রফিকুর রশীদ
রফিকুর রশীদ, কথাসাহিত্যিক‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’—অন্নদা দেবীর কাছে একদা এই অসামান্য বর প্রার্থনা করেছিল ঈশ্বর পাটনি। ভৈরব নদীপারের খুব সামান্য মানুষ। খেয়া পারাপারের পাটনি (মাঝি) সে। সন্তান-সন্ততির সুখ-সচ্ছলতার জন্য এইটুকু চাওয়া তার।
নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর (১৭১২-১৭৬০) অন্নদামঙ্গল কাব্যে যে ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক পটভূমি তুলে ধরেছেন তাতে অনুমিত হয়, অমর চরিত্র ঈশ্বর পাটনি ছিল নদীয়া সন্নিহিত মেহেরপুর অঞ্চলের মানুষ। শুধু নিজের সন্তান নয়, মূলত এতদঞ্চলের দারিদ্র্যলাঞ্ছিত সাধারণ মানুষের ঐকান্তিক প্রত্যাশাই উচ্চারিত হয়েছে দেবীর কাছে তার বর প্রার্থনার মধ্য দিয়ে।
আজ সেই ভৈরবে নাব্য নেই, নদীপারের কোথাও ঈশ্বর পাটনির অস্তিত্ব খুঁজেও পাওয়া যাবে না হয়তো। তবে এ অঞ্চলের মানুষ দুধে-ভাতে থাকার সচ্ছলতার জন্য সেকালের দেবীনির্ভরতার জায়গায় একালে হয়ে উঠেছে স্ব–উদ্যোগী ও কর্মতৎপর। বিশেষত শিক্ষিত বেকার তরুণেরা আধুনিক কৃষিভিত্তিক নানান কর্মোদ্যোগের মধ্য দিয়ে মেহেরপুর জেলার মানচিত্রে স্বনির্ভরতার নতুন মাত্রা যুক্ত করে চলেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী খ্যাত মুজিবনগরের স্মৃতিধন্য জেলা মেহেরপুরের বর্ণাঢ্য অতীত আছে। শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। একদা নদীপথে যশোর যাত্রাকালে মোগল সেনাপতি মানসিংহ যাত্রা বিরতি করেন এতদঞ্চলে। কথিত আছে, নবাব আলিবর্দি খাঁ বজরাযোগে মৃগয়ায় এসে প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ে (বর্তমান) মুজিবনগর উপজেলার আমদহ-বাগোয়ানের বিধবা রাজু গোয়ালিনীর আতিথ্য গ্রহণ করেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নেতাজি সুভাষ বসু থেকে মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পর্যন্ত বহু রাজনৈতিক নেতার পদস্পর্শে ধন্য হয়েছে মেহেরপুর। আর ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল এ জেলার (তখনো মহকুমা) মুক্ত মাটিতে (বৈদ্যনাথতলায়) স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় এবং এখান থেকেই দেশি-বিদেশি বহু সাংবাদিক ও স্থানীয় জনতার সামনে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়, সেই ইতিহাস সবার জানা।
এরই মাঝে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে বাংলাদেশের। অথচ বঙ্গবন্ধুর ঘোষণায় এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলা হয়েছে, সেই মুক্তির স্বপ্ন দীর্ঘকাল অধরাই ছিল স্বাধীনতার সূতিকাগার মেহেরপুর জেলার মানুষের কাছে। তারা প্রায় ভুলতেই বসেছিল যে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারেরও ভূমিকা থাকার কথা ছিল। তবে বছরের পর বছর তারা সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকেনি। নিজেরাই পথ খুঁজেছে অর্থনৈতিক মুক্তির।
কৃষিনির্ভর এই অঞ্চলের মানুষ প্রথমেই মনোযোগ দেয় কৃষিক্ষেত্রে। এখানে বন্যা-জলোচ্ছ্বাস নেই, অতিবৃষ্টি কিংবা তীব্র খরাও নেই। কৃষিতেই বিপ্লব সাধিত হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। সরকারের কৃষিনীতি কৃষকবান্ধব ছিল না বলেই প্রচলিত ফসল উৎপাদনের বাইরে বিকল্প ফসল উৎপাদনে উৎসাহিত করা হয়নি।
বর্তমান সরকারের কৃষকবান্ধব কৃষিনীতি, সার-সেচ ও কৃষি উপকরণে ভর্তুকি ও নানাবিধ প্রণোদনা, সেই সঙ্গে সহজ শর্তে কৃষিঋণ প্রকল্প এবং তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা মেহেরপুর জেলার শিক্ষিত বেকার যুবসম্প্রদায়কে আত্মকর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। ধান-পাট-ছোলা-মসুর-গম চাষের প্রচলিত বৃত্তকে তারা নতুনভাবে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়।
গাংনী উপজেলার সাহারবাটিতে গড়ে উঠেছে সবজিপল্লি। এখানে উৎপাদিত বাঁধাকপি, ফুলকপি, শিম, বরবটি, মিষ্টি কুমড়া, বেগুন, গাজর, ব্রোকলি, করলা, তরমুজ সারা জেলার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশালের সবজিবাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। ঢাকার কারওয়ান বাজার কিংবা চট্টগ্রামের রিয়াজুদ্দিন মার্কেটের সবজি আড়তে ‘সাহারবাটি’ এখন প্রতিষ্ঠিত নাম। সাহারবাটির সবজিবিপ্লব এখন ছড়িয়ে পড়েছে এই জেলার বিভিন্ন গ্রামে। শুধু সবজি নয়, সবজিবীজ থেকেও বিস্তর অর্থ উপার্জন করছেন এই অঞ্চলের কৃষি উদ্যোক্তারা।
সবজি চাষের পাশাপাশি মেহেরপুরের শিক্ষিত বেকার যুবকেরা ফল চাষের দিকেও গুরুত্ব দিয়েছে। এতদঞ্চলের সুস্বাদু আম-লিচুর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। এখন তা রপ্তানিও করা হচ্ছে। শতবর্ষী প্রাচীন বাগানের জায়গায় এখন প্রতিটি গ্রামে তৈরি হয়েছে আম লিচুর সুদৃশ্য নতুন নতুন বাগান। শৌখিন ফল চাষ নয়, বর্তমানে তা হয়ে উঠেছে অর্থকরী ফসলের চাষ। কলার চাষও এ জেলার অনেক তরুণ উদ্যোক্তার ভাগ্য বদলে দিয়েছে।
‘কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত’—খনার বচন আবারও সত্য হয়ে উঠেছে এখানে। আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির আশীর্বাদে উন্নত জাতের পেয়ারা, কুল, মাল্টা, স্ট্রবেরি প্রভৃতি ফলের চাষ মেহেরপুরের কৃষিতে যেমন নতুন মাত্রা যোগ করেছে, তেমনি এ জেলার কৃষি উদ্যোক্তাদের এনে দিয়েছে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা।
বিস্ময়কর হলেও সত্য, মহিষাখোলা গ্রামের সিঙ্গাপুরফেরত শিক্ষিত যুবক মাবুদ আলী নিজের জমির পাশে ১০ বিঘা জমি লিজ (ইজারা) নিয়ে আবাদ করেছেন ড্রাগন ফলের। আত্মকর্মসংস্থানের জন্য বিদেশি এই ফলের চাষ ছিল তাঁর জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ায় সেই চ্যালেঞ্জ তাঁর সফল হয়েছে।
মেহেরপুর শহরের এক সাহসী উদ্যোক্তা ২৯ বিঘা জমিতে ক্যাপসিক্যাম চাষ করে বিপুল সাফল্যের মুখ দেখেছেন। ক্যাপসিক্যামের চাষকে অনেকেই অর্থকরী আবাদ বলে গ্রহণ করেছেন।
এ ছাড়া এ জেলার অনেক গৃহিণী উদ্যোক্তা হাঁস-মুরগি পালনের পাশাপাশি বাড়ির উঠানে লেটুস, পুদিনা, মাশরুমসহ নানান জাতের শাকের আবাদ করে সংসারে বাড়তি উপার্জনের সংস্থান ঘটিয়েছেন।
সদর উপজেলার শালিখা গ্রামের আধুনিক চাষি আব্দুস সালাম স্ট্রবেরি চাষ করে মেহেরপুরের বাইরে বাজারজাত করার মাধ্যমে যে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন; তা অনেকের কাছেই অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে।
মেহেরপুর জেলার মাঠে মাঠে এবং বসতভিটার আশপাশে প্রাকৃতিকভাবেই অনেক খেজুরগাছ জন্মে, এখানকার খেজুরগুড়ের সুখ্যাতি দীর্ঘকালের। এই অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে মুজিবনগর উপজেলার এক কৃষি উদ্যোক্তা মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের সীমানাসংলগ্ন মাঠে সৌদি খেজুরের পরিকল্পিত চাষ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। এই চাষের অর্থকরী দিক অনেককে বিপুলভাবে উৎসাহিত করেছে।
এত দিন বাড়ির সামনে ছোটখাটো ফুলবাগান দেখেই সবাই অভ্যস্ত। এই ফুলেরও যে বাণিজ্যিক মূল্য আছে, সেটা প্রমাণ করেছে মেহেরপুর সদরের হরিরামপুর এবং আমঝুপি গ্রামের কয়েক জন ফুলচাষি। দূর মফস্বলে উৎপাদিত নানান জাতের ফুল ঢাকার বাজারে বিক্রির মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের অভিনব দিগন্ত খুঁজে পেয়েছেন এখানকার ফুলচাষিরা।
গাংনী উপজেলার ষোলটাকা এবং বানিয়াপুকুর গ্রাম দুটিকে বলা হয় ‘মৎস্যপল্লি’। এ অঞ্চলের মাটির পানি ধারণক্ষমতা বেশি হওয়ায় শুধু উল্লিখিত দুটি গ্রামই নয়, আশপাশের সব গ্রামের বহু পুকুরে এখন পরিকল্পিতভাবে হচ্ছে মাছের চাষ। প্রকৃতি-নির্ভরতার পরিবর্তে শিক্ষিত বেকার যুবকেরা আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মৎস্য চাষের উদ্যোগ নিয়ে অর্থনৈতিকভাবে সফল হয়েছেন। এ সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে জেলার মরা নদী ও মজে যাওয়া খালবিলে পুকুর খনন করে এবং বিশেষভাবে বাঁধ দিয়ে স্থানীয় অনেক শিক্ষিত যুবক এখন মাছ চাষে মনোযোগ দিয়েছেন।
মেহেরপুরের বেকার যুবকদের আত্মকর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ব্যক্তি উদ্যোগে পশুপালনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ জেলায় এমন কোনো গ্রাম পাওয়া যাবে না, যেখানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গো-পালন হয় না। বৃহদায়তনের প্রকল্প না থাক, আধুনিক পদ্ধতিতে মাত্র দু-চারটি গরু পালনের মধ্য দিয়েই অনেকে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি করে নিয়েছেন। গো-পালনের পাশাপাশি ব্ল্যাক বেঙ্গল প্রজাতির ছাগলও পালিত হচ্ছে এ জেলার ঘরে ঘরে; যা যথেষ্ট জনপ্রিয় এবং অর্থকরী হয়ে উঠেছে। ভেড়াসদৃশ দ্রুত বর্ধনশীল গাড়ল পালন এখানকার অনেক বেকার যুবককে এনে দিয়েছে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা।
পোলট্রিশিল্প এখন পৌঁছে গেছে এ জেলার গ্রামে গ্রামে। আত্মকর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে প্রায় প্রতিটি গ্রামে গড়ে উঠেছে হাঁস–মুরগির খামার। ক্ষুদ্র বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্জিত সীমিত মুনাফা থেকে গ্রামের অনেক বেকার এখন স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। ফলে চাকরির মুখাপেক্ষিতা অনেকাংশে কমেছে।
তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার এই জেলার শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর সামনে খুলে দিয়েছে কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত। অনলাইনে মেহেরপুরের সূচিশিল্প এবং নকশিকাঁথার বিজ্ঞাপন প্রচার ও অর্ডার (ফরমাশ) নেওয়া হচ্ছে। এমনকি আম-লিচু সরবরাহের অর্ডারও হচ্ছে অনলাইনে। এই উদ্যোগের ফলে উজলপুরের (সদর উপজেলা) কাঁথাপল্লিতে তৈরি নকশিকাঁথা এখন পৌঁছে যাচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকায়। কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা করোনাকালীন দীর্ঘ অবকাশে তৈরি পোশাকে বুটিক ও ফেব্রিকসের কাজ সম্পন্ন করে অনলাইনে বিপণন করছেন সারা দেশে। ঐতিহাসিক মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের ছবি ও লোগো ব্যবহার করে তাঁরা গত শীত মৌসুমে বিশেষ ধরনের জ্যাকেট ও হুডিকে নতুন আঙ্গিকে অনলাইনে বাজারজাত করেছেন। এভাবেই নিজেদের কর্মসংস্থানের উপায় নিজেরাই খুঁজে নিয়েছেন।
এই জেলার রেমিট্যান্স যোদ্ধাও উল্লেখযোগ্য। ৯০ শতাংশ ঘরের যুবক বিদেশে থাকেন এমন গ্রাম আছে অনেক। এরই মধ্যে বর্তমান সরকার মুজিবনগরের স্মৃতিবিজড়িত এই জেলায় পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, স্থলবন্দর, চেকপোস্ট, রেলপথ, বৃহত্তম কৃষিখামার ও আইটি (তথ্যপ্রযুক্তি) পল্লি স্থাপনের ঘোষণা দিয়ে জেলাবাসীর অন্তরে নতুন আশার সঞ্চার ঘটিয়েছে।
সরকারি এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বদলে যাবে মেহেরপুরের আর্থসামাজিক অবস্থা এবং উন্মুক্ত হবে কর্মসংস্থানের বিশাল দিগন্ত। তার ফলে মেহেরপুরের সন্তান ‘দুধে-ভাতে’ থাকার সম্মানযোগ্য পথ খুঁজে পাবে বলে পর্যবেক্ষক মহলের বিশ্বাস।
রফিকুর রশীদ
কথাসাহিত্যিক
রফিকুর রশীদ, কথাসাহিত্যিক‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’—অন্নদা দেবীর কাছে একদা এই অসামান্য বর প্রার্থনা করেছিল ঈশ্বর পাটনি। ভৈরব নদীপারের খুব সামান্য মানুষ। খেয়া পারাপারের পাটনি (মাঝি) সে। সন্তান-সন্ততির সুখ-সচ্ছলতার জন্য এইটুকু চাওয়া তার।
নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর (১৭১২-১৭৬০) অন্নদামঙ্গল কাব্যে যে ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক পটভূমি তুলে ধরেছেন তাতে অনুমিত হয়, অমর চরিত্র ঈশ্বর পাটনি ছিল নদীয়া সন্নিহিত মেহেরপুর অঞ্চলের মানুষ। শুধু নিজের সন্তান নয়, মূলত এতদঞ্চলের দারিদ্র্যলাঞ্ছিত সাধারণ মানুষের ঐকান্তিক প্রত্যাশাই উচ্চারিত হয়েছে দেবীর কাছে তার বর প্রার্থনার মধ্য দিয়ে।
আজ সেই ভৈরবে নাব্য নেই, নদীপারের কোথাও ঈশ্বর পাটনির অস্তিত্ব খুঁজেও পাওয়া যাবে না হয়তো। তবে এ অঞ্চলের মানুষ দুধে-ভাতে থাকার সচ্ছলতার জন্য সেকালের দেবীনির্ভরতার জায়গায় একালে হয়ে উঠেছে স্ব–উদ্যোগী ও কর্মতৎপর। বিশেষত শিক্ষিত বেকার তরুণেরা আধুনিক কৃষিভিত্তিক নানান কর্মোদ্যোগের মধ্য দিয়ে মেহেরপুর জেলার মানচিত্রে স্বনির্ভরতার নতুন মাত্রা যুক্ত করে চলেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী খ্যাত মুজিবনগরের স্মৃতিধন্য জেলা মেহেরপুরের বর্ণাঢ্য অতীত আছে। শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। একদা নদীপথে যশোর যাত্রাকালে মোগল সেনাপতি মানসিংহ যাত্রা বিরতি করেন এতদঞ্চলে। কথিত আছে, নবাব আলিবর্দি খাঁ বজরাযোগে মৃগয়ায় এসে প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ে (বর্তমান) মুজিবনগর উপজেলার আমদহ-বাগোয়ানের বিধবা রাজু গোয়ালিনীর আতিথ্য গ্রহণ করেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নেতাজি সুভাষ বসু থেকে মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পর্যন্ত বহু রাজনৈতিক নেতার পদস্পর্শে ধন্য হয়েছে মেহেরপুর। আর ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল এ জেলার (তখনো মহকুমা) মুক্ত মাটিতে (বৈদ্যনাথতলায়) স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় এবং এখান থেকেই দেশি-বিদেশি বহু সাংবাদিক ও স্থানীয় জনতার সামনে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়, সেই ইতিহাস সবার জানা।
এরই মাঝে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে বাংলাদেশের। অথচ বঙ্গবন্ধুর ঘোষণায় এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলা হয়েছে, সেই মুক্তির স্বপ্ন দীর্ঘকাল অধরাই ছিল স্বাধীনতার সূতিকাগার মেহেরপুর জেলার মানুষের কাছে। তারা প্রায় ভুলতেই বসেছিল যে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারেরও ভূমিকা থাকার কথা ছিল। তবে বছরের পর বছর তারা সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকেনি। নিজেরাই পথ খুঁজেছে অর্থনৈতিক মুক্তির।
কৃষিনির্ভর এই অঞ্চলের মানুষ প্রথমেই মনোযোগ দেয় কৃষিক্ষেত্রে। এখানে বন্যা-জলোচ্ছ্বাস নেই, অতিবৃষ্টি কিংবা তীব্র খরাও নেই। কৃষিতেই বিপ্লব সাধিত হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। সরকারের কৃষিনীতি কৃষকবান্ধব ছিল না বলেই প্রচলিত ফসল উৎপাদনের বাইরে বিকল্প ফসল উৎপাদনে উৎসাহিত করা হয়নি।
বর্তমান সরকারের কৃষকবান্ধব কৃষিনীতি, সার-সেচ ও কৃষি উপকরণে ভর্তুকি ও নানাবিধ প্রণোদনা, সেই সঙ্গে সহজ শর্তে কৃষিঋণ প্রকল্প এবং তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা মেহেরপুর জেলার শিক্ষিত বেকার যুবসম্প্রদায়কে আত্মকর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। ধান-পাট-ছোলা-মসুর-গম চাষের প্রচলিত বৃত্তকে তারা নতুনভাবে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়।
গাংনী উপজেলার সাহারবাটিতে গড়ে উঠেছে সবজিপল্লি। এখানে উৎপাদিত বাঁধাকপি, ফুলকপি, শিম, বরবটি, মিষ্টি কুমড়া, বেগুন, গাজর, ব্রোকলি, করলা, তরমুজ সারা জেলার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশালের সবজিবাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। ঢাকার কারওয়ান বাজার কিংবা চট্টগ্রামের রিয়াজুদ্দিন মার্কেটের সবজি আড়তে ‘সাহারবাটি’ এখন প্রতিষ্ঠিত নাম। সাহারবাটির সবজিবিপ্লব এখন ছড়িয়ে পড়েছে এই জেলার বিভিন্ন গ্রামে। শুধু সবজি নয়, সবজিবীজ থেকেও বিস্তর অর্থ উপার্জন করছেন এই অঞ্চলের কৃষি উদ্যোক্তারা।
সবজি চাষের পাশাপাশি মেহেরপুরের শিক্ষিত বেকার যুবকেরা ফল চাষের দিকেও গুরুত্ব দিয়েছে। এতদঞ্চলের সুস্বাদু আম-লিচুর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। এখন তা রপ্তানিও করা হচ্ছে। শতবর্ষী প্রাচীন বাগানের জায়গায় এখন প্রতিটি গ্রামে তৈরি হয়েছে আম লিচুর সুদৃশ্য নতুন নতুন বাগান। শৌখিন ফল চাষ নয়, বর্তমানে তা হয়ে উঠেছে অর্থকরী ফসলের চাষ। কলার চাষও এ জেলার অনেক তরুণ উদ্যোক্তার ভাগ্য বদলে দিয়েছে।
‘কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত’—খনার বচন আবারও সত্য হয়ে উঠেছে এখানে। আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির আশীর্বাদে উন্নত জাতের পেয়ারা, কুল, মাল্টা, স্ট্রবেরি প্রভৃতি ফলের চাষ মেহেরপুরের কৃষিতে যেমন নতুন মাত্রা যোগ করেছে, তেমনি এ জেলার কৃষি উদ্যোক্তাদের এনে দিয়েছে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা।
বিস্ময়কর হলেও সত্য, মহিষাখোলা গ্রামের সিঙ্গাপুরফেরত শিক্ষিত যুবক মাবুদ আলী নিজের জমির পাশে ১০ বিঘা জমি লিজ (ইজারা) নিয়ে আবাদ করেছেন ড্রাগন ফলের। আত্মকর্মসংস্থানের জন্য বিদেশি এই ফলের চাষ ছিল তাঁর জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ায় সেই চ্যালেঞ্জ তাঁর সফল হয়েছে।
মেহেরপুর শহরের এক সাহসী উদ্যোক্তা ২৯ বিঘা জমিতে ক্যাপসিক্যাম চাষ করে বিপুল সাফল্যের মুখ দেখেছেন। ক্যাপসিক্যামের চাষকে অনেকেই অর্থকরী আবাদ বলে গ্রহণ করেছেন।
এ ছাড়া এ জেলার অনেক গৃহিণী উদ্যোক্তা হাঁস-মুরগি পালনের পাশাপাশি বাড়ির উঠানে লেটুস, পুদিনা, মাশরুমসহ নানান জাতের শাকের আবাদ করে সংসারে বাড়তি উপার্জনের সংস্থান ঘটিয়েছেন।
সদর উপজেলার শালিখা গ্রামের আধুনিক চাষি আব্দুস সালাম স্ট্রবেরি চাষ করে মেহেরপুরের বাইরে বাজারজাত করার মাধ্যমে যে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন; তা অনেকের কাছেই অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে।
মেহেরপুর জেলার মাঠে মাঠে এবং বসতভিটার আশপাশে প্রাকৃতিকভাবেই অনেক খেজুরগাছ জন্মে, এখানকার খেজুরগুড়ের সুখ্যাতি দীর্ঘকালের। এই অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে মুজিবনগর উপজেলার এক কৃষি উদ্যোক্তা মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের সীমানাসংলগ্ন মাঠে সৌদি খেজুরের পরিকল্পিত চাষ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। এই চাষের অর্থকরী দিক অনেককে বিপুলভাবে উৎসাহিত করেছে।
এত দিন বাড়ির সামনে ছোটখাটো ফুলবাগান দেখেই সবাই অভ্যস্ত। এই ফুলেরও যে বাণিজ্যিক মূল্য আছে, সেটা প্রমাণ করেছে মেহেরপুর সদরের হরিরামপুর এবং আমঝুপি গ্রামের কয়েক জন ফুলচাষি। দূর মফস্বলে উৎপাদিত নানান জাতের ফুল ঢাকার বাজারে বিক্রির মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের অভিনব দিগন্ত খুঁজে পেয়েছেন এখানকার ফুলচাষিরা।
গাংনী উপজেলার ষোলটাকা এবং বানিয়াপুকুর গ্রাম দুটিকে বলা হয় ‘মৎস্যপল্লি’। এ অঞ্চলের মাটির পানি ধারণক্ষমতা বেশি হওয়ায় শুধু উল্লিখিত দুটি গ্রামই নয়, আশপাশের সব গ্রামের বহু পুকুরে এখন পরিকল্পিতভাবে হচ্ছে মাছের চাষ। প্রকৃতি-নির্ভরতার পরিবর্তে শিক্ষিত বেকার যুবকেরা আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মৎস্য চাষের উদ্যোগ নিয়ে অর্থনৈতিকভাবে সফল হয়েছেন। এ সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে জেলার মরা নদী ও মজে যাওয়া খালবিলে পুকুর খনন করে এবং বিশেষভাবে বাঁধ দিয়ে স্থানীয় অনেক শিক্ষিত যুবক এখন মাছ চাষে মনোযোগ দিয়েছেন।
মেহেরপুরের বেকার যুবকদের আত্মকর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ব্যক্তি উদ্যোগে পশুপালনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ জেলায় এমন কোনো গ্রাম পাওয়া যাবে না, যেখানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গো-পালন হয় না। বৃহদায়তনের প্রকল্প না থাক, আধুনিক পদ্ধতিতে মাত্র দু-চারটি গরু পালনের মধ্য দিয়েই অনেকে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি করে নিয়েছেন। গো-পালনের পাশাপাশি ব্ল্যাক বেঙ্গল প্রজাতির ছাগলও পালিত হচ্ছে এ জেলার ঘরে ঘরে; যা যথেষ্ট জনপ্রিয় এবং অর্থকরী হয়ে উঠেছে। ভেড়াসদৃশ দ্রুত বর্ধনশীল গাড়ল পালন এখানকার অনেক বেকার যুবককে এনে দিয়েছে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা।
পোলট্রিশিল্প এখন পৌঁছে গেছে এ জেলার গ্রামে গ্রামে। আত্মকর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে প্রায় প্রতিটি গ্রামে গড়ে উঠেছে হাঁস–মুরগির খামার। ক্ষুদ্র বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্জিত সীমিত মুনাফা থেকে গ্রামের অনেক বেকার এখন স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। ফলে চাকরির মুখাপেক্ষিতা অনেকাংশে কমেছে।
তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার এই জেলার শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর সামনে খুলে দিয়েছে কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত। অনলাইনে মেহেরপুরের সূচিশিল্প এবং নকশিকাঁথার বিজ্ঞাপন প্রচার ও অর্ডার (ফরমাশ) নেওয়া হচ্ছে। এমনকি আম-লিচু সরবরাহের অর্ডারও হচ্ছে অনলাইনে। এই উদ্যোগের ফলে উজলপুরের (সদর উপজেলা) কাঁথাপল্লিতে তৈরি নকশিকাঁথা এখন পৌঁছে যাচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকায়। কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা করোনাকালীন দীর্ঘ অবকাশে তৈরি পোশাকে বুটিক ও ফেব্রিকসের কাজ সম্পন্ন করে অনলাইনে বিপণন করছেন সারা দেশে। ঐতিহাসিক মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের ছবি ও লোগো ব্যবহার করে তাঁরা গত শীত মৌসুমে বিশেষ ধরনের জ্যাকেট ও হুডিকে নতুন আঙ্গিকে অনলাইনে বাজারজাত করেছেন। এভাবেই নিজেদের কর্মসংস্থানের উপায় নিজেরাই খুঁজে নিয়েছেন।
এই জেলার রেমিট্যান্স যোদ্ধাও উল্লেখযোগ্য। ৯০ শতাংশ ঘরের যুবক বিদেশে থাকেন এমন গ্রাম আছে অনেক। এরই মধ্যে বর্তমান সরকার মুজিবনগরের স্মৃতিবিজড়িত এই জেলায় পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, স্থলবন্দর, চেকপোস্ট, রেলপথ, বৃহত্তম কৃষিখামার ও আইটি (তথ্যপ্রযুক্তি) পল্লি স্থাপনের ঘোষণা দিয়ে জেলাবাসীর অন্তরে নতুন আশার সঞ্চার ঘটিয়েছে।
সরকারি এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বদলে যাবে মেহেরপুরের আর্থসামাজিক অবস্থা এবং উন্মুক্ত হবে কর্মসংস্থানের বিশাল দিগন্ত। তার ফলে মেহেরপুরের সন্তান ‘দুধে-ভাতে’ থাকার সম্মানযোগ্য পথ খুঁজে পাবে বলে পর্যবেক্ষক মহলের বিশ্বাস।
রফিকুর রশীদ
কথাসাহিত্যিক
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪