অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান
বাজেটের আলোচনায় যদিও অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ, রাজস্ব ও উন্নয়ন ব্যয়, ঘাটতি অর্থায়ন, বাজেট বাস্তবায়ন এবং রাজস্ব সংস্কার—এসব বিষয়ের ওপরই মূলত নিবদ্ধ থাকে, আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে সরকারি ব্যয় ও বাজেট প্রণয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ভিত্তি আছে। সেটা হলো অপেক্ষাকৃত স্বল্প আয়ের মানুষর সপক্ষে এসবের মাধ্যমে আয়, ভোগ ও সম্পদের পুনর্বণ্টন। স্মর্তব্য যে বাংলাদেশের সংবিধানে ও বর্তমান সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দলিলে কেবল প্রবৃদ্ধি নয়, একটি জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার, রূপকল্প ২০৪১ ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এ আকারের প্রতিফলন রয়েছে।
কর-ন্যায্যতা ও বণ্টন-ন্যায্যতার নিরিখে বাজেট ২০২১-২২-এর প্রস্তাবসমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে প্রবৃদ্ধি ও ব্যবসা, বিনিয়োগ ও উদ্যোক্তা-প্রণোদনায় যে প্রচেষ্টা আছে, কোভিডকালের চাহিদার পিরেপ্রেক্ষিতে নিম্নবিত্ত, কর্মচ্যুত, বেকার, উপান্তিক ও প্রান্তিক মানুষদের প্রকৃত আয় বৃদ্ধি; কর্মসংস্থান, সামাজিক সুরক্ষা ও আয়বৈষম্য হ্রাসের নিরিখে ব্যয়ের প্রস্তাব ও পদক্ষেপসমূহ সে তুলনায় অনেক দুর্বল।
এ কথা জানা যে কোভিডের আক্রমণের আগেই আয়, ভোগ ও সম্পদবৈষম্য বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়ের পরিসংখ্যান এবং বিভিন্ন আর্থসামাজিক সূচকের অগ্রগতি নিঃসন্দেহে আমাদের গৌরব ও গর্বের বিষয়। কিন্তু বিভাজিত তথ্য থেকে দেখা যায় যে এসব সূচকের গড় মান পিছিয়ে পড়া মানুষদের বণ্টনের ন্যায্যতার বিষয়টিকে অনেক ক্ষেত্রেই আড়াল করে রেখেছে। ২০১০ ও ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত খানা-জরিপের হিসাবমতে, বাংলাদেশে আয়ের বিচারে সবচেয়ে ওপরের মানুষদের সঙ্গে সবচেয়ে কম আয়ের মানুষের পার্থক্য বিভিন্ন সূচকে ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং আয়ের বৈষম্য পরিমাপক জিনি-সহগেও তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছিল। ২০২০ সালে কোভিড অতিমারির আক্রমণ–পরবর্তী সময়ে এ বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে। কর্মহীনতা, আয় হ্রাস, সেবা খাত থেকে অনিয়মিত ও স্বল্প আয়ের কৃষিকর্মে স্থানান্তর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আয়-বিনিয়োগে ক্ষতি, নিঃশেষিত সঞ্চয় ও ঋণের ফাঁদে আটকে পড়া—এসব কারণে কোভিডকালীন স্বল্প আয় ও উপান্তিক-প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমানের যে ক্ষয় হয়েছে, বাজেট ও সরকারি ব্যয়ের মাধ্যমে তার প্রতিকূলতা সহনীয় মাত্রায় রাখা ও ঝুঁকি প্রশমন অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে দেখার প্রয়োজন ছিল। সে ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের প্রস্তাবিত রাজস্বকাঠামো, কর প্রস্তাব ও উন্নয়ন বরাদ্দের বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। কোভিড অতিমারির চলমান দ্বিতীয় আঘাত মোকাবিলায় চাহিদার বিবেচনায় এ ঘাটতি আরও বেশি দৃশ্যমান।
পুনর্বণ্টনের নিরিখে একটা বড় বিবেচ্য বিষয় হলো বাজেটের আকার। অনেক সময়ই আমরা বলে থাকি ‘বড় অঙ্কের বাজেট’। কথাটার পেছনে একটা কারণ হলো, যে বাজেট গৃহীত হয়, তা বাস্তবায়িত হয় না। বাজেট বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে তা পরবর্তী সময়ে সংশোধন করতে হয়; অর্থাৎ কাটছাঁট করা হয়। আবার পরবর্তী সময়ে বছর শেষের উপাত্ত থেকে দেখা যায়, সংশোধিত আয় ও বরাদ্দের তুলনায়ও প্রকৃত আয় ও ব্যয় আরও কম। গত কয়েক অর্থবছরে প্রকৃত বাস্তবায়ন প্রস্তাবিত বাজেটের ৮০-৮৫ শতাংশ অতিক্রম করতে পারেনি। এ জন্য প্রায়শই বলা হয়, বাস্তবায়ন করতে সক্ষম না হলে বাজেট বাড়িয়ে লাভ কী? সে কারণে বাজেটের আকার বৃদ্ধি করা হলেই বলা হয় ‘বড় অঙ্কের বাজেট’। অথচ আমাদের যে কথাটার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত তা হলো, কেন আমরা বাস্তবায়ন সক্ষমতা বৃদ্ধি করে ‘বড় বাজেট’ প্রণয়ন করতে পারছি না? এ লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ও সুশাসন নিশ্চিতে বিনিয়োগ করছি না? স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করছি না? মনে রাখা ভালো যে বাংলাদেশে সরকারি ব্যয়, যা বছরে মাথাপিছু ৪০ হাজার টাকার কম, তা জিডিপির অংশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন এবং উন্নয়নশীল বিশ্বের গড়ের চেয়ে অনেক কম। বস্তুত, বঙ্গবন্ধুর সরকার প্রণীত বাংলাদেশের প্রথম বাজেট, যার আকার ছিল জিডিপির প্রায় ১৫ শতাংশ, সে তুলনায় বর্তমান বাজেট জিডিপির অংশ হিসেবে তেমন বড় নয়—২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট জিডিপর ১৭ দশমিক ৫ শতাংশের সমপরিমাণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে এটা ছিল ২৬ দশমিক ১ শতাংশ, নেপালে ৩১ দশমিক ৯ শতাংশ, মালদ্বীপে ৩১ দশমিক শূন্য শতাংশ, ভিয়েতনামে ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ। সুতরাং বাজেটের মাধ্যমে যে আয় ও সম্পদের পুনর্বণ্টন, তার সুযোগই অনেকাংশে সীমিত হয়ে যায়, যখন তার আকারই হয় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক ছোট। বাস্তবায়ন সক্ষমতার সঙ্গে অন্যতম আরেকটি কারণ হলো, কর ও কর-বহির্ভূত রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করে ব্যয়যোগ্য সম্পদ আহরণ করার জন্য যে উদ্যোগ-উদ্যম প্রয়োজন, সে জায়গায়ই রয়ে গেছে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। জানা কথা, বাংলাদেশে রাজস্ব-জিডিপির হার, যা বর্তমানে ৯ দশমিক শূন্য শতাংশ, তা দক্ষিণ এশিয়া ও উন্নয়নশীল বিশ্বে সর্বনিম্ন। আর যেটা আদায় হয় তার দুই-তৃতীয়াংশ অপ্রত্যক্ষ কর এবং মাত্র এক-তৃতীয়াংশ প্রত্যক্ষ কর থেকে। অনেক দেশেই এই অনুপাত বিপরীত। প্রত্যক্ষ করারোপের মাধ্যমে আহরিত অর্থই পুনর্বণ্টনের সুযোগ বেশি সৃষ্টি করে; অপ্রত্যক্ষ করের অভিঘাত এসে পড়ে মূলত সাধারণ মানুষ ও ভোক্তার ওপর। তাই রাজস্ব আয়কাঠামো এবং সরকারি ব্যয়ের আকার ও পরিধি—এ দুই দিক থেকেই পুনর্বণ্টনের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ছে।
২০২১-২২ অর্থবছরের ব্যয়কাঠামোতে সামাজিক সুরক্ষা, কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্য খাতে চলমান অতিমারির প্রেক্ষাপটে আরও অনেক বেশি বরাদ্দের প্রয়োজন ছিল। অতিমারির পূর্বে যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল, অতিমারির সময়ে তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘নতুন দরিদ্র’রা। কর্মসুযোগ যাঁরা হারিয়েছিলেন, তাঁরা কাজ ফিরে পেলেও অনেকেরই আয় কমে গেছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেমন ছোট ব্যবসায়ী, দোকানের মালিক ও তাঁদের কর্মচারী, ক্ষুদ্র বিক্রেতা, পরিবহনশ্রমিক, পর্যটনশিল্পে নিয়োজিতরাসহ অনেকেই হয় কাজ হারিয়েছেন বা তাঁদের আয় হ্রাস পেয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা দিয়ে এদের সবাইকে সাহায্য প্রদান করা সম্ভব হবে না। আর করতে গেলে তার পরিমাণ হবে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করে এবং তার বাস্তবায়নের গুণগত মান নিশ্চিত করে পুরোনো ও নতুন দরিদ্রসহ সব প্রান্তজনকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা আজ জরুরি হয়ে পড়েছে।
একই সঙ্গে সরকারি ব্যয়ে বাস্তবায়িত প্রকল্পের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী ও সময়মাফিক বাস্তবায়ন ও সুশাসন নিশ্চিত করা পুনর্বণ্টনের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ দুই কারণে—প্রথমত, সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় মূলত জনগণেরই করের টাকায় অথবা অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের টাকায়, যার সুদাসলসহ ঋণ পরিষেবা করতে হয় জনগণের করের টাকায়। তাই এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে যখন বিলম্ব, দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে ব্যয় বৃদ্ধি হয়, তার দায়ভার শেষ বিচারে করদাতাদের ওপরই বর্তায়। দ্বিতীয়ত, ব্যয় বৃদ্ধি পেলে সরকারি পরিষেবার মূল্য বৃদ্ধি পায়। যেমন—সেতুর টোলের হার, বিদ্যুতের মূল্য, গ্যাসের বিল বাড়িয়ে তার খেসারত দিতে হয়। সেই মূল্যবৃদ্ধির ভার বহন করতে হয় জনগণকেই। তাই বাজেট সাশ্রয়ীভাবে, সময়মাফিক ও সুশাসনের ভিত্তিতে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, তা জাতীয় আয়ের পুনর্বণ্টনের নিরিখে আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক।
আয়ের পুনর্বণ্টনের সঙ্গে শোভন কর্মসংস্থানের সম্পর্ক নিবিড় ও সরাসরি। ২০২১-২২ বাজেটে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি অনেকাংশে নির্ভর করবে ব্যক্তি খাতকে যেসব প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, তা কীভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে তার ওপর। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির অংশ হিসেবে ২৪-২৫ শতাংশে স্থবির হয়ে আছে কোভিড-পূর্ববর্তী সময় থেকেই। অতিমারির অভিঘাত স্থবির বিনিয়োগে বর্তমানে ক্রমবর্ধমানভাবে দৃশ্যমান। এর প্রতিফলন দেখা যায় ২০২০-২১ অর্থবছরে টার্ম লোনের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে (চলমান ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ), ব্যক্তি খাতের ঋণের শ্লথ প্রবৃদ্ধিতে (অর্থবছরের জন্য প্রাক্কলিত ১৫ শতাংশের বিপরীতে এখন পর্যন্ত ৯ শতাংশ) এবং মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানিতে (প্রথম ১০ মাসে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি) নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে।
ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে চাঞ্চল্য আনার ক্ষেত্রে বাজেটে প্রস্তাবিত করপোরেট কর হ্রাস, করছাড় এবং আমদানি প্রতিস্থাপক ও রপ্তানিমুখী শিল্পে বিভিন্ন প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপ ইতিবাচক। এটা প্রয়োজনীয় কিন্তু যথেষ্ট নয়। একই সঙ্গে ব্যবসা-পরিবেশ ও প্রতিযোগিতা–পরিবেশের উন্নতি ও সহজীকরণ, ওয়ান স্টপ সার্ভিস অ্যাক্ট দ্রুত বাস্তবায়ন, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকে আকর্ষণ করবে সে ধরনের সরকারি বিনিয়োগ বাস্তবায়নের দ্রুততর অগ্রগতি এবং একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল দ্রুততম সময়ে প্রতিষ্ঠার ওপর ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ও বৈদেশিক বিনিয়োগ নির্ভর করবে অনেকাংশেই।
প্রযুক্তি ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়তা, ডিজিটাল অর্থনীতির জন্য অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবনির্ভর ‘নতুন অর্থনীতি’কে উৎসাহিত করতে প্রযুক্তি ফান্ড গঠন, গবেষণা সহায়তা—এসবের জন্যও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে সমান্তরালভাবে। তাহলেই প্রস্তাবিত রাজস্ব প্রণোদনা ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে চাঞ্চল্য এনে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান রাখবে। ভুলে গেলে চলবে না, আয় পুনর্বণ্টনের শ্রেষ্ঠ উপায় উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তি ও দক্ষতানির্ভর শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, যা শ্রমিকদের মানসম্পন্ন জীবনযাত্রা নিশ্চিত করবে এবং জিডিপিতে মজুরির অংশ বৃদ্ধি করবে। বিগত সময়ে জাতীয় আয়ে মজুরির অংশের হ্রাস আয়বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
অতিমারির সময়ে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের জীবনে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে, তাদের সহায়তায় বেশ কিছু পদক্ষেপ ২০২০-২১ বাজেটে নেওয়া হয়েছিল, যা ২০২১-২২ বাজেটেও অব্যাহত আছে। এটা ইতিবাচক। এই সময়ে তাঁদের জন্য বিদেশযাত্রা সহায়তায় ভবিষ্যৎ আয়ের বিপরীতে শূন্য সুদে ঋণ প্রদান জরুরি; যাঁরা ফেরত এসেছেন তাঁদের জন্য ঋণসুবিধাসহ অন্যান্য পদক্ষেপ আরও শক্তিশালী করা এবং সহায়তার পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। প্রয়োজন অভিবাসন ব্যয় হ্রাস, যা গড়ে শ্রমিকপ্রতি বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী চার লাখ টাকারও বেশি, যা একজন অভিবাসী শ্রমিকের ১৮ মাসের আয়ের সমপরিমাণ। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে গড়ে বছরে সাত লাখেরও বেশি শ্রমিক দেশের বাইরে গেছেন। এ সংখ্যা প্রতিবছর যেসংখ্যক শ্রমিক শ্রম বাজারে যোগ দেন তার প্রায় এক-তৃতীয়াংশের সমান। অতিমারির কারণে এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, যার চাপ পড়বে অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারের ওপর। অর্থনীতিতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি তাই এখন আরও জরুরি হয়ে পড়েছে। এবং এটা অনেকাংশেই নির্ভর করবে বাজেটের পূর্ণ ও গুণমানসম্পন্ন বাস্তবায়ন ও ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের তাৎপর্যপূর্ণ বৃদ্ধির ওপর।
পুনর্বণ্টনের দিক থেকে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজস্ব সংস্কারের উদ্যোগ অনেক ক্ষেত্রেই অবহেলিত রয়ে গেছে। ব্যাংকিং কমিশন গঠনের দাবি অনেক দিনের এবং এ প্রসঙ্গ জাতীয় সংসদের বাজেট-পরবর্তী আলোচনায়ও উল্লেখিত হয়েছে। কৃষিপণ্য মূল্য কমিশন গঠন এখন সময়ের দাবি। সর্বজনীন পেনশন স্কিম, সামাজিক নিরাপত্তা জাল থেকে সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তায় উত্তরণ, স্বাস্থ্যবিমার প্রচলন—এসব কথা সরকারের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী দলিলে অনেকবারই বলা হয়েছে। এসবের পূর্ণ বাস্তবায়নে সময় প্রয়োজন, কিন্তু কাজটা শুরু করার এখনই সময়। শিক্ষায় যখন বরাদ্দ অপর্যাপ্ত থাকে, তখন আন্তপ্রজন্ম দারিদ্র্য ও বৈষম্যের ওপরও তার নেতিবাচক অভিঘাত পড়ে। কোভিডকালে যখন অনলাইন শিক্ষা শহর-গ্রাম এবং ধনী ও নিম্ন আয়ের পরিবারের শিশুদের মধ্যে পার্থক্য বাড়িয়ে দিচ্ছে, তখন এ কথাটা বিবেচনায় রাখা আরও জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসবের মাধ্যমে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার উৎকর্ষতা নিশ্চিত করা গেলে এবং সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা গেলে বাংলাদেশ হবে সত্যিকার অর্থে একটি মানবকল্যাণধর্মী রাষ্ট্র এবং এসব পদক্ষেপ হবে সাধারণ মানুষের পক্ষে আয়, ভোগ ও সম্পদ পুনর্বণ্টনের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
কোভিড অতিমারি থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে আজকাল প্রায়শই শোনা যায় ‘বিল্ড ব্যাক বেটার’ কথাটি। অর্থাৎ, আমরা অতিমারি থেকে উত্তরণ করব এমনভাবে, যেন অতিমারি-পরবর্তী অর্থনীতি ও জীবনমান–পূর্ববর্তী সময়ের থেকে ভিন্নতর ও শ্রেয়তর হয়। এ ধরনের কাঙ্ক্ষিত উত্তরণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক উত্তরণ, যেখানে বরাদ্দ বৃদ্ধি, মানসম্পন্ন বাস্তবায়ন ও বণ্টনের ন্যায্যতা বিধানের মাধ্যমে উপান্তিক-প্রান্তিক মানুষ যাঁরা কোভিডে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁরা ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হন। প্রস্তাবিত বাজেট ২০২১-২২–এ প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে তা করার সুযোগ এখনো আছে।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান
বিশেষ ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)
বাজেটের আলোচনায় যদিও অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ, রাজস্ব ও উন্নয়ন ব্যয়, ঘাটতি অর্থায়ন, বাজেট বাস্তবায়ন এবং রাজস্ব সংস্কার—এসব বিষয়ের ওপরই মূলত নিবদ্ধ থাকে, আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে সরকারি ব্যয় ও বাজেট প্রণয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ভিত্তি আছে। সেটা হলো অপেক্ষাকৃত স্বল্প আয়ের মানুষর সপক্ষে এসবের মাধ্যমে আয়, ভোগ ও সম্পদের পুনর্বণ্টন। স্মর্তব্য যে বাংলাদেশের সংবিধানে ও বর্তমান সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দলিলে কেবল প্রবৃদ্ধি নয়, একটি জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার, রূপকল্প ২০৪১ ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এ আকারের প্রতিফলন রয়েছে।
কর-ন্যায্যতা ও বণ্টন-ন্যায্যতার নিরিখে বাজেট ২০২১-২২-এর প্রস্তাবসমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে প্রবৃদ্ধি ও ব্যবসা, বিনিয়োগ ও উদ্যোক্তা-প্রণোদনায় যে প্রচেষ্টা আছে, কোভিডকালের চাহিদার পিরেপ্রেক্ষিতে নিম্নবিত্ত, কর্মচ্যুত, বেকার, উপান্তিক ও প্রান্তিক মানুষদের প্রকৃত আয় বৃদ্ধি; কর্মসংস্থান, সামাজিক সুরক্ষা ও আয়বৈষম্য হ্রাসের নিরিখে ব্যয়ের প্রস্তাব ও পদক্ষেপসমূহ সে তুলনায় অনেক দুর্বল।
এ কথা জানা যে কোভিডের আক্রমণের আগেই আয়, ভোগ ও সম্পদবৈষম্য বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়ের পরিসংখ্যান এবং বিভিন্ন আর্থসামাজিক সূচকের অগ্রগতি নিঃসন্দেহে আমাদের গৌরব ও গর্বের বিষয়। কিন্তু বিভাজিত তথ্য থেকে দেখা যায় যে এসব সূচকের গড় মান পিছিয়ে পড়া মানুষদের বণ্টনের ন্যায্যতার বিষয়টিকে অনেক ক্ষেত্রেই আড়াল করে রেখেছে। ২০১০ ও ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত খানা-জরিপের হিসাবমতে, বাংলাদেশে আয়ের বিচারে সবচেয়ে ওপরের মানুষদের সঙ্গে সবচেয়ে কম আয়ের মানুষের পার্থক্য বিভিন্ন সূচকে ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং আয়ের বৈষম্য পরিমাপক জিনি-সহগেও তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছিল। ২০২০ সালে কোভিড অতিমারির আক্রমণ–পরবর্তী সময়ে এ বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে। কর্মহীনতা, আয় হ্রাস, সেবা খাত থেকে অনিয়মিত ও স্বল্প আয়ের কৃষিকর্মে স্থানান্তর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আয়-বিনিয়োগে ক্ষতি, নিঃশেষিত সঞ্চয় ও ঋণের ফাঁদে আটকে পড়া—এসব কারণে কোভিডকালীন স্বল্প আয় ও উপান্তিক-প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমানের যে ক্ষয় হয়েছে, বাজেট ও সরকারি ব্যয়ের মাধ্যমে তার প্রতিকূলতা সহনীয় মাত্রায় রাখা ও ঝুঁকি প্রশমন অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে দেখার প্রয়োজন ছিল। সে ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের প্রস্তাবিত রাজস্বকাঠামো, কর প্রস্তাব ও উন্নয়ন বরাদ্দের বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। কোভিড অতিমারির চলমান দ্বিতীয় আঘাত মোকাবিলায় চাহিদার বিবেচনায় এ ঘাটতি আরও বেশি দৃশ্যমান।
পুনর্বণ্টনের নিরিখে একটা বড় বিবেচ্য বিষয় হলো বাজেটের আকার। অনেক সময়ই আমরা বলে থাকি ‘বড় অঙ্কের বাজেট’। কথাটার পেছনে একটা কারণ হলো, যে বাজেট গৃহীত হয়, তা বাস্তবায়িত হয় না। বাজেট বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে তা পরবর্তী সময়ে সংশোধন করতে হয়; অর্থাৎ কাটছাঁট করা হয়। আবার পরবর্তী সময়ে বছর শেষের উপাত্ত থেকে দেখা যায়, সংশোধিত আয় ও বরাদ্দের তুলনায়ও প্রকৃত আয় ও ব্যয় আরও কম। গত কয়েক অর্থবছরে প্রকৃত বাস্তবায়ন প্রস্তাবিত বাজেটের ৮০-৮৫ শতাংশ অতিক্রম করতে পারেনি। এ জন্য প্রায়শই বলা হয়, বাস্তবায়ন করতে সক্ষম না হলে বাজেট বাড়িয়ে লাভ কী? সে কারণে বাজেটের আকার বৃদ্ধি করা হলেই বলা হয় ‘বড় অঙ্কের বাজেট’। অথচ আমাদের যে কথাটার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত তা হলো, কেন আমরা বাস্তবায়ন সক্ষমতা বৃদ্ধি করে ‘বড় বাজেট’ প্রণয়ন করতে পারছি না? এ লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ও সুশাসন নিশ্চিতে বিনিয়োগ করছি না? স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করছি না? মনে রাখা ভালো যে বাংলাদেশে সরকারি ব্যয়, যা বছরে মাথাপিছু ৪০ হাজার টাকার কম, তা জিডিপির অংশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন এবং উন্নয়নশীল বিশ্বের গড়ের চেয়ে অনেক কম। বস্তুত, বঙ্গবন্ধুর সরকার প্রণীত বাংলাদেশের প্রথম বাজেট, যার আকার ছিল জিডিপির প্রায় ১৫ শতাংশ, সে তুলনায় বর্তমান বাজেট জিডিপির অংশ হিসেবে তেমন বড় নয়—২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট জিডিপর ১৭ দশমিক ৫ শতাংশের সমপরিমাণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে এটা ছিল ২৬ দশমিক ১ শতাংশ, নেপালে ৩১ দশমিক ৯ শতাংশ, মালদ্বীপে ৩১ দশমিক শূন্য শতাংশ, ভিয়েতনামে ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ। সুতরাং বাজেটের মাধ্যমে যে আয় ও সম্পদের পুনর্বণ্টন, তার সুযোগই অনেকাংশে সীমিত হয়ে যায়, যখন তার আকারই হয় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক ছোট। বাস্তবায়ন সক্ষমতার সঙ্গে অন্যতম আরেকটি কারণ হলো, কর ও কর-বহির্ভূত রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করে ব্যয়যোগ্য সম্পদ আহরণ করার জন্য যে উদ্যোগ-উদ্যম প্রয়োজন, সে জায়গায়ই রয়ে গেছে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। জানা কথা, বাংলাদেশে রাজস্ব-জিডিপির হার, যা বর্তমানে ৯ দশমিক শূন্য শতাংশ, তা দক্ষিণ এশিয়া ও উন্নয়নশীল বিশ্বে সর্বনিম্ন। আর যেটা আদায় হয় তার দুই-তৃতীয়াংশ অপ্রত্যক্ষ কর এবং মাত্র এক-তৃতীয়াংশ প্রত্যক্ষ কর থেকে। অনেক দেশেই এই অনুপাত বিপরীত। প্রত্যক্ষ করারোপের মাধ্যমে আহরিত অর্থই পুনর্বণ্টনের সুযোগ বেশি সৃষ্টি করে; অপ্রত্যক্ষ করের অভিঘাত এসে পড়ে মূলত সাধারণ মানুষ ও ভোক্তার ওপর। তাই রাজস্ব আয়কাঠামো এবং সরকারি ব্যয়ের আকার ও পরিধি—এ দুই দিক থেকেই পুনর্বণ্টনের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ছে।
২০২১-২২ অর্থবছরের ব্যয়কাঠামোতে সামাজিক সুরক্ষা, কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্য খাতে চলমান অতিমারির প্রেক্ষাপটে আরও অনেক বেশি বরাদ্দের প্রয়োজন ছিল। অতিমারির পূর্বে যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল, অতিমারির সময়ে তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘নতুন দরিদ্র’রা। কর্মসুযোগ যাঁরা হারিয়েছিলেন, তাঁরা কাজ ফিরে পেলেও অনেকেরই আয় কমে গেছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেমন ছোট ব্যবসায়ী, দোকানের মালিক ও তাঁদের কর্মচারী, ক্ষুদ্র বিক্রেতা, পরিবহনশ্রমিক, পর্যটনশিল্পে নিয়োজিতরাসহ অনেকেই হয় কাজ হারিয়েছেন বা তাঁদের আয় হ্রাস পেয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা দিয়ে এদের সবাইকে সাহায্য প্রদান করা সম্ভব হবে না। আর করতে গেলে তার পরিমাণ হবে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করে এবং তার বাস্তবায়নের গুণগত মান নিশ্চিত করে পুরোনো ও নতুন দরিদ্রসহ সব প্রান্তজনকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা আজ জরুরি হয়ে পড়েছে।
একই সঙ্গে সরকারি ব্যয়ে বাস্তবায়িত প্রকল্পের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী ও সময়মাফিক বাস্তবায়ন ও সুশাসন নিশ্চিত করা পুনর্বণ্টনের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ দুই কারণে—প্রথমত, সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় মূলত জনগণেরই করের টাকায় অথবা অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের টাকায়, যার সুদাসলসহ ঋণ পরিষেবা করতে হয় জনগণের করের টাকায়। তাই এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে যখন বিলম্ব, দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে ব্যয় বৃদ্ধি হয়, তার দায়ভার শেষ বিচারে করদাতাদের ওপরই বর্তায়। দ্বিতীয়ত, ব্যয় বৃদ্ধি পেলে সরকারি পরিষেবার মূল্য বৃদ্ধি পায়। যেমন—সেতুর টোলের হার, বিদ্যুতের মূল্য, গ্যাসের বিল বাড়িয়ে তার খেসারত দিতে হয়। সেই মূল্যবৃদ্ধির ভার বহন করতে হয় জনগণকেই। তাই বাজেট সাশ্রয়ীভাবে, সময়মাফিক ও সুশাসনের ভিত্তিতে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, তা জাতীয় আয়ের পুনর্বণ্টনের নিরিখে আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক।
আয়ের পুনর্বণ্টনের সঙ্গে শোভন কর্মসংস্থানের সম্পর্ক নিবিড় ও সরাসরি। ২০২১-২২ বাজেটে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি অনেকাংশে নির্ভর করবে ব্যক্তি খাতকে যেসব প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, তা কীভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে তার ওপর। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির অংশ হিসেবে ২৪-২৫ শতাংশে স্থবির হয়ে আছে কোভিড-পূর্ববর্তী সময় থেকেই। অতিমারির অভিঘাত স্থবির বিনিয়োগে বর্তমানে ক্রমবর্ধমানভাবে দৃশ্যমান। এর প্রতিফলন দেখা যায় ২০২০-২১ অর্থবছরে টার্ম লোনের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে (চলমান ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ), ব্যক্তি খাতের ঋণের শ্লথ প্রবৃদ্ধিতে (অর্থবছরের জন্য প্রাক্কলিত ১৫ শতাংশের বিপরীতে এখন পর্যন্ত ৯ শতাংশ) এবং মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানিতে (প্রথম ১০ মাসে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি) নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে।
ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে চাঞ্চল্য আনার ক্ষেত্রে বাজেটে প্রস্তাবিত করপোরেট কর হ্রাস, করছাড় এবং আমদানি প্রতিস্থাপক ও রপ্তানিমুখী শিল্পে বিভিন্ন প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপ ইতিবাচক। এটা প্রয়োজনীয় কিন্তু যথেষ্ট নয়। একই সঙ্গে ব্যবসা-পরিবেশ ও প্রতিযোগিতা–পরিবেশের উন্নতি ও সহজীকরণ, ওয়ান স্টপ সার্ভিস অ্যাক্ট দ্রুত বাস্তবায়ন, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকে আকর্ষণ করবে সে ধরনের সরকারি বিনিয়োগ বাস্তবায়নের দ্রুততর অগ্রগতি এবং একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল দ্রুততম সময়ে প্রতিষ্ঠার ওপর ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ও বৈদেশিক বিনিয়োগ নির্ভর করবে অনেকাংশেই।
প্রযুক্তি ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়তা, ডিজিটাল অর্থনীতির জন্য অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবনির্ভর ‘নতুন অর্থনীতি’কে উৎসাহিত করতে প্রযুক্তি ফান্ড গঠন, গবেষণা সহায়তা—এসবের জন্যও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে সমান্তরালভাবে। তাহলেই প্রস্তাবিত রাজস্ব প্রণোদনা ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে চাঞ্চল্য এনে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান রাখবে। ভুলে গেলে চলবে না, আয় পুনর্বণ্টনের শ্রেষ্ঠ উপায় উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তি ও দক্ষতানির্ভর শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, যা শ্রমিকদের মানসম্পন্ন জীবনযাত্রা নিশ্চিত করবে এবং জিডিপিতে মজুরির অংশ বৃদ্ধি করবে। বিগত সময়ে জাতীয় আয়ে মজুরির অংশের হ্রাস আয়বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
অতিমারির সময়ে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের জীবনে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে, তাদের সহায়তায় বেশ কিছু পদক্ষেপ ২০২০-২১ বাজেটে নেওয়া হয়েছিল, যা ২০২১-২২ বাজেটেও অব্যাহত আছে। এটা ইতিবাচক। এই সময়ে তাঁদের জন্য বিদেশযাত্রা সহায়তায় ভবিষ্যৎ আয়ের বিপরীতে শূন্য সুদে ঋণ প্রদান জরুরি; যাঁরা ফেরত এসেছেন তাঁদের জন্য ঋণসুবিধাসহ অন্যান্য পদক্ষেপ আরও শক্তিশালী করা এবং সহায়তার পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। প্রয়োজন অভিবাসন ব্যয় হ্রাস, যা গড়ে শ্রমিকপ্রতি বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী চার লাখ টাকারও বেশি, যা একজন অভিবাসী শ্রমিকের ১৮ মাসের আয়ের সমপরিমাণ। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে গড়ে বছরে সাত লাখেরও বেশি শ্রমিক দেশের বাইরে গেছেন। এ সংখ্যা প্রতিবছর যেসংখ্যক শ্রমিক শ্রম বাজারে যোগ দেন তার প্রায় এক-তৃতীয়াংশের সমান। অতিমারির কারণে এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, যার চাপ পড়বে অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারের ওপর। অর্থনীতিতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি তাই এখন আরও জরুরি হয়ে পড়েছে। এবং এটা অনেকাংশেই নির্ভর করবে বাজেটের পূর্ণ ও গুণমানসম্পন্ন বাস্তবায়ন ও ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের তাৎপর্যপূর্ণ বৃদ্ধির ওপর।
পুনর্বণ্টনের দিক থেকে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজস্ব সংস্কারের উদ্যোগ অনেক ক্ষেত্রেই অবহেলিত রয়ে গেছে। ব্যাংকিং কমিশন গঠনের দাবি অনেক দিনের এবং এ প্রসঙ্গ জাতীয় সংসদের বাজেট-পরবর্তী আলোচনায়ও উল্লেখিত হয়েছে। কৃষিপণ্য মূল্য কমিশন গঠন এখন সময়ের দাবি। সর্বজনীন পেনশন স্কিম, সামাজিক নিরাপত্তা জাল থেকে সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তায় উত্তরণ, স্বাস্থ্যবিমার প্রচলন—এসব কথা সরকারের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী দলিলে অনেকবারই বলা হয়েছে। এসবের পূর্ণ বাস্তবায়নে সময় প্রয়োজন, কিন্তু কাজটা শুরু করার এখনই সময়। শিক্ষায় যখন বরাদ্দ অপর্যাপ্ত থাকে, তখন আন্তপ্রজন্ম দারিদ্র্য ও বৈষম্যের ওপরও তার নেতিবাচক অভিঘাত পড়ে। কোভিডকালে যখন অনলাইন শিক্ষা শহর-গ্রাম এবং ধনী ও নিম্ন আয়ের পরিবারের শিশুদের মধ্যে পার্থক্য বাড়িয়ে দিচ্ছে, তখন এ কথাটা বিবেচনায় রাখা আরও জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসবের মাধ্যমে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার উৎকর্ষতা নিশ্চিত করা গেলে এবং সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা গেলে বাংলাদেশ হবে সত্যিকার অর্থে একটি মানবকল্যাণধর্মী রাষ্ট্র এবং এসব পদক্ষেপ হবে সাধারণ মানুষের পক্ষে আয়, ভোগ ও সম্পদ পুনর্বণ্টনের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
কোভিড অতিমারি থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে আজকাল প্রায়শই শোনা যায় ‘বিল্ড ব্যাক বেটার’ কথাটি। অর্থাৎ, আমরা অতিমারি থেকে উত্তরণ করব এমনভাবে, যেন অতিমারি-পরবর্তী অর্থনীতি ও জীবনমান–পূর্ববর্তী সময়ের থেকে ভিন্নতর ও শ্রেয়তর হয়। এ ধরনের কাঙ্ক্ষিত উত্তরণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক উত্তরণ, যেখানে বরাদ্দ বৃদ্ধি, মানসম্পন্ন বাস্তবায়ন ও বণ্টনের ন্যায্যতা বিধানের মাধ্যমে উপান্তিক-প্রান্তিক মানুষ যাঁরা কোভিডে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁরা ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হন। প্রস্তাবিত বাজেট ২০২১-২২–এ প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে তা করার সুযোগ এখনো আছে।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান
বিশেষ ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪