সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
একটা ব্যাপার আছে, যাকে আমরা অগ্রগতি বলি, অন্য একটা ব্যাপার হলো উন্নতি—এই দুইয়ের ভেতর পার্থক্য যে রয়েছে, সেটা তো অস্পষ্ট নয়। অগ্রগতি মানে হলো সামনের দিকে চলা, আর উন্নতির অর্থ ওপরের দিকে ওঠা। দুইয়ের ভেতর মিলেরও একটা জায়গা বিদ্যমান, সেটা হলো বৈষম্য। অগ্রগতি মানেই যে সবাই সমানতালে এগোতে পারছে তা নয়, কেউ এগোচ্ছে কেউ পিছিয়ে পড়ছে—ঘটনা এই রকমেরই। আর উন্নতি যদি হয় ওপরের দিকে ওঠা, তা হলে তো ব্যাপারটা পরিষ্কারভাবেই বৈষম্যমূলক। সবাই তো ওপরে উঠতে পারবে না। জায়গা হবে না সবার জন্য।
এখন আমরা অগ্রগতির চেয়ে উন্নতির কথাই বেশি বেশি করে বলছি। ধারণাগুলো তো ইংরেজি ভাষাতেই আছে, অগ্রগতি হলো প্রগ্রেস আর উন্নতি হচ্ছে ডেভেলপমেন্ট। যুগটা এখন যতটা না প্রগ্রেসের, তার চেয়ে বেশি ডেভেলপমেন্টের। তা উন্নতি আমরা চাই বৈকি, উন্নতি খুবই প্রয়োজন। স্থিতাবস্থা বলে তো আসলে কিছু নেই, উন্নতি না ঘটলে বুঝতে হবে অবনতি চলছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোন ধরনের উন্নতি আমরা চাই। উন্নতিটা কি হবে খাড়াখাড়ি পাহাড়ের মতো? নাকি অন্য ধরনের। পাহাড়ের সামাজিক ভূমিকা আছে বৈকি। সে মেঘকে থামিয়ে দিয়ে বৃষ্টিপাত ঘটায়। বরফ জমিয়ে ঝরনার সৃষ্টি করে। কিন্তু উন্নতি যদি পর্বতপ্রতিম হয়, তাহলে তো ভীষণ বিপদ। কেননা, পর্বত তো হৃদয়হীন। সে তো পাষাণে গড়া। চতুর্দিকে আজ যে উন্নতি দেখছি সেটা কিন্তু ওই পাহাড়ের মতোই, ক্ষেত্রবিশেষে সে জগদ্দল পাহাড়ই। উন্নতির পাহাড়গুলো দূরের নয়, খুবই নিকটের। তারা মানুষের বুকের ওপর, ঘাড়ের ওপর চেপে বসে আছে। অনুন্নত মানুষের দশাটা এখন পাহাড়ে মাথা ঠোকার মতো।
তাহলে কি উন্নতি চাই আকাশের মতো? না, তা-ও নয়। উন্নতি আকাশচারী হোক, ওটা চাইব না। তাকে থাকতে হবে ভূমিতেই। চাইব কি যে উন্নতি নেমে আসুক বৃষ্টির মতো? না, তা-ও নয়। কেননা, বৃষ্টিপাত স্থায়ী হয় না এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে প্লাবন ঘটে, সবকিছু তলিয়ে যায়, ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। আমরা বৃষ্টিনির্ভরতা চাইব না, যেমন চাইব না প্লাবন। উন্নতি হওয়া দরকার নদীর মতো। নদীর মতোই সে সর্বত্রগামী হবে, হবে সৃষ্টিশীল, ভূমিকে উর্বর করবে, চলমানতা আনবে যানবাহনে। একদিকে হবে সে সমুদ্রমুখী, অন্যদিকে তার নিত্য বিচরণ ঘটবে জনভূমিতে। ধারণ করবে সে পাহাড়ি বৃষ্টিপাত ও ঝরনাকে; পুষ্ট রাখবে খাল, বিল-নালাকে। ভালো কথা, ওই যে সমুদ্র এবং খাল-বিল, নালা—এদেরকে যেন আমরা না ভুলি। সমুদ্রকে উপেক্ষা করে এখন আক্ষরিক অর্থেই আমরা সমুদ্রকে হারাচ্ছি, আবার জলধারা ও জলাশয়কে অবজ্ঞা করে তাদের শুকিয়ে যেতে দিয়েছি। আমাদের সমুদ্র চলে যাচ্ছে অন্যের দখলে, জলাশয়গুলো সামাজিক মালিকানা থেকে চ্যুত হয়ে পরিণত হচ্ছে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে। উন্নতির এই ধরনটির চরিত্র হচ্ছে পুঁজিবাদী।
উন্নতিটা হওয়া চাই নদীর ভূমিকার মতো। উন্নতি ভূমিতেই ঘটবে, খাড়াখাড়ি উঠে যাবে না। আড়াআড়ি চলবে। বৈষম্য সৃষ্টি না করে, চেষ্টা করবে সাম্য প্রতিষ্ঠিত করতে। সবাইকে উন্নত করতে চাইবে, অল্প কয়েকজনকে নয়। তার চরিত্র হবে সমাজতান্ত্রিক। সবকিছু ব্যক্তিগত করে তোলার যে প্রবণতা, তাকে সে রুখে দেবে। এই যে জগতের সমস্ত কিছুকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি করে তোলার প্রবণতা, তার পরিণতি যে কেমন ভয়াবহ হতে পারে, পুঁজিবাদী বিশ্ব এখন তা মর্মে মর্মে টের পাচ্ছে। আত্মরক্ষার ভীষণ প্রয়োজনে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সে এখন সামাজিক হস্তক্ষেপকে ডেকে নিয়ে আসছে। কিন্তু তাতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা তো বদলাচ্ছে না, টিকেই যাচ্ছে। সামাজিক হস্তক্ষেপের অর্থটা কি? সে-ও তো এক প্রকারের শোষণই। কেননা, পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থাকে বাঁচানোর জন্য যে সামাজিক হস্তক্ষেপ ঘটছে, সেই টাকাটা আসছে সাধারণ মানুষের ওপর আরোপিত ট্যাক্স থেকেই। সাধারণ মানুষ কর জোগাবে, আর ব্যাংকওয়ালারা পুনরায় মুনাফা করা শুরু করবে —আশাটা তো এ রকমেরই। কোথাও কোথাও রাষ্ট্র ব্যাংকের মালিকানার একটা অংশ কিনে নিচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রটা কার? পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের মালিক তো জনগণ নয়, মালিক হচ্ছে ওই টাকাওয়ালারাই।
পুঁজিবাদী উন্নতির যে ব্যবস্থা বহু মানুষের শ্রম ও সঞ্চয় দিয়ে গড়ে তোলা, সে অল্প মানুষের সেবা করে। পাহাড়ের মতো সে সমাজের বুকে চেপে বসে, আবার সে খরার মতোও বটে; নিষ্পেষিত করে মানুষের হৃদয়ানুভূতিকে, কেড়ে নেয় তার মনুষ্যত্ব এবং অতিশয় আপাত স্বাস্থ্যবান মানুষেরাও পরিণত হয় নরকঙ্কালে। নিরন্ন কঙ্কাল আমরা চোখে দেখতে পাই; স্থূল স্বাস্থ্য ও উজ্জ্বল পোশাকে সজ্জিত কঙ্কালেরা দৃশ্যমান হয় না—তফাতটা এটুকুই মাত্র। যে মানুষের মনুষ্যত্ব নেই, তাকে মানুষ বলি কি করে? সে তো কঙ্কাল। গরিব মানুষ কঙ্কাল হয় দারিদ্র্যে, ধনী কঙ্কাল হয়ে যায় প্রাচুর্যে। উভয়েই কেবল নিজের কথা ভাবে, অন্যের কথা ভাবতে পারে না। যদিও অর্থনৈতিক অবস্থানগত দিক দিয়ে তারা পরস্পর থেকে অনেক দূরে রয়েছে।
আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ উন্নতির যে দর্শনে দীক্ষিত, সেটা পুঁজিবাদী বটে। এখানে নদী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। বাইরের নদী ভরাট হয় জবরদখলকারীদের দৌরাত্ম্যে। ভেতরের যে নদী, যার নাম মনুষ্যত্ব, সে-ও যাচ্ছে শুকিয়ে। পুঁজিবাদের খরা তাকে বাঁচতে দিচ্ছে না। ভেতরের নদীটা হলো মনুষ্যত্ব, মনুষ্যত্বের গুণ হচ্ছে সহমর্মিতা, সাম্য, সৃষ্টিশীলতা ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ। এখন সবাই চাইছে ওপরে উঠতে, সবাইকে ঠেলে নিচে ফেলে দিয়ে। আর এই যে উন্নতির আকাঙ্ক্ষা, এ ক্ষেত্রে ন্যায়-অন্যায়ের বোধ কাজ করে না, যা কিছু ব্যক্তিগত উন্নতির পক্ষে তাকেই মনে হয় ন্যায়সংগত। মনুষ্যত্বের কথা উঠেছে, নৈতিকতাবোধও মনুষ্যত্বের অপরিহার্য অংশ বৈকি। সেটি যখন না থাকে, তখন মানুষ আর মানুষ থাকে না, কঙ্কালে নয়, ক্ষুধার্ত জন্তুতেই পরিণত হয়। জন্তুর ক্ষুধার তবু নিবৃত্তি আছে, মনুষ্যত্বহীন পুঁজিবাদী মানুষের ক্ষুধাটা অপরিসীম, পারলে সে সারা বিশ্বকেই গ্রাস করে ফেলে।
বাংলাদেশ যে হঠাৎ করে দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন-এর কারণ কী? বলা সহজ যে মানুষের চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে। এক অর্থে সেটা যে মিথ্যা তা-ও নয়। চরিত্র তো বদলেছেই, নইলে ঘুষ দিই-বা কেন, আর ঘুষ নিই-বা কেন। কিন্তু চরিত্র যে বদলে গেল এর কারণটা কী? আমরা তো যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। তখন তো আত্মত্যাগের চরম দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল। তারপরে কেন এই পরিবর্তন? পরিবর্তনের কারণ ব্যক্তি নয়, কারণটা হচ্ছে ব্যবস্থা। আর সেই ব্যবস্থার নাম হচ্ছে পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ অন্যত্র যা করে বাংলাদেশেও তা-ই করেছে। ব্যক্তিগতভাবে উন্নতি করতে উৎসাহ দিয়েছে। উন্নতি করতে গিয়ে মানুষ স্বাধীনভাবে কাজ করেছে, ন্যায়-অন্যায়ের ধার ধারেনি। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ব্যক্তিগত উন্নতির স্বাধীনতাতে পরিণত হয়েছে। ঘটনা এটাই।
আগে লোকে ঘুষ দিতে সংকোচ বোধ করত। কীভাবে দেবে সেটা তাকে ভাবতে হতো। এখন সেসব ভাবনাচিন্তার অবসান ঘটেছে। কেননা, লোকে দেখছে যে ঘুষ না দিলে কাজ হয় না। আর সবাই তো দিচ্ছে। লুকোচুরি নেই। তাহলে অসুবিধাটা কোথায়? নিজেকে কেন বিব্রত করব? বোকার মতো? যারা ঘুষ নেয় তারা তো নির্লজ্জ। আগেকার সময়ে একটা ভয় ছিল। ধরা পড়লে শাস্তি হবে—এমন একটা ভয় কাজ করত। সমাজে হেয়প্রতিপন্ন হবে—এই আশঙ্কাটা ছিল অধিকতর কার্যকর। ঘুষখোরদের সমাজ মোটেই ভালো চোখে দেখত না। এখন কিন্তু জিনিসটা উল্টে গেছে। এখন দেখা যাচ্ছে যারা ঘুষ খায় অর্থাৎ উন্নতি করে, তারাই বীর। দাপটে চলে। অন্যদের ভয় পাইয়ে দেয়। উন্নতিটাই হলো আসল কথা, টাকা কীভাবে এসেছে সেটা কোনো বিবেচনার বিষয়ই নয়। স্বাধীনতা পুঁজিবাদকে স্বাধীন করে দিয়েছে।
এই যে উন্নতি এর জন্য প্রতারণা, জাল-জোচ্চুরি, হত্যা–কোনো কিছুই অন্যায় নয়। ছোট একটা খবর, কিন্তু এ খবরে অনেক সংবাদ রয়েছে। বগুড়ায় একটি পুকুরের লিজ নেওয়ার জন্য শিক্ষক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সরকারি চাকুরে হেন লোক নেই, যে জেলে সাজেনি। জেলে হওয়াটা মোটেই সম্মানজনক নয়। কিন্তু জেলে সাজতে কোনো প্রকার আপত্তি নেই, যদি পুকুরের দখল পাওয়া যায়, যদি সম্ভব হয় পুকুরচুরি। উন্নতির এই কারাগারে ভদ্র-অভদ্র পার্থক্য নেই। সবাই সমান।
স্বাধীনতা নয়, আমরা মুক্তিই চেয়েছিলাম। মুক্তিতে আমাদের অগ্রগতি হবে ভেবেছিলাম। সেই অগ্রগামিতার ভেতর উন্নতির স্বপ্নও ছিল। কিন্তু যুদ্ধের সময় আমরা ব্যক্তিগত উন্নতির কথা ভাবিনি। সমষ্টিগত উন্নতির স্বপ্ন দ্বারাই তাড়িত হচ্ছিলাম।
তবে আন্দোলন কিন্তু সব সময়েই পুঁজিবাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। ব্রিটিশ আমলে ছিল। পাকিস্তান আমলেও ছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনটা মোটেই পুঁজিবাদবিরোধী ছিল না। জিন্নাহ তো বটেই, গান্ধীও পুঁজিবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। পাকিস্তানের কালে আওয়ামী লীগই শেষ পর্যন্ত প্রধান রাজনৈতিক দল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ যে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল, তা মোটেই নয়। সমাজতন্ত্রীদের আওয়ামী লীগ ঘরের শত্রু বিভীষণ হিসেবেই দেখত। সমাজতন্ত্রের কথা আওয়ামী লীগ প্রথম বলেছে সত্তরের নির্বাচনে, তার আগে কখনো বলেনি। সেই বলাটাও জনগণের চাপে ঘটেছে। রাষ্ট্রের নতুন সংবিধানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার ছিল, সেটাও ঘটেছে জনগণের ওই চাপেই। আওয়ামী লীগের ভেতরেই খোন্দকার মোশতাক ছিলেন। তিনি ঘোরতর ও ঘোষিত রূপেই পুঁজিবাদে আস্থাশীল ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান সমাজতন্ত্র আনার কথা ঘোষণা করেছিলেন। আর সে জন্যই পুঁজিবাদে বিশ্বাসীরা তাঁকে সরিয়ে দিয়েছেন। এটা বজ্রাঘাতের মতো ব্যাপার যে শেখ মুজিব সমাজতন্ত্রীদেরই শত্রু ভেবেছেন, পুঁজিবাদীদের নয়। অথচ পুঁজিবাদীরাই ছিলেন তাঁর প্রকৃত শত্রু। তাঁকে সরিয়ে দিয়ে যাঁরা এলেন, তাঁরা তো পরিষ্কারভাবেই পুঁজিবাদী এবং তাঁদের কাজটা হচ্ছে পুঁজিবাদের বিকাশের জন্য পথটাকে প্রশস্ত ও পরিষ্কার করে দেওয়া। সেই কাজই তাঁরা করেছেন। ফলে ‘উন্নতি’ যা হওয়ার হয়েছে পুঁজিবাদী ধরনেই। সিঁড়ি ভেঙে নয়, ধাপে ধাপেও নয়, উন্মাদের মতো লোকে উন্নতি করেছে লাফিয়ে লাফিয়ে।
ভূমি ফুঁড়ে যদি কেবল পাহাড়ই গজাতে থাকে, তাহলে ভূমিকম্প ঘটবে–এটা স্বাভাবিক। সমাজেও হয়তো ভূমিকম্প দেখতে পাব আমরা। বিস্ফোরণ ঘটবে। কিন্তু সেটা তো আমরা চাই না। আমরা চাই স্বাভাবিক পথে অগ্রগতি।
প্রাকৃতিক ভূমিকম্পের বিরুদ্ধে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্ভবপর, সামাজিক ভূমিকম্পকেও ঠেকানো যেতে পারে, যদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। সেই পদক্ষেপটা হচ্ছে পুঁজিবাদী উন্নতির পথ ত্যাগ করে গণতান্ত্রিক উন্নতির পথ ধরা। এই গণতান্ত্রিক উন্নতিরই অপর নাম হচ্ছে সমাজতন্ত্র।
এটা তাত্ত্বিকভাবে আমরা বুঝি, কিন্তু একে বাস্তবিক করে তোলার উপায়টা কী? উপায় হচ্ছে আন্দোলন। এই আন্দোলন মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো করবে না। তাঁরা সবাই পুঁজিবাদী। তাদের ভেতরে যে লড়াই, সেটা একে অপরকে পেছনে ফেলে উন্নতি করার চেষ্টা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। আজ যেটা দরকার, তা হলো বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ। যে শক্তি উন্নতিকে নদীর প্রবাহে পরিণত করতে চাইবে, পাহাড়–পর্বতে দেশ ছেয়ে যাক–এমনটা চাইবে না। এই রাজনীতির লক্ষ্য হবে গোটা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা। মানুষ যাতে কঙ্কাল না হয়, না হয় ক্ষুধার্ত বন্য পশু। আমাদের অবশ্যই সামনের দিকে এগোতে হবে। তার জন্য বৈষম্য দূর করা চাই। বৈষম্য বাড়বে অথচ আমরা এগোবো–এটা মোটেই সম্ভবপর নয়।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
একটা ব্যাপার আছে, যাকে আমরা অগ্রগতি বলি, অন্য একটা ব্যাপার হলো উন্নতি—এই দুইয়ের ভেতর পার্থক্য যে রয়েছে, সেটা তো অস্পষ্ট নয়। অগ্রগতি মানে হলো সামনের দিকে চলা, আর উন্নতির অর্থ ওপরের দিকে ওঠা। দুইয়ের ভেতর মিলেরও একটা জায়গা বিদ্যমান, সেটা হলো বৈষম্য। অগ্রগতি মানেই যে সবাই সমানতালে এগোতে পারছে তা নয়, কেউ এগোচ্ছে কেউ পিছিয়ে পড়ছে—ঘটনা এই রকমেরই। আর উন্নতি যদি হয় ওপরের দিকে ওঠা, তা হলে তো ব্যাপারটা পরিষ্কারভাবেই বৈষম্যমূলক। সবাই তো ওপরে উঠতে পারবে না। জায়গা হবে না সবার জন্য।
এখন আমরা অগ্রগতির চেয়ে উন্নতির কথাই বেশি বেশি করে বলছি। ধারণাগুলো তো ইংরেজি ভাষাতেই আছে, অগ্রগতি হলো প্রগ্রেস আর উন্নতি হচ্ছে ডেভেলপমেন্ট। যুগটা এখন যতটা না প্রগ্রেসের, তার চেয়ে বেশি ডেভেলপমেন্টের। তা উন্নতি আমরা চাই বৈকি, উন্নতি খুবই প্রয়োজন। স্থিতাবস্থা বলে তো আসলে কিছু নেই, উন্নতি না ঘটলে বুঝতে হবে অবনতি চলছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোন ধরনের উন্নতি আমরা চাই। উন্নতিটা কি হবে খাড়াখাড়ি পাহাড়ের মতো? নাকি অন্য ধরনের। পাহাড়ের সামাজিক ভূমিকা আছে বৈকি। সে মেঘকে থামিয়ে দিয়ে বৃষ্টিপাত ঘটায়। বরফ জমিয়ে ঝরনার সৃষ্টি করে। কিন্তু উন্নতি যদি পর্বতপ্রতিম হয়, তাহলে তো ভীষণ বিপদ। কেননা, পর্বত তো হৃদয়হীন। সে তো পাষাণে গড়া। চতুর্দিকে আজ যে উন্নতি দেখছি সেটা কিন্তু ওই পাহাড়ের মতোই, ক্ষেত্রবিশেষে সে জগদ্দল পাহাড়ই। উন্নতির পাহাড়গুলো দূরের নয়, খুবই নিকটের। তারা মানুষের বুকের ওপর, ঘাড়ের ওপর চেপে বসে আছে। অনুন্নত মানুষের দশাটা এখন পাহাড়ে মাথা ঠোকার মতো।
তাহলে কি উন্নতি চাই আকাশের মতো? না, তা-ও নয়। উন্নতি আকাশচারী হোক, ওটা চাইব না। তাকে থাকতে হবে ভূমিতেই। চাইব কি যে উন্নতি নেমে আসুক বৃষ্টির মতো? না, তা-ও নয়। কেননা, বৃষ্টিপাত স্থায়ী হয় না এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে প্লাবন ঘটে, সবকিছু তলিয়ে যায়, ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। আমরা বৃষ্টিনির্ভরতা চাইব না, যেমন চাইব না প্লাবন। উন্নতি হওয়া দরকার নদীর মতো। নদীর মতোই সে সর্বত্রগামী হবে, হবে সৃষ্টিশীল, ভূমিকে উর্বর করবে, চলমানতা আনবে যানবাহনে। একদিকে হবে সে সমুদ্রমুখী, অন্যদিকে তার নিত্য বিচরণ ঘটবে জনভূমিতে। ধারণ করবে সে পাহাড়ি বৃষ্টিপাত ও ঝরনাকে; পুষ্ট রাখবে খাল, বিল-নালাকে। ভালো কথা, ওই যে সমুদ্র এবং খাল-বিল, নালা—এদেরকে যেন আমরা না ভুলি। সমুদ্রকে উপেক্ষা করে এখন আক্ষরিক অর্থেই আমরা সমুদ্রকে হারাচ্ছি, আবার জলধারা ও জলাশয়কে অবজ্ঞা করে তাদের শুকিয়ে যেতে দিয়েছি। আমাদের সমুদ্র চলে যাচ্ছে অন্যের দখলে, জলাশয়গুলো সামাজিক মালিকানা থেকে চ্যুত হয়ে পরিণত হচ্ছে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে। উন্নতির এই ধরনটির চরিত্র হচ্ছে পুঁজিবাদী।
উন্নতিটা হওয়া চাই নদীর ভূমিকার মতো। উন্নতি ভূমিতেই ঘটবে, খাড়াখাড়ি উঠে যাবে না। আড়াআড়ি চলবে। বৈষম্য সৃষ্টি না করে, চেষ্টা করবে সাম্য প্রতিষ্ঠিত করতে। সবাইকে উন্নত করতে চাইবে, অল্প কয়েকজনকে নয়। তার চরিত্র হবে সমাজতান্ত্রিক। সবকিছু ব্যক্তিগত করে তোলার যে প্রবণতা, তাকে সে রুখে দেবে। এই যে জগতের সমস্ত কিছুকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি করে তোলার প্রবণতা, তার পরিণতি যে কেমন ভয়াবহ হতে পারে, পুঁজিবাদী বিশ্ব এখন তা মর্মে মর্মে টের পাচ্ছে। আত্মরক্ষার ভীষণ প্রয়োজনে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সে এখন সামাজিক হস্তক্ষেপকে ডেকে নিয়ে আসছে। কিন্তু তাতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা তো বদলাচ্ছে না, টিকেই যাচ্ছে। সামাজিক হস্তক্ষেপের অর্থটা কি? সে-ও তো এক প্রকারের শোষণই। কেননা, পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থাকে বাঁচানোর জন্য যে সামাজিক হস্তক্ষেপ ঘটছে, সেই টাকাটা আসছে সাধারণ মানুষের ওপর আরোপিত ট্যাক্স থেকেই। সাধারণ মানুষ কর জোগাবে, আর ব্যাংকওয়ালারা পুনরায় মুনাফা করা শুরু করবে —আশাটা তো এ রকমেরই। কোথাও কোথাও রাষ্ট্র ব্যাংকের মালিকানার একটা অংশ কিনে নিচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রটা কার? পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের মালিক তো জনগণ নয়, মালিক হচ্ছে ওই টাকাওয়ালারাই।
পুঁজিবাদী উন্নতির যে ব্যবস্থা বহু মানুষের শ্রম ও সঞ্চয় দিয়ে গড়ে তোলা, সে অল্প মানুষের সেবা করে। পাহাড়ের মতো সে সমাজের বুকে চেপে বসে, আবার সে খরার মতোও বটে; নিষ্পেষিত করে মানুষের হৃদয়ানুভূতিকে, কেড়ে নেয় তার মনুষ্যত্ব এবং অতিশয় আপাত স্বাস্থ্যবান মানুষেরাও পরিণত হয় নরকঙ্কালে। নিরন্ন কঙ্কাল আমরা চোখে দেখতে পাই; স্থূল স্বাস্থ্য ও উজ্জ্বল পোশাকে সজ্জিত কঙ্কালেরা দৃশ্যমান হয় না—তফাতটা এটুকুই মাত্র। যে মানুষের মনুষ্যত্ব নেই, তাকে মানুষ বলি কি করে? সে তো কঙ্কাল। গরিব মানুষ কঙ্কাল হয় দারিদ্র্যে, ধনী কঙ্কাল হয়ে যায় প্রাচুর্যে। উভয়েই কেবল নিজের কথা ভাবে, অন্যের কথা ভাবতে পারে না। যদিও অর্থনৈতিক অবস্থানগত দিক দিয়ে তারা পরস্পর থেকে অনেক দূরে রয়েছে।
আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ উন্নতির যে দর্শনে দীক্ষিত, সেটা পুঁজিবাদী বটে। এখানে নদী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। বাইরের নদী ভরাট হয় জবরদখলকারীদের দৌরাত্ম্যে। ভেতরের যে নদী, যার নাম মনুষ্যত্ব, সে-ও যাচ্ছে শুকিয়ে। পুঁজিবাদের খরা তাকে বাঁচতে দিচ্ছে না। ভেতরের নদীটা হলো মনুষ্যত্ব, মনুষ্যত্বের গুণ হচ্ছে সহমর্মিতা, সাম্য, সৃষ্টিশীলতা ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ। এখন সবাই চাইছে ওপরে উঠতে, সবাইকে ঠেলে নিচে ফেলে দিয়ে। আর এই যে উন্নতির আকাঙ্ক্ষা, এ ক্ষেত্রে ন্যায়-অন্যায়ের বোধ কাজ করে না, যা কিছু ব্যক্তিগত উন্নতির পক্ষে তাকেই মনে হয় ন্যায়সংগত। মনুষ্যত্বের কথা উঠেছে, নৈতিকতাবোধও মনুষ্যত্বের অপরিহার্য অংশ বৈকি। সেটি যখন না থাকে, তখন মানুষ আর মানুষ থাকে না, কঙ্কালে নয়, ক্ষুধার্ত জন্তুতেই পরিণত হয়। জন্তুর ক্ষুধার তবু নিবৃত্তি আছে, মনুষ্যত্বহীন পুঁজিবাদী মানুষের ক্ষুধাটা অপরিসীম, পারলে সে সারা বিশ্বকেই গ্রাস করে ফেলে।
বাংলাদেশ যে হঠাৎ করে দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন-এর কারণ কী? বলা সহজ যে মানুষের চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে। এক অর্থে সেটা যে মিথ্যা তা-ও নয়। চরিত্র তো বদলেছেই, নইলে ঘুষ দিই-বা কেন, আর ঘুষ নিই-বা কেন। কিন্তু চরিত্র যে বদলে গেল এর কারণটা কী? আমরা তো যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। তখন তো আত্মত্যাগের চরম দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল। তারপরে কেন এই পরিবর্তন? পরিবর্তনের কারণ ব্যক্তি নয়, কারণটা হচ্ছে ব্যবস্থা। আর সেই ব্যবস্থার নাম হচ্ছে পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ অন্যত্র যা করে বাংলাদেশেও তা-ই করেছে। ব্যক্তিগতভাবে উন্নতি করতে উৎসাহ দিয়েছে। উন্নতি করতে গিয়ে মানুষ স্বাধীনভাবে কাজ করেছে, ন্যায়-অন্যায়ের ধার ধারেনি। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ব্যক্তিগত উন্নতির স্বাধীনতাতে পরিণত হয়েছে। ঘটনা এটাই।
আগে লোকে ঘুষ দিতে সংকোচ বোধ করত। কীভাবে দেবে সেটা তাকে ভাবতে হতো। এখন সেসব ভাবনাচিন্তার অবসান ঘটেছে। কেননা, লোকে দেখছে যে ঘুষ না দিলে কাজ হয় না। আর সবাই তো দিচ্ছে। লুকোচুরি নেই। তাহলে অসুবিধাটা কোথায়? নিজেকে কেন বিব্রত করব? বোকার মতো? যারা ঘুষ নেয় তারা তো নির্লজ্জ। আগেকার সময়ে একটা ভয় ছিল। ধরা পড়লে শাস্তি হবে—এমন একটা ভয় কাজ করত। সমাজে হেয়প্রতিপন্ন হবে—এই আশঙ্কাটা ছিল অধিকতর কার্যকর। ঘুষখোরদের সমাজ মোটেই ভালো চোখে দেখত না। এখন কিন্তু জিনিসটা উল্টে গেছে। এখন দেখা যাচ্ছে যারা ঘুষ খায় অর্থাৎ উন্নতি করে, তারাই বীর। দাপটে চলে। অন্যদের ভয় পাইয়ে দেয়। উন্নতিটাই হলো আসল কথা, টাকা কীভাবে এসেছে সেটা কোনো বিবেচনার বিষয়ই নয়। স্বাধীনতা পুঁজিবাদকে স্বাধীন করে দিয়েছে।
এই যে উন্নতি এর জন্য প্রতারণা, জাল-জোচ্চুরি, হত্যা–কোনো কিছুই অন্যায় নয়। ছোট একটা খবর, কিন্তু এ খবরে অনেক সংবাদ রয়েছে। বগুড়ায় একটি পুকুরের লিজ নেওয়ার জন্য শিক্ষক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সরকারি চাকুরে হেন লোক নেই, যে জেলে সাজেনি। জেলে হওয়াটা মোটেই সম্মানজনক নয়। কিন্তু জেলে সাজতে কোনো প্রকার আপত্তি নেই, যদি পুকুরের দখল পাওয়া যায়, যদি সম্ভব হয় পুকুরচুরি। উন্নতির এই কারাগারে ভদ্র-অভদ্র পার্থক্য নেই। সবাই সমান।
স্বাধীনতা নয়, আমরা মুক্তিই চেয়েছিলাম। মুক্তিতে আমাদের অগ্রগতি হবে ভেবেছিলাম। সেই অগ্রগামিতার ভেতর উন্নতির স্বপ্নও ছিল। কিন্তু যুদ্ধের সময় আমরা ব্যক্তিগত উন্নতির কথা ভাবিনি। সমষ্টিগত উন্নতির স্বপ্ন দ্বারাই তাড়িত হচ্ছিলাম।
তবে আন্দোলন কিন্তু সব সময়েই পুঁজিবাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। ব্রিটিশ আমলে ছিল। পাকিস্তান আমলেও ছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনটা মোটেই পুঁজিবাদবিরোধী ছিল না। জিন্নাহ তো বটেই, গান্ধীও পুঁজিবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। পাকিস্তানের কালে আওয়ামী লীগই শেষ পর্যন্ত প্রধান রাজনৈতিক দল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ যে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল, তা মোটেই নয়। সমাজতন্ত্রীদের আওয়ামী লীগ ঘরের শত্রু বিভীষণ হিসেবেই দেখত। সমাজতন্ত্রের কথা আওয়ামী লীগ প্রথম বলেছে সত্তরের নির্বাচনে, তার আগে কখনো বলেনি। সেই বলাটাও জনগণের চাপে ঘটেছে। রাষ্ট্রের নতুন সংবিধানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার ছিল, সেটাও ঘটেছে জনগণের ওই চাপেই। আওয়ামী লীগের ভেতরেই খোন্দকার মোশতাক ছিলেন। তিনি ঘোরতর ও ঘোষিত রূপেই পুঁজিবাদে আস্থাশীল ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান সমাজতন্ত্র আনার কথা ঘোষণা করেছিলেন। আর সে জন্যই পুঁজিবাদে বিশ্বাসীরা তাঁকে সরিয়ে দিয়েছেন। এটা বজ্রাঘাতের মতো ব্যাপার যে শেখ মুজিব সমাজতন্ত্রীদেরই শত্রু ভেবেছেন, পুঁজিবাদীদের নয়। অথচ পুঁজিবাদীরাই ছিলেন তাঁর প্রকৃত শত্রু। তাঁকে সরিয়ে দিয়ে যাঁরা এলেন, তাঁরা তো পরিষ্কারভাবেই পুঁজিবাদী এবং তাঁদের কাজটা হচ্ছে পুঁজিবাদের বিকাশের জন্য পথটাকে প্রশস্ত ও পরিষ্কার করে দেওয়া। সেই কাজই তাঁরা করেছেন। ফলে ‘উন্নতি’ যা হওয়ার হয়েছে পুঁজিবাদী ধরনেই। সিঁড়ি ভেঙে নয়, ধাপে ধাপেও নয়, উন্মাদের মতো লোকে উন্নতি করেছে লাফিয়ে লাফিয়ে।
ভূমি ফুঁড়ে যদি কেবল পাহাড়ই গজাতে থাকে, তাহলে ভূমিকম্প ঘটবে–এটা স্বাভাবিক। সমাজেও হয়তো ভূমিকম্প দেখতে পাব আমরা। বিস্ফোরণ ঘটবে। কিন্তু সেটা তো আমরা চাই না। আমরা চাই স্বাভাবিক পথে অগ্রগতি।
প্রাকৃতিক ভূমিকম্পের বিরুদ্ধে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্ভবপর, সামাজিক ভূমিকম্পকেও ঠেকানো যেতে পারে, যদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। সেই পদক্ষেপটা হচ্ছে পুঁজিবাদী উন্নতির পথ ত্যাগ করে গণতান্ত্রিক উন্নতির পথ ধরা। এই গণতান্ত্রিক উন্নতিরই অপর নাম হচ্ছে সমাজতন্ত্র।
এটা তাত্ত্বিকভাবে আমরা বুঝি, কিন্তু একে বাস্তবিক করে তোলার উপায়টা কী? উপায় হচ্ছে আন্দোলন। এই আন্দোলন মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো করবে না। তাঁরা সবাই পুঁজিবাদী। তাদের ভেতরে যে লড়াই, সেটা একে অপরকে পেছনে ফেলে উন্নতি করার চেষ্টা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। আজ যেটা দরকার, তা হলো বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ। যে শক্তি উন্নতিকে নদীর প্রবাহে পরিণত করতে চাইবে, পাহাড়–পর্বতে দেশ ছেয়ে যাক–এমনটা চাইবে না। এই রাজনীতির লক্ষ্য হবে গোটা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা। মানুষ যাতে কঙ্কাল না হয়, না হয় ক্ষুধার্ত বন্য পশু। আমাদের অবশ্যই সামনের দিকে এগোতে হবে। তার জন্য বৈষম্য দূর করা চাই। বৈষম্য বাড়বে অথচ আমরা এগোবো–এটা মোটেই সম্ভবপর নয়।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪