দীপংকর মোহান্ত
প্রকৃতির হাতে গড়া অনিন্দ্যসুন্দর জনপদের নাম মৌলভীবাজার। জীববৈচিত্র্য ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিচিত্র কোলাহল জেলাটিকে সর্বদা সচল রাখছে। জেলার একদিকে বড় বড় পাহাড়–টিলা, অন্যদিকে ছোট-বড় হাওর। পাহাড়ঘেরা সবুজ–শ্যামল প্রকৃতি। তারই নিচে সবুজবরণ টিলায় ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’র হাতছানি। দিনান্তে সূর্যদেব ‘বাইক্যা’ বিলে তার রক্তিম রং নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন উদয় হয় কুলাউড়ার কালা পাহাড়ের উঁচু চূড়ার ফাঁক দিয়ে। তার আলো ঠিকরে পড়ে কমলগঞ্জের ‘রাজকান্দির’ বাঁশবনের হেলানো-দোলানো মাথায়।
সেই সুদূর অতীত থেকে এই অঞ্চলে অস্ট্রিক নৃগোষ্ঠীর পদধ্বনি শোনা যায়। আগে কুকি, সিন্টেঙ্গদের বসবাস ছিল এখানে। এখনো এখানকার পাহাড়ে মাতৃতান্ত্রিক ‘খাসি’ সমাজ আছে নির্বিঘ্নে। নৃগোষ্ঠী ত্রিপুরাদের বসতিও অনেক প্রাচীন। ঐতিহাসিক বিভিন্ন নিদর্শন সাক্ষ্য দেয়—ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যেই এ অঞ্চলে বহিরাগত লোকেদের স্থায়ী আবাসন গড়ে উঠেছে। বণিক ব্রিটিশদের নখের আঁচড়ে মণিপুরিদের আগমন ঘটে ১৮ শতকের দিকে।
ঔপনিবেশিক শক্তির হাত ধরে মৌলভীবাজারে চা-শিল্পের বিকাশ ঘটে। চা–বাগান পত্তনকালে ‘আড়কাটি’র মাধ্যমে ভারতের নানা জায়গা থেকে বহুভাষিক লোকজনের আগমন ঘটে। তারাই মৌলভীবাজারে সবুজ টিলায় চা–গাছ রোপণ করেছে দেড় শ বছর আগে। ফলে এই জনপদ বহু ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর।
প্রশাসনিক কারণে মৌলভীবাজার বরাবর ‘শ্রীহট্ট মণ্ডলে’ যুক্ত ছিল। এর কিছু অংশ ত্রিপুরা রাজার অধীনে ছিল। ১৮৮২ সালে দক্ষিণ শ্রীহট্ট মহকুমা নাম ধরে অঞ্চলটির নতুন যাত্রা হয়। পরে নাম হয় মৌলভীবাজার মহকুমা। ১৯৮৪ সালে মৌলভীবাজার জেলা সৃষ্টি হয়।
প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার হিসেবে খ্যাত মৌলভীবাজারে ৯২টি চা–বাগান রয়েছে। বাংলাদেশের মধ্যে মৌলভীবাজারেই সবচেয়ে বেশি চা–বাগান রয়েছে। বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের পাশাপাশি খাসিয়া, মণিপুরি, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, মুণ্ডাসহ বহু কৃষ্টি সংস্কৃতির মানুষ এখানে একসঙ্গে বাস করছে। মণিপুরিদের মধ্যে আবার রয়েছে বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতৈ ও মুসলিম মণিপুরিরা। প্রাচীনকাল থেকেই এখানকার সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা পরম্পরাগত। ফলে বিচিত্রের মধ্যে ঐক্যই এ জেলার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
ভৌগোলিক কারণে মোগল আমল থেকে মৌলভীবাজার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কোম্পানি আমলে যোগাযোগব্যবস্থার আধুনিকীকরণ হয়। আসাম ও বঙ্গীয় অঞ্চলের মধ্যে রেলযোগাযোগ স্থাপিত হয় এই জেলার বুক চিরেই। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শমসেরনগরে স্থাপিত হয়েছিল বড় বিমানবন্দর।
ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে এখানকার আয়ের বড় উৎস ছিল চা ও আতর রপ্তানি। এই আতর মুম্বাই হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে চালান দেওয়ার পথ ছিল। এখন ইউরোপ পর্যন্ত যাচ্ছে। এখানকার মানুষের অভাব-অনটন অপেক্ষাকৃত কম ছিল। মাছের বড় জোগান আসত স্থানীয় নদী ও হাওর থেকে। ফলের মধ্যে শ্রীমঙ্গলের লেবু-আনারস, বড়লেখার কমলা ইত্যাদি আগেই বিখ্যাত ছিল। খাসিয়াদের পান ও মণিপুরিদের হাতে কোটা চিড়া স্থানীয়ভাবে প্রসিদ্ধ ছিল। উনিশ শতকের চল্লিশের দশক থেকে জেলায় অর্থনৈতিক উন্নতির আরেক পথ খুলে যায় ‘লন্ডনি ভাইসাবদের’ মাধ্যমে। তখন ‘রানির ভাইচার’ দিয়ে ‘লন্ডন’ যাওয়ার ঝড় উঠেছিল।
আশির দশকে মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমের বাজার উন্মুক্ত হলে এই জেলার শত শত লোক মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমায়। এখনো এই জেলার আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো টাকা। একুশ শতকে বিশ্বায়নের প্রভাবে মৌলভীবাজারের স্থানীয় অর্থনীতির ধরন বদলে যায়। নতুন নতুন আয়ের দ্বার উন্মোচিত হয়। চাঙা হয়ে ওঠে স্থানীয় অর্থনীতি। সরকারি-বেসরকারি বহুমুখী পদক্ষেপের ফলে নতুন নতুন অর্থনীতির ক্ষেত্র এখন দৃশ্যমান হচ্ছে, যার মধ্যে পর্যটন একটি। এই বিকাশমান শিল্পগুলোর যথাযথ ও পরিকল্পিত উন্নয়ন হলে স্থানীয় জীবনমান যেমন সমৃদ্ধ হবে, তেমনি দেশের আর্থিক খাতের বিস্তৃতি ঘটবে।
পর্যটনশিল্প: চা–শিল্পের পর বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলায় পর্যটনশিল্প অনেক গতিশীল। এই আয় প্রত্যক্ষভাবে বহুমাত্রিক পরিবার ভোগ করছে। অর্থাৎ, প্রান্তিক পরিবার থেকে উচ্চবিত্তের ঘর পর্যন্ত অর্থের প্রবাহ সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ ২০–২৫ বছর আগেও আজকের পর্যটনের স্থানগুলো ছিল বিভিন্ন স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে বনভোজনের আকর্ষণীয় জায়গা। কিন্তু বাজার অর্থনীতি সমৃদ্ধির কারণে এখন বহু পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে, যা শিল্পের রূপ নিয়েছে। নগদ আয়ের পাশাপাশি বহু কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। অন্যান্য জেলার সঙ্গে রেল ও সড়কপথে যোগাযোগ থাকায় শ্রীমঙ্গলকেন্দ্রিক পর্যটনশিল্প অনেক চাঙা হয়েছে। খাতসংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্যমতে, পর্যটন খাতে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা চলে এখানে।
প্রতিবছর সাত–আট লাখ লোক মৌলভীবাজারের নানা পর্যটন স্থানে ভ্রমণ করে। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে ছোট–বড় কর্মসংস্থানের পথ। পাল্টে গেছে শ্রীমঙ্গল, বড়লেখা, কমলগঞ্জ ও মৌলভীবাজার সদরের পুরোনো ব্যবসার ধরন ও জনমানস। আদিকালের হোটেলের বদলে পাঁচ তারকা ও তিন তারকা মানের হোটেল গড়ে উঠেছে। রয়েছে বাগানবাড়ি, রিসোর্ট ও কটেজ, ইকো-কটেজ ইত্যাদি। শুধু শ্রীমঙ্গলেই সম্প্রতি গড়ে উঠেছে প্রায় ৮০টি রিসোর্ট। পর্যটন মৌসুমে সরকারি বিভিন্ন বিভাগের গেস্টহাউসও অতিথিদের জন্য ভরে ওঠে। তা ছাড়া শহরের মধ্যে কিছু বাসাবাড়ির একাংশ পর্যটকদের ভাড়া দেওয়ার রেওয়াজও চালু হয়েছে। সেখানে নিজেরা রান্না করে খাওয়া যায়; আবার পরিবারের সঙ্গে খাওয়ার সুযোগ থাকে। নব্য এই ব্যবসা বিভিন্ন পরিবারের আয় বাড়াচ্ছে।
বেশির ভাগ কটেজ ও রিসোর্ট গড়ে উঠেছে পাহাড়-টিলা, পাহাড়ি ছড়া ও লেকের পাশে। নিম্ন–মধ্যবিত্তের ফ্যামিলি স্যুটের হোটেলও কম নয়। সব মিলিয়ে শুধু হোটেলগুলোতেই প্রায় ১২-১৫ হাজারের মতো লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এর বাইরে ছোট ছোট অনেক স্থায়ী ও অস্থায়ী মুখরোচক খাবারের দোকান, চা-পানের টং, বিপণিবিতান তো রয়েছেই। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর তথ্যমতে, শুধু শ্রীমঙ্গলেই এমন নিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। শতাধিক ব্যক্তি এখন ট্যুর গাইডকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। পর্যটন বিকাশের কারণে মণিপুরি হস্তশিল্পসহ স্থানীয় শিল্পের বিকাশ হচ্ছে।
স্থানীয় কৃষির ওপরও পড়েছে ইতিবাচক প্রভাব। লেবু, আনারস ও চা-পাতা সংগ্রহ পর্যটকদের শখের বিষয়। জিপগাড়িসহ নানা পরিবহনসংশ্লিষ্ট লোকের আয় বেড়েছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতও সম্প্রসারিত হচ্ছে।
মৌলভীবাজারে পর্যটন অনেক বিকশিত হলেও এখনো তা পূর্ণতা পায়নি। অধরা রয়ে গেছে আরও বিস্তর সম্ভাবনা। আজ কোভিড-১৯ পরিস্থিতি পর্যটনশিল্পকে থমকে দিয়েছে। তবে সব সরকারি-বেসরকারি খাতের সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে এই উদীয়মান শিল্পকে এর মধ্যেও গতিশীল করা সম্ভব।
আতর ও চা–শিল্প এই অঞ্চলের বৈদেশিক আয়ের উল্লেখযোগ্য উৎস। কিন্তু প্রায় তিন শতাব্দী ধরে এ দুই খাত প্রথাগত নিয়মে চলছে। প্রাকৃতিক গন্ধযুক্ত আতরের ঘ্রাণে প্রাণ জুড়ায়। অথচ এই শিল্প এখন প্রায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই চলছে। জেলার বড়লেখা উপজেলার মাটি আগরগাছের উপযোগী। বড়লেখার সুজানগর ইউনিয়নেই শুধু আতর তৈরির প্রায় ২০০ কারখানা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে আতর ও আগরের বিশাল বাজার রয়েছে। এই সম্ভাবনা এখনো পূর্ণ বিকশিত নয়।
বর্তমানে কমলগঞ্জ ও মৌলভীবাজার সদর উপজেলায়ও আতর উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু এখনো এর উৎপাদন চলছে সাবেকি পন্থায়। তার পরও প্রতি বছর প্রায় ৭০০–৮০০ কোটি টাকার আতর রপ্তানি হয় বিদেশে। এই শিল্পে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত। কিন্তু এই খাত এখনো তেমন কোনো সরকারি সহায়তা পায়নি। আতর পরিবহনে নানা আইনি জটিলতা এখনো রয়ে গেছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিকল্পনা থাকলে পোশাকশিল্পের মতো বৈদেশিক মুদ্রা এই খাত থেকে আয় করা সম্ভব। এ জন্য শুরুতেই আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার চালুসহ বিপণনে আইনি জটিলতা কমানো দরকার।
সব মিলিয়ে পর্যটন, চা ও আতরশিল্পই মৌলভীবাজারের অর্থনীতির মূল শক্তি। রয়েছে প্রবাসী আয়ের বিরাট ভিত্তি। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা এই মাটির সন্তানদের জন্য দরজা খুলে দিলে এসব খাতে তাদের বিপুল বিনিয়োগ আনা সম্ভব। কিছু কিছু হচ্ছেও। কিন্তু সরকারি বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হলে এটি আরও বেগবান হবে। সব মিলিয়ে জাতি ও অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যই মৌলভীবাজারের মূল শক্তি। এটি পুরো দেশের অর্থনৈতিক শক্তিরও একটি উৎস হয়ে উঠতে পারে।
দীপংকর মোহান্ত
মুক্তিযুদ্ধ ও নৃতত্ত্ববিষয়ক গবেষক
প্রকৃতির হাতে গড়া অনিন্দ্যসুন্দর জনপদের নাম মৌলভীবাজার। জীববৈচিত্র্য ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিচিত্র কোলাহল জেলাটিকে সর্বদা সচল রাখছে। জেলার একদিকে বড় বড় পাহাড়–টিলা, অন্যদিকে ছোট-বড় হাওর। পাহাড়ঘেরা সবুজ–শ্যামল প্রকৃতি। তারই নিচে সবুজবরণ টিলায় ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’র হাতছানি। দিনান্তে সূর্যদেব ‘বাইক্যা’ বিলে তার রক্তিম রং নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন উদয় হয় কুলাউড়ার কালা পাহাড়ের উঁচু চূড়ার ফাঁক দিয়ে। তার আলো ঠিকরে পড়ে কমলগঞ্জের ‘রাজকান্দির’ বাঁশবনের হেলানো-দোলানো মাথায়।
সেই সুদূর অতীত থেকে এই অঞ্চলে অস্ট্রিক নৃগোষ্ঠীর পদধ্বনি শোনা যায়। আগে কুকি, সিন্টেঙ্গদের বসবাস ছিল এখানে। এখনো এখানকার পাহাড়ে মাতৃতান্ত্রিক ‘খাসি’ সমাজ আছে নির্বিঘ্নে। নৃগোষ্ঠী ত্রিপুরাদের বসতিও অনেক প্রাচীন। ঐতিহাসিক বিভিন্ন নিদর্শন সাক্ষ্য দেয়—ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যেই এ অঞ্চলে বহিরাগত লোকেদের স্থায়ী আবাসন গড়ে উঠেছে। বণিক ব্রিটিশদের নখের আঁচড়ে মণিপুরিদের আগমন ঘটে ১৮ শতকের দিকে।
ঔপনিবেশিক শক্তির হাত ধরে মৌলভীবাজারে চা-শিল্পের বিকাশ ঘটে। চা–বাগান পত্তনকালে ‘আড়কাটি’র মাধ্যমে ভারতের নানা জায়গা থেকে বহুভাষিক লোকজনের আগমন ঘটে। তারাই মৌলভীবাজারে সবুজ টিলায় চা–গাছ রোপণ করেছে দেড় শ বছর আগে। ফলে এই জনপদ বহু ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর।
প্রশাসনিক কারণে মৌলভীবাজার বরাবর ‘শ্রীহট্ট মণ্ডলে’ যুক্ত ছিল। এর কিছু অংশ ত্রিপুরা রাজার অধীনে ছিল। ১৮৮২ সালে দক্ষিণ শ্রীহট্ট মহকুমা নাম ধরে অঞ্চলটির নতুন যাত্রা হয়। পরে নাম হয় মৌলভীবাজার মহকুমা। ১৯৮৪ সালে মৌলভীবাজার জেলা সৃষ্টি হয়।
প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার হিসেবে খ্যাত মৌলভীবাজারে ৯২টি চা–বাগান রয়েছে। বাংলাদেশের মধ্যে মৌলভীবাজারেই সবচেয়ে বেশি চা–বাগান রয়েছে। বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের পাশাপাশি খাসিয়া, মণিপুরি, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, মুণ্ডাসহ বহু কৃষ্টি সংস্কৃতির মানুষ এখানে একসঙ্গে বাস করছে। মণিপুরিদের মধ্যে আবার রয়েছে বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতৈ ও মুসলিম মণিপুরিরা। প্রাচীনকাল থেকেই এখানকার সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা পরম্পরাগত। ফলে বিচিত্রের মধ্যে ঐক্যই এ জেলার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
ভৌগোলিক কারণে মোগল আমল থেকে মৌলভীবাজার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কোম্পানি আমলে যোগাযোগব্যবস্থার আধুনিকীকরণ হয়। আসাম ও বঙ্গীয় অঞ্চলের মধ্যে রেলযোগাযোগ স্থাপিত হয় এই জেলার বুক চিরেই। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শমসেরনগরে স্থাপিত হয়েছিল বড় বিমানবন্দর।
ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে এখানকার আয়ের বড় উৎস ছিল চা ও আতর রপ্তানি। এই আতর মুম্বাই হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে চালান দেওয়ার পথ ছিল। এখন ইউরোপ পর্যন্ত যাচ্ছে। এখানকার মানুষের অভাব-অনটন অপেক্ষাকৃত কম ছিল। মাছের বড় জোগান আসত স্থানীয় নদী ও হাওর থেকে। ফলের মধ্যে শ্রীমঙ্গলের লেবু-আনারস, বড়লেখার কমলা ইত্যাদি আগেই বিখ্যাত ছিল। খাসিয়াদের পান ও মণিপুরিদের হাতে কোটা চিড়া স্থানীয়ভাবে প্রসিদ্ধ ছিল। উনিশ শতকের চল্লিশের দশক থেকে জেলায় অর্থনৈতিক উন্নতির আরেক পথ খুলে যায় ‘লন্ডনি ভাইসাবদের’ মাধ্যমে। তখন ‘রানির ভাইচার’ দিয়ে ‘লন্ডন’ যাওয়ার ঝড় উঠেছিল।
আশির দশকে মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমের বাজার উন্মুক্ত হলে এই জেলার শত শত লোক মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমায়। এখনো এই জেলার আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো টাকা। একুশ শতকে বিশ্বায়নের প্রভাবে মৌলভীবাজারের স্থানীয় অর্থনীতির ধরন বদলে যায়। নতুন নতুন আয়ের দ্বার উন্মোচিত হয়। চাঙা হয়ে ওঠে স্থানীয় অর্থনীতি। সরকারি-বেসরকারি বহুমুখী পদক্ষেপের ফলে নতুন নতুন অর্থনীতির ক্ষেত্র এখন দৃশ্যমান হচ্ছে, যার মধ্যে পর্যটন একটি। এই বিকাশমান শিল্পগুলোর যথাযথ ও পরিকল্পিত উন্নয়ন হলে স্থানীয় জীবনমান যেমন সমৃদ্ধ হবে, তেমনি দেশের আর্থিক খাতের বিস্তৃতি ঘটবে।
পর্যটনশিল্প: চা–শিল্পের পর বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলায় পর্যটনশিল্প অনেক গতিশীল। এই আয় প্রত্যক্ষভাবে বহুমাত্রিক পরিবার ভোগ করছে। অর্থাৎ, প্রান্তিক পরিবার থেকে উচ্চবিত্তের ঘর পর্যন্ত অর্থের প্রবাহ সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ ২০–২৫ বছর আগেও আজকের পর্যটনের স্থানগুলো ছিল বিভিন্ন স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে বনভোজনের আকর্ষণীয় জায়গা। কিন্তু বাজার অর্থনীতি সমৃদ্ধির কারণে এখন বহু পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে, যা শিল্পের রূপ নিয়েছে। নগদ আয়ের পাশাপাশি বহু কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। অন্যান্য জেলার সঙ্গে রেল ও সড়কপথে যোগাযোগ থাকায় শ্রীমঙ্গলকেন্দ্রিক পর্যটনশিল্প অনেক চাঙা হয়েছে। খাতসংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্যমতে, পর্যটন খাতে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা চলে এখানে।
প্রতিবছর সাত–আট লাখ লোক মৌলভীবাজারের নানা পর্যটন স্থানে ভ্রমণ করে। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে ছোট–বড় কর্মসংস্থানের পথ। পাল্টে গেছে শ্রীমঙ্গল, বড়লেখা, কমলগঞ্জ ও মৌলভীবাজার সদরের পুরোনো ব্যবসার ধরন ও জনমানস। আদিকালের হোটেলের বদলে পাঁচ তারকা ও তিন তারকা মানের হোটেল গড়ে উঠেছে। রয়েছে বাগানবাড়ি, রিসোর্ট ও কটেজ, ইকো-কটেজ ইত্যাদি। শুধু শ্রীমঙ্গলেই সম্প্রতি গড়ে উঠেছে প্রায় ৮০টি রিসোর্ট। পর্যটন মৌসুমে সরকারি বিভিন্ন বিভাগের গেস্টহাউসও অতিথিদের জন্য ভরে ওঠে। তা ছাড়া শহরের মধ্যে কিছু বাসাবাড়ির একাংশ পর্যটকদের ভাড়া দেওয়ার রেওয়াজও চালু হয়েছে। সেখানে নিজেরা রান্না করে খাওয়া যায়; আবার পরিবারের সঙ্গে খাওয়ার সুযোগ থাকে। নব্য এই ব্যবসা বিভিন্ন পরিবারের আয় বাড়াচ্ছে।
বেশির ভাগ কটেজ ও রিসোর্ট গড়ে উঠেছে পাহাড়-টিলা, পাহাড়ি ছড়া ও লেকের পাশে। নিম্ন–মধ্যবিত্তের ফ্যামিলি স্যুটের হোটেলও কম নয়। সব মিলিয়ে শুধু হোটেলগুলোতেই প্রায় ১২-১৫ হাজারের মতো লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এর বাইরে ছোট ছোট অনেক স্থায়ী ও অস্থায়ী মুখরোচক খাবারের দোকান, চা-পানের টং, বিপণিবিতান তো রয়েছেই। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর তথ্যমতে, শুধু শ্রীমঙ্গলেই এমন নিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। শতাধিক ব্যক্তি এখন ট্যুর গাইডকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। পর্যটন বিকাশের কারণে মণিপুরি হস্তশিল্পসহ স্থানীয় শিল্পের বিকাশ হচ্ছে।
স্থানীয় কৃষির ওপরও পড়েছে ইতিবাচক প্রভাব। লেবু, আনারস ও চা-পাতা সংগ্রহ পর্যটকদের শখের বিষয়। জিপগাড়িসহ নানা পরিবহনসংশ্লিষ্ট লোকের আয় বেড়েছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতও সম্প্রসারিত হচ্ছে।
মৌলভীবাজারে পর্যটন অনেক বিকশিত হলেও এখনো তা পূর্ণতা পায়নি। অধরা রয়ে গেছে আরও বিস্তর সম্ভাবনা। আজ কোভিড-১৯ পরিস্থিতি পর্যটনশিল্পকে থমকে দিয়েছে। তবে সব সরকারি-বেসরকারি খাতের সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে এই উদীয়মান শিল্পকে এর মধ্যেও গতিশীল করা সম্ভব।
আতর ও চা–শিল্প এই অঞ্চলের বৈদেশিক আয়ের উল্লেখযোগ্য উৎস। কিন্তু প্রায় তিন শতাব্দী ধরে এ দুই খাত প্রথাগত নিয়মে চলছে। প্রাকৃতিক গন্ধযুক্ত আতরের ঘ্রাণে প্রাণ জুড়ায়। অথচ এই শিল্প এখন প্রায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই চলছে। জেলার বড়লেখা উপজেলার মাটি আগরগাছের উপযোগী। বড়লেখার সুজানগর ইউনিয়নেই শুধু আতর তৈরির প্রায় ২০০ কারখানা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে আতর ও আগরের বিশাল বাজার রয়েছে। এই সম্ভাবনা এখনো পূর্ণ বিকশিত নয়।
বর্তমানে কমলগঞ্জ ও মৌলভীবাজার সদর উপজেলায়ও আতর উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু এখনো এর উৎপাদন চলছে সাবেকি পন্থায়। তার পরও প্রতি বছর প্রায় ৭০০–৮০০ কোটি টাকার আতর রপ্তানি হয় বিদেশে। এই শিল্পে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত। কিন্তু এই খাত এখনো তেমন কোনো সরকারি সহায়তা পায়নি। আতর পরিবহনে নানা আইনি জটিলতা এখনো রয়ে গেছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিকল্পনা থাকলে পোশাকশিল্পের মতো বৈদেশিক মুদ্রা এই খাত থেকে আয় করা সম্ভব। এ জন্য শুরুতেই আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার চালুসহ বিপণনে আইনি জটিলতা কমানো দরকার।
সব মিলিয়ে পর্যটন, চা ও আতরশিল্পই মৌলভীবাজারের অর্থনীতির মূল শক্তি। রয়েছে প্রবাসী আয়ের বিরাট ভিত্তি। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা এই মাটির সন্তানদের জন্য দরজা খুলে দিলে এসব খাতে তাদের বিপুল বিনিয়োগ আনা সম্ভব। কিছু কিছু হচ্ছেও। কিন্তু সরকারি বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হলে এটি আরও বেগবান হবে। সব মিলিয়ে জাতি ও অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যই মৌলভীবাজারের মূল শক্তি। এটি পুরো দেশের অর্থনৈতিক শক্তিরও একটি উৎস হয়ে উঠতে পারে।
দীপংকর মোহান্ত
মুক্তিযুদ্ধ ও নৃতত্ত্ববিষয়ক গবেষক
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪