ড. আতিউর রহমান
কোভিড-১৯ ভাইরাস সারা বিশ্বকেই টালমাটাল করে রেখেছে। এমন দীর্ঘস্থায়ী সর্বব্যাপী সংকটে আমাদের এই চেনা পৃথিবী আগে কখনো পড়েনি। এমনকি দুই দুটো বিশ্বযুদ্ধেও বিশ্ববাসীকে এতটা অসহায় বোধ করতে দেখা যায়নি। এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে এই অদৃশ্য শত্রু হানা দেয়নি। বিজ্ঞানের অসামান্য উন্নতির কারণেই দ্রুতই এই সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য টিকা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু জাতীয় স্বার্থকে বেশি করে দেখতে গিয়ে উন্নত দেশগুলো এই টিকার সরবরাহ সবার জন্য উন্মুক্ত করে উঠতে পারেনি। তাই বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। একদল তাদের প্রয়োজনের চেয়েও বেশি টিকা মজুত করে রেখেছে, আরেক দল পর্যাপ্ত টিকা টাকা দিয়েও সংগ্রহ করতে পারছে না। এমন বাস্তবতায় উন্নত সাত দেশের সংস্থা জি-৭ ঘোষণা করেছে যে তারা গরিব দেশগুলোর জন্য ১০০ কোটি ডোজ টিকার ব্যবস্থা করবে। তবে কবে করবে, কীভাবে করবে–সেসব এখনো পরিষ্কার নয়। তাই আইএমএফপ্রধান বলেছেন, সারা বিশ্বের বেশির ভাগ নাগরিককেই যদি আগামী বছরের মধ্যে এই টিকা না দেওয়া যায় তাহলে করোনাসংকট থেকে মুক্তির আশা বেশ ক্ষীণ। সে কারণেই তিনি বলেছেন, এই মুহূর্তে সব দেশে টিকা দেওয়ার নীতিটিই আসলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার নীতি। জানি না কবে করোনা এ বিশ্বকে রেহাই দেবে। তবে সবার প্রচেষ্টায় যদি বিশ্ববাসী এই অভাবনীয় সংকট থেকে বের হয়ে আসতেও পারে, তাহলেও আগামীর পৃথিবী আর আজকের পৃথিবীর মতো হবে না। শুধু অর্থনীতি নয়; সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি পুরোপুরিই বদলে যাবে। বদলে যাবে মানুষের জীবন চলার ধরন। বদলাবে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, বিনোদন, পর্যটন ও মানবিক সম্পর্কগুলোও। অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ জেঁকে বসবে বিশ্বজুড়েই। প্রযুক্তির প্রসার ঘটবে দ্রুতলয়ে। জীবন ও জীবিকার ধরনও পাল্টাবে এসব পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বোঝাপড়াও বদলে যাবে।
সেই বদলে যাওয়া বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান কেমন হবে? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মোটেও সহজ নয়। করোনার মতিগতি কেমন হবে তার ওপরই নির্ভর করবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থান, তখন কেমন হবে? বর্তমানে পরিস্থিতি বেশ অনিশ্চিত। এক দিকে টিকা সংগ্রহ করা যাচ্ছে না, অন্যদিকে মানুষ খুবই অসচেতন। কিছুতেই তারা স্বাস্থ্যবিধি মানতে চাইছে না। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে নতুন ধরনের করোনাভাইরাস যেভাবে আঘাত হেনেছে, তার প্রভাব শুধু স্থানীয় অর্থনীতির ওপরই পড়বে–এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। এই সংক্রমণ একপর্যায়ে রাজধানী ও তার আশপাশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে আছড়ে পড়লে তার পরিণতি ভালো হবে না। কেননা, তরুণ শ্রমজীবী সবাইকে আমরা টিকা দিতে পারিনি। তবে তাঁরা সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন। মাস্ক পরছেন। কিন্তু কারখানায় স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলেও তাঁরা যেখানে থাকেন, সেখানে তা সম্ভব হচ্ছে না। তাই ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। এমনি এক অনিশ্চিত পরিবেশে আমাদের করোনা-উত্তর বাংলাদেশের কথা ভাবতে হচ্ছে।
ধরে নিচ্ছি, এই সংকট কেটে যাবে। বাংলাদেশ ফের তার পুরোনো লয় খুঁজে পাবে। জীবন ও জীবিকা–দুই–ই সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। তা–ই যেন হয়। তবুও নয়া পৃথিবীর সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে বেশ খানিকটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি যে বাংলাদেশকে হতে হবে তা তো বলাই বাহুল্য। অবশ্য, সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের যে অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেটিই শেষ পর্যন্ত তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল সীমাহীন দুঃখ ও বেদনার মধ্য দিয়ে। একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন যিনি, সেই জাতির পিতা পাকিস্তানি কারাগারে। অথচ তাঁরই নেতৃত্বে চলছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচারে এক কোটির মতো মানুষ শরণার্থী। দেশের তরুণ-তরুণীরা জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছে। সে বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগও ছিল প্রবল। প্রাকৃতিক ও মানুষের তৈরি দুর্যোগ মোকাবিলা করেই বাঙালি মরণপণ লড়াইয়ে নেমেছিল মুক্তির অন্বেষায়। তাদের মনে লড়াই করার মতো মণ উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন জাতির পিতা। তাঁর সহনেতারা দেশবাসীকে তাঁরই নামে ঐক্যবদ্ধ করে এক সাগর রক্ত পাড়ি দিয়ে স্বাধীন করেছিলেন বাংলাদেশকে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর অকুণ্ঠ সমর্থন এবং ওই দেশের সেনাবাহিনী ও জনগণের সমর্থনে অতি অল্প সময়েই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল। এর পরের সংগ্রাম দেশ গড়ার। সেই যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন জাতির পিতা স্বয়ং। ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি সদ্য স্বাধীন দেশকে কী করে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু সে এক অনন্য কাহিনি। দারিদ্র্য, ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ, অন্তর্ঘাত, ঝড়-বৃষ্টি এবং বিভ্রান্ত তারুণ্যের অসহিষ্ণুতা–সবকিছু মোকাবিলা করেই বঙ্গবন্ধু একটি সুপরিকল্পিত অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কৌশল গ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশের জন্য। মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামোসমূহ পুনর্নির্মাণ, এক কোটি শরণার্থীদের পুনর্বাসন, প্রাদেশিক একটি সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকারে উন্নীতকরণ এবং বিপুল খাদ্যঘাটতি মোকাবিলার মতো চ্যালেঞ্জ সামলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানুষের গড় মাথাপিছু আয় মাত্র ৯৩ ডলার থেকে ২৭৩ ডলারে উন্নীত করেছিলেন। কৃষিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে, শিল্পকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় (ব্যক্তিমালিকানা ও সমবায় মালিকানার পথ খোলা রেখে) নিয়ে তিনি দ্রুতই অর্থনীতিকে সচল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শুরুতেই তিনি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানো এবং প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করার মতো সুদূরপ্রসারী নীতি গ্রহণ করেছিলেন। রাষ্ট্রের সক্ষমতা তখনো যথেষ্ট অর্জিত হয়নি। বিদেশি সাহায্য-নির্ভর কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নে তাই বেসরকারি উদ্যোগকে অংশীদার করতে তিনি দ্বিধা করেননি। এমনকি এসব সামাজিক উদ্যোক্তাদের (ডা. জাফরুল্লাহসহ আরও অনেকেই) জমি ও নীতি সমর্থন দিতেও কার্পণ্য করেননি। তাই শুরুর দিনগুলোতে জনস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণসহ সামাজিক উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ থেকে উৎসারিত এসব উন্নয়ন উদ্যোক্তারা যথেষ্ট স্বাধীনতা ও নীতি-সমর্থন ভোগ করেছেন। ফলে কম খরচে মানব উন্নয়নের নানা উদ্যোগ সরকারের পক্ষে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। অংশীদারিমূলক সেই উন্নয়নের ধারা বাংলাদেশে আজও বহমান।
দেশ যখন বিপর্যয় কাটিয়ে সুস্থিতির দিকে এগোচ্ছিল, ঠিক তখনই স্বাধীনতাবিরোধী চক্র মরণ ছোবল হানে বাঙালির জাতির পিতা ও তাঁর সহনেতাদের ওপর। পঁচাত্তরের সেই ট্র্যাজেডির ধাক্কায় বাংলাদেশ হাঁটতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উল্টো দিকে। দীর্ঘ ১৩ বছর লেগেছিল বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া ২৭৩ ডলারের মাথাপিছু আয়ে পুনরায় পৌঁছাতে। এরপরেও দেশ চলছিল ঢিমেতালে। বঙ্গবন্ধুকন্যা ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত সরকার গঠন করে দেশকে ফিরিয়ে আনেন মুক্তিযুদ্ধের পথে। ১৯৯৮–এর বন্যা মোকাবিলার সময় তিনি দেখিয়ে দেন সংকটকালেও কী করে সামাজিক সক্রিয়তা বজায় রেখে দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব।
একজন মানুষকেও অনাহারে মরতে দেননি তিনি ওই দুর্যোগকালে। শুরু করেন বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, মুক্তিযোদ্ধাভাতার মতো সুদূরপ্রসারী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসমূহ। এগুলো এখন আরও বিস্তৃত ও গভীরতর করা হয়েছে। দুর্ভাগ্য আমাদের। ২০০১ সালে ফের ষড়যন্ত্রের শিকার হলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। এর পরের বছরগুলো বাংলাদেশ কেমন ছিল তা আর না–ইবা বললাম। অনেক সংগ্রাম, ত্যাগ–তিতিক্ষার পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে দিন বদলের ‘সনদ’–এর অঙ্গীকার করে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন বঙ্গবন্ধুকন্যা। ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েই তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজে নেমে পড়েন। আজও সমান গতিতেই এগিয়ে চলেছেন তিনি উন্নয়নের ঝান্ডা হাতে নিয়ে। বিগত ১২ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়নসূচকে যে উল্লম্ফন ঘটেছে, তা বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে।
১৯৭৫–এর পর বাংলাদেশের আজ অবধি মাথাপিছু আয় সাত গুণের বেশি বেড়েছে। এর ৭৩ শতাংশই বেড়েছে গত এক যুগে। এই এক যুগে তা বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। পঁচাত্তর থেকে এখন অবধি প্রবাসী আয় বেড়েছে ২৮৫ গুণ। রপ্তানি বেড়েছে ১৩৩ গুণ। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তৈরি পোশাক খাত। গত ১২ বছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে প্রায় সাত গুণ। এ সময় মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল থেকেছে। ম্যাক্রো অর্থনীতির ভিত্তি দারুণ শক্তিশালী এখন। এ সবই সম্ভব হয়েছে আমাদের উপযুক্ত ম্যাক্রো অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহণের জন্য। আরও সাহায্য করছে তরুণ জনগোষ্ঠী। এরই অংশ অধিক হারে নারীর আনুষ্ঠানিক কর্মে অংশগ্রহণ। সরকার ও আর্থিক খাতে ব্যাপক ডিজিটাইজেশনও খুব সহায়ক হয়েছে। সরকারের ধারাবাহিকতার কারণে পদ্মা সেতুর মতো বড় বড় অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে। এসব অবকাঠামো আগামীর বাংলাদেশের চেহারাই বদলে দেবে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের এই গতিময়তার পাশাপাশি আমাদের সামাজিক সূচকগুলোতেও দারুণ অগ্রগতি লক্ষ করা গেছে। আমাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রিত বলে দম্পতি প্রতি সন্তানের সংখ্যা এখন ২ দশমিক ১–এ দাঁড়িয়েছে। বাহাত্তরের তা ছিল ৬–এরও বেশি। এখন আমাদের জীবনের আয়ু ৭৩ বছর। বাহাত্তরে তা ছিল ৪৭ বছর। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার উন্নয়নশীল দেশসমূহের অর্ধেক। সব শিশুকে আমরা টিকা দেওয়ার অবকাঠামো গড়ে তুলেছি। খাবার স্যালাইন, পুষ্টি শিক্ষা, স্যানিটেশন, সন্তান পালনসহ সামাজিক সচেতনতা বিস্ময়করভাবে বেড়েছে। কোভিড আসার আগে দারিদ্র্য কমে ২০ শতাংশে পৌঁছেছিল। মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশের মধ্যেই আছে। খাদ্য উৎপাদন ৫০ বছরে চার গুণ বেড়েছে। মাছ, সবজি, মাংস, ফল– উৎপাদনে আমরা প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। শিক্ষার পরিমাণ বেড়েছে। গুণমান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যের বিস্তার ঘটেছে। মধ্যম ও টারশিয়ারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় আরও যথেষ্ট নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
আমাদের এ অসামান্য অর্জনের পেছনে নিঃসন্দেহে নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল প্রবল। বঙ্গবন্ধু যেমনটি চেয়েছিলেন ঠিক সেরকম বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তাঁর নেতৃত্বে এগিয়ে চলা বাংলাদেশকে অনেকেই ‘রানিং বল’ বা ‘প্যারাগন অব ডেভেলপমেন্ট’ বলছেন। কেউ কেউ আবার তাকে মিরাকলও বলতে চাইছেন। আমি বলি এ অর্জন ‘বিরল’। আমাদের পরিশ্রমী উদ্যোক্তা মানুষ ও সুদৃঢ় নেতৃত্বের অর্জন। ]
অর্জনের এই শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই আমরা করোনা-উত্তর বাংলাদেশকে যেমনটি দেখতে চাই তা সংক্ষেপে উল্লেখ করছি:
এক. আগামীর বাংলাদেশ হবে পুরোপুরি ডিজিটাল। ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সবকিছুই হবে প্রযুক্তি-নির্ভর। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা এই আধুনিক বাংলাদেশের শুভসূচনা করেছি এক যুগ আগেই।
দুই. আগামীর বাংলাদেশ হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং খুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাবান্ধব। উদ্ভাবনই হবে মূল কথা। অর্থনীতির পিরামিডের ভিত্তিটি শক্ত করেই আমরা আমাদের ম্যাক্রো অর্থনীতিকে স্থিতিশীল ও টেকসই রাখব।
তিন. রাষ্ট্র শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করব। আর সেই পরিবেশে ব্যক্তি খাত অন্তর্ভুক্তিমূলক সবুজ অর্থনৈতিক রূপান্তরে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
চার. আমরা উচ্চশিক্ষাকে শিল্প তথা চতুর্থ শিল্প–বিপ্লবের সহযোগী করে ঢেলে সাজাতে চাই। শিল্পের চাহিদামতো জনশক্তি তৈরি করবে উচ্চ শিক্ষালয়।
পাঁচ. কৃষির আধুনিকায়ন এবং যন্ত্রায়ণের যে নীতি সমর্থন দিয়ে চলেছে বর্তমান সরকার, তা আরও বেগবান করার কোনো বিকল্প নেই।
ছয়. আমাদের গ্রামগুলোকেও শহরের সুবিধা দেব। তবে নগরায়ণকে হতে হবে স্মার্ট ও মানুষের বসবাসযোগ্য।
সাত. স্থানীয়, উপ-আঞ্চলিক ও আঞ্চলিক সরবরাহ চেইনগুলোকে সমন্বিত করে আমরা আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যকে আরও প্রসারিত করতে কানেকটিভিটির ওপর বেশি জোর দিতে চাই।
আট. আমাদের নিজস্ব সম্পদ বাড়াতে এনবিআরের সংস্কার করতে হবে। তার সক্ষমতা বাড়িয়ে কর-জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে তার দ্বিগুণ করতে আগ্রহী আমরা।
নয়. এ সবকিছুই সম্ভব যদি আমরা শাসনব্যবস্থার উন্নতি করে সামাজিক সুবিচার ও প্রবৃদ্ধিতে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারি। সে জন্য সর্বত্র জবাবদিহি ও অপচয়বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা খুবই জরুরি। ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং সামাজিক সক্রিয়তা বাড়িয়ে আমরা কাঙ্ক্ষিত এই গভর্নেন্সের মান নিশ্চয় উন্নত করতে পারি।
দশ. আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য খুব সহজে করা যায় না। পদে পদে বাধা। আর রয়েছে অযথা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। তাই নিয়মনীতি সহজ করে ‘ওয়ান–স্টপ সার্ভিস’সুবিধা আরও বাড়াতে আমাদের উদ্যোগী হতে হবে।
এগারো. প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। আয়ের বৈষম্যও বাড়ছে। তাই প্রগতিশীল চালু করে করব্যবস্থা এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিধি বাড়িয়ে আয়বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। ভোগবৈষম্য এখনো তীব্র নয়। এই সূচককে স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
বারো. প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়াটি অবশ্য সবুজ হতে হবে। সবুজ বিদ্যুতের প্রসার ঘটাতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী ‘গ্রিনহাউস গ্যাস’ উৎপাদনের উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে আরও জলবায়ুবান্ধব করে গড়ে তুলতে হবে।
চলমান করোনাসংকট সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করে আমরা এমন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার চাই, যাতে বাংলাদেশের এত দিনের অর্জন আমরা ধরে রাখতে পারি। একই সঙ্গে আমাদের উন্নয়নের মহাসড়ককে আরও মসৃণ ও সবুজ হোক, সেই প্রত্যাশাই করছি। এ সবকিছুতেই অঙ্গীকারবদ্ধ নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। সেই নেতৃত্ব আমাদের মাঝে আছে। আসুন, আরও সবুজ, পরিচ্ছন্ন ও সাম্যের বাংলাদেশ গড়তে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হই।
ড. আতিউর রহমান
সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
কোভিড-১৯ ভাইরাস সারা বিশ্বকেই টালমাটাল করে রেখেছে। এমন দীর্ঘস্থায়ী সর্বব্যাপী সংকটে আমাদের এই চেনা পৃথিবী আগে কখনো পড়েনি। এমনকি দুই দুটো বিশ্বযুদ্ধেও বিশ্ববাসীকে এতটা অসহায় বোধ করতে দেখা যায়নি। এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে এই অদৃশ্য শত্রু হানা দেয়নি। বিজ্ঞানের অসামান্য উন্নতির কারণেই দ্রুতই এই সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য টিকা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু জাতীয় স্বার্থকে বেশি করে দেখতে গিয়ে উন্নত দেশগুলো এই টিকার সরবরাহ সবার জন্য উন্মুক্ত করে উঠতে পারেনি। তাই বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। একদল তাদের প্রয়োজনের চেয়েও বেশি টিকা মজুত করে রেখেছে, আরেক দল পর্যাপ্ত টিকা টাকা দিয়েও সংগ্রহ করতে পারছে না। এমন বাস্তবতায় উন্নত সাত দেশের সংস্থা জি-৭ ঘোষণা করেছে যে তারা গরিব দেশগুলোর জন্য ১০০ কোটি ডোজ টিকার ব্যবস্থা করবে। তবে কবে করবে, কীভাবে করবে–সেসব এখনো পরিষ্কার নয়। তাই আইএমএফপ্রধান বলেছেন, সারা বিশ্বের বেশির ভাগ নাগরিককেই যদি আগামী বছরের মধ্যে এই টিকা না দেওয়া যায় তাহলে করোনাসংকট থেকে মুক্তির আশা বেশ ক্ষীণ। সে কারণেই তিনি বলেছেন, এই মুহূর্তে সব দেশে টিকা দেওয়ার নীতিটিই আসলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার নীতি। জানি না কবে করোনা এ বিশ্বকে রেহাই দেবে। তবে সবার প্রচেষ্টায় যদি বিশ্ববাসী এই অভাবনীয় সংকট থেকে বের হয়ে আসতেও পারে, তাহলেও আগামীর পৃথিবী আর আজকের পৃথিবীর মতো হবে না। শুধু অর্থনীতি নয়; সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি পুরোপুরিই বদলে যাবে। বদলে যাবে মানুষের জীবন চলার ধরন। বদলাবে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, বিনোদন, পর্যটন ও মানবিক সম্পর্কগুলোও। অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ জেঁকে বসবে বিশ্বজুড়েই। প্রযুক্তির প্রসার ঘটবে দ্রুতলয়ে। জীবন ও জীবিকার ধরনও পাল্টাবে এসব পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বোঝাপড়াও বদলে যাবে।
সেই বদলে যাওয়া বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান কেমন হবে? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মোটেও সহজ নয়। করোনার মতিগতি কেমন হবে তার ওপরই নির্ভর করবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থান, তখন কেমন হবে? বর্তমানে পরিস্থিতি বেশ অনিশ্চিত। এক দিকে টিকা সংগ্রহ করা যাচ্ছে না, অন্যদিকে মানুষ খুবই অসচেতন। কিছুতেই তারা স্বাস্থ্যবিধি মানতে চাইছে না। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে নতুন ধরনের করোনাভাইরাস যেভাবে আঘাত হেনেছে, তার প্রভাব শুধু স্থানীয় অর্থনীতির ওপরই পড়বে–এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। এই সংক্রমণ একপর্যায়ে রাজধানী ও তার আশপাশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে আছড়ে পড়লে তার পরিণতি ভালো হবে না। কেননা, তরুণ শ্রমজীবী সবাইকে আমরা টিকা দিতে পারিনি। তবে তাঁরা সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন। মাস্ক পরছেন। কিন্তু কারখানায় স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলেও তাঁরা যেখানে থাকেন, সেখানে তা সম্ভব হচ্ছে না। তাই ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। এমনি এক অনিশ্চিত পরিবেশে আমাদের করোনা-উত্তর বাংলাদেশের কথা ভাবতে হচ্ছে।
ধরে নিচ্ছি, এই সংকট কেটে যাবে। বাংলাদেশ ফের তার পুরোনো লয় খুঁজে পাবে। জীবন ও জীবিকা–দুই–ই সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। তা–ই যেন হয়। তবুও নয়া পৃথিবীর সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে বেশ খানিকটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি যে বাংলাদেশকে হতে হবে তা তো বলাই বাহুল্য। অবশ্য, সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের যে অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেটিই শেষ পর্যন্ত তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল সীমাহীন দুঃখ ও বেদনার মধ্য দিয়ে। একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন যিনি, সেই জাতির পিতা পাকিস্তানি কারাগারে। অথচ তাঁরই নেতৃত্বে চলছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচারে এক কোটির মতো মানুষ শরণার্থী। দেশের তরুণ-তরুণীরা জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছে। সে বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগও ছিল প্রবল। প্রাকৃতিক ও মানুষের তৈরি দুর্যোগ মোকাবিলা করেই বাঙালি মরণপণ লড়াইয়ে নেমেছিল মুক্তির অন্বেষায়। তাদের মনে লড়াই করার মতো মণ উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন জাতির পিতা। তাঁর সহনেতারা দেশবাসীকে তাঁরই নামে ঐক্যবদ্ধ করে এক সাগর রক্ত পাড়ি দিয়ে স্বাধীন করেছিলেন বাংলাদেশকে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর অকুণ্ঠ সমর্থন এবং ওই দেশের সেনাবাহিনী ও জনগণের সমর্থনে অতি অল্প সময়েই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল। এর পরের সংগ্রাম দেশ গড়ার। সেই যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন জাতির পিতা স্বয়ং। ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি সদ্য স্বাধীন দেশকে কী করে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু সে এক অনন্য কাহিনি। দারিদ্র্য, ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ, অন্তর্ঘাত, ঝড়-বৃষ্টি এবং বিভ্রান্ত তারুণ্যের অসহিষ্ণুতা–সবকিছু মোকাবিলা করেই বঙ্গবন্ধু একটি সুপরিকল্পিত অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কৌশল গ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশের জন্য। মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামোসমূহ পুনর্নির্মাণ, এক কোটি শরণার্থীদের পুনর্বাসন, প্রাদেশিক একটি সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকারে উন্নীতকরণ এবং বিপুল খাদ্যঘাটতি মোকাবিলার মতো চ্যালেঞ্জ সামলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানুষের গড় মাথাপিছু আয় মাত্র ৯৩ ডলার থেকে ২৭৩ ডলারে উন্নীত করেছিলেন। কৃষিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে, শিল্পকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় (ব্যক্তিমালিকানা ও সমবায় মালিকানার পথ খোলা রেখে) নিয়ে তিনি দ্রুতই অর্থনীতিকে সচল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শুরুতেই তিনি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানো এবং প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করার মতো সুদূরপ্রসারী নীতি গ্রহণ করেছিলেন। রাষ্ট্রের সক্ষমতা তখনো যথেষ্ট অর্জিত হয়নি। বিদেশি সাহায্য-নির্ভর কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নে তাই বেসরকারি উদ্যোগকে অংশীদার করতে তিনি দ্বিধা করেননি। এমনকি এসব সামাজিক উদ্যোক্তাদের (ডা. জাফরুল্লাহসহ আরও অনেকেই) জমি ও নীতি সমর্থন দিতেও কার্পণ্য করেননি। তাই শুরুর দিনগুলোতে জনস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণসহ সামাজিক উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ থেকে উৎসারিত এসব উন্নয়ন উদ্যোক্তারা যথেষ্ট স্বাধীনতা ও নীতি-সমর্থন ভোগ করেছেন। ফলে কম খরচে মানব উন্নয়নের নানা উদ্যোগ সরকারের পক্ষে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। অংশীদারিমূলক সেই উন্নয়নের ধারা বাংলাদেশে আজও বহমান।
দেশ যখন বিপর্যয় কাটিয়ে সুস্থিতির দিকে এগোচ্ছিল, ঠিক তখনই স্বাধীনতাবিরোধী চক্র মরণ ছোবল হানে বাঙালির জাতির পিতা ও তাঁর সহনেতাদের ওপর। পঁচাত্তরের সেই ট্র্যাজেডির ধাক্কায় বাংলাদেশ হাঁটতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উল্টো দিকে। দীর্ঘ ১৩ বছর লেগেছিল বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া ২৭৩ ডলারের মাথাপিছু আয়ে পুনরায় পৌঁছাতে। এরপরেও দেশ চলছিল ঢিমেতালে। বঙ্গবন্ধুকন্যা ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত সরকার গঠন করে দেশকে ফিরিয়ে আনেন মুক্তিযুদ্ধের পথে। ১৯৯৮–এর বন্যা মোকাবিলার সময় তিনি দেখিয়ে দেন সংকটকালেও কী করে সামাজিক সক্রিয়তা বজায় রেখে দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব।
একজন মানুষকেও অনাহারে মরতে দেননি তিনি ওই দুর্যোগকালে। শুরু করেন বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, মুক্তিযোদ্ধাভাতার মতো সুদূরপ্রসারী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসমূহ। এগুলো এখন আরও বিস্তৃত ও গভীরতর করা হয়েছে। দুর্ভাগ্য আমাদের। ২০০১ সালে ফের ষড়যন্ত্রের শিকার হলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। এর পরের বছরগুলো বাংলাদেশ কেমন ছিল তা আর না–ইবা বললাম। অনেক সংগ্রাম, ত্যাগ–তিতিক্ষার পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে দিন বদলের ‘সনদ’–এর অঙ্গীকার করে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন বঙ্গবন্ধুকন্যা। ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েই তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজে নেমে পড়েন। আজও সমান গতিতেই এগিয়ে চলেছেন তিনি উন্নয়নের ঝান্ডা হাতে নিয়ে। বিগত ১২ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়নসূচকে যে উল্লম্ফন ঘটেছে, তা বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে।
১৯৭৫–এর পর বাংলাদেশের আজ অবধি মাথাপিছু আয় সাত গুণের বেশি বেড়েছে। এর ৭৩ শতাংশই বেড়েছে গত এক যুগে। এই এক যুগে তা বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। পঁচাত্তর থেকে এখন অবধি প্রবাসী আয় বেড়েছে ২৮৫ গুণ। রপ্তানি বেড়েছে ১৩৩ গুণ। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তৈরি পোশাক খাত। গত ১২ বছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে প্রায় সাত গুণ। এ সময় মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল থেকেছে। ম্যাক্রো অর্থনীতির ভিত্তি দারুণ শক্তিশালী এখন। এ সবই সম্ভব হয়েছে আমাদের উপযুক্ত ম্যাক্রো অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহণের জন্য। আরও সাহায্য করছে তরুণ জনগোষ্ঠী। এরই অংশ অধিক হারে নারীর আনুষ্ঠানিক কর্মে অংশগ্রহণ। সরকার ও আর্থিক খাতে ব্যাপক ডিজিটাইজেশনও খুব সহায়ক হয়েছে। সরকারের ধারাবাহিকতার কারণে পদ্মা সেতুর মতো বড় বড় অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে। এসব অবকাঠামো আগামীর বাংলাদেশের চেহারাই বদলে দেবে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের এই গতিময়তার পাশাপাশি আমাদের সামাজিক সূচকগুলোতেও দারুণ অগ্রগতি লক্ষ করা গেছে। আমাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রিত বলে দম্পতি প্রতি সন্তানের সংখ্যা এখন ২ দশমিক ১–এ দাঁড়িয়েছে। বাহাত্তরের তা ছিল ৬–এরও বেশি। এখন আমাদের জীবনের আয়ু ৭৩ বছর। বাহাত্তরে তা ছিল ৪৭ বছর। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার উন্নয়নশীল দেশসমূহের অর্ধেক। সব শিশুকে আমরা টিকা দেওয়ার অবকাঠামো গড়ে তুলেছি। খাবার স্যালাইন, পুষ্টি শিক্ষা, স্যানিটেশন, সন্তান পালনসহ সামাজিক সচেতনতা বিস্ময়করভাবে বেড়েছে। কোভিড আসার আগে দারিদ্র্য কমে ২০ শতাংশে পৌঁছেছিল। মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশের মধ্যেই আছে। খাদ্য উৎপাদন ৫০ বছরে চার গুণ বেড়েছে। মাছ, সবজি, মাংস, ফল– উৎপাদনে আমরা প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। শিক্ষার পরিমাণ বেড়েছে। গুণমান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যের বিস্তার ঘটেছে। মধ্যম ও টারশিয়ারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় আরও যথেষ্ট নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
আমাদের এ অসামান্য অর্জনের পেছনে নিঃসন্দেহে নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল প্রবল। বঙ্গবন্ধু যেমনটি চেয়েছিলেন ঠিক সেরকম বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তাঁর নেতৃত্বে এগিয়ে চলা বাংলাদেশকে অনেকেই ‘রানিং বল’ বা ‘প্যারাগন অব ডেভেলপমেন্ট’ বলছেন। কেউ কেউ আবার তাকে মিরাকলও বলতে চাইছেন। আমি বলি এ অর্জন ‘বিরল’। আমাদের পরিশ্রমী উদ্যোক্তা মানুষ ও সুদৃঢ় নেতৃত্বের অর্জন। ]
অর্জনের এই শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই আমরা করোনা-উত্তর বাংলাদেশকে যেমনটি দেখতে চাই তা সংক্ষেপে উল্লেখ করছি:
এক. আগামীর বাংলাদেশ হবে পুরোপুরি ডিজিটাল। ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সবকিছুই হবে প্রযুক্তি-নির্ভর। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা এই আধুনিক বাংলাদেশের শুভসূচনা করেছি এক যুগ আগেই।
দুই. আগামীর বাংলাদেশ হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং খুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাবান্ধব। উদ্ভাবনই হবে মূল কথা। অর্থনীতির পিরামিডের ভিত্তিটি শক্ত করেই আমরা আমাদের ম্যাক্রো অর্থনীতিকে স্থিতিশীল ও টেকসই রাখব।
তিন. রাষ্ট্র শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করব। আর সেই পরিবেশে ব্যক্তি খাত অন্তর্ভুক্তিমূলক সবুজ অর্থনৈতিক রূপান্তরে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
চার. আমরা উচ্চশিক্ষাকে শিল্প তথা চতুর্থ শিল্প–বিপ্লবের সহযোগী করে ঢেলে সাজাতে চাই। শিল্পের চাহিদামতো জনশক্তি তৈরি করবে উচ্চ শিক্ষালয়।
পাঁচ. কৃষির আধুনিকায়ন এবং যন্ত্রায়ণের যে নীতি সমর্থন দিয়ে চলেছে বর্তমান সরকার, তা আরও বেগবান করার কোনো বিকল্প নেই।
ছয়. আমাদের গ্রামগুলোকেও শহরের সুবিধা দেব। তবে নগরায়ণকে হতে হবে স্মার্ট ও মানুষের বসবাসযোগ্য।
সাত. স্থানীয়, উপ-আঞ্চলিক ও আঞ্চলিক সরবরাহ চেইনগুলোকে সমন্বিত করে আমরা আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যকে আরও প্রসারিত করতে কানেকটিভিটির ওপর বেশি জোর দিতে চাই।
আট. আমাদের নিজস্ব সম্পদ বাড়াতে এনবিআরের সংস্কার করতে হবে। তার সক্ষমতা বাড়িয়ে কর-জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে তার দ্বিগুণ করতে আগ্রহী আমরা।
নয়. এ সবকিছুই সম্ভব যদি আমরা শাসনব্যবস্থার উন্নতি করে সামাজিক সুবিচার ও প্রবৃদ্ধিতে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারি। সে জন্য সর্বত্র জবাবদিহি ও অপচয়বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা খুবই জরুরি। ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং সামাজিক সক্রিয়তা বাড়িয়ে আমরা কাঙ্ক্ষিত এই গভর্নেন্সের মান নিশ্চয় উন্নত করতে পারি।
দশ. আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য খুব সহজে করা যায় না। পদে পদে বাধা। আর রয়েছে অযথা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। তাই নিয়মনীতি সহজ করে ‘ওয়ান–স্টপ সার্ভিস’সুবিধা আরও বাড়াতে আমাদের উদ্যোগী হতে হবে।
এগারো. প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। আয়ের বৈষম্যও বাড়ছে। তাই প্রগতিশীল চালু করে করব্যবস্থা এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিধি বাড়িয়ে আয়বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। ভোগবৈষম্য এখনো তীব্র নয়। এই সূচককে স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
বারো. প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়াটি অবশ্য সবুজ হতে হবে। সবুজ বিদ্যুতের প্রসার ঘটাতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী ‘গ্রিনহাউস গ্যাস’ উৎপাদনের উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে আরও জলবায়ুবান্ধব করে গড়ে তুলতে হবে।
চলমান করোনাসংকট সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করে আমরা এমন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার চাই, যাতে বাংলাদেশের এত দিনের অর্জন আমরা ধরে রাখতে পারি। একই সঙ্গে আমাদের উন্নয়নের মহাসড়ককে আরও মসৃণ ও সবুজ হোক, সেই প্রত্যাশাই করছি। এ সবকিছুতেই অঙ্গীকারবদ্ধ নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। সেই নেতৃত্ব আমাদের মাঝে আছে। আসুন, আরও সবুজ, পরিচ্ছন্ন ও সাম্যের বাংলাদেশ গড়তে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হই।
ড. আতিউর রহমান
সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪