জাহিদ হাসান, যশোর
দেশের অন্যতম বড় বিদ্যাপীঠ যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজে শিক্ষকতা করছেন হামিদুল হক শাহীন ও শাহজাহান কবীর। হামিদুল সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আর শাহজাহান ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। শিক্ষকতার গণ্ডির বাইরে তরুণ এই দুই শিক্ষক নিজ গুণে হাজারো শিক্ষার্থীর কাছে আদর্শ হয়ে উঠেছেন।
হামিদুল হক শাহীন ১৯৯৯ সালে প্রথম শ্রেণিতে যশোর জিলা স্কুল থেকে এসএসসি, ২০০১ সালে যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম শ্রেণি ও সম্মিলিত মেধাতালিকায় নবম স্থান অধিকার করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান স্নাতক (প্রথম শ্রেণি) ও স্নাতকোত্তর (প্রথম শ্রেণি) সম্পন্ন করেন। এমএ ইন এডুকেশন উইথ মেরিট (ইউনিভার্সিটি অন নটিংহ্যাম, মালয়েশিয়া ক্যাম্পাস); বাংলাদেশ ডিজাস্টার প্রিপেয়ার্ডনেস সেন্টারে (বিডিপিসি) ট্রেনিং অফিসার হিসেবে যোগদান; এরপর গ্রিন ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতার পর ৩১তম বিসিএসে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে প্রথম স্থান অর্জন করেন।
তরুণ এই শিক্ষক ২০১৩ সালে যশোর এমএম কলেজে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করেন। যে সময়ে শিক্ষার্থীরা ক্লাসবিমুখ হয়ে যাচ্ছেন, হামিদুল হক শাহীনের সৃজনশীল পাঠদান প্রক্রিয়ার কারণে আবারও ক্লাসমুখী হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। এই শিক্ষকের ভাষ্য, ‘একজন শিক্ষকের কাজ যতটুকু না পড়ানো, তার চেয়ে বেশি হলো কীভাবে পড়তে হয় তা শেখানো। যতটা না পিটিয়ে মানুষ করা, তার চেয়ে মানুষ কীভাবে হতে হয় সেই মূল্যবোধ জাগ্রত করা। পাঠদান প্রক্রিয়াকে আনন্দদান করে তুলতে পারা। পাঠদানকে গল্পের ভেতরে নিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ানো। আর এই তিনটা শিখন প্রক্রিয়ার কারণেই শিক্ষার্থীরা ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হন বলে কয়েকজন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন।
শ্রেণিকক্ষে একাডেমিক পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পর চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেদের মতো কিছু করার অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ জোগান হামিদুল হক শাহীন। শুধু শ্রেণিকক্ষে অনুপ্রেরণা নয়, তাঁর কল্যাণে তরুণেরা গড়ে তুলেছেন ‘আইডিয়া সমাজকল্যাণ সংস্থা’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এই সংস্থার মাধ্যমে উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন তাঁরা। তাতে নিজেদের উপার্জনের পাশাপাশি এলাকার উন্নয়নেও তাঁরা ভূমিকা রাখছেন।
শিক্ষার্থীরা জানান, হামিদুল হক শাহীন শিক্ষকতা জীবনের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের নিয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টা করেন। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে কিছু করার অনুমতি পাননি। পরে কলেজ ক্যাম্পাসের বাইরে ২০১৩ সালে তিনি শিক্ষার্থীদের নিয়ে আইডিয়া নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা গত এক দশকে শত শত সুবিধাবঞ্চিত শিশুর মধ্যে খাবার ও পোশাক বিতরণ করেছেন। এ ছাড়া রোজার মাসে তাঁরা শীতল পানি সরবরাহ, মসজিদে অজুখানা বানিয়ে দেওয়াসহ নানারকম সমাজসেবামূলক কাজ করেন।
এ ছাড়া প্রতি শুক্রবার অসহায় ভবঘুরেদের জন্য মিডডে মিলের ব্যবস্থা করছেন। প্রকল্পটি সম্প্রতি এই কাজের শততম পর্ব পার করেছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের দিয়ে তৈরি আইডিয়া পিঠা পার্কের পণ্য এখন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। পিঠার কারখানা স্থাপন ও কাজের জন্য শিক্ষক শাহীন যশোর শহরের খড়কী শাহ আব্দুল করিম রোডে নিজের একটি জায়গা (৫ দশমিক ৮ শতাংশ) ছেলেমেয়েদের দিয়ে দিয়েছেন। ২০১৭ সালের ৯ নভেম্বর ওই বাড়িতেই পিঠা পার্ক স্থাপন করা হয়েছে। পিঠা পার্কে পাটিসাপটা, পাকান, পুলি, ভাপা, চিতইসহ দেশীয় দেড় শতাধিক রকমের পিঠা তৈরি করা হচ্ছে।
শিক্ষার্থীরা জানান, পিঠা পার্ক থেকে অর্জিত লভ্যাংশ শুধু সদস্যরাই নেন না, এর একটা অংশ সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য ব্যয় করা হয়। অপরদিকে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শিক্ষা, বিসিএস শিক্ষা দেওয়ারও ব্যবস্থা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। নামমাত্র টাকা নেওয়া হয়, সেটাও নেন না হামিদুল। এসব টাকা ব্যয় করা হয় শিক্ষার্থীদের কল্যাণে।
মল্লিকা আফরোজ নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘স্যার শিক্ষার্থীদের শুধু একাডেমিক শিক্ষাই দেন না, কর্মমুখী শিক্ষাও দেন।’
হামিদুল হক বলেন, ‘আমার শিক্ষক হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আমার শিক্ষকেরাই জুগিয়েছেন। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এমন কয়েকজন শিক্ষককে আমি পেয়েছি, যাঁরা আমাকে সব সময় সমৃদ্ধির পথে, ভালো একজন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে উৎসাহী করেছেন। সেসব শিক্ষকের অনুপ্রেরণাতেই আমি আজ শিক্ষক। কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশ্বাস করি বলেই পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পর চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেদের মতো কিছু করার অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ দিই।’
অপর শিক্ষক শাহজাহান কবীর ২০০৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতক ও ২০০৯ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ২০১৯ সালে নটিংহ্যাম ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়া ক্যাম্পাস থেকে মাস্টার্স ইন এডুকেশন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের ইতিহাস বিভাগে যোগদান করেন। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে শিক্ষার্থীদের তিনি আনন্দ দেন সৃজনশীল পাঠদান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। পাঠদানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার বৃদ্ধি করতে তিনি বিভিন্ন কুইজ ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করেন। ইতিহাস বিষয়টি সবার কাছে পৌঁছে দিতে কলেজে গড়ে তুলেছেন ‘ইতিহাস ক্লাব’। গ্রুপভিত্তিক গল্পের মধ্য দিয়ে পাঠদানকে শিক্ষার্থীদের উপভোগ করান তিনি।
তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত বিকাশমান এই যুগে বই পড়ার প্রবণতা আমাদের সমাজে কমে আসছে। কিশোর ও তরুণেরা ডিজিটাল মাধ্যমে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পরীক্ষা ও পাসনির্ভর হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ের বাইরে তেমন কোনো বই পড়ছেন না। এমন পরিস্থিতিতে শাহজাহান শিক্ষকতার পাশাপাশি বই পড়ার আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে ‘সপ্তাহে একটি বই পড়ি’ নামে সংগঠন গড়ে তুলেছেন। নিজ কলেজের শিক্ষার্থী ছাড়াও শহরের বিভিন্ন কলেজ, স্কুলের শিক্ষার্থীরা এই সংগঠনের সদস্য।
‘সপ্তাহে একটি বই পড়ি’ কার্যক্রমের সদস্যরা নিজেরা বই পড়ার পাশাপাশি মূলত এখানে নিখাদ বন্ধুত্ব, নির্মল আনন্দ, সৌন্দর্য সৃজনের চর্চা করে থাকেন। এ ছাড়া নিজেদের পাশাপাশি অন্যকে বই পড়ানোর জন্য ‘বইয়ের বন্ধু’ নামে ‘ফ্রি বুক হোম ডেলিভারি সার্ভিস’ চালু করেছেন শাহজাহান। নিয়মিত পাঠচক্রে বই আলোচনার পাশাপাশি থাকে গান, কবিতা আবৃত্তি, স্বরচিত কবিতা পাঠসহ নানা সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। উপস্থিত সবাই পাঠচক্রে পূর্বনির্ধারিত বইয়ের ওপর পাঠ প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ পান। কোনো কোনো বইয়ের জন্য প্রধান আলোচকও রাখা হয়। বইটির ওপর বিশদ আলোচনার পাশাপাশি প্রধান আলোচক শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
পাঠচক্রের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন, জাতীয় দিবস উদ্যাপন, রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী উদ্যাপনের মতো নানা আয়োজন করে ‘সপ্তাহে একটি বই পড়ি’। প্রতি আসরে চা-নাশতার ব্যবস্থা রাখা হয়। সংগঠনের সদস্যদের কাছ থেকে কোনো চাঁদা নেওয়া হয় না। চাকরির বেতনের টাকা বাঁচিয়েই বই কেনা ও নাশতার খরচ জোগান শাহজাহান কবীর। সদস্যরা এক বছরে বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ বই থেকে নির্বাচিত ৪৮ থেকে ৫২টি বই পড়ার সুযোগ পান। শুরু থেকেই পাঠচক্রের গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করে যাচ্ছেন শাহজাহান কবীর।
পারিবারিকভাবে শিক্ষক পরিবারে বেড়ে ওঠার অনুপ্রেরণাতেই তিনি শিক্ষক পেশায় এসেছেন। ২০০৯ সাল থেকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। পাঠচক্রটি গড়ে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে শাহজাহান কবীর বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার একটি সুস্থ-সুন্দর পাঠকসমাজ গড়ে তোলা। একটা সুস্থ, মানবিক ও মননশীল সমাজ গঠনের জন্য বই পড়ার অভ্যাস অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।’
শিক্ষাঙ্গনের পাশাপাশি সামাজিক অঙ্গনেও সমান পরিচিত এই দুই শিক্ষক। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ জোগানোর সব শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হন তাঁরা। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁদের কথা শোনেন।
এই দুই গুণী শিক্ষকের বিষয়ে যশোর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মাহফুজুল হোসেন বলেন, শিক্ষকতার পাশাপাশি হামিদুল হক শাহীন ও শাহজাহান কবীরের কার্যক্রম বেশ প্রশংসিত। তাঁরা দুজনই শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় তাদের কর্মপরিধির কারণে। তাঁরা দুজনই শিক্ষকদের মডেল।
এ বিষয়ে যশোরের প্রবীণ শিক্ষাবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, এখন পাঠক কমে গেছে। এই পরিস্থিতিতে শ্রেণিকক্ষের বাইরে শাহজাহান কবীর মানুষকে বই পড়ানোর চেষ্টা করছেন। ক্লাসেও পড়ার বাইরে নতুন নতুন বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি করছেন। অন্যদিকে হামিদুল হক ছেলেমেয়েদের আত্মনির্ভর করতে নানামুখী উদ্যোগ নিচ্ছেন। তাঁরা আধুনিক শিক্ষকদের মডেল। তাঁরা কোচিংয়ের দিকে অগ্রসর হননি। তাঁরা মানুষকে আলোকিত করা, ভালো পথের দিশা দেওয়ার ব্রত নিয়েছেন। তাঁরা অর্থের পেছনে ঘোরেন না। তাঁদের কারণে শিক্ষার্থীরা আলোকিত হচ্ছেন।
দেশের অন্যতম বড় বিদ্যাপীঠ যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজে শিক্ষকতা করছেন হামিদুল হক শাহীন ও শাহজাহান কবীর। হামিদুল সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আর শাহজাহান ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। শিক্ষকতার গণ্ডির বাইরে তরুণ এই দুই শিক্ষক নিজ গুণে হাজারো শিক্ষার্থীর কাছে আদর্শ হয়ে উঠেছেন।
হামিদুল হক শাহীন ১৯৯৯ সালে প্রথম শ্রেণিতে যশোর জিলা স্কুল থেকে এসএসসি, ২০০১ সালে যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম শ্রেণি ও সম্মিলিত মেধাতালিকায় নবম স্থান অধিকার করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান স্নাতক (প্রথম শ্রেণি) ও স্নাতকোত্তর (প্রথম শ্রেণি) সম্পন্ন করেন। এমএ ইন এডুকেশন উইথ মেরিট (ইউনিভার্সিটি অন নটিংহ্যাম, মালয়েশিয়া ক্যাম্পাস); বাংলাদেশ ডিজাস্টার প্রিপেয়ার্ডনেস সেন্টারে (বিডিপিসি) ট্রেনিং অফিসার হিসেবে যোগদান; এরপর গ্রিন ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতার পর ৩১তম বিসিএসে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে প্রথম স্থান অর্জন করেন।
তরুণ এই শিক্ষক ২০১৩ সালে যশোর এমএম কলেজে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করেন। যে সময়ে শিক্ষার্থীরা ক্লাসবিমুখ হয়ে যাচ্ছেন, হামিদুল হক শাহীনের সৃজনশীল পাঠদান প্রক্রিয়ার কারণে আবারও ক্লাসমুখী হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। এই শিক্ষকের ভাষ্য, ‘একজন শিক্ষকের কাজ যতটুকু না পড়ানো, তার চেয়ে বেশি হলো কীভাবে পড়তে হয় তা শেখানো। যতটা না পিটিয়ে মানুষ করা, তার চেয়ে মানুষ কীভাবে হতে হয় সেই মূল্যবোধ জাগ্রত করা। পাঠদান প্রক্রিয়াকে আনন্দদান করে তুলতে পারা। পাঠদানকে গল্পের ভেতরে নিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ানো। আর এই তিনটা শিখন প্রক্রিয়ার কারণেই শিক্ষার্থীরা ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হন বলে কয়েকজন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন।
শ্রেণিকক্ষে একাডেমিক পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পর চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেদের মতো কিছু করার অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ জোগান হামিদুল হক শাহীন। শুধু শ্রেণিকক্ষে অনুপ্রেরণা নয়, তাঁর কল্যাণে তরুণেরা গড়ে তুলেছেন ‘আইডিয়া সমাজকল্যাণ সংস্থা’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এই সংস্থার মাধ্যমে উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন তাঁরা। তাতে নিজেদের উপার্জনের পাশাপাশি এলাকার উন্নয়নেও তাঁরা ভূমিকা রাখছেন।
শিক্ষার্থীরা জানান, হামিদুল হক শাহীন শিক্ষকতা জীবনের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের নিয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টা করেন। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে কিছু করার অনুমতি পাননি। পরে কলেজ ক্যাম্পাসের বাইরে ২০১৩ সালে তিনি শিক্ষার্থীদের নিয়ে আইডিয়া নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা গত এক দশকে শত শত সুবিধাবঞ্চিত শিশুর মধ্যে খাবার ও পোশাক বিতরণ করেছেন। এ ছাড়া রোজার মাসে তাঁরা শীতল পানি সরবরাহ, মসজিদে অজুখানা বানিয়ে দেওয়াসহ নানারকম সমাজসেবামূলক কাজ করেন।
এ ছাড়া প্রতি শুক্রবার অসহায় ভবঘুরেদের জন্য মিডডে মিলের ব্যবস্থা করছেন। প্রকল্পটি সম্প্রতি এই কাজের শততম পর্ব পার করেছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের দিয়ে তৈরি আইডিয়া পিঠা পার্কের পণ্য এখন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। পিঠার কারখানা স্থাপন ও কাজের জন্য শিক্ষক শাহীন যশোর শহরের খড়কী শাহ আব্দুল করিম রোডে নিজের একটি জায়গা (৫ দশমিক ৮ শতাংশ) ছেলেমেয়েদের দিয়ে দিয়েছেন। ২০১৭ সালের ৯ নভেম্বর ওই বাড়িতেই পিঠা পার্ক স্থাপন করা হয়েছে। পিঠা পার্কে পাটিসাপটা, পাকান, পুলি, ভাপা, চিতইসহ দেশীয় দেড় শতাধিক রকমের পিঠা তৈরি করা হচ্ছে।
শিক্ষার্থীরা জানান, পিঠা পার্ক থেকে অর্জিত লভ্যাংশ শুধু সদস্যরাই নেন না, এর একটা অংশ সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য ব্যয় করা হয়। অপরদিকে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শিক্ষা, বিসিএস শিক্ষা দেওয়ারও ব্যবস্থা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। নামমাত্র টাকা নেওয়া হয়, সেটাও নেন না হামিদুল। এসব টাকা ব্যয় করা হয় শিক্ষার্থীদের কল্যাণে।
মল্লিকা আফরোজ নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘স্যার শিক্ষার্থীদের শুধু একাডেমিক শিক্ষাই দেন না, কর্মমুখী শিক্ষাও দেন।’
হামিদুল হক বলেন, ‘আমার শিক্ষক হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আমার শিক্ষকেরাই জুগিয়েছেন। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এমন কয়েকজন শিক্ষককে আমি পেয়েছি, যাঁরা আমাকে সব সময় সমৃদ্ধির পথে, ভালো একজন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে উৎসাহী করেছেন। সেসব শিক্ষকের অনুপ্রেরণাতেই আমি আজ শিক্ষক। কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশ্বাস করি বলেই পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পর চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেদের মতো কিছু করার অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ দিই।’
অপর শিক্ষক শাহজাহান কবীর ২০০৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতক ও ২০০৯ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ২০১৯ সালে নটিংহ্যাম ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়া ক্যাম্পাস থেকে মাস্টার্স ইন এডুকেশন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের ইতিহাস বিভাগে যোগদান করেন। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে শিক্ষার্থীদের তিনি আনন্দ দেন সৃজনশীল পাঠদান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। পাঠদানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার বৃদ্ধি করতে তিনি বিভিন্ন কুইজ ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করেন। ইতিহাস বিষয়টি সবার কাছে পৌঁছে দিতে কলেজে গড়ে তুলেছেন ‘ইতিহাস ক্লাব’। গ্রুপভিত্তিক গল্পের মধ্য দিয়ে পাঠদানকে শিক্ষার্থীদের উপভোগ করান তিনি।
তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত বিকাশমান এই যুগে বই পড়ার প্রবণতা আমাদের সমাজে কমে আসছে। কিশোর ও তরুণেরা ডিজিটাল মাধ্যমে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পরীক্ষা ও পাসনির্ভর হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ের বাইরে তেমন কোনো বই পড়ছেন না। এমন পরিস্থিতিতে শাহজাহান শিক্ষকতার পাশাপাশি বই পড়ার আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে ‘সপ্তাহে একটি বই পড়ি’ নামে সংগঠন গড়ে তুলেছেন। নিজ কলেজের শিক্ষার্থী ছাড়াও শহরের বিভিন্ন কলেজ, স্কুলের শিক্ষার্থীরা এই সংগঠনের সদস্য।
‘সপ্তাহে একটি বই পড়ি’ কার্যক্রমের সদস্যরা নিজেরা বই পড়ার পাশাপাশি মূলত এখানে নিখাদ বন্ধুত্ব, নির্মল আনন্দ, সৌন্দর্য সৃজনের চর্চা করে থাকেন। এ ছাড়া নিজেদের পাশাপাশি অন্যকে বই পড়ানোর জন্য ‘বইয়ের বন্ধু’ নামে ‘ফ্রি বুক হোম ডেলিভারি সার্ভিস’ চালু করেছেন শাহজাহান। নিয়মিত পাঠচক্রে বই আলোচনার পাশাপাশি থাকে গান, কবিতা আবৃত্তি, স্বরচিত কবিতা পাঠসহ নানা সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। উপস্থিত সবাই পাঠচক্রে পূর্বনির্ধারিত বইয়ের ওপর পাঠ প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ পান। কোনো কোনো বইয়ের জন্য প্রধান আলোচকও রাখা হয়। বইটির ওপর বিশদ আলোচনার পাশাপাশি প্রধান আলোচক শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
পাঠচক্রের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন, জাতীয় দিবস উদ্যাপন, রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী উদ্যাপনের মতো নানা আয়োজন করে ‘সপ্তাহে একটি বই পড়ি’। প্রতি আসরে চা-নাশতার ব্যবস্থা রাখা হয়। সংগঠনের সদস্যদের কাছ থেকে কোনো চাঁদা নেওয়া হয় না। চাকরির বেতনের টাকা বাঁচিয়েই বই কেনা ও নাশতার খরচ জোগান শাহজাহান কবীর। সদস্যরা এক বছরে বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ বই থেকে নির্বাচিত ৪৮ থেকে ৫২টি বই পড়ার সুযোগ পান। শুরু থেকেই পাঠচক্রের গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করে যাচ্ছেন শাহজাহান কবীর।
পারিবারিকভাবে শিক্ষক পরিবারে বেড়ে ওঠার অনুপ্রেরণাতেই তিনি শিক্ষক পেশায় এসেছেন। ২০০৯ সাল থেকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। পাঠচক্রটি গড়ে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে শাহজাহান কবীর বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার একটি সুস্থ-সুন্দর পাঠকসমাজ গড়ে তোলা। একটা সুস্থ, মানবিক ও মননশীল সমাজ গঠনের জন্য বই পড়ার অভ্যাস অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।’
শিক্ষাঙ্গনের পাশাপাশি সামাজিক অঙ্গনেও সমান পরিচিত এই দুই শিক্ষক। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ জোগানোর সব শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হন তাঁরা। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁদের কথা শোনেন।
এই দুই গুণী শিক্ষকের বিষয়ে যশোর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মাহফুজুল হোসেন বলেন, শিক্ষকতার পাশাপাশি হামিদুল হক শাহীন ও শাহজাহান কবীরের কার্যক্রম বেশ প্রশংসিত। তাঁরা দুজনই শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় তাদের কর্মপরিধির কারণে। তাঁরা দুজনই শিক্ষকদের মডেল।
এ বিষয়ে যশোরের প্রবীণ শিক্ষাবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, এখন পাঠক কমে গেছে। এই পরিস্থিতিতে শ্রেণিকক্ষের বাইরে শাহজাহান কবীর মানুষকে বই পড়ানোর চেষ্টা করছেন। ক্লাসেও পড়ার বাইরে নতুন নতুন বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি করছেন। অন্যদিকে হামিদুল হক ছেলেমেয়েদের আত্মনির্ভর করতে নানামুখী উদ্যোগ নিচ্ছেন। তাঁরা আধুনিক শিক্ষকদের মডেল। তাঁরা কোচিংয়ের দিকে অগ্রসর হননি। তাঁরা মানুষকে আলোকিত করা, ভালো পথের দিশা দেওয়ার ব্রত নিয়েছেন। তাঁরা অর্থের পেছনে ঘোরেন না। তাঁদের কারণে শিক্ষার্থীরা আলোকিত হচ্ছেন।
খুলনায় অগ্নিকাণ্ডে একটি পাটের বস্তার গোডাউনসহ ১০টি দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে নগরীর বড় বাজারের বার্মাশীল এলাকায় এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
১৮ মিনিট আগেবৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিহত আবদুল্লাহকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে। আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় বেনাপোল পৌর বল ফিল্ড মাঠে গার্ড অব অনার শেষে পাশের বড় আঁচড়া গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হয়।
৩৬ মিনিট আগেপাবনার চাটমোহরে নিখোঁজের ২৪ ঘণ্টা পর গোলজার হোসেন (৫৩) নামের এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। আজ শুক্রবার সকালে উপজেলার বিলচলন ইউনিয়নের খলিশাগাড়ী বিলের কাজীর নালা থেকে ভাসমান অবস্থায় তাঁর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
৪০ মিনিট আগেঘন কুয়াশার কারণে নীলফামারীর সৈয়দপুর বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ ওঠানামায় বিঘ্ন ঘটছে। আজ শুক্রবার ভোর থেকে ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে রানওয়ে।
৪২ মিনিট আগে