এডওয়ার্ড আইয়ুব পালক
স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সূচকে এখন এক সম্মানজনক অবস্থানে। এই প্রথম কোনো সরকার একনাগাড়ে বেশ দীর্ঘ সময় পেয়েছে দেশের অগ্রগতিতে কাজ করার। কিন্তু এই অগ্রগতি মসৃণ নয়, রয়েছে বহুল আলোচিত নানাবিধ চ্যালেঞ্জ—দুর্নীতি, বিদেশে অর্থ পাচার, মৌলবাদের উত্থান, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সাম্প্রতিক করোনার আঘাত, শিক্ষার অনগ্রসরতা, বেকারত্ব, ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ, প্রায় অর্ধেকের মতো ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী জনসংখ্যার অসহযোগিতা, রাজনীতিতে কলুষতা, পক্ষপাতদুষ্ট, সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহার, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, মাদক ইত্যাদি। আমাদের সমাজে এরূপ হাজারো সমস্যা রয়েছে, বিশ্বের যেকোনো সমাজেও কমবেশি এসব রয়েছে। কোনো চ্যালেঞ্জ ও সমস্যার সংকটকে এককভাবে দায়ী বলা যাবে না। এসব আপেক্ষিক ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এসব অবস্তুগত বিষয় নয়, কিন্তু বাস্তব। আমি আমাদের জনসমাজের নীতি-নৈতিকতা নিয়ে চিন্তা করতে চাই। কেননা, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু যদি মানুষের নৈতিকতার পরিবর্তন না হয়, সব ধরনের উন্নয়ন ফলহীন হবে।
ঐতিহাসিক ও কৃষ্টিগত ঐতিহ্যের গর্বিত বাঙালি আমরা, কখনো দুর্নীতির ঊর্ধ্বে ছিলাম না। তবে এখন আমাদের নৈতিকতার মান আগের চেয়ে ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমরা কেউই শতভাগ দাবি করতে পারব না যে আমরা নৈতিক, সমাজের আদর্শ ও পরবর্তী প্রজন্মের অনুসরণীয় হতে পেরেছি। তবে ভালো লোক আমাদের সমাজে এখনো আছেন। অনৈতিকতার সুনামিতে তাঁরা নীরব, হতাশ, কোণঠাসা ও উপেক্ষিত। অনৈতিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নৈতিক সংখ্যালঘিষ্ঠ ক্ষমতায় আসুক তা চায় না। কেননা, এতে অনৈতিক সমাজকে অসুবিধায় পড়তে হয়। সমাজে বহুকাল ধরে চলমান অনৈতিকতাই নৈতিকতা হিসেবে গৃহীত হয়েছে। ঘুষ দিয়ে কাজ আদায় করার জন্য আমরা একজন ভালো ও নির্ভরযোগ্য লোক খুঁজি। ঘুষ নিয়ে কাজ করে দিলে তিনি ভালো লোক, ঘুষ নিয়েও যিনি কাজ করেন না, তিনি খারাপ লোক। তাহলে যিনি ঘুষ না নিয়ে কাজ করে দেন, তাঁর অবস্থান কোথায়? অনিয়ম এখন অলিখিত নিয়ম, যা লিখিত নিয়মের চেয়েও শক্তিশালী। অলিখিত অনৈতিক নিয়ম সমাজের চালিকাশক্তি। অনৈতিক কাজ করতে পেরে আমরা উল্লসিত, যেন বিশ্ব জয় করে ফেলেছি। আমরা সাহসিকতার সঙ্গে মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দিচ্ছি। মানুষ এখন আর ঘুষ দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দিনে নৈতিকতার মানদণ্ড বদলে যাবে, নীতিশাস্ত্রের সংজ্ঞা পাল্টাতে হবে।
সরকারকে দোষ দিয়ে আমাদের দায়িত্ব শেষ বলার কোনো সুযোগ নেই। নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করার সর্বপ্রথম স্তর হচ্ছে পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। পরিবারেই মা-বাবার নৈতিকতার আদর্শ সন্তানদের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। ঘরে নৈতিকতার চর্চা না থাকলে সন্তান বাইরে থেকে শিখবে না। যে পরিবারের বাবা-মা অনৈতিক উপায়ে অর্থ দিয়ে সন্তানদের লেখাপড়ায় অঢেল খরচ করছেন, তাঁরা সন্তানদের মধ্যে অজান্তেই অনৈতিকতার দূষিত বীজ বপন করছেন। আবার যে সমাজে একটি শিশু বড় হচ্ছে, সেই সমাজেরও দায়িত্ব আছে। সমাজের দায়িত্ব হচ্ছে সবাইকে সঠিক পথ দেখানো। নৈতিকতার চর্চা নিচ থেকে শুরু হতে হবে। ওপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে কোনো সরকার নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।
পরিবারের পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, ধারাবাহিকতার সম্পর্ক থাকতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ দায়িত্ব পালনে প্রশ্নের মুখে। ধর্মীয় শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ একপেশে ধর্মীয় নৈতিকতা দ্বারা নৈতিকতার বিভাজন সৃষ্টি করছে। কেউ একজন বলেছেন, অফিস-আদালত ও ব্যবসা-বাণিজ্যে ধর্মীয় লেবাস প্রতারণার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই সম্পূর্ণ ধর্ম-অনির্ভর পারিবারিক ও সামাজিক নৈতিকতাপূর্ণ মানবত্বের মান শিক্ষা দেওয়া দরকার। প্রায় প্রতিটি ধর্ম নৈতিকতা সম্পর্কে ভালো কথা বলে এবং শিক্ষা দেয়। প্রায় প্রতিটি ধর্ম পরকালকে ব্যবহার করে মানুষকে সতর্ক করতে। এই পরকাল-পন্থা কাজ করছে কি না, মূল্যায়ন করা উচিত। আমাদের সংস্কৃতিতে মানুষ এখনো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নয়, তাই তারা আগামী দিন নিয়ে তেমন চিন্তা করে না। নানা কারণে তারা ‘আজ ও বর্তমান’ নিয়ে চিন্তিত। আজকে দুমুঠো মোটা চাল, ডাল-ভাত জুটলেই খুশি। তাই ভবিষ্যতের ভয় না দেখিয়ে বর্তমান পরিণতি নিয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এর মানে পরকালকে অস্বীকার করতে বলছি না।
সমাধান একা সরকারের পক্ষে যেমন অসম্ভব, তেমনি এটি সময়সাপেক্ষ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারকে এখন থেকে যেদিকে নজর দিতে হবে, তা হচ্ছে দেশের মানুষের মধ্যে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করা এবং উত্তমতার স্বীকৃতি নিশ্চিত করা আর মন্দকে প্রশ্রয় না দেওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন। পরিবার, স্থানীয় সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও সরকার মিলে নৈতিকতার লক্ষ্যে সমন্বিত কাজ করা দরকার। সমাজে কোন কোন বিষয় আমাদের অনৈতিকতার দিকে চালিত করছে, তা নিয়ে চিন্তা করার চেয়েও আমাদের বের করতে হবে কারা আমাদের পরিকল্পিতভাবে অনৈতিক করছে, কেন করছে এবং তারা কোন কোন উপাদান ব্যবহার করছে।
শিক্ষার পাঠ্যসূচি আমাদের কৃষ্টি ও মূল্যবোধের আলোকে সর্বজনীন ও গ্রহণযোগ্য করে সাজাতে হবে। লেখাপড়ার লক্ষ্য গাড়ি-ঘোড়ায় চড়া নয়, অর্থ আয় করা নয়, স্বীয় জাগতিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা নয়, স্বার্থপরভাবে অন্যকে বঞ্চিত করে নিজে টিকে থাকা নয়; কিন্তু নৈতিক মানুষ হওয়া।
দেশের সব সেক্টরকে একই সঙ্গে নৈতিকতায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। যেমন—ভূমি সেক্টর যদি সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি চর্চার স্থান হয়, তাহলে সেই সেক্টরকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এর সঙ্গে লাখ লাখ লোক জড়িত, যারা প্রতিদিন অনৈতিকতার শিকার হচ্ছে। যদি শুধু এই সেক্টরকে রক্ষা করা যায়, তাহলে সরকারের জনপ্রিয়তা বহু গুণ বেড়ে যাবে। এটি উন্নয়ন দ্বারা জনপ্রিয়তা অর্জনের চেয়েও বেশি কার্যকর। ডিজিটালাইজেশন ও অনলাইন সেবা এতে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এর চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার কারণে বেশির ভাগ জনগণ এখনো এতে অভ্যস্ত নয়।
সরকার এবং দলের প্রধান ও নেতাদের উচিত সরকারের মধ্যে সংস্কার নিয়ে আসার চেষ্টা অব্যাহত রাখা। সমাজ এখনো একেবারে নষ্ট হয়ে যায়নি, নৈতিক লোক এখনো আছে। তাঁদের নেতৃত্বের মূলধারায় নিয়ে আসা দরকার। এতে সরকারের ওপর মানুষের আস্থা বাড়বে। সরকারের উদ্দেশ্য ক্ষমতায় টিকে থাকা যেন না হয়, ক্ষমতার বাইরে থেকেও সমাজের জন্য কাজ করা যায়। জনগণের সেবাই আসল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। সৎ ও দেশপ্রেমিক দল ও সরকারকে জনগণই খুঁজে বের করবে এবং ক্ষমতায় আনবে। ভোটের অধিকার নিয়ে জনগণ তেমন উদ্বিগ্ন নয়, তাই সেই প্রশ্ন নিয়ে সময় ব্যয় না করে আমাদের দেখা দরকার, অতীতে যে দলগুলো অনৈতিকতার চর্চা করেছে, জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই শুধু ভোটনির্ভর ক্ষমতায় আসার লোভ ত্যাগ করা উচিত। অনৈতিকতার জন্য আবার দ্রুত শাস্তি দেওয়া বাস্তবসম্মত হবে না, এতে কাউকে পাশে পাওয়া যাবে না, পরিবর্তন করার মতো লোকও পাওয়া যাবে না; বরং দূরে ঠেলে না দিয়ে পরিবর্তনের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
সবশেষে এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে শত চ্যালেঞ্জের মধ্যে দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষ স্বপ্ন দেখছে, তাদের পক্ষে অসম্ভব বলতে আর কিছু নেই। তাই এই অগ্রগতিকে চ্যালেঞ্জ-সংকুল অগ্রগতি বলা যায়। বাংলাদেশের অর্থনীতি পশ্চাৎপদতার প্রতিকূল স্রোত কাটিয়ে সামনের দিকে ধীরে অগ্রসরমাণ অগ্রগতি। অনৈতিকতার প্রতিকূলতা না থাকলে উন্নয়ন আরও অর্থবহ ও ত্বরান্বিত হতো। অনৈতিকতার জোয়ার উন্নয়নের সাফল্যকে ম্লান করছে। আমাদের দরকার নৈতিকতার বিপ্লব, যা বহু কষ্টসাধ্য পথ। অনৈতিকার দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্ত স্থাপন কিছুটা কাজ করতে পারে, কিন্তু মানুষের ভেতরকার পরিবর্তনের জন্য তৃণমূল থেকে পরিবর্তন শুরু করতে হবে। আসুন, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি বিশ্বাস করি। যার যার অবস্থান থেকে অবদান রাখি। কাউকে বাদ দিয়ে কেউ এগিয়ে যেতে পারে না, সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে এগিয়ে গেলেই প্রকৃত উন্নয়ন ফুটে উঠবে।
এডওয়ার্ড আইয়ুব পালক
গাজীপুর সিটি প্রেসবিটেরিয়ান চার্চ
স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সূচকে এখন এক সম্মানজনক অবস্থানে। এই প্রথম কোনো সরকার একনাগাড়ে বেশ দীর্ঘ সময় পেয়েছে দেশের অগ্রগতিতে কাজ করার। কিন্তু এই অগ্রগতি মসৃণ নয়, রয়েছে বহুল আলোচিত নানাবিধ চ্যালেঞ্জ—দুর্নীতি, বিদেশে অর্থ পাচার, মৌলবাদের উত্থান, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সাম্প্রতিক করোনার আঘাত, শিক্ষার অনগ্রসরতা, বেকারত্ব, ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ, প্রায় অর্ধেকের মতো ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী জনসংখ্যার অসহযোগিতা, রাজনীতিতে কলুষতা, পক্ষপাতদুষ্ট, সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহার, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, মাদক ইত্যাদি। আমাদের সমাজে এরূপ হাজারো সমস্যা রয়েছে, বিশ্বের যেকোনো সমাজেও কমবেশি এসব রয়েছে। কোনো চ্যালেঞ্জ ও সমস্যার সংকটকে এককভাবে দায়ী বলা যাবে না। এসব আপেক্ষিক ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এসব অবস্তুগত বিষয় নয়, কিন্তু বাস্তব। আমি আমাদের জনসমাজের নীতি-নৈতিকতা নিয়ে চিন্তা করতে চাই। কেননা, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু যদি মানুষের নৈতিকতার পরিবর্তন না হয়, সব ধরনের উন্নয়ন ফলহীন হবে।
ঐতিহাসিক ও কৃষ্টিগত ঐতিহ্যের গর্বিত বাঙালি আমরা, কখনো দুর্নীতির ঊর্ধ্বে ছিলাম না। তবে এখন আমাদের নৈতিকতার মান আগের চেয়ে ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমরা কেউই শতভাগ দাবি করতে পারব না যে আমরা নৈতিক, সমাজের আদর্শ ও পরবর্তী প্রজন্মের অনুসরণীয় হতে পেরেছি। তবে ভালো লোক আমাদের সমাজে এখনো আছেন। অনৈতিকতার সুনামিতে তাঁরা নীরব, হতাশ, কোণঠাসা ও উপেক্ষিত। অনৈতিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নৈতিক সংখ্যালঘিষ্ঠ ক্ষমতায় আসুক তা চায় না। কেননা, এতে অনৈতিক সমাজকে অসুবিধায় পড়তে হয়। সমাজে বহুকাল ধরে চলমান অনৈতিকতাই নৈতিকতা হিসেবে গৃহীত হয়েছে। ঘুষ দিয়ে কাজ আদায় করার জন্য আমরা একজন ভালো ও নির্ভরযোগ্য লোক খুঁজি। ঘুষ নিয়ে কাজ করে দিলে তিনি ভালো লোক, ঘুষ নিয়েও যিনি কাজ করেন না, তিনি খারাপ লোক। তাহলে যিনি ঘুষ না নিয়ে কাজ করে দেন, তাঁর অবস্থান কোথায়? অনিয়ম এখন অলিখিত নিয়ম, যা লিখিত নিয়মের চেয়েও শক্তিশালী। অলিখিত অনৈতিক নিয়ম সমাজের চালিকাশক্তি। অনৈতিক কাজ করতে পেরে আমরা উল্লসিত, যেন বিশ্ব জয় করে ফেলেছি। আমরা সাহসিকতার সঙ্গে মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দিচ্ছি। মানুষ এখন আর ঘুষ দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দিনে নৈতিকতার মানদণ্ড বদলে যাবে, নীতিশাস্ত্রের সংজ্ঞা পাল্টাতে হবে।
সরকারকে দোষ দিয়ে আমাদের দায়িত্ব শেষ বলার কোনো সুযোগ নেই। নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করার সর্বপ্রথম স্তর হচ্ছে পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। পরিবারেই মা-বাবার নৈতিকতার আদর্শ সন্তানদের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। ঘরে নৈতিকতার চর্চা না থাকলে সন্তান বাইরে থেকে শিখবে না। যে পরিবারের বাবা-মা অনৈতিক উপায়ে অর্থ দিয়ে সন্তানদের লেখাপড়ায় অঢেল খরচ করছেন, তাঁরা সন্তানদের মধ্যে অজান্তেই অনৈতিকতার দূষিত বীজ বপন করছেন। আবার যে সমাজে একটি শিশু বড় হচ্ছে, সেই সমাজেরও দায়িত্ব আছে। সমাজের দায়িত্ব হচ্ছে সবাইকে সঠিক পথ দেখানো। নৈতিকতার চর্চা নিচ থেকে শুরু হতে হবে। ওপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে কোনো সরকার নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।
পরিবারের পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, ধারাবাহিকতার সম্পর্ক থাকতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ দায়িত্ব পালনে প্রশ্নের মুখে। ধর্মীয় শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ একপেশে ধর্মীয় নৈতিকতা দ্বারা নৈতিকতার বিভাজন সৃষ্টি করছে। কেউ একজন বলেছেন, অফিস-আদালত ও ব্যবসা-বাণিজ্যে ধর্মীয় লেবাস প্রতারণার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই সম্পূর্ণ ধর্ম-অনির্ভর পারিবারিক ও সামাজিক নৈতিকতাপূর্ণ মানবত্বের মান শিক্ষা দেওয়া দরকার। প্রায় প্রতিটি ধর্ম নৈতিকতা সম্পর্কে ভালো কথা বলে এবং শিক্ষা দেয়। প্রায় প্রতিটি ধর্ম পরকালকে ব্যবহার করে মানুষকে সতর্ক করতে। এই পরকাল-পন্থা কাজ করছে কি না, মূল্যায়ন করা উচিত। আমাদের সংস্কৃতিতে মানুষ এখনো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নয়, তাই তারা আগামী দিন নিয়ে তেমন চিন্তা করে না। নানা কারণে তারা ‘আজ ও বর্তমান’ নিয়ে চিন্তিত। আজকে দুমুঠো মোটা চাল, ডাল-ভাত জুটলেই খুশি। তাই ভবিষ্যতের ভয় না দেখিয়ে বর্তমান পরিণতি নিয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এর মানে পরকালকে অস্বীকার করতে বলছি না।
সমাধান একা সরকারের পক্ষে যেমন অসম্ভব, তেমনি এটি সময়সাপেক্ষ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারকে এখন থেকে যেদিকে নজর দিতে হবে, তা হচ্ছে দেশের মানুষের মধ্যে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করা এবং উত্তমতার স্বীকৃতি নিশ্চিত করা আর মন্দকে প্রশ্রয় না দেওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন। পরিবার, স্থানীয় সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও সরকার মিলে নৈতিকতার লক্ষ্যে সমন্বিত কাজ করা দরকার। সমাজে কোন কোন বিষয় আমাদের অনৈতিকতার দিকে চালিত করছে, তা নিয়ে চিন্তা করার চেয়েও আমাদের বের করতে হবে কারা আমাদের পরিকল্পিতভাবে অনৈতিক করছে, কেন করছে এবং তারা কোন কোন উপাদান ব্যবহার করছে।
শিক্ষার পাঠ্যসূচি আমাদের কৃষ্টি ও মূল্যবোধের আলোকে সর্বজনীন ও গ্রহণযোগ্য করে সাজাতে হবে। লেখাপড়ার লক্ষ্য গাড়ি-ঘোড়ায় চড়া নয়, অর্থ আয় করা নয়, স্বীয় জাগতিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা নয়, স্বার্থপরভাবে অন্যকে বঞ্চিত করে নিজে টিকে থাকা নয়; কিন্তু নৈতিক মানুষ হওয়া।
দেশের সব সেক্টরকে একই সঙ্গে নৈতিকতায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। যেমন—ভূমি সেক্টর যদি সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি চর্চার স্থান হয়, তাহলে সেই সেক্টরকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এর সঙ্গে লাখ লাখ লোক জড়িত, যারা প্রতিদিন অনৈতিকতার শিকার হচ্ছে। যদি শুধু এই সেক্টরকে রক্ষা করা যায়, তাহলে সরকারের জনপ্রিয়তা বহু গুণ বেড়ে যাবে। এটি উন্নয়ন দ্বারা জনপ্রিয়তা অর্জনের চেয়েও বেশি কার্যকর। ডিজিটালাইজেশন ও অনলাইন সেবা এতে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এর চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার কারণে বেশির ভাগ জনগণ এখনো এতে অভ্যস্ত নয়।
সরকার এবং দলের প্রধান ও নেতাদের উচিত সরকারের মধ্যে সংস্কার নিয়ে আসার চেষ্টা অব্যাহত রাখা। সমাজ এখনো একেবারে নষ্ট হয়ে যায়নি, নৈতিক লোক এখনো আছে। তাঁদের নেতৃত্বের মূলধারায় নিয়ে আসা দরকার। এতে সরকারের ওপর মানুষের আস্থা বাড়বে। সরকারের উদ্দেশ্য ক্ষমতায় টিকে থাকা যেন না হয়, ক্ষমতার বাইরে থেকেও সমাজের জন্য কাজ করা যায়। জনগণের সেবাই আসল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। সৎ ও দেশপ্রেমিক দল ও সরকারকে জনগণই খুঁজে বের করবে এবং ক্ষমতায় আনবে। ভোটের অধিকার নিয়ে জনগণ তেমন উদ্বিগ্ন নয়, তাই সেই প্রশ্ন নিয়ে সময় ব্যয় না করে আমাদের দেখা দরকার, অতীতে যে দলগুলো অনৈতিকতার চর্চা করেছে, জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই শুধু ভোটনির্ভর ক্ষমতায় আসার লোভ ত্যাগ করা উচিত। অনৈতিকতার জন্য আবার দ্রুত শাস্তি দেওয়া বাস্তবসম্মত হবে না, এতে কাউকে পাশে পাওয়া যাবে না, পরিবর্তন করার মতো লোকও পাওয়া যাবে না; বরং দূরে ঠেলে না দিয়ে পরিবর্তনের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
সবশেষে এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে শত চ্যালেঞ্জের মধ্যে দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষ স্বপ্ন দেখছে, তাদের পক্ষে অসম্ভব বলতে আর কিছু নেই। তাই এই অগ্রগতিকে চ্যালেঞ্জ-সংকুল অগ্রগতি বলা যায়। বাংলাদেশের অর্থনীতি পশ্চাৎপদতার প্রতিকূল স্রোত কাটিয়ে সামনের দিকে ধীরে অগ্রসরমাণ অগ্রগতি। অনৈতিকতার প্রতিকূলতা না থাকলে উন্নয়ন আরও অর্থবহ ও ত্বরান্বিত হতো। অনৈতিকতার জোয়ার উন্নয়নের সাফল্যকে ম্লান করছে। আমাদের দরকার নৈতিকতার বিপ্লব, যা বহু কষ্টসাধ্য পথ। অনৈতিকার দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্ত স্থাপন কিছুটা কাজ করতে পারে, কিন্তু মানুষের ভেতরকার পরিবর্তনের জন্য তৃণমূল থেকে পরিবর্তন শুরু করতে হবে। আসুন, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি বিশ্বাস করি। যার যার অবস্থান থেকে অবদান রাখি। কাউকে বাদ দিয়ে কেউ এগিয়ে যেতে পারে না, সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে এগিয়ে গেলেই প্রকৃত উন্নয়ন ফুটে উঠবে।
এডওয়ার্ড আইয়ুব পালক
গাজীপুর সিটি প্রেসবিটেরিয়ান চার্চ
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪