উত্তরের স্বাস্থ্যসেবার প্রাণকেন্দ্র বলা হয় রংপুর নগরীকে। সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বিভাগীয় এ শহরের ধাপ এলাকার এক কিলোমিটার অংশে গড়ে উঠেছে শত শত ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ভিড় থাকে চিকিৎসা নিতে আসা সেবাগ্রহীতাদের। কিন্তু দুদিন ধরে চলা চিকিৎসকদের ধর্মঘটে রোগীরা পড়েছেন দুর্ভোগে।
এদিকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও পড়েছে ভাটা। ব্যস্ততম নগরীর রাস্তাঘাট করছে খাঁ খাঁ। তবে আগামীকাল বুধবার রোগী দেখার জন্য চিকিৎসকেরা সিরিয়াল নিচ্ছেন। আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ২০টি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার সরেজমিন ঘুরে এমনই চিত্র দেখা গেছে।
বেলা ৩টায় শহরের এক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে ৮ বছরের শিশুকে কোলে নিয়ে ঘুরছেন দিলীপ কুমার চন্দ্র। কথা হলে দিলীপ কুমার চন্দ্র বলেন, ‘ছেলের মাথায় আঘাত লাগছে। ডাক্তার দেখার আনছি সকালে। কোনো ক্লিনিক ডাক্তার নাই। শুনুছু ডাক্তারেরা ধর্মঘট দিছে। কন তো, ডাক্তারেরা ধর্মঘট করলে মানুষ বাঁচপে ক্যামনে?’
দিলীপ কুমার চন্দ্র জানান, তাঁর ৮ বছরের ছেলে আনন্দ চন্দ্র রায় মাথায় আঘাত পান। ছেলের উন্নত চিকিৎসার জন্য রংপুরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখানোর জন্য এসেছেন। দিলীপ কুমারের বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার পশ্চিম কালুডাঙ্গা গ্রামে।
বদরগঞ্জের কাচাবাড়ি গ্রামের আরজু আরার পিত্তথলিতে পাথর ছিল। এক মাস আগে চিকিৎসক তাঁকে অস্ত্রোপচার করতে বলেছিলেন। গতকাল পেটে প্রচণ্ড ব্যথা হলে স্বামী মাহাবুল ইসলাম একটি বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করার জন্য নিয়ে আসেন। কিন্তু চিকিৎসক না থাকায় তাঁর অস্ত্রোপচার হয়নি। স্ত্রীকে নিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উদ্দেশে রওনা হন।
মাহাবুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে সবকিছু দেরিতে হয়। তাই ক্লিনিকে বউকে নিয়ে আসছি। কিন্তু ডাক্তার নেই, বউয়ের ব্যথা আর চিৎকার সহ্য হচ্ছে না। আইজ তাঁরায় চেম্বারোত বইসে নাই। পাঁচটা ক্লিনিকোত ঘুরনু কোনোঠে ডাক্তার বইসে নাই। অসুস্থ মানুষক ভালো করার চেষ্টা করে ডাক্তার। সেই ডাক্তারে আইজ হরতাল দিছে, জীবন নিয়া ছিনিমিনি খেলাওছে। এটা কেমন কথা কন।’
চিকিৎসার অবহেলার কারণে মা ও নবজাতকের মৃত্যুর অভিযোগে রাজধানী ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালের দুজন চিকিৎসককে আটক করে জেলে পাঠানো হয়েছে। চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা ঠিক হয়নি দাবি করে প্রতিবাদ জানাতে ও চিকিৎসকদের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে ১৭ ও ১৮ জুলাই চিকিৎসকদের সংগঠন ব্যক্তিগত চেম্বার ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন।
চিকিৎসকদের দুই দিনের ধর্মঘটে শুধু রোগী ও স্বজনেরা দুর্ভোগে পড়েছেন তা নয়; রংপুরে চিকিৎসাকেন্দ্রিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও ভাটা নেমেছে। মানুষের উপস্থিতি কম থাকায় আয় কমেছে রিকশা-ইজিবাইকচালকদেরও। অলস সময় পার করছে ফার্মেসিগুলো। হোটেল-রেস্তোরাঁ ও বিপণিবিতানগুলোতে তেমন বেচাকেনা নেই।
শহরের এক ফার্মেসির ব্যবস্থাপক তপন বলেন, কাকডাকা ভোর থেকে ফার্মেসিগুলোতে ওষুধ কিনতে আসা মানুষের এত ভিড় থাকে যে তা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু দুদিন ধরে কোনো বেচা-বিক্রি নেই। হাসপাতাল, ক্লিনিক এলাকাগুলো মনে হয় জনশূন্য। একই ধরনের কথা জানান আরও ১০ জন ফার্মেসির মালিক।
বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকগুলো ঘুরতে রিকশায় উঠে কথা হয় পায়রাবন্দ এলাকার বাসিন্দা রিকশাচালক মেরাজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘দুই দিন ডাক্তার বইসে নাই। শহোরটা ফাঁকা, রাস্তাঘাট ফাঁকা। যাত্রী নাই, যানজট নাই কামাইও নাই। সকাল থাকি দেড় শ টাকা কামাছু। এমনি দিন হইলে ৫০০ টাকা কামানু হয়। এমতোন চলছে রোগী মরবে, হামাকও কামাই আবানে মরিবার নাগবে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রংপুর মহানগরের সভাপতি ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করে ধর্মঘট করাটা একেবারে অমানবিক। এতে অনেক মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন ওঠে। দুই দিন বন্ধ থাকায় এর সঙ্গে অনেক মানুষের জীবন-জীবিকায়ও প্রভাব পড়েছে। আন্দোলনের আরও পথ ছিল, চিকিৎসকেরা সাংগঠনিকভাবে এগোতে পারত।