এম আবদুল আলীম
পাবনা নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে সবার ভাবনায় প্রথমেই আসে হিমাইতপুরের মানসিক হাসপাতালের কথা। পাবনা কি তাহলে মানসিক রোগীদের জেলা? এককথায় উত্তর, না। সত্য হচ্ছে, পাবনার হিমাইতপুরের মানসিক হাসপাতাল দেশ-বিদেশের মানসিক রোগীদের সেবার জন্যই খ্যাতি অর্জন করেছে।
ঠিক কবে এ ভূখণ্ডে মানববসতি গড়ে উঠেছিল, তার দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। বিভিন্ন সময়ে পাবনা অঞ্চল শাসিত হয়েছে মৌর্য, পাল, সেন, মুসলমান, ইংরেজ ও পাকিস্তানি শাসকদের দ্বারা।
বর্তমানে পাবনা স্বাধীন বাংলাদেশের একটি জেলা, যা গঠিত হয়েছে এগারোটি থানা নিয়ে। এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি, চাকরিজীবী, নাপিত, কলু, ধোপা, চর্মকারসহ বহু বিচিত্র পেশার মানুষ বাস করে এখানে।
এ মাটিতে জন্মেছেন অনেক খ্যাতিমান মানুষ। এর মধ্যে রয়েছেন ভীম ওঝা, বাঙাল ওঝা, জটাধর নাগ, কালাকৃষ্ণ দাস, প্রমথ চৌধুরী, ব্যারিস্টার আশুতোষ চৌধুরী, শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র, ক্ষেপুউল্লাহ বয়াতি, বন্দে আলী মিয়া, আবদুল গনি হাজারী, সরদার জয়েন উদ্দীন, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, স্যামসন এইচ চৌধুরী, ওমর আলী, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার, আব্দুর রব বগা মিয়া, আমজাদ হোসেন, ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রমুখ। কৃষক বিদ্রোহের নেতা ছালু সরকার ও বাজু সরকার, জমিদার আজিম চৌধুরী, বিজয় গোবিন্দ চৌধুরী, রায় বাহাদুর বনমালী রায়, নারীনেত্রী সেলিনা বানু, ভাষাসংগ্রামী আব্দুল মতিন, ডা. সাঈদ হায়দার, রণেশ মৈত্র, শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. ফজলে রাব্বি প্রমুখ এ মাটিরই তেজোদীপ্ত সন্তান।
পাবনা জেলা দীর্ঘকালের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বুকে ধারণ করে আছে। এর উন্মুক্ত আকাশ, বিস্তীর্ণ মাঠ, নির্মল বাতাস, সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি, পদ্মা-যমুনা-ইছামতী-আত্রাই-চিকনাই নদীর ঢেউয়ের কলতাল, পাখিদের সুর, মাঠ-প্রান্তরে কিষান-মজুর-বাউলের মনমাতানো গান, মন্দিরে শঙ্খ আর কীর্তনের ধ্বনি, মসজিদে আজানের সুর, গির্জার ঘণ্টাধ্বনি—এককথায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের লীলাভূমি পাবনা। ১৮৭৬ সালে পাবনা পৌরসভা গঠিত হয়। এখানে জজকোর্ট স্থাপিত হয় ১৮৭৯ সালে। ক্রমে গড়ে ওঠে সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান, দালানকোঠা, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, বিপণি, রাস্তাঘাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। স্বাধীন বাংলাদেশে এ অগ্রগতি বহু গুণে বেড়েছে।
পাবনার মানুষ চিরকাল অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। এখানকার প্রজা বিদ্রোহ, সলঙ্গা বিদ্রোহ, ভুট্টা আন্দোলন ইতিহাসে বিশেষ স্থান লাভ করেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলনে পাবনার মানুষ বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ মাধ্যমে যে গণহত্যার সূচনা করেছিল পাকিস্তানিরা, তাদের প্রতিহতে পাবনার বীর জনতা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে অগণিত মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে পাবনার মাটি। স্বাধীন বাংলাদেশেও বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় আন্দোলনে এ অঞ্চলের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে।
দুই.
পদ্মা-যমুনার উর্বর পলিতে গড়া পাবনা ইতিহাসের নানা উপাদানে সমৃদ্ধ। মসজিদ-মন্দির, দেব-দেবীর বিগ্রহ, ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্থাপনা—এখানকার অতীত গৌরবের সাক্ষ্য বহন করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, লালন শাহ সেতু, জোড়বাংলা মন্দির, জজকোর্ট, মানসিক হাসপাতাল, এডওয়ার্ড কলেজ, ক্যাডেট কলেজ, ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি, বনমালী ইনস্টিটিউট ও শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আশ্রম। স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম বড় ওষুধ কোম্পানি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস পাবনাতেই অবস্থিত। এখানকার ঘি, তাঁতের শাড়ি, গেঞ্জি, লুঙ্গি, গামছা সারা দেশে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এ ছাড়া নানা পুরাকীর্তি, অধুনা প্রতিষ্ঠিত পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা মেডিকেল কলেজ পাবনা জেলার গৌরবকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এগুলোর সঙ্গে বর্তমান সরকার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, ঈশ্বরদী-ঢালার চর রেললাইন স্থাপন, মেরিন একাডেমি প্রতিষ্ঠাসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণ করে পাবনাকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিচ্ছে।
শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দিক থেকেও পাবনা জেলা পিছিয়ে নেই। তাঁত, হোসিয়ারি, বিড়ি, সাবান, মৃৎ, বাঁশ, বেত, কবিরাজি ও হেকিমি ওষুধ, কাঠের আসবাব প্রভৃতি কুটির শিল্প পাবনা জেলায় রয়েছে। ইংরেজ আমলে এ জেলার বিভিন্ন গ্রামে শোলার টুপি তৈরি হতো। সেগুলো কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন বাজারে চালান হতো এবং পাবনার মানুষ প্রচুর অর্থ উপার্জন করত। তাঁতশিল্পে পাবনা অঞ্চল বহুকাল ধরেই সুনাম ও যশের অধিকারী। শিবরামপুর, জালালপুর, দোগাছি, বেড়া, ছেঁচানিয়া, সাঁথিয়া, বরাট প্রভৃতি স্থানে অতি চমৎকার লুঙ্গি ও মনভোলানো শাড়ি প্রস্তুত হয়। রয়েছে বড় বড় শিল্পকারখানাও। আলহাজ টেক্সটাইল মিল, নর্থ বেঙ্গল পেপার মিল, ক্যালিকো কটন মিল (বর্তমানে বন্ধ), স্কয়ার গ্রুপ, এডরুক লিমিটেড, ইউনিভার্সাল ফুড লিমিটেড, বেঙ্গল মিট ইত্যাদি শিল্পপ্রতিষ্ঠান দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে।
এখানকার যোগাযোগব্যবস্থা বেশ উন্নত। অধিকাংশ স্থানে পাকা রাস্তা ও মেঠোপথ নির্মিত হয়েছে। রেলপথ ও নৌপথও রয়েছে। ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন সারা দেশে বিশেষভাবে পরিচিত। বর্ষাকালে নদীপথে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করা যায়। বঙ্গবন্ধু সেতু ও লালন শাহ সেতু পাবনা জেলার যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে বড় পরিবর্তন এনেছে। ১৯৬১ সালে ঈশ্বরদীতে একটি বিমানবন্দর নির্মিত হলেও বর্তমানে তা বন্ধ রয়েছে। এই বিমানবন্দর পুনরায় চালু করা গেলে তা এ জেলার সার্বিক উন্নয়নে বড় প্রভাব রাখবে।
তিন.
বর্তমান সরকার পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এ অঞ্চলের উন্নয়নে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। একে কেন্দ্র করে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা নব সাজে সজ্জিত হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পাবনা, তথা পুরো বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নবদিগন্তের দ্বার উন্মোচিত হবে।
পাবনার যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে বেশ কয়েকটি প্রকল্প চলমান। বাস্তবায়ন হওয়া গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর মধ্যে ঈশ্বরদী থেকে ঢালারচর পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প উল্লেখযোগ্য। ২০১৮ সালে নবনির্মিত এই রেলপথ দিয়ে রেল চলাচল শুরু হয়।
পাবনায় স্থাপিত হয়েছে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে পাবনার শিক্ষাঙ্গনে বড় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির ২২টি বিভাগে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও সামনে এগিয়ে নিতে চলছে নানা উন্নয়নকাজ।
দেশের অন্য আর দশটি জেলার মতো পাবনাও কৃষিপ্রধান। বিভিন্ন ধরনের উচ্চফলনশীল জাতের কারণে জেলার সার্বিক কৃষির উন্নয়ন হয়েছে। মাছ, গবাদিপশু ও মুরগি পালনের দিকেও আগের চেয়ে ঝোঁক বেড়েছে জেলার কৃষকদের। ঈশ্বরদী অঞ্চলে উৎপাদিত লিচু, কুল ও সবজি দেশের চাহিদা পূরণ করে এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। উন্নত হয়েছে চিকিৎসাসহ অন্য সেবা খাতেরও।
সংকট যে নেই, তা নয়। তবে এসব সংকট সমাধানের উপায় রয়েছে আমাদের হাতেই। আর সেদিকেই এখন নজর দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ইছামতী নদীর খননকাজের কথা উল্লেখ করা যায়। ইছামতী তার আগের রূপে ফিরলে তা শুধু পাবনার নয়, এ অববাহিকার চারপাশের সব জনপদের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। নৌ, সড়ক ও রেল যোগাযোগব্যবস্থার যে উন্নয়ন হয়েছে, তার সুফল এরই মধ্যে ভোগ করছে পাবনাবাসী। সঙ্গে পুরোনো বিমানবন্দরটি আবার চালু করলে স্থানীয় কৃষক ও উদ্যোক্তাদের জন্য তা আশীর্বাদ হয়ে উঠবে। সেদিকে নিশ্চয় আমরা নজর দেব। কারণ, এটি গোটা দেশের অর্থনীতির চাকাতেই শক্তি জোগাবে।
এম আবদুল আলীম
শিক্ষক,পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
পাবনা নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে সবার ভাবনায় প্রথমেই আসে হিমাইতপুরের মানসিক হাসপাতালের কথা। পাবনা কি তাহলে মানসিক রোগীদের জেলা? এককথায় উত্তর, না। সত্য হচ্ছে, পাবনার হিমাইতপুরের মানসিক হাসপাতাল দেশ-বিদেশের মানসিক রোগীদের সেবার জন্যই খ্যাতি অর্জন করেছে।
ঠিক কবে এ ভূখণ্ডে মানববসতি গড়ে উঠেছিল, তার দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। বিভিন্ন সময়ে পাবনা অঞ্চল শাসিত হয়েছে মৌর্য, পাল, সেন, মুসলমান, ইংরেজ ও পাকিস্তানি শাসকদের দ্বারা।
বর্তমানে পাবনা স্বাধীন বাংলাদেশের একটি জেলা, যা গঠিত হয়েছে এগারোটি থানা নিয়ে। এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি, চাকরিজীবী, নাপিত, কলু, ধোপা, চর্মকারসহ বহু বিচিত্র পেশার মানুষ বাস করে এখানে।
এ মাটিতে জন্মেছেন অনেক খ্যাতিমান মানুষ। এর মধ্যে রয়েছেন ভীম ওঝা, বাঙাল ওঝা, জটাধর নাগ, কালাকৃষ্ণ দাস, প্রমথ চৌধুরী, ব্যারিস্টার আশুতোষ চৌধুরী, শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র, ক্ষেপুউল্লাহ বয়াতি, বন্দে আলী মিয়া, আবদুল গনি হাজারী, সরদার জয়েন উদ্দীন, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, স্যামসন এইচ চৌধুরী, ওমর আলী, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার, আব্দুর রব বগা মিয়া, আমজাদ হোসেন, ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রমুখ। কৃষক বিদ্রোহের নেতা ছালু সরকার ও বাজু সরকার, জমিদার আজিম চৌধুরী, বিজয় গোবিন্দ চৌধুরী, রায় বাহাদুর বনমালী রায়, নারীনেত্রী সেলিনা বানু, ভাষাসংগ্রামী আব্দুল মতিন, ডা. সাঈদ হায়দার, রণেশ মৈত্র, শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. ফজলে রাব্বি প্রমুখ এ মাটিরই তেজোদীপ্ত সন্তান।
পাবনা জেলা দীর্ঘকালের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বুকে ধারণ করে আছে। এর উন্মুক্ত আকাশ, বিস্তীর্ণ মাঠ, নির্মল বাতাস, সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি, পদ্মা-যমুনা-ইছামতী-আত্রাই-চিকনাই নদীর ঢেউয়ের কলতাল, পাখিদের সুর, মাঠ-প্রান্তরে কিষান-মজুর-বাউলের মনমাতানো গান, মন্দিরে শঙ্খ আর কীর্তনের ধ্বনি, মসজিদে আজানের সুর, গির্জার ঘণ্টাধ্বনি—এককথায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের লীলাভূমি পাবনা। ১৮৭৬ সালে পাবনা পৌরসভা গঠিত হয়। এখানে জজকোর্ট স্থাপিত হয় ১৮৭৯ সালে। ক্রমে গড়ে ওঠে সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান, দালানকোঠা, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, বিপণি, রাস্তাঘাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। স্বাধীন বাংলাদেশে এ অগ্রগতি বহু গুণে বেড়েছে।
পাবনার মানুষ চিরকাল অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। এখানকার প্রজা বিদ্রোহ, সলঙ্গা বিদ্রোহ, ভুট্টা আন্দোলন ইতিহাসে বিশেষ স্থান লাভ করেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলনে পাবনার মানুষ বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ মাধ্যমে যে গণহত্যার সূচনা করেছিল পাকিস্তানিরা, তাদের প্রতিহতে পাবনার বীর জনতা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে অগণিত মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে পাবনার মাটি। স্বাধীন বাংলাদেশেও বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় আন্দোলনে এ অঞ্চলের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে।
দুই.
পদ্মা-যমুনার উর্বর পলিতে গড়া পাবনা ইতিহাসের নানা উপাদানে সমৃদ্ধ। মসজিদ-মন্দির, দেব-দেবীর বিগ্রহ, ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্থাপনা—এখানকার অতীত গৌরবের সাক্ষ্য বহন করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, লালন শাহ সেতু, জোড়বাংলা মন্দির, জজকোর্ট, মানসিক হাসপাতাল, এডওয়ার্ড কলেজ, ক্যাডেট কলেজ, ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি, বনমালী ইনস্টিটিউট ও শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আশ্রম। স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম বড় ওষুধ কোম্পানি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস পাবনাতেই অবস্থিত। এখানকার ঘি, তাঁতের শাড়ি, গেঞ্জি, লুঙ্গি, গামছা সারা দেশে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এ ছাড়া নানা পুরাকীর্তি, অধুনা প্রতিষ্ঠিত পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা মেডিকেল কলেজ পাবনা জেলার গৌরবকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এগুলোর সঙ্গে বর্তমান সরকার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, ঈশ্বরদী-ঢালার চর রেললাইন স্থাপন, মেরিন একাডেমি প্রতিষ্ঠাসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণ করে পাবনাকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিচ্ছে।
শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দিক থেকেও পাবনা জেলা পিছিয়ে নেই। তাঁত, হোসিয়ারি, বিড়ি, সাবান, মৃৎ, বাঁশ, বেত, কবিরাজি ও হেকিমি ওষুধ, কাঠের আসবাব প্রভৃতি কুটির শিল্প পাবনা জেলায় রয়েছে। ইংরেজ আমলে এ জেলার বিভিন্ন গ্রামে শোলার টুপি তৈরি হতো। সেগুলো কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন বাজারে চালান হতো এবং পাবনার মানুষ প্রচুর অর্থ উপার্জন করত। তাঁতশিল্পে পাবনা অঞ্চল বহুকাল ধরেই সুনাম ও যশের অধিকারী। শিবরামপুর, জালালপুর, দোগাছি, বেড়া, ছেঁচানিয়া, সাঁথিয়া, বরাট প্রভৃতি স্থানে অতি চমৎকার লুঙ্গি ও মনভোলানো শাড়ি প্রস্তুত হয়। রয়েছে বড় বড় শিল্পকারখানাও। আলহাজ টেক্সটাইল মিল, নর্থ বেঙ্গল পেপার মিল, ক্যালিকো কটন মিল (বর্তমানে বন্ধ), স্কয়ার গ্রুপ, এডরুক লিমিটেড, ইউনিভার্সাল ফুড লিমিটেড, বেঙ্গল মিট ইত্যাদি শিল্পপ্রতিষ্ঠান দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে।
এখানকার যোগাযোগব্যবস্থা বেশ উন্নত। অধিকাংশ স্থানে পাকা রাস্তা ও মেঠোপথ নির্মিত হয়েছে। রেলপথ ও নৌপথও রয়েছে। ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন সারা দেশে বিশেষভাবে পরিচিত। বর্ষাকালে নদীপথে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করা যায়। বঙ্গবন্ধু সেতু ও লালন শাহ সেতু পাবনা জেলার যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে বড় পরিবর্তন এনেছে। ১৯৬১ সালে ঈশ্বরদীতে একটি বিমানবন্দর নির্মিত হলেও বর্তমানে তা বন্ধ রয়েছে। এই বিমানবন্দর পুনরায় চালু করা গেলে তা এ জেলার সার্বিক উন্নয়নে বড় প্রভাব রাখবে।
তিন.
বর্তমান সরকার পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এ অঞ্চলের উন্নয়নে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। একে কেন্দ্র করে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা নব সাজে সজ্জিত হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পাবনা, তথা পুরো বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নবদিগন্তের দ্বার উন্মোচিত হবে।
পাবনার যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে বেশ কয়েকটি প্রকল্প চলমান। বাস্তবায়ন হওয়া গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর মধ্যে ঈশ্বরদী থেকে ঢালারচর পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প উল্লেখযোগ্য। ২০১৮ সালে নবনির্মিত এই রেলপথ দিয়ে রেল চলাচল শুরু হয়।
পাবনায় স্থাপিত হয়েছে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে পাবনার শিক্ষাঙ্গনে বড় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির ২২টি বিভাগে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও সামনে এগিয়ে নিতে চলছে নানা উন্নয়নকাজ।
দেশের অন্য আর দশটি জেলার মতো পাবনাও কৃষিপ্রধান। বিভিন্ন ধরনের উচ্চফলনশীল জাতের কারণে জেলার সার্বিক কৃষির উন্নয়ন হয়েছে। মাছ, গবাদিপশু ও মুরগি পালনের দিকেও আগের চেয়ে ঝোঁক বেড়েছে জেলার কৃষকদের। ঈশ্বরদী অঞ্চলে উৎপাদিত লিচু, কুল ও সবজি দেশের চাহিদা পূরণ করে এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। উন্নত হয়েছে চিকিৎসাসহ অন্য সেবা খাতেরও।
সংকট যে নেই, তা নয়। তবে এসব সংকট সমাধানের উপায় রয়েছে আমাদের হাতেই। আর সেদিকেই এখন নজর দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ইছামতী নদীর খননকাজের কথা উল্লেখ করা যায়। ইছামতী তার আগের রূপে ফিরলে তা শুধু পাবনার নয়, এ অববাহিকার চারপাশের সব জনপদের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। নৌ, সড়ক ও রেল যোগাযোগব্যবস্থার যে উন্নয়ন হয়েছে, তার সুফল এরই মধ্যে ভোগ করছে পাবনাবাসী। সঙ্গে পুরোনো বিমানবন্দরটি আবার চালু করলে স্থানীয় কৃষক ও উদ্যোক্তাদের জন্য তা আশীর্বাদ হয়ে উঠবে। সেদিকে নিশ্চয় আমরা নজর দেব। কারণ, এটি গোটা দেশের অর্থনীতির চাকাতেই শক্তি জোগাবে।
এম আবদুল আলীম
শিক্ষক,পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪