নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা
পার্বত্য এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে ‘অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরকালে একটি পৃথক বোর্ড গঠনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এর ছয় মাস পর ভূমি প্রশাসন ও ভূমিসংস্কারমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত রাঙামাটি সার্কিট হাউসে ১৯৭৩ সালের ৯ আগস্ট এক সুধী সমাবেশে জাতির পিতার পক্ষে এ এলাকার জন্য একটি পৃথক বোর্ড গঠনের ঘোষণা দেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত চিন্তাপ্রসূত একটি প্রতিষ্ঠান।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চার দশকের অধিক সময় পার্বত্য অঞ্চলের জনকল্যাণে গ্রামীণ সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও সেচ, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি, সমাজকল্যাণ, পর্যটন স্পট উন্নয়ন, শিশুশিক্ষা ও মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন ও জীবিকার্জনের লক্ষ্যে গাভি পালন প্রকল্প এবং উন্নত জাতের বাঁশ চাষ প্রকল্প, আইসিটি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবসম্পদ সৃষ্টি, প্রত্যন্ত এলাকায় বিনা মূল্যে সোলার প্যানেল বিতরণ, মিশ্র ফল ও মসলা চাষ প্রকল্প ইত্যাদি বাস্তবায়নের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
ভৌত অবকাঠামো নির্মাণকাজে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড তিন পার্বত্য জেলায় বিগত ১০ বছরে ১ হাজার ৪১২ কোটি টাকা ব্যয়ে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি ৩ হাজার ৯৮টি স্কিম ও ২৩৬টি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প সমাপ্ত করেছে। গত এক দশকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল এবং দেশের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যয়নরত বিভিন্ন জাতি–গোষ্ঠীর মেধাবী, গরিব ও অসচ্ছল প্রায় ১৩ হাজার ৫৬৩ জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে প্রতিবছর ২ কোটি টাকার শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে।
নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্যবিমোচন ও বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসচ্ছল ও প্রান্তিক পরিবারের উন্নয়নে গাভি পালন প্রকল্পের আওতায় তিন পার্বত্য জেলার ১৩টি উপজেলায় এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩০০ জন দুস্থ নারীকে গাভি বিতরণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে গাভিগুলো থেকে ৫০০টির অধিক বাছুরের জন্ম হয়েছে। প্রকল্পের আওতাভুক্ত নারীরা গাভি পালন করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর আয়বর্ধক কর্মসূচি হিসেবে উন্নত জাতের বাঁশ উৎপাদন প্রকল্পের ১৩ হাজার উপকারভোগী নারীকে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদানপূর্বক প্রত্যেককে ২৩৫টি করে বাঁশের চারা প্রদান করা হয়েছে। বাঁশভিত্তিক রপ্তানিমুখী ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প স্থাপনের জন্য ২৬০ জন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ প্রদানের পর প্রত্যেককে ইতিমধ্যে ৫০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে। উর্বর জমিতে সৃজিত বাঁশগুলো ক্রমান্বয়ে বড় হচ্ছে। উৎপাদিত বাঁশগুলো বিক্রি করে উপকারভোগী নারীদের জীবনমানের উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়।
সোলার প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রকল্পের লক্ষ্য অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখানে আগামী ১৫ থেকে ২০ বছরে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে না, ১০ হাজার ৮৯০টি সোলার হোম সিস্টেম, ৫ হাজার ৮৯০টি মোবাইল চার্জার এবং ২ হাজার ৮১৫টি সোলার কমিউনিটি সিস্টেম বিতরণ করা হয়েছে। পাড়াকেন্দ্রসমূহ ডিজিটালাইজড করার লক্ষ্যে পাড়াকেন্দ্রে সোলার কমিউনিটি সিস্টেম ও সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনের ফলে দুর্গম এলাকার ছাত্রছাত্রীরা রাতে লেখাপড়া করতে পারছে আর পুরুষ ও নারীরা আয়বর্ধনমূলক হস্তশিল্পের কাজে নিয়োজিত হতে পেরেছে।
মিশ্র ফল চাষ প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে তিন পার্বত্য জেলায় ৫ হাজারটি মিশ্র ফলের বাগান সৃজন করা হয়েছে। সৃজিত বাগানগুলোতে ফলন আসা শুরু হয়েছে। এ ছাড়া প্রত্যন্ত এলাকায় উচ্চমূল্যের মসলা চাষ প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে ১ হাজার ৮০০টি মসলাবাগান সৃজন করা হয়েছে এবং আরও ৮০০টি মসলাবাগান সৃজন প্রক্রিয়াধীন। নির্বাচিত ২ হাজার ৬০০ কৃষককে মসলাগাছ রোপণপদ্ধতি ও পরিচর্যাকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। ১ হাজার ৮০০ উপকারভোগীর মাঝে মসলার চারা-কলম, ট্যাবলেট সার, কৃষি যন্ত্রপাতি ও বিভিন্ন প্রজাতির সবজি বীজ প্রদান করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও ইউনিসেফের যৌথ অর্থায়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের আওতায় শিশুদের স্কুলমুখীকরণের লক্ষ্যে ৪ হাজার ৫০০টি পাড়াকেন্দ্রে স্থানীয় ভাষায় প্রাক্–শিক্ষা ও প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পাড়াকেন্দ্রে ৩-৬ বছর বয়সী ৫৪ হাজার ৪৪২ জন শিশু প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় দুর্গম অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য ৪টি আবাসিক বিদ্যালয় পরিচালনা করা হচ্ছে। এই ৪টি স্কুলে প্রতিবছর ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী সম্পূর্ণ বিনা খরচে থাকা–খাওয়াসহ যাবতীয় শিক্ষাসুবিধা পাচ্ছে। ৪ হাজার ৩০০ পাড়াকেন্দ্রে করোনা প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতামূলক বিশেষ উঠান বৈঠকের আয়োজন ও বাড়ি পরিদর্শনের মাধ্যমে পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে। ‘আমার শিশু ঘরে থাকে ঘরে শেখে’ নামের বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য শিক্ষা উপকরণ তৈরি ও শিখনপদ্ধতির ওপর গাইডলাইন বিতরণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় তিন পার্বত্য জেলার প্রতিটি উপজেলায় স্থায়ী কাঠামোতে মডেল পাড়াকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।
আইসিটি প্রকল্পের আওতায় দুই মেয়াদে ৬০০ জন স্থানীয় বেকার যুবক-যুবতীকে কম্পিউটার বিষয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ এবং ২০০ জনকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ এবং ১৫০ জনকে আউটসোর্সিং বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪৪ জন আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রান্তিক ও দরিদ্র কৃষকদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে কমলা ও মিশ্র ফসল চাষ প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ৬০ পরিবারকে কমলা, বিভিন্ন মিশ্র ফলের চারা ও প্রশিক্ষণ প্রদান ও কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পসমূহের মধ্যে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে খাগড়াছড়ি জেলার উপজেলা সদর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংযোগ সড়ক নির্মাণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার সদর উপজেলার জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে নয়নপুর মসজিদ থেকে বটতলী পর্যন্ত মাস্টার ড্রেন নির্মাণ প্রকল্পের কার্যক্রম সমাপ্ত হয়েছে এবং অন্যান্য বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে তিন পার্বত্য জেলায় ৪ হাজার ৩০০ পাড়াকেন্দ্রের মাধ্যমে ৪ হাজার ৩০০ গ্রামে একযোগে মাত্র এক ঘণ্টায় ১ লাখ ৪০ হাজার পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন জাতের ফলদ বৃক্ষ রোপণ করা হয়েছে। ১১-১৫ জানুয়ারি ২০২০ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় অ্যাডভেঞ্চার উৎসব ২০২০’-এর আয়োজন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড দেশ–বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছে। এ উৎসবে দেশ-বিদেশের ১০০ জন অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী তরুণ-তরুণী বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেছে। এ বছরও ১১-১৫ জানুয়ারি ‘বঙ্গবন্ধু অ্যাডভেঞ্চার উৎসব ২০২১’–এ পাহাড় ও সমতলের ১০০ জন তরুণ-তরুণী বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্চার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছে। পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর সফর নিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ ‘চরণরেখা তবঃ বঙ্গবন্ধু ও পার্বত্য চট্টগ্রাম’ প্রকাশ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে পার্বত্য এলাকায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সফর সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে। এ ছাড়া রাঙামাটির বেতবুনিয়ার বাংলাদেশের প্রথম উপগ্রহ ভূকেন্দ্র বেতবুনিয়া স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশনে নির্মিত ১০০ ফুট দীর্ঘ ও ৭১ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে। উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়ায় ভূ–উপগ্রহ কেন্দ্রটির উদ্বোধন করেছিলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের কল্যাণে ও জনগণকে সচেতন করার জন্য করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে মোট ২০টি স্প্রে মেশিন হস্তান্তর করা হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলার সদর হাসপাতালে ৪৫টি অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং রাঙামাটি পুলিশ হাসপাতালে ২টিসহ মোট ৪৭টি অক্সিজেন সিলিন্ডার ও ফ্লোমিটা বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন প্রকল্পের আওতাভুক্ত ৬ হাজার পরিবারকে সবজি বীজ ও কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণ করা হয়েছে।
সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে দুই দশক ধরে চলমান সংঘাতের পর ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের মূল স্রোতোধারার সঙ্গে সংযুক্ত হতে পেরেছে। এরপর এ অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে, যা ইতিমধ্যে তিন পার্বত্য জেলায় দৃশ্যমান ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আর্থসামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিগত চার দশকের নিরলস প্রচেষ্টার স্বীকৃতিস্বরূপ পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কার ‘ICIMOD Mountain Prize-2019’ অর্জন করেছে। পার্বত্য এলাকার কোনো সংস্থার এটিই প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা
সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার
পার্বত্য এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে ‘অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরকালে একটি পৃথক বোর্ড গঠনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এর ছয় মাস পর ভূমি প্রশাসন ও ভূমিসংস্কারমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত রাঙামাটি সার্কিট হাউসে ১৯৭৩ সালের ৯ আগস্ট এক সুধী সমাবেশে জাতির পিতার পক্ষে এ এলাকার জন্য একটি পৃথক বোর্ড গঠনের ঘোষণা দেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত চিন্তাপ্রসূত একটি প্রতিষ্ঠান।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চার দশকের অধিক সময় পার্বত্য অঞ্চলের জনকল্যাণে গ্রামীণ সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও সেচ, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি, সমাজকল্যাণ, পর্যটন স্পট উন্নয়ন, শিশুশিক্ষা ও মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন ও জীবিকার্জনের লক্ষ্যে গাভি পালন প্রকল্প এবং উন্নত জাতের বাঁশ চাষ প্রকল্প, আইসিটি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবসম্পদ সৃষ্টি, প্রত্যন্ত এলাকায় বিনা মূল্যে সোলার প্যানেল বিতরণ, মিশ্র ফল ও মসলা চাষ প্রকল্প ইত্যাদি বাস্তবায়নের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
ভৌত অবকাঠামো নির্মাণকাজে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড তিন পার্বত্য জেলায় বিগত ১০ বছরে ১ হাজার ৪১২ কোটি টাকা ব্যয়ে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি ৩ হাজার ৯৮টি স্কিম ও ২৩৬টি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প সমাপ্ত করেছে। গত এক দশকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল এবং দেশের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যয়নরত বিভিন্ন জাতি–গোষ্ঠীর মেধাবী, গরিব ও অসচ্ছল প্রায় ১৩ হাজার ৫৬৩ জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে প্রতিবছর ২ কোটি টাকার শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে।
নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্যবিমোচন ও বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসচ্ছল ও প্রান্তিক পরিবারের উন্নয়নে গাভি পালন প্রকল্পের আওতায় তিন পার্বত্য জেলার ১৩টি উপজেলায় এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩০০ জন দুস্থ নারীকে গাভি বিতরণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে গাভিগুলো থেকে ৫০০টির অধিক বাছুরের জন্ম হয়েছে। প্রকল্পের আওতাভুক্ত নারীরা গাভি পালন করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর আয়বর্ধক কর্মসূচি হিসেবে উন্নত জাতের বাঁশ উৎপাদন প্রকল্পের ১৩ হাজার উপকারভোগী নারীকে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদানপূর্বক প্রত্যেককে ২৩৫টি করে বাঁশের চারা প্রদান করা হয়েছে। বাঁশভিত্তিক রপ্তানিমুখী ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প স্থাপনের জন্য ২৬০ জন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ প্রদানের পর প্রত্যেককে ইতিমধ্যে ৫০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে। উর্বর জমিতে সৃজিত বাঁশগুলো ক্রমান্বয়ে বড় হচ্ছে। উৎপাদিত বাঁশগুলো বিক্রি করে উপকারভোগী নারীদের জীবনমানের উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়।
সোলার প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রকল্পের লক্ষ্য অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখানে আগামী ১৫ থেকে ২০ বছরে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে না, ১০ হাজার ৮৯০টি সোলার হোম সিস্টেম, ৫ হাজার ৮৯০টি মোবাইল চার্জার এবং ২ হাজার ৮১৫টি সোলার কমিউনিটি সিস্টেম বিতরণ করা হয়েছে। পাড়াকেন্দ্রসমূহ ডিজিটালাইজড করার লক্ষ্যে পাড়াকেন্দ্রে সোলার কমিউনিটি সিস্টেম ও সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনের ফলে দুর্গম এলাকার ছাত্রছাত্রীরা রাতে লেখাপড়া করতে পারছে আর পুরুষ ও নারীরা আয়বর্ধনমূলক হস্তশিল্পের কাজে নিয়োজিত হতে পেরেছে।
মিশ্র ফল চাষ প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে তিন পার্বত্য জেলায় ৫ হাজারটি মিশ্র ফলের বাগান সৃজন করা হয়েছে। সৃজিত বাগানগুলোতে ফলন আসা শুরু হয়েছে। এ ছাড়া প্রত্যন্ত এলাকায় উচ্চমূল্যের মসলা চাষ প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে ১ হাজার ৮০০টি মসলাবাগান সৃজন করা হয়েছে এবং আরও ৮০০টি মসলাবাগান সৃজন প্রক্রিয়াধীন। নির্বাচিত ২ হাজার ৬০০ কৃষককে মসলাগাছ রোপণপদ্ধতি ও পরিচর্যাকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। ১ হাজার ৮০০ উপকারভোগীর মাঝে মসলার চারা-কলম, ট্যাবলেট সার, কৃষি যন্ত্রপাতি ও বিভিন্ন প্রজাতির সবজি বীজ প্রদান করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও ইউনিসেফের যৌথ অর্থায়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের আওতায় শিশুদের স্কুলমুখীকরণের লক্ষ্যে ৪ হাজার ৫০০টি পাড়াকেন্দ্রে স্থানীয় ভাষায় প্রাক্–শিক্ষা ও প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পাড়াকেন্দ্রে ৩-৬ বছর বয়সী ৫৪ হাজার ৪৪২ জন শিশু প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় দুর্গম অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য ৪টি আবাসিক বিদ্যালয় পরিচালনা করা হচ্ছে। এই ৪টি স্কুলে প্রতিবছর ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী সম্পূর্ণ বিনা খরচে থাকা–খাওয়াসহ যাবতীয় শিক্ষাসুবিধা পাচ্ছে। ৪ হাজার ৩০০ পাড়াকেন্দ্রে করোনা প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতামূলক বিশেষ উঠান বৈঠকের আয়োজন ও বাড়ি পরিদর্শনের মাধ্যমে পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে। ‘আমার শিশু ঘরে থাকে ঘরে শেখে’ নামের বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য শিক্ষা উপকরণ তৈরি ও শিখনপদ্ধতির ওপর গাইডলাইন বিতরণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় তিন পার্বত্য জেলার প্রতিটি উপজেলায় স্থায়ী কাঠামোতে মডেল পাড়াকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।
আইসিটি প্রকল্পের আওতায় দুই মেয়াদে ৬০০ জন স্থানীয় বেকার যুবক-যুবতীকে কম্পিউটার বিষয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ এবং ২০০ জনকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ এবং ১৫০ জনকে আউটসোর্সিং বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪৪ জন আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রান্তিক ও দরিদ্র কৃষকদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে কমলা ও মিশ্র ফসল চাষ প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ৬০ পরিবারকে কমলা, বিভিন্ন মিশ্র ফলের চারা ও প্রশিক্ষণ প্রদান ও কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পসমূহের মধ্যে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে খাগড়াছড়ি জেলার উপজেলা সদর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংযোগ সড়ক নির্মাণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার সদর উপজেলার জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে নয়নপুর মসজিদ থেকে বটতলী পর্যন্ত মাস্টার ড্রেন নির্মাণ প্রকল্পের কার্যক্রম সমাপ্ত হয়েছে এবং অন্যান্য বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে তিন পার্বত্য জেলায় ৪ হাজার ৩০০ পাড়াকেন্দ্রের মাধ্যমে ৪ হাজার ৩০০ গ্রামে একযোগে মাত্র এক ঘণ্টায় ১ লাখ ৪০ হাজার পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন জাতের ফলদ বৃক্ষ রোপণ করা হয়েছে। ১১-১৫ জানুয়ারি ২০২০ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় অ্যাডভেঞ্চার উৎসব ২০২০’-এর আয়োজন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড দেশ–বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছে। এ উৎসবে দেশ-বিদেশের ১০০ জন অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী তরুণ-তরুণী বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেছে। এ বছরও ১১-১৫ জানুয়ারি ‘বঙ্গবন্ধু অ্যাডভেঞ্চার উৎসব ২০২১’–এ পাহাড় ও সমতলের ১০০ জন তরুণ-তরুণী বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্চার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছে। পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর সফর নিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ ‘চরণরেখা তবঃ বঙ্গবন্ধু ও পার্বত্য চট্টগ্রাম’ প্রকাশ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে পার্বত্য এলাকায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সফর সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে। এ ছাড়া রাঙামাটির বেতবুনিয়ার বাংলাদেশের প্রথম উপগ্রহ ভূকেন্দ্র বেতবুনিয়া স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশনে নির্মিত ১০০ ফুট দীর্ঘ ও ৭১ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে। উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়ায় ভূ–উপগ্রহ কেন্দ্রটির উদ্বোধন করেছিলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের কল্যাণে ও জনগণকে সচেতন করার জন্য করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে মোট ২০টি স্প্রে মেশিন হস্তান্তর করা হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলার সদর হাসপাতালে ৪৫টি অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং রাঙামাটি পুলিশ হাসপাতালে ২টিসহ মোট ৪৭টি অক্সিজেন সিলিন্ডার ও ফ্লোমিটা বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন প্রকল্পের আওতাভুক্ত ৬ হাজার পরিবারকে সবজি বীজ ও কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণ করা হয়েছে।
সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে দুই দশক ধরে চলমান সংঘাতের পর ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের মূল স্রোতোধারার সঙ্গে সংযুক্ত হতে পেরেছে। এরপর এ অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে, যা ইতিমধ্যে তিন পার্বত্য জেলায় দৃশ্যমান ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আর্থসামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিগত চার দশকের নিরলস প্রচেষ্টার স্বীকৃতিস্বরূপ পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কার ‘ICIMOD Mountain Prize-2019’ অর্জন করেছে। পার্বত্য এলাকার কোনো সংস্থার এটিই প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা
সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪