সঞ্জয় সরকার
লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি চর্চার এক উর্বর ভূমি নেত্রকোনা। বাউল, ভাটিয়ালি, জারি, সারি, পালা, ঢপ, কিচ্ছা, ধামাইল, মেয়েলি গীত, গাইনের গীত, ঘাটুগান, কবিগানসহ লোকগানের হাজারো ধারক-বাহকের জন্ম এ জেলায়। কিন্তু আধুনিক সংস্কৃতির ব্যাপক প্রচার-প্রসার ও বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসনে সারা দেশের মতো এখানেও পল্লিগানের বেশির ভাগ ধারা আজ বিলুপ্তির পথে। এর মধ্যেও যে ধারাটি ক্ষয়িষ্ণুভাবে টিকে আছে, সেটি হচ্ছে বাউলগান। এখনো প্রায় রাতেই এখানকার গ্রামগঞ্জে বাউলগানের আসর বসে। গভীর রাতে দূর থেকে ভেসে আসে বাউলদের সহজিয়া সুর।
একসময় বাউলগান বলতেই ছিল বৈঠকি আসরের গান। এটিই বাউলগানের আদি ধারা। সাধারণত পীর-ফকির ও সাধু-সন্ন্যাসীদের আস্তানায়, ধনী ব্যক্তিদের বৈঠকখানায়, হাটবাজারে বৈঠকি বাউল গানের আসর জমত। দর্শক-শ্রোতারা চাঁদোয়া বা শামিয়ানার নিচে গোল হয়ে বসতেন। আসরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বা বসে পালাক্রমে গান করতেন এক বা একাধিক বাউল। দিনে দিনে বাউলগানের আনুষ্ঠানিকতার ধরন পাল্টায়। প্রচলন হয় মঞ্চের। কিন্তু তাই বলে বৈঠকি আসরের আগের রেওয়াজ হারিয়ে যায়নি। মঞ্চের প্রচলন বেশি হলেও গ্রামাঞ্চলে এখনো মঞ্চ ছাড়া আসর বসতে দেখা যায়।
কিন্তু প্রচলিত রেওয়াজের বাইরে ত্রিশের দশকে এক ব্যতিক্রমী ধারার বাউলগানের প্রচলন শুরু হয় নেত্রকোনায়। এর নাম ‘মালজোড়া বাউলগান’। মনে করা হয়, মালজোড়া বাউলগানের ধারণাটি এসেছে কবিগান থেকে। নেত্রকোনাসহ পূর্ব ময়মনসিংহ অঞ্চলে একসময় কবিগানের জয়জয়কার ছিল। কবিগান ছিল মূলত দুই কবিয়ালের লড়াই বা বাগ্যুদ্ধ। সেই ধারাটিই বাউলগানে সংমিশ্রিত হয়ে ‘মালজোড়া বাউলগান’ নামে নতুন আরেক ধারার প্রচলন করে। মালজোড়া বাউলগানের ‘মাল’ শব্দটি এসেছে ‘কুস্তির লড়াই’ থেকে। এ অঞ্চলে আগে যাঁরা কুস্তি করতেন তাঁদের ‘মাল’ বলা হতো। মালজোড়া বাউলগানও একধরনের লড়াই। গানে গানে তাত্ত্বিক বিভিন্ন প্রশ্নোত্তরের লড়াই এটি। এখানেও একজন আরেকজনকে পরাস্ত করার চেষ্টা করেন। তাই মালজোড়ার শিল্পীরাও পান ‘মাল’–এর খ্যাতি।
মালজোড়া বাউলগানের মূল প্রবর্তক নেত্রকোনার বাহিরচাপড়া গ্রামের বাউলসাধক রশিদ উদ্দিন। রশিদ নিজেও প্রথমজীবনে কবিগানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর একটি নিজস্ব বাউল ঘরানা ছিল। এ কারণে তাঁকে এ অঞ্চলের বাউল শিরোমণি মনে করা হয়। গবেষক গোলাম এরশাদুর রহমান ‘নেত্রকোনার বাউলগীতি’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘অত্রাঞ্চলের বাউলগানের আসরে তত্ত্বভিত্তিক বিতর্কানুষ্ঠানের (মালজোড়া বাউলগান) প্রচলিত ধারার প্রবর্তক হলেন বাউলসাধক রশিদ উদ্দিন।’ তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় সংগীতসাধক রামকানাই দাশের বক্তব্যেরও। রামকানাইও তাঁর ‘সঙ্গীত ও আমার জীবন’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘একজন অসাধারণ তাত্ত্বিক বাউলের নাম রশিদ উদ্দিন। যুগের এবং সমাজজীবনের পরিবর্তনকে বিবেচনায় রেখে কবিগানের সংগীতাংশের পর্যালোচনাগুলোকে বাদ দিয়ে কেবল দুই কবিয়ালের তর্কাতর্কি অংশটিকে বাউলগানে নিয়ে এসে নিজ বাড়িতে প্রাতিষ্ঠানিক বাউল শিক্ষাকেন্দ্র চালু করেছিলেন তিনি। এ তর্কাতর্কির অংশটিকে কাজে লাগিয়েই মালজোড়া তৈরি হয় এবং বাউলসাধক রশিদ উদ্দিনই এর প্রধান প্রবর্তক বলে আমার বিশ্বাস।’
বাউলসাধক রশিদ উদ্দিনের উদ্যোগে ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বর মাসে নেত্রকোনা শহরের গরুহাট্টায় প্রথম তত্ত্বভিত্তিক বিতর্কমূলক বাউলগানের আয়োজন করা হয়। এ বিতর্কে বাউল রশিদ উদ্দিন, জালাল উদ্দিন খাঁ ও চান খাঁ অংশ নেন। বিচারকের আসনে ছিলেন পূর্বধলার লেটিরকান্দার পীর আছমত আলী শাহ্ ফকির ও সিংহেরবাংলার প্রখ্যাত কবিয়াল বিজয় নারায়ণ আচার্যসহ কয়েকজন। এ ছাড়া অন্য বাউলদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তৈয়ব আলী, মিরাজ আলী, ইদ্রিছ মিয়া, চান মিয়া প্রমুখ। বিপুলসংখ্যক দর্শকের উপস্থিতিতে প্রথম আসরেই জমে ওঠে বিতর্কমূলক বাউলগানের নতুন ধারাটি। আর এর প্রভাব পড়ে সারা জেলায়। পরে বাউল রশিদ ও তাঁর শিষ্যদের সংস্পর্শে এসে উকিল মুন্সি, কমল মিয়া, আবদুল মজিদ তালুকদার, আলী হোসেন সরকার, প্রভাত সূত্রধর, তৈয়ব আলী, আবেদ আলী, অন্ধ খোরশেদ প্রমুখ বাউলও মালজোড়া বাউলগানের কৌশল রপ্ত করেন। পরে অন্যান্য অঞ্চলের বাউলরা নেত্রকোনার বাউলদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে মালজোড়া গানের ধারাটিকে সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন স্থানে বিস্তৃত করেন। তত্ত্বভিত্তিক যুক্তি খণ্ডন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক উপস্থাপনার কারণে দিনে দিনে তা কবিগান, জারিগান বা ঘাটুগানের চেয়েও বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
মালজোড়া ও বৈঠকি—দুই ধরনের বাউলগানেরই প্রচার-প্রসারে এ অঞ্চলের পীর-ফকিরদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। সে সময় মালজোড়া বাউলগানে কোনো না কোনো পীর উপস্থিত থেকে বিচারকের দায়িত্ব পালন করতেন। পীরদের সান্নিধ্যে থেকে বাউলরা বিভিন্ন তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা পেতেন।
মালজোড়া বাউলগানের পরিবেশন রীতি বৈঠকি বাউলের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। মালজোড়ার আসরে প্রথমে একজন বাউল উঠে দাঁড়িয়ে একটি গান পরিবেশন করেন। এরপর প্রতিদ্বন্দ্বী বাউলের উদ্দেশ্যে আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে কিছু প্রশ্ন উপস্থাপন করেন। পরে আরও একটি গান গেয়ে তিনি প্রথম পর্বের সমাপ্তি ঘটান। এরপর দ্বিতীয় বাউল উঠে দাঁড়ান। তিনিও শুরুতে একটি গান পরিবেশন করেন। এরপর প্রথম বাউলের করা প্রশ্নের উত্তর দেন। পরে প্রতিদ্বন্দ্বী বাউলের উদ্দেশে এক বা একাধিক প্রশ্ন উত্থাপন করে আরও একটি গান গেয়ে প্রথম পর্বের সমাপ্তি টানেন। এভাবে রাতব্যাপী চলে গান ও প্রশ্নোত্তর পর্ব। এসব প্রশ্নকে নেত্রকোনাসহ পূর্ব ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় ‘ধরাট’ বলা হয়। ধরাটের উত্তর দিতে গিয়ে যে বাউল যত বেশি পারদর্শিতা দেখান, তিনি তত বেশি প্রশংসা কুড়ান। প্রশ্ন ও ধরাটের উত্তর কখনো গানে গানে, আবার কখনো গান ছাড়াই বক্তব্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। যেমন—আটপাড়া উপজেলার এক আসরে একবার জালাল খাঁ গানে গানে প্রশ্ন করেন, ‘আল্লাহ বলতে কেউ নাই এ সংসারে/মিশে গেছে আলো হাওয়ায়/বিশ্বজুড়ে তালাশ কর কারে?’ উত্তরে বাউল ইদ্রিছ মিয়া বলেন, ‘জালাল তুমি ভাবের দেশে চলো/আল্লাহকে দেখবে যদি/চর্মচোখের পর্দা খোলো।’ প্রতিদ্বন্দ্বী বাউলদের প্রশ্ন ও উত্তর যত যৌক্তিক বা অযৌক্তিকই হোক না কেন, গানের শেষ প্রান্তে এসে যৌক্তিক বিষয়েরই জয় হয়। আর দুই বাউলের জয়-পরাজয় নির্ভর করে তাঁদের উপস্থাপনশৈলীর ওপর।
চিরাচরিত ধর্মীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সঙ্গে বাউলদের চিন্তাচেতনা ও ব্যাখ্যার কিছু অমিল লক্ষণীয়। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, ব্রাহ্মণ-শূদ্র, আতরাফ- আশরাফ প্রভৃতি বিভাজনকে তাঁরা অস্বীকার করে বরাবরই অসাম্প্রদায়িক চেতনার চর্চা করে এসেছেন। কখনো কখনো তথাকথিত ধর্মাচার বা মৌলবাদকে সরাসরি আক্রমণ করতেও ভোলেননি। মালজোড়া বাউলগানে তাদের এসব চিন্তাচেতনার প্রকাশ ঘটে। এসব কারণে বিভিন্ন সময়ে তারা ধর্মান্ধদের চক্ষুশূল হয়েছেন। বাউলগানকে নিষিদ্ধের দাবিতে ১৯৫১ সালের ২৮ জানুয়ারি একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী প্রচারপত্র বিলি করে নেত্রকোনা সদরের বালী-অনন্তপুরে ধর্মসভা আয়োজন করে। এ খবর পেয়ে বাউলরাও সংগঠিত হন। তাঁরাও লেটিরকান্দার পীর আছমত আলী শাহ ফকিরের পৃষ্ঠপোষকতায় একই সময়ে একই গ্রামের মিরাজ আলীর বাড়ির সামনে মালজোড়া বাউলগানের আসর জমান। রশিদ উদ্দিন, উকিল মুন্সি, উপেন্দ্র সরকার, মিরাজ আলীসহ তখনকার বিশিষ্ট বাউল সাধকেরা ওই আসরে যোগ দেন। বাউলদের লাগাতার গান ও পীরভক্তদের জিকিরের জোয়ারে বাউলবিরোধী ধর্মসভা পণ্ড হওয়ার উপক্রম হয়। একপর্যায়ে তাঁরা তড়িঘড়ি সভা শেষ করে স্থান ত্যাগ করেন। এ ঘটনার পর এ অঞ্চলে আর কোনো দিন বাউলগানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোনো বিদ্রোহ দেখা যায়নি। এ উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়, বাউলচর্চার জন্য এ অঞ্চলের সামাজিক প্রেক্ষাপট কতখানি উপযোগী।
আগের মতো জোরালোভাবে না হলেও নেত্রকোনাসহ পূর্ব ময়মনসিংহে মালজোড়া বাউলগানের সেই ধারাটি এখনো অব্যাহত। সিরাজ উদ্দিন খান পাঠান, সুনীল কর্মকার, আজাদ মিয়া, ইসলাম উদ্দিন, আবুল বাশার তালুকদার, নূর মিয়া, সালাম সরকার, বাবুল মিয়া, রব মিয়া, গোলাম মৌলা, সবুজ সরকার, আলেয়া বেগমসহ বেশ কিছু নবীন-প্রবীণ বাউল আজও ঐতিহ্যটি ধরে রেখেছেন। তবে এখন আর নির্ধারিত বিচারক থাকেন না। দর্শকেরাই গান ও তত্ত্বকথার বিচার-বিশ্লেষণ করেন। বাউলধারার এই ঐতিহ্য ও এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিবেচনায় নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা করা হলে এই হাওরাঞ্চলেও পর্যটনের দ্বার উন্মুক্ত হবে। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পর্যটকেরা বিশেষত বর্ষা মৌসুমে এখানে ঘুরতে আসেন। এর পরিসর আরও বাড়ানো সম্ভব।
সঞ্জয় সরকার
ছড়াকার ও লোকসংস্কৃতি গবেষক
লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি চর্চার এক উর্বর ভূমি নেত্রকোনা। বাউল, ভাটিয়ালি, জারি, সারি, পালা, ঢপ, কিচ্ছা, ধামাইল, মেয়েলি গীত, গাইনের গীত, ঘাটুগান, কবিগানসহ লোকগানের হাজারো ধারক-বাহকের জন্ম এ জেলায়। কিন্তু আধুনিক সংস্কৃতির ব্যাপক প্রচার-প্রসার ও বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসনে সারা দেশের মতো এখানেও পল্লিগানের বেশির ভাগ ধারা আজ বিলুপ্তির পথে। এর মধ্যেও যে ধারাটি ক্ষয়িষ্ণুভাবে টিকে আছে, সেটি হচ্ছে বাউলগান। এখনো প্রায় রাতেই এখানকার গ্রামগঞ্জে বাউলগানের আসর বসে। গভীর রাতে দূর থেকে ভেসে আসে বাউলদের সহজিয়া সুর।
একসময় বাউলগান বলতেই ছিল বৈঠকি আসরের গান। এটিই বাউলগানের আদি ধারা। সাধারণত পীর-ফকির ও সাধু-সন্ন্যাসীদের আস্তানায়, ধনী ব্যক্তিদের বৈঠকখানায়, হাটবাজারে বৈঠকি বাউল গানের আসর জমত। দর্শক-শ্রোতারা চাঁদোয়া বা শামিয়ানার নিচে গোল হয়ে বসতেন। আসরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বা বসে পালাক্রমে গান করতেন এক বা একাধিক বাউল। দিনে দিনে বাউলগানের আনুষ্ঠানিকতার ধরন পাল্টায়। প্রচলন হয় মঞ্চের। কিন্তু তাই বলে বৈঠকি আসরের আগের রেওয়াজ হারিয়ে যায়নি। মঞ্চের প্রচলন বেশি হলেও গ্রামাঞ্চলে এখনো মঞ্চ ছাড়া আসর বসতে দেখা যায়।
কিন্তু প্রচলিত রেওয়াজের বাইরে ত্রিশের দশকে এক ব্যতিক্রমী ধারার বাউলগানের প্রচলন শুরু হয় নেত্রকোনায়। এর নাম ‘মালজোড়া বাউলগান’। মনে করা হয়, মালজোড়া বাউলগানের ধারণাটি এসেছে কবিগান থেকে। নেত্রকোনাসহ পূর্ব ময়মনসিংহ অঞ্চলে একসময় কবিগানের জয়জয়কার ছিল। কবিগান ছিল মূলত দুই কবিয়ালের লড়াই বা বাগ্যুদ্ধ। সেই ধারাটিই বাউলগানে সংমিশ্রিত হয়ে ‘মালজোড়া বাউলগান’ নামে নতুন আরেক ধারার প্রচলন করে। মালজোড়া বাউলগানের ‘মাল’ শব্দটি এসেছে ‘কুস্তির লড়াই’ থেকে। এ অঞ্চলে আগে যাঁরা কুস্তি করতেন তাঁদের ‘মাল’ বলা হতো। মালজোড়া বাউলগানও একধরনের লড়াই। গানে গানে তাত্ত্বিক বিভিন্ন প্রশ্নোত্তরের লড়াই এটি। এখানেও একজন আরেকজনকে পরাস্ত করার চেষ্টা করেন। তাই মালজোড়ার শিল্পীরাও পান ‘মাল’–এর খ্যাতি।
মালজোড়া বাউলগানের মূল প্রবর্তক নেত্রকোনার বাহিরচাপড়া গ্রামের বাউলসাধক রশিদ উদ্দিন। রশিদ নিজেও প্রথমজীবনে কবিগানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর একটি নিজস্ব বাউল ঘরানা ছিল। এ কারণে তাঁকে এ অঞ্চলের বাউল শিরোমণি মনে করা হয়। গবেষক গোলাম এরশাদুর রহমান ‘নেত্রকোনার বাউলগীতি’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘অত্রাঞ্চলের বাউলগানের আসরে তত্ত্বভিত্তিক বিতর্কানুষ্ঠানের (মালজোড়া বাউলগান) প্রচলিত ধারার প্রবর্তক হলেন বাউলসাধক রশিদ উদ্দিন।’ তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় সংগীতসাধক রামকানাই দাশের বক্তব্যেরও। রামকানাইও তাঁর ‘সঙ্গীত ও আমার জীবন’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘একজন অসাধারণ তাত্ত্বিক বাউলের নাম রশিদ উদ্দিন। যুগের এবং সমাজজীবনের পরিবর্তনকে বিবেচনায় রেখে কবিগানের সংগীতাংশের পর্যালোচনাগুলোকে বাদ দিয়ে কেবল দুই কবিয়ালের তর্কাতর্কি অংশটিকে বাউলগানে নিয়ে এসে নিজ বাড়িতে প্রাতিষ্ঠানিক বাউল শিক্ষাকেন্দ্র চালু করেছিলেন তিনি। এ তর্কাতর্কির অংশটিকে কাজে লাগিয়েই মালজোড়া তৈরি হয় এবং বাউলসাধক রশিদ উদ্দিনই এর প্রধান প্রবর্তক বলে আমার বিশ্বাস।’
বাউলসাধক রশিদ উদ্দিনের উদ্যোগে ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বর মাসে নেত্রকোনা শহরের গরুহাট্টায় প্রথম তত্ত্বভিত্তিক বিতর্কমূলক বাউলগানের আয়োজন করা হয়। এ বিতর্কে বাউল রশিদ উদ্দিন, জালাল উদ্দিন খাঁ ও চান খাঁ অংশ নেন। বিচারকের আসনে ছিলেন পূর্বধলার লেটিরকান্দার পীর আছমত আলী শাহ্ ফকির ও সিংহেরবাংলার প্রখ্যাত কবিয়াল বিজয় নারায়ণ আচার্যসহ কয়েকজন। এ ছাড়া অন্য বাউলদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তৈয়ব আলী, মিরাজ আলী, ইদ্রিছ মিয়া, চান মিয়া প্রমুখ। বিপুলসংখ্যক দর্শকের উপস্থিতিতে প্রথম আসরেই জমে ওঠে বিতর্কমূলক বাউলগানের নতুন ধারাটি। আর এর প্রভাব পড়ে সারা জেলায়। পরে বাউল রশিদ ও তাঁর শিষ্যদের সংস্পর্শে এসে উকিল মুন্সি, কমল মিয়া, আবদুল মজিদ তালুকদার, আলী হোসেন সরকার, প্রভাত সূত্রধর, তৈয়ব আলী, আবেদ আলী, অন্ধ খোরশেদ প্রমুখ বাউলও মালজোড়া বাউলগানের কৌশল রপ্ত করেন। পরে অন্যান্য অঞ্চলের বাউলরা নেত্রকোনার বাউলদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে মালজোড়া গানের ধারাটিকে সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন স্থানে বিস্তৃত করেন। তত্ত্বভিত্তিক যুক্তি খণ্ডন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক উপস্থাপনার কারণে দিনে দিনে তা কবিগান, জারিগান বা ঘাটুগানের চেয়েও বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
মালজোড়া ও বৈঠকি—দুই ধরনের বাউলগানেরই প্রচার-প্রসারে এ অঞ্চলের পীর-ফকিরদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। সে সময় মালজোড়া বাউলগানে কোনো না কোনো পীর উপস্থিত থেকে বিচারকের দায়িত্ব পালন করতেন। পীরদের সান্নিধ্যে থেকে বাউলরা বিভিন্ন তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা পেতেন।
মালজোড়া বাউলগানের পরিবেশন রীতি বৈঠকি বাউলের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। মালজোড়ার আসরে প্রথমে একজন বাউল উঠে দাঁড়িয়ে একটি গান পরিবেশন করেন। এরপর প্রতিদ্বন্দ্বী বাউলের উদ্দেশ্যে আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে কিছু প্রশ্ন উপস্থাপন করেন। পরে আরও একটি গান গেয়ে তিনি প্রথম পর্বের সমাপ্তি ঘটান। এরপর দ্বিতীয় বাউল উঠে দাঁড়ান। তিনিও শুরুতে একটি গান পরিবেশন করেন। এরপর প্রথম বাউলের করা প্রশ্নের উত্তর দেন। পরে প্রতিদ্বন্দ্বী বাউলের উদ্দেশে এক বা একাধিক প্রশ্ন উত্থাপন করে আরও একটি গান গেয়ে প্রথম পর্বের সমাপ্তি টানেন। এভাবে রাতব্যাপী চলে গান ও প্রশ্নোত্তর পর্ব। এসব প্রশ্নকে নেত্রকোনাসহ পূর্ব ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় ‘ধরাট’ বলা হয়। ধরাটের উত্তর দিতে গিয়ে যে বাউল যত বেশি পারদর্শিতা দেখান, তিনি তত বেশি প্রশংসা কুড়ান। প্রশ্ন ও ধরাটের উত্তর কখনো গানে গানে, আবার কখনো গান ছাড়াই বক্তব্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। যেমন—আটপাড়া উপজেলার এক আসরে একবার জালাল খাঁ গানে গানে প্রশ্ন করেন, ‘আল্লাহ বলতে কেউ নাই এ সংসারে/মিশে গেছে আলো হাওয়ায়/বিশ্বজুড়ে তালাশ কর কারে?’ উত্তরে বাউল ইদ্রিছ মিয়া বলেন, ‘জালাল তুমি ভাবের দেশে চলো/আল্লাহকে দেখবে যদি/চর্মচোখের পর্দা খোলো।’ প্রতিদ্বন্দ্বী বাউলদের প্রশ্ন ও উত্তর যত যৌক্তিক বা অযৌক্তিকই হোক না কেন, গানের শেষ প্রান্তে এসে যৌক্তিক বিষয়েরই জয় হয়। আর দুই বাউলের জয়-পরাজয় নির্ভর করে তাঁদের উপস্থাপনশৈলীর ওপর।
চিরাচরিত ধর্মীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সঙ্গে বাউলদের চিন্তাচেতনা ও ব্যাখ্যার কিছু অমিল লক্ষণীয়। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, ব্রাহ্মণ-শূদ্র, আতরাফ- আশরাফ প্রভৃতি বিভাজনকে তাঁরা অস্বীকার করে বরাবরই অসাম্প্রদায়িক চেতনার চর্চা করে এসেছেন। কখনো কখনো তথাকথিত ধর্মাচার বা মৌলবাদকে সরাসরি আক্রমণ করতেও ভোলেননি। মালজোড়া বাউলগানে তাদের এসব চিন্তাচেতনার প্রকাশ ঘটে। এসব কারণে বিভিন্ন সময়ে তারা ধর্মান্ধদের চক্ষুশূল হয়েছেন। বাউলগানকে নিষিদ্ধের দাবিতে ১৯৫১ সালের ২৮ জানুয়ারি একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী প্রচারপত্র বিলি করে নেত্রকোনা সদরের বালী-অনন্তপুরে ধর্মসভা আয়োজন করে। এ খবর পেয়ে বাউলরাও সংগঠিত হন। তাঁরাও লেটিরকান্দার পীর আছমত আলী শাহ ফকিরের পৃষ্ঠপোষকতায় একই সময়ে একই গ্রামের মিরাজ আলীর বাড়ির সামনে মালজোড়া বাউলগানের আসর জমান। রশিদ উদ্দিন, উকিল মুন্সি, উপেন্দ্র সরকার, মিরাজ আলীসহ তখনকার বিশিষ্ট বাউল সাধকেরা ওই আসরে যোগ দেন। বাউলদের লাগাতার গান ও পীরভক্তদের জিকিরের জোয়ারে বাউলবিরোধী ধর্মসভা পণ্ড হওয়ার উপক্রম হয়। একপর্যায়ে তাঁরা তড়িঘড়ি সভা শেষ করে স্থান ত্যাগ করেন। এ ঘটনার পর এ অঞ্চলে আর কোনো দিন বাউলগানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোনো বিদ্রোহ দেখা যায়নি। এ উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়, বাউলচর্চার জন্য এ অঞ্চলের সামাজিক প্রেক্ষাপট কতখানি উপযোগী।
আগের মতো জোরালোভাবে না হলেও নেত্রকোনাসহ পূর্ব ময়মনসিংহে মালজোড়া বাউলগানের সেই ধারাটি এখনো অব্যাহত। সিরাজ উদ্দিন খান পাঠান, সুনীল কর্মকার, আজাদ মিয়া, ইসলাম উদ্দিন, আবুল বাশার তালুকদার, নূর মিয়া, সালাম সরকার, বাবুল মিয়া, রব মিয়া, গোলাম মৌলা, সবুজ সরকার, আলেয়া বেগমসহ বেশ কিছু নবীন-প্রবীণ বাউল আজও ঐতিহ্যটি ধরে রেখেছেন। তবে এখন আর নির্ধারিত বিচারক থাকেন না। দর্শকেরাই গান ও তত্ত্বকথার বিচার-বিশ্লেষণ করেন। বাউলধারার এই ঐতিহ্য ও এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিবেচনায় নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা করা হলে এই হাওরাঞ্চলেও পর্যটনের দ্বার উন্মুক্ত হবে। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পর্যটকেরা বিশেষত বর্ষা মৌসুমে এখানে ঘুরতে আসেন। এর পরিসর আরও বাড়ানো সম্ভব।
সঞ্জয় সরকার
ছড়াকার ও লোকসংস্কৃতি গবেষক
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪