ময়মনসিংহের খড়িয়া

নদীর জমি দখল, হচ্ছে বিক্রিও

  • ১৫ বছর আগেও স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ছিল।
  • ফুলপুর পৌরশহরের সেতুর দুই পাশে দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে বাড়ি, দোকানপাট।
  • দখল করা জমি আবার অন্যের কাছে বিক্রিও করা হচ্ছে, এমনকি প্লট আকারেও।
  • সিএস রেকর্ড অনুযায়ী খনন করা হবে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
ইলিয়াস আহমেদ, ময়মনসিংহ
প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ০১: ২৮
Thumbnail image
১৫ বছর আগেও স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ছিল খড়িয়া নদীতে। কিন্তু ক্রমাগত দখল-দূষণে সেই চিত্র আর নেই। নদীর জায়গায় গড়ে তোলা হচ্ছে বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা। প্রতিনিয়ত ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। এতে বেহাল হয়ে পড়েছে নদীটি। ছবিটি সম্প্রতি ময়মনসিংহের ফুলপুর পৌর শহরের সেতুসংলগ্ন এলাকা থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

একসময়ের উত্তাল খড়িয়া নদী এখন স্রোতহীন। দখল-দূষণে গতিহারা ময়মনসিংহের ফুলপুরের এই নদী। এর দুই পাশে এখন ফসল এবং মাঝখানে কচুরিপানায় ভরা। প্রতিনিয়ত ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। নদীর জায়গায় গড়ে তোলা হচ্ছে দোকানপাট, ঘরবাড়িসহ বহুতল ভবন। বছরের পর বছর ধরে চলা এই ‘নির্যাতনে’ নিজস্বতা হারিয়েছে নদীটি।

৩৭ কিলোমিটার খড়িয়া নদী ময়মনসিংহ সদর উপজেলার রাংসা থেকে ফুলপুর উপজেলা অতিক্রম করে হালুয়াঘাটের ভোগাই কংস নদে গিয়ে মিশেছে। নদীটির বেশির ভাগ অংশ ফুলপুরে হওয়ায় এটি ফুলপুর খড়িয়া নদী হিসেবে পরিচিত।

নদীতীরের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৫ বছর আগেও খড়িয়ায় স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ছিল। অথচ ফুলপুর পৌরশহরের সেতুর দুই পাশে নদী দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে বাসাবাড়ি, করা হয়েছে ফসলের আবাদ। সিএস রেকর্ডে নদীর জায়গা থাকলেও আরওআর এবং বিআরএস খতিয়ান রেকর্ডে দখলসূত্রে নিজেদের নামে দলিল করে নিয়েছেন অনেকে। সেই জমি আবার অন্যের কাছে বিক্রিও করা হচ্ছে।

তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, নদী খননের সময় তারা সিএস রেকর্ড অনুযায়ী খনন করবে।

প্রায় ৩০ বছর আগে ফুলপুর সরকারি কলেজ রোডে খড়িয়া নদীর পাড়ে বহুতল ভবন নির্মাণ করেন ব্যবসায়ী মোফাজ্জল হোসেন। এ নিয়ে স্থানীয়রা প্রশাসনকে বারবার জানালেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

সেখানকার বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘চারতলা ওই বাড়িটি যে কেউ দেখলে বলবে সেটি নদীর মধ্যে পড়েছে, কিন্তু তিনি (মোফাজ্জল) কোন ক্ষমতাবলে তা করেছেন, সেটি আমরা জানি না। তাঁকে প্রশ্ন করা হলে নদীর মধ্যে তাঁর জায়গা রয়েছে বলে দাবি করেন। তাঁর মতো আরও অনেকে নদীর জায়গা দখল সূত্রে কাগজপত্র করে নিজেদের নামে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করছেন, এসবের একটি বিহিত হওয়া প্রয়োজন।’

এ বিষয়ে মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘ক্রয়সূত্রে আড়াই শতাংশ জমি কিনে প্রায় ৩০ বছর আগে চারতলা বাসাটি নির্মাণ করেছি। নির্মাণের পর থেকেই মানুষ বলছে সেটি নদীর মধ্যে পড়েছে, কিন্তু এ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। জায়গাটির মালিক প্রকৃতপক্ষে আমিই।’

স্থানীয় বিল্লাল হোসেন জানান, সেতুর নিচে খড়িয়া নদীর অংশটুকু মেন্দুমিয়ার চর নামে পরিচিত। সরকারের কাছ থেকে ১০০ বছরের জন্য এ অংশ লিজ নিয়েছেন চৌকিদার কদ্দুস। পরে তিনি বিআরএস খতিয়ানে নিজের নামে লিখে নেন। এখন প্লট করে বিক্রি করছেন। কিছুদিন আগেও শাহজাহান নামে এক ব্যবসায়ী এখানে জমি কিনেছেন।

মাওলানা রফিকুল ইসলাম নামে একজন বলেন, ১৫-২০ বছর আগেও নদীতে প্রবল স্রোত ছিল। অনেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ধীরে ধীরে নদীটি যেমন দখল হয়ে সংকীর্ণ হয়েছে; তেমনি বেশ কয়েক জায়গায় বাঁধের কারণে স্রোত না থাকায় কচুরিপানায় ভরে গেছে।

সেই সঙ্গে পৌরসভা ও আশপাশের কলকারখানার বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে পানি।

গোদারিয়া গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রত্যেকে তাঁর বাড়ির সামনের নদীর অংশ দখল করে আবাদ করার পাশাপাশি জমি বিক্রিও করছেন। তাঁরা কীভাবে কাগজপত্র করে এসব করছেন, তাঁরাই তা ভালো জানেন। নদী তো এখন সবুজ মাঠ, বহুতল ভবন ও দোকানপাটের জায়গা।’

নদীর পাড় ঘেঁষে বাসা নির্মাণ করা আব্দুল খালেকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাগজপত্র দেখেই আমি জমি কিনে বাসা করেছি। আমার বাসার অনেক দূরে নদীর অবস্থান। এ পাড়ে নয়, ওই পাড়ে আমুয়াকান্দা মসজিদের আশপাশে খড়িয়া নদী দখল হচ্ছে।’

সেতুর পাশে নদীর ওপর কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বেশ কয়েকটি চায়ের দোকান। ওই সব দোকান থেকে প্রতিদিন ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে নদীতে।

দোকানি মো. রাজু বলেন, ‘সেতুর পাশে বাপ-দাদা ব্যবসা করেছে। আমিও দোকান করছি। কিছুদিন আগে আমরাই কাঠ দিয়ে কয়েকটি দোকান তুলেছি।’ তবে কোনো ময়লা নদীতে ফেলা হচ্ছে না বলে তিনি দাবি করেন।

ফুলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাদিয়া ইসলাম সীমা বলেন, নদী সুরক্ষায় আইন রয়েছে। কেউ আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে দখল-দূষণে জড়িত থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী আবু রায়হান বলেন, ‘আমরা নিয়মিত নদী খনন করছি। আর সকল নদী সিএস রেকর্ড অনুযায়ী খনন করা হয়। সেখানে অনেকের জায়গা-জমি থাকলেও আমাদের কিছু করার থাকে না। তাই নদীর জায়গা দখল করে অন্যত্র বিক্রি এবং বহুতল ভবন, দোকানপাট নির্মাণ করা কোনোভাবেই কাম্য নয়।’

ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো.আখলাক উল জামিল বলেন, জেলায় ৫৯টি নদনদী রয়েছে। এর মধ্যে এলাকার মানুষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে খননকাজও অব্যাহত আছে। বিগত পাঁচ বছরে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় জেলায় ছোট-বড় ২১টি নদী ও খাল খনন করা হয়েছে। বর্তমানে মুক্তাগাছার আয়মন নদীর খননকাজ অব্যাহত রয়েছে। নান্দাইলের কাঁচামাটিয়া নদীর খননকাজ অচিরেই শুরু হবে। জনগণের দাবি বিবেচনা করে ফুলপুরের খড়িয়া নদী দখলমুক্ত করে খননের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত