শরিফুল হাসান
৯ মাসের স্বাধীনতাসংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ যখন বিজয় লাভ করে তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশটি পৃথিবীর দ্বিতীয় দরিদ্রতম দেশ ছিল। একদিকে শূন্য রিজার্ভ আরেক দিকে ডলারের তীব্র সংকট। কিন্তু পাঁচ দশক পর আজ অন্য এক উচ্চতায় বাংলাদেশ। প্রবাসী আয় প্রাপ্তিতে গোটা পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশ এখন সপ্তম স্থানে।
মূলত এক কোটিরও বেশি প্রবাসী বিদেশ থেকে এই প্রবাসী আয় পাঠাচ্ছেন। তাদের অবদানে গত ৩ মে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৪৫ বিলিয়ন (সাড়ে চার হাজার কোটি) মার্কিন ডলারের মাইলফলক ছুঁয়েছে। রিজার্ভের এমন শক্ত ভিতের কারণে শ্রীলঙ্কার মতো দেশকেও এখন অর্থ সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে বাংলাদেশ। এ যেন অন্য রকম এক বদলে যাওয়া।
কিন্তু মাত্র পাঁচ দশকে কী করে বদলে গেল বাংলাদেশ? এ প্রসঙ্গে আমার নিজের একটা ভাবনা আছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে কেউ জানতে চাইলে তিনটি অক্ষর বলি। ই, এফ এবং জি। ই মানে এক্সপেট্রিয়েট ওয়ার্কার বা প্রবাসী শ্রমিক। এফ মানে ফার্মারস বা কৃষক। আর জি মানে গার্মেন্টস ওয়ার্কার বা পোশাকশ্রমিক। বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত আসলে এই তিন খাত। এর মধ্যে প্রবাসীদের অবদান অনন্য।
এই যে বাংলাদেশ এখন আর বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীল কোনো দেশ নয় তার কারণ প্রবাসীরা। এই করোনা মহামারির মধ্যেও চলতি অর্থবছরে প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আরেকটু সহজ করে বললে বলা যায়, সারা বিশ্ব মিলে বাংলাদেশকে এখন যে পরিমাণ ঋণ বা অনুদান দিচ্ছে বা সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) যে অর্থ আসছে তার চেয়ে ছয় থেকে দশ গুণ পর্যন্ত বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা, যার ওপর ভিত্তি করে দারুণ শক্ত অবস্থানে আছে দেশের অর্থনীতি।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়ে পৃথিবীর শীর্ষ ১০ দেশের একটি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করতে গেছেন, যার ৭৫ শতাংশই আছেন মধ্যপ্রাচ্যে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব, যেখানে আছেন প্রায় ২০ লাখ বাংলাদেশি। এই দেশটি থেকে প্রতিবছর গড়ে তিন থেকে চার বিলিয়ন ডলার আসে। অবশ্য ২০২০-২১ অর্থবছরে সেটি পাঁচ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
সৌদি আরবের পর সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আছেন আরব আমিরাতে, সংখ্যাটা অন্তত ১৫ লাখ। এ ছাড়া কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইনে গড়ে তিন থেকে চার লাখ বাংলাদেশি আছেন। মালয়েশিয়াতেও ছয় থেকে সাত লাখ বাংলাদেশি আছেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেই, জর্ডান, ব্রুনেই, লেবানন, ইতালি, মরিশাস কিংবা দক্ষিণ কোরিয়াতেও আছেন কয়েক লাখ বাংলাদেশি। মূলত এই দেশগুলো থেকেই বাংলাদেশের প্রবাসী আয় সবচেয়ে বেশি আসে।
বাংলাদেশিরা কোন কোন দেশে যায়, সেটা তো শুনলেন কিন্তু কোন জেলা থেকে যায়? বিএমইটির তথ্য বলছে, চাকরি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে কুমিল্লা। গত দেড় দশকে এ জেলা থেকে ১০ লাখেরও বেশি লোক বিদেশে গেছেন। শীর্ষ দশে থাকা বাকি জেলাগুলো হলো যথাক্রমে চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল, ঢাকা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ ও ফেনী।
এই জেলাগুলোতে বেড়াতে গেলে বাংলাদেশের অন্য এলাকার সঙ্গে এখানকার পার্থক্যটা ধরতে পারবেন। ছিমছাম সবুজ গ্রামের ভেতরকার রাস্তাঘাট-বাড়িঘর দেখে মনে হয় উন্নত এক বাংলাদেশ। এই জেলাগুলোর প্রায় সব বাড়ি থেকেই কেউ না কেউ বিদেশে গিয়ে কাজ করছেন।
বিদেশের পাঠানো টাকায় চলে এখানকার গ্রামীণ অর্থনীতি। শুধু যে প্রবাসীদের পরিবারগুলোই এ টাকা ব্যবহার করে তা নয়, এখানকার পুরো অর্থনীতিই সচল রাখে এ প্রবাসী আয়। কৃষি হোক, মৎস্য কিংবা ছোট-বড় বেশির ভাগ উদ্যোগের পেছনেই আছে প্রবাসীদের বিনিয়োগ।
৬৪ জেলার মধ্যে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের তালিকার ১১ থেকে ২০-এ আছে যথাক্রমে লক্ষ্মীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, ফরিদপুর ও হবিগঞ্জ। এর প্রতিটি থেকে গত এক দশকে এক লাখের বেশি লোক বিদেশে গেছেন। তালিকার পরের জেলাগুলো হলো বরিশাল, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, যশোর, বগুড়া, কক্সবাজার, পাবনা, সুনামগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কুষ্টিয়া।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ আয় ও ব্যয় খানা জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে দারিদ্র্য কম বা ধনী ১০টি জেলা হলো নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, গাজীপুর, ফরিদপুর, ঢাকা ও নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজার ও সিলেট।
আগেই বলেছি, এই জেলাগুলো থেকেই বিদেশে শ্রম অভিবাসন হয় সবচেয়ে বেশি। তার মানে আন্তর্জাতিক অভিবাসন এবং প্রবাসী আয় এ জেলাগুলোর অর্থনীতি বদলাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ এলাকাগুলোতে নিয়মিতই বিদেশ থেকে টাকা আসছে। এখানকার ব্যাংক, বিনিয়োগ, বাজার, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা—সবকিছুতেই প্রবাসীদের মূল অবদান।
শুধু প্রবাসী আয় নয়, নতুন কর্মসংস্থানেও অভিবাসন খাতের গুরুত্ব অনেক। বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০ লাখ লোক নতুন করে শ্রমবাজোরে প্রবেশ করে। এদের বেশির ভাগেরেই কর্মসংস্থান হয় বিদেশে।
বিএমইটির তথ্য অনুসারে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ছয়-সাত লাখ মানুষ গড়ে বিদেশে যাচ্ছেন। মূলত নির্মাণশ্রমিক, প্লান্টেশেন, কৃষি, সার্ভিস বা উৎপাদন খাতে কাজ করেন বাংলাদেশিরা। তবে একটা বিষয় ভীষণ ইতিবাচক। বাংলাদেশিরা খুব দ্রুত কাজ ও ভাষা শিখে যান। এরপর কঠোর পরিশ্রম করে প্রবাসীরা দেশে টাকা পাঠান।
এত অবদানের পরও প্রবাসীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি, বিমানবন্দর থেকে শুরু করে দূতাবাস—সবখানেই পোহাতে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। পাসপোর্ট তৈরি থেকেই এর শুরু। এরপর রিক্রুটিং এজেন্সির দালাল ও প্রতারক এজেন্সি, চাকরির বিষয়ে অসত্য তথ্য, উচ্চমূল্যে ভিসা কেনাবেচা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সরকারি ছাড়পত্র —সবক্ষেত্রে সীমাহীন যন্ত্রণা। দেশের আকাশ পার হলে শুরু হয় বিরূপ প্রকৃতি, অমানুষিক পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন, মালিকদের প্রতারণা, নির্যাতনসহ আরও কত-কী। বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে গেলে কাঙ্ক্ষিত সেবা মেলে না, দেশে ফিরলেও ভোগান্তি।
পুরোনো এসবের সঙ্গে কোভিড-১৯ সংকট আরও বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের জন্য এই সংকটটা ছিল মূলত তিন ধরনের। প্রথমত, স্বাভাবিক বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রায় বন্ধ। দ্বিতীয়ত, ছুটিতে দেশে এসে করোনার কারণে লকডাউনে আটকে পড়েছেন লাখখানেকেরও বেশি মানুষ। তৃতীয়ত, কাজ হারিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ প্রবাসী দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন।
অবশ্য কোভিড-১৯ শুধু প্রবাসীদের জীবিকাতেই নয়, আঘাত করেছে জীবনেও৷ গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ও বিভিন্ন দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, করোনার কারণে বিদেশে আড়াইহাজারেরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি মারা গেছেন৷ পুরোনো তথ্য যোগ করলে, গত এক যুগে ৪০ হাজারেরও বেশি প্রবাসীর মরদেহ এসেছে। এদের অনেকেই ২৮ কিংবা ৩০ বছর বয়সেও মারা গেছেন। এদের মধ্যে অনেক নারীকর্মীও আছেন।
অবশ্য করোনায় কেবল চাকরি হারানো বা মৃত্যু নয়, আশার কথাও আছে। সারা বিশ্বেই কৃষিসহ নানা খাতে কর্মীদের চাহিদা বাড়ছে। এ বছরের প্রথম তিন মাসেই এক লাখ লোকের বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে। সরকার এখন নতুন করে আগামী দিনগুলোতে কোন খাতের লোক যাবে, তাদের দক্ষতা কী হবে— এসব প্রস্তুতি এগিয়ে রাখতে পারে। বিশেষ করে নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান জরুরি। পাশাপাশি করোনার কারণে যেসব পেশার চাহিদা বেড়েছে, সেসব পেশায় দক্ষ জনবল তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।
কোনো সন্দেহ নেই, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়ের ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবেই।
তবে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, এক কোটিরও বেশি প্রবাসী শুধু দেশের অর্থনীতি সচল রাখছেন তা নয়, অনেক দূর থেকেও বুকের মধ্যে যত্ন করে রেখেছেন লাল-সবুজের জন্য ভালোবাসা। আর পৃথিবীর প্রতিটা দেশে তারাই তো বাংলাদেশের প্রতিনিধি! এই বাংলাদেশের উন্নতির জন্য লাল-সবুজের পাসপোর্টধারী প্রবাসীদের তাই সম্মান জানাতেই হবে। কাজেই স্যালুট এই প্রবাসীদের।
শরিফুল হাসান
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান
৯ মাসের স্বাধীনতাসংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ যখন বিজয় লাভ করে তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশটি পৃথিবীর দ্বিতীয় দরিদ্রতম দেশ ছিল। একদিকে শূন্য রিজার্ভ আরেক দিকে ডলারের তীব্র সংকট। কিন্তু পাঁচ দশক পর আজ অন্য এক উচ্চতায় বাংলাদেশ। প্রবাসী আয় প্রাপ্তিতে গোটা পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশ এখন সপ্তম স্থানে।
মূলত এক কোটিরও বেশি প্রবাসী বিদেশ থেকে এই প্রবাসী আয় পাঠাচ্ছেন। তাদের অবদানে গত ৩ মে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৪৫ বিলিয়ন (সাড়ে চার হাজার কোটি) মার্কিন ডলারের মাইলফলক ছুঁয়েছে। রিজার্ভের এমন শক্ত ভিতের কারণে শ্রীলঙ্কার মতো দেশকেও এখন অর্থ সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে বাংলাদেশ। এ যেন অন্য রকম এক বদলে যাওয়া।
কিন্তু মাত্র পাঁচ দশকে কী করে বদলে গেল বাংলাদেশ? এ প্রসঙ্গে আমার নিজের একটা ভাবনা আছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে কেউ জানতে চাইলে তিনটি অক্ষর বলি। ই, এফ এবং জি। ই মানে এক্সপেট্রিয়েট ওয়ার্কার বা প্রবাসী শ্রমিক। এফ মানে ফার্মারস বা কৃষক। আর জি মানে গার্মেন্টস ওয়ার্কার বা পোশাকশ্রমিক। বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত আসলে এই তিন খাত। এর মধ্যে প্রবাসীদের অবদান অনন্য।
এই যে বাংলাদেশ এখন আর বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীল কোনো দেশ নয় তার কারণ প্রবাসীরা। এই করোনা মহামারির মধ্যেও চলতি অর্থবছরে প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আরেকটু সহজ করে বললে বলা যায়, সারা বিশ্ব মিলে বাংলাদেশকে এখন যে পরিমাণ ঋণ বা অনুদান দিচ্ছে বা সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) যে অর্থ আসছে তার চেয়ে ছয় থেকে দশ গুণ পর্যন্ত বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা, যার ওপর ভিত্তি করে দারুণ শক্ত অবস্থানে আছে দেশের অর্থনীতি।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়ে পৃথিবীর শীর্ষ ১০ দেশের একটি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করতে গেছেন, যার ৭৫ শতাংশই আছেন মধ্যপ্রাচ্যে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব, যেখানে আছেন প্রায় ২০ লাখ বাংলাদেশি। এই দেশটি থেকে প্রতিবছর গড়ে তিন থেকে চার বিলিয়ন ডলার আসে। অবশ্য ২০২০-২১ অর্থবছরে সেটি পাঁচ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
সৌদি আরবের পর সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আছেন আরব আমিরাতে, সংখ্যাটা অন্তত ১৫ লাখ। এ ছাড়া কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইনে গড়ে তিন থেকে চার লাখ বাংলাদেশি আছেন। মালয়েশিয়াতেও ছয় থেকে সাত লাখ বাংলাদেশি আছেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেই, জর্ডান, ব্রুনেই, লেবানন, ইতালি, মরিশাস কিংবা দক্ষিণ কোরিয়াতেও আছেন কয়েক লাখ বাংলাদেশি। মূলত এই দেশগুলো থেকেই বাংলাদেশের প্রবাসী আয় সবচেয়ে বেশি আসে।
বাংলাদেশিরা কোন কোন দেশে যায়, সেটা তো শুনলেন কিন্তু কোন জেলা থেকে যায়? বিএমইটির তথ্য বলছে, চাকরি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে কুমিল্লা। গত দেড় দশকে এ জেলা থেকে ১০ লাখেরও বেশি লোক বিদেশে গেছেন। শীর্ষ দশে থাকা বাকি জেলাগুলো হলো যথাক্রমে চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল, ঢাকা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ ও ফেনী।
এই জেলাগুলোতে বেড়াতে গেলে বাংলাদেশের অন্য এলাকার সঙ্গে এখানকার পার্থক্যটা ধরতে পারবেন। ছিমছাম সবুজ গ্রামের ভেতরকার রাস্তাঘাট-বাড়িঘর দেখে মনে হয় উন্নত এক বাংলাদেশ। এই জেলাগুলোর প্রায় সব বাড়ি থেকেই কেউ না কেউ বিদেশে গিয়ে কাজ করছেন।
বিদেশের পাঠানো টাকায় চলে এখানকার গ্রামীণ অর্থনীতি। শুধু যে প্রবাসীদের পরিবারগুলোই এ টাকা ব্যবহার করে তা নয়, এখানকার পুরো অর্থনীতিই সচল রাখে এ প্রবাসী আয়। কৃষি হোক, মৎস্য কিংবা ছোট-বড় বেশির ভাগ উদ্যোগের পেছনেই আছে প্রবাসীদের বিনিয়োগ।
৬৪ জেলার মধ্যে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের তালিকার ১১ থেকে ২০-এ আছে যথাক্রমে লক্ষ্মীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, ফরিদপুর ও হবিগঞ্জ। এর প্রতিটি থেকে গত এক দশকে এক লাখের বেশি লোক বিদেশে গেছেন। তালিকার পরের জেলাগুলো হলো বরিশাল, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, যশোর, বগুড়া, কক্সবাজার, পাবনা, সুনামগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কুষ্টিয়া।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ আয় ও ব্যয় খানা জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে দারিদ্র্য কম বা ধনী ১০টি জেলা হলো নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, গাজীপুর, ফরিদপুর, ঢাকা ও নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজার ও সিলেট।
আগেই বলেছি, এই জেলাগুলো থেকেই বিদেশে শ্রম অভিবাসন হয় সবচেয়ে বেশি। তার মানে আন্তর্জাতিক অভিবাসন এবং প্রবাসী আয় এ জেলাগুলোর অর্থনীতি বদলাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ এলাকাগুলোতে নিয়মিতই বিদেশ থেকে টাকা আসছে। এখানকার ব্যাংক, বিনিয়োগ, বাজার, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা—সবকিছুতেই প্রবাসীদের মূল অবদান।
শুধু প্রবাসী আয় নয়, নতুন কর্মসংস্থানেও অভিবাসন খাতের গুরুত্ব অনেক। বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০ লাখ লোক নতুন করে শ্রমবাজোরে প্রবেশ করে। এদের বেশির ভাগেরেই কর্মসংস্থান হয় বিদেশে।
বিএমইটির তথ্য অনুসারে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ছয়-সাত লাখ মানুষ গড়ে বিদেশে যাচ্ছেন। মূলত নির্মাণশ্রমিক, প্লান্টেশেন, কৃষি, সার্ভিস বা উৎপাদন খাতে কাজ করেন বাংলাদেশিরা। তবে একটা বিষয় ভীষণ ইতিবাচক। বাংলাদেশিরা খুব দ্রুত কাজ ও ভাষা শিখে যান। এরপর কঠোর পরিশ্রম করে প্রবাসীরা দেশে টাকা পাঠান।
এত অবদানের পরও প্রবাসীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি, বিমানবন্দর থেকে শুরু করে দূতাবাস—সবখানেই পোহাতে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। পাসপোর্ট তৈরি থেকেই এর শুরু। এরপর রিক্রুটিং এজেন্সির দালাল ও প্রতারক এজেন্সি, চাকরির বিষয়ে অসত্য তথ্য, উচ্চমূল্যে ভিসা কেনাবেচা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সরকারি ছাড়পত্র —সবক্ষেত্রে সীমাহীন যন্ত্রণা। দেশের আকাশ পার হলে শুরু হয় বিরূপ প্রকৃতি, অমানুষিক পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন, মালিকদের প্রতারণা, নির্যাতনসহ আরও কত-কী। বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে গেলে কাঙ্ক্ষিত সেবা মেলে না, দেশে ফিরলেও ভোগান্তি।
পুরোনো এসবের সঙ্গে কোভিড-১৯ সংকট আরও বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের জন্য এই সংকটটা ছিল মূলত তিন ধরনের। প্রথমত, স্বাভাবিক বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রায় বন্ধ। দ্বিতীয়ত, ছুটিতে দেশে এসে করোনার কারণে লকডাউনে আটকে পড়েছেন লাখখানেকেরও বেশি মানুষ। তৃতীয়ত, কাজ হারিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ প্রবাসী দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন।
অবশ্য কোভিড-১৯ শুধু প্রবাসীদের জীবিকাতেই নয়, আঘাত করেছে জীবনেও৷ গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ও বিভিন্ন দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, করোনার কারণে বিদেশে আড়াইহাজারেরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি মারা গেছেন৷ পুরোনো তথ্য যোগ করলে, গত এক যুগে ৪০ হাজারেরও বেশি প্রবাসীর মরদেহ এসেছে। এদের অনেকেই ২৮ কিংবা ৩০ বছর বয়সেও মারা গেছেন। এদের মধ্যে অনেক নারীকর্মীও আছেন।
অবশ্য করোনায় কেবল চাকরি হারানো বা মৃত্যু নয়, আশার কথাও আছে। সারা বিশ্বেই কৃষিসহ নানা খাতে কর্মীদের চাহিদা বাড়ছে। এ বছরের প্রথম তিন মাসেই এক লাখ লোকের বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে। সরকার এখন নতুন করে আগামী দিনগুলোতে কোন খাতের লোক যাবে, তাদের দক্ষতা কী হবে— এসব প্রস্তুতি এগিয়ে রাখতে পারে। বিশেষ করে নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান জরুরি। পাশাপাশি করোনার কারণে যেসব পেশার চাহিদা বেড়েছে, সেসব পেশায় দক্ষ জনবল তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।
কোনো সন্দেহ নেই, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়ের ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবেই।
তবে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, এক কোটিরও বেশি প্রবাসী শুধু দেশের অর্থনীতি সচল রাখছেন তা নয়, অনেক দূর থেকেও বুকের মধ্যে যত্ন করে রেখেছেন লাল-সবুজের জন্য ভালোবাসা। আর পৃথিবীর প্রতিটা দেশে তারাই তো বাংলাদেশের প্রতিনিধি! এই বাংলাদেশের উন্নতির জন্য লাল-সবুজের পাসপোর্টধারী প্রবাসীদের তাই সম্মান জানাতেই হবে। কাজেই স্যালুট এই প্রবাসীদের।
শরিফুল হাসান
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪