সাজেদুর রহমান প্রভাষক
সৃষ্টির উষালগ্ন থেকেই পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ভেষজ ওষুধ গুরুত্বপূর্ণ অবদান ঃরেখে চলেছে। স্বাস্থ্য রক্ষা ও পরিচর্যায় ভেষজ উদ্ভিদের অবদান ও গুরুত্ব অস্বীকার করে আধুনিক চিকিৎসা ও ওষুধের বর্তমান অবস্থান কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। যুগের পর যুগ বিভিন্ন রূপে ও নামে মানবস্বাস্থ্যের পরিচর্যায় ভেষজ ওষুধ ব্যবহৃত হচ্ছে।
দেশে বর্তমানে পাঁচ শতাধিক পরিচিতিসম্পন্ন ভেষজ উদ্ভিদ থাকলেও অচেনা কিন্তু ভেষজ গুণসম্পন্ন উদ্ভিদ ও লতাগুল্ম নেহাত কম নয়।
দেশের পার্বত্য অঞ্চল মূলত ভেষজ উদ্ভিদের প্রধান জন্মস্থান হিসেবে পরিচিত হলেও খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের নাটোর জেলার লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়ন ভেষজ উদ্ভিদের উৎপাদনক্ষেত্র হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। আশির দশকে এই ইউনিয়নের বাসিন্দা আফাজ উদ্দিন (পাগলা আফাজ) নামের এক কবিরাজ একক প্রচেষ্টায় লক্ষ্মীপুর, পিজ্জিপাড়া, ইব্রাহিমপুর, সোনাপুর, চানপুর, দক্ষিণপুর, দোয়াতপাড়া, সুলতানপুরসহ বেশ কিছু গ্রামে নানা জাতের ঔষধি গাছের আবাদ শুরু করেন। এভাবে এক দশকে গড়ে তোলেন দেশের প্রথম ও একমাত্র ঔষধি গ্রাম। ধীরে ধীরে ভেষজ উদ্ভিদ চাষ সম্প্রসারিত হয়ে ঔষধি গ্রাম ও ঔষধি ইউনিয়নে রূপান্তরিত হয়। এখন ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি পরিবার কোনো না কোনো ভেষজ উদ্ভিদ চাষের সঙ্গে জড়িত। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ভেষজ উদ্ভিদ উৎপাদন করে জীবিকা অর্জন করে অনেক পরিবার।
ভেষজ গাছের নামে ইউনিয়নের পরিচয় তৈরি হওয়া লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া নাটোর জেলাকে আলাদা পরিচিতি এনে দিয়েছে। আগে ‘বনলতার’ ও ‘কাঁচাগোল্লার’ নাটোর বলা হলেও এখন শোনা যায় ‘ঔষধি গ্রামের’ নাটোর। ইউনিয়নজুড়ে দেড় শ প্রজাতির ভেষজ উদ্ভিদের চাষ হয়।
ভেষজ উদ্ভিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী। এ ছাড়া অর্জুন, অশোক, আতা, আনার, আমলকী, কুটজ, কতবেল, কাগজি লেবু, কাঞ্চন, কুচিলা, খয়েরখদির, গনিয়ারী, গাব, গামার, গোড়া, জামির, চন্দন, চম্পক, চালতা, চালমুগরা, ছাতিম, জয়ন্তী, দারুচিনি, ধাইফুল, নিম, নিশিন্দা, পলাশ, পার্বল, হেড়া,মহুয়া,রক্তচন্দন, রোহিতকা, শিমুল, সোনা, শজনে, সোনালু, হরীতকী, আগর, কর্পূর, ঘোড়ানিম, নাগেশ্বর, অনন্তমূল, আঙুর, আলকুশি, গন্ধভাদুলে, গুড়ুচী, গুলঞ্চ, চই, পটোল, পূর্ণনবা, ভৃঙ্গরাজ, শতমূলী, অর্শ্বগন্ধা, এরণ্ড, কালকাসুন্দে, কালমেঘ, চিতা, সর্পগন্ধা, জবা, তুলসী, বলা, বামুনহাটি, বাসক, বাবুই, শালপনি, স্বর্ণলতা, উলটকম্বল, শতমূল, মিছরিদানা প্রভৃতি।
দেশে দুই দশক ধরে রোগ প্রতিরোধে যেসব ওষুধ বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, সেসবের অধিকাংশেরই (কিছু আমদানি উপকরণ বাদে) প্রস্তুত উপকরণ কোনো না কোনোভাবে ভেষজ উদ্ভিদ। বিগত সময়ে এসব উপকরণের মূল ক্রেতা ছিলেন উত্তরাঞ্চলের কবিরাজেরা। তাঁরা এসব ভেষজ উদ্ভিদ কম দামে কিনে ওষুধ-তাবিজ তৈরি করে আঞ্চলিক হাট-বাজারে বিক্রি করতেন।
গত দুই দশকে এখানে অন্য উদ্ভিদ চাষের চেয়ে জ্যামিতিক হারে বেড়েছে ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরার উৎপাদন। বর্তমানে এক হাজার বিঘার বেশি জমিতে চাষ হচ্ছে ঘৃতকুমারী। প্রথম আবাদে এক বিঘা জমিতে খরচ হয় দেড় লাখ টাকা, যা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। বিনিয়োগের দ্বিগুণ টাকা মুনাফা হয়ে ফিরে আসে মাত্র দুই বছর শেষে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, বিপুল এই ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরার ৯৫ শতাংশ ক্রয় করেন ঢাকার একশ্রেণির ফড়িয়া। তাঁরা এসব অ্যালোভেরা বিক্রি করেন শরবতবিক্রেতাদের কাছে। শরবত বিক্রি অব্যাহত থাকলে কদর থাকে অ্যালোভেরার, না থাকলে নয়। এই পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি হয়েছে গত বছর করোনা অতিমারিজনিত লকডাউনের কারণে। লকডাউনের কারণে পাইকাররা আসতে পারেননি নাটোরে। বিক্রি না হওয়ায় অ্যালোভেরা তাই খেতেই পচেছে। গাছ বাঁচাতে চাষিরা অ্যালোভেরার পাতা কেটে নিজেরাই ফেলে দিয়েছেন ভাগাড়ে। এই পরিস্থিতিতে পরিকল্পিতভাবে অ্যালোভেরা উৎপাদন ও সমন্বিত বাজারজাতকরণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
অন্য ভেষজ উদ্ভিদের উৎপাদন ও কেনাবেচা কম হওয়ায় এখানে আশা জাগাচ্ছে অ্যালোভেরা। হজম প্রক্রিয়া, ডায়াবেটিস, ত্বক ও চুলের যত্ন, ওজন কমানো এবং হাড় ও দাঁতের যত্নে অ্যালোভেরার কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। বাজারে প্রচলিত ওষুধগুলো মানবদেহভেদে বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করায় চিকিৎসায় ভেষজনির্ভরতা বাড়ছে দিনদিন। এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে অদূর ভবিষ্যতে দেশে ভেষজ উদ্ভিদের উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প থাকবে না। তাই এখন থেকে ভেষজ উৎপাদনের এই উর্বর ভূমি নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে। এক বা একাধিক ভেষজপল্লি সৃষ্টির চেয়ে নাটোরের এই পল্লি ভবিষ্যতে ভেষজ উদ্ভিদের জোগান দেবে সবার আগে।
সম্ভাবনার ভেষজ ইউনিয়ন নাটোরের লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া এখন সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে। বিগত বছরগুলোতে একাধিকবার সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই ইউনিয়ন পরিদর্শনে এসে কয়েক হাজার ভেষজচাষিকে আশ্বস্ত করে গেছেন। একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যম এই ইউনিয়নকে সরকারিভাবে ভেষজ গবেষণারকেন্দ্র হিসেবে উন্নীত করার কথা জানিয়েছেন। অ্যালোভেরাসহ ভেষজ উদ্ভিদের বহুমুখী ব্যবহার ও বাজারজাতকরণ নিয়ে প্রয়োজনীয় সরকারি দিকনির্দেশনা ও ঘোষণা বেসরকারি বিনিয়োগ ও পৃষ্ঠপোষকতাকে উৎসাহিত করবে নিঃসন্দেহে।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের আশ্বাস দ্রুত বাস্তবায়িত হলে বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানি এই ইউনিয়নে বিনিয়োগে আস্থা পাবে। ওষুধ ও প্রসাধনী উৎপাদনে ভেষজ উদ্ভিদের বহুল ব্যবহার নিশ্চিত সম্ভব হলে নকল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার অনেকাংশে কমবে। এতে উৎপাদনকারীরা ন্যায্যমূল্য পাবেন এবং আবাদে উৎসাহিত হবেন। রোগ নির্মূলে প্রাকৃতিক উপাদানের ব্যবহার জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
নাটোর এখনো কিছু সূচকে পিছিয়ে আছে। তিন দশকে যোগাযোগ অবকাঠামো, শিক্ষা ও দারিদ্র্যবিমোচনে তেমন অগ্রগতি হয়নি। এ জন্য রাজনৈতিক অনৈক্য ও নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণমূলক প্রতিনিধিত্বের অভাব অনেকটাই দায়ী। এই সময়ে কৃষকেরাই উৎপাদনকেন্দ্রিক অর্থনীতির বনিয়াদ গড়ে তুলেছেন।
কৃষিবৈচিত্র্যের নাটোরে ভেষজ উদ্ভিদের চাষাবাদ উৎপাদনমূলক অর্থনীতিতে এক ভিন্ন মাত্রা সংযোজন করেছে। ভিন্ন এই মাত্রাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ও বাণিজ্যিক স্বীকৃতি দিতে ঔষধি গ্রাম নিয়ে সরকারের ইতিবাচক ভাবনা ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ কাম্য। সরকার এগিয়ে এলেই এগিয়ে আসবেন বিনিয়োগকারীরা। দেশে উন্মোচিত হবে ভেষজ উপকরণের ওষুধ ও প্রসাধনসামগ্রীর নতুন দিগন্ত। সেই সোনালি দিনের প্রতীক্ষায় নাটোরবাসী।
ঔষধি ইউনিয়ন দেশব্যাপী নাটোর জেলার পরিচিতির নতুন দুয়ার খুলে দিলেও উঁকি দিচ্ছে কৃষি ও পর্যটন সম্ভাবনা। গত এক দশকে বিনা চাষে উৎপাদিত রসুন ও বোরো ধান কৃষি সম্ভাবনায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। প্রতিবছর দেশে রসুনের চাহিদা ৫ লাখ মেট্রিক টন, যার এক-তৃতীয়াংশই উৎপাদিত হয় নাটোরে। দেশব্যাপী বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার রসুন বিক্রি হয় নাটোর থেকে। দেশের বাজারে চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি হতে পারে নাটোরের রসুন। অন্যদিকে চলনবিলকে বলা হচ্ছে বোরো ধানের গোলা। বছরের অধিকাংশ সময় পানিতে নিমজ্জিত চলনবিলে আবাদি জমিগুলো একফসলি। সেচনির্ভর বোরো ধানের আবাদই এখানে মৌসুমের প্রধান ও একমাত্র ফসল। গত পাঁচ বছরে নাটোর জেলায় উৎপাদিত মোট বোরো ধানের ৬৩ শতাংশ আবাদ হয়েছে সিংড়ার বিলগুলোতে। কৃষি বিভাগ সুনজর দিলে হাওরাঞ্চলের পর বোরো ধানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎস হতে পারে চলনবিল এলাকা।
এই মুহূর্তে নাটোর সবচেয়ে সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকা। জেলার দর্শনীয় স্থানগুলো হলো উত্তরা গণভবন, রানি ভবানী রাজবাড়ি, দয়ারামপুর রাজবাড়ি, বনপাড়া লুর্দের রানি মা মারিয়া ধর্মপল্লি, বোর্ণী মারীয়াবাদ ধর্মপল্লি, শহীদ সাগর, চলনবিল, হালতি বিল, চলনবিল জাদুঘর, ধরাইল জমিদারবাড়ি, নীলকুঠি, গিরিশ ধাম প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। চলনবিল ও হালতি বিলের সাবমার্সিবল দুটি রাস্তা বর্ষাকালে ডুবে গেলে মিনি কক্সবাজারের আবহ সৃষ্টি হয়। আর এতেই আশপাশের জেলাগুলো থেকে হাজার হাজার মানুষ এখানে ছুটে আসে সমুদ্রের স্বাদ নিতে। তবে দুঃখের বিষয়, নাটোরে পর্যটকদের অবস্থান করে এসব দর্শনীয় স্থান দেখার জন্য নেই ভালো হোটেল-মোটেল। প্রশাসন অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করলে এসব দর্শনীয় স্থান থেকে আরও বেশি রাজস্ব আয় করা সম্ভব হবে।
সাজেদুর রহমান প্রভাষক, দর্শন বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কলেজ, নাটোর
সৃষ্টির উষালগ্ন থেকেই পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ভেষজ ওষুধ গুরুত্বপূর্ণ অবদান ঃরেখে চলেছে। স্বাস্থ্য রক্ষা ও পরিচর্যায় ভেষজ উদ্ভিদের অবদান ও গুরুত্ব অস্বীকার করে আধুনিক চিকিৎসা ও ওষুধের বর্তমান অবস্থান কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। যুগের পর যুগ বিভিন্ন রূপে ও নামে মানবস্বাস্থ্যের পরিচর্যায় ভেষজ ওষুধ ব্যবহৃত হচ্ছে।
দেশে বর্তমানে পাঁচ শতাধিক পরিচিতিসম্পন্ন ভেষজ উদ্ভিদ থাকলেও অচেনা কিন্তু ভেষজ গুণসম্পন্ন উদ্ভিদ ও লতাগুল্ম নেহাত কম নয়।
দেশের পার্বত্য অঞ্চল মূলত ভেষজ উদ্ভিদের প্রধান জন্মস্থান হিসেবে পরিচিত হলেও খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের নাটোর জেলার লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়ন ভেষজ উদ্ভিদের উৎপাদনক্ষেত্র হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। আশির দশকে এই ইউনিয়নের বাসিন্দা আফাজ উদ্দিন (পাগলা আফাজ) নামের এক কবিরাজ একক প্রচেষ্টায় লক্ষ্মীপুর, পিজ্জিপাড়া, ইব্রাহিমপুর, সোনাপুর, চানপুর, দক্ষিণপুর, দোয়াতপাড়া, সুলতানপুরসহ বেশ কিছু গ্রামে নানা জাতের ঔষধি গাছের আবাদ শুরু করেন। এভাবে এক দশকে গড়ে তোলেন দেশের প্রথম ও একমাত্র ঔষধি গ্রাম। ধীরে ধীরে ভেষজ উদ্ভিদ চাষ সম্প্রসারিত হয়ে ঔষধি গ্রাম ও ঔষধি ইউনিয়নে রূপান্তরিত হয়। এখন ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি পরিবার কোনো না কোনো ভেষজ উদ্ভিদ চাষের সঙ্গে জড়িত। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ভেষজ উদ্ভিদ উৎপাদন করে জীবিকা অর্জন করে অনেক পরিবার।
ভেষজ গাছের নামে ইউনিয়নের পরিচয় তৈরি হওয়া লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া নাটোর জেলাকে আলাদা পরিচিতি এনে দিয়েছে। আগে ‘বনলতার’ ও ‘কাঁচাগোল্লার’ নাটোর বলা হলেও এখন শোনা যায় ‘ঔষধি গ্রামের’ নাটোর। ইউনিয়নজুড়ে দেড় শ প্রজাতির ভেষজ উদ্ভিদের চাষ হয়।
ভেষজ উদ্ভিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী। এ ছাড়া অর্জুন, অশোক, আতা, আনার, আমলকী, কুটজ, কতবেল, কাগজি লেবু, কাঞ্চন, কুচিলা, খয়েরখদির, গনিয়ারী, গাব, গামার, গোড়া, জামির, চন্দন, চম্পক, চালতা, চালমুগরা, ছাতিম, জয়ন্তী, দারুচিনি, ধাইফুল, নিম, নিশিন্দা, পলাশ, পার্বল, হেড়া,মহুয়া,রক্তচন্দন, রোহিতকা, শিমুল, সোনা, শজনে, সোনালু, হরীতকী, আগর, কর্পূর, ঘোড়ানিম, নাগেশ্বর, অনন্তমূল, আঙুর, আলকুশি, গন্ধভাদুলে, গুড়ুচী, গুলঞ্চ, চই, পটোল, পূর্ণনবা, ভৃঙ্গরাজ, শতমূলী, অর্শ্বগন্ধা, এরণ্ড, কালকাসুন্দে, কালমেঘ, চিতা, সর্পগন্ধা, জবা, তুলসী, বলা, বামুনহাটি, বাসক, বাবুই, শালপনি, স্বর্ণলতা, উলটকম্বল, শতমূল, মিছরিদানা প্রভৃতি।
দেশে দুই দশক ধরে রোগ প্রতিরোধে যেসব ওষুধ বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, সেসবের অধিকাংশেরই (কিছু আমদানি উপকরণ বাদে) প্রস্তুত উপকরণ কোনো না কোনোভাবে ভেষজ উদ্ভিদ। বিগত সময়ে এসব উপকরণের মূল ক্রেতা ছিলেন উত্তরাঞ্চলের কবিরাজেরা। তাঁরা এসব ভেষজ উদ্ভিদ কম দামে কিনে ওষুধ-তাবিজ তৈরি করে আঞ্চলিক হাট-বাজারে বিক্রি করতেন।
গত দুই দশকে এখানে অন্য উদ্ভিদ চাষের চেয়ে জ্যামিতিক হারে বেড়েছে ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরার উৎপাদন। বর্তমানে এক হাজার বিঘার বেশি জমিতে চাষ হচ্ছে ঘৃতকুমারী। প্রথম আবাদে এক বিঘা জমিতে খরচ হয় দেড় লাখ টাকা, যা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। বিনিয়োগের দ্বিগুণ টাকা মুনাফা হয়ে ফিরে আসে মাত্র দুই বছর শেষে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, বিপুল এই ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরার ৯৫ শতাংশ ক্রয় করেন ঢাকার একশ্রেণির ফড়িয়া। তাঁরা এসব অ্যালোভেরা বিক্রি করেন শরবতবিক্রেতাদের কাছে। শরবত বিক্রি অব্যাহত থাকলে কদর থাকে অ্যালোভেরার, না থাকলে নয়। এই পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি হয়েছে গত বছর করোনা অতিমারিজনিত লকডাউনের কারণে। লকডাউনের কারণে পাইকাররা আসতে পারেননি নাটোরে। বিক্রি না হওয়ায় অ্যালোভেরা তাই খেতেই পচেছে। গাছ বাঁচাতে চাষিরা অ্যালোভেরার পাতা কেটে নিজেরাই ফেলে দিয়েছেন ভাগাড়ে। এই পরিস্থিতিতে পরিকল্পিতভাবে অ্যালোভেরা উৎপাদন ও সমন্বিত বাজারজাতকরণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
অন্য ভেষজ উদ্ভিদের উৎপাদন ও কেনাবেচা কম হওয়ায় এখানে আশা জাগাচ্ছে অ্যালোভেরা। হজম প্রক্রিয়া, ডায়াবেটিস, ত্বক ও চুলের যত্ন, ওজন কমানো এবং হাড় ও দাঁতের যত্নে অ্যালোভেরার কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। বাজারে প্রচলিত ওষুধগুলো মানবদেহভেদে বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করায় চিকিৎসায় ভেষজনির্ভরতা বাড়ছে দিনদিন। এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে অদূর ভবিষ্যতে দেশে ভেষজ উদ্ভিদের উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প থাকবে না। তাই এখন থেকে ভেষজ উৎপাদনের এই উর্বর ভূমি নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে। এক বা একাধিক ভেষজপল্লি সৃষ্টির চেয়ে নাটোরের এই পল্লি ভবিষ্যতে ভেষজ উদ্ভিদের জোগান দেবে সবার আগে।
সম্ভাবনার ভেষজ ইউনিয়ন নাটোরের লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া এখন সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে। বিগত বছরগুলোতে একাধিকবার সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই ইউনিয়ন পরিদর্শনে এসে কয়েক হাজার ভেষজচাষিকে আশ্বস্ত করে গেছেন। একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যম এই ইউনিয়নকে সরকারিভাবে ভেষজ গবেষণারকেন্দ্র হিসেবে উন্নীত করার কথা জানিয়েছেন। অ্যালোভেরাসহ ভেষজ উদ্ভিদের বহুমুখী ব্যবহার ও বাজারজাতকরণ নিয়ে প্রয়োজনীয় সরকারি দিকনির্দেশনা ও ঘোষণা বেসরকারি বিনিয়োগ ও পৃষ্ঠপোষকতাকে উৎসাহিত করবে নিঃসন্দেহে।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের আশ্বাস দ্রুত বাস্তবায়িত হলে বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানি এই ইউনিয়নে বিনিয়োগে আস্থা পাবে। ওষুধ ও প্রসাধনী উৎপাদনে ভেষজ উদ্ভিদের বহুল ব্যবহার নিশ্চিত সম্ভব হলে নকল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার অনেকাংশে কমবে। এতে উৎপাদনকারীরা ন্যায্যমূল্য পাবেন এবং আবাদে উৎসাহিত হবেন। রোগ নির্মূলে প্রাকৃতিক উপাদানের ব্যবহার জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
নাটোর এখনো কিছু সূচকে পিছিয়ে আছে। তিন দশকে যোগাযোগ অবকাঠামো, শিক্ষা ও দারিদ্র্যবিমোচনে তেমন অগ্রগতি হয়নি। এ জন্য রাজনৈতিক অনৈক্য ও নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণমূলক প্রতিনিধিত্বের অভাব অনেকটাই দায়ী। এই সময়ে কৃষকেরাই উৎপাদনকেন্দ্রিক অর্থনীতির বনিয়াদ গড়ে তুলেছেন।
কৃষিবৈচিত্র্যের নাটোরে ভেষজ উদ্ভিদের চাষাবাদ উৎপাদনমূলক অর্থনীতিতে এক ভিন্ন মাত্রা সংযোজন করেছে। ভিন্ন এই মাত্রাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ও বাণিজ্যিক স্বীকৃতি দিতে ঔষধি গ্রাম নিয়ে সরকারের ইতিবাচক ভাবনা ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ কাম্য। সরকার এগিয়ে এলেই এগিয়ে আসবেন বিনিয়োগকারীরা। দেশে উন্মোচিত হবে ভেষজ উপকরণের ওষুধ ও প্রসাধনসামগ্রীর নতুন দিগন্ত। সেই সোনালি দিনের প্রতীক্ষায় নাটোরবাসী।
ঔষধি ইউনিয়ন দেশব্যাপী নাটোর জেলার পরিচিতির নতুন দুয়ার খুলে দিলেও উঁকি দিচ্ছে কৃষি ও পর্যটন সম্ভাবনা। গত এক দশকে বিনা চাষে উৎপাদিত রসুন ও বোরো ধান কৃষি সম্ভাবনায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। প্রতিবছর দেশে রসুনের চাহিদা ৫ লাখ মেট্রিক টন, যার এক-তৃতীয়াংশই উৎপাদিত হয় নাটোরে। দেশব্যাপী বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার রসুন বিক্রি হয় নাটোর থেকে। দেশের বাজারে চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি হতে পারে নাটোরের রসুন। অন্যদিকে চলনবিলকে বলা হচ্ছে বোরো ধানের গোলা। বছরের অধিকাংশ সময় পানিতে নিমজ্জিত চলনবিলে আবাদি জমিগুলো একফসলি। সেচনির্ভর বোরো ধানের আবাদই এখানে মৌসুমের প্রধান ও একমাত্র ফসল। গত পাঁচ বছরে নাটোর জেলায় উৎপাদিত মোট বোরো ধানের ৬৩ শতাংশ আবাদ হয়েছে সিংড়ার বিলগুলোতে। কৃষি বিভাগ সুনজর দিলে হাওরাঞ্চলের পর বোরো ধানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎস হতে পারে চলনবিল এলাকা।
এই মুহূর্তে নাটোর সবচেয়ে সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকা। জেলার দর্শনীয় স্থানগুলো হলো উত্তরা গণভবন, রানি ভবানী রাজবাড়ি, দয়ারামপুর রাজবাড়ি, বনপাড়া লুর্দের রানি মা মারিয়া ধর্মপল্লি, বোর্ণী মারীয়াবাদ ধর্মপল্লি, শহীদ সাগর, চলনবিল, হালতি বিল, চলনবিল জাদুঘর, ধরাইল জমিদারবাড়ি, নীলকুঠি, গিরিশ ধাম প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। চলনবিল ও হালতি বিলের সাবমার্সিবল দুটি রাস্তা বর্ষাকালে ডুবে গেলে মিনি কক্সবাজারের আবহ সৃষ্টি হয়। আর এতেই আশপাশের জেলাগুলো থেকে হাজার হাজার মানুষ এখানে ছুটে আসে সমুদ্রের স্বাদ নিতে। তবে দুঃখের বিষয়, নাটোরে পর্যটকদের অবস্থান করে এসব দর্শনীয় স্থান দেখার জন্য নেই ভালো হোটেল-মোটেল। প্রশাসন অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করলে এসব দর্শনীয় স্থান থেকে আরও বেশি রাজস্ব আয় করা সম্ভব হবে।
সাজেদুর রহমান প্রভাষক, দর্শন বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কলেজ, নাটোর
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪