এম এম আকাশ
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মানুষ রাজপথে সমুদ্রের ঢলের মতো, উচ্ছ্বসিত তরঙ্গের মতো উল্লাস, নর্তনের এক উৎসবমুখর মহামিলনের মহোৎসবে যোগ দিয়েছিল। আমার বাবা ডা. মোকাদ্দেম আমার ছোট বোনকে কাঁধে তুলে নাচতে নাচতে ঘরের বাইরে চলে এসেছিলেন। এটা ছিল ৯ মাসের রুদ্ধদ্বার জেলখানায় মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গোনার পর, হঠাৎ ফটক ভেঙে বেরিয়ে আসার আনন্দোচ্ছল মুহূর্ত। অন্ধকারমুক্ত এক অবারিত আলোর বন্যা।
হানাদারদের তাড়ানোর গর্বে, মেশিনগানের বিরুদ্ধে জনতার লাঠি নিয়ে লড়াইয়ের দুঃসাহসী অভিযান শেষে সাফল্য অর্জনের গর্বে আমাদের বক্ষ স্ফীত হয়ে উঠেছিল। আমাদের পাশে ছিলেন বীর গেরিলা সন্তানেরা। ছিল মিত্রবাহিনী। ছিল হানাদার বাহিনীর মুষ্টিমেয় সহযোগী ছাড়া সমগ্র জনগণ।
আমি ১৬ বছরের বালক ছিলাম। যুদ্ধ শেষে আমাদের বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবারের বৃহৎ বাসাটিতে (সেন্ট্রাল রোডের ‘দারুল আফিয়া’, এখন যেটা ভেঙে আধুনিক একটি কমপ্লেক্স তৈরি হয়েছে) প্রথম পদার্পণ করি। যখন যুদ্ধ শেষে ফিরে মাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, তখন আমাদের উভয়ের চোখে ছিল আনন্দাশ্রু। সবাই আমাকে ঘিরে ধরেছিল। দেখছিল আমার কৃশ দেহ, আমার চোখে ‘জয় বাংলা’ অসুখের ছাপ (তখন চোখের একটি অসুখে প্রায় সব আগরতলাবাসী আক্রান্ত হয়েছিল এবং এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘জয় বাংলা’ চোখের অসুখ!), আমার চুল লম্বা, গালে দাড়ি গজিয়ে গেছে, যুদ্ধ শেষে ফেরত আসা এক সন্তানের স্বাভাবিক একটি রূপ। বাসায় আনন্দের পাশাপাশি দম আটকানো এক দুশ্চিন্তাও বিরাজ করছিল, কারণ এর দুই দিন আগে এই বাসা থেকেই বদর বাহিনীর সদস্যরা মুনীর চৌধুরীকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। পরে আমরা জেনেছি, অনেক শহীদ বুদ্ধিজীবীর মতো বিজয়ের শেষ মুহূর্তে তাঁকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
আজ ৫০ বছর পর যখন সেই স্মৃতি আমি রোমন্থন করতে বসেছি, তখন মনে হচ্ছে কোথায় যেন সব হারিয়ে যেতে বসেছে। স্মৃতিও ম্লান হয়ে গেছে, বুড়িগঙ্গায়ও অনেক পানি প্রবাহিত হয়েছে। আমাদের জাতি আজ এই মুহূর্তে অনেক মীমাংসিত বিষয়ে সম্পূর্ণ আড়াআড়িভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বিজয় মুহূর্তেও মহামিলনের সূত্রটি আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এমনকি আমাদের আত্মপরিচয় কী হবে, তাই-ই আবার প্রশ্নবিদ্ধ আকারে উঠে এসেছে। একদল মনে করে, আমাদের আত্মপরিচয় হওয়া উচিত ‘বাঙালি মুসলমান’। আরেক দল মনে করে, না, সেটা হওয়া উচিত ভাষাভিত্তিক পরিচয়, অর্থাৎ ‘বাঙালি’। অথচ আমরা কে বাঙালি কে বাংলাদেশি, তার চুলচেরা মীমাংসা না করেও দিব্যি কিন্তু জীবন চালিয়ে যাচ্ছি। যখন পাসপোর্ট বহন করে বিমানবন্দর ত্যাগ করি অথবা অন্য দেশে পাসপোর্ট নিয়ে ঘুরে বেড়াই, তখন পরিচয় জানতে চাইলে ‘পাসপোর্ট’ দলিলটিই আমরা দেখাই। কারোরই তাতে কোনো দ্বিমত থাকে না। তাতে আমাদের নাগরিক পরিচয় ‘বাংলাদেশিই’ লেখা থাকে এবং তখন সেটাই আমাদের পরিচয় হিসেবে প্রদর্শিত হয়।
কিন্তু অন্য সময়ে এটা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। অমর্ত্য সেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Identity and Violence দেখিয়েছেন, এক ব্যক্তি একই সঙ্গে বহু আত্মপরিচয় ধারণ করতে পারেন। একেক সময় একেকটি পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আত্মপরিচয়কে একপেশে বা সার্বভৌম একে পরিণত করলেই পরস্পর আমরা ‘পরিচয়ভিত্তিক’ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। তা সমাজে অকারণে কখনো কখনো সংঘর্ষ ও অশান্তি ডেকে আনে। চতুর রাজনীতিবিদেরা তখন তা স্বীয় স্বার্থে ব্যবহারও করেন।
এমনিতে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখুন, যখন দেশের ভেতরে শুক্রবার একজন বাংলাদেশি নাগরিক মসজিদে নামাজ পড়তে যান, তখন নামাজ শেষে বাংলা ভাষাতেই সবাই সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। তখন তাঁকে একজন ‘মুসলমান বাঙালি’ মনে করা হয়। আবার কোনো ‘বাংলাদেশি হিন্দু’ যখন মন্দিরে যান, পূজা দিয়ে বের হয়ে বাংলায় কুশল বিনিময় করেন (নিশ্চয় তিনি যেমন তখন সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করেন না, তেমনি এটাও সত্য যে, মুসলমান বাংলাদেশিরাও নামাজ শেষে আরবি ভাষা ব্যবহার করে কুশল বিনিময় করেন না!), তখন তাকে ‘বাঙালি হিন্দুই’ ভাবা হয়।
আবার ধরুন, যখন পয়লা বৈশাখে বাংলার হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই একসঙ্গে শিশুদের নিয়ে ঢাকার চারুকলা অনুষদ থেকে শুরু হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রায় যোগ দেন বা গ্রামে যখন হালখাতা খোলা হয় বা বাংলা নববর্ষ উদ্যাপিত হয়, তখন আমরা সহজেই বুঝতে পারি জাতি হিসেবে আমরা সবাই ধর্মনির্বিশেষে ‘বাঙালি’ এবং আমরা সবাই ‘বাংলারই (বাংলাদেশের) জয় চাই, ‘পরাজয়’ নয়। কিন্তু এভাবে কি উদারভাবে আমরা চিন্তা করতে পারছি?
কজন বাঙালি, ভারতের অথবা বাংলাদেশের নাগরিক, যখন বাংলাদেশ বনাম ভারতীয় ক্রিকেট ম্যাচটি দেখেন, তখন সেই বাঙালি বাংলাদেশের সমর্থক হতে পারেন আবার ভারতেরও সমর্থক হতে পারেন। তিনি হয়তো ভারতীয় বাঙালি হয়েও বাংলাদেশি টিমের সমর্থক হতে পারেন আবার একজন বাংলাদেশি বাঙালি সাকিবের সমর্থক না হয়ে সৌরভের সমর্থক হতে পারেন। এসব উদার বহুত্ববাদী ধারণা অবশ্য একটি সমাজে এক দিনে গড়ে ওঠে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কিন্তু সর্বোচ্চ উদারতা নিয়ে বহু আগেই এভাবে ভাবতে পেরেছিলেন যে তিনি যেমন একদিকে বাঙালি ছিলেন, তেমনি মুসলমানও ছিলেন। আবার তিনি এটাও বলেছিলেন যে তিনি ‘মানুষও’ ছিলেন। বস্তুত ‘মানুষ’ না হলে আমরা কিন্তু কোনোটাই হতে পারব না। আমাদের কবিগুরু যথার্থই বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালী করে মানুষ করনি’। আজও আমাদের মানুষ হওয়ার সাধনা শেষ হয়নি।
এই ৫০ বছরে আমরা জাতিকে আত্মপরিচয়ের সংকটে বিদীর্ণ করে বিভক্ত করে ফেলেছি—শুধু এটুকু পূর্ণাঙ্গ সত্য নয়। পাশাপাশি এ কথাও সত্য যে আমাদের অনেক সমৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, আমাদের দেশ আর হতদরিদ্র দেশ নেই। আমাদের দেশ আজ সমগ্র পৃথিবীতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আমরা প্রমাণ করেছি, আমরা তলাবিহীন ঝুড়ি নই। আমরা বিদেশি সাহায্য ছাড়াই পদ্মা সেতুকে দৃশ্যমান করেছি। পরিণত হয়েছি বিশ্ব–নির্ধারিত সংজ্ঞানুসারে ‘নিম্ন–মধ্য আয়ের দেশে’। আমাদের দেশে দুর্ভিক্ষ সম্ভবত আর হবে না, এটাই আন্তরিকভাবে প্রত্যাশা করি, যদিও হয়তো ‘সুপ্ত ক্ষুধা’ এখনো বজায় আছে। আমাদের কৃষকেরা সোনার বাংলায় অজস্র বহুমুখী সোনার ফসল ফলিয়েছেন এ কথা তো সত্য। আমাদের নারী শ্রমিকেরা পোশাকশিল্পে বিপ্লব সাধন করেছেন, এ কথাও সত্য। আমাদের প্রবাসীরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা জুগিয়ে আমাদের ‘বিদেশি সাহায্য ও পরনির্ভরতার’ গ্লানি থেকে মুক্ত করেছেন, এও সত্য। আমাদের গ্রামীণ দরিদ্র মানুষ অত্যন্ত উচ্চ হারে তথা ২৪ থেকে ৩০ শতাংশ সুদে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে তার ৯৮ থেকে ১০০ শতাংশ সময়মতো শোধ করে খেলাপি না হওয়ার অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, কিছুটা দারিদ্র্যমুক্তও হয়েছেন। তবে এসব শ্রমজীবী মানুষের সবার প্রতি আমরা কি ন্যায়বিচার করতে পেরেছিলাম? যাঁদের জন্য আমাদের এই অর্জন, তাঁদের জন্য আমরা কী করেছি? আজ এই সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের সবাইকে এই আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হতে হবে। আমরা মধ্য ও উচ্চবিত্তরা স্বাধীনতার পর যতটা ওপরে উঠতে পেরেছি, ততটা কি এই শ্রমজীবীরা পেরেছেন? অর্থনীতিতে তাঁদের যতটুকু অবদান, ততটুকু হিস্যা কি তাঁদের বরাতে জুটেছে?
‘ন্যায়বিচার’ সহজ কোনো বিষয় নয়। এখানে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের প্রয়োজন হয়। গ্রিস দেবী থেমিটিসের মতো চোখ বন্ধ করে ‘পক্ষপাতশূন্য অন্ধতার’ প্রয়োজন হয়। আমরা যারা এযাবৎ দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছি, শাসন করেছি, শাসক দল ও তার অনুগ্রহপুষ্ট হিসেবে জীবনযাপন করে এসেছি, তারা কি এই কঠিন বৈশিষ্ট্য ঠিকভাবে ধারণ করেছি? করতে পেরেছি? স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে শুধু অতীত কৃতিত্বের স্মৃতি রোমন্থন না করে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জের কথাও তুলে ধরা উচিত সততার সঙ্গে। অর্ধসত্য নয়, সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ নয় এবং মিথ্যা তো নয়ই। যদিও সারা পৃথিবী এখন ‘সত্য-উত্তর’ যুগে পদার্পণ করেছে। অক্সফোর্ড অভিধানেই ২০১৬ সালে সত্য-উত্তর সমাজের এই শব্দ ‘অফিশিয়ালি’ গৃহীত হয়েছে এবং উদাহরণ হিসেবে বিশেষভাবে Populist বা জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিবিদদের নাম তুলে ধরা হয়েছে, যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদি। তাঁরা জনপ্রিয় বিশাল ভোট পান, কিন্তু আবার জনতাকে মিথ্যা বলতেও কসুর করেন না, যদি তা স্বার্থের জন্য ফলপ্রসূ হয় বা নিজের অবস্থানকে শক্ত করে। এ ধরনের সত্য-উত্তর সমাজের জন্য কিন্তু আমরা সংগ্রাম করিনি। আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম সমতা, ন্যায়বিচার, শোষণহীন সমাজ ও গণতন্ত্র কায়েমের জন্য। শুধু বস্তুগত সমৃদ্ধির জন্য নয়। আসুন আজ এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই—আমরা আবার মানুষ হই এবং পূর্বপুরুষের ঋণ পরিশোধ করে তাদের এই মহৎ স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নের জন্য সচেষ্ট হই। স্মৃতিকাতর হয়ে সবার প্রতি এটুকুই আমার সেন্টিমেন্টাল আবেদন।
এম এম আকাশ
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মানুষ রাজপথে সমুদ্রের ঢলের মতো, উচ্ছ্বসিত তরঙ্গের মতো উল্লাস, নর্তনের এক উৎসবমুখর মহামিলনের মহোৎসবে যোগ দিয়েছিল। আমার বাবা ডা. মোকাদ্দেম আমার ছোট বোনকে কাঁধে তুলে নাচতে নাচতে ঘরের বাইরে চলে এসেছিলেন। এটা ছিল ৯ মাসের রুদ্ধদ্বার জেলখানায় মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গোনার পর, হঠাৎ ফটক ভেঙে বেরিয়ে আসার আনন্দোচ্ছল মুহূর্ত। অন্ধকারমুক্ত এক অবারিত আলোর বন্যা।
হানাদারদের তাড়ানোর গর্বে, মেশিনগানের বিরুদ্ধে জনতার লাঠি নিয়ে লড়াইয়ের দুঃসাহসী অভিযান শেষে সাফল্য অর্জনের গর্বে আমাদের বক্ষ স্ফীত হয়ে উঠেছিল। আমাদের পাশে ছিলেন বীর গেরিলা সন্তানেরা। ছিল মিত্রবাহিনী। ছিল হানাদার বাহিনীর মুষ্টিমেয় সহযোগী ছাড়া সমগ্র জনগণ।
আমি ১৬ বছরের বালক ছিলাম। যুদ্ধ শেষে আমাদের বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবারের বৃহৎ বাসাটিতে (সেন্ট্রাল রোডের ‘দারুল আফিয়া’, এখন যেটা ভেঙে আধুনিক একটি কমপ্লেক্স তৈরি হয়েছে) প্রথম পদার্পণ করি। যখন যুদ্ধ শেষে ফিরে মাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, তখন আমাদের উভয়ের চোখে ছিল আনন্দাশ্রু। সবাই আমাকে ঘিরে ধরেছিল। দেখছিল আমার কৃশ দেহ, আমার চোখে ‘জয় বাংলা’ অসুখের ছাপ (তখন চোখের একটি অসুখে প্রায় সব আগরতলাবাসী আক্রান্ত হয়েছিল এবং এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘জয় বাংলা’ চোখের অসুখ!), আমার চুল লম্বা, গালে দাড়ি গজিয়ে গেছে, যুদ্ধ শেষে ফেরত আসা এক সন্তানের স্বাভাবিক একটি রূপ। বাসায় আনন্দের পাশাপাশি দম আটকানো এক দুশ্চিন্তাও বিরাজ করছিল, কারণ এর দুই দিন আগে এই বাসা থেকেই বদর বাহিনীর সদস্যরা মুনীর চৌধুরীকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। পরে আমরা জেনেছি, অনেক শহীদ বুদ্ধিজীবীর মতো বিজয়ের শেষ মুহূর্তে তাঁকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
আজ ৫০ বছর পর যখন সেই স্মৃতি আমি রোমন্থন করতে বসেছি, তখন মনে হচ্ছে কোথায় যেন সব হারিয়ে যেতে বসেছে। স্মৃতিও ম্লান হয়ে গেছে, বুড়িগঙ্গায়ও অনেক পানি প্রবাহিত হয়েছে। আমাদের জাতি আজ এই মুহূর্তে অনেক মীমাংসিত বিষয়ে সম্পূর্ণ আড়াআড়িভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বিজয় মুহূর্তেও মহামিলনের সূত্রটি আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এমনকি আমাদের আত্মপরিচয় কী হবে, তাই-ই আবার প্রশ্নবিদ্ধ আকারে উঠে এসেছে। একদল মনে করে, আমাদের আত্মপরিচয় হওয়া উচিত ‘বাঙালি মুসলমান’। আরেক দল মনে করে, না, সেটা হওয়া উচিত ভাষাভিত্তিক পরিচয়, অর্থাৎ ‘বাঙালি’। অথচ আমরা কে বাঙালি কে বাংলাদেশি, তার চুলচেরা মীমাংসা না করেও দিব্যি কিন্তু জীবন চালিয়ে যাচ্ছি। যখন পাসপোর্ট বহন করে বিমানবন্দর ত্যাগ করি অথবা অন্য দেশে পাসপোর্ট নিয়ে ঘুরে বেড়াই, তখন পরিচয় জানতে চাইলে ‘পাসপোর্ট’ দলিলটিই আমরা দেখাই। কারোরই তাতে কোনো দ্বিমত থাকে না। তাতে আমাদের নাগরিক পরিচয় ‘বাংলাদেশিই’ লেখা থাকে এবং তখন সেটাই আমাদের পরিচয় হিসেবে প্রদর্শিত হয়।
কিন্তু অন্য সময়ে এটা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। অমর্ত্য সেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Identity and Violence দেখিয়েছেন, এক ব্যক্তি একই সঙ্গে বহু আত্মপরিচয় ধারণ করতে পারেন। একেক সময় একেকটি পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আত্মপরিচয়কে একপেশে বা সার্বভৌম একে পরিণত করলেই পরস্পর আমরা ‘পরিচয়ভিত্তিক’ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। তা সমাজে অকারণে কখনো কখনো সংঘর্ষ ও অশান্তি ডেকে আনে। চতুর রাজনীতিবিদেরা তখন তা স্বীয় স্বার্থে ব্যবহারও করেন।
এমনিতে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখুন, যখন দেশের ভেতরে শুক্রবার একজন বাংলাদেশি নাগরিক মসজিদে নামাজ পড়তে যান, তখন নামাজ শেষে বাংলা ভাষাতেই সবাই সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। তখন তাঁকে একজন ‘মুসলমান বাঙালি’ মনে করা হয়। আবার কোনো ‘বাংলাদেশি হিন্দু’ যখন মন্দিরে যান, পূজা দিয়ে বের হয়ে বাংলায় কুশল বিনিময় করেন (নিশ্চয় তিনি যেমন তখন সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করেন না, তেমনি এটাও সত্য যে, মুসলমান বাংলাদেশিরাও নামাজ শেষে আরবি ভাষা ব্যবহার করে কুশল বিনিময় করেন না!), তখন তাকে ‘বাঙালি হিন্দুই’ ভাবা হয়।
আবার ধরুন, যখন পয়লা বৈশাখে বাংলার হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই একসঙ্গে শিশুদের নিয়ে ঢাকার চারুকলা অনুষদ থেকে শুরু হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রায় যোগ দেন বা গ্রামে যখন হালখাতা খোলা হয় বা বাংলা নববর্ষ উদ্যাপিত হয়, তখন আমরা সহজেই বুঝতে পারি জাতি হিসেবে আমরা সবাই ধর্মনির্বিশেষে ‘বাঙালি’ এবং আমরা সবাই ‘বাংলারই (বাংলাদেশের) জয় চাই, ‘পরাজয়’ নয়। কিন্তু এভাবে কি উদারভাবে আমরা চিন্তা করতে পারছি?
কজন বাঙালি, ভারতের অথবা বাংলাদেশের নাগরিক, যখন বাংলাদেশ বনাম ভারতীয় ক্রিকেট ম্যাচটি দেখেন, তখন সেই বাঙালি বাংলাদেশের সমর্থক হতে পারেন আবার ভারতেরও সমর্থক হতে পারেন। তিনি হয়তো ভারতীয় বাঙালি হয়েও বাংলাদেশি টিমের সমর্থক হতে পারেন আবার একজন বাংলাদেশি বাঙালি সাকিবের সমর্থক না হয়ে সৌরভের সমর্থক হতে পারেন। এসব উদার বহুত্ববাদী ধারণা অবশ্য একটি সমাজে এক দিনে গড়ে ওঠে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কিন্তু সর্বোচ্চ উদারতা নিয়ে বহু আগেই এভাবে ভাবতে পেরেছিলেন যে তিনি যেমন একদিকে বাঙালি ছিলেন, তেমনি মুসলমানও ছিলেন। আবার তিনি এটাও বলেছিলেন যে তিনি ‘মানুষও’ ছিলেন। বস্তুত ‘মানুষ’ না হলে আমরা কিন্তু কোনোটাই হতে পারব না। আমাদের কবিগুরু যথার্থই বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালী করে মানুষ করনি’। আজও আমাদের মানুষ হওয়ার সাধনা শেষ হয়নি।
এই ৫০ বছরে আমরা জাতিকে আত্মপরিচয়ের সংকটে বিদীর্ণ করে বিভক্ত করে ফেলেছি—শুধু এটুকু পূর্ণাঙ্গ সত্য নয়। পাশাপাশি এ কথাও সত্য যে আমাদের অনেক সমৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, আমাদের দেশ আর হতদরিদ্র দেশ নেই। আমাদের দেশ আজ সমগ্র পৃথিবীতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আমরা প্রমাণ করেছি, আমরা তলাবিহীন ঝুড়ি নই। আমরা বিদেশি সাহায্য ছাড়াই পদ্মা সেতুকে দৃশ্যমান করেছি। পরিণত হয়েছি বিশ্ব–নির্ধারিত সংজ্ঞানুসারে ‘নিম্ন–মধ্য আয়ের দেশে’। আমাদের দেশে দুর্ভিক্ষ সম্ভবত আর হবে না, এটাই আন্তরিকভাবে প্রত্যাশা করি, যদিও হয়তো ‘সুপ্ত ক্ষুধা’ এখনো বজায় আছে। আমাদের কৃষকেরা সোনার বাংলায় অজস্র বহুমুখী সোনার ফসল ফলিয়েছেন এ কথা তো সত্য। আমাদের নারী শ্রমিকেরা পোশাকশিল্পে বিপ্লব সাধন করেছেন, এ কথাও সত্য। আমাদের প্রবাসীরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা জুগিয়ে আমাদের ‘বিদেশি সাহায্য ও পরনির্ভরতার’ গ্লানি থেকে মুক্ত করেছেন, এও সত্য। আমাদের গ্রামীণ দরিদ্র মানুষ অত্যন্ত উচ্চ হারে তথা ২৪ থেকে ৩০ শতাংশ সুদে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে তার ৯৮ থেকে ১০০ শতাংশ সময়মতো শোধ করে খেলাপি না হওয়ার অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, কিছুটা দারিদ্র্যমুক্তও হয়েছেন। তবে এসব শ্রমজীবী মানুষের সবার প্রতি আমরা কি ন্যায়বিচার করতে পেরেছিলাম? যাঁদের জন্য আমাদের এই অর্জন, তাঁদের জন্য আমরা কী করেছি? আজ এই সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের সবাইকে এই আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হতে হবে। আমরা মধ্য ও উচ্চবিত্তরা স্বাধীনতার পর যতটা ওপরে উঠতে পেরেছি, ততটা কি এই শ্রমজীবীরা পেরেছেন? অর্থনীতিতে তাঁদের যতটুকু অবদান, ততটুকু হিস্যা কি তাঁদের বরাতে জুটেছে?
‘ন্যায়বিচার’ সহজ কোনো বিষয় নয়। এখানে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের প্রয়োজন হয়। গ্রিস দেবী থেমিটিসের মতো চোখ বন্ধ করে ‘পক্ষপাতশূন্য অন্ধতার’ প্রয়োজন হয়। আমরা যারা এযাবৎ দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছি, শাসন করেছি, শাসক দল ও তার অনুগ্রহপুষ্ট হিসেবে জীবনযাপন করে এসেছি, তারা কি এই কঠিন বৈশিষ্ট্য ঠিকভাবে ধারণ করেছি? করতে পেরেছি? স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে শুধু অতীত কৃতিত্বের স্মৃতি রোমন্থন না করে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জের কথাও তুলে ধরা উচিত সততার সঙ্গে। অর্ধসত্য নয়, সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ নয় এবং মিথ্যা তো নয়ই। যদিও সারা পৃথিবী এখন ‘সত্য-উত্তর’ যুগে পদার্পণ করেছে। অক্সফোর্ড অভিধানেই ২০১৬ সালে সত্য-উত্তর সমাজের এই শব্দ ‘অফিশিয়ালি’ গৃহীত হয়েছে এবং উদাহরণ হিসেবে বিশেষভাবে Populist বা জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিবিদদের নাম তুলে ধরা হয়েছে, যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদি। তাঁরা জনপ্রিয় বিশাল ভোট পান, কিন্তু আবার জনতাকে মিথ্যা বলতেও কসুর করেন না, যদি তা স্বার্থের জন্য ফলপ্রসূ হয় বা নিজের অবস্থানকে শক্ত করে। এ ধরনের সত্য-উত্তর সমাজের জন্য কিন্তু আমরা সংগ্রাম করিনি। আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম সমতা, ন্যায়বিচার, শোষণহীন সমাজ ও গণতন্ত্র কায়েমের জন্য। শুধু বস্তুগত সমৃদ্ধির জন্য নয়। আসুন আজ এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই—আমরা আবার মানুষ হই এবং পূর্বপুরুষের ঋণ পরিশোধ করে তাদের এই মহৎ স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নের জন্য সচেষ্ট হই। স্মৃতিকাতর হয়ে সবার প্রতি এটুকুই আমার সেন্টিমেন্টাল আবেদন।
এম এম আকাশ
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪