গৌতম রায়
শিক্ষা সামাজিক অগ্রগতির নির্দেশক হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষার পরিসর নির্ধারণ এবং শিক্ষাকে উন্নয়নের ধারার সঙ্গে সংযুক্ত করার বিষয়টি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী বিষয়াবলির সঙ্গে যুক্ত। পৃথিবীব্যাপী শিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রসমূহ একই সঙ্গে স্থানীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের শিক্ষার অগ্রগতির ইতিহাস ও কার্যক্রম তিনটি পর্যায়ে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে।
স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে যে কয়টি খাত তুলনামূলকভাবে গুরুত্ব পেয়েছিল, তার একটি হচ্ছে শিক্ষা। স্বাধীনতা-পূর্ব এই ভূখণ্ডে শিক্ষার প্রসারের জন্য ব্রিটিশরা সময়ে সময়ে শিক্ষা কমিশন ও শিক্ষানীতি তৈরি করে, মূলত তাদের ব্যবসায়িক সহযোগী হিসেবে একটি জনশক্তি গড়ে তোলার প্রয়াসে। সেখানে শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের অন্তর্নিহিত বিকাশের পথগুলো তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্ব পায়। একই ধারা চালু থাকে পাকিস্তান আমলেও। ১৯৪৭-এর পর থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী একাধিক শিক্ষা কমিশন গঠন করলেও সেগুলোর বৈষম্যমূলক সুপারিশ বাংলাদেশের মানুষের প্রতিবাদের কারণে বাস্তবায়িত হতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করেন এবং এই কমিশন ১৯৭৪ সালে তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। তৎকালীন বিশ্বপরিস্থিতি, জনগণের চাহিদা ও রাষ্ট্রীয় নীতির এক যুগোপযোগী প্রতিফলন দেখা যায় সেই কমিশনের সুপারিশগুলোতে। কিন্তু সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে সেসব সুপারিশকে অন্ধকারে পাঠানোর পাশাপাশি পরবর্তী সময়ে শিক্ষা বিষয়ে একাধিক জনবিরোধী সুপারিশ প্রণীত হয়।
স্বাধীনতার পরের এই প্রথম পর্যায়ের চার বছরে সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও কিছু সাহসী ভূমিকা গ্রহণ করা হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, সে সময় বাংলাদেশের প্রায় ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকার জাতীয়করণ করে, যার ফলে প্রাথমিক শিক্ষার পথ অনেকটাই সুগম হয়। অর্থনৈতিক বিবেচনায় এটি একটি সাহসী সিদ্ধান্ত ছিল। ওই চার বছরে বাংলাদেশের শিক্ষা নিয়ে যেসব সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতা দেখা গেছে, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে বর্তমানের বাংলাদেশ আরেকটু ভিন্ন অবস্থানে থাকত বলে অনুমান করা যায়।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে নানা রুটিন কার্যক্রম গ্রহণ করা হলেও সার্বিক অর্থে সেগুলো বড় আকারে প্রভাব ফেলতে পারেনি মূলত দুটো কারণে। প্রথমত, অধিকাংশ সিদ্ধান্তই কোনো গবেষণা ছাড়া শীর্ষ মহল থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়, যার সঙ্গে বাস্তবতার সংযোগ ছিল একেবারেই কম। যেমন—ড. খুদা কমিশনে যেভাবে জনমতের সহায়তায় ও তৎকালীন সম্পদ ব্যবহারের সক্ষমতা বিবেচনায় অগ্রগতির সুপারিশ করা হয়েছিল, সেসব প্রক্রিয়া পরবর্তী সময়ে থমকে যায় এবং নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে খেয়ালখুশিমতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মজিদ খান শিক্ষা কমিশন এ ক্ষেত্রে বড় উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। নব্বইয়ে স্বৈরাচার পতনের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের শিক্ষা বিষয়ে বড় ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেনি তৎকালীন সরকারগুলো। ফলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্র তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে এই সময়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
নব্বইয়ের পর থেকে বাংলাদেশের শিক্ষার অগ্রগতিকে তৃতীয় পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। বিশেষত বৈশ্বিক নানা অঙ্গীকারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় শিক্ষার অগ্রগতিকে সমন্বিত করে দেখার প্রয়াস এই পর্বে লক্ষণীয়। ১৯৯০ সালে থাইল্যান্ডের জমতিয়েনে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার যে আহ্বান জানানো হয়, বাংলাদেশে সেই কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর হয়। প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বিনা মূল্যে রূপান্তরিত করার সুফল পরবর্তী সময়ে দৃশ্যমান হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির হার বাড়ে, আস্তে আস্তে কমতে থাকে ঝরে পড়ার হার। ভর্তির ক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়ে প্রাথমিকে জেন্ডার সমতা অর্জিত হয় এবং পরবর্তী সময়ে মাধ্যমিকেও এই হার কাছাকাছি চলে আসে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য হচ্ছে, প্রাথমিকে ভর্তির হার শতভাগে উন্নীত হওয়া এবং জেন্ডার সমতা অর্জনের বিষয়টি বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ধরে রেখেছে, যা বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত। এই অগ্রগতির প্রভাব পরে মাধ্যমিক পর্যায়ে দৃশ্যমান হয়।
স্বাধীনতার প্রায় ৩০ বছর পর ড. খুদা কমিশনের প্রতিবেদন ও সুপারিশের তুলনায় সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও ২০০০ সালে প্রথম শিক্ষানীতি গৃহীত হয়; যদিও সেটির সুপারিশ ও কৌশলসমূহ রাজনৈতিক কারণে বাস্তবায়িত হতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে ২০১০ সালে ড. খুদা কমিশনকে ভিত্তি ধরে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ও বর্তমান শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও এর সব কৌশল এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এর কারণ হিসেবে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবকেই চিহ্নিত করা যায়। এটি ইতিমধ্যে প্রমাণিত যে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির প্রভাব শুধু শিক্ষা খাতেই দৃশ্যমান হয় না, একটি নির্দিষ্ট সময় পরে সেগুলো রাষ্ট্রের অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। তৃতীয় পর্যায়ের নানা সময়ে আমরা শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত যেসব উদ্যোগ দেখতে পেয়েছি, সেগুলোর প্রভাবই এখন বাংলাদেশে বিদ্যমান। সম্প্রতি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান রয়েছে।
তবে এ ক্ষেত্রে এটিও আলোচনার বিষয় যে শিক্ষার যেসব অগ্রগতি আজকে দৃশ্যমান, তার অধিকাংশই পরিমাণগত। প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই মানের ক্ষেত্রে প্রশ্ন রয়ে গেছে। সমস্যা এখনো বিদ্যমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সম্পদ ব্যবস্থাপনায়, দক্ষ শিক্ষক তৈরিতে এবং সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে। বর্তমানে নানা ধরনের অস্থিরতা ও নৈতিকতার অভাব যেভাবে দেখা যাচ্ছে, তাতে এটিই প্রতীয়মান হয় যে সুশিক্ষা পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে যথাক্রমে প্রান্তিক যোগ্যতা ও শিখনফল রয়েছে। গুণগত শিক্ষা অর্জন করা যাচ্ছে কি না, তার একটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে শিক্ষার্থী সেগুলো অর্জন করতে পারছে কি না তার ওপর। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই এই অর্জন থেকে অনেক দূরে। জেএসসি, এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও সত্যিকার অর্থে শিখন কতটুকু হচ্ছে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। নীতিগত কিছু বিষয়েও ঘাটতি রয়েছে আমাদের; নীতি বাস্তবায়নেও রয়েছে সমস্যা। উদাহরণস্বরূপ, কোভিড-১৯ অতিমারিতে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার অচলাবস্থা প্রমাণ করে দিয়েছে যে আমাদের দুর্যোগকালীন শিক্ষা নিয়ে কোনো নীতি নেই। অন্যদিকে, বর্তমান শিক্ষানীতি অনুসারে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করা বা কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার মতো অগ্রাধিকার বিষয়গুলো এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে এসব ঘাটতি নানাভাবে শিক্ষার মান অর্জনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে আছে গবেষণায়। বৈশ্বিক নানা সূচকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তেমন কোনো অবস্থান নেই। প্রশাসকদের দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধুঁকছে। বাণিজ্যিকীকরণও চলছে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে। রমরমায় রয়েছে নোট ও গাইড বইয়ের বাজার। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও যেসব বিষয়ে আমাদের দৃঢ় অবস্থানে থাকার প্রয়োজন ছিল, সেখানে উদাসীনতা রয়েছে।
এসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠা খুব কঠিন বিষয় নয়। সে ক্ষেত্রে প্রথমেই নজর দিতে হবে সরকার যেসব বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেগুলো দ্রুত ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ যেসব কৌশল গ্রহণ করেছে সরকার, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে অনেক বড় সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এর জন্য বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দও বাড়াতে হবে। শুধু শিক্ষার জন্য জাতীয় আয়ের ৪ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশ বরাদ্দ রাখতে হবে। এই বরাদ্দ যথাযথভাবে ব্যবহৃত হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেমন সম্পদের অভাব কাটিয়ে উঠতে পারবে, তেমনি শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ গুণগত মান বৃদ্ধির যেসব সূচক রয়েছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রায়োগিক কৌশল ব্যবহার করে সমস্যার দ্রুত সমাধান করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি প্রয়োজন শিক্ষাকে স্থানীয় রাজনৈতিক বলয় থেকে মুক্ত করার রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে একটি দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারে। পৃথিবীব্যাপী এ রকম অনেক উদাহরণ রয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। অগ্রগতির এই ধারা কখনো ধীর, কখনো দ্রুত। একই কথা প্রযোজ্য বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রেও। এত দিন যেভাবে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কাজ করা হয়েছে, তাতে পরিমাণগত উন্নয়ন হয়েছে প্রচুর। এখন সময় এসেছে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা। সে ক্ষেত্রেই কেবল টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, সম্ভব হবে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজেদের অবস্থান আরও জোরালো করা।
গৌতম রায়
সহকারী অধ্যাপক শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষা সামাজিক অগ্রগতির নির্দেশক হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষার পরিসর নির্ধারণ এবং শিক্ষাকে উন্নয়নের ধারার সঙ্গে সংযুক্ত করার বিষয়টি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী বিষয়াবলির সঙ্গে যুক্ত। পৃথিবীব্যাপী শিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রসমূহ একই সঙ্গে স্থানীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের শিক্ষার অগ্রগতির ইতিহাস ও কার্যক্রম তিনটি পর্যায়ে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে।
স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে যে কয়টি খাত তুলনামূলকভাবে গুরুত্ব পেয়েছিল, তার একটি হচ্ছে শিক্ষা। স্বাধীনতা-পূর্ব এই ভূখণ্ডে শিক্ষার প্রসারের জন্য ব্রিটিশরা সময়ে সময়ে শিক্ষা কমিশন ও শিক্ষানীতি তৈরি করে, মূলত তাদের ব্যবসায়িক সহযোগী হিসেবে একটি জনশক্তি গড়ে তোলার প্রয়াসে। সেখানে শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের অন্তর্নিহিত বিকাশের পথগুলো তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্ব পায়। একই ধারা চালু থাকে পাকিস্তান আমলেও। ১৯৪৭-এর পর থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী একাধিক শিক্ষা কমিশন গঠন করলেও সেগুলোর বৈষম্যমূলক সুপারিশ বাংলাদেশের মানুষের প্রতিবাদের কারণে বাস্তবায়িত হতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করেন এবং এই কমিশন ১৯৭৪ সালে তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। তৎকালীন বিশ্বপরিস্থিতি, জনগণের চাহিদা ও রাষ্ট্রীয় নীতির এক যুগোপযোগী প্রতিফলন দেখা যায় সেই কমিশনের সুপারিশগুলোতে। কিন্তু সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে সেসব সুপারিশকে অন্ধকারে পাঠানোর পাশাপাশি পরবর্তী সময়ে শিক্ষা বিষয়ে একাধিক জনবিরোধী সুপারিশ প্রণীত হয়।
স্বাধীনতার পরের এই প্রথম পর্যায়ের চার বছরে সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও কিছু সাহসী ভূমিকা গ্রহণ করা হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, সে সময় বাংলাদেশের প্রায় ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকার জাতীয়করণ করে, যার ফলে প্রাথমিক শিক্ষার পথ অনেকটাই সুগম হয়। অর্থনৈতিক বিবেচনায় এটি একটি সাহসী সিদ্ধান্ত ছিল। ওই চার বছরে বাংলাদেশের শিক্ষা নিয়ে যেসব সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতা দেখা গেছে, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে বর্তমানের বাংলাদেশ আরেকটু ভিন্ন অবস্থানে থাকত বলে অনুমান করা যায়।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে নানা রুটিন কার্যক্রম গ্রহণ করা হলেও সার্বিক অর্থে সেগুলো বড় আকারে প্রভাব ফেলতে পারেনি মূলত দুটো কারণে। প্রথমত, অধিকাংশ সিদ্ধান্তই কোনো গবেষণা ছাড়া শীর্ষ মহল থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়, যার সঙ্গে বাস্তবতার সংযোগ ছিল একেবারেই কম। যেমন—ড. খুদা কমিশনে যেভাবে জনমতের সহায়তায় ও তৎকালীন সম্পদ ব্যবহারের সক্ষমতা বিবেচনায় অগ্রগতির সুপারিশ করা হয়েছিল, সেসব প্রক্রিয়া পরবর্তী সময়ে থমকে যায় এবং নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে খেয়ালখুশিমতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মজিদ খান শিক্ষা কমিশন এ ক্ষেত্রে বড় উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। নব্বইয়ে স্বৈরাচার পতনের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের শিক্ষা বিষয়ে বড় ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেনি তৎকালীন সরকারগুলো। ফলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্র তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে এই সময়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
নব্বইয়ের পর থেকে বাংলাদেশের শিক্ষার অগ্রগতিকে তৃতীয় পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। বিশেষত বৈশ্বিক নানা অঙ্গীকারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় শিক্ষার অগ্রগতিকে সমন্বিত করে দেখার প্রয়াস এই পর্বে লক্ষণীয়। ১৯৯০ সালে থাইল্যান্ডের জমতিয়েনে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার যে আহ্বান জানানো হয়, বাংলাদেশে সেই কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর হয়। প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বিনা মূল্যে রূপান্তরিত করার সুফল পরবর্তী সময়ে দৃশ্যমান হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির হার বাড়ে, আস্তে আস্তে কমতে থাকে ঝরে পড়ার হার। ভর্তির ক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়ে প্রাথমিকে জেন্ডার সমতা অর্জিত হয় এবং পরবর্তী সময়ে মাধ্যমিকেও এই হার কাছাকাছি চলে আসে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য হচ্ছে, প্রাথমিকে ভর্তির হার শতভাগে উন্নীত হওয়া এবং জেন্ডার সমতা অর্জনের বিষয়টি বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ধরে রেখেছে, যা বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত। এই অগ্রগতির প্রভাব পরে মাধ্যমিক পর্যায়ে দৃশ্যমান হয়।
স্বাধীনতার প্রায় ৩০ বছর পর ড. খুদা কমিশনের প্রতিবেদন ও সুপারিশের তুলনায় সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও ২০০০ সালে প্রথম শিক্ষানীতি গৃহীত হয়; যদিও সেটির সুপারিশ ও কৌশলসমূহ রাজনৈতিক কারণে বাস্তবায়িত হতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে ২০১০ সালে ড. খুদা কমিশনকে ভিত্তি ধরে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ও বর্তমান শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও এর সব কৌশল এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এর কারণ হিসেবে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবকেই চিহ্নিত করা যায়। এটি ইতিমধ্যে প্রমাণিত যে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির প্রভাব শুধু শিক্ষা খাতেই দৃশ্যমান হয় না, একটি নির্দিষ্ট সময় পরে সেগুলো রাষ্ট্রের অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। তৃতীয় পর্যায়ের নানা সময়ে আমরা শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত যেসব উদ্যোগ দেখতে পেয়েছি, সেগুলোর প্রভাবই এখন বাংলাদেশে বিদ্যমান। সম্প্রতি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান রয়েছে।
তবে এ ক্ষেত্রে এটিও আলোচনার বিষয় যে শিক্ষার যেসব অগ্রগতি আজকে দৃশ্যমান, তার অধিকাংশই পরিমাণগত। প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই মানের ক্ষেত্রে প্রশ্ন রয়ে গেছে। সমস্যা এখনো বিদ্যমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সম্পদ ব্যবস্থাপনায়, দক্ষ শিক্ষক তৈরিতে এবং সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে। বর্তমানে নানা ধরনের অস্থিরতা ও নৈতিকতার অভাব যেভাবে দেখা যাচ্ছে, তাতে এটিই প্রতীয়মান হয় যে সুশিক্ষা পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে যথাক্রমে প্রান্তিক যোগ্যতা ও শিখনফল রয়েছে। গুণগত শিক্ষা অর্জন করা যাচ্ছে কি না, তার একটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে শিক্ষার্থী সেগুলো অর্জন করতে পারছে কি না তার ওপর। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই এই অর্জন থেকে অনেক দূরে। জেএসসি, এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও সত্যিকার অর্থে শিখন কতটুকু হচ্ছে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। নীতিগত কিছু বিষয়েও ঘাটতি রয়েছে আমাদের; নীতি বাস্তবায়নেও রয়েছে সমস্যা। উদাহরণস্বরূপ, কোভিড-১৯ অতিমারিতে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার অচলাবস্থা প্রমাণ করে দিয়েছে যে আমাদের দুর্যোগকালীন শিক্ষা নিয়ে কোনো নীতি নেই। অন্যদিকে, বর্তমান শিক্ষানীতি অনুসারে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করা বা কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার মতো অগ্রাধিকার বিষয়গুলো এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে এসব ঘাটতি নানাভাবে শিক্ষার মান অর্জনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে আছে গবেষণায়। বৈশ্বিক নানা সূচকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তেমন কোনো অবস্থান নেই। প্রশাসকদের দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধুঁকছে। বাণিজ্যিকীকরণও চলছে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে। রমরমায় রয়েছে নোট ও গাইড বইয়ের বাজার। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও যেসব বিষয়ে আমাদের দৃঢ় অবস্থানে থাকার প্রয়োজন ছিল, সেখানে উদাসীনতা রয়েছে।
এসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠা খুব কঠিন বিষয় নয়। সে ক্ষেত্রে প্রথমেই নজর দিতে হবে সরকার যেসব বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেগুলো দ্রুত ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ যেসব কৌশল গ্রহণ করেছে সরকার, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে অনেক বড় সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এর জন্য বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দও বাড়াতে হবে। শুধু শিক্ষার জন্য জাতীয় আয়ের ৪ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশ বরাদ্দ রাখতে হবে। এই বরাদ্দ যথাযথভাবে ব্যবহৃত হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেমন সম্পদের অভাব কাটিয়ে উঠতে পারবে, তেমনি শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ গুণগত মান বৃদ্ধির যেসব সূচক রয়েছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রায়োগিক কৌশল ব্যবহার করে সমস্যার দ্রুত সমাধান করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি প্রয়োজন শিক্ষাকে স্থানীয় রাজনৈতিক বলয় থেকে মুক্ত করার রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে একটি দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারে। পৃথিবীব্যাপী এ রকম অনেক উদাহরণ রয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। অগ্রগতির এই ধারা কখনো ধীর, কখনো দ্রুত। একই কথা প্রযোজ্য বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রেও। এত দিন যেভাবে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কাজ করা হয়েছে, তাতে পরিমাণগত উন্নয়ন হয়েছে প্রচুর। এখন সময় এসেছে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা। সে ক্ষেত্রেই কেবল টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, সম্ভব হবে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজেদের অবস্থান আরও জোরালো করা।
গৌতম রায়
সহকারী অধ্যাপক শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪