মাহবুবুল আলম কবীর
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এটা নিয়ে অতি মাতামাতির কিছু নেই। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশসহ দুনিয়ার বেবাক দেশই এগিয়ে চলেছে। এটা ভৌগোলিক এবং বৈজ্ঞানিক সত্য। কীভাবে? পৃথিবী তো সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। বলা যায়, দৌড়ের ওপরে আছে। বিশ্রাম নেওয়ার ফুরসত তো দূর অস্ত, তার একটুও ফাঁকি দেওয়ার যো নেই।
তো, পৃথিবী সামনের দিকে ঘুরবে আর বাংলাদেশ নট নড়নচড়ন? গ্যাঁট হয়ে বসে থাকবে? তার কিন্তু উপায় নেই। প্রতিটি দেশ যেহেতু পৃথিবীরই অংশ, তাই এখানে ঘাড় ত্যাড়ামির সুযোগই নেই। জাতিসংঘের ডাকে আমেরিকা-রাশিয়া-চীন যে কেউ সাড়া না দিতে পারে, কোনো প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারে, কিন্তু সুয্যি মামা এসব আমলে নেবে না। সে পৃথিবীকে টেনেহিঁচড়ে ঘোরাবেই, সেই সঙ্গে আমরাও, মানে প্রতিটা দেশ আর কী!
সুতরাং আমরা এগোবই। বাংলার দামাল ছেলেরা ভাদাইম্যা হয়ে ঘরে বসে থাকলেও এগিয়ে যাবে। কোন ‘শ্বশুরের ছেলে’র সাধ্য–আমাদের ঠেকিয়ে রাখবে? তবে হ্যাঁ, আমরাই আমাদের প্রতিপক্ষ, নিজেরাই নিজেদের ঠেকিয়ে রাখতে সদা তৎপর। একে অন্যকে টেনে ধরে গতিটা কমিয়ে দিই। এই মহান কাজটুকু যদি না করতাম, তাহলে দেখা যেত পৃথিবীর গতিকে আমরা টেক্কা দিয়ে ফেলেছি। মহাকাশবিজ্ঞানীরা চোখ ছানাবড়া করে টেলিস্কোপে দেখতেন– পৃথিবী থেকে একটা অংশ ছিটকে বেরিয়ে তুমুল বেগে মাতৃগ্রহের দ্বিগুণ বেগে ঘুরছে! সেই টুকরাটার নাম বাংলাদেশ!
এরপরও নাকি কিছু হিসাব–নিকাশ, বিচার-বিশ্লেষণ থাকে। নানান রকম অঙ্ক কষে বিজ্ঞজনেরা বলেন, উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এসব বিশ্লেষণ শুনে আমরা নতুন করে ভাবতে থাকি–দেশ এগিয়ে গেলে আমাদেরও তো এগোতে হবে। ওই যে কবি নজরুল বলেছিলেন না–‘আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে?’ তাই সেই সকাল আনার জন্য আমরা রাত আরও গভীর করে তুলি, দেশের অন্ধকার বাড়াই।
‘বাপের আগে পোলায় ছোটে’-র মতো করে দেশ এগিয়ে যাওয়ার আগেই আমরা এগোতে থাকি। যেখানে যা দেখি খাবলা মেরে করায়ত্ত করতে চাই। একেকজনের পেট যেন হাবিয়া দোজখের মতো, দে দে খাই খাই। পেট আর ভরে না! গাছেরটা খাই, তলারটা কুড়াই, মওকা পেলে মাঝেও হাত বুলিয়ে খামচে–আঁচড়ে যাচাই করি– খেজুরের রসের মতো এখানেও যদি কিছু মেলে! লাভের ওপর লাভ করার ধান্দায় আমাদের সব ছোটাছুটি। কেউ ছোটে ঝাড়া হাত-পা নিয়ে, কিছু পেলেই যেন খপ করে তুলে নেওয়া যায়। আবার কেউ ছোটে বেশ আয়োজন করে, একেবারে গাট্টিবোঁচকা, লোটা-কম্বল, চুলাচাক্কি নিয়ে। সবাই কেবল সামনের দিকে ধেয়ে চলে, এগিয়ে যেতে না পারলে তো জীবনই বৃথা! অথচ সামনে কী আছে, কেউ জানে না। ‘যাইতাছি তো যাইতাছি, কই যাইতাছি জানি না।’
ব্যক্তি হচ্ছে সমাজ তথা রাষ্ট্রের অণু। তাই ব্যক্তির উন্নয়ন হলেই দেশের উন্নয়ন সম্ভব। আমাদের এক সাবেক নেতাও বলেছিলেন, ‘৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে।’ তাঁর অনুসারীরাও এই স্লোগান প্রচার করতে থাকেন। এমনকি দেশে গ্রামের সংখ্যা ৮৪ হাজার পেরিয়ে গেলেও তাদের বক্তৃতা-বিবৃতি, স্লোগান, ব্যানার-পোস্টারে সেই ৬৮ হাজারই রয়ে গেল! নেতার মুখের বাণী বলে কথা! বাসি হলেও ঠিক। ধ্রুব সত্য। ভাবটা যেন–‘কইছি তো কইছিই, একটাও কমামু না, বাড়ামুও না।’
সেই মোতাবেক রাষ্ট্রের অণু হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিরা ব্যক্তিগত উন্নয়নে মন দেন। রাষ্ট্র তথা জনগণের টাকা-সম্পদ লুট করে তাদের ‘প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন’ অবস্থা। এই শিক্ষিত সিঁধেল চোরেরা করোনা মহামারির সংকটেও জাতিকে জিম্মি করে আখের গুছিয়ে নেয়। চুরি-চামারি, ছিনতাই-রাহাজানি, চড়া দামে ভেজাল পণ্য বেচা, ব্যাংকঋণের টাকা পাচার, নিরীহদের ভিটেছাড়া করা, রেলের জমি গিলে খাওয়া, নদী-খাল-বন দখল, টেক্সটাইল মিলের সমান দামে জানালার পর্দা কেনা, হীরার দামে বালিশ কেনা–সব টেকনিকের প্রভূত উন্নতি হয়েছে।
কেনা হবে হাসপাতালের সুই, খরচের বিল দেখে মনে হবে আস্ত সাবমেরিন কিনে ফেলেছে! ২৫০ টাকার একেকটা সুইয়ের দাম দেখানো হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। ৪০০ টাকার বাঁকানো কাঁচি কিনে তার ভাউচার করা হয়েছে সাড়ে ১০ হাজার টাকা। ভাবছেন, কীভাবে এটা হলো? আরে ভাই, কাঁচিই বাঁকা, তার ভাউচার সোজা পথে হবে কেন? চারপাশে এমন গোপন তথ্য গিজগিজ করলেও বলা যাবে না কিছু। শুধুই ‘খেলা দেখে যান বাবু’।
জাল সনদ দাখিল করে তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকের চাকরি নিলে এখন আর ইজ্জত থাকে? দেশ এগিয়েছে না? সেই অনুযায়ী আমাদেরও তো এগোতে হবে, নাকি? তারচেয়ে বরং কাগজপত্র জাল করে আমলা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার চেষ্টা করুন। যদি লাইগ্যা যায়…। কোভিডকালে ছাত্ররা অনলাইনে পরীক্ষা পর্যন্ত দিয়ে (কখনোবা উত্তর লিখে দিচ্ছে বাপ) অটো পাস পেয়ে যাচ্ছে। কী মজার ইশকুল!
ধরুন, আপনার এলাকায় নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ‘নির্বাচিত’ শব্দটা নিয়ে যদি আপনার আপত্তি থাকে, তবে নিজের পছন্দমতো জুতসই একটা শব্দ বসিয়ে নিন, আমার আপত্তি থাকবে না। কবি বলেছেন, ‘মদ সত্য, পাত্র সত্য নয়/ যে পাত্রে ঢালিয়া খাও সেই নেশা হয়।’ সুতরাং যেভাবেই গদিতে বসুন না কেন, তিনিই চেয়ারম্যান। ক্ষমতা তাঁর পদতলে নেড়ি কুকুরের মতো লুটোপুটি খায়।
তিনি ক্ষমতায় আসার বছর না পেরোতেই এলাকায় চুরি-ডাকাতি, খুন-ধর্ষণ , গুম বাড়তে লাগল। এসব দেখে আপনি হয়তো বিবেকের তাড়নায় (ওটা যদি তখনো থেকে থাকে আর কি!) চেয়ারম্যানের সামনে এগিয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘গত কয়েক মাসে এলাকায় খুন হয়েছে চারটি, ধর্ষণ তিনটি, সর্বশেষ গতকাল যে ১১ নম্বর গুমটি হলো–চেয়ারম্যান হিসেবে আপনার কী বক্তব্য।’ চেয়ারম্যান সাহেব সেই গৎবাঁধা জবাবটা দিয়ে দেবেন, ‘আমার আগের চেয়ারম্যানের আমলে খুন হয়েছিল ৭টি, ধর্ষণ ৯টি আর গুম হয়েছিল ১৭ জন। তাহলে আমার ব্যর্থতাটা কোথায়?’
চেয়ারম্যানের এই জবাবের পরেও কি আপনি আরেকটু এগিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নেবেন? আগ বাড়িয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়বেন– ‘তাহলে খুন-ধর্ষণ-গুম… এসব ঘটার ক্ষেত্রে আপনার টার্গেট কত? বিরোধীপক্ষের সঙ্গে ড্র করবেন? নাকি আরেকটু এগিয়ে যাবেন? ব্যস, কপাল পুড়ল আপনার। এলাকায় যে গুমের সংখ্যা ১১টি ছিল, রাত পোহাতেই তা ডজনে উন্নীত হয়ে যেতে পারে। আপনার পরিবার থানা পর্যন্ত এগোতে পারলে হয়তো একটা জিডি করে রাখতে পারে, কিন্তু আপনি এগিয়ে এসে পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে পারবেন–সেই গ্যারান্টি নেই। তাই বলছি কি ভাই, সব জায়গায় এগিয়ে যেতে নেই।
প্রায় সবাই তো এগিয়ে যায়, নাম ফাটে কয়জনের? লং জাম্প বা দীর্ঘ লম্ফ প্রতিযোগিতায় এক লাফে মোটামুটি ১৯ ফুট সবাই পার হয়। কিন্তু ১৯ ফুট ৩ ইঞ্চি পার হয়ে গোল্ড মেডেল পেয়ে গেল একজন। এখানে ১৯ ফুটের কোনো দাম আছে? ওইটুকু দূরত্ব তো ১০ জন প্রতিযোগীর ৮ জনই পার হয়েছে। তাহলে মানেটা কী দাঁড়াল? পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত যে ১৯ ফুট ফাউ, গোল্ড মেডেল মাত্র ৩ ইঞ্চির জন্য। ভাই রে, ওই ৩ ইঞ্চিওয়ালারাই আমাদের উন্নয়নের ধারক ও বাহক। বাকি ১০ জন যতই লাফালাফি করুন, সেই ১৯ ফুটের ফেরেই আটকে থাকবেন।
অবশ্য কেউ কেউ এই ভাগ্য নিয়েও দুনিয়াতে আসে যে বাকি ১০ জনই তাকে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেবে। তারপর সেই এগিয়ে যাওয়া লোকটা ধীরেসুস্থে সকল সুবিধা চেটেপুটে খেয়ে বাকি ১০ জনের হতভম্ব চোখের সামনে দিয়েই লারে লাপ্পা গান গাইতে গাইতে সটকে পড়বে। কীভাবে এটা সম্ভব? তাহলে শুনুন– বিপদকালে সবাই গেছে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে। ব্যাংকের সামনে বিশাল লাইন। পেছনের দিকে যারা, তারা ভাবছে-শেষমেশ টাকা পাওয়া যাবে তো? নাকি তারা কাউন্টারে যাওয়ার আগেই টাকা ফুরিয়ে যাবে! টানটান উত্তেজনা। এমন সময় লাইনের একেবারে লেজের দিকে এক ভিক্ষুকের উদয় হলো। হাত পেতে ভিক্ষা চাইতেই লাইনের লোকটি বলল, ‘মাফ কর, আগে বাড়ো…।’ চার-পাঁচজনকে পেছনে ফেলে ভিক্ষুক সামনে এগিয়ে গেল। এখানেও হাত পাতার পর লাইনের কয়েকজন শুকনো মুখে বলল, ‘আগে বাড়ো…।’ ভিক্ষুকও নাছোড়বান্দা, ভিক্ষা না নিয়ে যেন যাবেই না। এইভাবে লাইনের সবাই তাঁকে আগে পাঠাতে লাগল। একসময় দেখা গেল সবার অনুমোদন পেয়েই ভিক্ষুক একদম কাউন্টারের সামনে চলে গেল। তারপর? তারপর ভিক্ষুক ব্যাটা বিজয়ীর হাসি হেসে পকেট থেকে একটা চেক বের করল। নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে সে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে গেল। বাকি লোকগুলো বিস্ময়ের ধাক্কাটা কাটিয়ে ওঠার আগেই ভিক্ষুক পগারপার। এইবার চিন্তা করেন, আমরা বেখেয়ালে কাদের এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা পরিষ্কার করে দিই! পরে ধরা খেয়ে কপাল চাপড়াই। কিন্তু ঘটনা ঘটে গেলে কপাল কেন, অন্য কোথাও উপর্যুপরি চাপড় দিলেও লাভ হবে না বাপু।
মিখাইল গর্বাচেভের আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন সমাজতন্ত্রে পতনের ঢেউ লাগে, তখন অনেক কমিউনিস্ট সান্ত্বনাসূচক প্রবাদ শোনাতেন, ‘লাফ দিয়ে যদি বেশিদূর যেতে চাও, তাহলে খানিকটা পেছনে সরে এসো’। কিন্তু পরে দেখা গেল পেছনে সরতে সরতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, আর লাফানোর তাকতটুকুও নাই!
এর পরও কি কেউ থামে? আমরাও থামব না। ওই যে একটা গান আছে না– ‘হারজিৎ চিরদিন থাকবে, তবুও এগিয়ে যেতেই হবে…।’
মাহবুবুল আলম কবীর
ছড়াকার ও রম্যলেখক
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এটা নিয়ে অতি মাতামাতির কিছু নেই। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশসহ দুনিয়ার বেবাক দেশই এগিয়ে চলেছে। এটা ভৌগোলিক এবং বৈজ্ঞানিক সত্য। কীভাবে? পৃথিবী তো সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। বলা যায়, দৌড়ের ওপরে আছে। বিশ্রাম নেওয়ার ফুরসত তো দূর অস্ত, তার একটুও ফাঁকি দেওয়ার যো নেই।
তো, পৃথিবী সামনের দিকে ঘুরবে আর বাংলাদেশ নট নড়নচড়ন? গ্যাঁট হয়ে বসে থাকবে? তার কিন্তু উপায় নেই। প্রতিটি দেশ যেহেতু পৃথিবীরই অংশ, তাই এখানে ঘাড় ত্যাড়ামির সুযোগই নেই। জাতিসংঘের ডাকে আমেরিকা-রাশিয়া-চীন যে কেউ সাড়া না দিতে পারে, কোনো প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারে, কিন্তু সুয্যি মামা এসব আমলে নেবে না। সে পৃথিবীকে টেনেহিঁচড়ে ঘোরাবেই, সেই সঙ্গে আমরাও, মানে প্রতিটা দেশ আর কী!
সুতরাং আমরা এগোবই। বাংলার দামাল ছেলেরা ভাদাইম্যা হয়ে ঘরে বসে থাকলেও এগিয়ে যাবে। কোন ‘শ্বশুরের ছেলে’র সাধ্য–আমাদের ঠেকিয়ে রাখবে? তবে হ্যাঁ, আমরাই আমাদের প্রতিপক্ষ, নিজেরাই নিজেদের ঠেকিয়ে রাখতে সদা তৎপর। একে অন্যকে টেনে ধরে গতিটা কমিয়ে দিই। এই মহান কাজটুকু যদি না করতাম, তাহলে দেখা যেত পৃথিবীর গতিকে আমরা টেক্কা দিয়ে ফেলেছি। মহাকাশবিজ্ঞানীরা চোখ ছানাবড়া করে টেলিস্কোপে দেখতেন– পৃথিবী থেকে একটা অংশ ছিটকে বেরিয়ে তুমুল বেগে মাতৃগ্রহের দ্বিগুণ বেগে ঘুরছে! সেই টুকরাটার নাম বাংলাদেশ!
এরপরও নাকি কিছু হিসাব–নিকাশ, বিচার-বিশ্লেষণ থাকে। নানান রকম অঙ্ক কষে বিজ্ঞজনেরা বলেন, উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এসব বিশ্লেষণ শুনে আমরা নতুন করে ভাবতে থাকি–দেশ এগিয়ে গেলে আমাদেরও তো এগোতে হবে। ওই যে কবি নজরুল বলেছিলেন না–‘আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে?’ তাই সেই সকাল আনার জন্য আমরা রাত আরও গভীর করে তুলি, দেশের অন্ধকার বাড়াই।
‘বাপের আগে পোলায় ছোটে’-র মতো করে দেশ এগিয়ে যাওয়ার আগেই আমরা এগোতে থাকি। যেখানে যা দেখি খাবলা মেরে করায়ত্ত করতে চাই। একেকজনের পেট যেন হাবিয়া দোজখের মতো, দে দে খাই খাই। পেট আর ভরে না! গাছেরটা খাই, তলারটা কুড়াই, মওকা পেলে মাঝেও হাত বুলিয়ে খামচে–আঁচড়ে যাচাই করি– খেজুরের রসের মতো এখানেও যদি কিছু মেলে! লাভের ওপর লাভ করার ধান্দায় আমাদের সব ছোটাছুটি। কেউ ছোটে ঝাড়া হাত-পা নিয়ে, কিছু পেলেই যেন খপ করে তুলে নেওয়া যায়। আবার কেউ ছোটে বেশ আয়োজন করে, একেবারে গাট্টিবোঁচকা, লোটা-কম্বল, চুলাচাক্কি নিয়ে। সবাই কেবল সামনের দিকে ধেয়ে চলে, এগিয়ে যেতে না পারলে তো জীবনই বৃথা! অথচ সামনে কী আছে, কেউ জানে না। ‘যাইতাছি তো যাইতাছি, কই যাইতাছি জানি না।’
ব্যক্তি হচ্ছে সমাজ তথা রাষ্ট্রের অণু। তাই ব্যক্তির উন্নয়ন হলেই দেশের উন্নয়ন সম্ভব। আমাদের এক সাবেক নেতাও বলেছিলেন, ‘৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে।’ তাঁর অনুসারীরাও এই স্লোগান প্রচার করতে থাকেন। এমনকি দেশে গ্রামের সংখ্যা ৮৪ হাজার পেরিয়ে গেলেও তাদের বক্তৃতা-বিবৃতি, স্লোগান, ব্যানার-পোস্টারে সেই ৬৮ হাজারই রয়ে গেল! নেতার মুখের বাণী বলে কথা! বাসি হলেও ঠিক। ধ্রুব সত্য। ভাবটা যেন–‘কইছি তো কইছিই, একটাও কমামু না, বাড়ামুও না।’
সেই মোতাবেক রাষ্ট্রের অণু হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিরা ব্যক্তিগত উন্নয়নে মন দেন। রাষ্ট্র তথা জনগণের টাকা-সম্পদ লুট করে তাদের ‘প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন’ অবস্থা। এই শিক্ষিত সিঁধেল চোরেরা করোনা মহামারির সংকটেও জাতিকে জিম্মি করে আখের গুছিয়ে নেয়। চুরি-চামারি, ছিনতাই-রাহাজানি, চড়া দামে ভেজাল পণ্য বেচা, ব্যাংকঋণের টাকা পাচার, নিরীহদের ভিটেছাড়া করা, রেলের জমি গিলে খাওয়া, নদী-খাল-বন দখল, টেক্সটাইল মিলের সমান দামে জানালার পর্দা কেনা, হীরার দামে বালিশ কেনা–সব টেকনিকের প্রভূত উন্নতি হয়েছে।
কেনা হবে হাসপাতালের সুই, খরচের বিল দেখে মনে হবে আস্ত সাবমেরিন কিনে ফেলেছে! ২৫০ টাকার একেকটা সুইয়ের দাম দেখানো হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। ৪০০ টাকার বাঁকানো কাঁচি কিনে তার ভাউচার করা হয়েছে সাড়ে ১০ হাজার টাকা। ভাবছেন, কীভাবে এটা হলো? আরে ভাই, কাঁচিই বাঁকা, তার ভাউচার সোজা পথে হবে কেন? চারপাশে এমন গোপন তথ্য গিজগিজ করলেও বলা যাবে না কিছু। শুধুই ‘খেলা দেখে যান বাবু’।
জাল সনদ দাখিল করে তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকের চাকরি নিলে এখন আর ইজ্জত থাকে? দেশ এগিয়েছে না? সেই অনুযায়ী আমাদেরও তো এগোতে হবে, নাকি? তারচেয়ে বরং কাগজপত্র জাল করে আমলা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার চেষ্টা করুন। যদি লাইগ্যা যায়…। কোভিডকালে ছাত্ররা অনলাইনে পরীক্ষা পর্যন্ত দিয়ে (কখনোবা উত্তর লিখে দিচ্ছে বাপ) অটো পাস পেয়ে যাচ্ছে। কী মজার ইশকুল!
ধরুন, আপনার এলাকায় নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ‘নির্বাচিত’ শব্দটা নিয়ে যদি আপনার আপত্তি থাকে, তবে নিজের পছন্দমতো জুতসই একটা শব্দ বসিয়ে নিন, আমার আপত্তি থাকবে না। কবি বলেছেন, ‘মদ সত্য, পাত্র সত্য নয়/ যে পাত্রে ঢালিয়া খাও সেই নেশা হয়।’ সুতরাং যেভাবেই গদিতে বসুন না কেন, তিনিই চেয়ারম্যান। ক্ষমতা তাঁর পদতলে নেড়ি কুকুরের মতো লুটোপুটি খায়।
তিনি ক্ষমতায় আসার বছর না পেরোতেই এলাকায় চুরি-ডাকাতি, খুন-ধর্ষণ , গুম বাড়তে লাগল। এসব দেখে আপনি হয়তো বিবেকের তাড়নায় (ওটা যদি তখনো থেকে থাকে আর কি!) চেয়ারম্যানের সামনে এগিয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘গত কয়েক মাসে এলাকায় খুন হয়েছে চারটি, ধর্ষণ তিনটি, সর্বশেষ গতকাল যে ১১ নম্বর গুমটি হলো–চেয়ারম্যান হিসেবে আপনার কী বক্তব্য।’ চেয়ারম্যান সাহেব সেই গৎবাঁধা জবাবটা দিয়ে দেবেন, ‘আমার আগের চেয়ারম্যানের আমলে খুন হয়েছিল ৭টি, ধর্ষণ ৯টি আর গুম হয়েছিল ১৭ জন। তাহলে আমার ব্যর্থতাটা কোথায়?’
চেয়ারম্যানের এই জবাবের পরেও কি আপনি আরেকটু এগিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নেবেন? আগ বাড়িয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়বেন– ‘তাহলে খুন-ধর্ষণ-গুম… এসব ঘটার ক্ষেত্রে আপনার টার্গেট কত? বিরোধীপক্ষের সঙ্গে ড্র করবেন? নাকি আরেকটু এগিয়ে যাবেন? ব্যস, কপাল পুড়ল আপনার। এলাকায় যে গুমের সংখ্যা ১১টি ছিল, রাত পোহাতেই তা ডজনে উন্নীত হয়ে যেতে পারে। আপনার পরিবার থানা পর্যন্ত এগোতে পারলে হয়তো একটা জিডি করে রাখতে পারে, কিন্তু আপনি এগিয়ে এসে পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে পারবেন–সেই গ্যারান্টি নেই। তাই বলছি কি ভাই, সব জায়গায় এগিয়ে যেতে নেই।
প্রায় সবাই তো এগিয়ে যায়, নাম ফাটে কয়জনের? লং জাম্প বা দীর্ঘ লম্ফ প্রতিযোগিতায় এক লাফে মোটামুটি ১৯ ফুট সবাই পার হয়। কিন্তু ১৯ ফুট ৩ ইঞ্চি পার হয়ে গোল্ড মেডেল পেয়ে গেল একজন। এখানে ১৯ ফুটের কোনো দাম আছে? ওইটুকু দূরত্ব তো ১০ জন প্রতিযোগীর ৮ জনই পার হয়েছে। তাহলে মানেটা কী দাঁড়াল? পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত যে ১৯ ফুট ফাউ, গোল্ড মেডেল মাত্র ৩ ইঞ্চির জন্য। ভাই রে, ওই ৩ ইঞ্চিওয়ালারাই আমাদের উন্নয়নের ধারক ও বাহক। বাকি ১০ জন যতই লাফালাফি করুন, সেই ১৯ ফুটের ফেরেই আটকে থাকবেন।
অবশ্য কেউ কেউ এই ভাগ্য নিয়েও দুনিয়াতে আসে যে বাকি ১০ জনই তাকে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেবে। তারপর সেই এগিয়ে যাওয়া লোকটা ধীরেসুস্থে সকল সুবিধা চেটেপুটে খেয়ে বাকি ১০ জনের হতভম্ব চোখের সামনে দিয়েই লারে লাপ্পা গান গাইতে গাইতে সটকে পড়বে। কীভাবে এটা সম্ভব? তাহলে শুনুন– বিপদকালে সবাই গেছে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে। ব্যাংকের সামনে বিশাল লাইন। পেছনের দিকে যারা, তারা ভাবছে-শেষমেশ টাকা পাওয়া যাবে তো? নাকি তারা কাউন্টারে যাওয়ার আগেই টাকা ফুরিয়ে যাবে! টানটান উত্তেজনা। এমন সময় লাইনের একেবারে লেজের দিকে এক ভিক্ষুকের উদয় হলো। হাত পেতে ভিক্ষা চাইতেই লাইনের লোকটি বলল, ‘মাফ কর, আগে বাড়ো…।’ চার-পাঁচজনকে পেছনে ফেলে ভিক্ষুক সামনে এগিয়ে গেল। এখানেও হাত পাতার পর লাইনের কয়েকজন শুকনো মুখে বলল, ‘আগে বাড়ো…।’ ভিক্ষুকও নাছোড়বান্দা, ভিক্ষা না নিয়ে যেন যাবেই না। এইভাবে লাইনের সবাই তাঁকে আগে পাঠাতে লাগল। একসময় দেখা গেল সবার অনুমোদন পেয়েই ভিক্ষুক একদম কাউন্টারের সামনে চলে গেল। তারপর? তারপর ভিক্ষুক ব্যাটা বিজয়ীর হাসি হেসে পকেট থেকে একটা চেক বের করল। নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে সে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে গেল। বাকি লোকগুলো বিস্ময়ের ধাক্কাটা কাটিয়ে ওঠার আগেই ভিক্ষুক পগারপার। এইবার চিন্তা করেন, আমরা বেখেয়ালে কাদের এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা পরিষ্কার করে দিই! পরে ধরা খেয়ে কপাল চাপড়াই। কিন্তু ঘটনা ঘটে গেলে কপাল কেন, অন্য কোথাও উপর্যুপরি চাপড় দিলেও লাভ হবে না বাপু।
মিখাইল গর্বাচেভের আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন সমাজতন্ত্রে পতনের ঢেউ লাগে, তখন অনেক কমিউনিস্ট সান্ত্বনাসূচক প্রবাদ শোনাতেন, ‘লাফ দিয়ে যদি বেশিদূর যেতে চাও, তাহলে খানিকটা পেছনে সরে এসো’। কিন্তু পরে দেখা গেল পেছনে সরতে সরতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, আর লাফানোর তাকতটুকুও নাই!
এর পরও কি কেউ থামে? আমরাও থামব না। ওই যে একটা গান আছে না– ‘হারজিৎ চিরদিন থাকবে, তবুও এগিয়ে যেতেই হবে…।’
মাহবুবুল আলম কবীর
ছড়াকার ও রম্যলেখক
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪