়োগে মানসজগতে স্বস্তির বাতাস অনুভূত হয়। এটাই সমাজের সম্পদ, মানুষের ভবিষ্যৎ। সমষ্টিগত প্রেরণা মানুষকে সব অসুবিধা বা প্রতিবন্ধকতা দূর করে এক জায়গায় জড়ো করে। যার নাম মনুষ্যত্ব কিংবা বেঁচে থাকার নির্মল বায়ু। যা আস্থার, বিশ্বাসের বা দায়িত্বের গণ্ডিতে এক মোহনীয় সংসার।
বিচ্ছিন্নতাবোধ মানুষের জীবনে কিংবা রাষ্ট্রের পরিমণ্ডলে এক অখণ্ডনীয় অসুবিধা জাগ্রত করে। মানুষকে দাঁড় করায় মানুষের বিরুদ্ধে। মানুষকে খেপিয়ে তোলে সমাজ ও রাষ্ট্রের চলতি নিয়ম ও সম্প্রীতির ওপর। মানুষকে বিচ্ছিন্ন চিন্তাধারা যুগে যুগে সর্বধ্বংসী মহামারির মধ্যে ফেলে বারবার পরীক্ষা করেছে। ইতিহাসের পর্যালোচনায় সেসব ঘটনা মানুষকে কতটা ‘মানুষ’ করতে পেরেছে, তা সময়ব্যাপী আলোচনার দাবি রাখে। সমাজ সৃষ্টি এবং মানুষের সমাজ সম্পৃক্ততার গল্পে যে বিষয়টি সবচেয়ে এগিয়ে, তা হলো মানুষের বাঁচার প্রেরণায় সবার সম্পৃক্তি ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সর্বকণ্ঠ সোচ্চার করা। মানুষ শৃঙ্খলার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে উন্নত সমাজ ও পরিশীলিত ভবিষ্যতের স্বপ্নে কাজে নেমেছে। কাজের চলমানতায়, কাজের গভীরতায় ও শৃঙ্খলার মনুষ্য পরীক্ষায় আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল এক স্বাপ্নিক সময়। সমাজতাত্ত্বিক ও সংস্কৃতির জাগরণে তা ‘সভ্যতা’ নামে পরিচিত। সমাজকাঠামো যেসব দেশ বা সমাজ কাঙ্ক্ষি ধারায় পরিচালিত করতে পেরেছে, তারাই সভ্যতার চাদরে আবৃত হয়েছে। সবার জন্য কল্যাণ ও সুবিধার বন্দোবস্ত করতে পেরেছে। সেসব দেশে মানুষের জীবন হয়েছে বসন্তের চূড়ান্তে কড়া হলদে রঙের পাতার মতো, সমুদ্রের পাশে এসে মিলে যাওয়া পানির কম্পনের মতো। কল্যাণধারা ও শৃঙ্খলার বেষ্টনীতে নিজেদের জড়িত করা খুবই অপরিহার্য।
বাংলাদেশের সমাজ বিনির্মাণে ও এ কাজে সমবেত দায়িত্ব আজ বিচ্ছিন্নতার অসুখে কাতর। ব্যক্তিস্বার্থপরতার প্রবল চপেটাঘাত সমাজে বেশি লক্ষণীয়। শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, নারী হারাচ্ছে যত্নের সতীত্ব এবং বিশ্বাস-অবিশ্বাসের এক দোলাচলে চলছে বাংলাদেশের সমাজজীবন। অধিক জনসংখ্যার দেশে সামাজিক অস্থিরতা ও অপরিপক্বতা থাকবে। তবে তার মাত্রা দিনে দিনে আমরা ছাড়িয়ে যাচ্ছি। খুঁজে পাচ্ছি না ঠিকানা, আমাদের আদি উৎস। জীবনের কল্পিত ক্যানভাস কিংবা সম্পর্কে আস্থার প্রলেপ। পরস্পর অবিশ্বাস আর দায়িত্ববোধের অবক্ষয় আমাদের নিয়ে যাচ্ছে চূড়ান্ত পরীক্ষার আসরে। সম্মিলিত ও সৎ প্রচেষ্টা ব্যতীত ফিরে আসা কঠিন। কারণ, মানুষের মধ্যে ভোগবাদের সর্বোচ্চ লোভ দৃষ্টিগোচর হলে সমাজ টিকে থাকে না। এটি সমাজ বিশ্লেষণের এক গভীরতর উপলব্ধি।
সমাজে ক্রিয়াশীল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের মধ্যে দেশীয় আমেজে দায়িত্ব পালনের সুযোগ সৃষ্টি করে, মানুষকে প্রস্তুত করে। মানুষকে উদার মানবিকতার শিক্ষণে এক সম্ভাবনায় সমবেত করে। সময়ের পরিক্রমায় হোক অথবা মানুষের কাছে মানুষের প্রত্যাশার ব্যাপ্তিতে হোক, মানুষকে হতে হবে পরস্পর প্রীতির সংগীতে উদ্বুদ্ধ। মানুষের প্রেরণা, সমাজ ও রাষ্ট্রের আদর্শিক ভাবধারায় পরিবর্তনের সূচনা করে। এমনটি বাংলাদেশের সমাজে লক্ষ করা যাচ্ছে না। তবে মাঝে মাঝে জেগে ওঠে মানুষ। যা উদাহরণ হতে পারে তবে বিশেষ। এর মাধ্যমে সমাজের ভিতরকার কাঠামোতে প্রত্যাশিত পরিবর্তনের ঢেউ লাগবে বলে মনে হয় না।
অথচ বাংলাদেশে ইতিহাসসংশ্লিষ্ট সমাজ বিশ্লেষণে গভীরভাবে উপলব্ধি হয় যে, এই দেশটি নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা ও রাষ্ট্রিক অমানবিক সিদ্ধান্ত ও আচরণের বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়াই করেছে। আদর্শিক প্রেরণায় জীবনকে তুচ্ছ মনে করে মানুষ সমাজ ও দেশের তরে সর্বস্ব ত্যাগের জন্য প্রস্তুত ছিল। স্বপ্ন একটাই। সেটি হলো, দেশের সর্বত্র এবং মানুষের মূল্যায়নে সমতা ও অবস্থানগত যোগ্যতার সর্বোচ্চ চর্চা হবে। স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে এই সময়ের সমাজ কিংবা দেশ একাত্ম হতে পারছে না। আমরা স্বাধীনতার বছর হিসেবে সংখ্যার বিচারে যত বড় হচ্ছি, মূল অবস্থান থেকে তত দূরে সরে যাচ্ছি। একটি বৈষম্যহীন আদর্শিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় যে সিদ্ধান্তগুলো এবং পরিবেশ প্রয়োজন, তার সবটাই আমাদের আছে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ক্ষমতাকেন্দ্রিক মনোভাব, দুর্নীতির অনুশীলনে আমাদের সম্পৃক্ততা ও দক্ষতার প্রমাণ এবং মানুষের মধ্যকার মনস্তাত্ত্বিক অসংলগ্নতা আমাদের ‘আমাদের’ হতে দিচ্ছে না।
স্বাধীনতার সাল থেকে পঞ্চাশ বছর বয়স্ক দেশটি সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। এখনো প্রতিনিয়ত মানুষ তুচ্ছ কারণে জড়িয়ে যাচ্ছে বিবাদে কিংবা কোনো কারণ ছাড়াই ক্ষতি করছে অন্যের সম্মান, অবস্থান এবং সম্পদ। এর মধ্যে কেউ কেউ আনন্দ পায়। বিষাদের আনন্দ, কষ্ট দিয়ে আনন্দের জোয়ার মানবজাতি কিংবা আমাদের জাতিগত বিপর্যয়ের উদাহরণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ ক্ষেত্রে পরিত্রাণের সুযোগ থাকলেও ‘সংকটকেন্দ্রিক বাণিজ্য’ চলমান সমাজ ও সভ্যতার সবচেয়ে বড় শত্রু। মানুষের অশ্রুর মূল্য নেই, মানুষের অশ্রু বিক্রি হয় আজ টাকায় অথবা ধার দেয় চড়া সুদে। মানুষ সামাজিকতার পরিধি পেরিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে নিষ্ঠুরতার গহ্বরে, মানুষ হারিয়ে ফেলছে নিজস্বতার ঠিকানা।
বাংলাদেশের অবস্থান ও প্রাকৃতিক পরিমণ্ডল এক সম্ভাবনাময় দেশের ইঙ্গিত সব সময়ই প্রকাশ করছে। আমরা ধরি ধরি করে ধরতে পারছি না। রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের জায়গা থেকে সমাজের ও মানুষের প্রত্যাশিত পরিবর্তনের ক্ষেত্রগুলো নির্ধারণ করা সঠিকভাবে সম্ভব হচ্ছে না। সবাই নিজের স্বার্থের মিছিলে এগিয়ে থাকছে, তবে ব্যতিক্রম আছে, তা সংখ্যায় অল্প। আমাদের সমাজ জীবন ও পরস্পর পরিচর্যার আকাশে ঘন মেঘ পুঞ্জীভূত। প্রচণ্ড দমকা বাতাস আর ঝড়ের অপেক্ষায়। মেঘ হলে বৃষ্টি হয়, কেটে যায় অস্বস্তির অপ্রত্যাশিত কষ্ট। সমাজের নিয়মের ক্ষেত্রেও তাই। সংকটই সম্ভাবনার সুযোগ সৃষ্টি করে। তবে সেই সুযোগ অনুভব করার মতো ক্ষমতা ও মানসিকতা থাকা চাই। দক্ষিণা বাতাসের উপস্থিতি শরীরজুড়ে শীতল প্রলেপ জাগিয়ে তোলে। মানুষের আরামের অন্দরে সংযোজন ঘটায় নতুন উপকরণের। প্রকৃতিলব্ধ নিয়মের ব্যাখ্যায়নে মানুষের জীবন ও বসবাসের ঠিকানায় সমাজের রূপান্তর প্রয়োজন। একা হেঁটে অনেক দূরে যাওয়া যায়, দ্রুত হাঁটাও যায়। কিন্তু সমষ্টিগত বসবাসে হাঁটার মধ্যে ছন্দের উপস্থিতি অপরিহার্য। যা সমাজে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে, মানুষকে বিদ্রোহী করে মানুষের প্রয়োজনে এবং মানুষ দাম দিতে শেখে মানুষের।
সমাজব্যবস্থার রূপান্তর ব্যতীত আমরা যা যা চাই, তার কোনো কিছুই আমাদের কাছে ধরা দেবে না। মানুষগুলোকেই তৈরি করতে হবে, এগিয়ে যাওয়ার জন্য সম্ভাবনার সুযোগ সৃষ্টিতে প্রস্তুত মানুষের খুব দরকার। সামাজিক ক্ষেত্রগুলোতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং রাষ্ট্রের শিক্ষণ ও সেবার জায়গায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের আদর্শিক অবস্থান ও ন্যায়পরায়ণতার শাসনে নিজেদের শাসন করার মানসিকতা থাকা চাই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন আসবে। তবে পরিকল্পিত পরিবর্তন জীবনের সঙ্গে একনিষ্ঠ করতে না পারলে সামাজিক সংকট লেগেই থাকবে। মানুষ বিরুদ্ধাচরণ করবে মানুষের, নিয়মের এবং এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রসিদ্ধ রীতির। এর থেকে মুক্তি চাই, বেরিয়ে আসতে চাই। প্রয়োজন নিজেদের সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাসগত ঐতিহ্যে নিজেদের প্রস্তুত করা। আদর্শিক কাঠামো ও পরস্পর সহযোগিতার পরিবেশ আমাদের আরও উন্নত জীবনের বাস্তবিক ঠিকানায় পৌঁছে দেবে এবং মানুষ খুঁজে পাবে স্বাচ্ছন্দ্যে ভরপুর এক সংগীতময় জীবন। যেখানে প্রতিযোগিতার বিপরীতে সহযোগিতা-সহমর্মিতার পতাকা বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়বে। এ জীবন বাঙালির, এ জীবন বাংলাদেশের।
তৌহিদুল হক
কবি ও সহকারী অধ্যাপক, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪