রুমিন ফারহানা
বাংলাদেশের গণমাধ্যম কি স্বাধীন? রিপোর্টাররা কতটুকু পারেন অনুসন্ধানী রিপোর্ট করতে? আচ্ছা, অনুসন্ধানী রিপোর্ট নাহয় বাদই দিই, একটা সাধারণ রিপোর্ট, যেটি সরকারে থাকা রাঘববোয়াল, বড় ব্যবসায়ী/শিল্পপতি, বড় আমলা কিংবা অতি প্রভাবশালী কারও বিপক্ষে যায়, এমন কোনো খবর কি সহজেই দেওয়া যায়? মালিকপক্ষের চাপে সাংবাদিকতার নীতির বাইরে গিয়ে সংবাদ ‘তৈরি’ না করে থাকা আদৌ কি সম্ভব অধিকাংশ গণমাধ্যমের পক্ষে? সরকার, মালিকপক্ষ, বিজ্ঞাপনদাতা ছাড়া আর কার কার চাপ সামলে চলতে হয় গণমাধ্যমকে? ঢাকার নামীদামি সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত একজন রিপোর্টার আর অজপাড়াগাঁয়ে কাজ করা একজন স্থানীয় প্রতিনিধিকে কি একই ধরনের চাপ/বাধা ডিঙিয়ে চলতে হয়? রাষ্ট্র, সরকার, মালিকপক্ষ, বিজ্ঞাপনদাতা–সবার চাপ পেরিয়ে যেটুকু খবর পাঠকের হাতে দিন শেষে পৌঁছায়, সেটা খবরের মোট পরিমাণ আর গুরুত্বের ঠিক কত শতাংশ কভার করে?
এত সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা বিশ্বের সবচেয়ে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের (আরএসএফ) মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের অবস্থান দেখলে। ২০২০ সালে এটা আগের বছরের তুলনায় এক ধাপ পিছিয়ে ১৫২তম অবস্থানে আছে। গত কয়েক বছরে এই অবনতি একেবারে ধারাবাহিকভাবে হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানান সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় একেবারে তলানিতে থাকলেও আফগানিস্তান অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের চেয়ে নিচে থাকে। কিন্তু মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার আফগানিস্তান (১২২তম), মিয়ানমারসহ (১৪০তম) সব দেশ তো বটেই, হালে বাংলাদেশকে নিয়ে ট্রল করতে গিয়ে যে দেশটির নাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব ব্যবহৃত হয়, সেই উগান্ডাও (১২৫তম) আছে আমাদের চেয়ে অনেকটা ভালো অবস্থানে। অথচ বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তা ও লেখার স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা–এ সবকিছুই সুরক্ষিত আছে আমাদের সংবিধানে। এ ছাড়া আছে ‘তথ্য অধিকার আইন’ এবং ‘জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন ২০১১’। তারপরও বাংলাদেশের অবস্থান মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে কেন ক্রমাগত পেছায়, সেটা বুঝতে হলে আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সরকার, সরকারের তিন অঙ্গের বিভাজন ও ক্ষমতার ভারসাম্য, চেক অ্যান্ড ব্যালান্স, বিশেষ করে বিচার বিভাগের ক্ষমতা ও স্বাধীনতা কতটুকু, সেটার একটা নির্মোহ বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
সর্বশেষ ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে নিবন্ধিত পত্রপত্রিকার সংখ্যা ৩ হাজার ২১০টি (অনলাইন গণমাধ্যম ব্যতীত)। এর মধ্যে দৈনিক পত্রিকা ১ হাজার ৩০৯টি, অর্ধসাপ্তাহিক ৩টি, সাপ্তাহিক ১ হাজার ২১৪টি, পাক্ষিক ২১৬টি, মাসিক ৪২৫টি, দ্বিমাসিক ৮টি, ত্রৈমাসিক ৩০টি, চতুর্মাসিক ১টি, ষাণ্মাসিক ২টি এবং বার্ষিক পত্রিকা রয়েছে ২টি। আর অনলাইন গণমাধ্যমকে ধরলে সংখ্যাটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমেয়। বাংলাদেশে বর্তমানে লাইসেন্সপ্রাপ্ত বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের সংখ্যা ৪৫টি। এ ছাড়া আছে এফএম রেডিও, আছে হাতে হাতে মোবাইল ফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। আর সে কারণেই যখনই মুক্ত গণমাধ্যমের প্রসঙ্গে কোনো আলোচনা এসেছে, তখনই সরকার মিডিয়ার সংখ্যাগত আধিক্যের বিষয়টি সামনে এনেছে। অথচ মজার বিষয় হলো, এত এত গণমাধ্যমের যুগে অধিকাংশ চাঞ্চল্যকর তথ্য আমাদের দেখতে হয় বিদেশি গণমাধ্যমে।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে চট্টগ্রামের একটি কেন্দ্রে ভোট শুরুর আগেই ব্যালটভর্তি বাক্স পাওয়ার ভিডিও আমাদের দেখতে হয়েছে বিবিসি বাংলায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ লুটের খবর প্রথম আমরা দেখি ফিলিপাইনের এক পত্রিকায়। বর্তমান সরকারের এক অতি প্রভাবশালী উপদেষ্টার দুটি অতি প্রচারিত সাক্ষাৎকারের একটি নিয়েছিল আল জাজিরা আর অন্যটি ডয়চে ভেলে। মানুষকে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্যাতনের তথ্যসংবলিত র্যাবের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার একটি অডিও রেকর্ডিং প্রকাশ করেছিল সুইডিশ একটি রেডিও। এমনকি তনু হত্যার খবরও মূলধারার গণমাধ্যম তখনই প্রকাশ করেছে যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ক্রমেই এতই শক্তিশালী হয়ে উঠছে যে সমাজে এমন প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে মূলধারার মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা মানুষ সামাজিক মাধ্যমে গিয়ে যাচাই করবে কি না।
একটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশের আইনের ধরন, তার প্রয়োগ, ব্যাখ্যা–সবকিছুই নির্ভর করে সরকারের চরিত্রের ওপর, সে কী পরিচয়ে পরিচিত হতে চায়, তার ওপর। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, ২০০৬ সালে করা মূল আইসিটি অ্যাক্টে ৫৭ ধারা বলে কিছু ছিল না। ২০১৩ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে ৫৭ ধারা যুক্ত করা হয়। একইভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনও আসে ২০১৮ সালের আরেকটি নির্বাচন সামনে রেখে। ২০১৮ সালের আইন করার আগে ৫৭ ধারার সমালোচনার বিষয়টি নানা মহল থেকে বারবার উঠে আসছিল। অথচ আইন করার পরে দেখা গেল ৫৭ ধারাটি চার ধারায় ভাগ করে আরও অস্পষ্ট, আরও কঠিন সাজা এবং জামিন অযোগ্যতা দিয়ে নতুন আইনে রাখা হয়েছে। এই আইনে গুপ্তচরবৃত্তি বন্ধ করার নামে ৩২ ধারা যুক্ত করা হয়, যা আদতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বন্ধ করার এক নোংরা পদক্ষেপ। এমন কোনো ধারা আইসিটি অ্যাক্টে ছিল না।
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, ভারতের মতো অসাধারণ গণতান্ত্রিক এক দেশেও তো ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যাক্ট ২০০০ আছে। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, এই আইনের অপপ্রয়োগ ঠেকানোর জন্য ভারতের আছে অসাধারণ জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং শক্ত বিচার বিভাগ। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে যখন দেশটি একেবারে যাচ্ছেতাই পরিস্থিতিতে পড়ে, তখন দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানাসহ নানা রাজ্যে মানুষ হাসপাতাল শয্যা, অক্সিজেন, চিকিৎসা না পেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দেওয়ার ‘অপরাধে’ পুলিশি হয়রানির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট কঠোরভাবে জানান, কোনোভাবেই অনলাইনে মতপ্রকাশের জন্য নাগরিকদের হয়রানি করা যাবে না। হাইকোর্ট এটাও জানান, এরপরও কাউকে হয়রানি করা হলে সেটা আদালত অবমাননা বলে গণ্য হবে। এমন রক্ষাকবচ কি আমাদের দেশে কল্পনাবিলাস নয়? তাহলে মিডিয়া কীভাবে হবে স্বাধীন?
আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে ‘আজকের পত্রিকা’। শত হতাশার মাঝেও আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে। বিশ্বাস করি, হাজার পত্রিকার ভিড়ে কেবল আরেকটি পত্রিকা হওয়ার জন্য তৈরি হয়নি ‘আজকের পত্রিকা’। স্বপ্ন দেখি এই পত্রিকা ধীরে ধীরে কালের পরিক্রমায় দেশের প্রথম সারির একটি পত্রিকা হয়ে উঠবে; হয়ে উঠবে খবর এবং বিশ্লেষণ জানার জন্য মানুষের আস্থা ও ভরসার জায়গা। যদিও জানি, রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি স্তম্ভের ভিত্তির ওপরই দাঁড়িয়ে থাকে চতুর্থ স্তম্ভ। যে রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ মজবুত, শক্তিশালী কিন্তু আলাদা, সে রাষ্ট্রের গণমাধ্যম নির্ভীক ও স্বাধীন হতে বাধ্য। কিন্তু আমাদের দেশে বিরাজ করছে তার উল্টো পরিস্থিতি।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে তাই ভয় হয়। রাষ্ট্র, সরকার, মালিকপক্ষ, বিজ্ঞাপন, কালাকানুন এত কিছুর চাপ সামলে সত্যিকার গণমানুষের হয়ে উঠতে পারবে তো ‘আজকের পত্রিকা’? বিশ্বাস বড় কঠিন জিনিস, তৈরি হতে সময় নেয়, কিন্তু ভাঙতে লাগে মুহূর্ত। আশা করব নির্ভীকতা, সততা আর বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে ‘আজকের পত্রিকা’ প্রমাণ করবে এটি শুধুই আরেকটি দৈনিক পত্রিকা নয়।
রুমিন ফারহানা
সংসদীয় দলের হুইপ, বিএনপি
বাংলাদেশের গণমাধ্যম কি স্বাধীন? রিপোর্টাররা কতটুকু পারেন অনুসন্ধানী রিপোর্ট করতে? আচ্ছা, অনুসন্ধানী রিপোর্ট নাহয় বাদই দিই, একটা সাধারণ রিপোর্ট, যেটি সরকারে থাকা রাঘববোয়াল, বড় ব্যবসায়ী/শিল্পপতি, বড় আমলা কিংবা অতি প্রভাবশালী কারও বিপক্ষে যায়, এমন কোনো খবর কি সহজেই দেওয়া যায়? মালিকপক্ষের চাপে সাংবাদিকতার নীতির বাইরে গিয়ে সংবাদ ‘তৈরি’ না করে থাকা আদৌ কি সম্ভব অধিকাংশ গণমাধ্যমের পক্ষে? সরকার, মালিকপক্ষ, বিজ্ঞাপনদাতা ছাড়া আর কার কার চাপ সামলে চলতে হয় গণমাধ্যমকে? ঢাকার নামীদামি সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত একজন রিপোর্টার আর অজপাড়াগাঁয়ে কাজ করা একজন স্থানীয় প্রতিনিধিকে কি একই ধরনের চাপ/বাধা ডিঙিয়ে চলতে হয়? রাষ্ট্র, সরকার, মালিকপক্ষ, বিজ্ঞাপনদাতা–সবার চাপ পেরিয়ে যেটুকু খবর পাঠকের হাতে দিন শেষে পৌঁছায়, সেটা খবরের মোট পরিমাণ আর গুরুত্বের ঠিক কত শতাংশ কভার করে?
এত সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা বিশ্বের সবচেয়ে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের (আরএসএফ) মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের অবস্থান দেখলে। ২০২০ সালে এটা আগের বছরের তুলনায় এক ধাপ পিছিয়ে ১৫২তম অবস্থানে আছে। গত কয়েক বছরে এই অবনতি একেবারে ধারাবাহিকভাবে হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানান সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় একেবারে তলানিতে থাকলেও আফগানিস্তান অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের চেয়ে নিচে থাকে। কিন্তু মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার আফগানিস্তান (১২২তম), মিয়ানমারসহ (১৪০তম) সব দেশ তো বটেই, হালে বাংলাদেশকে নিয়ে ট্রল করতে গিয়ে যে দেশটির নাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব ব্যবহৃত হয়, সেই উগান্ডাও (১২৫তম) আছে আমাদের চেয়ে অনেকটা ভালো অবস্থানে। অথচ বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তা ও লেখার স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা–এ সবকিছুই সুরক্ষিত আছে আমাদের সংবিধানে। এ ছাড়া আছে ‘তথ্য অধিকার আইন’ এবং ‘জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন ২০১১’। তারপরও বাংলাদেশের অবস্থান মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে কেন ক্রমাগত পেছায়, সেটা বুঝতে হলে আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সরকার, সরকারের তিন অঙ্গের বিভাজন ও ক্ষমতার ভারসাম্য, চেক অ্যান্ড ব্যালান্স, বিশেষ করে বিচার বিভাগের ক্ষমতা ও স্বাধীনতা কতটুকু, সেটার একটা নির্মোহ বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
সর্বশেষ ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে নিবন্ধিত পত্রপত্রিকার সংখ্যা ৩ হাজার ২১০টি (অনলাইন গণমাধ্যম ব্যতীত)। এর মধ্যে দৈনিক পত্রিকা ১ হাজার ৩০৯টি, অর্ধসাপ্তাহিক ৩টি, সাপ্তাহিক ১ হাজার ২১৪টি, পাক্ষিক ২১৬টি, মাসিক ৪২৫টি, দ্বিমাসিক ৮টি, ত্রৈমাসিক ৩০টি, চতুর্মাসিক ১টি, ষাণ্মাসিক ২টি এবং বার্ষিক পত্রিকা রয়েছে ২টি। আর অনলাইন গণমাধ্যমকে ধরলে সংখ্যাটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমেয়। বাংলাদেশে বর্তমানে লাইসেন্সপ্রাপ্ত বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের সংখ্যা ৪৫টি। এ ছাড়া আছে এফএম রেডিও, আছে হাতে হাতে মোবাইল ফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। আর সে কারণেই যখনই মুক্ত গণমাধ্যমের প্রসঙ্গে কোনো আলোচনা এসেছে, তখনই সরকার মিডিয়ার সংখ্যাগত আধিক্যের বিষয়টি সামনে এনেছে। অথচ মজার বিষয় হলো, এত এত গণমাধ্যমের যুগে অধিকাংশ চাঞ্চল্যকর তথ্য আমাদের দেখতে হয় বিদেশি গণমাধ্যমে।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে চট্টগ্রামের একটি কেন্দ্রে ভোট শুরুর আগেই ব্যালটভর্তি বাক্স পাওয়ার ভিডিও আমাদের দেখতে হয়েছে বিবিসি বাংলায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ লুটের খবর প্রথম আমরা দেখি ফিলিপাইনের এক পত্রিকায়। বর্তমান সরকারের এক অতি প্রভাবশালী উপদেষ্টার দুটি অতি প্রচারিত সাক্ষাৎকারের একটি নিয়েছিল আল জাজিরা আর অন্যটি ডয়চে ভেলে। মানুষকে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্যাতনের তথ্যসংবলিত র্যাবের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার একটি অডিও রেকর্ডিং প্রকাশ করেছিল সুইডিশ একটি রেডিও। এমনকি তনু হত্যার খবরও মূলধারার গণমাধ্যম তখনই প্রকাশ করেছে যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ক্রমেই এতই শক্তিশালী হয়ে উঠছে যে সমাজে এমন প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে মূলধারার মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা মানুষ সামাজিক মাধ্যমে গিয়ে যাচাই করবে কি না।
একটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশের আইনের ধরন, তার প্রয়োগ, ব্যাখ্যা–সবকিছুই নির্ভর করে সরকারের চরিত্রের ওপর, সে কী পরিচয়ে পরিচিত হতে চায়, তার ওপর। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, ২০০৬ সালে করা মূল আইসিটি অ্যাক্টে ৫৭ ধারা বলে কিছু ছিল না। ২০১৩ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে ৫৭ ধারা যুক্ত করা হয়। একইভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনও আসে ২০১৮ সালের আরেকটি নির্বাচন সামনে রেখে। ২০১৮ সালের আইন করার আগে ৫৭ ধারার সমালোচনার বিষয়টি নানা মহল থেকে বারবার উঠে আসছিল। অথচ আইন করার পরে দেখা গেল ৫৭ ধারাটি চার ধারায় ভাগ করে আরও অস্পষ্ট, আরও কঠিন সাজা এবং জামিন অযোগ্যতা দিয়ে নতুন আইনে রাখা হয়েছে। এই আইনে গুপ্তচরবৃত্তি বন্ধ করার নামে ৩২ ধারা যুক্ত করা হয়, যা আদতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বন্ধ করার এক নোংরা পদক্ষেপ। এমন কোনো ধারা আইসিটি অ্যাক্টে ছিল না।
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, ভারতের মতো অসাধারণ গণতান্ত্রিক এক দেশেও তো ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যাক্ট ২০০০ আছে। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, এই আইনের অপপ্রয়োগ ঠেকানোর জন্য ভারতের আছে অসাধারণ জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং শক্ত বিচার বিভাগ। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে যখন দেশটি একেবারে যাচ্ছেতাই পরিস্থিতিতে পড়ে, তখন দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানাসহ নানা রাজ্যে মানুষ হাসপাতাল শয্যা, অক্সিজেন, চিকিৎসা না পেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দেওয়ার ‘অপরাধে’ পুলিশি হয়রানির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট কঠোরভাবে জানান, কোনোভাবেই অনলাইনে মতপ্রকাশের জন্য নাগরিকদের হয়রানি করা যাবে না। হাইকোর্ট এটাও জানান, এরপরও কাউকে হয়রানি করা হলে সেটা আদালত অবমাননা বলে গণ্য হবে। এমন রক্ষাকবচ কি আমাদের দেশে কল্পনাবিলাস নয়? তাহলে মিডিয়া কীভাবে হবে স্বাধীন?
আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে ‘আজকের পত্রিকা’। শত হতাশার মাঝেও আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে। বিশ্বাস করি, হাজার পত্রিকার ভিড়ে কেবল আরেকটি পত্রিকা হওয়ার জন্য তৈরি হয়নি ‘আজকের পত্রিকা’। স্বপ্ন দেখি এই পত্রিকা ধীরে ধীরে কালের পরিক্রমায় দেশের প্রথম সারির একটি পত্রিকা হয়ে উঠবে; হয়ে উঠবে খবর এবং বিশ্লেষণ জানার জন্য মানুষের আস্থা ও ভরসার জায়গা। যদিও জানি, রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি স্তম্ভের ভিত্তির ওপরই দাঁড়িয়ে থাকে চতুর্থ স্তম্ভ। যে রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ মজবুত, শক্তিশালী কিন্তু আলাদা, সে রাষ্ট্রের গণমাধ্যম নির্ভীক ও স্বাধীন হতে বাধ্য। কিন্তু আমাদের দেশে বিরাজ করছে তার উল্টো পরিস্থিতি।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে তাই ভয় হয়। রাষ্ট্র, সরকার, মালিকপক্ষ, বিজ্ঞাপন, কালাকানুন এত কিছুর চাপ সামলে সত্যিকার গণমানুষের হয়ে উঠতে পারবে তো ‘আজকের পত্রিকা’? বিশ্বাস বড় কঠিন জিনিস, তৈরি হতে সময় নেয়, কিন্তু ভাঙতে লাগে মুহূর্ত। আশা করব নির্ভীকতা, সততা আর বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে ‘আজকের পত্রিকা’ প্রমাণ করবে এটি শুধুই আরেকটি দৈনিক পত্রিকা নয়।
রুমিন ফারহানা
সংসদীয় দলের হুইপ, বিএনপি
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪