জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা
১৪ আগস্ট রাত ৮টার দিকে বঙ্গবন্ধু গণভবন থেকে ফিরলেন বাড়িতে। কয়েকজন কর্মকর্তাকে বললেন, সকালে যেন তাঁরা সরাসরি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে চলে যান।
বাড়ি ফিরে তিনি দেখলেন বঙ্গবন্ধুর মেজ বোন—শেখ ফজলুল হক মনির মা শেখ আছিয়া খাতুন তাঁদের বাড়িতে এসেছেন। রাত ১২টা পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ছিলেন। গল্প করেছেন ভাই ও ভাবির সঙ্গে। শেখ মনি এসেছিলেন মাকে নিয়ে যেতে। তাঁদের খেয়ে যেতে বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু তাড়াহুড়া করে তাঁরা চলে গেলেন।
সেই রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ জামাল, তাঁর স্ত্রী রোজী, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের ঘুমিয়েছিলেন দোতলায়। তিনতলার দুটি ঘরের একটিতে ঘুমিয়েছিলেন শেখ কামাল ও তাঁর স্ত্রী সুলতানা। বঙ্গবন্ধুর ঘরের সামনের বারান্দায় ঘুমিয়েছিলেন বাড়ির দুই পরিচারক আবদুর রহমান শেখ (রমা) ও সেলিম ওরফে আবদুল।
বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সেদিন এ এফ এম মহিতুল ইসলামের কাজের সময় নির্ধারিত ছিল ১৪ আগস্ট রাত ৮টা থেকে ১৫ আগস্ট সকাল ৮টা পর্যন্ত। রাত ১টার দিকে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। খুব ভোরে তিনি ঘুম থেকে উঠলেন টেলিফোন মিস্ত্রির ডাকে। বঙ্গবন্ধু ডাকছেন মহিতুলকে।
তখন ভোর। চারদিকের আকাশ ফরসা হয়ে আসছে। ভোর সাড়ে ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে কোনো একসময়। বঙ্গবন্ধু ফোনেই বললেন, ‘সেরনিয়াবাতের বাড়িতে দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে।’
সে খবর বেগম মুজিবের কাছেও পৌঁছে যায়। দোতলার দরজা খুলে ‘সেরনিয়াবাতের বাড়িতে দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে’—এ কথা বলতে বলতে তিনি বেরিয়ে আসেন। রমা বাড়ি থেকে বেরিয়ে লেকের দিকে যান। দেখতে পান, গুলি ছুড়তে ছুড়তে কিছু সৈন্য বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে আসছে। ফেরার পথে রমা বঙ্গবন্ধু ও মহিতুল ইসলামকে কথা বলতে দেখেন।
কী হচ্ছে, ঘটনা কোনদিকে মোড় নিচ্ছে, সেটা বোঝা যাচ্ছিল না। মহিতুল ফোন করেন পুলিশ কন্ট্রোলরুমে। কিন্তু সেখানে ফোন ঢোকে না। লাইন পাওয়া যায় না। এরপর চেষ্টা করেন গণভবন এক্সচেঞ্জে ফোন করতে। সেখানেও লাইন পাওয়া যায় না। সে সময় বঙ্গবন্ধু নিচে নেমে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘পুলিশ কন্ট্রোলরুম থেকে কেন ফোন ধরছে না?’
মহিতুল ফোন করার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। তিনি যখন ‘হ্যালো, হ্যালো’ বলছেন, তখন বঙ্গবন্ধু এসে সেই ফোন হাতে নেন। বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট বলছি।’
ঠিক সে সময় শুরু হলো গুলি। দক্ষিণ দিকের জানালা ভেঙে গেল গুলিতে। মহিতুলের হাত জখম হলো সেই কাচে। বঙ্গবন্ধু শুয়ে পড়লেন। দেখাদেখি মহিতুলও শুয়ে পড়লেন। একটু পর কিছুক্ষণের জন্য গুলি বন্ধ হলে উঠে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু।
এরই মধ্যে রমা দৌড়ে গেছেন ওপরে। শেখ কামাল ও শেখ জামালের ঘুম ভাঙিয়েছেন। শেখ কামাল প্যান্ট–শার্ট পরে চলে গেছেন নিচতলায়। শেখ জামাল ও তাঁর স্ত্রী রোজী গেছেন মায়ের ঘরে। সুলতানাও আশ্রয় নিলেন বেগম মুজিবের কাছে এসে। দোতলা থেকে গৃহপরিচারক সেলিম ওরফে আবদুল বঙ্গবন্ধুর পাঞ্জাবি আর চশমাটা এনে বঙ্গবন্ধুকে দিলেন। সেগুলো পরলেন বঙ্গবন্ধু। তারপর বারান্দায় এসে গেটের কাছে দাঁড়ানো নিরাপত্তা বাহিনীর লোকদের উদ্দেশে বললেন, ‘আর্মি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি—এত গুলি চলছে, তোমরা কী করো?’
এ সময় শেখ কামালও বললেন, ‘আর্মি ও পুলিশ ভাই, আপনারা আমার সঙ্গে আসুন।’
ততক্ষণে খুনিরা ঢুকে পড়েছে বাড়িতে। শেখ কামালের সামনে এসে দাঁড়াল কালো আর খাকি পোশাকের খুনিরা। মহিতুল ও ডিএসপি নূরুল ইসলাম খান ছিলেন শেখ কামালের পেছনে। নূরুল ইসলাম মহিতুলকে টান দিয়ে নিয়ে গেলেন অফিস কক্ষে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শোনা গেল গুলির শব্দ। শেখ কামাল গুলির আঘাতে ছিটকে পড়লেন অফিস ঘরের দিকে। তিনি চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল, ভাই, ওদেরকে বলেন।’
বঙ্গবন্ধু সে সময় ফিরে গেছেন দোতলায় নিজের ঘরে। প্রচণ্ড গোলাগুলিতে কান ঝালাপালা। বঙ্গবন্ধু ফোন করতে থাকেন। একসময় ফোন কাজ করা শুরু করে। কর্নেল জামিলকে ফোনে পান তিনি। কর্নেল জামিল আশ্বাস দেন, তিনি আসছেন। ফোনে পান সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে। তাঁদের জানান এই পরিস্থিতির কথা। একসময় গোলাগুলি থামলে বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে আসেন তাঁর ঘর থেকে। খুনিরা তাঁকে ঘিরে ধরে। রমা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পেছনে।
খুনিদের দেখে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যেতে চাস আমাকে?’
এ সময় তিনি গুলিতে আহত সেলিমকে দেখে অবাক হন। ঘাতকদের বলেন, ‘এই ছেলেটা ছোটবেলা থেকে আমার এখানে থাকে। ওকে কে গুলি করল?’
ঘাতকের দল বঙ্গবন্ধুকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। নিচ থেকে দুই ঘাতক ইংরেজিতে কিছু বললে পেছনের খুনিরা সরে যায়। নিচ থেকে অকস্মাৎ বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে ওরা। বঙ্গবন্ধু লুটিয়ে পড়েন সিঁড়িতে।
রমা এসে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করার কথা জানান বেগম মুজিবকে। শেখ নাসের এ ঘরে আসার আগেই তাঁর গায়ে গুলি লাগে। বেগম মুজিব তাঁর শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে রক্ত মুছে দেন। বঙ্গবন্ধুর ঘরে তখন দোতলার সবাই আর তিনতলা থেকে সুলতানা কামাল এসে আশ্রয় নিয়েছেন।
খুনিরা তখন হত্যার আনন্দে মেতে উঠেছে। দোতলায় এসে এই ঘরের দরজা ধাক্কাতে থাকলে বেগম মুজিব বলেন, ‘মরলে সবাই একসাথে মরব।’ এ কথা বলে তিনি দরজা খুলে দেন। সবাইকে নয়, বেগম মুজিব, শেখ নাসের, শেখ রাসেল ও রমাকে নিয়ে নেমে আসছিল খুনিরা। সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ পড়ে থাকতে দেখেন বেগম মুজিব। তখনই তিনি বলে ওঠেন, ‘আমি যাব না, আমাকে এখানেই মেরে ফেলো।’
খুনিরা তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ঘরে। ব্রাশফায়ার করে ঘরে থাকা সবাইকে হত্যা করে। শুধু শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমাকে নিচে নিয়ে আসে। মহিতুলসহ সবাইকে লাইনে দাঁড় করানো হয়।
শেখ নাসেরকে ওরা জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কে?’
শেখ নাসের পরিচয় দিলে নিচতলার বাথরুমে নিয়ে গিয়ে তাঁকে হত্যা করে খুনিরা।
শিশু শেখ রাসেল মহিতুলকে দেখতে পেয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে। বলে, ‘আমাকে মারবে না তো?’
মহিতুল বলেন, ‘না। তোমাকে কিছু বলবে না।’
মহিতুল কল্পনাও করতে পারেননি এতটুকু একটি ছেলেকে কেউ হত্যা করতে পারে। রাসেল বলেছিল, আমি মায়ের কাছে যাব। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাসেলকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে হত্যা করে খুনিরা। এরপর মেজর বজলুল হুদা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা মেজর ফারুককে বলেন, ‘অল আর ফিনিশড’।
ডিএসসি নূরুল ইসলাম, পিও মহিতুল ইসলাম ও সেলিম আহত হয়েছিলেন সেদিন।
এ বাড়িতে হত্যা করা হয়েছিল ৯ জনকে।
সোবহানবাগ মসজিদের কাছে কর্নেল জামিলের গাড়ি থামিয়ে তাঁকে হত্যা করে খুনিরা।
পুনশ্চ:
১৫ আগস্ট ভোরে খুনিদের একটি দল ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে আসার আগে বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও তৎকালীন পানি, সেচ ও বন্যানিয়ন্ত্রণমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে হামলা চালিয়েছিল। তিনি তখন সপরিবারে থাকতেন ২৭ নম্বর মিন্টো রোডের বাড়িতে। বঙ্গবন্ধুর খুনি সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, আজিজ পাশা ও নুরুল হুদার নেতৃত্বে একদল সেনাসদস্য মন্ত্রীর বাড়িতে হামলা চালায়। বাড়ির ড্রইংরুমে আবদুর রব সেরনিয়াবাতসহ আটজনকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। অন্যরা হলেন আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবি সেরনিয়াবাত, চাচাতো ভাই শহীদ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত হাসানাত (আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলে), গৃহপরিচারিকা লক্ষ্মীর মা, গৃহপরিচারক পোটকা ও আবদুর নইম খান।
ধানমন্ডি ১৩ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে থাকতেন শেখ ফজলুল হক মনি। এ বাড়িতেও হামলা চালিয়েছিল ঘাতকেরা। হত্যা করেছিল শেখ মনি ও তাঁর স্ত্রী আরজু মনিকে।
সেদিন নিহত হয়েছিলেন এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান এবং সেনাসদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক।
আর নিহত হয়েছিলেন কর্নেল জামিল। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে ফোন পেয়ে তিনি জিপে করে রওনা হয়েছিলেন। সোবহানবাগ মসজিদের সামনে তাঁকে দাঁড় করায় দুর্বৃত্তরা। তিনি বাধা পেরিয়ে রওনা হন। তখন তাঁকে গুলি করে হত্যা করে ঘাতকেরা।
সূত্র:
১. রমার জবানবন্দি
২. সেলিমের জবানবন্দি
৩. এ এফ এম মহিতুল ইসলামের এজাহার
৪. ‘কর্মময় জীবনের শেষ সপ্তাহ’, শাহরিয়ার ইকবাল (ভোরের কাগজ, ১৫ আগস্ট, ১৯৯৬)
১৪ আগস্ট রাত ৮টার দিকে বঙ্গবন্ধু গণভবন থেকে ফিরলেন বাড়িতে। কয়েকজন কর্মকর্তাকে বললেন, সকালে যেন তাঁরা সরাসরি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে চলে যান।
বাড়ি ফিরে তিনি দেখলেন বঙ্গবন্ধুর মেজ বোন—শেখ ফজলুল হক মনির মা শেখ আছিয়া খাতুন তাঁদের বাড়িতে এসেছেন। রাত ১২টা পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ছিলেন। গল্প করেছেন ভাই ও ভাবির সঙ্গে। শেখ মনি এসেছিলেন মাকে নিয়ে যেতে। তাঁদের খেয়ে যেতে বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু তাড়াহুড়া করে তাঁরা চলে গেলেন।
সেই রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ জামাল, তাঁর স্ত্রী রোজী, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের ঘুমিয়েছিলেন দোতলায়। তিনতলার দুটি ঘরের একটিতে ঘুমিয়েছিলেন শেখ কামাল ও তাঁর স্ত্রী সুলতানা। বঙ্গবন্ধুর ঘরের সামনের বারান্দায় ঘুমিয়েছিলেন বাড়ির দুই পরিচারক আবদুর রহমান শেখ (রমা) ও সেলিম ওরফে আবদুল।
বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সেদিন এ এফ এম মহিতুল ইসলামের কাজের সময় নির্ধারিত ছিল ১৪ আগস্ট রাত ৮টা থেকে ১৫ আগস্ট সকাল ৮টা পর্যন্ত। রাত ১টার দিকে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। খুব ভোরে তিনি ঘুম থেকে উঠলেন টেলিফোন মিস্ত্রির ডাকে। বঙ্গবন্ধু ডাকছেন মহিতুলকে।
তখন ভোর। চারদিকের আকাশ ফরসা হয়ে আসছে। ভোর সাড়ে ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে কোনো একসময়। বঙ্গবন্ধু ফোনেই বললেন, ‘সেরনিয়াবাতের বাড়িতে দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে।’
সে খবর বেগম মুজিবের কাছেও পৌঁছে যায়। দোতলার দরজা খুলে ‘সেরনিয়াবাতের বাড়িতে দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে’—এ কথা বলতে বলতে তিনি বেরিয়ে আসেন। রমা বাড়ি থেকে বেরিয়ে লেকের দিকে যান। দেখতে পান, গুলি ছুড়তে ছুড়তে কিছু সৈন্য বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে আসছে। ফেরার পথে রমা বঙ্গবন্ধু ও মহিতুল ইসলামকে কথা বলতে দেখেন।
কী হচ্ছে, ঘটনা কোনদিকে মোড় নিচ্ছে, সেটা বোঝা যাচ্ছিল না। মহিতুল ফোন করেন পুলিশ কন্ট্রোলরুমে। কিন্তু সেখানে ফোন ঢোকে না। লাইন পাওয়া যায় না। এরপর চেষ্টা করেন গণভবন এক্সচেঞ্জে ফোন করতে। সেখানেও লাইন পাওয়া যায় না। সে সময় বঙ্গবন্ধু নিচে নেমে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘পুলিশ কন্ট্রোলরুম থেকে কেন ফোন ধরছে না?’
মহিতুল ফোন করার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। তিনি যখন ‘হ্যালো, হ্যালো’ বলছেন, তখন বঙ্গবন্ধু এসে সেই ফোন হাতে নেন। বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট বলছি।’
ঠিক সে সময় শুরু হলো গুলি। দক্ষিণ দিকের জানালা ভেঙে গেল গুলিতে। মহিতুলের হাত জখম হলো সেই কাচে। বঙ্গবন্ধু শুয়ে পড়লেন। দেখাদেখি মহিতুলও শুয়ে পড়লেন। একটু পর কিছুক্ষণের জন্য গুলি বন্ধ হলে উঠে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু।
এরই মধ্যে রমা দৌড়ে গেছেন ওপরে। শেখ কামাল ও শেখ জামালের ঘুম ভাঙিয়েছেন। শেখ কামাল প্যান্ট–শার্ট পরে চলে গেছেন নিচতলায়। শেখ জামাল ও তাঁর স্ত্রী রোজী গেছেন মায়ের ঘরে। সুলতানাও আশ্রয় নিলেন বেগম মুজিবের কাছে এসে। দোতলা থেকে গৃহপরিচারক সেলিম ওরফে আবদুল বঙ্গবন্ধুর পাঞ্জাবি আর চশমাটা এনে বঙ্গবন্ধুকে দিলেন। সেগুলো পরলেন বঙ্গবন্ধু। তারপর বারান্দায় এসে গেটের কাছে দাঁড়ানো নিরাপত্তা বাহিনীর লোকদের উদ্দেশে বললেন, ‘আর্মি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি—এত গুলি চলছে, তোমরা কী করো?’
এ সময় শেখ কামালও বললেন, ‘আর্মি ও পুলিশ ভাই, আপনারা আমার সঙ্গে আসুন।’
ততক্ষণে খুনিরা ঢুকে পড়েছে বাড়িতে। শেখ কামালের সামনে এসে দাঁড়াল কালো আর খাকি পোশাকের খুনিরা। মহিতুল ও ডিএসপি নূরুল ইসলাম খান ছিলেন শেখ কামালের পেছনে। নূরুল ইসলাম মহিতুলকে টান দিয়ে নিয়ে গেলেন অফিস কক্ষে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শোনা গেল গুলির শব্দ। শেখ কামাল গুলির আঘাতে ছিটকে পড়লেন অফিস ঘরের দিকে। তিনি চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল, ভাই, ওদেরকে বলেন।’
বঙ্গবন্ধু সে সময় ফিরে গেছেন দোতলায় নিজের ঘরে। প্রচণ্ড গোলাগুলিতে কান ঝালাপালা। বঙ্গবন্ধু ফোন করতে থাকেন। একসময় ফোন কাজ করা শুরু করে। কর্নেল জামিলকে ফোনে পান তিনি। কর্নেল জামিল আশ্বাস দেন, তিনি আসছেন। ফোনে পান সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে। তাঁদের জানান এই পরিস্থিতির কথা। একসময় গোলাগুলি থামলে বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে আসেন তাঁর ঘর থেকে। খুনিরা তাঁকে ঘিরে ধরে। রমা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পেছনে।
খুনিদের দেখে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যেতে চাস আমাকে?’
এ সময় তিনি গুলিতে আহত সেলিমকে দেখে অবাক হন। ঘাতকদের বলেন, ‘এই ছেলেটা ছোটবেলা থেকে আমার এখানে থাকে। ওকে কে গুলি করল?’
ঘাতকের দল বঙ্গবন্ধুকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। নিচ থেকে দুই ঘাতক ইংরেজিতে কিছু বললে পেছনের খুনিরা সরে যায়। নিচ থেকে অকস্মাৎ বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে ওরা। বঙ্গবন্ধু লুটিয়ে পড়েন সিঁড়িতে।
রমা এসে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করার কথা জানান বেগম মুজিবকে। শেখ নাসের এ ঘরে আসার আগেই তাঁর গায়ে গুলি লাগে। বেগম মুজিব তাঁর শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে রক্ত মুছে দেন। বঙ্গবন্ধুর ঘরে তখন দোতলার সবাই আর তিনতলা থেকে সুলতানা কামাল এসে আশ্রয় নিয়েছেন।
খুনিরা তখন হত্যার আনন্দে মেতে উঠেছে। দোতলায় এসে এই ঘরের দরজা ধাক্কাতে থাকলে বেগম মুজিব বলেন, ‘মরলে সবাই একসাথে মরব।’ এ কথা বলে তিনি দরজা খুলে দেন। সবাইকে নয়, বেগম মুজিব, শেখ নাসের, শেখ রাসেল ও রমাকে নিয়ে নেমে আসছিল খুনিরা। সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ পড়ে থাকতে দেখেন বেগম মুজিব। তখনই তিনি বলে ওঠেন, ‘আমি যাব না, আমাকে এখানেই মেরে ফেলো।’
খুনিরা তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ঘরে। ব্রাশফায়ার করে ঘরে থাকা সবাইকে হত্যা করে। শুধু শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমাকে নিচে নিয়ে আসে। মহিতুলসহ সবাইকে লাইনে দাঁড় করানো হয়।
শেখ নাসেরকে ওরা জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কে?’
শেখ নাসের পরিচয় দিলে নিচতলার বাথরুমে নিয়ে গিয়ে তাঁকে হত্যা করে খুনিরা।
শিশু শেখ রাসেল মহিতুলকে দেখতে পেয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে। বলে, ‘আমাকে মারবে না তো?’
মহিতুল বলেন, ‘না। তোমাকে কিছু বলবে না।’
মহিতুল কল্পনাও করতে পারেননি এতটুকু একটি ছেলেকে কেউ হত্যা করতে পারে। রাসেল বলেছিল, আমি মায়ের কাছে যাব। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাসেলকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে হত্যা করে খুনিরা। এরপর মেজর বজলুল হুদা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা মেজর ফারুককে বলেন, ‘অল আর ফিনিশড’।
ডিএসসি নূরুল ইসলাম, পিও মহিতুল ইসলাম ও সেলিম আহত হয়েছিলেন সেদিন।
এ বাড়িতে হত্যা করা হয়েছিল ৯ জনকে।
সোবহানবাগ মসজিদের কাছে কর্নেল জামিলের গাড়ি থামিয়ে তাঁকে হত্যা করে খুনিরা।
পুনশ্চ:
১৫ আগস্ট ভোরে খুনিদের একটি দল ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে আসার আগে বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও তৎকালীন পানি, সেচ ও বন্যানিয়ন্ত্রণমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে হামলা চালিয়েছিল। তিনি তখন সপরিবারে থাকতেন ২৭ নম্বর মিন্টো রোডের বাড়িতে। বঙ্গবন্ধুর খুনি সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, আজিজ পাশা ও নুরুল হুদার নেতৃত্বে একদল সেনাসদস্য মন্ত্রীর বাড়িতে হামলা চালায়। বাড়ির ড্রইংরুমে আবদুর রব সেরনিয়াবাতসহ আটজনকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। অন্যরা হলেন আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবি সেরনিয়াবাত, চাচাতো ভাই শহীদ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত হাসানাত (আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলে), গৃহপরিচারিকা লক্ষ্মীর মা, গৃহপরিচারক পোটকা ও আবদুর নইম খান।
ধানমন্ডি ১৩ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে থাকতেন শেখ ফজলুল হক মনি। এ বাড়িতেও হামলা চালিয়েছিল ঘাতকেরা। হত্যা করেছিল শেখ মনি ও তাঁর স্ত্রী আরজু মনিকে।
সেদিন নিহত হয়েছিলেন এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান এবং সেনাসদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক।
আর নিহত হয়েছিলেন কর্নেল জামিল। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে ফোন পেয়ে তিনি জিপে করে রওনা হয়েছিলেন। সোবহানবাগ মসজিদের সামনে তাঁকে দাঁড় করায় দুর্বৃত্তরা। তিনি বাধা পেরিয়ে রওনা হন। তখন তাঁকে গুলি করে হত্যা করে ঘাতকেরা।
সূত্র:
১. রমার জবানবন্দি
২. সেলিমের জবানবন্দি
৩. এ এফ এম মহিতুল ইসলামের এজাহার
৪. ‘কর্মময় জীবনের শেষ সপ্তাহ’, শাহরিয়ার ইকবাল (ভোরের কাগজ, ১৫ আগস্ট, ১৯৯৬)
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪