ইবরাহীম মুহাম্মদ
ভিনদেশি এক ক্যাপ্টেন এসেছিলেন দুঃশাসনতাড়িত আশ্রয়প্রার্থী মানুষের দেখভাল করতে। মশার কামড়ে তৎকালে দুরারোগ্য ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু তাঁকে চিরকালের জন্য আপন করে দেয় এই ভূমির। তিনি ব্রিটিশ উপনিবেশের তদারককারী পক্ষের একজন, স্কটিশ ক্যাপ্টেন হাইরাম কক্স। আমাদের কাছে ‘হিরাম কক্স’ বা ‘ক্যাপ্টেন কক্স’ বা ‘কক্স সাহেব’ বা শুধুই ‘সাহেব’। এই ভূমিতে চির সমাধিলাভের পর ললাটলিখনে হয়ে যান এই অঞ্চলেরই পরিচিতি সূত্র। একজন ভিনদেশি মানুষ স্বল্প মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে এসে এভাবে পুরো অঞ্চলটিকেই স্বনামাঙ্কিত করে ফেলার এমন ঘটনা ইতিহাসে খুব বেশি নেই।
কক্সবাজার স্বাধীন বাংলাদেশের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল-জেলা। কিন্তু এর নামোচ্চারণেই চলে আসে এক অকালমৃত দূরদেশির স্মৃতি। তিনি হাইরাম কক্স। সেনাবাহিনীর তরুণ ক্যাডেট হাইরাম কক্স যখন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে আসেন, তখন তাঁর বয়স উনিশ কি বিশ। ১৭৯৬ সালে তিনি বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্টের ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের ব্যাটালিয়ন-ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হলে তাঁকে ব্রিটিশ সরকারের দূত হিসেবে পাঠানো হয় রেঙ্গুনে (বর্তমান ইয়াঙ্গুন)। সেখানে বার্মার (অধুনা মিয়ানমার) বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে হাইরাম কক্স অবহিত হন।
ইতিমধ্যে আরাকানের রাজার সঙ্গে স্থানীয় সামন্তরাজাদের কোন্দলের সুযোগে বর্মিরাজ বোদপায়া (ভিন্ন উচ্চারণে ‘বোধাপায়া’) আরাকান আক্রমণ করেন। সামন্ত ও রাজ-অমাত্যদের সহযোগিতায় প্রায় বিনা বাধায় তিনি আরাকান দখল করে নেন। আরাকানরাজের বিরোধীপক্ষ আশা করেছিল, বর্মিরাজের সহায়তায় তারা রাজ্য শাসনের অধিকার লাভ করবে। কিন্তু বর্মিরাজ বিশ্বাসঘাতকতা করেন। তাঁর সৈন্যরা আরাকানের মানুষের ওপর বর্বর পীড়ন চালায়।
আরাকানে বৌদ্ধ ও মুসলমানরা বহু যুগ ধরে সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করে আসছিল। তাদের ওপর বর্বরতা সীমা ছাড়িয়ে গেলে প্রাণরক্ষার তাগিদে মুসলমান-রোহিঙ্গা ও বৌদ্ধরা সদলে নাফ নদী পেরিয়ে ব্রিটিশ ভারতের জনবিরল ও জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় প্রবেশ করতে থাকে। ১৭৯৬ সালে আরাকানের সামন্তরাজারা একত্র হয়ে বার্মারাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে হেরে গেলে উদ্বাস্তু-সমস্যা আরও গুরুতর হয়ে ওঠে। প্রাণভয়ে ভীত ও আশ্রয়ের সন্ধানে আকুল রোহিঙ্গা-মুসলমান ও বৌদ্ধদের আশ্রয়দান ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয় ক্যাপ্টেন হাইরাম কক্সকে। কারণ, ওই অঞ্চলের অধিবাসীদের সম্পর্কে তাঁর কিছু পূর্বধারণা ছিল।
১৭৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাপ্টেন হাইরাম কক্স আরাকানি-উদ্বাস্তুদের দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে রামুতে ঘাঁটি গাড়েন বাকোলি নদীর তীরে, যার বর্তমান নাম বাঁকখালী। আরাকানি-উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের কাজ চলতে থাকে। তদারক করতে থাকা হাইরাম কক্স মশার কামড়ে জ্বরে আক্রান্ত হন। সেই জ্বর তিনি আর সামলে উঠতে পারেননি। ১৭৯৯ সালের ২ আগস্ট রামুতে মারা যান তিনি। বাঁকখালী নদীর তীরে হাইটুপিতে তাঁকে সমাহিত করা হয়। নদীর আগ্রাসী ভাঙনে সে সমাধি আজ বিলীন; কিন্তু তিনি ছড়িয়ে গেছেন পুরো অঞ্চলে।
আরাকানি উদ্বাস্তুদের জন্য বসতি স্থাপনের পর আশ্রয়ার্থীদের সুবিধার্থে হাইরাম কক্স সমুদ্র-উপকূলের অদূরে স্থাপন করেন একটি বাজার। লোকমুখে যার নাম হলো ‘সাহেবের বাজার’। রাখাইনদের মুখে যা ‘ফালং ঝি’, তা-ও একই অর্থবহ। ‘ফালং’ অর্থ সাহেব, আর ‘ঝি’ হলো বাজার। অর্থাৎ ‘সাহেবের বাজার’। আর ‘সাহেব’ বলতে ক্যাপ্টেন হাইরাম কক্সকেই বোঝানো হতো। অনেকে একে ‘পালংকি’ হিসেবেও লিখেছেন।
ক্যাপ্টেন হাইরাম কক্সের অকস্মাৎ মৃত্যুর পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন ঢাকার রেজিস্ট্রার কার সাহেব। তিনি হাইরাম কক্সের স্থাপিত বাজারটি দেখে অকালমৃত কক্সের স্মৃতির প্রতি সম্মানার্থে সেই বাজারের আনুষ্ঠানিক নাম দিলেন ‘কক্সেস বাজার’ বা কক্স-এর বাজার, যা পরবর্তী সময়ে সম্প্রসারিত অঞ্চল নিয়ে হয়ে দাঁড়ায় ‘কক্সবাজার’।
তারপর আর থেমে থাকেনি কক্স সাহেবের বাজার। এর অঞ্চল ও খ্যাতির সীমানা বাড়তেই লাগল। হাইরাম কক্সের প্রতিষ্ঠিত বাজারটির নামানুসারে মৌজার নামকরণ করা হয় কক্সবাজার। আবার এ মৌজাটিকেই সদর করে ১৮৫৪ সালে স্থাপন করা হয় কক্সবাজার মহকুমা। তারপর ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ একে জেলা ঘোষণা করা হয়।
দুই.
সমতল, পাহাড়-টিলা, নিচু ভূমি, বন-উপবন, নদী-খাল-ছড়া-ঝিরি, দ্বীপ, চ্যানেল আর সমুদ্র নিয়ে এক অপরূপ এলাকা কক্সবাজার। এখানে আছে পৃথিবীর দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্রসৈকত, বাংলাদেশের একমাত্র শৈলদ্বীপ মহেশখালী, দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ অসাধারণ সুন্দর সেন্ট মার্টিন, দেশের বৃহত্তম রামু রাবারবাগান, এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম পরিকল্পিত নারকেলবাগান, দেশের প্রথম সাফারি পার্ক ডুলাহাজারায় অবস্থিত বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, এশিয়ার বৃহত্তম সমবায় সমিতি বলে কথিত বদরখালী কৃষি ও উপনিবেশ সমিতি, দেশের একমাত্র কুমির প্রজননকেন্দ্র, বাংলাদেশের বৃহত্তম বুদ্ধমূর্তি ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির পীঠস্থান রামু, দেশের চাহিদার সিংহভাগ নুন জোগানো লবণমাঠ, আন্তর্জাতিকভাবে আদৃত চিংড়ি ও অন্য মাছের ঘের। সব মিলিয়ে প্রকৃতির অকৃপণ দানে ঋদ্ধ কক্সবাজার কেবল দেশের নয়, পৃথিবীর মানচিত্রে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান।
বাংলাদেশের মোট লবণ চাহিদার সিংহভাগই উৎপাদন করে কক্সবাজার। এ অঞ্চলে ১৯৬০ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে লবণ উৎপাদন শুরু হয়ে এখন ৬০ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন হয়, যা দেশের লবণের চাহিদার সিংহভাগই জোগান দিতে পারে। দেশের ১৯টি জাতীয় উদ্যানের তিনটিই কক্সবাজারে। এ তিনটি হলো মেধা কচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যান, হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান ও ইনানি জাতীয় উদ্যান।
দেশের অন্যতম প্রধান বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে মাতারবাড়িতে। কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশাপাশি এগোচ্ছে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ। তৈরি হলে এটি হবে দেশের চতুর্থ বন্দর। এ বন্দরের নির্মাণকাজ দুই ধাপে হবে, প্রথম ধাপে হবে কনটেইনার টার্মিনাল এবং দ্বিতীয় ধাপে বহুমুখী টার্মিনাল। মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গেই নির্মিত হতে চলেছে চার লেনের একটি সড়ক, যা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত হবে। ইতিমধ্যে বন্দর নির্মাণের কাজ অনেকখানি এগিয়েছে। ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল বহনকারী জাহাজ প্রথমবারের মতো এই বন্দরে ঢুকেছে।
কক্সবাজারের যোগাযোগব্যবস্থাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের নির্মিত ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ সড়ক। এই সড়ক কক্সবাজার শহরের কলাতলী থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত। পৃথিবীর দীর্ঘতম এই মেরিন ড্রাইভ সড়ককে অধিকতর কার্যকর ও পূর্ণতা দিতে এর বিস্তৃতি চট্টগ্রাম পর্যন্ত বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এটি নির্মিত হলে তা হবে দেশের পর্যটনশিল্পের জন্য অভাবনীয় উন্নতির সোপান।
ব্রিটিশরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কক্সবাজার এলাকায় দুটি বিমানবন্দর তৈরি করে কক্সবাজার ও চকরিয়ায়। যুদ্ধ শেষে দুটিই পরিত্যক্ত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার কক্সবাজার বিমানবন্দরের সংস্কার করে। স্বাধীন বাংলাদেশে, ১৯৭২ সালে কক্সবাজার বিমানবন্দর ব্যবহারের উপযোগী হয়। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি চারটি সংস্থা এই বিমানবন্দরে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এই বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার প্রক্রিয়া চলছে।
কক্সবাজারের যোগাযোগব্যবস্থা ও পর্যটন খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধন করতে পারে কক্সবাজার পর্যন্ত সম্প্রসারিত রেলযোগাযোগ। ১৯৩১ সালের দিকে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন স্থাপিত হলেও নানা কারণে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ ফাইলবন্দী হয়ে ছিল বহু বছর। ২০১১ সালে কক্সবাজার পর্যন্ত এ রেলপথ সম্প্রসারণের প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও সম্প্রতি এ প্রকল্পের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। আশা করা হচ্ছে, ২০২২ সালের শেষের দিকে এ রেলপথ দিয়ে রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে মানুষ কক্সবাজার আসতে পারবে। পরিকল্পকেরা আশা করছেন, এই রেলপথ কক্সবাজারেই শেষ হবে না। ভবিষ্যতে রেলপথটি কক্সবাজার থেকে একসময় চীন পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে। যদি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়, তবে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও পর্যটনের ক্ষেত্রে কক্সবাজার নতুন মাত্রা লাভ করবে।
কক্সবাজারের সমৃদ্ধির মুকুটে আরেকটি পালক হয়ে যুক্ত হয়েছে বানৌজা শেখ হাসিনা দেশের প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ ডুবোজাহাজ ঘাঁটি। কুতুবদিয়া চ্যানেলকে ঘিরে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এ ঘাঁটি স্থাপনের প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে কক্সবাজারের ভূমিকা নানামাত্রিক। এর বনের কাঠ, বিস্তৃত মাঠে উৎপাদিত বাগদা-গলদা ও লবণ, এর পর্যটনশিল্পসহ অন্যান্য উৎস থেকে জাতীয় তহবিলের ধমনিতে রক্ত সঞ্চালিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেশের অগ্রগতি কক্সবাজারের অগ্রগতির সমার্থক হয়ে উঠেছে বহুদিন ধরেই। দেশ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে কক্সবাজারের হাত ধরে। আর দেশের সমৃদ্ধির নানা চিহ্ন ধারণ করছে কক্সবাজার।
ইবরাহীম মুহাম্মদ
সহকারী অধ্যাপক, শহীদ জিয়া ডিএমআই ইনস্টিটিউট
ভিনদেশি এক ক্যাপ্টেন এসেছিলেন দুঃশাসনতাড়িত আশ্রয়প্রার্থী মানুষের দেখভাল করতে। মশার কামড়ে তৎকালে দুরারোগ্য ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু তাঁকে চিরকালের জন্য আপন করে দেয় এই ভূমির। তিনি ব্রিটিশ উপনিবেশের তদারককারী পক্ষের একজন, স্কটিশ ক্যাপ্টেন হাইরাম কক্স। আমাদের কাছে ‘হিরাম কক্স’ বা ‘ক্যাপ্টেন কক্স’ বা ‘কক্স সাহেব’ বা শুধুই ‘সাহেব’। এই ভূমিতে চির সমাধিলাভের পর ললাটলিখনে হয়ে যান এই অঞ্চলেরই পরিচিতি সূত্র। একজন ভিনদেশি মানুষ স্বল্প মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে এসে এভাবে পুরো অঞ্চলটিকেই স্বনামাঙ্কিত করে ফেলার এমন ঘটনা ইতিহাসে খুব বেশি নেই।
কক্সবাজার স্বাধীন বাংলাদেশের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল-জেলা। কিন্তু এর নামোচ্চারণেই চলে আসে এক অকালমৃত দূরদেশির স্মৃতি। তিনি হাইরাম কক্স। সেনাবাহিনীর তরুণ ক্যাডেট হাইরাম কক্স যখন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে আসেন, তখন তাঁর বয়স উনিশ কি বিশ। ১৭৯৬ সালে তিনি বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্টের ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের ব্যাটালিয়ন-ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হলে তাঁকে ব্রিটিশ সরকারের দূত হিসেবে পাঠানো হয় রেঙ্গুনে (বর্তমান ইয়াঙ্গুন)। সেখানে বার্মার (অধুনা মিয়ানমার) বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে হাইরাম কক্স অবহিত হন।
ইতিমধ্যে আরাকানের রাজার সঙ্গে স্থানীয় সামন্তরাজাদের কোন্দলের সুযোগে বর্মিরাজ বোদপায়া (ভিন্ন উচ্চারণে ‘বোধাপায়া’) আরাকান আক্রমণ করেন। সামন্ত ও রাজ-অমাত্যদের সহযোগিতায় প্রায় বিনা বাধায় তিনি আরাকান দখল করে নেন। আরাকানরাজের বিরোধীপক্ষ আশা করেছিল, বর্মিরাজের সহায়তায় তারা রাজ্য শাসনের অধিকার লাভ করবে। কিন্তু বর্মিরাজ বিশ্বাসঘাতকতা করেন। তাঁর সৈন্যরা আরাকানের মানুষের ওপর বর্বর পীড়ন চালায়।
আরাকানে বৌদ্ধ ও মুসলমানরা বহু যুগ ধরে সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করে আসছিল। তাদের ওপর বর্বরতা সীমা ছাড়িয়ে গেলে প্রাণরক্ষার তাগিদে মুসলমান-রোহিঙ্গা ও বৌদ্ধরা সদলে নাফ নদী পেরিয়ে ব্রিটিশ ভারতের জনবিরল ও জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় প্রবেশ করতে থাকে। ১৭৯৬ সালে আরাকানের সামন্তরাজারা একত্র হয়ে বার্মারাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে হেরে গেলে উদ্বাস্তু-সমস্যা আরও গুরুতর হয়ে ওঠে। প্রাণভয়ে ভীত ও আশ্রয়ের সন্ধানে আকুল রোহিঙ্গা-মুসলমান ও বৌদ্ধদের আশ্রয়দান ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয় ক্যাপ্টেন হাইরাম কক্সকে। কারণ, ওই অঞ্চলের অধিবাসীদের সম্পর্কে তাঁর কিছু পূর্বধারণা ছিল।
১৭৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাপ্টেন হাইরাম কক্স আরাকানি-উদ্বাস্তুদের দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে রামুতে ঘাঁটি গাড়েন বাকোলি নদীর তীরে, যার বর্তমান নাম বাঁকখালী। আরাকানি-উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের কাজ চলতে থাকে। তদারক করতে থাকা হাইরাম কক্স মশার কামড়ে জ্বরে আক্রান্ত হন। সেই জ্বর তিনি আর সামলে উঠতে পারেননি। ১৭৯৯ সালের ২ আগস্ট রামুতে মারা যান তিনি। বাঁকখালী নদীর তীরে হাইটুপিতে তাঁকে সমাহিত করা হয়। নদীর আগ্রাসী ভাঙনে সে সমাধি আজ বিলীন; কিন্তু তিনি ছড়িয়ে গেছেন পুরো অঞ্চলে।
আরাকানি উদ্বাস্তুদের জন্য বসতি স্থাপনের পর আশ্রয়ার্থীদের সুবিধার্থে হাইরাম কক্স সমুদ্র-উপকূলের অদূরে স্থাপন করেন একটি বাজার। লোকমুখে যার নাম হলো ‘সাহেবের বাজার’। রাখাইনদের মুখে যা ‘ফালং ঝি’, তা-ও একই অর্থবহ। ‘ফালং’ অর্থ সাহেব, আর ‘ঝি’ হলো বাজার। অর্থাৎ ‘সাহেবের বাজার’। আর ‘সাহেব’ বলতে ক্যাপ্টেন হাইরাম কক্সকেই বোঝানো হতো। অনেকে একে ‘পালংকি’ হিসেবেও লিখেছেন।
ক্যাপ্টেন হাইরাম কক্সের অকস্মাৎ মৃত্যুর পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন ঢাকার রেজিস্ট্রার কার সাহেব। তিনি হাইরাম কক্সের স্থাপিত বাজারটি দেখে অকালমৃত কক্সের স্মৃতির প্রতি সম্মানার্থে সেই বাজারের আনুষ্ঠানিক নাম দিলেন ‘কক্সেস বাজার’ বা কক্স-এর বাজার, যা পরবর্তী সময়ে সম্প্রসারিত অঞ্চল নিয়ে হয়ে দাঁড়ায় ‘কক্সবাজার’।
তারপর আর থেমে থাকেনি কক্স সাহেবের বাজার। এর অঞ্চল ও খ্যাতির সীমানা বাড়তেই লাগল। হাইরাম কক্সের প্রতিষ্ঠিত বাজারটির নামানুসারে মৌজার নামকরণ করা হয় কক্সবাজার। আবার এ মৌজাটিকেই সদর করে ১৮৫৪ সালে স্থাপন করা হয় কক্সবাজার মহকুমা। তারপর ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ একে জেলা ঘোষণা করা হয়।
দুই.
সমতল, পাহাড়-টিলা, নিচু ভূমি, বন-উপবন, নদী-খাল-ছড়া-ঝিরি, দ্বীপ, চ্যানেল আর সমুদ্র নিয়ে এক অপরূপ এলাকা কক্সবাজার। এখানে আছে পৃথিবীর দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্রসৈকত, বাংলাদেশের একমাত্র শৈলদ্বীপ মহেশখালী, দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ অসাধারণ সুন্দর সেন্ট মার্টিন, দেশের বৃহত্তম রামু রাবারবাগান, এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম পরিকল্পিত নারকেলবাগান, দেশের প্রথম সাফারি পার্ক ডুলাহাজারায় অবস্থিত বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, এশিয়ার বৃহত্তম সমবায় সমিতি বলে কথিত বদরখালী কৃষি ও উপনিবেশ সমিতি, দেশের একমাত্র কুমির প্রজননকেন্দ্র, বাংলাদেশের বৃহত্তম বুদ্ধমূর্তি ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির পীঠস্থান রামু, দেশের চাহিদার সিংহভাগ নুন জোগানো লবণমাঠ, আন্তর্জাতিকভাবে আদৃত চিংড়ি ও অন্য মাছের ঘের। সব মিলিয়ে প্রকৃতির অকৃপণ দানে ঋদ্ধ কক্সবাজার কেবল দেশের নয়, পৃথিবীর মানচিত্রে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান।
বাংলাদেশের মোট লবণ চাহিদার সিংহভাগই উৎপাদন করে কক্সবাজার। এ অঞ্চলে ১৯৬০ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে লবণ উৎপাদন শুরু হয়ে এখন ৬০ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন হয়, যা দেশের লবণের চাহিদার সিংহভাগই জোগান দিতে পারে। দেশের ১৯টি জাতীয় উদ্যানের তিনটিই কক্সবাজারে। এ তিনটি হলো মেধা কচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যান, হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান ও ইনানি জাতীয় উদ্যান।
দেশের অন্যতম প্রধান বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে মাতারবাড়িতে। কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশাপাশি এগোচ্ছে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ। তৈরি হলে এটি হবে দেশের চতুর্থ বন্দর। এ বন্দরের নির্মাণকাজ দুই ধাপে হবে, প্রথম ধাপে হবে কনটেইনার টার্মিনাল এবং দ্বিতীয় ধাপে বহুমুখী টার্মিনাল। মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গেই নির্মিত হতে চলেছে চার লেনের একটি সড়ক, যা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত হবে। ইতিমধ্যে বন্দর নির্মাণের কাজ অনেকখানি এগিয়েছে। ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল বহনকারী জাহাজ প্রথমবারের মতো এই বন্দরে ঢুকেছে।
কক্সবাজারের যোগাযোগব্যবস্থাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের নির্মিত ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ সড়ক। এই সড়ক কক্সবাজার শহরের কলাতলী থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত। পৃথিবীর দীর্ঘতম এই মেরিন ড্রাইভ সড়ককে অধিকতর কার্যকর ও পূর্ণতা দিতে এর বিস্তৃতি চট্টগ্রাম পর্যন্ত বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এটি নির্মিত হলে তা হবে দেশের পর্যটনশিল্পের জন্য অভাবনীয় উন্নতির সোপান।
ব্রিটিশরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কক্সবাজার এলাকায় দুটি বিমানবন্দর তৈরি করে কক্সবাজার ও চকরিয়ায়। যুদ্ধ শেষে দুটিই পরিত্যক্ত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার কক্সবাজার বিমানবন্দরের সংস্কার করে। স্বাধীন বাংলাদেশে, ১৯৭২ সালে কক্সবাজার বিমানবন্দর ব্যবহারের উপযোগী হয়। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি চারটি সংস্থা এই বিমানবন্দরে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এই বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার প্রক্রিয়া চলছে।
কক্সবাজারের যোগাযোগব্যবস্থা ও পর্যটন খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধন করতে পারে কক্সবাজার পর্যন্ত সম্প্রসারিত রেলযোগাযোগ। ১৯৩১ সালের দিকে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন স্থাপিত হলেও নানা কারণে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ ফাইলবন্দী হয়ে ছিল বহু বছর। ২০১১ সালে কক্সবাজার পর্যন্ত এ রেলপথ সম্প্রসারণের প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও সম্প্রতি এ প্রকল্পের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। আশা করা হচ্ছে, ২০২২ সালের শেষের দিকে এ রেলপথ দিয়ে রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে মানুষ কক্সবাজার আসতে পারবে। পরিকল্পকেরা আশা করছেন, এই রেলপথ কক্সবাজারেই শেষ হবে না। ভবিষ্যতে রেলপথটি কক্সবাজার থেকে একসময় চীন পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে। যদি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়, তবে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও পর্যটনের ক্ষেত্রে কক্সবাজার নতুন মাত্রা লাভ করবে।
কক্সবাজারের সমৃদ্ধির মুকুটে আরেকটি পালক হয়ে যুক্ত হয়েছে বানৌজা শেখ হাসিনা দেশের প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ ডুবোজাহাজ ঘাঁটি। কুতুবদিয়া চ্যানেলকে ঘিরে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এ ঘাঁটি স্থাপনের প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে কক্সবাজারের ভূমিকা নানামাত্রিক। এর বনের কাঠ, বিস্তৃত মাঠে উৎপাদিত বাগদা-গলদা ও লবণ, এর পর্যটনশিল্পসহ অন্যান্য উৎস থেকে জাতীয় তহবিলের ধমনিতে রক্ত সঞ্চালিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেশের অগ্রগতি কক্সবাজারের অগ্রগতির সমার্থক হয়ে উঠেছে বহুদিন ধরেই। দেশ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে কক্সবাজারের হাত ধরে। আর দেশের সমৃদ্ধির নানা চিহ্ন ধারণ করছে কক্সবাজার।
ইবরাহীম মুহাম্মদ
সহকারী অধ্যাপক, শহীদ জিয়া ডিএমআই ইনস্টিটিউট
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪