শফিকুল ইসলাম
দেশের সম্ভাবনাময় জেলাগুলোর অন্যতম হিসেবে সম্প্রতি পঞ্চগড় জেলার নাম বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছে। হিমালয়ের পাদদেশীয় সীমান্তবর্তী এই জেলার অনন্য অবস্থানগত বৈশিষ্ট্য ও ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এর উল্লেখযোগ্য কারণ। এ ছাড়া সমতলকেন্দ্রিক ক্রমবর্ধিঞ্চু চা–শিল্প, পাথরশিল্প ও ব্যবসা, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর ও ইমিগ্রেশন, কৃষিভিত্তিক নতুন ধারার পণ্য উৎপাদনে সাফল্য এবং সড়ক ও রেল যোগাযোগে লক্ষণীয় অগ্রগতিও বড় কারণ।
পঞ্চগড়ের ভিন্নধর্মী ভূপ্রকৃতি, ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সবাই কমবেশি অবহিত। হিমালয়ের পাদদেশীয় তরাই বনভূমি সন্নিহিত এই জনপদে যেমন রয়েছে রাজবংশী ও ভাওয়াইয়া সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ প্রভাব, তেমনি আছে উত্তরের পার্বত্য জনগোষ্ঠী ও পশ্চিমের বিহার অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতির নানা লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। ভারতের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন পর্যটন এলাকাসহ নেপাল, ভুটান ও পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন রাজ্যে যাতায়াতের ক্ষেত্রে এই জেলার বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট এক আদর্শ প্রবেশদ্বার হয়ে উঠেছে। পর্যটন বাণিজ্য ও শিক্ষা–সংস্কৃতি বিষয়ে আন্তর্দেশীয় যোগাযোগের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি এক বহুমাত্রিক সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে।
ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে পঞ্চগড় ছিল ভিন্ন ভিন্ন প্রশাসনিক কেন্দ্রের আওতাভুক্ত। কোচবিহার, রংপুর, জলপাইগুড়ি এবং অবশেষে ১৯৪৭ সালের দেশভাগজনিত প্রেক্ষাপটে পঞ্চগড় পুনর্গঠিত দিনাজপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। ঐতিহ্যগতভাবে দিনাজপুর ছিল দেশের অন্যতম বড় খাদ্যভান্ডার। এখানকার কাটারিভোগ চাল ব্যাপক সমাদৃত। মৌসুমি ফল লিচু, আম—এসবের জন্যও এর রয়েছে ভিন্ন এক পরিচিতি। কিন্তু দেশভাগ–পরবর্তী সময়ে দিনাজপুর জেলার আওতাধীন পঞ্চগড়ের দৃশ্যপট ছিল অতীতের মতোই পশ্চাৎপদ। মঙ্গাপীড়িত এলাকা হিসেবে পরিচিত বৃহত্তর রংপুরের যে চিত্র, পঞ্চগড়ের মানুষের জীবনচিত্রও ছিল অনেকটা সে রকমই। পাকিস্তানি শাসনামলের দীর্ঘ সময়েও পঞ্চগড়ের এই জরাজীর্ণ আর্থসামাজিক চেহারাই পরিদৃষ্ট হয়। মুক্তিযুদ্ধপূর্ব সময়ে পঞ্চগড়ে রেল যোগাযোগ সম্প্রসারণ এবং পঞ্চগড় চিনিকল স্থাপনের মতো ইতিবাচক ঘটনা থাকলেও বৃহত্তর জনজীবনে এগুলো দৃশ্যত বড় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে পঞ্চগড় ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গন। সর্ব উত্তরের মুক্তাঞ্চল তেঁতুলিয়া হয়ে উঠেছিল তৎকালীন প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশেও পঞ্চগড়ের মানুষের আর্থসামাজিক দৃশ্যপট বলতে গেলে আগের মতোই অনুজ্জ্বল থেকে যায়।
ঐতিহাসিকভাবে পঞ্চগড় ও সন্নিহিত জনপদের মানুষের বেশ কিছু সংগ্রামী ঘটনা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে। ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, তেভাগা সংগ্রাম এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এই অভিজ্ঞতা সাধারণ মানুষের রাজনীতি ও অধিকারচেতনা গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে মর্মে ধারণা করা যায়।
১৯৪৭–পরবর্তী সময়েও এলাকার মানুষ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে সঠিক পথটিই বেছে নিয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনসহ পরবর্তী প্রতিটি ঘটনায় সেটি খুবই স্পষ্ট।
স্বাধীন বাংলাদেশে পঞ্চগড়ের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা ও দাবি জোরালো হতে থাকে। তারই একটি অংশ ছিল মহকুমা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এলাকার সুধীজন, তথা বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার প্রতিনিধিত্বশীল মানুষের এই দাবি বাস্তবায়িত হয় ১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারি। পরে উপজেলা পদ্ধতি চালু এবং তৎকালীন মহকুমাগুলো জেলায় উন্নীত করা হয়। এই সরকারি সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড় একটি স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
জেলায় উন্নীত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্চগড়ে অবকাঠামোগত কিছু পরিবর্তন বা নতুন নতুন কিছু স্থাপনা দৃশ্যমান হতে শুরু করলেও এখানকার অর্থনীতিতে বাণিজ্য ও পর্যটন গুরুত্ব পেতে শুরু করে আরও পরে। ১৯৯৮ সালে যমুনা বহুমুখী সেতু চালু হলে উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য অংশের পাশাপাশি সর্ব উত্তরের পঞ্চগড়েও এর ইতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যোগাযোগ ও বাণিজ্যে স্বাভাবিকভাবেই নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়। এর আগের বছর ১৯৯৭ সালে পঞ্চগড়ের উত্তর সীমান্তবর্তী তেঁতুলিয়ায় বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর চালু হয়। এই বন্দরের কার্যক্রম প্রথমে নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যে পণ্য আমদানি–রপ্তানি সীমাবদ্ধ থাকলেও পরে ভারত–বাংলাদেশের মধ্যেও পণ্য পরিবহন শুরু হয়। বিপুল পরিমাণ পাথরসহ আরও বেশ কিছু পণ্য বর্তমানে নিয়মিতভাবেই আমদানি–রপ্তানি হচ্ছে। পঞ্চগড় থেকে নীলফামারী, সৈয়দপুরসহ বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে যোগাযোগ সহজতর করার ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চতুর্থ চীন মৈত্রী সেতু জেলার দেবীগঞ্জে করতোয়া নদীর ওপর নির্মিত হয়। এই সেতুও ১৯৯৮ সালে উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
চা-শিল্পের দুই প্রধান এলাকা সিলেটকেন্দ্রিক সুরমা ভ্যালি ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক হালদা ভ্যালির পাশাপাশি এখন পঞ্চগড়কেন্দ্রিক করতোয়া ভ্যালির নামও সামনে
চলে এসেছে।
একসময় রাজধানী ঢাকা থেকে যাত্রা করে ফেরিযোগে যমুনা পার হয়ে পঞ্চগড় পৌঁছাতে প্রায় দুই দিন সময় লাগত। দৈনিক পত্রিকা পৌঁছাতেও একই সময় লাগত। আজ সেখানে পঞ্চগড়-ঢাকা সরাসরি কোচ সার্ভিসের সংখ্যা শতাধিক। সাম্প্রতিক সময়ে পঞ্চগড়-ঢাকা, পঞ্চগড়-রাজশাহী চলাচলকারী মোট চারটি আন্তনগর ট্রেন সার্ভিস এই জেলার যোগাযোগচিত্রকে আমূল বদলে দিয়েছে।
পঞ্চগড়ের নদী থেকে উত্তোলিত পাথরসহ ভূ-অভ্যন্তর থেকে উত্তোলন করা পাথর এবং ভারত থেকে আমদানি করা বিভিন্ন উন্নত পাথরকে কেন্দ্র করে এক বিরাট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গড়ে উঠেছে। নির্মাণকাজে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মান ও আকারের ভাঙা পাথর সরবরাহের ক্ষেত্রে পঞ্চগড় এখন অতিপরিচিত নাম। পঞ্চগড়ের সিলিকা বালুর চাহিদাও সারা দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বিদ্যুতের লাইনে ব্যবহৃত কংক্রিট পোল নির্মাণ ও সরবরাহের ক্ষেত্রে পঞ্চগড় একটি বড় জায়গা তৈরি করে নিয়েছে।
বাংলাদেশের চা–শিল্পের দুই প্রধান এলাকা সিলেটকেন্দ্রিক সুরমা ভ্যালি ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক হালদা ভ্যালির পাশাপাশি এখন পঞ্চগড়কেন্দ্রিক করতোয়া ভ্যালির নামও সামনে চলে এসেছে। গত শতকের আশির দশকে পঞ্চগড়ের সমতলভূমিতে চা চাষের কিছু বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা শুরু হয়। নব্বইয়ের দশকেই চা একটি কৃষিপণ্যরূপে সুসংহত আকার নিতে শুরু করে। সেই সময়ের এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চগড়ে চা চাষের বিষয়টিকে উৎসাহিত করেন। ফলে এলাকায় সমভূমিতে চা চাষের সম্প্রসারণ অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। বর্তমানে পঞ্চগড় জেলার সব উপজেলার বিস্তীর্ণ সমতল ছাড়াও পার্শ্ববর্তী ঠাকুরগাঁও জেলায়ও বহু চা–বাগান গড়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিক তথ্যমতে, জেলায় গড়ে ওঠা চা-বাগানের মোট জমির পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার একর। বেশ কয়েকটি বৃহদায়তন টি এস্টেট ছাড়াও জেলায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ে চা-বাগানের সংখ্যা এরই মধ্যে হাজার ছুঁয়েছে। ২০১৯ সালে জেলার চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি কেজি। সেটি যথারীতি পূর্ণ হয়েছে। পঞ্চগড়ে ২০০১ সালে চা-গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি উপকেন্দ্র স্থাপিত হয়। বর্তমানে সেটি আঞ্চলিক টি বোর্ড হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। জেলার বিভিন্ন স্থানে এরই মধ্যে কুড়িটির বেশি চা-কারখানায় পূর্ণোদ্যমে চা-পাতা ক্রয় ও চা উৎপাদন কার্যক্রম চলছে।
চা ও পাথরের জন্য পঞ্চগড়ের পরিচিতি গড়ে উঠলেও সাম্প্রতিক কালে এই জেলায় আরও কিছু কৃষিপণ্য দেশের বাজারে সমাদৃত হয়েছে। এখানে সুপারি, পান, মরিচ, আলু, বাদাম ইত্যাদি আগে থেকেই উৎপাদিত হয়। এর পাশাপাশি ভুট্টা, পোলট্রি খাদ্য ইত্যাদি উৎপাদনেও এই জেলা বিশেষ ভূমিকা রাখছে। জেলার কিছু এলাকায় কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন ফল ও সবজি উৎপাদন ও বিপণনে উদ্যোক্তা চাষিদের সাফল্য এখন স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। ফলের মধ্যে আম্রপালি জাতের আম, কুল, পেয়ারা, তরমুজ, লিচু ইত্যাদির উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। এ ছাড়া কমলা, মাল্টা, ড্রাগন, স্ট্রবেরি—এসব ফলেরও কমবেশি উৎপাদন শুরু হয়েছে। ইদানীং এই এলাকায় বিভিন্ন সবজিও রেকর্ড পরিমাণে উৎপাদিত হচ্ছে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে হাইব্রিড জাতের টমেটো, শসা, শিম, লাউ, কুমড়া, পেঁপে, বরবটি, করলাসহ শীতকালীন বিভিন্ন সবজি। সারা দেশের বাজারে এ খাত এরই মধ্যে বড় জায়গা দখল করতে পেরেছে। করোনায় লকডাউন চলাকালে রাজশাহীর আম পরিবহনের জন্য যে ধরনের বিশেষ ট্রেন–সুবিধা চালু করা হয়, পঞ্চগড়ের সবজিচাষিদের জন্যও অনুরূপ সুবিধা চালু করা হয়। এ থেকেই পঞ্চগড়ে সবজি চাষের বিস্তৃতি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়।
একসময় যে অঞ্চলের মানুষ বিস্তীর্ণ অনাবাদি জমির বোঝা নিয়ে এবং ব্যবসায় সুবিধাবঞ্চিত থেকে ধুঁকে ধুঁকে পথ চলাকেই প্রায় নিয়তি ভাবতে বসেছিল, সেই অঞ্চলের বর্তমান দৃশ্যপট ও মানুষের জীবনমান নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ।
জেলার শিক্ষা–সংস্কৃতি ও চিকিৎসাব্যবস্থার গুণগত প্রসার এবং প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করাসহ পর্যটন সম্ভাবনাকে সুপরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো হলে পঞ্চগড় যে অতি অল্প সময়ে দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হয়ে উঠবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
শফিকুল ইসলাম
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, ভজনপুর ডিগ্রি কলেজ
দেশের সম্ভাবনাময় জেলাগুলোর অন্যতম হিসেবে সম্প্রতি পঞ্চগড় জেলার নাম বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছে। হিমালয়ের পাদদেশীয় সীমান্তবর্তী এই জেলার অনন্য অবস্থানগত বৈশিষ্ট্য ও ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এর উল্লেখযোগ্য কারণ। এ ছাড়া সমতলকেন্দ্রিক ক্রমবর্ধিঞ্চু চা–শিল্প, পাথরশিল্প ও ব্যবসা, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর ও ইমিগ্রেশন, কৃষিভিত্তিক নতুন ধারার পণ্য উৎপাদনে সাফল্য এবং সড়ক ও রেল যোগাযোগে লক্ষণীয় অগ্রগতিও বড় কারণ।
পঞ্চগড়ের ভিন্নধর্মী ভূপ্রকৃতি, ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সবাই কমবেশি অবহিত। হিমালয়ের পাদদেশীয় তরাই বনভূমি সন্নিহিত এই জনপদে যেমন রয়েছে রাজবংশী ও ভাওয়াইয়া সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ প্রভাব, তেমনি আছে উত্তরের পার্বত্য জনগোষ্ঠী ও পশ্চিমের বিহার অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতির নানা লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। ভারতের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন পর্যটন এলাকাসহ নেপাল, ভুটান ও পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন রাজ্যে যাতায়াতের ক্ষেত্রে এই জেলার বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট এক আদর্শ প্রবেশদ্বার হয়ে উঠেছে। পর্যটন বাণিজ্য ও শিক্ষা–সংস্কৃতি বিষয়ে আন্তর্দেশীয় যোগাযোগের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি এক বহুমাত্রিক সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে।
ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে পঞ্চগড় ছিল ভিন্ন ভিন্ন প্রশাসনিক কেন্দ্রের আওতাভুক্ত। কোচবিহার, রংপুর, জলপাইগুড়ি এবং অবশেষে ১৯৪৭ সালের দেশভাগজনিত প্রেক্ষাপটে পঞ্চগড় পুনর্গঠিত দিনাজপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। ঐতিহ্যগতভাবে দিনাজপুর ছিল দেশের অন্যতম বড় খাদ্যভান্ডার। এখানকার কাটারিভোগ চাল ব্যাপক সমাদৃত। মৌসুমি ফল লিচু, আম—এসবের জন্যও এর রয়েছে ভিন্ন এক পরিচিতি। কিন্তু দেশভাগ–পরবর্তী সময়ে দিনাজপুর জেলার আওতাধীন পঞ্চগড়ের দৃশ্যপট ছিল অতীতের মতোই পশ্চাৎপদ। মঙ্গাপীড়িত এলাকা হিসেবে পরিচিত বৃহত্তর রংপুরের যে চিত্র, পঞ্চগড়ের মানুষের জীবনচিত্রও ছিল অনেকটা সে রকমই। পাকিস্তানি শাসনামলের দীর্ঘ সময়েও পঞ্চগড়ের এই জরাজীর্ণ আর্থসামাজিক চেহারাই পরিদৃষ্ট হয়। মুক্তিযুদ্ধপূর্ব সময়ে পঞ্চগড়ে রেল যোগাযোগ সম্প্রসারণ এবং পঞ্চগড় চিনিকল স্থাপনের মতো ইতিবাচক ঘটনা থাকলেও বৃহত্তর জনজীবনে এগুলো দৃশ্যত বড় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে পঞ্চগড় ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গন। সর্ব উত্তরের মুক্তাঞ্চল তেঁতুলিয়া হয়ে উঠেছিল তৎকালীন প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশেও পঞ্চগড়ের মানুষের আর্থসামাজিক দৃশ্যপট বলতে গেলে আগের মতোই অনুজ্জ্বল থেকে যায়।
ঐতিহাসিকভাবে পঞ্চগড় ও সন্নিহিত জনপদের মানুষের বেশ কিছু সংগ্রামী ঘটনা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে। ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, তেভাগা সংগ্রাম এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এই অভিজ্ঞতা সাধারণ মানুষের রাজনীতি ও অধিকারচেতনা গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে মর্মে ধারণা করা যায়।
১৯৪৭–পরবর্তী সময়েও এলাকার মানুষ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে সঠিক পথটিই বেছে নিয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনসহ পরবর্তী প্রতিটি ঘটনায় সেটি খুবই স্পষ্ট।
স্বাধীন বাংলাদেশে পঞ্চগড়ের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা ও দাবি জোরালো হতে থাকে। তারই একটি অংশ ছিল মহকুমা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এলাকার সুধীজন, তথা বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার প্রতিনিধিত্বশীল মানুষের এই দাবি বাস্তবায়িত হয় ১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারি। পরে উপজেলা পদ্ধতি চালু এবং তৎকালীন মহকুমাগুলো জেলায় উন্নীত করা হয়। এই সরকারি সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড় একটি স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
জেলায় উন্নীত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্চগড়ে অবকাঠামোগত কিছু পরিবর্তন বা নতুন নতুন কিছু স্থাপনা দৃশ্যমান হতে শুরু করলেও এখানকার অর্থনীতিতে বাণিজ্য ও পর্যটন গুরুত্ব পেতে শুরু করে আরও পরে। ১৯৯৮ সালে যমুনা বহুমুখী সেতু চালু হলে উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য অংশের পাশাপাশি সর্ব উত্তরের পঞ্চগড়েও এর ইতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যোগাযোগ ও বাণিজ্যে স্বাভাবিকভাবেই নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়। এর আগের বছর ১৯৯৭ সালে পঞ্চগড়ের উত্তর সীমান্তবর্তী তেঁতুলিয়ায় বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর চালু হয়। এই বন্দরের কার্যক্রম প্রথমে নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যে পণ্য আমদানি–রপ্তানি সীমাবদ্ধ থাকলেও পরে ভারত–বাংলাদেশের মধ্যেও পণ্য পরিবহন শুরু হয়। বিপুল পরিমাণ পাথরসহ আরও বেশ কিছু পণ্য বর্তমানে নিয়মিতভাবেই আমদানি–রপ্তানি হচ্ছে। পঞ্চগড় থেকে নীলফামারী, সৈয়দপুরসহ বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে যোগাযোগ সহজতর করার ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চতুর্থ চীন মৈত্রী সেতু জেলার দেবীগঞ্জে করতোয়া নদীর ওপর নির্মিত হয়। এই সেতুও ১৯৯৮ সালে উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
চা-শিল্পের দুই প্রধান এলাকা সিলেটকেন্দ্রিক সুরমা ভ্যালি ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক হালদা ভ্যালির পাশাপাশি এখন পঞ্চগড়কেন্দ্রিক করতোয়া ভ্যালির নামও সামনে
চলে এসেছে।
একসময় রাজধানী ঢাকা থেকে যাত্রা করে ফেরিযোগে যমুনা পার হয়ে পঞ্চগড় পৌঁছাতে প্রায় দুই দিন সময় লাগত। দৈনিক পত্রিকা পৌঁছাতেও একই সময় লাগত। আজ সেখানে পঞ্চগড়-ঢাকা সরাসরি কোচ সার্ভিসের সংখ্যা শতাধিক। সাম্প্রতিক সময়ে পঞ্চগড়-ঢাকা, পঞ্চগড়-রাজশাহী চলাচলকারী মোট চারটি আন্তনগর ট্রেন সার্ভিস এই জেলার যোগাযোগচিত্রকে আমূল বদলে দিয়েছে।
পঞ্চগড়ের নদী থেকে উত্তোলিত পাথরসহ ভূ-অভ্যন্তর থেকে উত্তোলন করা পাথর এবং ভারত থেকে আমদানি করা বিভিন্ন উন্নত পাথরকে কেন্দ্র করে এক বিরাট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গড়ে উঠেছে। নির্মাণকাজে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মান ও আকারের ভাঙা পাথর সরবরাহের ক্ষেত্রে পঞ্চগড় এখন অতিপরিচিত নাম। পঞ্চগড়ের সিলিকা বালুর চাহিদাও সারা দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বিদ্যুতের লাইনে ব্যবহৃত কংক্রিট পোল নির্মাণ ও সরবরাহের ক্ষেত্রে পঞ্চগড় একটি বড় জায়গা তৈরি করে নিয়েছে।
বাংলাদেশের চা–শিল্পের দুই প্রধান এলাকা সিলেটকেন্দ্রিক সুরমা ভ্যালি ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক হালদা ভ্যালির পাশাপাশি এখন পঞ্চগড়কেন্দ্রিক করতোয়া ভ্যালির নামও সামনে চলে এসেছে। গত শতকের আশির দশকে পঞ্চগড়ের সমতলভূমিতে চা চাষের কিছু বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা শুরু হয়। নব্বইয়ের দশকেই চা একটি কৃষিপণ্যরূপে সুসংহত আকার নিতে শুরু করে। সেই সময়ের এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চগড়ে চা চাষের বিষয়টিকে উৎসাহিত করেন। ফলে এলাকায় সমভূমিতে চা চাষের সম্প্রসারণ অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। বর্তমানে পঞ্চগড় জেলার সব উপজেলার বিস্তীর্ণ সমতল ছাড়াও পার্শ্ববর্তী ঠাকুরগাঁও জেলায়ও বহু চা–বাগান গড়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিক তথ্যমতে, জেলায় গড়ে ওঠা চা-বাগানের মোট জমির পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার একর। বেশ কয়েকটি বৃহদায়তন টি এস্টেট ছাড়াও জেলায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ে চা-বাগানের সংখ্যা এরই মধ্যে হাজার ছুঁয়েছে। ২০১৯ সালে জেলার চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি কেজি। সেটি যথারীতি পূর্ণ হয়েছে। পঞ্চগড়ে ২০০১ সালে চা-গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি উপকেন্দ্র স্থাপিত হয়। বর্তমানে সেটি আঞ্চলিক টি বোর্ড হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। জেলার বিভিন্ন স্থানে এরই মধ্যে কুড়িটির বেশি চা-কারখানায় পূর্ণোদ্যমে চা-পাতা ক্রয় ও চা উৎপাদন কার্যক্রম চলছে।
চা ও পাথরের জন্য পঞ্চগড়ের পরিচিতি গড়ে উঠলেও সাম্প্রতিক কালে এই জেলায় আরও কিছু কৃষিপণ্য দেশের বাজারে সমাদৃত হয়েছে। এখানে সুপারি, পান, মরিচ, আলু, বাদাম ইত্যাদি আগে থেকেই উৎপাদিত হয়। এর পাশাপাশি ভুট্টা, পোলট্রি খাদ্য ইত্যাদি উৎপাদনেও এই জেলা বিশেষ ভূমিকা রাখছে। জেলার কিছু এলাকায় কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন ফল ও সবজি উৎপাদন ও বিপণনে উদ্যোক্তা চাষিদের সাফল্য এখন স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। ফলের মধ্যে আম্রপালি জাতের আম, কুল, পেয়ারা, তরমুজ, লিচু ইত্যাদির উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। এ ছাড়া কমলা, মাল্টা, ড্রাগন, স্ট্রবেরি—এসব ফলেরও কমবেশি উৎপাদন শুরু হয়েছে। ইদানীং এই এলাকায় বিভিন্ন সবজিও রেকর্ড পরিমাণে উৎপাদিত হচ্ছে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে হাইব্রিড জাতের টমেটো, শসা, শিম, লাউ, কুমড়া, পেঁপে, বরবটি, করলাসহ শীতকালীন বিভিন্ন সবজি। সারা দেশের বাজারে এ খাত এরই মধ্যে বড় জায়গা দখল করতে পেরেছে। করোনায় লকডাউন চলাকালে রাজশাহীর আম পরিবহনের জন্য যে ধরনের বিশেষ ট্রেন–সুবিধা চালু করা হয়, পঞ্চগড়ের সবজিচাষিদের জন্যও অনুরূপ সুবিধা চালু করা হয়। এ থেকেই পঞ্চগড়ে সবজি চাষের বিস্তৃতি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়।
একসময় যে অঞ্চলের মানুষ বিস্তীর্ণ অনাবাদি জমির বোঝা নিয়ে এবং ব্যবসায় সুবিধাবঞ্চিত থেকে ধুঁকে ধুঁকে পথ চলাকেই প্রায় নিয়তি ভাবতে বসেছিল, সেই অঞ্চলের বর্তমান দৃশ্যপট ও মানুষের জীবনমান নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ।
জেলার শিক্ষা–সংস্কৃতি ও চিকিৎসাব্যবস্থার গুণগত প্রসার এবং প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করাসহ পর্যটন সম্ভাবনাকে সুপরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো হলে পঞ্চগড় যে অতি অল্প সময়ে দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হয়ে উঠবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
শফিকুল ইসলাম
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, ভজনপুর ডিগ্রি কলেজ
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪