ড. বনানী বিশ্বাস
আমাদের আলোচনা কিংবা চিন্তাবলয়ে ‘জেন্ডার সমতা’, ‘উচ্চশিক্ষায় নারী’ কিংবা ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ বিষয়গুলোর উপস্থিতি জানান দেয় আমাদের সমাজব্যবস্থা জেন্ডার-নিরপেক্ষ নয়। প্রকৃতি প্রদত্ত পৃথিবীতে নারী-পুরুষের সুষম বণ্টন হলেও মনুষ্যসমাজ তৈরি করেছে লিঙ্গভিত্তিক রীতিনীতি ও মতাদর্শ, যা বিমূর্ত ঈশ্বরকেও দিয়েছে লৈঙ্গিক পরিচয়। নারীর পূর্ণবিকাশে তাই রাষ্ট্র এবং সমাজের ভূমিকা নিরীক্ষাসাপেক্ষ বিষয়।
এ কথা অনস্বীকার্য যে স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশে নারীর অগ্রযাত্রা ঈর্ষণীয়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদন ২০২০-এ উঠে এসেছে লিঙ্গবৈষম্য নিরসনে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতির পুনর্গঠনে নারীর ক্ষমতায়নের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে দূরদর্শী দার্শনিক তথা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৭ সালে মহিলা লীগ প্রতিষ্ঠা করেন, যা রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ সুগম করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বত্র নারীর সমঅধিকার নিশ্চিত করা হয়। সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদে নারী ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে রাষ্ট্রের বিশেষ বিধান প্রণয়নের ক্ষমতাও সংযোজন করা হয়। শিক্ষায় নারীর শতভাগ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা, নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করা, আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নারীদের সুরক্ষা প্রদান ও অধিকার নিশ্চিত করা এবং রাজনীতিতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে সরকার কর্তৃক গৃহীত নানামুখী কর্মপরিকল্পনায় প্রতীয়মান হয় যে নারী-পুরুষের সমতা বর্তমান রাষ্ট্রের একটি অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। নারীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি, স্বতন্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসন, জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে সরকারি বিভিন্ন চাকরিতে কোটা সংরক্ষণ, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন, পারিবারিক আইন এবং ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের মতো উদ্যোগসমূহ সমাজকে নারী অংশগ্রহণমূলক করে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে। বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নারীশিক্ষার হার পুরুষের সমান, যা ১৯৭১ সালে ছিল ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্র এত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা সত্ত্বেও উচ্চশিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ কেন হতাশাব্যঞ্জক? কেন সমাজে নারীর প্রতি এত ঘৃণা ও সহিংসতা? তবে কি নারী প্রসঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজের অবস্থান বিপরীতমুখী?
একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে নারী প্রশ্নে আমাদের সমাজ মূলত দ্বিধাবিভক্ত। নারীর বিষয়ে সমাজ কখনো আদর্শিকভাবে মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেনি। অজ্ঞতা, উদারপন্থী দার্শনিক চিন্তাভাবনার অনুপস্থিতি এবং ধর্মীয় অপব্যাখ্যাসহ সঠিক ধর্মজ্ঞানের অপ্রতুলতার সঙ্গে প্রতিহিংসার রাজনীতির মিশেলে তৈরি হয়েছে সমাজের ভেতর আরেক সমাজ, যা অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল। এই শক্তি মানুষের মনোজগতে এতটাই ক্রিয়াশীল যে রাষ্ট্র যেন অসহায়। সে বিবেচনায় নারী প্রশ্নে আদর্শিক দ্বন্দ্বের এক প্রান্তে রয়েছে রাষ্ট্র ও সুস্থ সমাজ ও অন্য প্রান্তে রয়েছে একটি অপশক্তি, যা ধর্মীয় অজ্ঞতা ও অপব্যাখ্যাকে হাতিয়ার করে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে নারীর। আর নারীর বড় পরাজয় ঘটেছে তখনই, যখন সে সামাজিকীকরণের মাধ্যমে নিজেই নিজের অবদমনের অংশ হয়ে পড়েছে। অচেতন মনটিই যেন তার চেতনাজুড়ে। নিজেকে আবিষ্কার করা কিংবা ‘নিজ’ হয়ে ওঠার বিষয়টি কখনো অনুভূত হয়নি তার। নিজ সত্তার বাইরে সমাজে তার বাস। অস্তিত্বহীনতাই তার অস্তিত্ব!
লৈঙ্গিক দৃষ্টিভঙ্গির স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়াটি সমাজজাত। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য সাধারণত ২০-৩০ বছর বয়সকাল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জীবিকার উৎস নিশ্চিতকরণ, বিবাহ ও সন্তান জন্মদানের মতো সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার তাগিদ থাকে সবার। তবে এই সময়ে যেখানে একজন পুরুষ উচ্চশিক্ষার পাট চুকিয়ে চাকরির তুমুল প্রতিযোগিতমূলক বাজারে লড়াই করে, সেখানে একজন নারী সংগ্রাম করে নতুন পরিবারে মানিয়ে নিয়ে ৩০ বছরের মধ্যে নিদেনপক্ষে দুটি সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে। কোনো কারণে সন্তান জন্মদানে ব্যর্থ হলে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যতিরেকে নারীর বয়সকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয় প্রথমে। স্নাতক পর্যায়ে অধ্যয়নরত একটি মেয়ের বাবা-মায়ের প্রধান লক্ষ্য থাকে মেয়েটিকে পাত্রস্থ করা। এক অদৃশ্য ভয়ে তাঁরা সর্বদা থাকেন আতঙ্কিত। প্রতিদিন সুস্থ শরীরে মেয়ে ঘরে ফিরলে তাঁরা যেন একটি দিন বেঁচে যান। উচ্চশিক্ষা শেষ হতে না–হতে কেবল অধিকাংশ মেয়ের বিয়েই হয় না, এই বিয়ে বিষয়টি এতটাই অমোঘ যে একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মেয়ের বিয়ে হতে দেখা যায় পরীক্ষার মধ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার কল্যাণে দেখেছি প্রায় প্রতিটি সমাপনী পরীক্ষার আগে একঝাঁক বন্ধুবৎসল মুখ দরজায় কড়া নাড়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষার দাবি নিয়ে, যাতে তাদের বন্ধুর সন্তান জন্মদান নির্বিঘ্ন হয়। আর যেখানে সেই দাবি জানানোর সুযোগ নেই? ধরা যাক আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই জীবন বড় হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মেয়ে শিক্ষার্থীর রয়েছে একাধিক সন্তান। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষার মতো একাগ্র ও শ্রমনিষ্ঠ বিষয়টি তাদের সে স্বাভাবিক জীবনে এতটুকু ছন্দপাত ঘটাতে পারেনি। যখন পরিণত গর্ভাবস্থা আলগা কাপড়ে ঢেকে একজন শিক্ষার্থী অটোরিকশা করে কিংবা দৌড়ঝাঁপ করে সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিংবা বাস ধরে, রুদ্ধশ্বাসে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে শীতকালেও গলদঘর্ম হয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত কণ্ঠে আরজি জানায়, তখন আমার ভেতরে যেন কী হয়। সেটি রাগ, ক্ষোভ নাকি দুঃখ–এখনো সংজ্ঞায়িত করতে পারিনি। হয়তো সবকিছুর সংমিশ্রণ, যা এক হয়ে চোখ ভিজিয়ে দেয়। প্রশ্নের উত্তর ফেলে বলি, ‘তুমি বসো। পানি খাবে?’ যাঁরা ভাবতে পারছেন পড়াশোনার পাশাপাশি বাচ্চা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বোঝাপড়ার বিষয়, তাঁরা সমাজের সেই স্বাভাবিক মানুষ। আমার কাছে এটি চরম অমানবিকতার নিদর্শন। মেয়েটির চেহারার দিকে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়। কখনো কখনো ব্যথিতচিত্তে সাহস করে বলেছি, ‘থিসিস করার সময়টা অপেক্ষা করতে পারতে।’ কয়েকজন স্বামীর বয়স কিংবা দূরবাসের কথা বললেও অধিকাংশের কাছ থেকে পেয়েছি এক ভয়ানক বার্তা। বিয়ের পরে মা হতে হবে এটাই স্বাভাবিক। অন্য কোনো ভাবনা কস্মিনকালেও তাদের মনের কোণে আবির্ভূত হয়নি। যখন অন্য বন্ধুরা রাত জেগে পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করে, তার কাছে তখন ২৪ ঘণ্টাই দিন! কখনো কখনো পত্রপত্রিকায় সগর্বে বলতে শোনা যায় ভোররাতে সন্তান জন্ম দিয়ে সকালে পরীক্ষা দেওয়া মেয়েটি এখন বিসিএস ক্যাডার। মেয়েটির সফলতায় গর্ববোধ করেছেন বলে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু একবারও ভেবেছেন তাঁর সংগ্রামের কথা? সমাজের এই মনোভাব মিশেল ফুঁকোর উল্লেখিত সেই পশ্চিমা ডিসকোর্সের কথাই মনে করিয়ে দেয় যে ‘কালোরা’ প্রসব করে ঘোড়ার মতো সোজা কোনো গোঙানি ছাড়া। ব্যথা বোঝার কেউ না থাকলে কি ব্যথা হয়? তা ছাড়া সন্তান জন্মদানের আনন্দ তো সব ব্যথাই ভুলিয়ে দেয়। শরীর আর মনের দ্বন্দ্ব বাধিয়ে লাভ কী! মেয়ের শরীর তো কখনোই তার নিজের নয়। তবে কি হয় উচ্চশিক্ষা নাহয় সন্তান জন্মদান? জীবনের এই অতিগুরুত্বপূর্ণ কার্যগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য প্রয়োজন একটু সহানুভূতি আর চিন্তাপ্রসূত সঠিক একটি পরিকল্পনা। নিজের প্রয়োজন কিংবা ভালো লাগা বুঝে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সমাজে নয়; ব্যক্তির কাছে থাকা প্রয়োজন। আর এর থেকেও বেশি প্রয়োজন নিজেকে সঠিকভাবে বুঝতে পারার মতো জেন্ডার-নিরপেক্ষ সামাজিকীকরণ। জেন্ডার-নিরপেক্ষতা বলতে কেবল নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবার সমানাধিকারকে বোঝায় না, বরং লিঙ্গনির্দিষ্ট সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণকে বোঝায়। যে সমাজ নারীর মা হওয়াকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, সেই সমাজই একজন কর্মজীবী মাকে চোখে চোখে রেখেছে। সেই সমাজ একজন সন্তানসম্ভবা নারীকে চাকরি দেওয়ার আগে এক শবার ভেবেছে। আবার, উচ্চশিক্ষারত কিংবা কর্মজীবী মাকে ঘরে ফিরে ‘ভালো মা’ হওয়ার পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হতে হচ্ছে প্রতিদিন। উচ্চশিক্ষায় কিংবা কর্মক্ষেত্রে নারীর ঝরে পড়া এবং পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণাকে স্বাভাবিক বলে চালিয়ে নেওয়া তাই একই সূত্রে গাঁথা।
পরিশেষে, নারীর অগ্রযাত্রায় আধুনিক রাষ্ট্র যতটা সচেষ্ট, সমাজ ততটা হতে পারেনি এখনো। কিন্তু একটি সুন্দর জাতি গঠনের নিয়ামক হলো রাষ্ট্র ও সমাজের সমান্তরাল অভিযাত্রা। বারবার তাই রাষ্ট্রকেও হোঁচট খেতে দেখা যায়। সরকারের ‘নারী উন্নয়ন নীতিমালা’ তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের তাই বুঝতে হবে সমাজ পরিবর্তন করে নারীর পথচলাকে সুগম করতে করণীয় কী। এ ক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন মনোজাগতিক পরিবর্তন। আর সেই প্রক্রিয়াটি হাতে নেওয়ার সময় এখনই।
ড. বনানী বিশ্বাস
সহযোগী অধ্যাপক, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
আমাদের আলোচনা কিংবা চিন্তাবলয়ে ‘জেন্ডার সমতা’, ‘উচ্চশিক্ষায় নারী’ কিংবা ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ বিষয়গুলোর উপস্থিতি জানান দেয় আমাদের সমাজব্যবস্থা জেন্ডার-নিরপেক্ষ নয়। প্রকৃতি প্রদত্ত পৃথিবীতে নারী-পুরুষের সুষম বণ্টন হলেও মনুষ্যসমাজ তৈরি করেছে লিঙ্গভিত্তিক রীতিনীতি ও মতাদর্শ, যা বিমূর্ত ঈশ্বরকেও দিয়েছে লৈঙ্গিক পরিচয়। নারীর পূর্ণবিকাশে তাই রাষ্ট্র এবং সমাজের ভূমিকা নিরীক্ষাসাপেক্ষ বিষয়।
এ কথা অনস্বীকার্য যে স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশে নারীর অগ্রযাত্রা ঈর্ষণীয়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদন ২০২০-এ উঠে এসেছে লিঙ্গবৈষম্য নিরসনে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতির পুনর্গঠনে নারীর ক্ষমতায়নের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে দূরদর্শী দার্শনিক তথা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৭ সালে মহিলা লীগ প্রতিষ্ঠা করেন, যা রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ সুগম করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বত্র নারীর সমঅধিকার নিশ্চিত করা হয়। সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদে নারী ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে রাষ্ট্রের বিশেষ বিধান প্রণয়নের ক্ষমতাও সংযোজন করা হয়। শিক্ষায় নারীর শতভাগ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা, নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করা, আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নারীদের সুরক্ষা প্রদান ও অধিকার নিশ্চিত করা এবং রাজনীতিতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে সরকার কর্তৃক গৃহীত নানামুখী কর্মপরিকল্পনায় প্রতীয়মান হয় যে নারী-পুরুষের সমতা বর্তমান রাষ্ট্রের একটি অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। নারীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি, স্বতন্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসন, জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে সরকারি বিভিন্ন চাকরিতে কোটা সংরক্ষণ, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন, পারিবারিক আইন এবং ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের মতো উদ্যোগসমূহ সমাজকে নারী অংশগ্রহণমূলক করে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে। বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নারীশিক্ষার হার পুরুষের সমান, যা ১৯৭১ সালে ছিল ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্র এত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা সত্ত্বেও উচ্চশিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ কেন হতাশাব্যঞ্জক? কেন সমাজে নারীর প্রতি এত ঘৃণা ও সহিংসতা? তবে কি নারী প্রসঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজের অবস্থান বিপরীতমুখী?
একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে নারী প্রশ্নে আমাদের সমাজ মূলত দ্বিধাবিভক্ত। নারীর বিষয়ে সমাজ কখনো আদর্শিকভাবে মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেনি। অজ্ঞতা, উদারপন্থী দার্শনিক চিন্তাভাবনার অনুপস্থিতি এবং ধর্মীয় অপব্যাখ্যাসহ সঠিক ধর্মজ্ঞানের অপ্রতুলতার সঙ্গে প্রতিহিংসার রাজনীতির মিশেলে তৈরি হয়েছে সমাজের ভেতর আরেক সমাজ, যা অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল। এই শক্তি মানুষের মনোজগতে এতটাই ক্রিয়াশীল যে রাষ্ট্র যেন অসহায়। সে বিবেচনায় নারী প্রশ্নে আদর্শিক দ্বন্দ্বের এক প্রান্তে রয়েছে রাষ্ট্র ও সুস্থ সমাজ ও অন্য প্রান্তে রয়েছে একটি অপশক্তি, যা ধর্মীয় অজ্ঞতা ও অপব্যাখ্যাকে হাতিয়ার করে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে নারীর। আর নারীর বড় পরাজয় ঘটেছে তখনই, যখন সে সামাজিকীকরণের মাধ্যমে নিজেই নিজের অবদমনের অংশ হয়ে পড়েছে। অচেতন মনটিই যেন তার চেতনাজুড়ে। নিজেকে আবিষ্কার করা কিংবা ‘নিজ’ হয়ে ওঠার বিষয়টি কখনো অনুভূত হয়নি তার। নিজ সত্তার বাইরে সমাজে তার বাস। অস্তিত্বহীনতাই তার অস্তিত্ব!
লৈঙ্গিক দৃষ্টিভঙ্গির স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়াটি সমাজজাত। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য সাধারণত ২০-৩০ বছর বয়সকাল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জীবিকার উৎস নিশ্চিতকরণ, বিবাহ ও সন্তান জন্মদানের মতো সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার তাগিদ থাকে সবার। তবে এই সময়ে যেখানে একজন পুরুষ উচ্চশিক্ষার পাট চুকিয়ে চাকরির তুমুল প্রতিযোগিতমূলক বাজারে লড়াই করে, সেখানে একজন নারী সংগ্রাম করে নতুন পরিবারে মানিয়ে নিয়ে ৩০ বছরের মধ্যে নিদেনপক্ষে দুটি সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে। কোনো কারণে সন্তান জন্মদানে ব্যর্থ হলে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যতিরেকে নারীর বয়সকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয় প্রথমে। স্নাতক পর্যায়ে অধ্যয়নরত একটি মেয়ের বাবা-মায়ের প্রধান লক্ষ্য থাকে মেয়েটিকে পাত্রস্থ করা। এক অদৃশ্য ভয়ে তাঁরা সর্বদা থাকেন আতঙ্কিত। প্রতিদিন সুস্থ শরীরে মেয়ে ঘরে ফিরলে তাঁরা যেন একটি দিন বেঁচে যান। উচ্চশিক্ষা শেষ হতে না–হতে কেবল অধিকাংশ মেয়ের বিয়েই হয় না, এই বিয়ে বিষয়টি এতটাই অমোঘ যে একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মেয়ের বিয়ে হতে দেখা যায় পরীক্ষার মধ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার কল্যাণে দেখেছি প্রায় প্রতিটি সমাপনী পরীক্ষার আগে একঝাঁক বন্ধুবৎসল মুখ দরজায় কড়া নাড়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষার দাবি নিয়ে, যাতে তাদের বন্ধুর সন্তান জন্মদান নির্বিঘ্ন হয়। আর যেখানে সেই দাবি জানানোর সুযোগ নেই? ধরা যাক আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই জীবন বড় হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মেয়ে শিক্ষার্থীর রয়েছে একাধিক সন্তান। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষার মতো একাগ্র ও শ্রমনিষ্ঠ বিষয়টি তাদের সে স্বাভাবিক জীবনে এতটুকু ছন্দপাত ঘটাতে পারেনি। যখন পরিণত গর্ভাবস্থা আলগা কাপড়ে ঢেকে একজন শিক্ষার্থী অটোরিকশা করে কিংবা দৌড়ঝাঁপ করে সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিংবা বাস ধরে, রুদ্ধশ্বাসে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে শীতকালেও গলদঘর্ম হয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত কণ্ঠে আরজি জানায়, তখন আমার ভেতরে যেন কী হয়। সেটি রাগ, ক্ষোভ নাকি দুঃখ–এখনো সংজ্ঞায়িত করতে পারিনি। হয়তো সবকিছুর সংমিশ্রণ, যা এক হয়ে চোখ ভিজিয়ে দেয়। প্রশ্নের উত্তর ফেলে বলি, ‘তুমি বসো। পানি খাবে?’ যাঁরা ভাবতে পারছেন পড়াশোনার পাশাপাশি বাচ্চা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বোঝাপড়ার বিষয়, তাঁরা সমাজের সেই স্বাভাবিক মানুষ। আমার কাছে এটি চরম অমানবিকতার নিদর্শন। মেয়েটির চেহারার দিকে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়। কখনো কখনো ব্যথিতচিত্তে সাহস করে বলেছি, ‘থিসিস করার সময়টা অপেক্ষা করতে পারতে।’ কয়েকজন স্বামীর বয়স কিংবা দূরবাসের কথা বললেও অধিকাংশের কাছ থেকে পেয়েছি এক ভয়ানক বার্তা। বিয়ের পরে মা হতে হবে এটাই স্বাভাবিক। অন্য কোনো ভাবনা কস্মিনকালেও তাদের মনের কোণে আবির্ভূত হয়নি। যখন অন্য বন্ধুরা রাত জেগে পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করে, তার কাছে তখন ২৪ ঘণ্টাই দিন! কখনো কখনো পত্রপত্রিকায় সগর্বে বলতে শোনা যায় ভোররাতে সন্তান জন্ম দিয়ে সকালে পরীক্ষা দেওয়া মেয়েটি এখন বিসিএস ক্যাডার। মেয়েটির সফলতায় গর্ববোধ করেছেন বলে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু একবারও ভেবেছেন তাঁর সংগ্রামের কথা? সমাজের এই মনোভাব মিশেল ফুঁকোর উল্লেখিত সেই পশ্চিমা ডিসকোর্সের কথাই মনে করিয়ে দেয় যে ‘কালোরা’ প্রসব করে ঘোড়ার মতো সোজা কোনো গোঙানি ছাড়া। ব্যথা বোঝার কেউ না থাকলে কি ব্যথা হয়? তা ছাড়া সন্তান জন্মদানের আনন্দ তো সব ব্যথাই ভুলিয়ে দেয়। শরীর আর মনের দ্বন্দ্ব বাধিয়ে লাভ কী! মেয়ের শরীর তো কখনোই তার নিজের নয়। তবে কি হয় উচ্চশিক্ষা নাহয় সন্তান জন্মদান? জীবনের এই অতিগুরুত্বপূর্ণ কার্যগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য প্রয়োজন একটু সহানুভূতি আর চিন্তাপ্রসূত সঠিক একটি পরিকল্পনা। নিজের প্রয়োজন কিংবা ভালো লাগা বুঝে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সমাজে নয়; ব্যক্তির কাছে থাকা প্রয়োজন। আর এর থেকেও বেশি প্রয়োজন নিজেকে সঠিকভাবে বুঝতে পারার মতো জেন্ডার-নিরপেক্ষ সামাজিকীকরণ। জেন্ডার-নিরপেক্ষতা বলতে কেবল নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবার সমানাধিকারকে বোঝায় না, বরং লিঙ্গনির্দিষ্ট সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণকে বোঝায়। যে সমাজ নারীর মা হওয়াকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, সেই সমাজই একজন কর্মজীবী মাকে চোখে চোখে রেখেছে। সেই সমাজ একজন সন্তানসম্ভবা নারীকে চাকরি দেওয়ার আগে এক শবার ভেবেছে। আবার, উচ্চশিক্ষারত কিংবা কর্মজীবী মাকে ঘরে ফিরে ‘ভালো মা’ হওয়ার পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হতে হচ্ছে প্রতিদিন। উচ্চশিক্ষায় কিংবা কর্মক্ষেত্রে নারীর ঝরে পড়া এবং পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণাকে স্বাভাবিক বলে চালিয়ে নেওয়া তাই একই সূত্রে গাঁথা।
পরিশেষে, নারীর অগ্রযাত্রায় আধুনিক রাষ্ট্র যতটা সচেষ্ট, সমাজ ততটা হতে পারেনি এখনো। কিন্তু একটি সুন্দর জাতি গঠনের নিয়ামক হলো রাষ্ট্র ও সমাজের সমান্তরাল অভিযাত্রা। বারবার তাই রাষ্ট্রকেও হোঁচট খেতে দেখা যায়। সরকারের ‘নারী উন্নয়ন নীতিমালা’ তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের তাই বুঝতে হবে সমাজ পরিবর্তন করে নারীর পথচলাকে সুগম করতে করণীয় কী। এ ক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন মনোজাগতিক পরিবর্তন। আর সেই প্রক্রিয়াটি হাতে নেওয়ার সময় এখনই।
ড. বনানী বিশ্বাস
সহযোগী অধ্যাপক, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪