আব্দুল খালেক ফারুক
২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবর কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠের এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রামের আর্থসামাজিক অবস্থার কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘কুড়িগ্রামে এখন মঙ্গা নেই, কুড়িগ্রাম এখন চাঙা।’ সেই সভায় কুড়িগ্রামকে এগিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রী কুড়িগ্রামে আন্তনগর ট্রেন চালু, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠাসহ বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি দেন, যা ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের কারণে বদলে গেছে দৃশ্যপট।
সেই জনসভার মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন কুড়িগ্রামের সন্তান সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। উৎফুল্ল চিত্তে তিনি প্রধানমন্ত্রীর উক্তিটি সমর্থন করেন। সভামঞ্চের খুব কাছেই তিনি এখন শায়িত আছেন চিরনিদ্রায়।
বস্তুত, কাজের অভাবে কুড়িগ্রামে আশ্বিন-কার্তিকসহ বছরের কয়েকটা মাস আকাল জেঁকে বসেছিল একসময়। খাদ্যাভাবে, বিনা চিকিৎসায় মারা যেত হতভাগ্য মানুষ। বিশেষ করে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে কুড়িগ্রামের চিলমারীর জেলেপাড়ার এক তরুণীর জাল পরা ছবি দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। সেই দুর্ভিক্ষে কুড়িগ্রামে মাত্র তিন মাসে ১৬ হাজার ৪৮৮ জন মারা যায়। এর মধ্যে নাগেশ্বরী উপজেলায় সর্বাধিক ৯ হাজার মানুষ মারা যায়।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে কুড়িগ্রাম এগিয়ে গেছে অনেকখানি। এর প্রমাণ জেলার চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন, ধরলা ও তিস্তা নদীর ওপর গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সেতু নির্মাণ, তিস্তা ও দুধকুমারের ওপর আরও দুটি সেতু নির্মাণাধীন থাকা, দুটি স্থলবন্দর চালু, একটি নৌবন্দর চালুর উদ্যোগ, অভ্যন্তরীণ যোগাযোগব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি।
এসব অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে কর্মসংস্থান বেড়েছে। ন্যায্যমূল্য মিলছে কৃষিপণ্যের। এ ছাড়া ঢাকার সঙ্গে সরাসরি আন্তনগর ট্রেন চালুসহ রেল যোগাযোগের উন্নয়ন, শিক্ষার উন্নয়ন, বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের গার্মেন্টসে কর্মসংস্থান, ১৬টি নদীর বুকে জেগে ওঠা অনুর্বর চরে নানা ফসলের সমাহার, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নসহ নানা অগ্রগতি দৃশ্যমান।
মঙ্গা আর অনুন্নয়নের প্রতীক হয়ে ওঠা কুড়িগ্রাম এখন খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলা। বালুকাময় চরের জমি ব্যবহার, নানা ধরনের ধান ও সবজি উৎপাদন, সেচব্যবস্থার সম্প্রসারণ এবং কৃষিপ্রযুক্তির ক্রমাগত ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে এই অভাবনীয় সাফল্য এসেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে জেলায় বার্ষিক খাদ্যের চাহিদা ছিল (চাল ও গম) ৩ লাখ ৯০ হাজার ৬২৩ মেট্রিক টন। অথচ খাদ্য উৎপাদন হয়েছে ৭ লাখ ৫১ হাজার ১৮ মেট্রিক টন। এই বছরে খাদ্য উদ্বৃত্ত ৩ লাখ ৬০ হাজার ৩৯০ মেট্রিক টন। চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় ৬০ শতাংশ জমিতে হাইব্রিড জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের ধান চাষ সম্প্রসারণের কারণে প্রতিবছর বাড়ছে ধানের উৎপাদন।
জমিতে ধান বোনা আর কাটার মধ্যবর্তী সময়, বিশেষ করে আশ্বিন-কার্তিকে একসময় মঙ্গার কবলে পড়ে অর্ধাহারে–অনাহারে বহু মানুষ দিন কাটাত। অনেকে মারা যেত অভুক্ত থেকে এবং অপুষ্টিতে ভুগে।
যমুনা সেতু চালুর পর ঘর ছাড়তে শুরু করে কুড়িগ্রামের দরিদ্র মানুষ। এখন ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত পোশাকশিল্পে জেলার লক্ষাধিক মানুষ কাজ করে। প্রতিদিন প্রায় ২০০ দূরপাল্লার বাস কুড়িগ্রাম থেকে ছেড়ে যায়। এর বেশির ভাগ যাত্রীই গার্মেন্টস আর বিভিন্ন নির্মাণশিল্পের শ্রমিক। আগে কুড়িগ্রামের গ্রামে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে শণের ঘর ছিল, পরে শণ উঠে গিয়ে চকচকে টিনের ঘর ওঠে। এখন বাড়িতে বাড়িতে পাকা-আধা পাকা দালান নির্মিত হচ্ছে। আগে একজন দিনমজুর দিনমান খেটে দুই কেজি চালের টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খেতেন, এখন দৈনিক মজুরির টাকায় ৮-১০ কেজি চাল ক্রয়ের সংগতি আছে দিনমজুরদের। এ ছাড়া দিনমজুরদের ছেলেরা পিতার পেশায় না এসে গার্মেন্টসের শ্রমিক হচ্ছে বা অন্য কোনো কাজ বেছে নিচ্ছে। তাই ধান কাটার মৌসুমে মজুর সংকটের অভাবনীয় ঘটনাও ঘটছে। এ সবই অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির সুলক্ষণ।
কুড়িগ্রামের ধরলা নদীর কারণে নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী ও ফুলবাড়ী উপজেলা জেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেমে এসেছিল স্থবিরতা। কিন্তু ধরলা নদীর ওপর দুটি সেতু নির্মাণের পর বদলে গেছে দৃশ্যপট।
১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী কুড়িগ্রাম শহরসংলগ্ন প্রথম ধরলা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করেন। ফুলবাড়ী উপজেলার কুলাঘাটে ২০১৮ সালের ৩ জুন ৯৫০ মিটার দীর্ঘ দ্বিতীয় ‘শেখ হাসিনা ধরলা সেতু’ চালুর পর সীমান্তবর্তী এই তিন উপজেলায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে বিপ্লব। ভূরুঙ্গামারীর সোনাহাট স্থলবন্দরের সঙ্গে সেই দুই সেতুর মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্য পরিবহন সহজতর হয়েছে। মাঝপথে দুধকুমার নদের ওপর আর একটি সেতু নির্মাণ শুরু হয়েছে। পাশাপাশি চার লেন বা প্রশস্ত সড়ক ও বাইপাস সড়ক নির্মাণের কাজ চলমান থাকায় অপার সম্ভাবনার প্রহর গুনছে মানুষ। ২০১২ সালে তিস্তা রেলসেতুর পাশে আর একটি সড়ক সেতু নির্মাণের ফলে যাতায়াতের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেয়েছে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলার কয়েক লাখ মানুষ। আগে রেলসেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন, বাসসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচল করার কারণে সময় নষ্ট হতো। এই সঙ্গে চিলমারীর হরিপুরে তিস্তা নদীর ওপর ১ হাজার ৪৯০ মিটার দীর্ঘ তৃতীয় তিস্তা সেতু নির্মাণ সমাপ্ত হলে ঢাকার সঙ্গে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরত্ব কমবে কুড়িগ্রামে। আর রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগের বহুমুখী পথ খুলে যাবে কুড়িগ্রামবাসীর জন্য।
প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ‘কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস’ নামে একটি আন্তনগর ট্রেন চালু হয় ২০১৯ সালের ১৬ অক্টোবর। এর আগের বছর রংপুর এক্সপ্রেসের সঙ্গে একটি শাটল ট্রেন যুক্ত করে দেওয়ায় ট্রেন যোগাযোগের সুফল নিতে শুরু করে কুড়িগ্রামবাসী। এখন সরাসরি ট্রেন চালুর কারণে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা আসা-যাওয়া করতে পারেন। ফলে ব্যবসা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন।
যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে পণ্য পরিবহনে সুবিধা ও ছোট-বড় যানবাহন চলাচল সহজতর হওয়ায় এই খাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে অভাবনীয়। বহু বেকার যুবক এখন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আর মিশুক-রিকশা কিনে পথে নেমেছেন। তাঁদের দৈনিক গড় আয় কমপক্ষে ৫০০ টাকা। আগে ঢাকা বা বিভিন্ন এলাকায় যারা রিকশা চালাতেন, তাঁরাও থিতু হওয়ার চেষ্টা করছেন নিজ গ্রামে। দূর গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাওয়ার পর অটোরিকশা, মোবাইল ফোন, টিভি মেরামতসহ নানা ধরনের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
আসাম সীমান্তবর্তী কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় চালু হয়েছে সোনাহাট স্থলবন্দর। ২০১৮ সালে বন্দরটি চালুর পর ভারত থেকে নিয়মিত পাথর ও কয়লা আমদানি করছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। তাতে দূরত্ব ও খরচ কমে গেছে। কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিকের। এই স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট স্থাপন প্রক্রিয়াধীন। এটি চালু হলে ভারত গমনে সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। একইভাবে রৌমারীর নতুন বন্দর এলাকায় রৌমারী বন্দরটি দিয়ে আসাম ও মেঘালয় রাজ্যের যোগাযোগ সহজতর হওয়ায় আমদানি-রপ্তানি বেড়েছে এই বন্দর দিয়ে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ব্রহ্মপুত্রের পারে ঐতিহাসিক চিলমারী বন্দরের উন্নয়ন শুরু হয়েছে। নির্মিত হচ্ছে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। এই বন্দর চালু হলে ভারতের আসাম থেকে বাংলাদেশের পায়রা বন্দর পর্যন্ত আন্তদেশীয় পণ্য আনা-নেওয়া সহজতর হবে।
ব্রহ্মপুত্র বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে কুড়িগ্রামের রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলাকে। চিলমারী বন্দর থেকে ফেরি সার্ভিস চালুর উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে জেলা সদরের সঙ্গে যাতায়াত অনেক সহজতর হবে। নদীকেন্দ্রিক পর্যটন সম্ভাবনার কথাও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই কুড়িগ্রাম। ১৯৯৭ সালে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে ১৪টি বিষয়ে স্নাতক সম্মান (অনার্স) ও কয়েকটি বিষয়ে স্নাতকোত্তর চালুর পর প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সামনে এগোনোর অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। কুড়িগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও কুড়িগ্রাম টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ দক্ষ জনশক্তি তৈরি করছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ পাচ্ছে। দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সারিতে রয়েছেন কুড়িগ্রামের অনেক উজ্জ্বল মুখ। বিসিএস পরীক্ষায় প্রতিবছর সফল শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। দারিদ্র্য জয় করে এগিয়ে যাচ্ছে অদম্য মেধাবী মুখ। এ সবই কুড়িগ্রামের সম্ভাবনা।
কুড়িগ্রামবাসীর জন্য প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি উপহার কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নির্বাচনসহ কারিগরি দিক নিয়ে কাজ চলছে। কৃষিপ্রধান কুড়িগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে ফসলের নতুন নতুন জাত নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি ব্যবসা ও কর্মসংস্থানের আরেকটি দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
এত অগ্রগতির পরেও শিল্পায়নের অভাব কুড়িগ্রামবাসীর হতাশার মূল জায়গা। তবে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত অর্থনৈতিক অঞ্চলটি প্রতিষ্ঠা পেলে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এখন এটির স্থান নির্বাচনের কাজ চলমান। এই অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপিত হলে গড়ে উঠবে ছোট-বড় শিল্পকারখানা। দারিদ্র্য ঘুচে উন্নত জেলাগুলোর সারিতে চলে যাবে কুড়িগ্রাম। মঙ্গা আর অনাহার হবে দূর অতীত। উন্মোচিত হবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আর সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।
আব্দুল খালেক ফারুক
লেখক ও সাংবাদিক
২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবর কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠের এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রামের আর্থসামাজিক অবস্থার কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘কুড়িগ্রামে এখন মঙ্গা নেই, কুড়িগ্রাম এখন চাঙা।’ সেই সভায় কুড়িগ্রামকে এগিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রী কুড়িগ্রামে আন্তনগর ট্রেন চালু, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠাসহ বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি দেন, যা ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের কারণে বদলে গেছে দৃশ্যপট।
সেই জনসভার মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন কুড়িগ্রামের সন্তান সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। উৎফুল্ল চিত্তে তিনি প্রধানমন্ত্রীর উক্তিটি সমর্থন করেন। সভামঞ্চের খুব কাছেই তিনি এখন শায়িত আছেন চিরনিদ্রায়।
বস্তুত, কাজের অভাবে কুড়িগ্রামে আশ্বিন-কার্তিকসহ বছরের কয়েকটা মাস আকাল জেঁকে বসেছিল একসময়। খাদ্যাভাবে, বিনা চিকিৎসায় মারা যেত হতভাগ্য মানুষ। বিশেষ করে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে কুড়িগ্রামের চিলমারীর জেলেপাড়ার এক তরুণীর জাল পরা ছবি দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। সেই দুর্ভিক্ষে কুড়িগ্রামে মাত্র তিন মাসে ১৬ হাজার ৪৮৮ জন মারা যায়। এর মধ্যে নাগেশ্বরী উপজেলায় সর্বাধিক ৯ হাজার মানুষ মারা যায়।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে কুড়িগ্রাম এগিয়ে গেছে অনেকখানি। এর প্রমাণ জেলার চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন, ধরলা ও তিস্তা নদীর ওপর গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সেতু নির্মাণ, তিস্তা ও দুধকুমারের ওপর আরও দুটি সেতু নির্মাণাধীন থাকা, দুটি স্থলবন্দর চালু, একটি নৌবন্দর চালুর উদ্যোগ, অভ্যন্তরীণ যোগাযোগব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি।
এসব অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে কর্মসংস্থান বেড়েছে। ন্যায্যমূল্য মিলছে কৃষিপণ্যের। এ ছাড়া ঢাকার সঙ্গে সরাসরি আন্তনগর ট্রেন চালুসহ রেল যোগাযোগের উন্নয়ন, শিক্ষার উন্নয়ন, বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের গার্মেন্টসে কর্মসংস্থান, ১৬টি নদীর বুকে জেগে ওঠা অনুর্বর চরে নানা ফসলের সমাহার, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নসহ নানা অগ্রগতি দৃশ্যমান।
মঙ্গা আর অনুন্নয়নের প্রতীক হয়ে ওঠা কুড়িগ্রাম এখন খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলা। বালুকাময় চরের জমি ব্যবহার, নানা ধরনের ধান ও সবজি উৎপাদন, সেচব্যবস্থার সম্প্রসারণ এবং কৃষিপ্রযুক্তির ক্রমাগত ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে এই অভাবনীয় সাফল্য এসেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে জেলায় বার্ষিক খাদ্যের চাহিদা ছিল (চাল ও গম) ৩ লাখ ৯০ হাজার ৬২৩ মেট্রিক টন। অথচ খাদ্য উৎপাদন হয়েছে ৭ লাখ ৫১ হাজার ১৮ মেট্রিক টন। এই বছরে খাদ্য উদ্বৃত্ত ৩ লাখ ৬০ হাজার ৩৯০ মেট্রিক টন। চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় ৬০ শতাংশ জমিতে হাইব্রিড জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের ধান চাষ সম্প্রসারণের কারণে প্রতিবছর বাড়ছে ধানের উৎপাদন।
জমিতে ধান বোনা আর কাটার মধ্যবর্তী সময়, বিশেষ করে আশ্বিন-কার্তিকে একসময় মঙ্গার কবলে পড়ে অর্ধাহারে–অনাহারে বহু মানুষ দিন কাটাত। অনেকে মারা যেত অভুক্ত থেকে এবং অপুষ্টিতে ভুগে।
যমুনা সেতু চালুর পর ঘর ছাড়তে শুরু করে কুড়িগ্রামের দরিদ্র মানুষ। এখন ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত পোশাকশিল্পে জেলার লক্ষাধিক মানুষ কাজ করে। প্রতিদিন প্রায় ২০০ দূরপাল্লার বাস কুড়িগ্রাম থেকে ছেড়ে যায়। এর বেশির ভাগ যাত্রীই গার্মেন্টস আর বিভিন্ন নির্মাণশিল্পের শ্রমিক। আগে কুড়িগ্রামের গ্রামে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে শণের ঘর ছিল, পরে শণ উঠে গিয়ে চকচকে টিনের ঘর ওঠে। এখন বাড়িতে বাড়িতে পাকা-আধা পাকা দালান নির্মিত হচ্ছে। আগে একজন দিনমজুর দিনমান খেটে দুই কেজি চালের টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খেতেন, এখন দৈনিক মজুরির টাকায় ৮-১০ কেজি চাল ক্রয়ের সংগতি আছে দিনমজুরদের। এ ছাড়া দিনমজুরদের ছেলেরা পিতার পেশায় না এসে গার্মেন্টসের শ্রমিক হচ্ছে বা অন্য কোনো কাজ বেছে নিচ্ছে। তাই ধান কাটার মৌসুমে মজুর সংকটের অভাবনীয় ঘটনাও ঘটছে। এ সবই অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির সুলক্ষণ।
কুড়িগ্রামের ধরলা নদীর কারণে নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী ও ফুলবাড়ী উপজেলা জেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেমে এসেছিল স্থবিরতা। কিন্তু ধরলা নদীর ওপর দুটি সেতু নির্মাণের পর বদলে গেছে দৃশ্যপট।
১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী কুড়িগ্রাম শহরসংলগ্ন প্রথম ধরলা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করেন। ফুলবাড়ী উপজেলার কুলাঘাটে ২০১৮ সালের ৩ জুন ৯৫০ মিটার দীর্ঘ দ্বিতীয় ‘শেখ হাসিনা ধরলা সেতু’ চালুর পর সীমান্তবর্তী এই তিন উপজেলায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে বিপ্লব। ভূরুঙ্গামারীর সোনাহাট স্থলবন্দরের সঙ্গে সেই দুই সেতুর মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্য পরিবহন সহজতর হয়েছে। মাঝপথে দুধকুমার নদের ওপর আর একটি সেতু নির্মাণ শুরু হয়েছে। পাশাপাশি চার লেন বা প্রশস্ত সড়ক ও বাইপাস সড়ক নির্মাণের কাজ চলমান থাকায় অপার সম্ভাবনার প্রহর গুনছে মানুষ। ২০১২ সালে তিস্তা রেলসেতুর পাশে আর একটি সড়ক সেতু নির্মাণের ফলে যাতায়াতের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেয়েছে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলার কয়েক লাখ মানুষ। আগে রেলসেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন, বাসসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচল করার কারণে সময় নষ্ট হতো। এই সঙ্গে চিলমারীর হরিপুরে তিস্তা নদীর ওপর ১ হাজার ৪৯০ মিটার দীর্ঘ তৃতীয় তিস্তা সেতু নির্মাণ সমাপ্ত হলে ঢাকার সঙ্গে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরত্ব কমবে কুড়িগ্রামে। আর রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগের বহুমুখী পথ খুলে যাবে কুড়িগ্রামবাসীর জন্য।
প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ‘কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস’ নামে একটি আন্তনগর ট্রেন চালু হয় ২০১৯ সালের ১৬ অক্টোবর। এর আগের বছর রংপুর এক্সপ্রেসের সঙ্গে একটি শাটল ট্রেন যুক্ত করে দেওয়ায় ট্রেন যোগাযোগের সুফল নিতে শুরু করে কুড়িগ্রামবাসী। এখন সরাসরি ট্রেন চালুর কারণে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা আসা-যাওয়া করতে পারেন। ফলে ব্যবসা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন।
যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে পণ্য পরিবহনে সুবিধা ও ছোট-বড় যানবাহন চলাচল সহজতর হওয়ায় এই খাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে অভাবনীয়। বহু বেকার যুবক এখন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আর মিশুক-রিকশা কিনে পথে নেমেছেন। তাঁদের দৈনিক গড় আয় কমপক্ষে ৫০০ টাকা। আগে ঢাকা বা বিভিন্ন এলাকায় যারা রিকশা চালাতেন, তাঁরাও থিতু হওয়ার চেষ্টা করছেন নিজ গ্রামে। দূর গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাওয়ার পর অটোরিকশা, মোবাইল ফোন, টিভি মেরামতসহ নানা ধরনের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
আসাম সীমান্তবর্তী কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় চালু হয়েছে সোনাহাট স্থলবন্দর। ২০১৮ সালে বন্দরটি চালুর পর ভারত থেকে নিয়মিত পাথর ও কয়লা আমদানি করছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। তাতে দূরত্ব ও খরচ কমে গেছে। কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিকের। এই স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট স্থাপন প্রক্রিয়াধীন। এটি চালু হলে ভারত গমনে সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। একইভাবে রৌমারীর নতুন বন্দর এলাকায় রৌমারী বন্দরটি দিয়ে আসাম ও মেঘালয় রাজ্যের যোগাযোগ সহজতর হওয়ায় আমদানি-রপ্তানি বেড়েছে এই বন্দর দিয়ে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ব্রহ্মপুত্রের পারে ঐতিহাসিক চিলমারী বন্দরের উন্নয়ন শুরু হয়েছে। নির্মিত হচ্ছে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। এই বন্দর চালু হলে ভারতের আসাম থেকে বাংলাদেশের পায়রা বন্দর পর্যন্ত আন্তদেশীয় পণ্য আনা-নেওয়া সহজতর হবে।
ব্রহ্মপুত্র বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে কুড়িগ্রামের রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলাকে। চিলমারী বন্দর থেকে ফেরি সার্ভিস চালুর উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে জেলা সদরের সঙ্গে যাতায়াত অনেক সহজতর হবে। নদীকেন্দ্রিক পর্যটন সম্ভাবনার কথাও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই কুড়িগ্রাম। ১৯৯৭ সালে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে ১৪টি বিষয়ে স্নাতক সম্মান (অনার্স) ও কয়েকটি বিষয়ে স্নাতকোত্তর চালুর পর প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সামনে এগোনোর অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। কুড়িগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও কুড়িগ্রাম টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ দক্ষ জনশক্তি তৈরি করছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ পাচ্ছে। দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সারিতে রয়েছেন কুড়িগ্রামের অনেক উজ্জ্বল মুখ। বিসিএস পরীক্ষায় প্রতিবছর সফল শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। দারিদ্র্য জয় করে এগিয়ে যাচ্ছে অদম্য মেধাবী মুখ। এ সবই কুড়িগ্রামের সম্ভাবনা।
কুড়িগ্রামবাসীর জন্য প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি উপহার কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নির্বাচনসহ কারিগরি দিক নিয়ে কাজ চলছে। কৃষিপ্রধান কুড়িগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে ফসলের নতুন নতুন জাত নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি ব্যবসা ও কর্মসংস্থানের আরেকটি দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
এত অগ্রগতির পরেও শিল্পায়নের অভাব কুড়িগ্রামবাসীর হতাশার মূল জায়গা। তবে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত অর্থনৈতিক অঞ্চলটি প্রতিষ্ঠা পেলে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এখন এটির স্থান নির্বাচনের কাজ চলমান। এই অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপিত হলে গড়ে উঠবে ছোট-বড় শিল্পকারখানা। দারিদ্র্য ঘুচে উন্নত জেলাগুলোর সারিতে চলে যাবে কুড়িগ্রাম। মঙ্গা আর অনাহার হবে দূর অতীত। উন্মোচিত হবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আর সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।
আব্দুল খালেক ফারুক
লেখক ও সাংবাদিক
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪