হাসান মোরশেদ
আফগান সেনাপতি খোয়াজ ওসমানকে পরাজিত করে সিলেট অঞ্চলকে মোগল সাম্রাজ্যের সুবা বাংলার অন্তর্ভুক্ত করা হয় সম্রাট আকবরের সময়। আকবরের অর্থমন্ত্রী টোডরমল তখন সুবা বাংলার ১৯টি অঞ্চলের জন্য আলাদা আলাদা রাজস্ব নির্ধারণ করে দেন। এর মধ্যে সিলেট অঞ্চলের রাজস্ব ছিল তৎকালীন মুদ্রায় ১ লাখ ৬৭ হাজার ৪০ টাকা। এ ছাড়া সিলেট অঞ্চল থেকে ফলমূল, বৃক্ষ, পশুপাখি বিশেষত হাতি বিক্রি করে অতিরিক্ত আয়কর পাঠানো হতো বলে উল্লেখ আছে আইন-ই-আকবরিতে। ১৭২২ সালে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ রাজস্বের নতুন হিসাব প্রস্তুত করেন। ত্রিপুরা রাজ্যের সরাইল ও ময়মনসিংহের কিছু অঞ্চলকেও সিলেটের রাজস্ব অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত করে নতুন করের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় ৫ লাখ ৩১ হাজার ৪৫৫ টাকা।
১৭৬৫ সালে ব্রিটিশদের দখলে যাওয়ার আগে থেকেই সিলেট অঞ্চলের প্রধান রাজস্ব খাত ছিল চুনশিল্প। ইছাকলস (ছাতক) ও লাউড় (তাহিরপুর) পরগনায় পাথর পুড়িয়ে চুন বানানো হতো। মেঘালয় পাহাড় থেকে চুনাপাথর এনে জমানো হতো পাড়ুয়াতে (বর্তমানে কোম্পানীগঞ্জ—ব্রিটিশ কোম্পানির নামেই বাজার)। উত্তর–পূর্ব থেকে উত্তর–পশ্চিম পর্যন্ত সুরমা নদীর দুই পাড়ে অসংখ্য চুল্লিতে এই পাথর পোড়ানো হতো। স্থানীয় মানুষদের প্রধান ব্যবসা ছিল এটাই। তারপর ভাটি অঞ্চলের আজমিরীগঞ্জ বাজারের পাইকারি আড়তে গিয়ে জমা হতো। আজমিরীগঞ্জ থেকে মেঘনা নদী ধরে চলে যেত কলকাতা, পাটনা পর্যন্ত তখনকার প্রধান এই নির্মাণ উপকরণ। মীর কাশিমের সঙ্গে ইংরেজদের যে চুক্তি হয়, তাতে আলাদাভাবে সিলেটের চুনশিল্পের কথা উল্লেখ ছিল।
১৭৭৮ সালে রবার্ট লিন্ডসে নামে এক তরুণ ইংরেজ সিলেট আসেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে। বার্ষিক বেতন ৫ হাজার পাউন্ড খুব আকর্ষণীয় ছিল না উচ্চাভিলাষী লিন্ডসের কাছে। তিনি চুনাপাথরের উৎস খাসিয়া পাহাড় দখল করে নেন, সিলেট অঞ্চলজুড়ে চুন প্রস্তুতের যে কুটিরশিল্প ছিল, সেটা করায়ত্ত করেন এবং আটখানা সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণ করেন সিলেটের স্থানীয় কারিগরদের দিয়ে। জাহাজ ভর্তি করে আরও বেশি বেশি চুনাপাথর বিক্রির জন্য পাঠাতে লাগলেন কলকাতায়। মাদ্রাজে দুর্ভিক্ষ লাগলে বরিশাল থেকে ১৫ হাজার বস্তা চাল পাঠানো হয়েছিল সমুদ্রপথে। বড় জাহাজটি ছিল ১৮টি কামানযুক্ত এবং ৪ হাজার টন মাল বহন করতে পারত। সিলেটি কারিগরদের প্রশংসা করে লিন্ডসে লিখেছেন, ‘জাহাজ নির্মাণে আমার সাফল্য সিলেটিদের বুদ্ধিমত্তার ফল।’ দুই দশক পর রবার্ট লিন্ডসে ব্রিটেনে ফিরে গিয়ে জমিদারি কিনে লর্ড বনে যান।
ব্রিটিশ আমলেই সিলেটে চা–শিল্পের গোড়াপত্তন ঘটে। ১৮৫৪ সালে উপমহাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে চা–বাগান স্থাপিত হয় সিলেট শহরের কাছে মালনীছড়ায়। বাংলাদেশের মোট ১৬৭টি চা–বাগানের মধ্যে ১৩৫টিই সিলেট অঞ্চলে। চা উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১% আসে চা–শিল্প থেকে। প্রায় অর্ধকোটি মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য অংশ নারী।
পাকিস্তান আমলের শুরুতে সিলেটে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিপুল মজুত আবিষ্কার হলে সারা দেশের শিল্পোন্নয়নের এক বিশাল সম্ভাবনার দ্বার খুলে যায়। সিলেটের ছয়টি গ্যাসফিল্ডে এখনো দেশের অধিকাংশ গ্যাস মজুত আছে এবং সারা দেশে গ্যাস সরবরাহ আছে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক গ্যাসের সঙ্গে এখান থেকে অপরিশোধিত তেল–ডিজেল, পেট্রল, অকটেনও উত্তোলিত হয়। গ্যাসের পাশাপাশি সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলোর পাথর এবং বিখ্যাত সিলেট স্যান্ডস দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে অনেক বছর ধরে। সিলেটের অর্থনীতিতে ভিন্ন মাত্রা সংযোজন করে, সিলেটিদের ‘লন্ডনি’ হয়ে ওঠার সুযোগ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে সিলেট অঞ্চলের মানুষ ব্রিটেনে যাওয়া শুরু করেন।
তবে গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এই সুযোগ বেড়ে যায় অনেক। এ সময়ে অন্য কোনো জেলা থেকে প্রবাসী হওয়ার হার ছিল নিতান্ত কম। সিলেটের মানুষেরা কেবল সাময়িক শ্রম বিক্রির জন্য যাননি বরং তাঁরা ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাস করে বিশেষত লন্ডন শহরে এক টুকরো সিলেট গড়ে তোলেন। প্রথম, দ্বিতীয় প্রজন্ম হয়ে এখন লন্ডনীদের তৃতীয় প্রজন্ম ব্রিটেনের মূল ধারায় মিশে গেছেন। সেখানে তাঁরা নির্বাচিত মেয়র, সংসদ সদস্যও হচ্ছেন। সিলেটিদের হাতে ব্রিটেনে দেশি রেস্টুরেন্ট শিল্পের বিকাশ ঘটে। একসময় ভারতীয়দের আধিপত্য থাকলেও ক্রমান্বয়ে তা চলে আসে সিলেটিদের দখলে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা মামলা মোকাবিলায় এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে লন্ডন প্রবাসী সিলেটিরা অসামান্য অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ভূমিকা রাখেন। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যসহ নানা দেশ থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার অন্যতম শক্তি। কিন্তু একটা সময় পর্যন্ত ‘সিলেটি লন্ডনী’দের পাঠানো ব্রিটিশ পাউন্ডই ছিল রেমিট্যান্সের প্রধান উৎস। এই বিপুল পরিমাণ অর্থপ্রবাহ ব্যয় হয়েছে পরিবারের সদস্য, আত্মীয়–স্বজনের ব্যয়ভার বহন এবং উন্নত আবাসন নির্মাণে। ফলে সিলেটের জীবনযাত্রার মান ও ব্যয় বেড়ে গেছে দেশের অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে। সিলেটের প্রাকৃতিক সম্পদ ও লন্ডন থেকে আসা অর্থপ্রবাহকে কাজে লাগিয়ে টেকসই শিল্পোন্নয়নের যে সম্ভাবনা ছিল, সেটা কাজে লাগেনি। এর জন্য সিলেটের মানুষেরা সরকারি নীতি ও উদ্যোগের অভাবকেই দায়ী করেন। প্রবাসী বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ, সঠিক পরিকল্পনা ও নীতিমালা প্রণয়ন এবং এসব বাস্তবায়নের অভাব রয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন। এ ছাড়া সিলেটের গ্যাস, পাথর, বালু দেশের অন্য অঞ্চলের শিল্প ও অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও সিলেট বঞ্চিত রয়েছে বলে সিলেটের মানুষের ক্ষোভ আছে। বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর উত্তরাঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বর্তমান সরকারের সময় দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের যে মহাযজ্ঞ চলছে, সে তুলনায় সিলেট সত্যিই পিছিয়ে আছে। এই অঞ্চলের ব্যাংকগুলোতে অলস আমানতের পরিমাণ অনেক বেশি, যা সহজেই প্রকৃত বিনিয়োগ হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব।
বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের বিশাল হাওর অঞ্চল গোটা দেশের ধান ও মাছের জোগানের অন্যতম উৎস। কৃষিভিত্তিক শিল্পোন্নয়নের প্রভূত সুযোগ রয়েছে, তুলনামূলকভাবে অবহেলিত হাওর অঞ্চলে।
গত এক দশকে পর্যটনশিল্পে যে প্রাণ জেগেছে, সিলেট এর প্রধান অংশীদার। সিলেট শহর, উত্তর সিলেট ও শ্রীমঙ্গলকে ঘিরে বেসরকারি খাতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। পাহাড়, নদী, ঝরনা, চা–বাগান, হাওর এবং বৈচিত্র্যময় জনসংস্কৃতিসমৃদ্ধ সিলেট পর্যটনশিল্পের স্বর্গ হয়ে ওঠার দাবিদার। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও টেকসই, দীর্ঘমেয়াদি সরকারি পরিকল্পনা ও নীতিমালার প্রয়োজন রয়েছে।
সিলেট বাংলাদেশের এমন এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল, যার রয়েছে সমৃদ্ধ অতীত এবং স্বস্তিকর বর্তমান। ব্রিটেনে স্থায়ী ৫ লাখ সিলেটি, সিলেটকে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক পরিচিতি। টেকসই উন্নয়ন ও মানবিক অর্থনীতি গড়ে তোলার মতো প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থপ্রবাহ রয়েছে সিলেটে। সমন্বিত পরিকল্পনা, আন্তরিক উদ্যোগ ও পেশাদারি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে দিতে পারে এই অঞ্চলের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ।
পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রায়, উত্তর–পূর্বের এই অঞ্চল হতে পারে অন্যতম অংশীদার।
হাসান মোরশেদ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক
আফগান সেনাপতি খোয়াজ ওসমানকে পরাজিত করে সিলেট অঞ্চলকে মোগল সাম্রাজ্যের সুবা বাংলার অন্তর্ভুক্ত করা হয় সম্রাট আকবরের সময়। আকবরের অর্থমন্ত্রী টোডরমল তখন সুবা বাংলার ১৯টি অঞ্চলের জন্য আলাদা আলাদা রাজস্ব নির্ধারণ করে দেন। এর মধ্যে সিলেট অঞ্চলের রাজস্ব ছিল তৎকালীন মুদ্রায় ১ লাখ ৬৭ হাজার ৪০ টাকা। এ ছাড়া সিলেট অঞ্চল থেকে ফলমূল, বৃক্ষ, পশুপাখি বিশেষত হাতি বিক্রি করে অতিরিক্ত আয়কর পাঠানো হতো বলে উল্লেখ আছে আইন-ই-আকবরিতে। ১৭২২ সালে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ রাজস্বের নতুন হিসাব প্রস্তুত করেন। ত্রিপুরা রাজ্যের সরাইল ও ময়মনসিংহের কিছু অঞ্চলকেও সিলেটের রাজস্ব অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত করে নতুন করের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় ৫ লাখ ৩১ হাজার ৪৫৫ টাকা।
১৭৬৫ সালে ব্রিটিশদের দখলে যাওয়ার আগে থেকেই সিলেট অঞ্চলের প্রধান রাজস্ব খাত ছিল চুনশিল্প। ইছাকলস (ছাতক) ও লাউড় (তাহিরপুর) পরগনায় পাথর পুড়িয়ে চুন বানানো হতো। মেঘালয় পাহাড় থেকে চুনাপাথর এনে জমানো হতো পাড়ুয়াতে (বর্তমানে কোম্পানীগঞ্জ—ব্রিটিশ কোম্পানির নামেই বাজার)। উত্তর–পূর্ব থেকে উত্তর–পশ্চিম পর্যন্ত সুরমা নদীর দুই পাড়ে অসংখ্য চুল্লিতে এই পাথর পোড়ানো হতো। স্থানীয় মানুষদের প্রধান ব্যবসা ছিল এটাই। তারপর ভাটি অঞ্চলের আজমিরীগঞ্জ বাজারের পাইকারি আড়তে গিয়ে জমা হতো। আজমিরীগঞ্জ থেকে মেঘনা নদী ধরে চলে যেত কলকাতা, পাটনা পর্যন্ত তখনকার প্রধান এই নির্মাণ উপকরণ। মীর কাশিমের সঙ্গে ইংরেজদের যে চুক্তি হয়, তাতে আলাদাভাবে সিলেটের চুনশিল্পের কথা উল্লেখ ছিল।
১৭৭৮ সালে রবার্ট লিন্ডসে নামে এক তরুণ ইংরেজ সিলেট আসেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে। বার্ষিক বেতন ৫ হাজার পাউন্ড খুব আকর্ষণীয় ছিল না উচ্চাভিলাষী লিন্ডসের কাছে। তিনি চুনাপাথরের উৎস খাসিয়া পাহাড় দখল করে নেন, সিলেট অঞ্চলজুড়ে চুন প্রস্তুতের যে কুটিরশিল্প ছিল, সেটা করায়ত্ত করেন এবং আটখানা সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণ করেন সিলেটের স্থানীয় কারিগরদের দিয়ে। জাহাজ ভর্তি করে আরও বেশি বেশি চুনাপাথর বিক্রির জন্য পাঠাতে লাগলেন কলকাতায়। মাদ্রাজে দুর্ভিক্ষ লাগলে বরিশাল থেকে ১৫ হাজার বস্তা চাল পাঠানো হয়েছিল সমুদ্রপথে। বড় জাহাজটি ছিল ১৮টি কামানযুক্ত এবং ৪ হাজার টন মাল বহন করতে পারত। সিলেটি কারিগরদের প্রশংসা করে লিন্ডসে লিখেছেন, ‘জাহাজ নির্মাণে আমার সাফল্য সিলেটিদের বুদ্ধিমত্তার ফল।’ দুই দশক পর রবার্ট লিন্ডসে ব্রিটেনে ফিরে গিয়ে জমিদারি কিনে লর্ড বনে যান।
ব্রিটিশ আমলেই সিলেটে চা–শিল্পের গোড়াপত্তন ঘটে। ১৮৫৪ সালে উপমহাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে চা–বাগান স্থাপিত হয় সিলেট শহরের কাছে মালনীছড়ায়। বাংলাদেশের মোট ১৬৭টি চা–বাগানের মধ্যে ১৩৫টিই সিলেট অঞ্চলে। চা উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১% আসে চা–শিল্প থেকে। প্রায় অর্ধকোটি মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য অংশ নারী।
পাকিস্তান আমলের শুরুতে সিলেটে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিপুল মজুত আবিষ্কার হলে সারা দেশের শিল্পোন্নয়নের এক বিশাল সম্ভাবনার দ্বার খুলে যায়। সিলেটের ছয়টি গ্যাসফিল্ডে এখনো দেশের অধিকাংশ গ্যাস মজুত আছে এবং সারা দেশে গ্যাস সরবরাহ আছে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক গ্যাসের সঙ্গে এখান থেকে অপরিশোধিত তেল–ডিজেল, পেট্রল, অকটেনও উত্তোলিত হয়। গ্যাসের পাশাপাশি সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলোর পাথর এবং বিখ্যাত সিলেট স্যান্ডস দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে অনেক বছর ধরে। সিলেটের অর্থনীতিতে ভিন্ন মাত্রা সংযোজন করে, সিলেটিদের ‘লন্ডনি’ হয়ে ওঠার সুযোগ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে সিলেট অঞ্চলের মানুষ ব্রিটেনে যাওয়া শুরু করেন।
তবে গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এই সুযোগ বেড়ে যায় অনেক। এ সময়ে অন্য কোনো জেলা থেকে প্রবাসী হওয়ার হার ছিল নিতান্ত কম। সিলেটের মানুষেরা কেবল সাময়িক শ্রম বিক্রির জন্য যাননি বরং তাঁরা ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাস করে বিশেষত লন্ডন শহরে এক টুকরো সিলেট গড়ে তোলেন। প্রথম, দ্বিতীয় প্রজন্ম হয়ে এখন লন্ডনীদের তৃতীয় প্রজন্ম ব্রিটেনের মূল ধারায় মিশে গেছেন। সেখানে তাঁরা নির্বাচিত মেয়র, সংসদ সদস্যও হচ্ছেন। সিলেটিদের হাতে ব্রিটেনে দেশি রেস্টুরেন্ট শিল্পের বিকাশ ঘটে। একসময় ভারতীয়দের আধিপত্য থাকলেও ক্রমান্বয়ে তা চলে আসে সিলেটিদের দখলে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা মামলা মোকাবিলায় এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে লন্ডন প্রবাসী সিলেটিরা অসামান্য অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ভূমিকা রাখেন। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যসহ নানা দেশ থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার অন্যতম শক্তি। কিন্তু একটা সময় পর্যন্ত ‘সিলেটি লন্ডনী’দের পাঠানো ব্রিটিশ পাউন্ডই ছিল রেমিট্যান্সের প্রধান উৎস। এই বিপুল পরিমাণ অর্থপ্রবাহ ব্যয় হয়েছে পরিবারের সদস্য, আত্মীয়–স্বজনের ব্যয়ভার বহন এবং উন্নত আবাসন নির্মাণে। ফলে সিলেটের জীবনযাত্রার মান ও ব্যয় বেড়ে গেছে দেশের অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে। সিলেটের প্রাকৃতিক সম্পদ ও লন্ডন থেকে আসা অর্থপ্রবাহকে কাজে লাগিয়ে টেকসই শিল্পোন্নয়নের যে সম্ভাবনা ছিল, সেটা কাজে লাগেনি। এর জন্য সিলেটের মানুষেরা সরকারি নীতি ও উদ্যোগের অভাবকেই দায়ী করেন। প্রবাসী বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ, সঠিক পরিকল্পনা ও নীতিমালা প্রণয়ন এবং এসব বাস্তবায়নের অভাব রয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন। এ ছাড়া সিলেটের গ্যাস, পাথর, বালু দেশের অন্য অঞ্চলের শিল্প ও অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও সিলেট বঞ্চিত রয়েছে বলে সিলেটের মানুষের ক্ষোভ আছে। বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর উত্তরাঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বর্তমান সরকারের সময় দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের যে মহাযজ্ঞ চলছে, সে তুলনায় সিলেট সত্যিই পিছিয়ে আছে। এই অঞ্চলের ব্যাংকগুলোতে অলস আমানতের পরিমাণ অনেক বেশি, যা সহজেই প্রকৃত বিনিয়োগ হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব।
বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের বিশাল হাওর অঞ্চল গোটা দেশের ধান ও মাছের জোগানের অন্যতম উৎস। কৃষিভিত্তিক শিল্পোন্নয়নের প্রভূত সুযোগ রয়েছে, তুলনামূলকভাবে অবহেলিত হাওর অঞ্চলে।
গত এক দশকে পর্যটনশিল্পে যে প্রাণ জেগেছে, সিলেট এর প্রধান অংশীদার। সিলেট শহর, উত্তর সিলেট ও শ্রীমঙ্গলকে ঘিরে বেসরকারি খাতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। পাহাড়, নদী, ঝরনা, চা–বাগান, হাওর এবং বৈচিত্র্যময় জনসংস্কৃতিসমৃদ্ধ সিলেট পর্যটনশিল্পের স্বর্গ হয়ে ওঠার দাবিদার। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও টেকসই, দীর্ঘমেয়াদি সরকারি পরিকল্পনা ও নীতিমালার প্রয়োজন রয়েছে।
সিলেট বাংলাদেশের এমন এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল, যার রয়েছে সমৃদ্ধ অতীত এবং স্বস্তিকর বর্তমান। ব্রিটেনে স্থায়ী ৫ লাখ সিলেটি, সিলেটকে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক পরিচিতি। টেকসই উন্নয়ন ও মানবিক অর্থনীতি গড়ে তোলার মতো প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থপ্রবাহ রয়েছে সিলেটে। সমন্বিত পরিকল্পনা, আন্তরিক উদ্যোগ ও পেশাদারি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে দিতে পারে এই অঞ্চলের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ।
পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রায়, উত্তর–পূর্বের এই অঞ্চল হতে পারে অন্যতম অংশীদার।
হাসান মোরশেদ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪