হাসপাতালে ২৭ কর্মচারীর বেতন নেই দেড় বছর, ঘুষ নিয়ে নিয়োগের অভিযোগ

মনিরামপুর (যশোর) প্রতিনিধি 
প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩: ৩৫
যশোরের মনিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ছবি: আজকের পত্রিকা

যশোরের মনিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া ২৭ কর্মচারী প্রায় দেড় বছর ধরে বেতন-ভাতা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এসব কর্মচারী নিয়োগে আড়াই থেকে চার লাখ টাকা ঘুষ নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ঘুষ লেনদেনের বিষয় অস্বীকার করেছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেয়ে যশোরের সিভিল সার্জন তিন ধাপে দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে এসব কর্মচারী বাছাই করে। এরপর অর্থ প্রাইভেট লিমিটেড, গালফ সিকিউরিটি সার্ভিস ও একতা আউটসোর্সিং লিমিটেড নামের তিন প্রতিষ্ঠান দরপত্রে জিতে মনিরামপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৭ জন কর্মচারী নিয়োগ দেয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

মনিরামপুর হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, যেসব হাসপাতাল ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়ে লোকবলের সংকটে ভুগছে সেসব হাসপাতাল বেছে নিয়ে তৃতীয় একটি পক্ষ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে হাসপাতালগুলোতে কর্মচারী নিয়োগের অনুমোদন এনে সিভিল সার্জনের মাধ্যমে কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছে। মনিরামপুরে এমন নিয়োগ পেয়েছেন ২৭ কর্মচারী। নিয়োগকারী সংস্থা কর্মচারীদের মাসিক ১৬ হাজার ১৩০ টাকা বেতনভাতা পরিশোধ করবে। এর মধ্যে কয়েকজনের যোগদানের মেয়াদ দেড় বছর পার হতে যাচ্ছে। কেউ এখনো বেতন পাননি। কয়েকজন ইতিমধ্যে কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। এখন ১৯ জন কর্মচারী হাসপাতালে কাজ করছেন।

অর্থ লিমিটেডের নিয়োগ ১১ জন

অর্থ প্রাইভেট লিমিটেডের মাধ্যমে আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ পেয়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন মনিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগ দেন ১১ জন কর্মচারী। নয় মাস বিনা বেতনে কাজ করার পর তাঁরা জানতে পারেন অর্থের লিমিটেডের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিয়োগ পাওয়াদের কয়েকজন জানান, কাজল বিশ্বাসের বন্ধু মনিরামপুর বাজারের ফিফো ডিজিটাল প্রিন্টিংয়ের মালিক অসীত বিশ্বাস ঘুষের টাকা লেনদেন করেছেন। তাঁদের কাছ থেকে অসীত বিশ্বাস তিন থেকে চার লাখ টাকা করে নিয়েছেন। আর অসীতের এই কাজে সহযোগী ছিলেন তাঁর অপর বন্ধু মনিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা তন্ময় বিশ্বাস। অসীতের মাধ্যমে আপন ভাইপোসহ কাছের পরিচিতজনদের নিয়োগ পেতে কাজ করেছেন তন্ময় বিশ্বাস।

রাকেস দত্ত নামের এক কর্মচারী বলেন, বিএ পাশ করে এই কাজে এসেছি। নিয়োগের সময় অসীত আমার কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়েছিল। হাসপাতালে কাজের বয়স দেড় বছর পার হচ্ছে বেতন পাইনি। অসীতকে টাকা ফেরতের জন্য চাপ দিচ্ছি। সে দুই মাস সময় নিয়েছে।

ইসমাইল হোসেন নামের এক যুবক বলেন, দীর্ঘদিন খেটে কোনো বেতন পাইনি। কাজলের বিরুদ্ধে মামলার কথা ভাবছি।

এদিকে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর টাকা ফেরত চেয়ে অনেকে অসীতকে চাপ দিতে থাকেন। এরপর কৌশলে মনিরামপুর ছেড়ে আত্মগোপনে চলে জান অসীত বিশ্বাস।

এই বিষয়ে জানতে একাধিকবার অসীত বিশ্বাসের মোবাইল ফোন নম্বরে কল করা হয়েছে। তিনি কল ধরেননি।

অর্থ প্রাইভেট লিমিটেডের কাজল বিশ্বাস বলেন, সিভিল সার্জনের ভুলের কারণে আমাদের টেন্ডার বাতিল হয়েছে। এরপর নিয়োগ পাওয়াদের পারিশ্রমিক চেয়ে আমরা উচ্চ আদালতে রিট করেছি।

কাজল বিশ্বাস আরও বলেন, অসীত বা আমি হাতে করে কোনো টাকা নিইনি। বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা আমার হাতে আসতে পারে। আমি মনিরামপুরে থাকি না। বেতন না হওয়ায় নিয়োগকৃতরা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অসীতকে কাছে না পেয়ে চাপ দিচ্ছেন। এখন তাঁরা টাকা ঘুষ দেওয়ার কথা তুলছেন। এ জন্য অসীত এলাকায় ঢুকতে পারছেন না।

গালফের নিয়োগ ৮ জন

অর্থ লিমিটেডের নিয়োগ বাতিলের পর চলতি বছরের এপ্রিলে গালফ সিকিউরিটি সার্ভিসের মাধ্যমে মনিরামপুর হাসপাতালে আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ পেয়েছেন ৮ কর্মচারী। সেখানেও আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে।

ইমান হোসেন নামের এক কর্মচারী বলেন, বেতন বিহীন অর্থে ৯ মাস কাজ করার পর নিয়োগ বাতিল হলে এপ্রিলে আমাদের পুরোনো তিনজনকে গাল্ফের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়। এখানে ৮ মাস কাজের বয়স। তাও বেতন পাইনি।

গালফ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী এবিএস খান স্বপন বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগাযোগ চলছে। এক সপ্তাহের মধ্যে কর্মচারীদের তিন মাসের বেতন হয়ে যাবে।

নিয়োগে টাকা লেনদেনের বিষয়ে স্বপন বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্মচারীর বেতন প্রতি আমাদের পাঁচ শতাংশ দেয়। কর্মচারী নিয়োগে আমরা কোনো ঘুষ নেই না।

একতা আউটসোর্সিংয়ের নিয়োগ ১১ জন

কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে মাসের পর মাস বেতন দিতে ‘অর্থ’ ও ‘গালফ’ ব্যর্থ হওয়ার মধ্যে চলতি বছরের জুলাই মাসে একই প্রক্রিয়ায় মনিরামপুর হাসপাতালে ১১ কর্মচারী নিয়োগ দেয় একতা আউটসোর্সিং নামের একটি প্রতিষ্ঠান। মনিরামপুরের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) এসএম ইয়াকুব আলীর ছোট ভাই বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক মেহেদি হাসান এই নিয়োগে ভূমিকা রেখেছেন। নিয়োগ পাওয়াদের অনেকে নাম না প্রকাশের শর্তে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে ঘুষ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন।

রাসেল আলম নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, সাবেক এমপি ইয়াকুব আলীর ভাইয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছি। ৫ মাসের মধ্যে কোনো মাসের বেতন পাইনি।

এই বিষয়ে একতা লিমিটেডের কারও সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। তবে নিয়োগে জড়িত বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের চিকিৎসক মেহেদি হাসান বলেন, একতার কর্ণধর মমিনুর রহমান জিহাদের বাড়ি যশোরে। তিনি আমার রোগী। মনিরামপুরে লোক নেওয়ার কথা শুনে তাঁকে বলে আমরা কয়েকজনকে ঢুকিয়েছি।

মেহেদি হাসান বলেন, সরকারের সঙ্গে চুক্তির সময় একতাকে তিন বছরের জন্য সিকিউরিটি মানি ব্যাংকে জমা রাখতে হয়েছে। সে হিসেবে নিয়োগের সময় কিছু টাকা নিতে পারে। আমি কোনো টাকা নিইনি। এগুলো নিয়ে নিউজ করার কিছু নাই।

মনিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা তন্ময় বিশ্বাস বলেন, অসীত আমার বন্ধু। সেই হিসেবে তাঁর মনিরামপুরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসতাম। তাঁদের আউটসোর্সিংয়ের নিয়োগে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

তন্ময় বিশ্বাস বলেন, তিন ধাপে আমার হাসপাতালে আউটসোর্সিংয়ে ২৭ জনের নিয়োগ হয়েছে। এখন ১৯ জন আছেন। তাঁরা কোনো বেতন না পাওয়ায় আমরা বিব্রতবোধ করছি।

যশোরের সিভিল সার্জন মাহমুদুল হাসান বলেন, গালফ ও একতার মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া কর্মচারীদের বেতনের জন্য কাজ করছি। তাঁরা দ্রুত বেতন পেয়ে যাবে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত