ইমতিয়াজ মাহমুদ
বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে এবং বেশ ভালো গতিতেই যে অগ্রসর হচ্ছে, এ কথা তো আর অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই। যেটাকে বলে উন্নয়ন, সেই জিনিস যে তরতর করে হচ্ছে, সেটা তো দৃশ্যমান দিনের আলোতে এবং রাতের অন্ধকারেও। অন্ধকারে কীভাবে উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়? অন্ধকার তো হচ্ছে চোরদের সময়, বাংলাদেশের বড় চোর যারা, ওরা এখন চুরিও করে হাজার কোটি টাকার হিসাবে আর মাঝারি চোরেরা শতকোটি টাকার হিসাবে। অথচ এই দেশের প্রথম বাজেট, যেটা আমাদের তাজউদ্দীন আহমদ দিয়েছিলেন, সেটার সর্বমোট অঙ্কই ছিল সাড়ে সাত শ কোটি টাকার মতো, আর তৃতীয় বাজেটের আকার ছিল এক হাজার কোটি টাকার। আর আজকের বাজেটের আকার কী, সেটা আপনারা জানেন। যে অর্থবছরটা শেষ হতে চলেছে, সেটাতে বাজেটের আকার ছিল সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকার ওপরে। সংখ্যাগুলো যদি ঘেঁটে দেখেন, দেখবেন যে এই অগ্রগতিটা ঠিক ধীরে ধীরে হয়নি, গত দশ–এগারো বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির একরকম একটা উল্লম্ফন ঘটেছে।
সংখ্যা, পরিসংখ্যান ইত্যাদি দিয়ে একটা দেশের অগ্রগতি বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারেন, কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষ সংখ্যা দিয়ে উন্নয়ন সব সময় বুঝতে পারি না। আমাদের উন্নয়ন বোঝার জন্য মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাপনের দিকে তাকাতে হয়। মানুষের জীবনযাপনের সাধারণ মান দেখতে গেলে বাংলাদেশ যে কোথা থেকে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, সে কথা তরুণেরা হয়তো অতটা উপলব্ধি করতে পারবেন না, যতটা পারবেন পঞ্চাশোর্ধ্ব লোকেরা। এই দেশে আমরা দেখেছি দেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ খালি পায়ে হাঁটত, জুতা পরার সামর্থ্য ওদের ছিল না। এই ঢাকার রাস্তায়ই বঙ্গভবনের আশপাশেই হতদরিদ্র লোকজনকে দেখা যেত খালি পায়ে হাঁটছে। আজকে আপনি ঢাকা শহরে তো নয়ই, নিতান্ত অজপাড়াগাঁ কিংবা দূরতম পাহাড়েও সম্ভবত এমন কাউকে খুঁজে পাবেন না, যার পায়ে জুতা নাই। না, জুতা পরার ব্যাপারটা তুচ্ছ করার কিছু নাই, জুতাটাকে আপনি জীবনযাপনের মানের একটা ইনডিকেটর হিসেবে ধরেন।
বাংলাদেশের মানুষের খাবারে প্রোটিনের ঘাটতি—এটা আমাদের দেশের একটা বড় সমস্যা ছিল এই কয়েক বছর আগেও। এখনো সেই সমস্যা পুরোটা মিটেছে কি না জানি না, কিন্তু মানুষের প্রতিদিনের খাবারে প্রোটিনের উপস্থিতি ঠিকই বেড়েছে। ডিমের উৎপাদন, মুরগির উৎপাদন, মাছের উৎপাদন—এসবে যে কবে আমরা এতটা অগ্রসর হয়েছি, সে কথা ঠিক করে বলতে পারব না; কিন্তু নিতান্ত দরিদ্র পরিবারের বাচ্চারাও যে মাঝেমধ্যে এক–দুইটা ডিম খেতে পায়, সে কথা আমি নিশ্চিত বলতে পারি। খাবারের কথাই যখন উঠেছে, আমি আমার কৈশোর থেকেই জেনে এসেছি আমাদের দেশে কখনোই সব মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য থাকত না। কোনো বছর পনেরো লাখ টন আবার কোনো বছর বিশ লাখ টন খাদ্যশস্যের ঘাটতি থাকত। উত্তরবঙ্গে প্রতিবছর কার্তিক মাস এলেই মঙ্গা হতো, না খেয়ে থাকত লাখ লাখ মানুষ। সেসব সমস্যা এখন আর বাংলাদেশে নেই, কার্তিকের মঙ্গা তো এখন মানুষ ভুলেই গেছে।
বড় বড় অবকাঠামোর কথা তো সবাই জানেন। ১৯৯৬ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে বিদ্যুতের সমস্যা তীব্র ছিল। এখন তো দেশে বিদ্যুতের সংকট আর নাই বললেই চলে। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক যখন টাকা দেবে না বলে জানিয়েছিল, তখন তো মনেই হয়েছিল পদ্মা সেতু বোধ হয় আর হবে না। এখন তো পদ্মা সেতুও শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। বাংলাদেশ মহাকাশে স্যাটেলাইট স্থাপন করেছে। ঢাকা শহরে মেট্রোরেল চলবে। এসব যে বাংলাদেশে কখনো হবে, সে কথা তো আমরা একসময় ভাবতেই পারতাম না। টেলিযোগাযোগ উন্নত হয়েছে, ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ বলে যে স্লোগানটা দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বানিয়েছিল, সেটা তো বাস্তবায়ন করেই ছেড়েছে প্রায়। আর এসব উন্নয়নের ছোঁয়া কোনো না–কোনোভাবে দেশের সব মানুষের কাছেই পৌঁছেছে।
কিন্তু এসব উন্নয়ন ও অগ্রগতির কথা যখন আমরা গর্বভরে বলি, তখন একটা কথা মনের কোনায় সব সময়ই আসে—আমরা কি আমাদের নারীদের পেছনে ফেলেই সামনে এগিয়ে যাব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি? কেন এই প্রশ্নটা মাথায় আসে সে কথা বলি।
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই একটা লক্ষ্য যেন আমাদের সবার মনে ছিল—বাংলাদেশকে আমরা এমন একটা দেশ হিসেবে তৈরি করব, যেখানে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য থাকবে না, নারীকেও পুরুষের সমানই পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এটা আপনি পাবেন আমাদের সংবিধানের ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে এবং ১৯৭২-এর সংবিধানে শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ের মধ্যে। সেই লক্ষ্যে আমাদের সংবিধানে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা রাখা হয়। ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে একটি উপ–অনুচ্ছেদ সন্নিবেশ করা হয়, যাতে করে রাষ্ট্র নারীদের পুরুষের সঙ্গে এক কাতারে আনার লক্ষ্যে ইতিবাচক বৈষম্য করতে পারবে। সত্তরের দশকের শুরুর এই সময়টায় আমেরিকা ও ইউরোপ নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের আন্দোলনে বিক্ষোভে উত্তাল ছিল। বিশ্বময় নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে জনমত ছিল তৈরি। অনুমান করি, তার একটা প্রভাব আমাদের সংবিধান প্রণেতাদের মধ্যে ছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার কয়েক বছর পর ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের নারী দশক শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর সরকার তখনো ক্ষমতায়, যখন নারী দশকের প্রথম সম্মেলনটি মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৫ সালের জুন মাসে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৯ সালে নারীর প্রতি সব বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে জাতিসংঘের কনভেনশনটি গৃহীত হয়। এই কনভেনশনটিকে ধরা হয় নারীর জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ হিসেবে। বাংলাদেশ কনভেনশনটি অনুস্বাক্ষর করে ১৯৮৪ সালে, কিন্তু সেটা করে কিছু শর্ত সাপেক্ষে।
আমরা জানি, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দেশের পরিস্থিতি পাল্টে যায়। সেই পরিস্থিতিতে আলাদা করে নারীদের অধিকারের প্রশ্নটা বাস্তব কারণেই পেছনে পড়ে যায়, তবু আমাদের দেশের নারী সংগঠনগুলো সব সময়ই নারী অধিকারের প্রশ্নে মাঠে ছিল এবং দাবিদাওয়াগুলো সবার সামনে তুলে ধরেছে। এসব দাবিদাওয়ার মধ্যে মূল দাবিটি ছিল একটা ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড বা সর্বজনীন পারিবারিক আইন প্রণয়ন করা।
নারীদের দাবিগুলোর মধ্যে একটা মৌলিক দাবি হচ্ছে সম্পদের উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করতে হবে। এটা তো অন্যায় কোনো দাবি নয়। আমি আমার নিজের উদাহরণই দিই। আমার দুই সন্তান, সুখের কথা হচ্ছে, ওরা দুজনই মেয়ে। আমার এমনিতে কোনো সম্পদ নেই, কেবল কয়েক হাজার বই আছে। কাল যদি আমি মারা যাই, তাহলে প্রচলিত বিধানে আমার দুই মেয়ে সব বই পাবে না; এর একটা ছোট অংশ পাবেন আমার স্ত্রী আর বাকিটার চার ভাগের এক ভাগ করে পাবে আমার একেকজন কন্যা আর বাকি দুই ভাগ চলে যাবে আমার ভাইদের কাছে। বিধানটা হচ্ছে, একজন ছেলে যা পাবে, মেয়ে পাবে তার অর্ধেক। কারও যদি ছেলে না থাকে, তাহলে সেই অংশটা চলে যাবে মৃত ব্যক্তির ভাইদের কাছে। এটা কি ন্যায়? মেয়েরা পড়ালেখায় কারও কোনো পুত্রের চেয়ে কম নয়, মেয়েরা তো এখন যেকোনো চাকরিও করতে পারে, এমনকি চাইলে মিলিটারিতেও যোগ দিতে পারে বা পুলিশে। কেবল উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে এসে কেন ওরা পুত্রের চেয়ে অধম হয়ে যাবে? কেন? কোন যুক্তিতে? কোনো যুক্তি নাই।
এটা হচ্ছে মুসলমানদের ক্ষেত্রে বিধান, হিন্দুদের ক্ষেত্রে বিধান আরও ভয়াবহ। এই বিধানটা আমরা বদলাতে পারলাম না। আমরা এমন একটা আইন করতে পারলাম না, যা উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে হিন্দু–মুসলমান সবার ক্ষেত্রেই সমান বিধান হবে এবং সেই বিধানে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো বৈষম্য করা হবে না। তাহলে বৈষম্যটা তো রয়েই গেল। আমরা রাষ্ট্রটা শুরু করেছিলাম এই লক্ষ্যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য করব না এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে। এবং বলেছিলাম, নারীরা যেহেতু আগে বঞ্চিত হয়েছে, ওদের পুরুষের সমান কাতারে নিয়ে আসার জন্য কিছু বিশেষ পদক্ষেপ নিতে পারব। বৈষম্য তো দূর করলাম না। আবার কী করেছি? ওই বিশেষ পদক্ষেপ হিসেবে চাকরিতে নারীর জন্য একটা কোটা ছিল, সেটাও তুলে দিয়েছি।
না, কিছু সুযোগসুবিধা নারীর জন্য যে করা হয়নি, তা নয়। শিক্ষাসহ নানান ক্ষেত্রে নারীর জন্য নানা রকম সাহায্য-সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেগুলো তো ভালো। কিন্তু সাহায্য-সহযোগিতা এক জিনিস আর অধিকার প্রতিষ্ঠা আরেক জিনিস। নারীর অধিকার হচ্ছে পুরুষের মতো সমান, মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবার অধিকার—পুরুষের চেয়ে একটু কম মানুষ বা ঊনমানুষ নয়। এই যে উত্তরাধিকারের বৈষম্য দূর করা, সেটা হতে পারত সেই লক্ষ্যে একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপটা আমরা নিচ্ছি না। কেন? তাহলে কি আমরা ইচ্ছে করেই চাইছি, এসব উন্নয়ন–অগ্রগতি সবকিছুতেই নারীকে একটু পিছিয়ে রাখব? বা নারীকে পেছনে ফেলে রেখেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব?
ইমতিয়াজ মাহমুদ
আইনজীবী
বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে এবং বেশ ভালো গতিতেই যে অগ্রসর হচ্ছে, এ কথা তো আর অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই। যেটাকে বলে উন্নয়ন, সেই জিনিস যে তরতর করে হচ্ছে, সেটা তো দৃশ্যমান দিনের আলোতে এবং রাতের অন্ধকারেও। অন্ধকারে কীভাবে উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়? অন্ধকার তো হচ্ছে চোরদের সময়, বাংলাদেশের বড় চোর যারা, ওরা এখন চুরিও করে হাজার কোটি টাকার হিসাবে আর মাঝারি চোরেরা শতকোটি টাকার হিসাবে। অথচ এই দেশের প্রথম বাজেট, যেটা আমাদের তাজউদ্দীন আহমদ দিয়েছিলেন, সেটার সর্বমোট অঙ্কই ছিল সাড়ে সাত শ কোটি টাকার মতো, আর তৃতীয় বাজেটের আকার ছিল এক হাজার কোটি টাকার। আর আজকের বাজেটের আকার কী, সেটা আপনারা জানেন। যে অর্থবছরটা শেষ হতে চলেছে, সেটাতে বাজেটের আকার ছিল সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকার ওপরে। সংখ্যাগুলো যদি ঘেঁটে দেখেন, দেখবেন যে এই অগ্রগতিটা ঠিক ধীরে ধীরে হয়নি, গত দশ–এগারো বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির একরকম একটা উল্লম্ফন ঘটেছে।
সংখ্যা, পরিসংখ্যান ইত্যাদি দিয়ে একটা দেশের অগ্রগতি বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারেন, কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষ সংখ্যা দিয়ে উন্নয়ন সব সময় বুঝতে পারি না। আমাদের উন্নয়ন বোঝার জন্য মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাপনের দিকে তাকাতে হয়। মানুষের জীবনযাপনের সাধারণ মান দেখতে গেলে বাংলাদেশ যে কোথা থেকে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, সে কথা তরুণেরা হয়তো অতটা উপলব্ধি করতে পারবেন না, যতটা পারবেন পঞ্চাশোর্ধ্ব লোকেরা। এই দেশে আমরা দেখেছি দেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ খালি পায়ে হাঁটত, জুতা পরার সামর্থ্য ওদের ছিল না। এই ঢাকার রাস্তায়ই বঙ্গভবনের আশপাশেই হতদরিদ্র লোকজনকে দেখা যেত খালি পায়ে হাঁটছে। আজকে আপনি ঢাকা শহরে তো নয়ই, নিতান্ত অজপাড়াগাঁ কিংবা দূরতম পাহাড়েও সম্ভবত এমন কাউকে খুঁজে পাবেন না, যার পায়ে জুতা নাই। না, জুতা পরার ব্যাপারটা তুচ্ছ করার কিছু নাই, জুতাটাকে আপনি জীবনযাপনের মানের একটা ইনডিকেটর হিসেবে ধরেন।
বাংলাদেশের মানুষের খাবারে প্রোটিনের ঘাটতি—এটা আমাদের দেশের একটা বড় সমস্যা ছিল এই কয়েক বছর আগেও। এখনো সেই সমস্যা পুরোটা মিটেছে কি না জানি না, কিন্তু মানুষের প্রতিদিনের খাবারে প্রোটিনের উপস্থিতি ঠিকই বেড়েছে। ডিমের উৎপাদন, মুরগির উৎপাদন, মাছের উৎপাদন—এসবে যে কবে আমরা এতটা অগ্রসর হয়েছি, সে কথা ঠিক করে বলতে পারব না; কিন্তু নিতান্ত দরিদ্র পরিবারের বাচ্চারাও যে মাঝেমধ্যে এক–দুইটা ডিম খেতে পায়, সে কথা আমি নিশ্চিত বলতে পারি। খাবারের কথাই যখন উঠেছে, আমি আমার কৈশোর থেকেই জেনে এসেছি আমাদের দেশে কখনোই সব মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য থাকত না। কোনো বছর পনেরো লাখ টন আবার কোনো বছর বিশ লাখ টন খাদ্যশস্যের ঘাটতি থাকত। উত্তরবঙ্গে প্রতিবছর কার্তিক মাস এলেই মঙ্গা হতো, না খেয়ে থাকত লাখ লাখ মানুষ। সেসব সমস্যা এখন আর বাংলাদেশে নেই, কার্তিকের মঙ্গা তো এখন মানুষ ভুলেই গেছে।
বড় বড় অবকাঠামোর কথা তো সবাই জানেন। ১৯৯৬ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে বিদ্যুতের সমস্যা তীব্র ছিল। এখন তো দেশে বিদ্যুতের সংকট আর নাই বললেই চলে। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক যখন টাকা দেবে না বলে জানিয়েছিল, তখন তো মনেই হয়েছিল পদ্মা সেতু বোধ হয় আর হবে না। এখন তো পদ্মা সেতুও শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। বাংলাদেশ মহাকাশে স্যাটেলাইট স্থাপন করেছে। ঢাকা শহরে মেট্রোরেল চলবে। এসব যে বাংলাদেশে কখনো হবে, সে কথা তো আমরা একসময় ভাবতেই পারতাম না। টেলিযোগাযোগ উন্নত হয়েছে, ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ বলে যে স্লোগানটা দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বানিয়েছিল, সেটা তো বাস্তবায়ন করেই ছেড়েছে প্রায়। আর এসব উন্নয়নের ছোঁয়া কোনো না–কোনোভাবে দেশের সব মানুষের কাছেই পৌঁছেছে।
কিন্তু এসব উন্নয়ন ও অগ্রগতির কথা যখন আমরা গর্বভরে বলি, তখন একটা কথা মনের কোনায় সব সময়ই আসে—আমরা কি আমাদের নারীদের পেছনে ফেলেই সামনে এগিয়ে যাব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি? কেন এই প্রশ্নটা মাথায় আসে সে কথা বলি।
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই একটা লক্ষ্য যেন আমাদের সবার মনে ছিল—বাংলাদেশকে আমরা এমন একটা দেশ হিসেবে তৈরি করব, যেখানে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য থাকবে না, নারীকেও পুরুষের সমানই পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এটা আপনি পাবেন আমাদের সংবিধানের ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে এবং ১৯৭২-এর সংবিধানে শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ের মধ্যে। সেই লক্ষ্যে আমাদের সংবিধানে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা রাখা হয়। ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে একটি উপ–অনুচ্ছেদ সন্নিবেশ করা হয়, যাতে করে রাষ্ট্র নারীদের পুরুষের সঙ্গে এক কাতারে আনার লক্ষ্যে ইতিবাচক বৈষম্য করতে পারবে। সত্তরের দশকের শুরুর এই সময়টায় আমেরিকা ও ইউরোপ নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের আন্দোলনে বিক্ষোভে উত্তাল ছিল। বিশ্বময় নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে জনমত ছিল তৈরি। অনুমান করি, তার একটা প্রভাব আমাদের সংবিধান প্রণেতাদের মধ্যে ছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার কয়েক বছর পর ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের নারী দশক শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর সরকার তখনো ক্ষমতায়, যখন নারী দশকের প্রথম সম্মেলনটি মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৫ সালের জুন মাসে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৯ সালে নারীর প্রতি সব বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে জাতিসংঘের কনভেনশনটি গৃহীত হয়। এই কনভেনশনটিকে ধরা হয় নারীর জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ হিসেবে। বাংলাদেশ কনভেনশনটি অনুস্বাক্ষর করে ১৯৮৪ সালে, কিন্তু সেটা করে কিছু শর্ত সাপেক্ষে।
আমরা জানি, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দেশের পরিস্থিতি পাল্টে যায়। সেই পরিস্থিতিতে আলাদা করে নারীদের অধিকারের প্রশ্নটা বাস্তব কারণেই পেছনে পড়ে যায়, তবু আমাদের দেশের নারী সংগঠনগুলো সব সময়ই নারী অধিকারের প্রশ্নে মাঠে ছিল এবং দাবিদাওয়াগুলো সবার সামনে তুলে ধরেছে। এসব দাবিদাওয়ার মধ্যে মূল দাবিটি ছিল একটা ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড বা সর্বজনীন পারিবারিক আইন প্রণয়ন করা।
নারীদের দাবিগুলোর মধ্যে একটা মৌলিক দাবি হচ্ছে সম্পদের উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করতে হবে। এটা তো অন্যায় কোনো দাবি নয়। আমি আমার নিজের উদাহরণই দিই। আমার দুই সন্তান, সুখের কথা হচ্ছে, ওরা দুজনই মেয়ে। আমার এমনিতে কোনো সম্পদ নেই, কেবল কয়েক হাজার বই আছে। কাল যদি আমি মারা যাই, তাহলে প্রচলিত বিধানে আমার দুই মেয়ে সব বই পাবে না; এর একটা ছোট অংশ পাবেন আমার স্ত্রী আর বাকিটার চার ভাগের এক ভাগ করে পাবে আমার একেকজন কন্যা আর বাকি দুই ভাগ চলে যাবে আমার ভাইদের কাছে। বিধানটা হচ্ছে, একজন ছেলে যা পাবে, মেয়ে পাবে তার অর্ধেক। কারও যদি ছেলে না থাকে, তাহলে সেই অংশটা চলে যাবে মৃত ব্যক্তির ভাইদের কাছে। এটা কি ন্যায়? মেয়েরা পড়ালেখায় কারও কোনো পুত্রের চেয়ে কম নয়, মেয়েরা তো এখন যেকোনো চাকরিও করতে পারে, এমনকি চাইলে মিলিটারিতেও যোগ দিতে পারে বা পুলিশে। কেবল উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে এসে কেন ওরা পুত্রের চেয়ে অধম হয়ে যাবে? কেন? কোন যুক্তিতে? কোনো যুক্তি নাই।
এটা হচ্ছে মুসলমানদের ক্ষেত্রে বিধান, হিন্দুদের ক্ষেত্রে বিধান আরও ভয়াবহ। এই বিধানটা আমরা বদলাতে পারলাম না। আমরা এমন একটা আইন করতে পারলাম না, যা উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে হিন্দু–মুসলমান সবার ক্ষেত্রেই সমান বিধান হবে এবং সেই বিধানে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো বৈষম্য করা হবে না। তাহলে বৈষম্যটা তো রয়েই গেল। আমরা রাষ্ট্রটা শুরু করেছিলাম এই লক্ষ্যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য করব না এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে। এবং বলেছিলাম, নারীরা যেহেতু আগে বঞ্চিত হয়েছে, ওদের পুরুষের সমান কাতারে নিয়ে আসার জন্য কিছু বিশেষ পদক্ষেপ নিতে পারব। বৈষম্য তো দূর করলাম না। আবার কী করেছি? ওই বিশেষ পদক্ষেপ হিসেবে চাকরিতে নারীর জন্য একটা কোটা ছিল, সেটাও তুলে দিয়েছি।
না, কিছু সুযোগসুবিধা নারীর জন্য যে করা হয়নি, তা নয়। শিক্ষাসহ নানান ক্ষেত্রে নারীর জন্য নানা রকম সাহায্য-সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেগুলো তো ভালো। কিন্তু সাহায্য-সহযোগিতা এক জিনিস আর অধিকার প্রতিষ্ঠা আরেক জিনিস। নারীর অধিকার হচ্ছে পুরুষের মতো সমান, মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবার অধিকার—পুরুষের চেয়ে একটু কম মানুষ বা ঊনমানুষ নয়। এই যে উত্তরাধিকারের বৈষম্য দূর করা, সেটা হতে পারত সেই লক্ষ্যে একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপটা আমরা নিচ্ছি না। কেন? তাহলে কি আমরা ইচ্ছে করেই চাইছি, এসব উন্নয়ন–অগ্রগতি সবকিছুতেই নারীকে একটু পিছিয়ে রাখব? বা নারীকে পেছনে ফেলে রেখেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব?
ইমতিয়াজ মাহমুদ
আইনজীবী
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪