এ কে এম শামসুদ্দিন
প্রতিদিনের ঘটনা বা গল্পই আগামী দিনের ইতিহাস। এই গল্পে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা থাকে। ইতিহাস আমাদের পায়ের নিচের মাটিকে শক্ত করে। সে ইতিহাস গৌরবময় হলে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শক্তি জোগায়; ন্যায়ের অজুহাতে শক্তিধর শাসকের অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রবণতাকে লজ্জা দেয়। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের সবারই নিজেদের ইতিহাস জানা দরকার। কিন্তু যে ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতাসংগ্রামের ফলে বিশ্ব দরবারে বাঙালির জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার প্রকৃত ইতিহাসচর্চা আমরা কতজন করি? দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, যে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, সেই ঘটনাবহুল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের নতুন প্রজন্মের বেশির ভাগের কাছেই অস্পষ্ট ও অস্বচ্ছ। তাদের কাছে স্বাধীনতা মানেই ১৯৭১ সালে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাস যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করা। কিন্তু যে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্টের বিজয়, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ৬ দফা, উনসত্তরের গণ–আন্দোলন, সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরষ্কুশ জয়লাভ, অতঃপর সশস্ত্র যুদ্ধের পথ ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে–এ প্রজন্মের কতজনের চেতনায় সে ধারাবাহিক ইতিহাস উদ্ভাসিত হয়? স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও আমরা আমাদের উত্তরসূরিদের মুক্তিযুদ্ধের পরিপূর্ণ ইতিহাস জানাতে পারিনি। এটি আমাদের অনেক বড় ব্যর্থতা। এ বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপিত হচ্ছে। এই সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়, সভা-সমাবেশ, আলোচনা সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের যে আয়োজন করা হয়েছে, সেসব অনুষ্ঠানেও কি আমরা স্বাধীনতার ইতিহাসের সত্য ও সুন্দর রূপ তুলে ধরতে পেরেছি?
আমাদের তরুণদের ভেতর এমনিতেই ইতিহাসচর্চা খুব কম হয়। নতুন প্রজন্মের নাগরিকরা যখন একসঙ্গে বসে আড্ডা দেয় তখন মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটি খুব কমই আলোচিত হয়। বছর ঘুরে যখন স্বাধীনতা বা বিজয় দিবস ফিরে আসে, তখন ওই একটি দিনেই মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিযুদ্ধের কথা বেশি বেশি আলোচিত হয়। বিভিন্ন মিডিয়া এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বছরের অন্যান্য সময় তো নয়ই, এসব বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানেও স্বাধীনতার পটভূমিতে শের–ই–বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, এমনকি মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় চার নেতার অতুলনীয় আত্মত্যাগের কথা কমই আলোচনা হয়। ফলে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে জাতীয় এই নেতাদের সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের ধারণা স্পষ্ট নয়। এ প্রসঙ্গে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা পদে চাকরির ইন্টারভিউ বোর্ডের একজন সদস্য হিসেবে আমার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করতে চাই। ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় চাকরিপ্রার্থীদের জন্য আমার একটি কমন প্রশ্ন থাকত। প্রশ্নটি ছিল, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে কবে’? প্রশ্নটি সহজ হলেও উত্তর শুনে অবাক হতাম। অধিকাংশ প্রার্থীর উত্তর ছিল, ১৬ ডিসেম্বর। উত্তর শুনে পাল্টা জিজ্ঞেস করতাম, ‘তাহলে স্বাধীনতা দিবস কবে’? তাঁদের উত্তর, ২৬ মার্চ। ১৬ ডিসেম্বর যদি দেশ স্বাধীন হয়ে থাকে তাহলে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস হয় কী করে, জিজ্ঞেস করতেই প্রার্থীরা কনফিউজড হয়ে তাকিয়ে থাকতেন। স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের তাৎপর্য ও পার্থক্য যাঁরা বোঝেন না, তাঁরা স্বাধীনতার পটভূমি সম্পর্কে কতটুকু জানবে, তা বলাই বাহুল্য। আমি ইন্টারভিউ বোর্ডে অবাক হয়ে লক্ষ করেছি, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর নাম জিজ্ঞেস করায় প্রায় সবাই উত্তর দিয়েছেন, ‘বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’! বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের নাম খুব কম প্রার্থীই উত্তর দিয়েছেন। আমি এ ধরনের প্রায় সাতটি ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্য কিংবা সভাপতি হিসেবে আনুমানিক ১০–১২ হাজার প্রার্থীর ইন্টারভিউ নিয়েছি। শতকরা হিসাবে, মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ প্রার্থীর কাছ থেকে এ দুটি সহজ প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেয়েছি।
এ কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবদান অনস্বীকার্য। একটি কথা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি, বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। কথাটি শতভাগ সত্য। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্থপতি, এ কথা যিনি স্বীকার করেন না, তিনি যেন এ দেশের নাগরিক হিসেবে নিজেকেই অস্বীকার করলেন। বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী, তখন মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে সামনে রেখেই শত্রুর মোকাবিলা করে দেশকে স্বাধীন করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে কোনো কিছু দিয়েই পরিমাপ করা যায় না। তাই বলে জাতীয় অন্য নেতাদের অবদানের কথা অস্বীকার করি কী করে? তাহলে যে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটবে।! তাঁরা যে আমাদের ইতিহাসেরই অংশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম কোনো একক ঘটনার গল্প নয়। ধারাবাহিক আন্দোলন ও সংগ্রামের চূড়ান্ত রূপটি পায় মুক্তিযুদ্ধে। আমার বন্ধু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিশিষ্ট গবেষক মেজর (অব.) সাইদুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়, আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম ছিল রিলে রেসের মতো। যে রেস শুরু হয়েছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন দিয়ে; যার শেষ এবং চূড়ান্ত রূপটি ছিল মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই বাঙালি চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করে। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে বিতাড়িত করে বিশ্ববাসীকে সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছিল–বাঙালি যোদ্ধার জাতি। কিন্তু ৯ মাসের সেই সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করা এত সহজ ছিল না। নানা রকম সীমাবদ্ধতার মধ্যে যে নেতারা তাঁদের প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বের গুণাবলিতে প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিলেন, তাঁদের জাতি চিরদিন স্মরণ করবে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁরই গঠিত আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান সেদিন মুক্তিযুদ্ধকে দৃঢ়তার সঙ্গে পরিচালনা করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন। অথচ প্রবাসী সরকার গঠন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করতে গিয়ে সেদিন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁদের। এ বাধা-বিপত্তি নিজ দলের সদস্যদের কাছ থেকেও এসেছিল প্রবলভাবে।
প্রবাসী সরকারের কথা বলতে গেলে প্রথমেই যার নাম করতে হয় তিনি হলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে অনেকেই আপত্তি জানিয়েছিলেন সেদিন। দলীয় নেতৃত্বের মধ্যে অনেকেই মনে করতেন তিনিই বোধ হয় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য ব্যক্তি। অনেক নেতাই তখন মুজিবনগর সরকারের সমালোচক ছিলেন। কিন্তু তাজউদ্দীন ছিলেন বহুদিনের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য তিনি পেয়েছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর অন্ধ অনুরাগী ছিলেন। শুধু তা–ই নয়, বঙ্গবন্ধুকেই তিনি তাঁর জীবনের একমাত্র নেতা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। মন ও মানসিকতার দিক থেকে তিনি অন্য নেতাদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। অন্যদের মতো সংকীর্ণ মনোবৃত্তি কখনোই তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি কর্তব্যে ছিলেন অটল, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে বজ্রকঠিন প্রত্যয় নিয়ে সেদিন জাতিকে সঠিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর চরিত্রের এসব গুণে মুগ্ধ হয়েই দলের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে অধীনস্থ বেশির ভাগ বেসামরিক কর্মচারী তাঁর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা স্থাপন করেছিলেন।
তবে ভিন্ন মনোভাব ও ভিন্ন চিন্তার স্রোতোধারার মানুষ যে ছিল না, তা নয়। প্রবাসী সরকার গঠনের প্রথম থেকেই তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে মন্ত্রিপরিষদের অন্যতম সদস্য খোন্দকার মোশতাক আহমদ চরম অসন্তুষ্ট ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ব্যক্তিগত আক্রোশ, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি ভিন্ন মনোভাব প্রকাশ করে যেকোনো কাজেই তিনি বাধা সৃষ্টি করেছেন। শুধু তা–ই নয়, প্রবাসী সরকারের অগোচরে যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা করেন। এ ছাড়া ‘মুজিবকে চাও, না স্বাধীনতা চাও? স্বাধীনতা চাইলে মুজিবকে হারাতে হবে। কোনটা চাও’? এমন তত্ত্ব ছড়িয়ে দিয়ে দলীয় নেতা–কর্মী ও সংসদ সদস্যদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছেন। খোন্দকার মোশতাকের পাশাপাশি আরও অনেকেই প্রবাসী সরকারের অনেক পদক্ষেপকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিলেন। প্রভাবশালী কিছু যুবনেতা প্রাথমিক পর্যায় থেকেই নিজেদের প্রবাসী সরকারের কর্তৃত্বের বাইরে রেখেছিলেন। যুবনেতাদের এমন ভিন্ন পথে হাঁটা প্রবাসী সরকারের জন্য কখনোই সুখকর ছিল না। তাঁদের এমন অনেক বিরূপ আচরণ মুক্তিযুদ্ধের ময়দানেও প্রভাব বিস্তার করেছিল। তা ছাড়া, বামপন্থী, ডানপন্থী সমস্যা তো ছিলই। এসব অযাচিত সমস্যা প্রবাসী সরকারকেই সামাল দিতে হয়েছে। তবে এসব কোনো কিছুই তাজউদ্দীন আহমদকে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব থেকে একবিন্দুও বিচ্যুত করতে পারেনি। এত বাধা-বিপত্তির পরও তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রেখে স্বাধীনতা অর্জনের অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পেরেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদের তখন একটাই চাওয়া ছিল, ‘আমরা মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে দেশের স্বাধীনতাও চাই’। শেষ পর্যন্ত নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে, সব বিভ্রান্তি দূর করে দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকেও ফিরে পেয়েছিল এ দেশের মানুষ।
মুক্তিযুদ্ধের সেই ক্রান্তিলগ্নে, অন্তর্ঘাতমূলক অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয়ের মধ্যেও মন্ত্রিপরিষদের অন্য সদস্যরা দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তাজউদ্দীন আহমদকে সমর্থন ও সক্রিয় সহযোগিতা করে গিয়েছেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানসহ অন্যরা একাগ্র মন নিয়ে, নিজেদের আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে পরিশ্রম করে গেছেন। স্বাধীনতার এই দীর্ঘ রেসের চূড়ান্ত পর্বে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জাতীয় নেতাদের এই অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্যপটে তাঁরা যে ভূমিকা পালন করেছেন, আমরা কি আমাদের সন্তানদের তাঁদের সেই ভূমিকার কথা বলতে পেরেছি? প্রতিবছর স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস আসে, আবার চলেও যায়। এসব জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানমালায় তাঁদের অবদানের কথা, তাঁদের আত্মত্যাগের কথা কতটুকু তুলে ধরেছি?
আজকাল অনেকের মুখে প্রায়ই শুনি বর্তমান প্রজন্মের সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানার আগ্রহ বেড়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্য দিয়ে তাদের ভেতর এই আগ্রহের জন্ম হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি শুভ লক্ষণ। তাদের এই চেতনাবোধকে আরও উসকে দিতে হবে। তাহলেই তাদের দেশপ্রেমের ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হবে। এর জন্য চাই মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তাদের সামনে তুলে ধরা। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে সবার অবদানের কথা সমানভাবে তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হলে ইতিহাসের সত্য ও সুন্দরকে উপস্থাপন করা জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধু মুখে নয়, মনেপ্রাণে, তাদের প্রতিটি কর্মকাণ্ডেই যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুরণিত হয়। মনে রাখতে হবে, সঠিক ইতিহাস জানা জরুরি শুধু সত্য কিংবা মিথ্যা নির্ণয় করার জন্য নয়; ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সত্যকে, ন্যায়কে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যও।
এ কে এম শামসুদ্দিন
অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
প্রতিদিনের ঘটনা বা গল্পই আগামী দিনের ইতিহাস। এই গল্পে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা থাকে। ইতিহাস আমাদের পায়ের নিচের মাটিকে শক্ত করে। সে ইতিহাস গৌরবময় হলে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শক্তি জোগায়; ন্যায়ের অজুহাতে শক্তিধর শাসকের অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রবণতাকে লজ্জা দেয়। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের সবারই নিজেদের ইতিহাস জানা দরকার। কিন্তু যে ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতাসংগ্রামের ফলে বিশ্ব দরবারে বাঙালির জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার প্রকৃত ইতিহাসচর্চা আমরা কতজন করি? দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, যে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, সেই ঘটনাবহুল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের নতুন প্রজন্মের বেশির ভাগের কাছেই অস্পষ্ট ও অস্বচ্ছ। তাদের কাছে স্বাধীনতা মানেই ১৯৭১ সালে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাস যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করা। কিন্তু যে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্টের বিজয়, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ৬ দফা, উনসত্তরের গণ–আন্দোলন, সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরষ্কুশ জয়লাভ, অতঃপর সশস্ত্র যুদ্ধের পথ ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে–এ প্রজন্মের কতজনের চেতনায় সে ধারাবাহিক ইতিহাস উদ্ভাসিত হয়? স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও আমরা আমাদের উত্তরসূরিদের মুক্তিযুদ্ধের পরিপূর্ণ ইতিহাস জানাতে পারিনি। এটি আমাদের অনেক বড় ব্যর্থতা। এ বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপিত হচ্ছে। এই সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়, সভা-সমাবেশ, আলোচনা সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের যে আয়োজন করা হয়েছে, সেসব অনুষ্ঠানেও কি আমরা স্বাধীনতার ইতিহাসের সত্য ও সুন্দর রূপ তুলে ধরতে পেরেছি?
আমাদের তরুণদের ভেতর এমনিতেই ইতিহাসচর্চা খুব কম হয়। নতুন প্রজন্মের নাগরিকরা যখন একসঙ্গে বসে আড্ডা দেয় তখন মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটি খুব কমই আলোচিত হয়। বছর ঘুরে যখন স্বাধীনতা বা বিজয় দিবস ফিরে আসে, তখন ওই একটি দিনেই মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিযুদ্ধের কথা বেশি বেশি আলোচিত হয়। বিভিন্ন মিডিয়া এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বছরের অন্যান্য সময় তো নয়ই, এসব বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানেও স্বাধীনতার পটভূমিতে শের–ই–বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, এমনকি মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় চার নেতার অতুলনীয় আত্মত্যাগের কথা কমই আলোচনা হয়। ফলে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে জাতীয় এই নেতাদের সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের ধারণা স্পষ্ট নয়। এ প্রসঙ্গে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা পদে চাকরির ইন্টারভিউ বোর্ডের একজন সদস্য হিসেবে আমার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করতে চাই। ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় চাকরিপ্রার্থীদের জন্য আমার একটি কমন প্রশ্ন থাকত। প্রশ্নটি ছিল, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে কবে’? প্রশ্নটি সহজ হলেও উত্তর শুনে অবাক হতাম। অধিকাংশ প্রার্থীর উত্তর ছিল, ১৬ ডিসেম্বর। উত্তর শুনে পাল্টা জিজ্ঞেস করতাম, ‘তাহলে স্বাধীনতা দিবস কবে’? তাঁদের উত্তর, ২৬ মার্চ। ১৬ ডিসেম্বর যদি দেশ স্বাধীন হয়ে থাকে তাহলে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস হয় কী করে, জিজ্ঞেস করতেই প্রার্থীরা কনফিউজড হয়ে তাকিয়ে থাকতেন। স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের তাৎপর্য ও পার্থক্য যাঁরা বোঝেন না, তাঁরা স্বাধীনতার পটভূমি সম্পর্কে কতটুকু জানবে, তা বলাই বাহুল্য। আমি ইন্টারভিউ বোর্ডে অবাক হয়ে লক্ষ করেছি, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর নাম জিজ্ঞেস করায় প্রায় সবাই উত্তর দিয়েছেন, ‘বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’! বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের নাম খুব কম প্রার্থীই উত্তর দিয়েছেন। আমি এ ধরনের প্রায় সাতটি ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্য কিংবা সভাপতি হিসেবে আনুমানিক ১০–১২ হাজার প্রার্থীর ইন্টারভিউ নিয়েছি। শতকরা হিসাবে, মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ প্রার্থীর কাছ থেকে এ দুটি সহজ প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেয়েছি।
এ কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবদান অনস্বীকার্য। একটি কথা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি, বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। কথাটি শতভাগ সত্য। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্থপতি, এ কথা যিনি স্বীকার করেন না, তিনি যেন এ দেশের নাগরিক হিসেবে নিজেকেই অস্বীকার করলেন। বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী, তখন মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে সামনে রেখেই শত্রুর মোকাবিলা করে দেশকে স্বাধীন করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে কোনো কিছু দিয়েই পরিমাপ করা যায় না। তাই বলে জাতীয় অন্য নেতাদের অবদানের কথা অস্বীকার করি কী করে? তাহলে যে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটবে।! তাঁরা যে আমাদের ইতিহাসেরই অংশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম কোনো একক ঘটনার গল্প নয়। ধারাবাহিক আন্দোলন ও সংগ্রামের চূড়ান্ত রূপটি পায় মুক্তিযুদ্ধে। আমার বন্ধু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিশিষ্ট গবেষক মেজর (অব.) সাইদুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়, আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম ছিল রিলে রেসের মতো। যে রেস শুরু হয়েছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন দিয়ে; যার শেষ এবং চূড়ান্ত রূপটি ছিল মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই বাঙালি চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করে। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে বিতাড়িত করে বিশ্ববাসীকে সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছিল–বাঙালি যোদ্ধার জাতি। কিন্তু ৯ মাসের সেই সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করা এত সহজ ছিল না। নানা রকম সীমাবদ্ধতার মধ্যে যে নেতারা তাঁদের প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বের গুণাবলিতে প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিলেন, তাঁদের জাতি চিরদিন স্মরণ করবে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁরই গঠিত আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান সেদিন মুক্তিযুদ্ধকে দৃঢ়তার সঙ্গে পরিচালনা করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন। অথচ প্রবাসী সরকার গঠন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করতে গিয়ে সেদিন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁদের। এ বাধা-বিপত্তি নিজ দলের সদস্যদের কাছ থেকেও এসেছিল প্রবলভাবে।
প্রবাসী সরকারের কথা বলতে গেলে প্রথমেই যার নাম করতে হয় তিনি হলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে অনেকেই আপত্তি জানিয়েছিলেন সেদিন। দলীয় নেতৃত্বের মধ্যে অনেকেই মনে করতেন তিনিই বোধ হয় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য ব্যক্তি। অনেক নেতাই তখন মুজিবনগর সরকারের সমালোচক ছিলেন। কিন্তু তাজউদ্দীন ছিলেন বহুদিনের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য তিনি পেয়েছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর অন্ধ অনুরাগী ছিলেন। শুধু তা–ই নয়, বঙ্গবন্ধুকেই তিনি তাঁর জীবনের একমাত্র নেতা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। মন ও মানসিকতার দিক থেকে তিনি অন্য নেতাদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। অন্যদের মতো সংকীর্ণ মনোবৃত্তি কখনোই তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি কর্তব্যে ছিলেন অটল, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে বজ্রকঠিন প্রত্যয় নিয়ে সেদিন জাতিকে সঠিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর চরিত্রের এসব গুণে মুগ্ধ হয়েই দলের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে অধীনস্থ বেশির ভাগ বেসামরিক কর্মচারী তাঁর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা স্থাপন করেছিলেন।
তবে ভিন্ন মনোভাব ও ভিন্ন চিন্তার স্রোতোধারার মানুষ যে ছিল না, তা নয়। প্রবাসী সরকার গঠনের প্রথম থেকেই তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে মন্ত্রিপরিষদের অন্যতম সদস্য খোন্দকার মোশতাক আহমদ চরম অসন্তুষ্ট ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ব্যক্তিগত আক্রোশ, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি ভিন্ন মনোভাব প্রকাশ করে যেকোনো কাজেই তিনি বাধা সৃষ্টি করেছেন। শুধু তা–ই নয়, প্রবাসী সরকারের অগোচরে যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা করেন। এ ছাড়া ‘মুজিবকে চাও, না স্বাধীনতা চাও? স্বাধীনতা চাইলে মুজিবকে হারাতে হবে। কোনটা চাও’? এমন তত্ত্ব ছড়িয়ে দিয়ে দলীয় নেতা–কর্মী ও সংসদ সদস্যদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছেন। খোন্দকার মোশতাকের পাশাপাশি আরও অনেকেই প্রবাসী সরকারের অনেক পদক্ষেপকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিলেন। প্রভাবশালী কিছু যুবনেতা প্রাথমিক পর্যায় থেকেই নিজেদের প্রবাসী সরকারের কর্তৃত্বের বাইরে রেখেছিলেন। যুবনেতাদের এমন ভিন্ন পথে হাঁটা প্রবাসী সরকারের জন্য কখনোই সুখকর ছিল না। তাঁদের এমন অনেক বিরূপ আচরণ মুক্তিযুদ্ধের ময়দানেও প্রভাব বিস্তার করেছিল। তা ছাড়া, বামপন্থী, ডানপন্থী সমস্যা তো ছিলই। এসব অযাচিত সমস্যা প্রবাসী সরকারকেই সামাল দিতে হয়েছে। তবে এসব কোনো কিছুই তাজউদ্দীন আহমদকে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব থেকে একবিন্দুও বিচ্যুত করতে পারেনি। এত বাধা-বিপত্তির পরও তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রেখে স্বাধীনতা অর্জনের অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পেরেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদের তখন একটাই চাওয়া ছিল, ‘আমরা মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে দেশের স্বাধীনতাও চাই’। শেষ পর্যন্ত নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে, সব বিভ্রান্তি দূর করে দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকেও ফিরে পেয়েছিল এ দেশের মানুষ।
মুক্তিযুদ্ধের সেই ক্রান্তিলগ্নে, অন্তর্ঘাতমূলক অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয়ের মধ্যেও মন্ত্রিপরিষদের অন্য সদস্যরা দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তাজউদ্দীন আহমদকে সমর্থন ও সক্রিয় সহযোগিতা করে গিয়েছেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানসহ অন্যরা একাগ্র মন নিয়ে, নিজেদের আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে পরিশ্রম করে গেছেন। স্বাধীনতার এই দীর্ঘ রেসের চূড়ান্ত পর্বে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জাতীয় নেতাদের এই অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্যপটে তাঁরা যে ভূমিকা পালন করেছেন, আমরা কি আমাদের সন্তানদের তাঁদের সেই ভূমিকার কথা বলতে পেরেছি? প্রতিবছর স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস আসে, আবার চলেও যায়। এসব জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানমালায় তাঁদের অবদানের কথা, তাঁদের আত্মত্যাগের কথা কতটুকু তুলে ধরেছি?
আজকাল অনেকের মুখে প্রায়ই শুনি বর্তমান প্রজন্মের সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানার আগ্রহ বেড়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্য দিয়ে তাদের ভেতর এই আগ্রহের জন্ম হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি শুভ লক্ষণ। তাদের এই চেতনাবোধকে আরও উসকে দিতে হবে। তাহলেই তাদের দেশপ্রেমের ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হবে। এর জন্য চাই মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তাদের সামনে তুলে ধরা। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে সবার অবদানের কথা সমানভাবে তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হলে ইতিহাসের সত্য ও সুন্দরকে উপস্থাপন করা জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধু মুখে নয়, মনেপ্রাণে, তাদের প্রতিটি কর্মকাণ্ডেই যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুরণিত হয়। মনে রাখতে হবে, সঠিক ইতিহাস জানা জরুরি শুধু সত্য কিংবা মিথ্যা নির্ণয় করার জন্য নয়; ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সত্যকে, ন্যায়কে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যও।
এ কে এম শামসুদ্দিন
অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪