মো. বাবুল হাওলাদার
যত দূর চোখ যায়, সবুজ আর সবুজ। মাঠজুড়ে সবুজ ফসল। মাঠে মাঠে কিষান-কিষানির আনাগোনা। ফড়িয়া-পাইকারদের সরব উপস্থিতি। আবালবৃদ্ধবনিতা সবার মুখে হাসি।
বলছিলাম দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা খুলনার দাকোপের কথা। দীর্ঘদিন যাবৎ এ অঞ্চলটি লবণের কশাঘাতে হাহাকার করছিল। মিঠেপানির ধান-সবজির চাষ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। পুনরায় ঘুরে দাঁড়িয়েছেন এখানকার কৃষকেরা।
মূলত সত্তরের দশকের শেষভাগে বৃহত্তর খুলনার বাগেরহাট থেকে বাগদা চাষের গোড়াপত্তন হয়। শুরুতে স্বাদুপানিতে সীমিত পরিসরে বাগদা চিংড়ির চাষ হলেও দ্রুততম সময়ের মধ্যে তা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল অংশে ছড়িয়ে পড়ে। লবণ পানিতে বাগদার উৎপাদন ভালো হওয়ায় প্রথমে প্রাকৃতিকভাবে লবণাক্ত জমিতে স্থানীয় বাসিন্দারা এ চাষ শুরু করেন। কিন্তু বাগদা চাষ শুরুতে খুব লাভজনক হওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা বাড়তে থাকায় এ চাষের প্রতি নজর পড়ে এলাকার জোতদার-মহাজন, শহুরে মাস্তান, প্রভাবশালী বড় বড় ব্যবসায়ী, এমনকি রাজনীতিবিদদের।
শুরুতে খণ্ড খণ্ড জমিতে বাঁধ দিয়ে বাগদার চাষ হলেও আস্তে আস্তে তা বড় বড় ঘেরে পরিণত হয়। ঘের করার জন্য এলাকার কৃষকদের জমি দিতে বাধ্য করতে শুরু হয় জোর-জবরদস্তি, অস্ত্রের ঝনঝনানি, খুন, গুম ইত্যাদি। শুরু হয় লবণপানিতে চিংড়িচাষিদের রামরাজত্ব। তাঁরা ক্ষমতা, অর্থ দিয়ে করায়ত্ত করে ফেলেন তৎকালীন মন্ত্রী, সাংসদ, স্থানীয় প্রশাসনসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনেককে।
মূলত আশির দশকের শেষ ভাগে এবং নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে লবণপানিতে চিংড়ি চাষ অনেকটা নাটকীয়ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সরকারও বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনাসহ এ খাতের সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, একপর্যায়ে এসে সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে বাগদার চাষ হয়। স্থানীয় লোকজনের হিসাবে বাগদা চাষের জমির পরিমাণ আরও বেশি।
বাগদা রপ্তানি করে সর্বোচ্চ ৫০ কোটি ৯০ লাখ ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। আপাতদৃষ্টিতে এটি অত্যন্ত লাভজনক ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম বড় খাত হিসেবে বিবেচিত হলেও এর ফলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের শঙ্কা ছিল শুরু থেকে। স্থানীয় সচেতন মহল, পরিবেশবাদী, মানবাধিকার সংগঠন, বিশেষ করে বাম রাজনৈতিক দলগুলো এর বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলে। চলে হামলা-মামলা-নির্যাতন।
প্রভাবশালী ঘের ব্যবসায়ীর লোকেরা ১৯৯০ সালের ৭ নভেম্বর ঘেরবিরোধী মিছিলে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করে ভূমিহীন নেত্রী পাইকগাছা দেলুটি গ্রামের করুণাময়ী সরদারকে।
বেসরকারি সংস্থা ‘নিজেরা করি’ খুলনার ডিভিশনাল কো-অর্ডিনেটর স্বপন দাসের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কলে-কৌশলে, জোর-জবরদস্তিতে লবণপানি তুলে ছোট কৃষকদের নামমাত্র হারির (ভাড়া) বিনিময়ে জমি দিতে বাধ্য করেন। বছরে বিঘাপ্রতি হারি দেওয়া হতো মাত্র ৩০০ থেকে ১ হাজার টাকা। ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততার ফলে কৃষিজমি অনুর্বর ও নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ধান ও সবজি চাষ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এ অঞ্চল পরিণত হয় বিরাণভূমিতে।
খাবার পানির আধারগুলো বিলুপ্ত হওয়ার কারণে এলাকায় দেখা দেয় সুপেয় পানির হাহাকার।
চার–পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হতো, যা এখনো অনেকটা বর্তমান।
দাকোপ থেকে ২০০৭ সালের দিকে নতুন করে আন্দোলন দানা বাঁধে। আন্দোলনের পাশাপাশি আইনি লড়াইও চলছিল।
বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও ‘নিজেরা করি’ ২০০৫, ২০০৭, ২০০৮ ও ২০১০ সালে উচ্চ আদালতে পৃথক রিট আবেদন করে। ২০১০ সালের রিটে প্রথমে আবেদনের বিষয়বস্তুর ওপর রুল জারি এবং আবেদনটি শুনানি শেষে উচ্চ আদালত ২০১২ সালে খুলনাসহ ৫ জেলায় লবণপানি তুলে চিংড়ি চাষ বন্ধের রায় দেন। এ রায় যথাযথভাবে মানা না হলেও ধীরে ধীরে পটপরিবর্তন হতে থাকে। বিশেষ করে বহিরাগত ঘেরের মালিকেরা আস্তে আস্তে তাঁদের হাত গোটাতে থাকেন। স্থানীয় কৃষকেরা চেষ্টা করেন তাঁদের পুরোনো কৃষিকাজে ফিরে যাওয়ার। স্থানীয় সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো বিশেষ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শ ও সহায়তায় তিল চাষের মাধ্যমে জমি কিছুটা স্বাভাবিক করে। কৃষকেরা ধান চাষের পাশাপাশি শুরু করেন তরমুজের চাষ। দেখা দেয় অবিশ্বাস্য সাফল্য।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, খুলনা জেলায় গত বছর তরমুজ চাষ হয়েছে ২ হাজার হেক্টর জমিতে। এ বছর দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার হেক্টরে। স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আড়াই মাসমেয়াদি এ ফসলে ১ লাখ টাকা খরচ করে ৪ থেকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যায়। এক বিঘা জমির উৎপাদিত তরমুজ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যায়।
চিংড়ি চাষের এক ফসলি জমি এখন তিন ফসলের জমিতে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ তরমুজ, বোরো বা আউশ বা তিল ও আমন। কৃষকেরা ফিরে পেয়েছেন নতুন প্রাণ। তাঁরা নতুন উৎসাহে শুরু করেছেন গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি ইত্যাদি পালন। লবণপানি না তু্লে মিষ্টিপানির আধার থেকে সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে পারছেন তাঁরা। আবার সুপারি-নারিকেল শোভা পাবে গাছে গাছে, সেই স্বপ্নে বুক বেঁধেছেন স্থানীয় কৃষকেরা। শিশু-কিশোররা ইতিমধ্যেই ফিরে পেয়েছে তাদের খেলার মাঠ। চোখে পড়ে অন্য রকম প্রাণচাঞ্চল্য।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, কৃষির এই ইতিবাচক পরিস্থিতির গতি আরও বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন স্বল্প-দীর্ঘমেয়াদি বহুমুখী প্রকল্প। ভরাট হয়ে যাওয়া খাল-পুকুর-জলাশয়গুলো খনন, সেচের ব্যবস্থা, ফসল পরিবহনের জন্য নদী-খালে ঘাট তৈরি, কৃষকদের প্রণোদনা, সহজ শর্তে ও বিনা সুদে ঋণ ইত্যাদি।
বেলার খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘লবণপানিতে চিংড়ি চাষ যেমন দখল করে নিয়েছিলেন জোতদার-মহাজনরা। সম্ভাবনাময়ী এ সবুজ বিপ্লবের ফলাফলও বহুজাতিক কোম্পানি বা দেশীয় করপোরেট ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যেতে পারে। কারণ ইতিপূর্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ এলাকায় শত শত হেক্টর জমি ক্রয় করেছে। তারাও দাদনের ফাঁদে বা লিজের (ইজারার) নামে স্থানীয় ছোট কৃষকদের করায়ত্ত করে ফেলতে পারে। এতে স্থানীয় কৃষকেরা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবেন। এ ব্যাপারেও এখন থেকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।’
হলফ করে বলা যায়, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি লবণ পানির বিদায় এবং সম্ভাবনাময় সবুজ বিপ্লব পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে, যা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চেয়েও অনেক বেশি কিছু। এটা অর্থের মানদণ্ডে পরিমাপ করা যায় না। চিংড়ি রপ্তানি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে, বিদ্যমান বাস্তবতায় সামগ্রিক উৎপাদন, পরিবেশ-প্রতিবেশগত বিষয়, মানুষের সামাজিক মর্যাদা, মানসিক-শারীরিক বিকাশ, লবণপানির প্রভাবে মানুষের রোগ-ব্যাধি এবং এর চিকিৎসার খরচ, সামগ্রিক ভঙ্গুর স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি প্রভৃতির ক্ষতি ওই আয়ের কয়েক গুণ বেশি হবে। অবশিষ্ট যেটুকু জমিতে লবণপানি তুলে চিংড়ি চাষ হচ্ছে, তা নির্মূল করে পুরো এলাকা এ ধারায় নিয়ে আসতে পারলে এ অঞ্চলে শুধু সবুজের বিপ্লবই নয়, হবে সামগ্রিক উল্লম্ফন।
মো. বাবুল হাওলাদার
সমন্বয়কারী, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন
যত দূর চোখ যায়, সবুজ আর সবুজ। মাঠজুড়ে সবুজ ফসল। মাঠে মাঠে কিষান-কিষানির আনাগোনা। ফড়িয়া-পাইকারদের সরব উপস্থিতি। আবালবৃদ্ধবনিতা সবার মুখে হাসি।
বলছিলাম দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা খুলনার দাকোপের কথা। দীর্ঘদিন যাবৎ এ অঞ্চলটি লবণের কশাঘাতে হাহাকার করছিল। মিঠেপানির ধান-সবজির চাষ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। পুনরায় ঘুরে দাঁড়িয়েছেন এখানকার কৃষকেরা।
মূলত সত্তরের দশকের শেষভাগে বৃহত্তর খুলনার বাগেরহাট থেকে বাগদা চাষের গোড়াপত্তন হয়। শুরুতে স্বাদুপানিতে সীমিত পরিসরে বাগদা চিংড়ির চাষ হলেও দ্রুততম সময়ের মধ্যে তা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল অংশে ছড়িয়ে পড়ে। লবণ পানিতে বাগদার উৎপাদন ভালো হওয়ায় প্রথমে প্রাকৃতিকভাবে লবণাক্ত জমিতে স্থানীয় বাসিন্দারা এ চাষ শুরু করেন। কিন্তু বাগদা চাষ শুরুতে খুব লাভজনক হওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা বাড়তে থাকায় এ চাষের প্রতি নজর পড়ে এলাকার জোতদার-মহাজন, শহুরে মাস্তান, প্রভাবশালী বড় বড় ব্যবসায়ী, এমনকি রাজনীতিবিদদের।
শুরুতে খণ্ড খণ্ড জমিতে বাঁধ দিয়ে বাগদার চাষ হলেও আস্তে আস্তে তা বড় বড় ঘেরে পরিণত হয়। ঘের করার জন্য এলাকার কৃষকদের জমি দিতে বাধ্য করতে শুরু হয় জোর-জবরদস্তি, অস্ত্রের ঝনঝনানি, খুন, গুম ইত্যাদি। শুরু হয় লবণপানিতে চিংড়িচাষিদের রামরাজত্ব। তাঁরা ক্ষমতা, অর্থ দিয়ে করায়ত্ত করে ফেলেন তৎকালীন মন্ত্রী, সাংসদ, স্থানীয় প্রশাসনসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনেককে।
মূলত আশির দশকের শেষ ভাগে এবং নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে লবণপানিতে চিংড়ি চাষ অনেকটা নাটকীয়ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সরকারও বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনাসহ এ খাতের সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, একপর্যায়ে এসে সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে বাগদার চাষ হয়। স্থানীয় লোকজনের হিসাবে বাগদা চাষের জমির পরিমাণ আরও বেশি।
বাগদা রপ্তানি করে সর্বোচ্চ ৫০ কোটি ৯০ লাখ ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। আপাতদৃষ্টিতে এটি অত্যন্ত লাভজনক ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম বড় খাত হিসেবে বিবেচিত হলেও এর ফলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের শঙ্কা ছিল শুরু থেকে। স্থানীয় সচেতন মহল, পরিবেশবাদী, মানবাধিকার সংগঠন, বিশেষ করে বাম রাজনৈতিক দলগুলো এর বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলে। চলে হামলা-মামলা-নির্যাতন।
প্রভাবশালী ঘের ব্যবসায়ীর লোকেরা ১৯৯০ সালের ৭ নভেম্বর ঘেরবিরোধী মিছিলে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করে ভূমিহীন নেত্রী পাইকগাছা দেলুটি গ্রামের করুণাময়ী সরদারকে।
বেসরকারি সংস্থা ‘নিজেরা করি’ খুলনার ডিভিশনাল কো-অর্ডিনেটর স্বপন দাসের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কলে-কৌশলে, জোর-জবরদস্তিতে লবণপানি তুলে ছোট কৃষকদের নামমাত্র হারির (ভাড়া) বিনিময়ে জমি দিতে বাধ্য করেন। বছরে বিঘাপ্রতি হারি দেওয়া হতো মাত্র ৩০০ থেকে ১ হাজার টাকা। ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততার ফলে কৃষিজমি অনুর্বর ও নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ধান ও সবজি চাষ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এ অঞ্চল পরিণত হয় বিরাণভূমিতে।
খাবার পানির আধারগুলো বিলুপ্ত হওয়ার কারণে এলাকায় দেখা দেয় সুপেয় পানির হাহাকার।
চার–পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হতো, যা এখনো অনেকটা বর্তমান।
দাকোপ থেকে ২০০৭ সালের দিকে নতুন করে আন্দোলন দানা বাঁধে। আন্দোলনের পাশাপাশি আইনি লড়াইও চলছিল।
বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও ‘নিজেরা করি’ ২০০৫, ২০০৭, ২০০৮ ও ২০১০ সালে উচ্চ আদালতে পৃথক রিট আবেদন করে। ২০১০ সালের রিটে প্রথমে আবেদনের বিষয়বস্তুর ওপর রুল জারি এবং আবেদনটি শুনানি শেষে উচ্চ আদালত ২০১২ সালে খুলনাসহ ৫ জেলায় লবণপানি তুলে চিংড়ি চাষ বন্ধের রায় দেন। এ রায় যথাযথভাবে মানা না হলেও ধীরে ধীরে পটপরিবর্তন হতে থাকে। বিশেষ করে বহিরাগত ঘেরের মালিকেরা আস্তে আস্তে তাঁদের হাত গোটাতে থাকেন। স্থানীয় কৃষকেরা চেষ্টা করেন তাঁদের পুরোনো কৃষিকাজে ফিরে যাওয়ার। স্থানীয় সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো বিশেষ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শ ও সহায়তায় তিল চাষের মাধ্যমে জমি কিছুটা স্বাভাবিক করে। কৃষকেরা ধান চাষের পাশাপাশি শুরু করেন তরমুজের চাষ। দেখা দেয় অবিশ্বাস্য সাফল্য।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, খুলনা জেলায় গত বছর তরমুজ চাষ হয়েছে ২ হাজার হেক্টর জমিতে। এ বছর দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার হেক্টরে। স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আড়াই মাসমেয়াদি এ ফসলে ১ লাখ টাকা খরচ করে ৪ থেকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যায়। এক বিঘা জমির উৎপাদিত তরমুজ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যায়।
চিংড়ি চাষের এক ফসলি জমি এখন তিন ফসলের জমিতে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ তরমুজ, বোরো বা আউশ বা তিল ও আমন। কৃষকেরা ফিরে পেয়েছেন নতুন প্রাণ। তাঁরা নতুন উৎসাহে শুরু করেছেন গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি ইত্যাদি পালন। লবণপানি না তু্লে মিষ্টিপানির আধার থেকে সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে পারছেন তাঁরা। আবার সুপারি-নারিকেল শোভা পাবে গাছে গাছে, সেই স্বপ্নে বুক বেঁধেছেন স্থানীয় কৃষকেরা। শিশু-কিশোররা ইতিমধ্যেই ফিরে পেয়েছে তাদের খেলার মাঠ। চোখে পড়ে অন্য রকম প্রাণচাঞ্চল্য।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, কৃষির এই ইতিবাচক পরিস্থিতির গতি আরও বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন স্বল্প-দীর্ঘমেয়াদি বহুমুখী প্রকল্প। ভরাট হয়ে যাওয়া খাল-পুকুর-জলাশয়গুলো খনন, সেচের ব্যবস্থা, ফসল পরিবহনের জন্য নদী-খালে ঘাট তৈরি, কৃষকদের প্রণোদনা, সহজ শর্তে ও বিনা সুদে ঋণ ইত্যাদি।
বেলার খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘লবণপানিতে চিংড়ি চাষ যেমন দখল করে নিয়েছিলেন জোতদার-মহাজনরা। সম্ভাবনাময়ী এ সবুজ বিপ্লবের ফলাফলও বহুজাতিক কোম্পানি বা দেশীয় করপোরেট ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যেতে পারে। কারণ ইতিপূর্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ এলাকায় শত শত হেক্টর জমি ক্রয় করেছে। তারাও দাদনের ফাঁদে বা লিজের (ইজারার) নামে স্থানীয় ছোট কৃষকদের করায়ত্ত করে ফেলতে পারে। এতে স্থানীয় কৃষকেরা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবেন। এ ব্যাপারেও এখন থেকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।’
হলফ করে বলা যায়, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি লবণ পানির বিদায় এবং সম্ভাবনাময় সবুজ বিপ্লব পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে, যা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চেয়েও অনেক বেশি কিছু। এটা অর্থের মানদণ্ডে পরিমাপ করা যায় না। চিংড়ি রপ্তানি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে, বিদ্যমান বাস্তবতায় সামগ্রিক উৎপাদন, পরিবেশ-প্রতিবেশগত বিষয়, মানুষের সামাজিক মর্যাদা, মানসিক-শারীরিক বিকাশ, লবণপানির প্রভাবে মানুষের রোগ-ব্যাধি এবং এর চিকিৎসার খরচ, সামগ্রিক ভঙ্গুর স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি প্রভৃতির ক্ষতি ওই আয়ের কয়েক গুণ বেশি হবে। অবশিষ্ট যেটুকু জমিতে লবণপানি তুলে চিংড়ি চাষ হচ্ছে, তা নির্মূল করে পুরো এলাকা এ ধারায় নিয়ে আসতে পারলে এ অঞ্চলে শুধু সবুজের বিপ্লবই নয়, হবে সামগ্রিক উল্লম্ফন।
মো. বাবুল হাওলাদার
সমন্বয়কারী, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪