সঞ্জীব দ্রং
চলতি বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করছি আমরা। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে দেশের সব নাগরিক স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই মহোৎসবে সমান আনন্দ উপভোগ করতে পারলে ভালো হতো। নিশ্চয় এই দীর্ঘ সময়ে দেশ অনেক দূর এগিয়েছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে আমরা আশপাশের দেশগুলোর চেয়ে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আমরা অঙ্গীকার করেছিলাম, বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করব। বাঙালি জাতির পাশাপাশি আদিবাসীরাও মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। অবর্ণনীয় যন্ত্রণা ও কষ্ট সইতে হয়েছে আদিবাসীদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে। আমি একাত্তরে পরিবারের সঙ্গে শরণার্থী হয়েছিলাম ভারতের মেঘালয়ে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে এসে গ্রামে ধ্বংসস্তূপ দেখেছিলাম।
সম্পূর্ণ নতুন করে সব শুরু করতে হয়েছিল আমাদের। এখন ভাবতে ভালো লাগছে যে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে আমরা দেখছি প্রিয় স্বদেশ এগিয়ে চলেছে। অন্যদিকে দৃশ্যমান হচ্ছে নাগরিকদের একটি অংশ, ৪০ লক্ষাধিক আদিবাসী মানুষ সবার সঙ্গে সমানতালে এগোতে পারছে না। একদিকে বিশাল বাজেটের মেগা প্রকল্প ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অন্যদিকে সমাজের কিছু মানুষের জীবনে বৈষম্য ও হাহাকারের চিত্র প্রকট হচ্ছে। আদিবাসী জনগণ, চা-শ্রমিক, দলিত, দূর পাহাড়, চর ও হাওর অঞ্চলের মানুষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও অন্যান্য প্রান্তিক মানুষের দুয়ারে এই উন্নয়নের সুফল সমানভাবে পৌঁছাতে পারছে না। ইতিবাচক যা কিছু অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতার
৫০ বছরে, তা হলো, আদিবাসী ইস্যু নিয়ে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। দেশে নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি পর্যায়ে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে আদিবাসী ভাষায় পড়াশোনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এবং পাঁচটি আদিবাসী ভাষায় বই রচিত হয়েছে। নারী উন্নয়ননীতি ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আদিবাসী ইস্যু অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
২০১০ সালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন হয়েছে, যেখানে নৃগোষ্ঠী বলতে আদিবাসীদের উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৯ সালে ৫০টি আদিবাসী জাতির নাম সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় গেজেটভুক্ত করেছে। সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত না হলেও বাজেট বরাদ্দসহ কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে।
গবাদিপশু বিতরণ, কৃষি উপকরণ সরবরাহ, গৃহহীনদের জন্য ঘর, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর সহায়তা, চাকরিতে সীমিত সুযোগ ইত্যাদি আদিবাসী জনগণ পাচ্ছে। সীমান্তবর্তী আদিবাসী গ্রামগুলোতেও বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসবে আদিবাসী শিল্পীরাও অংশগ্রহণ করেছেন। করোনাকালে অপ্রতুল হলেও আদিবাসীরাও কিছু সহায়তা পেয়েছে। বলা যায়, এ ধরনের অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় ২৩ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’
প্রশ্ন হলো, স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা আজ কোথায়? কথা ছিল সবার জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত হবে। জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার কোন স্তরে? কেন শাল্লা, রামু, নাসিরনগরের মতো স্থানে স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটেই চলেছে? কী বেদনায় ও হতাশায় সংখ্যালঘু মানুষ জন্মভূমি-দেশ ছেড়ে চলে যায়? কথা ছিল সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য একটি পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করা হবে। বর্তমান সরকার ২০০৮ সালে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এ নিয়ে কাজ শুরুই হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ছিল। ২৩ বছরেও সেটির পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। দেশ দৃশ্যমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে সত্যি; অন্যদিকে আদিবাসী জনগণ তাদের চিরায়ত, ঐতিহ্যগত ভূমি থেকে বিতাড়িত হচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদ নির্বিচারে উত্তোলন করে প্রাণ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা হচ্ছে। দুর্বল ও ক্ষমতাহীন আদিবাসী মানুষ অসহায়। যে পাহাড় ও বনে আদিবাসীরা একসময় স্বাধীন ও নিরাপদে বিচরণ করত, সেই বনে আদি অধিবাসীদের ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও আদিবাসীদের সঙ্গে কোনো সংলাপ ছাড়াই রিজার্ভ ফরেস্ট, ন্যাশনাল পার্ক, ইকো-পার্ক করা হচ্ছে এবং নানা প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে প্রাকৃতিক বন উজাড় করে। মধুপুর বনে প্রায় ২৫ হাজার গারো ও কোচ আদিবাসীর জীবন এখন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে কেন আমাদের প্রশ্ন করতে হয় দেশে আদিবাসী জনসংখ্যা কত? কেন বিভাজিত তথ্য নেই রাষ্ট্রীয় তথ্যভান্ডারে? আদিবাসী মানুষের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার; অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার; মানবাধিকারের আজ কী অবস্থা? সংখ্যালঘুদের জীবন ও নিরাপত্তা আজ কেমন?
পাহাড়ের মানুষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও অন্যান্য প্রান্তিক মানুষের দৃষ্টি দিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে দেখার চেষ্টা করলে সত্য জানা যাবে আর আমরা ভাবব এই মানুষদের জন্য আরও অনেক কিছু করা জরুরি সামনের দিনগুলোতে। কেন আজও আদিবাসীদের মৌলিক মানবাধিকারকে রাষ্ট্রের চোখে দয়া ও করুণার দৃষ্টিতে দেখা হয়?
জকল্যাণমূলক যেসব পদক্ষেপ আদিবাসী মানুষের জন্য নেওয়া হয়, সেখানে কোথাও কি আছে আদিবাসীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার? যেহেতু ঐতিহাসিকভাবে আদিবাসীরা শোষণ, অবিচার ও বঞ্চনার শিকার, তাই ওরা অনগ্রসর রয়ে গেছে। এসব কারণে আদিবাসীদের জন্য চাকরিতে কোটা ছিল, তাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আদিবাসীরা নিশ্চয় অনন্তকাল ধরে কোটা চায় না। আজ বলি, আদিবাসী মানুষের অধিকার হৃদয়ে ধারণ করা, সম্মান করা অথবা আদিবাসী অধিকার একটু বুঝতে চেষ্টা
করার কাজটা আমরা যথাযথভাবে করতে পারিনি।
জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণ সম্পর্কে রাষ্ট্রের সঠিক নীতি প্রণীত হয়নি। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল, একটি সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা হবে। এ নিয়েও কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়।
আদিবাসীদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আনন্দ-বেদনা-উন্নয়ন ও এগিয়ে যাওয়া জড়িয়ে আছে ওদের সামষ্টিক সংস্কৃতি চেতনায়। ওদের এই মনস্তত্ত্বকে, জীবন ভাবনার বিশ্বজনীনতাকে আমাদের বুঝতে হবে। বুঝতে হবে ভালোবাসা ও মমতা দিয়ে, শক্তির দাপটে নয়। ওদের জীবনে বহিরাগতরা প্রবল রাষ্ট্রীয় শক্তি নিয়ে ঢুকে গেছে আর সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের মতো চলে গেছে জমি, বন, প্রাকৃতিক সম্পদ। ওরা এখন অধিকারহীন অসহায় মানুষ। বিনম্র, প্রচণ্ড ভালোবাসা ছাড়া আদিবাসীদের উন্নয়ন এখন আর সম্ভব নয়। রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি—সবখানে এই ভালোবাসার প্রতিফলন দরকার। আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ওদের মনে যেন এই ধারণা না জন্মায়, ওরা অন্যের দ্বারা শাসিত হচ্ছে, শাসকগোষ্ঠী ওদের শাসন করছে। এই কাজ করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং মূল দায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের। সবকিছুর জন্য দরকার আদিবাসীদের সঙ্গে অর্থপূর্ণ আলাপ-আলোচনা ও সংলাপ। আদিবাসীদের আস্থায় এনে কাজটি করতে হবে।
আশা করি, একদিন রাষ্ট্র অনেক বেশি গণতান্ত্রিক ও মানবিক হবে। দেশে একটি সংবেদনশীল আদিবাসী নীতি থাকবে। সেই নীতির মূল কথা হবে—আদিবাসী স্পর্শ বা ইনডিজিনাস টাচ। গভীর আন্তরিকতা, শুদ্ধতা ও উদারতা নিয়ে লেখা হবে সেই নীতিমালার বাক্যগুলো। আমাদের সবাইকে মিলেমিশে রাষ্ট্রকে তার সঠিক জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। আদিবাসী-বাঙালি যোগাযোগের সংবাহন বিন্দু গড়ে উঠবে। সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই—কথাগুলো সত্যি হবে। এখানে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-সুরমার সঙ্গে সাংগু-মাইনী-বুগাই-সীমসাং নদীকে মেলাবার আয়োজন শুরু হবে, জীবনে জীবন যোগ হবে।
সঞ্জীব দ্রং, লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী
চলতি বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করছি আমরা। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে দেশের সব নাগরিক স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই মহোৎসবে সমান আনন্দ উপভোগ করতে পারলে ভালো হতো। নিশ্চয় এই দীর্ঘ সময়ে দেশ অনেক দূর এগিয়েছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে আমরা আশপাশের দেশগুলোর চেয়ে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আমরা অঙ্গীকার করেছিলাম, বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করব। বাঙালি জাতির পাশাপাশি আদিবাসীরাও মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। অবর্ণনীয় যন্ত্রণা ও কষ্ট সইতে হয়েছে আদিবাসীদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে। আমি একাত্তরে পরিবারের সঙ্গে শরণার্থী হয়েছিলাম ভারতের মেঘালয়ে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে এসে গ্রামে ধ্বংসস্তূপ দেখেছিলাম।
সম্পূর্ণ নতুন করে সব শুরু করতে হয়েছিল আমাদের। এখন ভাবতে ভালো লাগছে যে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে আমরা দেখছি প্রিয় স্বদেশ এগিয়ে চলেছে। অন্যদিকে দৃশ্যমান হচ্ছে নাগরিকদের একটি অংশ, ৪০ লক্ষাধিক আদিবাসী মানুষ সবার সঙ্গে সমানতালে এগোতে পারছে না। একদিকে বিশাল বাজেটের মেগা প্রকল্প ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অন্যদিকে সমাজের কিছু মানুষের জীবনে বৈষম্য ও হাহাকারের চিত্র প্রকট হচ্ছে। আদিবাসী জনগণ, চা-শ্রমিক, দলিত, দূর পাহাড়, চর ও হাওর অঞ্চলের মানুষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও অন্যান্য প্রান্তিক মানুষের দুয়ারে এই উন্নয়নের সুফল সমানভাবে পৌঁছাতে পারছে না। ইতিবাচক যা কিছু অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতার
৫০ বছরে, তা হলো, আদিবাসী ইস্যু নিয়ে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। দেশে নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি পর্যায়ে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে আদিবাসী ভাষায় পড়াশোনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এবং পাঁচটি আদিবাসী ভাষায় বই রচিত হয়েছে। নারী উন্নয়ননীতি ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আদিবাসী ইস্যু অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
২০১০ সালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন হয়েছে, যেখানে নৃগোষ্ঠী বলতে আদিবাসীদের উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৯ সালে ৫০টি আদিবাসী জাতির নাম সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় গেজেটভুক্ত করেছে। সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত না হলেও বাজেট বরাদ্দসহ কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে।
গবাদিপশু বিতরণ, কৃষি উপকরণ সরবরাহ, গৃহহীনদের জন্য ঘর, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর সহায়তা, চাকরিতে সীমিত সুযোগ ইত্যাদি আদিবাসী জনগণ পাচ্ছে। সীমান্তবর্তী আদিবাসী গ্রামগুলোতেও বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসবে আদিবাসী শিল্পীরাও অংশগ্রহণ করেছেন। করোনাকালে অপ্রতুল হলেও আদিবাসীরাও কিছু সহায়তা পেয়েছে। বলা যায়, এ ধরনের অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় ২৩ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’
প্রশ্ন হলো, স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা আজ কোথায়? কথা ছিল সবার জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত হবে। জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার কোন স্তরে? কেন শাল্লা, রামু, নাসিরনগরের মতো স্থানে স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটেই চলেছে? কী বেদনায় ও হতাশায় সংখ্যালঘু মানুষ জন্মভূমি-দেশ ছেড়ে চলে যায়? কথা ছিল সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য একটি পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করা হবে। বর্তমান সরকার ২০০৮ সালে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এ নিয়ে কাজ শুরুই হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ছিল। ২৩ বছরেও সেটির পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। দেশ দৃশ্যমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে সত্যি; অন্যদিকে আদিবাসী জনগণ তাদের চিরায়ত, ঐতিহ্যগত ভূমি থেকে বিতাড়িত হচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদ নির্বিচারে উত্তোলন করে প্রাণ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা হচ্ছে। দুর্বল ও ক্ষমতাহীন আদিবাসী মানুষ অসহায়। যে পাহাড় ও বনে আদিবাসীরা একসময় স্বাধীন ও নিরাপদে বিচরণ করত, সেই বনে আদি অধিবাসীদের ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও আদিবাসীদের সঙ্গে কোনো সংলাপ ছাড়াই রিজার্ভ ফরেস্ট, ন্যাশনাল পার্ক, ইকো-পার্ক করা হচ্ছে এবং নানা প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে প্রাকৃতিক বন উজাড় করে। মধুপুর বনে প্রায় ২৫ হাজার গারো ও কোচ আদিবাসীর জীবন এখন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে কেন আমাদের প্রশ্ন করতে হয় দেশে আদিবাসী জনসংখ্যা কত? কেন বিভাজিত তথ্য নেই রাষ্ট্রীয় তথ্যভান্ডারে? আদিবাসী মানুষের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার; অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার; মানবাধিকারের আজ কী অবস্থা? সংখ্যালঘুদের জীবন ও নিরাপত্তা আজ কেমন?
পাহাড়ের মানুষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও অন্যান্য প্রান্তিক মানুষের দৃষ্টি দিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে দেখার চেষ্টা করলে সত্য জানা যাবে আর আমরা ভাবব এই মানুষদের জন্য আরও অনেক কিছু করা জরুরি সামনের দিনগুলোতে। কেন আজও আদিবাসীদের মৌলিক মানবাধিকারকে রাষ্ট্রের চোখে দয়া ও করুণার দৃষ্টিতে দেখা হয়?
জকল্যাণমূলক যেসব পদক্ষেপ আদিবাসী মানুষের জন্য নেওয়া হয়, সেখানে কোথাও কি আছে আদিবাসীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার? যেহেতু ঐতিহাসিকভাবে আদিবাসীরা শোষণ, অবিচার ও বঞ্চনার শিকার, তাই ওরা অনগ্রসর রয়ে গেছে। এসব কারণে আদিবাসীদের জন্য চাকরিতে কোটা ছিল, তাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আদিবাসীরা নিশ্চয় অনন্তকাল ধরে কোটা চায় না। আজ বলি, আদিবাসী মানুষের অধিকার হৃদয়ে ধারণ করা, সম্মান করা অথবা আদিবাসী অধিকার একটু বুঝতে চেষ্টা
করার কাজটা আমরা যথাযথভাবে করতে পারিনি।
জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণ সম্পর্কে রাষ্ট্রের সঠিক নীতি প্রণীত হয়নি। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল, একটি সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা হবে। এ নিয়েও কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়।
আদিবাসীদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আনন্দ-বেদনা-উন্নয়ন ও এগিয়ে যাওয়া জড়িয়ে আছে ওদের সামষ্টিক সংস্কৃতি চেতনায়। ওদের এই মনস্তত্ত্বকে, জীবন ভাবনার বিশ্বজনীনতাকে আমাদের বুঝতে হবে। বুঝতে হবে ভালোবাসা ও মমতা দিয়ে, শক্তির দাপটে নয়। ওদের জীবনে বহিরাগতরা প্রবল রাষ্ট্রীয় শক্তি নিয়ে ঢুকে গেছে আর সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের মতো চলে গেছে জমি, বন, প্রাকৃতিক সম্পদ। ওরা এখন অধিকারহীন অসহায় মানুষ। বিনম্র, প্রচণ্ড ভালোবাসা ছাড়া আদিবাসীদের উন্নয়ন এখন আর সম্ভব নয়। রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি—সবখানে এই ভালোবাসার প্রতিফলন দরকার। আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ওদের মনে যেন এই ধারণা না জন্মায়, ওরা অন্যের দ্বারা শাসিত হচ্ছে, শাসকগোষ্ঠী ওদের শাসন করছে। এই কাজ করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং মূল দায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের। সবকিছুর জন্য দরকার আদিবাসীদের সঙ্গে অর্থপূর্ণ আলাপ-আলোচনা ও সংলাপ। আদিবাসীদের আস্থায় এনে কাজটি করতে হবে।
আশা করি, একদিন রাষ্ট্র অনেক বেশি গণতান্ত্রিক ও মানবিক হবে। দেশে একটি সংবেদনশীল আদিবাসী নীতি থাকবে। সেই নীতির মূল কথা হবে—আদিবাসী স্পর্শ বা ইনডিজিনাস টাচ। গভীর আন্তরিকতা, শুদ্ধতা ও উদারতা নিয়ে লেখা হবে সেই নীতিমালার বাক্যগুলো। আমাদের সবাইকে মিলেমিশে রাষ্ট্রকে তার সঠিক জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। আদিবাসী-বাঙালি যোগাযোগের সংবাহন বিন্দু গড়ে উঠবে। সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই—কথাগুলো সত্যি হবে। এখানে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-সুরমার সঙ্গে সাংগু-মাইনী-বুগাই-সীমসাং নদীকে মেলাবার আয়োজন শুরু হবে, জীবনে জীবন যোগ হবে।
সঞ্জীব দ্রং, লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪