ড. মো. গোলাম রহমান
বঙ্গবন্ধু পর্বতপ্রমাণ ব্যক্তিত্ব, সূর্যস্তম্ভের মতো দৃঢ় একজন মহানুভব মানুষ। যাঁকে নিয়ে আজকে বাংলার মানুষের অফুরান গর্ব। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। এই মহামানবকে নিয়ে আজ ঘরে ঘরে স্মৃতিরোমন্থনের পালা। এই উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের দ্যুতি ছড়িয়ে আছে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়কন্দরে। কতিপয় কুচক্রী এই অবিসংবাদিত নেতাকে বাঙালির মনের গভীর থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছে; কিন্তু বঙ্গবন্ধু সময়ের বিবর্তনে অধিকতর উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন।
বঙ্গবন্ধুকে আমরা সময়ে সময়ে পেয়েছি, আবার হারিয়েছিও। এই পেয়ে হারানোর বেদনা বাঙালির জীবনে গভীর। ১৭ মার্চ ১৯২০ সালে টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেন শেখ মুজিবুর রহমান। ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের মূল রাজনৈতিক ধারা থেকে পথচ্যুত হয়ে সাম্প্রদায়িক ধারায় প্রবাহিত হতে থাকা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রভাবের কারণে সৃষ্ট পাকিস্তানি রাজনৈতিক চিন্তা তিনি স্বস্তির সঙ্গে গ্রহণ করতে পারেননি। তাঁর চিন্তা ও চেতনার যে বৈশিষ্ট্য, তা সব সময় বাঙালির গর্ব হয়ে একটি পৃথক স্বরগ্রাম তৈরি করেছে। যেখানে বাংলার মাঠ-ঘাট, কৃষক-শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষের সত্যিকার বাঁচার স্বপ্নই চিরন্তন। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ এই ব্যক্তিকে তাই দেখা যায় ১৯৪৯ সাল থেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের মৌল কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টায় এক নির্মাণকুশলী, রাজনীতির ফুল দিয়ে মালা গাঁথছেন একটি আধুনিক স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলার স্বপ্নে এবং চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে।
১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। সে বছরের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করেন মুসলিম ছাত্রলীগ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ইসলামিয়া কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে ইতিমধ্যে তিনি ঢাকায় ফিরে এসেছেন। তখন দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধুর উচ্চকণ্ঠ উপস্থিতি যখন আইন পরিষদে খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালু করার গভীর চক্রান্ত চালাচ্ছেন; অপরদিকে বঙ্গবন্ধু ছাত্র-জনতাকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সংঘবদ্ধ করছেন। চলতে থাকে প্রতিবাদের ঝড়। ১১ মার্চ তিনি প্রতিবাদ করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। কিছুদিন বাঙালির দৃষ্টির আড়াল হলেও বেরিয়ে আসেন গরাদের আড়াল থেকে। আবার ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮-এ বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর থেকেই কারাগার যেন তাঁর জীবনের একটি অপরিহার্য পরিণতি হয়ে দেখা দেয়। সংগ্রাম-আন্দোলনের জন্য যে পুরুষের জন্ম, তাঁকে কি কোনো জেল-হাজতের মধ্যে পুরে রাখলেই নিঃশেষ করে ফেলা যায়? তিনি ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি জেল থেকে মুক্তি পান এবং মুক্তি পেয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবিদাওয়া সমর্থন করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। এ বছর কয়েকবার তিনি কারাবরণ করেন এবং ১ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু আবার বন্দী হন। ভাষার দাবিতে তিনি কারাগারে অনশন করেন। দৃষ্টির আড়াল হয়ে কারাগারে অন্তরীণ হয়ে থাকেন প্রায় দুই বছর। বাঙালির এই নেতা মাঝে মাঝে এমনই হারিয়ে গেছেন সময়ের ব্যবধানে। কিন্তু বাঙালি নেতৃত্ব কখনো তাঁকে হারিয়ে ফেলেনি একেবারে। ২৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্তি পান কারাগার থেকে।
মুজিব ব্যস্ত হয়ে পড়েন যুক্তফ্রন্ট গঠনে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করার লক্ষ্যে শেখ মুজিব বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ১৯৬০-এর দশকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। ১৯৬৬-তে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারকে উজ্জীবিত করে তোলার একটি বড় মাপের পদক্ষেপ। যার ফলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে এক নম্বর আসামি করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হয়েছিল শাসকগোষ্ঠীর পাঁয়তারায়। কুচক্রীদের মাথায় তখন থেকেই শেখ মুজিবকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানোর ষড়যন্ত্র ছিল। অপরদিকে জনগণের আন্দোলন হচ্ছিল বেগবান। সেদিনের জনজোয়ারের ফলে শেখ মুজিবকে আটকে রাখা যায়নি।
Cyril Dunn-এর ভাষায়, ‘Released again, he dedicated himself more vehemently than ever to the liberation of Bengal. …On these occasions he was always immensely cheerful and was plainly supported by the belief that the mass of the Bengalis were behind him.’ [“How Mujib Turned into Bengal’s Hero,” The Observer, 28 March 1971, London.] মুজিবকে আমরা হারিয়েছি তখন কিছুটা সময়ের জন্য। পেয়েছিও। কিন্তু ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুথানে ২২ ফেব্রুয়ারি তাঁকে ফিরে পাওয়া যেন এক নতুন মুজিবকে ফিরে পাওয়া। ৬ দফা তথা ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের ফলে মুজিব কারা-অন্তরাল থেকে বেরিয়ে এলেন; বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হলো তাঁকে। যখন বাংলার মাটির একান্ত গন্ধে ভরা; শিশুর মতো কোমল হৃদয়ের মানুষটি যখন তর্জনী নেড়ে ‘মুক্তিসংগ্রামে’র ঘোষণা দিয়ে দিলেন, তখন তিনি অনেক কঠোর মনোবল আর জনগণের মুক্তির উন্মাদনায় অনেক বেশি কৌশলী ব্যক্তিত্ব হিসেবে গণমানুষের হৃদয়ের গভীরে স্থান করে নিয়েছেন।
বাঁচার জন্য যুদ্ধ, অস্তিত্বের জন্য যুদ্ধ। তখন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বরই আমাদের চেতনার আগুনে সঞ্চিত শক্তি। প্রতিটি বাঙালিই যেন একেকটি যোদ্ধা। আর যাঁরা রণাঙ্গনে, তাঁরা তো প্রতি নিশ্বাস-প্রশ্বাসে বঙ্গবন্ধুকে ভর করে আছেন। তখন আরেকবার আমরা হারিয়েছি এই বিরাট ব্যক্তিত্বকে। স্বাধীন মাটি, স্বাধীন জলবায়ু আর ভৌগোলিক রেখা ও স্বাধীন পতাকার জন্য নয়টি মাস অধিকার আদায়ের যুদ্ধ চলল। চলল ইতিহাসের সব উদাহরণ ছাড়িয়ে। তখন সবার একই প্রত্যাশা, শেখ মুজিবকে মুক্ত মানব হিসেবে দেশের মাটিতে ফিরে পাওয়া; পাকিস্তানের শাসকেরা তখন তাঁকে ফাঁসি দেওয়ার পাঁয়তারা করছে, কনডেমড সেলের পাশেই কবর খোঁড়া হয়েছে শেখ মুজিবের জন্য, কিন্তু বিশ্ববিবেক তখন সোচ্চার। বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে শেখ মুজিবের মুক্তির আন্দোলনে সারা দুনিয়ায় তখন কী এক জাগরণ!
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ বিবিসিকে চিনেছিল আপন করে। যে খবর বিশ্বাস করা যায়, মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলিকে নিশ্চিত করে বোঝা যায়, সেই বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যম হিসেবে বিবিসিতে লুকিয়ে লুকিয়ে কান রাখা–যেন এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। সেই বিবিসির খবরের প্রতি কান পেতে প্রতীক্ষা করতে হয়েছে পুরো জাতিকে, স্বাধীনতা-উত্তরকালেও। বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরা নিয়ে নানা রকমের গুজব আর আশঙ্কার কথাকে মিথ্যে করে দিয়ে বিবিসি খবর দিয়েছে, বঙ্গবন্ধু ফিরছেন।
বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ ব্রিটিশ রয়েল এয়ারফোর্সের একটি বিমানে ফিরেছেন নিউ দিল্লি, তারপর তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান—এই তিন মাইল পথ পাড়ি দিয়ে জনস্রোতের ভালোবাসায় নিজেকে সিক্ত করে পৌঁছাতে তাঁর সময়ই লেগেছে দুই ঘণ্টার বেশি। বঙ্গবন্ধুর এই ফিরে আসা যেন আকাশ বিদীর্ণ করে কোনো দেবদূতের ফিরে আসা।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৪—এই তিন বছর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের জনগণের জন্য ছিল বিরাট পরীক্ষার সময়। দেশের সব অবকাঠামোই ধ্বংসপ্রাপ্ত, পোড়া মাটির ওপর গড়ে উঠেছে মানুষের নতুন বসতি। ধীরে ধীরে মানুষ নতুন উদ্দীপনায় বাঁচার স্বপ্ন দেখছে। আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা ধীরে ধীরে বাস্তবতার নিরিখে সহনীয় হয়ে উঠছে। আর সেই সময়ে দেশি-বিদেশি রাজনীতি ও অর্থনীতির কূটচাল চলছে বাংলাদেশের ওপর। বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি তিন বছর কিছুই দিতে পারব না, প্রত্যাশাপিয়াসী মানুষ তখন বুঝতে পেরেছিল যে জাতি হিসেবে আমাদের অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করতে হবে। অভাব-অনটনের মধ্যে সাধারণ মানুষ ভবিষ্যতের আশায় বুক বাঁধতে শুরু করে। দেশকে গড়ে তুলতে ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-জনতা—সবাই তৎপর হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তেলের মূল্য বৃদ্ধি এবং বিশ্বজুড়ে অশান্তির সূত্রপাত হতে থাকে। দেশের মানুষ খাদ্যঘাটতি মোকাবিলা করে, উপর্যুপরি বন্যায় ফসল বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে এই খাদ্যঘাটতি এবং নিরন্ন মানুষের কষ্ট বঙ্গবন্ধুকে গভীর পীড়া দেয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশের বিভিন্ন স্থানে লঙ্গরখানা চালু হয়। রুটি-খিচুড়ি রান্না করে ক্ষুধার্থ মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয় বেশ অনেক দিন।
দেশের মানুষের যুদ্ধজয়ের ফসল ঘরে তোলার যে প্রত্যাশা, তা বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ায়। সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে থাকে। দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ নিজস্ব ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। অধনতান্ত্রিক বিকাশের পথে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র চর্চার এক নতুন অধ্যায় সূচিত হতে থাকে, কিন্তু অপরদিকে ষড়যন্ত্রকারীরা বাঙালি জাতির কণ্ঠরোধ করে নিস্তব্ধ করার চেষ্টায় মেতে ওঠে। কুচক্রীরা জনমতের তোয়াক্কা না করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ খুঁজতে থাকে। দেশের তৎকালীন শাসকদের সমালোচনা করতে তাদের কোনো কুণ্ঠা নেই, সংকোচ নেই, লজ্জা নেই। দেশকে স্বাধীন করতে গিয়ে রক্তবন্যায় যে জাতি সিক্ত হলো, সে জাতির জন্য নতুন পরীক্ষার সময় এলো। পরাজিত শত্রুর ষড়যন্ত্রের শেষ ছিল না। কতিপয় উচ্চাভিলাষী উর্দি পরা লোক কাপুরুষের বেশে রাতের আধাঁরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে হামলা চালিয়ে জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দিল ক্ষণজন্মা এই পুরুষের। তাদের সহায়তা করল খোন্দকার মুশতাক গং। বিশাল-বিস্তৃত মানবিক উদারতার অখণ্ড উদাহরণ বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের সমাপ্তি টেনে দিল খুনিরা। বাঙালি জাতি যাঁকে পেয়ে হারালাম, আবার পেলাম তাঁকে, ১৯৭৫-এর আগস্টে যে মহামানবকে হারালাম, তাঁকে কি সত্যিকার অর্থে আমরা হারিয়েছি? পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতি বাকহীন...স্তব্ধ হয়ে গেছে... চোখ দিয়ে তাদের অশ্রু গড়িয়েছে ... কিন্তু উচ্চারণে বিদীর্ণ হয়নি পরিবেশ। জাতি যেন গুমরে মরেছে এক নিঃশব্দ চিৎকারে।
কালের অমোঘ নিয়মে আমরা পেরিয়েছি প্রায় ৫০ বছর। ১৯৯৬-তে যখন দেশের শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন হলো, তখন দেখা গেল টেলিভিশনের পর্দায় বঙ্গবন্ধুকে তর্জনী উঁচিয়ে সেই ৭ মার্চের ভাষণ দিতে। জনতা জাগল নতুন জোয়ারে; যা নাকি টিভির পর্দায় নিষিদ্ধ ছিল গত ২১ বছর। বাঙালির হৃদয়ের গভীর উৎসমূল থেকে বেরিয়ে এলেন স্মরণের পথরেখা বেয়ে বঙ্গবন্ধু। বাঙালি জাতি তো বঙ্গবন্ধুকে তাদের হৃদয়ের অন্তঃস্থলে স্থান করে নিয়েছে, তা কি বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে! যুগ যুগ যে জাতি নীরবে স্মরণের প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছে, বঙ্গোপসাগরের বালুকাবেলায় যে মানুষ নগ্ন পায়ে হেঁটে এসে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ জাগরূক রাখতে আজীবন পণ করেছে, আজ তো সেই জাতির নতুন শপথের দিন।
ভ্রান্তিবিলাসে কেটেছে এ জাতির অনেকটা সময়। আজ যারা তরুণ, নব প্রজন্মের, নব পথরেখায় যাদের যাত্রা, তারা আত্ম-উন্মোচন করছে উত্তরাধিকারের। তারা অনেক দিন দেখেনি বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলাদেশের বেতার-টিভিতে কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে। ঐতিহাসিক ঘটনাক্রমে বঙ্গবন্ধু বাঙালির অস্তিত্বে, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে একটি উজ্জ্বলতম নাম, তা এই প্রজন্মকে জানতে দেওয়া হয়নি। সত্যকে চেপে রাখা হয়েছে গভীরভাবে। যারা এই ষড়যন্ত্র করেই ক্ষান্ত হয়নি, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে, রাষ্ট্রীয় মর্যাদাকে মিথ্যাচার করে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে; নতুন প্রজন্মকে বিপথে চলতে শিখিয়েছে তাদের মিথ্যাচারের স্বরূপ উদ্ঘাটন করে শাস্তি দেওয়া হবে না?
শুধু বাঙালি নয়, শোষিত-বঞ্চিত জাতিসত্তার অধিকার আদায়ের সংগ্রামের প্রতীক বিশ্বনেতা হয়ে বঙ্গবন্ধু ফিরে ফিরে আসেন। তাঁর চেতনা বাঙালির জীবন পাঁচালীর প্রতিটি গর্বের অফুরন্ত শক্তির আধার হোক। আত্মজিজ্ঞাসায় নতুন প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হোক। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিময় পথছায়ায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রচিত হোক। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির চেতনায় উজ্জ্বল হয়ে, প্রজ্বলিত হয়ে, চির অম্লান হয়ে ফিরে ফিরে আসুক নিরন্তর সময়ের ধারায়।
বঙ্গবন্ধু পর্বতপ্রমাণ ব্যক্তিত্ব, সূর্যস্তম্ভের মতো দৃঢ় একজন মহানুভব মানুষ। যাঁকে নিয়ে আজকে বাংলার মানুষের অফুরান গর্ব। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। এই মহামানবকে নিয়ে আজ ঘরে ঘরে স্মৃতিরোমন্থনের পালা। এই উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের দ্যুতি ছড়িয়ে আছে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়কন্দরে। কতিপয় কুচক্রী এই অবিসংবাদিত নেতাকে বাঙালির মনের গভীর থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছে; কিন্তু বঙ্গবন্ধু সময়ের বিবর্তনে অধিকতর উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন।
বঙ্গবন্ধুকে আমরা সময়ে সময়ে পেয়েছি, আবার হারিয়েছিও। এই পেয়ে হারানোর বেদনা বাঙালির জীবনে গভীর। ১৭ মার্চ ১৯২০ সালে টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেন শেখ মুজিবুর রহমান। ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের মূল রাজনৈতিক ধারা থেকে পথচ্যুত হয়ে সাম্প্রদায়িক ধারায় প্রবাহিত হতে থাকা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রভাবের কারণে সৃষ্ট পাকিস্তানি রাজনৈতিক চিন্তা তিনি স্বস্তির সঙ্গে গ্রহণ করতে পারেননি। তাঁর চিন্তা ও চেতনার যে বৈশিষ্ট্য, তা সব সময় বাঙালির গর্ব হয়ে একটি পৃথক স্বরগ্রাম তৈরি করেছে। যেখানে বাংলার মাঠ-ঘাট, কৃষক-শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষের সত্যিকার বাঁচার স্বপ্নই চিরন্তন। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ এই ব্যক্তিকে তাই দেখা যায় ১৯৪৯ সাল থেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের মৌল কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টায় এক নির্মাণকুশলী, রাজনীতির ফুল দিয়ে মালা গাঁথছেন একটি আধুনিক স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলার স্বপ্নে এবং চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে।
১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। সে বছরের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করেন মুসলিম ছাত্রলীগ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ইসলামিয়া কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে ইতিমধ্যে তিনি ঢাকায় ফিরে এসেছেন। তখন দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধুর উচ্চকণ্ঠ উপস্থিতি যখন আইন পরিষদে খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালু করার গভীর চক্রান্ত চালাচ্ছেন; অপরদিকে বঙ্গবন্ধু ছাত্র-জনতাকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সংঘবদ্ধ করছেন। চলতে থাকে প্রতিবাদের ঝড়। ১১ মার্চ তিনি প্রতিবাদ করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। কিছুদিন বাঙালির দৃষ্টির আড়াল হলেও বেরিয়ে আসেন গরাদের আড়াল থেকে। আবার ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮-এ বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর থেকেই কারাগার যেন তাঁর জীবনের একটি অপরিহার্য পরিণতি হয়ে দেখা দেয়। সংগ্রাম-আন্দোলনের জন্য যে পুরুষের জন্ম, তাঁকে কি কোনো জেল-হাজতের মধ্যে পুরে রাখলেই নিঃশেষ করে ফেলা যায়? তিনি ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি জেল থেকে মুক্তি পান এবং মুক্তি পেয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবিদাওয়া সমর্থন করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। এ বছর কয়েকবার তিনি কারাবরণ করেন এবং ১ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু আবার বন্দী হন। ভাষার দাবিতে তিনি কারাগারে অনশন করেন। দৃষ্টির আড়াল হয়ে কারাগারে অন্তরীণ হয়ে থাকেন প্রায় দুই বছর। বাঙালির এই নেতা মাঝে মাঝে এমনই হারিয়ে গেছেন সময়ের ব্যবধানে। কিন্তু বাঙালি নেতৃত্ব কখনো তাঁকে হারিয়ে ফেলেনি একেবারে। ২৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্তি পান কারাগার থেকে।
মুজিব ব্যস্ত হয়ে পড়েন যুক্তফ্রন্ট গঠনে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করার লক্ষ্যে শেখ মুজিব বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ১৯৬০-এর দশকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। ১৯৬৬-তে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারকে উজ্জীবিত করে তোলার একটি বড় মাপের পদক্ষেপ। যার ফলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে এক নম্বর আসামি করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হয়েছিল শাসকগোষ্ঠীর পাঁয়তারায়। কুচক্রীদের মাথায় তখন থেকেই শেখ মুজিবকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানোর ষড়যন্ত্র ছিল। অপরদিকে জনগণের আন্দোলন হচ্ছিল বেগবান। সেদিনের জনজোয়ারের ফলে শেখ মুজিবকে আটকে রাখা যায়নি।
Cyril Dunn-এর ভাষায়, ‘Released again, he dedicated himself more vehemently than ever to the liberation of Bengal. …On these occasions he was always immensely cheerful and was plainly supported by the belief that the mass of the Bengalis were behind him.’ [“How Mujib Turned into Bengal’s Hero,” The Observer, 28 March 1971, London.] মুজিবকে আমরা হারিয়েছি তখন কিছুটা সময়ের জন্য। পেয়েছিও। কিন্তু ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুথানে ২২ ফেব্রুয়ারি তাঁকে ফিরে পাওয়া যেন এক নতুন মুজিবকে ফিরে পাওয়া। ৬ দফা তথা ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের ফলে মুজিব কারা-অন্তরাল থেকে বেরিয়ে এলেন; বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হলো তাঁকে। যখন বাংলার মাটির একান্ত গন্ধে ভরা; শিশুর মতো কোমল হৃদয়ের মানুষটি যখন তর্জনী নেড়ে ‘মুক্তিসংগ্রামে’র ঘোষণা দিয়ে দিলেন, তখন তিনি অনেক কঠোর মনোবল আর জনগণের মুক্তির উন্মাদনায় অনেক বেশি কৌশলী ব্যক্তিত্ব হিসেবে গণমানুষের হৃদয়ের গভীরে স্থান করে নিয়েছেন।
বাঁচার জন্য যুদ্ধ, অস্তিত্বের জন্য যুদ্ধ। তখন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বরই আমাদের চেতনার আগুনে সঞ্চিত শক্তি। প্রতিটি বাঙালিই যেন একেকটি যোদ্ধা। আর যাঁরা রণাঙ্গনে, তাঁরা তো প্রতি নিশ্বাস-প্রশ্বাসে বঙ্গবন্ধুকে ভর করে আছেন। তখন আরেকবার আমরা হারিয়েছি এই বিরাট ব্যক্তিত্বকে। স্বাধীন মাটি, স্বাধীন জলবায়ু আর ভৌগোলিক রেখা ও স্বাধীন পতাকার জন্য নয়টি মাস অধিকার আদায়ের যুদ্ধ চলল। চলল ইতিহাসের সব উদাহরণ ছাড়িয়ে। তখন সবার একই প্রত্যাশা, শেখ মুজিবকে মুক্ত মানব হিসেবে দেশের মাটিতে ফিরে পাওয়া; পাকিস্তানের শাসকেরা তখন তাঁকে ফাঁসি দেওয়ার পাঁয়তারা করছে, কনডেমড সেলের পাশেই কবর খোঁড়া হয়েছে শেখ মুজিবের জন্য, কিন্তু বিশ্ববিবেক তখন সোচ্চার। বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে শেখ মুজিবের মুক্তির আন্দোলনে সারা দুনিয়ায় তখন কী এক জাগরণ!
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ বিবিসিকে চিনেছিল আপন করে। যে খবর বিশ্বাস করা যায়, মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলিকে নিশ্চিত করে বোঝা যায়, সেই বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যম হিসেবে বিবিসিতে লুকিয়ে লুকিয়ে কান রাখা–যেন এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। সেই বিবিসির খবরের প্রতি কান পেতে প্রতীক্ষা করতে হয়েছে পুরো জাতিকে, স্বাধীনতা-উত্তরকালেও। বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরা নিয়ে নানা রকমের গুজব আর আশঙ্কার কথাকে মিথ্যে করে দিয়ে বিবিসি খবর দিয়েছে, বঙ্গবন্ধু ফিরছেন।
বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ ব্রিটিশ রয়েল এয়ারফোর্সের একটি বিমানে ফিরেছেন নিউ দিল্লি, তারপর তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান—এই তিন মাইল পথ পাড়ি দিয়ে জনস্রোতের ভালোবাসায় নিজেকে সিক্ত করে পৌঁছাতে তাঁর সময়ই লেগেছে দুই ঘণ্টার বেশি। বঙ্গবন্ধুর এই ফিরে আসা যেন আকাশ বিদীর্ণ করে কোনো দেবদূতের ফিরে আসা।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৪—এই তিন বছর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের জনগণের জন্য ছিল বিরাট পরীক্ষার সময়। দেশের সব অবকাঠামোই ধ্বংসপ্রাপ্ত, পোড়া মাটির ওপর গড়ে উঠেছে মানুষের নতুন বসতি। ধীরে ধীরে মানুষ নতুন উদ্দীপনায় বাঁচার স্বপ্ন দেখছে। আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা ধীরে ধীরে বাস্তবতার নিরিখে সহনীয় হয়ে উঠছে। আর সেই সময়ে দেশি-বিদেশি রাজনীতি ও অর্থনীতির কূটচাল চলছে বাংলাদেশের ওপর। বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি তিন বছর কিছুই দিতে পারব না, প্রত্যাশাপিয়াসী মানুষ তখন বুঝতে পেরেছিল যে জাতি হিসেবে আমাদের অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করতে হবে। অভাব-অনটনের মধ্যে সাধারণ মানুষ ভবিষ্যতের আশায় বুক বাঁধতে শুরু করে। দেশকে গড়ে তুলতে ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-জনতা—সবাই তৎপর হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তেলের মূল্য বৃদ্ধি এবং বিশ্বজুড়ে অশান্তির সূত্রপাত হতে থাকে। দেশের মানুষ খাদ্যঘাটতি মোকাবিলা করে, উপর্যুপরি বন্যায় ফসল বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে এই খাদ্যঘাটতি এবং নিরন্ন মানুষের কষ্ট বঙ্গবন্ধুকে গভীর পীড়া দেয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশের বিভিন্ন স্থানে লঙ্গরখানা চালু হয়। রুটি-খিচুড়ি রান্না করে ক্ষুধার্থ মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয় বেশ অনেক দিন।
দেশের মানুষের যুদ্ধজয়ের ফসল ঘরে তোলার যে প্রত্যাশা, তা বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ায়। সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে থাকে। দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ নিজস্ব ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। অধনতান্ত্রিক বিকাশের পথে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র চর্চার এক নতুন অধ্যায় সূচিত হতে থাকে, কিন্তু অপরদিকে ষড়যন্ত্রকারীরা বাঙালি জাতির কণ্ঠরোধ করে নিস্তব্ধ করার চেষ্টায় মেতে ওঠে। কুচক্রীরা জনমতের তোয়াক্কা না করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ খুঁজতে থাকে। দেশের তৎকালীন শাসকদের সমালোচনা করতে তাদের কোনো কুণ্ঠা নেই, সংকোচ নেই, লজ্জা নেই। দেশকে স্বাধীন করতে গিয়ে রক্তবন্যায় যে জাতি সিক্ত হলো, সে জাতির জন্য নতুন পরীক্ষার সময় এলো। পরাজিত শত্রুর ষড়যন্ত্রের শেষ ছিল না। কতিপয় উচ্চাভিলাষী উর্দি পরা লোক কাপুরুষের বেশে রাতের আধাঁরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে হামলা চালিয়ে জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দিল ক্ষণজন্মা এই পুরুষের। তাদের সহায়তা করল খোন্দকার মুশতাক গং। বিশাল-বিস্তৃত মানবিক উদারতার অখণ্ড উদাহরণ বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের সমাপ্তি টেনে দিল খুনিরা। বাঙালি জাতি যাঁকে পেয়ে হারালাম, আবার পেলাম তাঁকে, ১৯৭৫-এর আগস্টে যে মহামানবকে হারালাম, তাঁকে কি সত্যিকার অর্থে আমরা হারিয়েছি? পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতি বাকহীন...স্তব্ধ হয়ে গেছে... চোখ দিয়ে তাদের অশ্রু গড়িয়েছে ... কিন্তু উচ্চারণে বিদীর্ণ হয়নি পরিবেশ। জাতি যেন গুমরে মরেছে এক নিঃশব্দ চিৎকারে।
কালের অমোঘ নিয়মে আমরা পেরিয়েছি প্রায় ৫০ বছর। ১৯৯৬-তে যখন দেশের শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন হলো, তখন দেখা গেল টেলিভিশনের পর্দায় বঙ্গবন্ধুকে তর্জনী উঁচিয়ে সেই ৭ মার্চের ভাষণ দিতে। জনতা জাগল নতুন জোয়ারে; যা নাকি টিভির পর্দায় নিষিদ্ধ ছিল গত ২১ বছর। বাঙালির হৃদয়ের গভীর উৎসমূল থেকে বেরিয়ে এলেন স্মরণের পথরেখা বেয়ে বঙ্গবন্ধু। বাঙালি জাতি তো বঙ্গবন্ধুকে তাদের হৃদয়ের অন্তঃস্থলে স্থান করে নিয়েছে, তা কি বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে! যুগ যুগ যে জাতি নীরবে স্মরণের প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছে, বঙ্গোপসাগরের বালুকাবেলায় যে মানুষ নগ্ন পায়ে হেঁটে এসে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ জাগরূক রাখতে আজীবন পণ করেছে, আজ তো সেই জাতির নতুন শপথের দিন।
ভ্রান্তিবিলাসে কেটেছে এ জাতির অনেকটা সময়। আজ যারা তরুণ, নব প্রজন্মের, নব পথরেখায় যাদের যাত্রা, তারা আত্ম-উন্মোচন করছে উত্তরাধিকারের। তারা অনেক দিন দেখেনি বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলাদেশের বেতার-টিভিতে কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে। ঐতিহাসিক ঘটনাক্রমে বঙ্গবন্ধু বাঙালির অস্তিত্বে, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে একটি উজ্জ্বলতম নাম, তা এই প্রজন্মকে জানতে দেওয়া হয়নি। সত্যকে চেপে রাখা হয়েছে গভীরভাবে। যারা এই ষড়যন্ত্র করেই ক্ষান্ত হয়নি, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে, রাষ্ট্রীয় মর্যাদাকে মিথ্যাচার করে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে; নতুন প্রজন্মকে বিপথে চলতে শিখিয়েছে তাদের মিথ্যাচারের স্বরূপ উদ্ঘাটন করে শাস্তি দেওয়া হবে না?
শুধু বাঙালি নয়, শোষিত-বঞ্চিত জাতিসত্তার অধিকার আদায়ের সংগ্রামের প্রতীক বিশ্বনেতা হয়ে বঙ্গবন্ধু ফিরে ফিরে আসেন। তাঁর চেতনা বাঙালির জীবন পাঁচালীর প্রতিটি গর্বের অফুরন্ত শক্তির আধার হোক। আত্মজিজ্ঞাসায় নতুন প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হোক। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিময় পথছায়ায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রচিত হোক। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির চেতনায় উজ্জ্বল হয়ে, প্রজ্বলিত হয়ে, চির অম্লান হয়ে ফিরে ফিরে আসুক নিরন্তর সময়ের ধারায়।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪