সেলিম জাহান
২০২১ সাল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর। ৯ মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয়ের লাল সূর্য। আমাদের স্বাধীনতা শুধু একটি ভূখণ্ডের নয়, নয় একটি মানবগোষ্ঠীর; সে বিজয় একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি ইতিহাসের। সেই স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ নয় একটি দিবসে, তা অনুরণিত প্রতিদিন, প্রতি পলে, প্রতি প্রাণে।
আজ ২০২১ সালে এসে যখন পেছনে ফিরে তাকাই, তখন দেখি অর্জন আমাদের অনেক, বিশেষত আর্থসামাজিক অঙ্গনে। ৫০ বছর আগে ধ্বংসস্তূপের ভস্ম থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ, তারপর সে আর পেছনে ফিরে তাকায়নি। গত অর্ধশতাব্দীতে দেশটির অনন্য সাফল্যের কারণে বিশ্ব তাকে চিহ্নিত করেছে ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ বলে।
৫০ নয়, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশ অর্থনীতির আকার বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ—৩৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩৫০ বিলিয়ন। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৩০০ থেকে ২ হাজার ২২৭ ডলারে। মধ্য নব্বইয়ের দশকে যেখানে দেশের ৫৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত, আজ সেখানে মাত্র ২১ শতাংশ মানুষ বাস করে। বয়স্ক সাক্ষরতার হার ১৯৯০ সালে যেখানে ছিল ৩৫ শতাংশ, আজ তা এসে দাঁড়িয়েছে ৭৫ শতাংশে।
প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী অন্তর্ভুক্তির হার ১৯৯০ থেকে ২০১৯ সাল নাগাদ ৭৫ থেকে ৯৭ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। মাধ্যমিক স্তরে সংশ্লিষ্ট সংখ্যাদ্বয় হচ্ছে যথাক্রমে ২০ ও ৬৬ শতাংশ। ওই সময়কালের মধ্যে বাংলাদেশের শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১০০ থেকে ২১-এ নেমে এসেছে এবং মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ৫৯৪ থেকে ১৬৫তে হ্রাস পেয়েছে।
আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই অগ্রগতি বিস্ময়কর। আসলে সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে প্রত্যাশিত গড় আয়ু আজ ৭৩ বছর, ভারতে যেখানে ৭০ বছর, পাকিস্তানে ৬৭ বছর। অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশুমৃত্যুর হার বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৩১, ভারতে ৩৫ এবং পাকিস্তানে ৬৭।
কিন্তু এসব অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে তিনটি আর্থসামাজিক অন্তরায় আমাকে ভাবিত করে। প্রথমত, সমাজের ক্রমবর্ধমান অসমতা ফলাফলের ক্ষেত্রে এবং সেই সঙ্গে সুযোগের ক্ষেত্রেও। আয়ের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার উচ্চতম ১০ শতাংশ যেখানে দেশজ আয়ের ৩৮ শতাংশ ভোগ করেছে, সেখানে জনসংখ্যার নিম্নতম ৪০ শতাংশ দেশজ আয়ের ১৩ শতাংশ পেয়েছে। বরিশালে বয়স্ক সাক্ষরতার হার যেখানে ৭৫ শতাংশ, সেখানে সিলেটে সেই হার হচ্ছে ৬০ শতাংশ। শ্রমবাজারে পুরুষের অংশগ্রহণের হার যেখানে ৮১ শতাংশ, সেখানে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৬ শতাংশ।
অর্থনৈতিক গণ্ডি পেরিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও অসমতা লক্ষণীয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর ও প্রতিনিধিত্ব নিতান্তই প্রান্তিক। বাংলাদেশে সামাজিক বৈষম্য লক্ষণীয়—দরিদ্র মানুষ সমাজের প্রান্তসীমায় অবস্থান করছে। ঢাকা শহরেই বিত্তবান এলাকার জীবনযাত্রার সঙ্গে অন্য এলাকার জীবনযাত্রার মানের কোনো মিল নেই। ধনী-দরিদ্রের সাংস্কৃতিক বৈষম্যের কথাও সর্বজনবিদিত।
দ্বিতীয়ত, আমাদের সমাজে মানুষের ক্রমবর্ধমান আত্মকেন্দ্রিকতা আমাকে ভাবিত করে। আমরা আমাদের ভাবনাতেই মগ্ন—আমার নাম, আমার অর্থবিত্ত, আত্মপ্রচার। আমরা ভুলে গেছি যে আমাদের সব অর্জন কিন্তু যূথবদ্ধতার ফসল। আমরা যৌথভাবে আন্দোলন করেছি, সবাই মিলে একত্রে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আমাদের সমাজের মূল শক্তিই ছিল যূথবদ্ধতা। কিন্তু আজ আমরা ভুলে গেছি যে আমাদের প্রত্যেকের অগ্রগতি ও নিরাপত্তা আমাদের একার ওপরে নির্ভর করে না, তা নির্ভর করে যে বৃহত্তর কাঠামোর আমরা অংশ, তার ওপরে। মনে রাখা দরকার, নগরীতে আগুন লাগলে দেবালয়ও তা থেকে রক্ষা পায় না।
আমাদের আর্থিক সাফল্যকেই আমরা একজন সফল মানুষের নির্ণায়ক বলে মেনে নিয়েছি। বিত্তের মাপকাঠিতেই আজ আমরা মানুষের মূল্যায়ন করছি। শিক্ষা, মানবিকতা, সংস্কৃতিমনস্কতা, ভদ্রতা-শোভনতা— এগুলোকে আমরা আর মনুষ্য বিচারের মাপকাঠি বলে ভাবি না। ফলে মানুষের বহু সুকুমারবৃত্তিকে আমরা বিসর্জন দিয়েছি, তাদের অপ্রাসঙ্গিকতাও মূল্যহীন করে ফেলেছি।
তৃতীয়ত, সমাজে সন্ত্রাস ও সহিংসতার বিস্তৃতি ঘটেছে। আমাদের সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ হ্রাস পেয়েছে। মানুষকে ন্যূনতম মানবিক মর্যাদা দিতেও আমরা ভুলে যাই। যেকোনো মতভেদ, মতানৈক্য ও বিরোধ নিষ্পত্তিতে আমরা আজ কথাবার্তার পরিবর্তে শক্তিকেই ব্যবহার করি—পেশিশক্তি, বিত্তশক্তি, ক্ষমতার শক্তি। তার পথ ধরেই এসেছে অস্ত্রায়ন, সহিংসতা আর সন্ত্রাস। যেকোনো মতবিরোধ, মতানৈক্য আর মতভেদে আমরা আশ্রয় নিই সহিংসতা আর সন্ত্রাসের। সহিংসতা আজ আমাদের ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সন্ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের সংস্কৃতি।
চতুর্থত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পরে জনগণের সার্বিক মুক্তির চালচিত্র মাথায় রেখে চারটি বিষয়কে জাতীয় নীতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতীয়তাবাদ আমাদের বাঙালি আত্মসত্তার জন্য আবশ্যিক শর্ত। আত্মসত্তার বোধ একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দরকার। গণতন্ত্র ভিন্ন স্বাধীনতা বা মুক্তিকে একটি বজায়ক্ষম ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা মানবিক অধিকার, সামাজিক ন্যায্যতা ও সর্বপ্রকার সমতার জন্য অত্যাবশ্যকীয়।
আজ বাংলাদেশ এই মূলনীতিগুলো থেকে সরে এসেছে। ‘বাঙালি’ না ‘বাংলাদেশি’ এমনতরো ধুয়ো তুলে আমাদের বাঙালিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। ধর্মকেন্দ্রিক মৌলবাদী অপশক্তিকে আশকারা দিয়ে উদারপন্থী বাঙালিত্বকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ আজ শঙ্কাক্রান্ত। আমরা ভুলে গেছি যে গণতন্ত্রের জন্য নিরন্তর সংগ্রামের নামই গণতন্ত্র।
সামাজিক ন্যায্যতা আজ মুখে মুখেই আমরা বলি, আমাদের কাজে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। সুতরাং আইন ও বিচারের ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে, অসমতা আছে জীবনের নানা ক্ষেত্রে। আমাদের চিন্তায়, কাজে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়েছি। তাই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলা হচ্ছে, তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে।
পঞ্চমত, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি আবার জেঁকে বসেছে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনে। এদেরই পূর্বসূরিরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, গণহত্যার দোসর হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে ইতিহাস বিকৃত করেছিল। আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ এবং যেকোনো মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে এই অপশক্তি এক বিরাট হুমকি। এ এক অশনিসংকেত এবং এ আমাদের অস্তিত্বের সংগ্রাম।
এসব কাঠামোগত অন্তরায় আর প্রতিবন্ধকতাগুলো জয় করতে হলে আমাদের সবাই মিলে এগুলোর বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও মূল্যায়ন করতে হবে। মনে রাখা দরকার, সব সমাধান আমাদের একার হাতে নেই এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমরা সবগুলোর সমাধানও করতে পারব না। কিন্তু কোন জায়গায় আমরা এখনই চিন্তা-ভাবনা করতে পারি, সেটা ভাবা দরকার।
যেমন আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠার মূল ভূমিকা নিতে হবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে। অপশক্তি নির্মূলেও অগ্রগণ্য ভূমিকা রাষ্ট্রের। অসমতা দূরীকরণে অন্তর্ভুক্ত প্রবৃদ্ধি নীতিমালা, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা, করনীতিতে সংস্কার, নারীর ক্ষমতায়ন ঘটাতে হবে।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে এবং সহিংসতা ও সন্ত্রাস বন্ধে রাষ্ট্রীয় ভূমিকা যেমন আছে, তেমনি ভূমিকা আছে সামাজিক আন্দোলনের। সেই সঙ্গে আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগতভাবে বহু কিছু করার আছে। মনে রাখা দরকার, ‘এ দায়ভাগে আমরা সমান অংশীদার, অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে, আমাদের পরে দেনা শুধবার ভার’।
আমাদের যাত্রাপথে আমরা একটি ক্রান্তিকালে এসে পৌঁছেছি। পার করেছি স্বাধীনতার ৫০ বছর, সামনে পড়ে আছে এক দীর্ঘ পথযাত্রা। এ ক্রান্তিলগ্নে এসে মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর সেই কথাগুলো, যা তিনি উচ্চারণ করেছিলেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি কারাগার থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশে যাত্রাপথে—‘আমার এই পথযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোর পথে, বন্দিত্ব থেকে মুক্তির পথে, একাকিত্ব থেকে আশার পথে’। সেই সুরে আমি বলি, আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশের পথযাত্রা হবে বঞ্চনা থেকে প্রাচুর্যের পথে, প্রতিবন্ধকতা থেকে সুযোগের দিকে, দিগ্দর্শন থেকে কর্মকাণ্ডের দিকে।
সেলিম জাহান, অর্থনীতিবিদ
২০২১ সাল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর। ৯ মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয়ের লাল সূর্য। আমাদের স্বাধীনতা শুধু একটি ভূখণ্ডের নয়, নয় একটি মানবগোষ্ঠীর; সে বিজয় একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি ইতিহাসের। সেই স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ নয় একটি দিবসে, তা অনুরণিত প্রতিদিন, প্রতি পলে, প্রতি প্রাণে।
আজ ২০২১ সালে এসে যখন পেছনে ফিরে তাকাই, তখন দেখি অর্জন আমাদের অনেক, বিশেষত আর্থসামাজিক অঙ্গনে। ৫০ বছর আগে ধ্বংসস্তূপের ভস্ম থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ, তারপর সে আর পেছনে ফিরে তাকায়নি। গত অর্ধশতাব্দীতে দেশটির অনন্য সাফল্যের কারণে বিশ্ব তাকে চিহ্নিত করেছে ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ বলে।
৫০ নয়, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশ অর্থনীতির আকার বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ—৩৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩৫০ বিলিয়ন। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৩০০ থেকে ২ হাজার ২২৭ ডলারে। মধ্য নব্বইয়ের দশকে যেখানে দেশের ৫৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত, আজ সেখানে মাত্র ২১ শতাংশ মানুষ বাস করে। বয়স্ক সাক্ষরতার হার ১৯৯০ সালে যেখানে ছিল ৩৫ শতাংশ, আজ তা এসে দাঁড়িয়েছে ৭৫ শতাংশে।
প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী অন্তর্ভুক্তির হার ১৯৯০ থেকে ২০১৯ সাল নাগাদ ৭৫ থেকে ৯৭ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। মাধ্যমিক স্তরে সংশ্লিষ্ট সংখ্যাদ্বয় হচ্ছে যথাক্রমে ২০ ও ৬৬ শতাংশ। ওই সময়কালের মধ্যে বাংলাদেশের শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১০০ থেকে ২১-এ নেমে এসেছে এবং মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ৫৯৪ থেকে ১৬৫তে হ্রাস পেয়েছে।
আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই অগ্রগতি বিস্ময়কর। আসলে সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে প্রত্যাশিত গড় আয়ু আজ ৭৩ বছর, ভারতে যেখানে ৭০ বছর, পাকিস্তানে ৬৭ বছর। অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশুমৃত্যুর হার বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৩১, ভারতে ৩৫ এবং পাকিস্তানে ৬৭।
কিন্তু এসব অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে তিনটি আর্থসামাজিক অন্তরায় আমাকে ভাবিত করে। প্রথমত, সমাজের ক্রমবর্ধমান অসমতা ফলাফলের ক্ষেত্রে এবং সেই সঙ্গে সুযোগের ক্ষেত্রেও। আয়ের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার উচ্চতম ১০ শতাংশ যেখানে দেশজ আয়ের ৩৮ শতাংশ ভোগ করেছে, সেখানে জনসংখ্যার নিম্নতম ৪০ শতাংশ দেশজ আয়ের ১৩ শতাংশ পেয়েছে। বরিশালে বয়স্ক সাক্ষরতার হার যেখানে ৭৫ শতাংশ, সেখানে সিলেটে সেই হার হচ্ছে ৬০ শতাংশ। শ্রমবাজারে পুরুষের অংশগ্রহণের হার যেখানে ৮১ শতাংশ, সেখানে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৬ শতাংশ।
অর্থনৈতিক গণ্ডি পেরিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও অসমতা লক্ষণীয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর ও প্রতিনিধিত্ব নিতান্তই প্রান্তিক। বাংলাদেশে সামাজিক বৈষম্য লক্ষণীয়—দরিদ্র মানুষ সমাজের প্রান্তসীমায় অবস্থান করছে। ঢাকা শহরেই বিত্তবান এলাকার জীবনযাত্রার সঙ্গে অন্য এলাকার জীবনযাত্রার মানের কোনো মিল নেই। ধনী-দরিদ্রের সাংস্কৃতিক বৈষম্যের কথাও সর্বজনবিদিত।
দ্বিতীয়ত, আমাদের সমাজে মানুষের ক্রমবর্ধমান আত্মকেন্দ্রিকতা আমাকে ভাবিত করে। আমরা আমাদের ভাবনাতেই মগ্ন—আমার নাম, আমার অর্থবিত্ত, আত্মপ্রচার। আমরা ভুলে গেছি যে আমাদের সব অর্জন কিন্তু যূথবদ্ধতার ফসল। আমরা যৌথভাবে আন্দোলন করেছি, সবাই মিলে একত্রে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আমাদের সমাজের মূল শক্তিই ছিল যূথবদ্ধতা। কিন্তু আজ আমরা ভুলে গেছি যে আমাদের প্রত্যেকের অগ্রগতি ও নিরাপত্তা আমাদের একার ওপরে নির্ভর করে না, তা নির্ভর করে যে বৃহত্তর কাঠামোর আমরা অংশ, তার ওপরে। মনে রাখা দরকার, নগরীতে আগুন লাগলে দেবালয়ও তা থেকে রক্ষা পায় না।
আমাদের আর্থিক সাফল্যকেই আমরা একজন সফল মানুষের নির্ণায়ক বলে মেনে নিয়েছি। বিত্তের মাপকাঠিতেই আজ আমরা মানুষের মূল্যায়ন করছি। শিক্ষা, মানবিকতা, সংস্কৃতিমনস্কতা, ভদ্রতা-শোভনতা— এগুলোকে আমরা আর মনুষ্য বিচারের মাপকাঠি বলে ভাবি না। ফলে মানুষের বহু সুকুমারবৃত্তিকে আমরা বিসর্জন দিয়েছি, তাদের অপ্রাসঙ্গিকতাও মূল্যহীন করে ফেলেছি।
তৃতীয়ত, সমাজে সন্ত্রাস ও সহিংসতার বিস্তৃতি ঘটেছে। আমাদের সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ হ্রাস পেয়েছে। মানুষকে ন্যূনতম মানবিক মর্যাদা দিতেও আমরা ভুলে যাই। যেকোনো মতভেদ, মতানৈক্য ও বিরোধ নিষ্পত্তিতে আমরা আজ কথাবার্তার পরিবর্তে শক্তিকেই ব্যবহার করি—পেশিশক্তি, বিত্তশক্তি, ক্ষমতার শক্তি। তার পথ ধরেই এসেছে অস্ত্রায়ন, সহিংসতা আর সন্ত্রাস। যেকোনো মতবিরোধ, মতানৈক্য আর মতভেদে আমরা আশ্রয় নিই সহিংসতা আর সন্ত্রাসের। সহিংসতা আজ আমাদের ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সন্ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের সংস্কৃতি।
চতুর্থত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পরে জনগণের সার্বিক মুক্তির চালচিত্র মাথায় রেখে চারটি বিষয়কে জাতীয় নীতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতীয়তাবাদ আমাদের বাঙালি আত্মসত্তার জন্য আবশ্যিক শর্ত। আত্মসত্তার বোধ একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দরকার। গণতন্ত্র ভিন্ন স্বাধীনতা বা মুক্তিকে একটি বজায়ক্ষম ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা মানবিক অধিকার, সামাজিক ন্যায্যতা ও সর্বপ্রকার সমতার জন্য অত্যাবশ্যকীয়।
আজ বাংলাদেশ এই মূলনীতিগুলো থেকে সরে এসেছে। ‘বাঙালি’ না ‘বাংলাদেশি’ এমনতরো ধুয়ো তুলে আমাদের বাঙালিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। ধর্মকেন্দ্রিক মৌলবাদী অপশক্তিকে আশকারা দিয়ে উদারপন্থী বাঙালিত্বকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ আজ শঙ্কাক্রান্ত। আমরা ভুলে গেছি যে গণতন্ত্রের জন্য নিরন্তর সংগ্রামের নামই গণতন্ত্র।
সামাজিক ন্যায্যতা আজ মুখে মুখেই আমরা বলি, আমাদের কাজে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। সুতরাং আইন ও বিচারের ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে, অসমতা আছে জীবনের নানা ক্ষেত্রে। আমাদের চিন্তায়, কাজে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়েছি। তাই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলা হচ্ছে, তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে।
পঞ্চমত, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি আবার জেঁকে বসেছে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনে। এদেরই পূর্বসূরিরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, গণহত্যার দোসর হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে ইতিহাস বিকৃত করেছিল। আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ এবং যেকোনো মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে এই অপশক্তি এক বিরাট হুমকি। এ এক অশনিসংকেত এবং এ আমাদের অস্তিত্বের সংগ্রাম।
এসব কাঠামোগত অন্তরায় আর প্রতিবন্ধকতাগুলো জয় করতে হলে আমাদের সবাই মিলে এগুলোর বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও মূল্যায়ন করতে হবে। মনে রাখা দরকার, সব সমাধান আমাদের একার হাতে নেই এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমরা সবগুলোর সমাধানও করতে পারব না। কিন্তু কোন জায়গায় আমরা এখনই চিন্তা-ভাবনা করতে পারি, সেটা ভাবা দরকার।
যেমন আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠার মূল ভূমিকা নিতে হবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে। অপশক্তি নির্মূলেও অগ্রগণ্য ভূমিকা রাষ্ট্রের। অসমতা দূরীকরণে অন্তর্ভুক্ত প্রবৃদ্ধি নীতিমালা, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা, করনীতিতে সংস্কার, নারীর ক্ষমতায়ন ঘটাতে হবে।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে এবং সহিংসতা ও সন্ত্রাস বন্ধে রাষ্ট্রীয় ভূমিকা যেমন আছে, তেমনি ভূমিকা আছে সামাজিক আন্দোলনের। সেই সঙ্গে আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগতভাবে বহু কিছু করার আছে। মনে রাখা দরকার, ‘এ দায়ভাগে আমরা সমান অংশীদার, অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে, আমাদের পরে দেনা শুধবার ভার’।
আমাদের যাত্রাপথে আমরা একটি ক্রান্তিকালে এসে পৌঁছেছি। পার করেছি স্বাধীনতার ৫০ বছর, সামনে পড়ে আছে এক দীর্ঘ পথযাত্রা। এ ক্রান্তিলগ্নে এসে মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর সেই কথাগুলো, যা তিনি উচ্চারণ করেছিলেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি কারাগার থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশে যাত্রাপথে—‘আমার এই পথযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোর পথে, বন্দিত্ব থেকে মুক্তির পথে, একাকিত্ব থেকে আশার পথে’। সেই সুরে আমি বলি, আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশের পথযাত্রা হবে বঞ্চনা থেকে প্রাচুর্যের পথে, প্রতিবন্ধকতা থেকে সুযোগের দিকে, দিগ্দর্শন থেকে কর্মকাণ্ডের দিকে।
সেলিম জাহান, অর্থনীতিবিদ
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪