মো. মোশারেফ হোসেন
অনেক দিন লিখিনি। ফরমাশি একটি লেখা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। আমার প্রিয় চাঁদপুর জেলাকে নিয়ে, যেখানে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। পড়াশোনা করতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা যেমন আমি দেখেছি, তেমনিভাবে চাকরির সুবাদে এবং ভ্রমণ আকাঙ্ক্ষার কারণেও দেশের অনেক অঞ্চল দেখার সুযোগ হয়েছে। মানুষের জীবনমান, সংস্কৃতি, আতিথেয়তা, শিক্ষা, অর্থনীতি, ধর্মীয়বোধ প্রভৃতি বিষয় আমাকে বিভিন্নভাবে নাড়া দিয়েছে। নিজ জেলাকে নিয়ে যেভাবে গৌরব ও অহংকার করি, আসলে ভেতরে–ভেতরে তলাবিহীন ঝুড়ি। আগেই বলেছি, ফরমাশি লেখাটি লিখতে গিয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিশ্লেষণে এমনটিই বেরিয়ে এসেছে।
২৮ লাখ ৬১ হাজার ৮৮৫ জন জনসংখ্যার এ জেলার আয়তন ১৭০৪.০৬ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১ হাজার ৬৮০ জন, যেখানে দেশের মোট জনসংখ্যার ঘনত্ব ১ হাজার ২৬০ জন।
ফরেন রেমিট্যান্স বা বিদেশে নিয়োজিত কর্মীদের দ্বারা অর্জিত আয়ে সারা বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে চাঁদপুর জেলার অবস্থান ষষ্ঠ। বর্তমানে চাঁদপুরের ৩ লাখের বেশি প্রবাসী বিদেশে কর্মরত থেকে শুধু ২০২১ সালের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল— এ চার মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে ৪২৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা প্রেরণ করেন। সে হিসাবে বছর শেষে প্রেরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা হবে। এই হিসাবটি চাঁদপুরের চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের আঞ্চলিক অফিস থেকে নেওয়া। তবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, চাঁদপুরের ২ লাখ ৬৫ হাজার কর্মী বিদেশে নিয়োজিত থেকে ফরেন রেমিট্যান্সে অংশ নিচ্ছেন। শতকরা হিসাবে ৯ ভাগের বেশি মানুষ বিদেশে কর্মরত। এত অধিক মানুষ বিদেশে কর্মরত থেকে জীবিকা অর্জন করলেও চাঁদপুর জেলাটি চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। ২০১৪ সালের হিসাব অনুসারে, দেশের জেলাগুলোর মধ্যে দারিদ্র্যের দিক থেকে চাঁদপুরের অবস্থান পঞ্চম। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। কুড়িগ্রাম, বরিশাল, শরীয়তপুর, জামালপুর জেলার পরে চাঁদপুরের অবস্থান। অথচ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে জেলাগুলোর মধ্যে চাঁদপুরের অবস্থান ষষ্ঠ।
তাহলে কেন এমন অবস্থা?
আগেই বলেছি, ভূমির তুলনায় জনসংখ্যা অত্যধিক, অর্থাৎ যেখানে দেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১ হাজার ২৬০ জন, সেখানে চাঁদপুরে বাস করে ১ হাজার ৬৮০ জন। পরিবারপ্রতি জনসংখ্যা ৬ জনের বেশি। পরিবারপ্রতি জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণহীনতা দারিদ্র্যের অন্যতম প্রধান কারণ বলে আমার মনে হয়। অন্যদিকে শিক্ষার হার যেখানে দেশে ৭৪ শতাংশের বেশি সেখানে চাঁদপুরে ৬৯ শতাংশ। অনেকে নদীভাঙনকে চাঁদপুরের দারিদ্র্যের একটি কারণ বলে উল্লেখ করেন। আমার তা পুরোপুরি সত্য বলে মনে হয় না। তার কারণ, হাইমচর ও রাজরাজেশ্বর এলাকার নদীভাঙনকবলিত মানুষের একটা বিরাট অংশ বাস্তুচ্যুত হয়ে চাঁদপুর ত্যাগ করেছে। দেখা গেছে, যারাই বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তারা হয়েছে সংগ্রামী, হয়েছে আর্থিকভাবে অনেক বেশি স্বাবলম্বী। ঢাকার গাজীপুরের বিশাল এলাকা এই নদীভাঙনকবলিত মানুষের ঠিকানায় রূপ নিয়েছে। চাঁদপুর থেকে যাঁরা বিদেশ গেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক দেশগুলোতে নাহয় মালয়েশিয়াতে কর্মী হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। তাঁদের শতকরা ৯৯ ভাগের বেশি অদক্ষ শ্রমিক এবং অনেকেই প্রাথমিক শিক্ষাটুকুও অর্জন করতে পারেননি। যেহেতু শিক্ষাহীন কঠিন কর্মে নিয়োজিত, তাই তাঁদের প্রত্যশায় থাকে তাঁদের সন্তানদের ভালো মানের শিক্ষাদানের। বাড়ির স্ত্রী তাঁর সন্তানদের ভালো স্কুলে ভর্তি করানোর বাসনা নিয়ে শহরমুখী হন। ফল দাঁড়ায়, বাড়িতে তাঁর মা–বাবা, শহরে স্ত্রী-সন্তান, যা উপার্জন করেন তার পুরোটাই খরচ করে ফেলেন। ৭-৮ বা ১০ বছর পরে একেবারে রিক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে সেই দারিদ্র্যের জাঁতাকলে বন্দী হয়ে যান। বিদেশ যাওয়ার সময় বাবার কিছু জমি বিক্রি করেছেন, নাহয় বোনের স্বর্ণালংকার বন্ধক রেখেছেন। এগুলো ফিরিয়ে দিতে না পারার কারণে সম্পত্তি নিয়ে সৃষ্টি হয় মামলা-মোকদ্দমা। ফলাফল আরও নিঃস্ব। এ ছাড়া আছে মা-বাবার চিকিৎসা। বাবার জন্য একটি সুন্দর পাকাঘর বানানো, বোনের বিয়ে প্রভৃতি কারণে যে দারিদ্র্যের মধ্যে ছিলেন, সেই দারিদ্র্যের মধ্যেই বসবাস করেন।
প্রবাসীদের দ্বারা সামাজিক অনাচার এবং ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতা বেড়েছে অনেক বেশি। সৌদি আরবপ্রবাসী লোকজনের দ্বারা এ বিষয়গুলো প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য ছিল চাঁদপুরের প্রবহমান একটি ধারা । বর্তমানে সে স্থানটি দখল করেছে ইসলামীকরণ। মেয়েদের শিক্ষাকে সীমিত পরিসরে নিয়ে বাল্যবিবাহের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি বলে মনে হয় এ জেলায়। বাল্যবিবাহ দেওয়া মেয়েদের মা হওয়ার প্রবণতা বেশি এবং শারীরিক জটিলতাও দেখা দেয় সবচেয়ে বেশি। চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে পরিবারকে হিমশিম খেতে হয়। স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের তুলনায় সিজারিয়ান সন্তান প্রসবের হার বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম চাঁদপুর। একেকটি সন্তান প্রসবে খরচ হয় ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার মতো। সঠিক পরিসংখ্যান হাতে নেই, তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, চিকিৎসার খরচ বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাঁদপুরে। একটি ছোট জেলা শহর, অথচ যেখানে বেসরকারি হাসপাতাল আছে ২৫টির বেশি। ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে ৫০টির বেশি। উপজেলা ছাড়িয়ে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অবস্থান লক্ষণীয়।
ফরেন রেমিট্যান্সের একটি বিশাল অংশ ব্যয় হয়ে থাকে এসব হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। আমি যে এলাকায় বাস করি তার দুই পাশে রয়েছে অনেক হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, যেখানে রয়েছে চিকিৎসকদের চেম্বার। রোগী এলে চিকিৎসকের ভিজিট দেওয়ার পর বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষা বাবদ সঙ্গে নিয়ে আসা টাকা খরচ করার পর ওষুধ কেনার আর টাকা থাকে না। মোবাইল ফোনে তাঁর নিকটাত্মীয়কে বলতে শোনা যায়, সুদে টাকা নিয়ে (যা কিস্তি নামে পরিচিত) অথবা বাড়ির পালিত ছাগল বা মুরগি বিক্রি করে বিকাশে টাকা পাঠানোর অনুরোধ করতে। এভাবে সাধারণ ও নিরীহ মানুষগুলো সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছেন।
ফরেন রেমিট্যান্স ব্যয়ের ধারাটি এ রকম: শিশুসন্তানকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে না পড়িয়ে বাড়ির পাশে স্বল্পশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত ছেলেমেয়েদের দ্বারা গড়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়াশোনা করানো, একটু বড় হলে উপজেলা বা জেলা সদরে গিয়ে কোনো স্কুলে ভর্তি করা, বেসরকারি হাসপাতাল এবং চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসাসেবা নেওয়া, ছোটখাটো বিরোধে মামলায় জড়িয়ে পড়া, বাড়িতে পাকাঘর নির্মাণ করা, স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য দামি মোবাইল ফোন ব্যবহার করা। সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে নূরানি বা কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শিক্ষাদান। আয়ের একটি বিশাল অংশ সেখানে ব্যয় হচ্ছে।
উত্তরণ কোন পথে?
এর সহজ কোনো পথ খোলা নেই। তবে নির্দ্বিধায় বলা যায়, যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তাঁদের কারিগরি জ্ঞান অর্জন ছাড়া বিদেশে না যাওয়া ভালো। ওই সব দেশে গিয়ে নিম্ন মজুরিতে নিম্নস্তরের কাজগুলোই তাঁরা করেন। যার ফলে, আধুনিক জ্ঞান ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁদের কোনো পরিচয় ঘটে না। ঈশ্বর বা স্রষ্টাকেন্দ্রিক মনোবৃত্তি তাঁদের মধ্যে এমনভাবে গেঁথে যায়, যা দেশে এসেও বলবৎ করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়।
বর্তমানে দক্ষ জনবল তৈরির জন্য চাঁদপুরে স্থাপিত হয়েছে মেরিন ইনস্টিটিউট, মৎস্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি উন্নয়নকল্পে বিভিন্ন প্রশিক্ষণকেন্দ্র। এখান থেকে বের হওয়া দক্ষ জনবল আগামী দিনগুলোতে ফরেন রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে আরও অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন, যা দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্ত করবে চাঁদপুর জেলাকে, রচিত হবে সোনার বাংলা, রক্তিম আভায় উদ্ভাসিত হবে দেশ।
মো. মোশারেফ হোসেন
অধ্যক্ষ, বাবুরহাট উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ
অনেক দিন লিখিনি। ফরমাশি একটি লেখা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। আমার প্রিয় চাঁদপুর জেলাকে নিয়ে, যেখানে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। পড়াশোনা করতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা যেমন আমি দেখেছি, তেমনিভাবে চাকরির সুবাদে এবং ভ্রমণ আকাঙ্ক্ষার কারণেও দেশের অনেক অঞ্চল দেখার সুযোগ হয়েছে। মানুষের জীবনমান, সংস্কৃতি, আতিথেয়তা, শিক্ষা, অর্থনীতি, ধর্মীয়বোধ প্রভৃতি বিষয় আমাকে বিভিন্নভাবে নাড়া দিয়েছে। নিজ জেলাকে নিয়ে যেভাবে গৌরব ও অহংকার করি, আসলে ভেতরে–ভেতরে তলাবিহীন ঝুড়ি। আগেই বলেছি, ফরমাশি লেখাটি লিখতে গিয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিশ্লেষণে এমনটিই বেরিয়ে এসেছে।
২৮ লাখ ৬১ হাজার ৮৮৫ জন জনসংখ্যার এ জেলার আয়তন ১৭০৪.০৬ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১ হাজার ৬৮০ জন, যেখানে দেশের মোট জনসংখ্যার ঘনত্ব ১ হাজার ২৬০ জন।
ফরেন রেমিট্যান্স বা বিদেশে নিয়োজিত কর্মীদের দ্বারা অর্জিত আয়ে সারা বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে চাঁদপুর জেলার অবস্থান ষষ্ঠ। বর্তমানে চাঁদপুরের ৩ লাখের বেশি প্রবাসী বিদেশে কর্মরত থেকে শুধু ২০২১ সালের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল— এ চার মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে ৪২৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা প্রেরণ করেন। সে হিসাবে বছর শেষে প্রেরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা হবে। এই হিসাবটি চাঁদপুরের চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের আঞ্চলিক অফিস থেকে নেওয়া। তবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, চাঁদপুরের ২ লাখ ৬৫ হাজার কর্মী বিদেশে নিয়োজিত থেকে ফরেন রেমিট্যান্সে অংশ নিচ্ছেন। শতকরা হিসাবে ৯ ভাগের বেশি মানুষ বিদেশে কর্মরত। এত অধিক মানুষ বিদেশে কর্মরত থেকে জীবিকা অর্জন করলেও চাঁদপুর জেলাটি চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। ২০১৪ সালের হিসাব অনুসারে, দেশের জেলাগুলোর মধ্যে দারিদ্র্যের দিক থেকে চাঁদপুরের অবস্থান পঞ্চম। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। কুড়িগ্রাম, বরিশাল, শরীয়তপুর, জামালপুর জেলার পরে চাঁদপুরের অবস্থান। অথচ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে জেলাগুলোর মধ্যে চাঁদপুরের অবস্থান ষষ্ঠ।
তাহলে কেন এমন অবস্থা?
আগেই বলেছি, ভূমির তুলনায় জনসংখ্যা অত্যধিক, অর্থাৎ যেখানে দেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১ হাজার ২৬০ জন, সেখানে চাঁদপুরে বাস করে ১ হাজার ৬৮০ জন। পরিবারপ্রতি জনসংখ্যা ৬ জনের বেশি। পরিবারপ্রতি জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণহীনতা দারিদ্র্যের অন্যতম প্রধান কারণ বলে আমার মনে হয়। অন্যদিকে শিক্ষার হার যেখানে দেশে ৭৪ শতাংশের বেশি সেখানে চাঁদপুরে ৬৯ শতাংশ। অনেকে নদীভাঙনকে চাঁদপুরের দারিদ্র্যের একটি কারণ বলে উল্লেখ করেন। আমার তা পুরোপুরি সত্য বলে মনে হয় না। তার কারণ, হাইমচর ও রাজরাজেশ্বর এলাকার নদীভাঙনকবলিত মানুষের একটা বিরাট অংশ বাস্তুচ্যুত হয়ে চাঁদপুর ত্যাগ করেছে। দেখা গেছে, যারাই বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তারা হয়েছে সংগ্রামী, হয়েছে আর্থিকভাবে অনেক বেশি স্বাবলম্বী। ঢাকার গাজীপুরের বিশাল এলাকা এই নদীভাঙনকবলিত মানুষের ঠিকানায় রূপ নিয়েছে। চাঁদপুর থেকে যাঁরা বিদেশ গেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক দেশগুলোতে নাহয় মালয়েশিয়াতে কর্মী হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। তাঁদের শতকরা ৯৯ ভাগের বেশি অদক্ষ শ্রমিক এবং অনেকেই প্রাথমিক শিক্ষাটুকুও অর্জন করতে পারেননি। যেহেতু শিক্ষাহীন কঠিন কর্মে নিয়োজিত, তাই তাঁদের প্রত্যশায় থাকে তাঁদের সন্তানদের ভালো মানের শিক্ষাদানের। বাড়ির স্ত্রী তাঁর সন্তানদের ভালো স্কুলে ভর্তি করানোর বাসনা নিয়ে শহরমুখী হন। ফল দাঁড়ায়, বাড়িতে তাঁর মা–বাবা, শহরে স্ত্রী-সন্তান, যা উপার্জন করেন তার পুরোটাই খরচ করে ফেলেন। ৭-৮ বা ১০ বছর পরে একেবারে রিক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে সেই দারিদ্র্যের জাঁতাকলে বন্দী হয়ে যান। বিদেশ যাওয়ার সময় বাবার কিছু জমি বিক্রি করেছেন, নাহয় বোনের স্বর্ণালংকার বন্ধক রেখেছেন। এগুলো ফিরিয়ে দিতে না পারার কারণে সম্পত্তি নিয়ে সৃষ্টি হয় মামলা-মোকদ্দমা। ফলাফল আরও নিঃস্ব। এ ছাড়া আছে মা-বাবার চিকিৎসা। বাবার জন্য একটি সুন্দর পাকাঘর বানানো, বোনের বিয়ে প্রভৃতি কারণে যে দারিদ্র্যের মধ্যে ছিলেন, সেই দারিদ্র্যের মধ্যেই বসবাস করেন।
প্রবাসীদের দ্বারা সামাজিক অনাচার এবং ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতা বেড়েছে অনেক বেশি। সৌদি আরবপ্রবাসী লোকজনের দ্বারা এ বিষয়গুলো প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য ছিল চাঁদপুরের প্রবহমান একটি ধারা । বর্তমানে সে স্থানটি দখল করেছে ইসলামীকরণ। মেয়েদের শিক্ষাকে সীমিত পরিসরে নিয়ে বাল্যবিবাহের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি বলে মনে হয় এ জেলায়। বাল্যবিবাহ দেওয়া মেয়েদের মা হওয়ার প্রবণতা বেশি এবং শারীরিক জটিলতাও দেখা দেয় সবচেয়ে বেশি। চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে পরিবারকে হিমশিম খেতে হয়। স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের তুলনায় সিজারিয়ান সন্তান প্রসবের হার বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম চাঁদপুর। একেকটি সন্তান প্রসবে খরচ হয় ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার মতো। সঠিক পরিসংখ্যান হাতে নেই, তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, চিকিৎসার খরচ বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাঁদপুরে। একটি ছোট জেলা শহর, অথচ যেখানে বেসরকারি হাসপাতাল আছে ২৫টির বেশি। ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে ৫০টির বেশি। উপজেলা ছাড়িয়ে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অবস্থান লক্ষণীয়।
ফরেন রেমিট্যান্সের একটি বিশাল অংশ ব্যয় হয়ে থাকে এসব হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। আমি যে এলাকায় বাস করি তার দুই পাশে রয়েছে অনেক হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, যেখানে রয়েছে চিকিৎসকদের চেম্বার। রোগী এলে চিকিৎসকের ভিজিট দেওয়ার পর বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষা বাবদ সঙ্গে নিয়ে আসা টাকা খরচ করার পর ওষুধ কেনার আর টাকা থাকে না। মোবাইল ফোনে তাঁর নিকটাত্মীয়কে বলতে শোনা যায়, সুদে টাকা নিয়ে (যা কিস্তি নামে পরিচিত) অথবা বাড়ির পালিত ছাগল বা মুরগি বিক্রি করে বিকাশে টাকা পাঠানোর অনুরোধ করতে। এভাবে সাধারণ ও নিরীহ মানুষগুলো সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছেন।
ফরেন রেমিট্যান্স ব্যয়ের ধারাটি এ রকম: শিশুসন্তানকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে না পড়িয়ে বাড়ির পাশে স্বল্পশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত ছেলেমেয়েদের দ্বারা গড়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়াশোনা করানো, একটু বড় হলে উপজেলা বা জেলা সদরে গিয়ে কোনো স্কুলে ভর্তি করা, বেসরকারি হাসপাতাল এবং চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসাসেবা নেওয়া, ছোটখাটো বিরোধে মামলায় জড়িয়ে পড়া, বাড়িতে পাকাঘর নির্মাণ করা, স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য দামি মোবাইল ফোন ব্যবহার করা। সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে নূরানি বা কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শিক্ষাদান। আয়ের একটি বিশাল অংশ সেখানে ব্যয় হচ্ছে।
উত্তরণ কোন পথে?
এর সহজ কোনো পথ খোলা নেই। তবে নির্দ্বিধায় বলা যায়, যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তাঁদের কারিগরি জ্ঞান অর্জন ছাড়া বিদেশে না যাওয়া ভালো। ওই সব দেশে গিয়ে নিম্ন মজুরিতে নিম্নস্তরের কাজগুলোই তাঁরা করেন। যার ফলে, আধুনিক জ্ঞান ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁদের কোনো পরিচয় ঘটে না। ঈশ্বর বা স্রষ্টাকেন্দ্রিক মনোবৃত্তি তাঁদের মধ্যে এমনভাবে গেঁথে যায়, যা দেশে এসেও বলবৎ করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়।
বর্তমানে দক্ষ জনবল তৈরির জন্য চাঁদপুরে স্থাপিত হয়েছে মেরিন ইনস্টিটিউট, মৎস্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি উন্নয়নকল্পে বিভিন্ন প্রশিক্ষণকেন্দ্র। এখান থেকে বের হওয়া দক্ষ জনবল আগামী দিনগুলোতে ফরেন রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে আরও অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন, যা দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্ত করবে চাঁদপুর জেলাকে, রচিত হবে সোনার বাংলা, রক্তিম আভায় উদ্ভাসিত হবে দেশ।
মো. মোশারেফ হোসেন
অধ্যক্ষ, বাবুরহাট উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪