ফজলুল কবির, ঢাকা
‘গণগ্রন্থাগার চত্বর যেমন/ হাঁটতে নিলেই বকুল পিষে যায় পায়ের তলায়/ এ এক নৃশংস পদচারণ।’ আসলেই কি তাই? পায়ের দিকে একবার তাকাই। তার তলাটি তো দেখা যায় না। তবে চারদিকে ছড়ানো আহত ও শুষ্ক বকুল ফুল বলে দিচ্ছে নিজের পায়ের তলায়ও এমন আহতের দল পড়ে আছে। তলানিতে বলে কেউ ভ্রুক্ষেপ করছে না; আক্ষেপ তো দূরের কথা। তলায় বা প্রান্তে থাকার নিয়তিই এমন। যাক, সে অন্য কথা। বকুলের সঙ্গে হয়ে যাওয়া এই নিত্যকার নৃশংসতা নিয়ে মনকে আর বাড়তে দেওয়া যায় না। কারণ, চোখের সামনে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নৃশংসতা, তার সমস্তটা নিয়ে। না, আক্ষরিক অর্থে নয়। তবে গণগ্রন্থাগারের ভেঙে পড়া দেখে এই একটি শব্দই ঘুরেফিরে মাথায় আসছে বারবার।
রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘর ও চারুকলা অনুষদকে দুই বাহুতে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গণগ্রন্থাগারের বর্তমান কাঠামো ভেঙে ফেলা হচ্ছে। গণগ্রন্থাগারটির পোশাকি নাম সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার। কিন্তু সবার কাছে পাবলিক লাইব্রেরি নামেই পরিচিত। কতটা পরিচিত? ব্যক্তিগত খাতা খুললে তার তল পাওয়া কঠিন।
তার আগে বলে নিই, পাঠকের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে এই স্থাপনা ভেঙে ফেলা হচ্ছে। পাঠকদের জন্য আপাতত ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে অস্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানে হবে বহুতল ভবন। বিপুল ব্যয়ে সে ভবন নির্মাণ করা হবে, যা শেষ হবে ২০২৪ সালে। পাঠকক্ষগুলোর সংখ্যা ও পরিসরে বড় হবে। ডিজিটাইজেশনের গতি বাড়বে। প্রতিবন্ধীদের কথা মাথায় রেখে আলাদা ব্যবস্থা হবে। গবেষকদের পাঠ উপকরণ ও গবেষণার দিকে আলাদা মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। বই, পত্রিকা, সাময়িকী, ডিজিটাল আর্কাইভ ইত্যাদির সংখ্যা বাড়বে। সেবার পরিসর বৃদ্ধির এই প্রতিটি বিষয়ই আনন্দের। কিন্তু কোথায় যেন ব্যথা বাজে। শঙ্কা জাগে, যে সুপ্রশস্ত পরিসর দিয়ে এই গণগ্রন্থাগার মানুষের কাছে সহজ প্রাঙ্গণের পরিচয় নিয়ে হাজির হয়েছিল, তা কি আর আগের মতো থাকবে?
কত না স্মৃতিগদ্য আছে এই স্থাপনা নিয়ে। কত শতজনের কথায়, ছোট ছোট উক্তিতে, বাক্যে এর কথা উঠে এসেছে। এমন স্মৃতি জন্ম দেওয়া, আশ্রয় দেওয়া প্রাঙ্গণ ঢাকায় খুব কম। এর নকশাটাই মানুষকে আপন করে নেয় বলা যায়। আচ্ছা কে এর স্থপতি? খুঁজতে গিয়েই মাথা ঘুরে গেল। কোথাও নেই সে নাম। পুরোনো গণগ্রন্থাগার, অর্থাৎ বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারটি নন্দিত স্থপতি মাজহারুল ইসলামের নকশায় করা। কিন্তু যে ভবনে পরে স্থানান্তর করা হলো, তার স্থপতি কে? কোথাও নেই। সরকারি ওয়েবসাইটগুলো খুঁজে হয়রান হতে হলো। নেই অন্য কোনো ওয়েবসাইটেও। অনেক খুঁটিনাটি তথ্য সেগুলোতে থাকলেও এই জরুরি তথ্যটি নেই। মনটা দমে গেল। এত স্মৃতির রঙিন সিঁড়িগুলো তবে কে বানালেন!
এই গণগ্রন্থাগারের সিঁড়ি তো বিখ্যাত হয়ে আছে নব্বইয়ের দশকে বিটিভিতে প্রচারিত ধারাবাহিক বা সাপ্তাহিক নাটকের কল্যাণে। এর সিঁড়িতে বসে তৌকীর আহমেদ, বিপাশা হায়াত, জাহিদ হাসান, শমী কায়সারেরা কত যে প্রেম করেছেন! গ্রন্থাগারের পাঠকক্ষে বই সরাতে গিয়ে কত নায়ক-নায়িকার চার চোখের মিলন হয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। নব্বইয়ের দশকের বিটিভি নাটকে থানা বলতে যেমন শুধু রমনা থানা ছিল, ঠিক তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া নায়ক-নায়িকার আউটডোর (সে সময়ের নাটকে আউটডোর বিষয়টা বেশ কম ছিল) প্রথম সাক্ষাৎ বলতে যে গুটি কয়েক স্থান ছিল, তার অন্যতম এই জাতীয় গণগ্রন্থাগার।
বাস্তবেও কি তা-ই নয়? এর সেই আইকনিক সিঁড়ি কত শত স্মৃতির আকর! কত তরুণ-তরুণী যে এই সিঁড়িতে বসেই প্রণয়কাল কাটিয়ে দিল, কতজন সদ্য পাওয়া কষ্ট ভুলতে এই সিঁড়িতে চুপ হয়ে বসে থাকল, কতজন কিছুই নয়, শুধু সময় কাটাতে সিঁড়িটুকু আঁকড়ে বসে থাকল! মোবাইল ফোন, বিশেষত স্মার্টফোন আসার আগে এই সিঁড়িতে বসে নানা বয়সী মানুষকে বই পড়তে দেখা যেত। বিকেলের দিকে এই সিঁড়ি ঘিরেই জমত আড্ডা। কবি, শিল্পী থেকে শুরু করে ভবঘুরে আড্ডার উন্মুক্ত স্থান ছিল এটি। তবে হুজ্জতও ছিল; নিরাপত্তাকর্মী বা পাঠাগার তত্ত্বাবধায়কেরা মাঝেমধ্যেই এসে আড্ডা দিতে নিষেধ করতেন। তখন কিছুক্ষণের বিরতি। তারপর আবার হয়তো নতুন কোনো আড্ডাবাজ দলবল নিয়ে বসে যেত।
সিঁড়িতে না টিকলেও ক্ষতি নেই তেমন। বকুলঝরা পথ দিয়ে সোজা চলে গেলেই হলো। একেবারে মাথায় ক্যানটিন, যার বাইরে বসবার জায়গা আছে। সেই ক্যানটিনের স্বভাবও প্রায় গণগ্রন্থাগারের মতোই। এর বাইরে বা ভেতরে বসে দীর্ঘ আড্ডায় সাধারণত কোনো বাধা আসত না। শেষ দিকে এর কিছুটা ব্যত্যয় দেখা দিয়েছিল। বাণিজ্যিক দুনিয়ায় পুঁজির চাপে এর অন্যথাও তো হওয়ার কথা নয়। বরং এত দীর্ঘ সময় যে এটি এমনভাবে উদার থাকল, তাই-বা কম কী।
এই ক্যানটিন থেকে বাম দিকে শওকত ওসমান মিলনায়তনের মধ্যকার সবুজ প্রাঙ্গণটি অন্যরকম এক ভালো লাগা তৈরি করে। কত দীর্ঘ দুপুর ও বিকেল যে এখানে কেটেছে! বিকেল থেকেই শুরু হতো মিলনায়তন ঘিরে নানা তৎপরতা। হয়তো কোনো গানের অনুষ্ঠান আছে, অথবা আছে কোনো নাটকের শো, কিংবা স্বল্পদৈর্ঘ্য বা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী। আলোচনা সভাও হতো নিয়মিত। বিকেল থেকেই গমগম করত গোটা প্রাঙ্গণ।
শিশু থেকে বৃদ্ধ—সব বয়সী মানুষের পদচারণে মুখর ছিল যে প্রাঙ্গণ, তা এখন ভাঙা ইট-পাথর ও ধুলার রাজত্ব। এখনো মুখর সেই প্রাঙ্গণ, তবে তা হাতুড়ির শব্দে। প্রায় প্রতিদিনই বাইরে থেকে এই ধ্বংসযজ্ঞের শব্দ কানে আসে। ধুলার অত্যাচারে শ্বাস জানান দেয় কিছু একটা ভেঙে পড়ছে। সেদিন ভেতরে ঢুকে পুরো বিষয়টা দেখার ইচ্ছা হলো। দেখা গেল শওকত ওসমান মিলনায়তনের এক পাশ ভেঙে ফেলা হয়েছে এরই মধ্যে। জমে থাকা বর্জ্য সরাতে কাজ করা হচ্ছে। ক্যানটিন ও মিলনায়তনের মাঝখানের প্রাঙ্গণটায়, যেখানে আগে বিশেষত তরুণ-তরুণীদের উপস্থিতি ছিল, সেখানে দেখা গেল এক তরুণী বসে আছেন পা দুলিয়ে। বিষণ্ন তাঁর চোখ। নিজের ভেতরে চলতে থাকা নানা ভাবনার ছাপ যেন তাঁর চোখেও দেখা গেল। তাঁর পায়ের তলায়ও যেন বকুল পিষে গেছে অজ্ঞাতে; তাই কী মন খারাপ?
ফিরে এসে আবার সেই সিঁড়ির সামনে দাাঁড়নো গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা শুধু। গোটা কয় ছবি তোলা হলো। মনের ভেতর একটা মোচড় দিয়ে উঠল। বামে তাকাতেই দেখা গেল স্মৃতিময় শিশু-কিশোর পাঠকক্ষটি ভেঙে ফেলা হয়েছে, যেখানে কেটেছে শৈশব-কৈশোরের আশ্চর্য সুন্দর কিছু সময়। স্কুল পালিয়ে কত কী করে মানুষ! আমারা দুই-তিনজন ছিলাম, যাঁরা পালিয়ে আসতাম এই পাঠাগারে। পাশের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা চারুকলায় যাওয়া শুরুও সে সময়েই। কিংবা চলে যেতাম বাংলাবাজার, নীলক্ষেত, পল্টন, গুলিস্তানের বইয়ের দোকানগুলোয়। বইয়ের পোকা ছিল মাথায়। সিনেমা দেখা বা রমনা উদ্যানে ঘুরে বেড়ানো—সে-ও ছিল।
সে যাক। সিঁড়িটি বাদ রেখে মূল ভবনের পেছনের দিকটা ভাঙা হচ্ছে। যাঁরা ভাঙছেন, তাঁদেরও কি মন টানছে না তবে? তাঁদেরও কি কিছু জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে? নাকি এ নিছক কল্পনা?
ছবি তুলতে দেখে আশপাশে ভাঙার কাজে মত্ত পরিশ্রান্ত শ্রমিকেরা আমাকে দেখার ছলেই একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন দেখা গেল। এগিয়ে যেতেই হেসে তাকালেন বয়স্ক একজন। নাম আলতাফ হোসেন। জানালেন, বেশ কিছুদিন ধরে কাজ করছেন। জানতে চাইলাম, কত দিন লাগবে ভাঙতে? হাসলেন। বললেন, ‘তা এক সপ্তাহের মধ্যেই হয়া যাইব।’ মন কেমন করল! কিছুক্ষণ চুপ থেকে আলতাফ হোসেন বললেন, ‘সিঁড়িটা সুন্দর।’ হয়তো আমাকে দূর থেকে সিঁড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করতে দেখেই এমনটা বললেন, হয়তো না। দেখা গেল, পরিশ্রান্ত শ্রমিকদের বেশ কয়েকজন ততক্ষণে সেই সিঁড়িতে গিয়ে বসেছেন। লাল-সাদা সেই আইকনিক সিঁড়ি; ভেঙে যাওয়ার আগেও যে পরিশ্রান্ত ক্লান্ত মানুষদের আশ্রয় দিতে ভুলছে না।
কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে গেলাম। কে জানে, এটাই হয়তো শেষবারের মতো এই সিঁড়ি ভাঙা। মাথার ভেতরে তখন সঞ্জীব চৌধুরী গাইছেন—‘তুমি সিঁড়ি ভাঙো/ কত সিঁড়ি ভাঙো/ ভেঙে ফেলেছ কি স্বপ্নের সিঁড়ি?’ সঞ্জীব সম্পূর্ণ অন্য ভাবনা থেকে গেয়েছেন হয়তো, কিন্তু কেমন মিলে গেল। এ সিঁড়ি তো স্বপ্নেরও। যেকোনো গ্রন্থাগারের সিঁড়িই তা-ই। সে হিসেবে বেশ খাপ খেয়ে যায় সঞ্জীবের গানটি। এ সিঁড়ি আক্ষরিক অর্থেই ভাঙা হবে। এই তো আর কয়েকটি দিন।
‘গণগ্রন্থাগার চত্বর যেমন/ হাঁটতে নিলেই বকুল পিষে যায় পায়ের তলায়/ এ এক নৃশংস পদচারণ।’ আসলেই কি তাই? পায়ের দিকে একবার তাকাই। তার তলাটি তো দেখা যায় না। তবে চারদিকে ছড়ানো আহত ও শুষ্ক বকুল ফুল বলে দিচ্ছে নিজের পায়ের তলায়ও এমন আহতের দল পড়ে আছে। তলানিতে বলে কেউ ভ্রুক্ষেপ করছে না; আক্ষেপ তো দূরের কথা। তলায় বা প্রান্তে থাকার নিয়তিই এমন। যাক, সে অন্য কথা। বকুলের সঙ্গে হয়ে যাওয়া এই নিত্যকার নৃশংসতা নিয়ে মনকে আর বাড়তে দেওয়া যায় না। কারণ, চোখের সামনে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নৃশংসতা, তার সমস্তটা নিয়ে। না, আক্ষরিক অর্থে নয়। তবে গণগ্রন্থাগারের ভেঙে পড়া দেখে এই একটি শব্দই ঘুরেফিরে মাথায় আসছে বারবার।
রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘর ও চারুকলা অনুষদকে দুই বাহুতে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গণগ্রন্থাগারের বর্তমান কাঠামো ভেঙে ফেলা হচ্ছে। গণগ্রন্থাগারটির পোশাকি নাম সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার। কিন্তু সবার কাছে পাবলিক লাইব্রেরি নামেই পরিচিত। কতটা পরিচিত? ব্যক্তিগত খাতা খুললে তার তল পাওয়া কঠিন।
তার আগে বলে নিই, পাঠকের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে এই স্থাপনা ভেঙে ফেলা হচ্ছে। পাঠকদের জন্য আপাতত ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে অস্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানে হবে বহুতল ভবন। বিপুল ব্যয়ে সে ভবন নির্মাণ করা হবে, যা শেষ হবে ২০২৪ সালে। পাঠকক্ষগুলোর সংখ্যা ও পরিসরে বড় হবে। ডিজিটাইজেশনের গতি বাড়বে। প্রতিবন্ধীদের কথা মাথায় রেখে আলাদা ব্যবস্থা হবে। গবেষকদের পাঠ উপকরণ ও গবেষণার দিকে আলাদা মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। বই, পত্রিকা, সাময়িকী, ডিজিটাল আর্কাইভ ইত্যাদির সংখ্যা বাড়বে। সেবার পরিসর বৃদ্ধির এই প্রতিটি বিষয়ই আনন্দের। কিন্তু কোথায় যেন ব্যথা বাজে। শঙ্কা জাগে, যে সুপ্রশস্ত পরিসর দিয়ে এই গণগ্রন্থাগার মানুষের কাছে সহজ প্রাঙ্গণের পরিচয় নিয়ে হাজির হয়েছিল, তা কি আর আগের মতো থাকবে?
কত না স্মৃতিগদ্য আছে এই স্থাপনা নিয়ে। কত শতজনের কথায়, ছোট ছোট উক্তিতে, বাক্যে এর কথা উঠে এসেছে। এমন স্মৃতি জন্ম দেওয়া, আশ্রয় দেওয়া প্রাঙ্গণ ঢাকায় খুব কম। এর নকশাটাই মানুষকে আপন করে নেয় বলা যায়। আচ্ছা কে এর স্থপতি? খুঁজতে গিয়েই মাথা ঘুরে গেল। কোথাও নেই সে নাম। পুরোনো গণগ্রন্থাগার, অর্থাৎ বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারটি নন্দিত স্থপতি মাজহারুল ইসলামের নকশায় করা। কিন্তু যে ভবনে পরে স্থানান্তর করা হলো, তার স্থপতি কে? কোথাও নেই। সরকারি ওয়েবসাইটগুলো খুঁজে হয়রান হতে হলো। নেই অন্য কোনো ওয়েবসাইটেও। অনেক খুঁটিনাটি তথ্য সেগুলোতে থাকলেও এই জরুরি তথ্যটি নেই। মনটা দমে গেল। এত স্মৃতির রঙিন সিঁড়িগুলো তবে কে বানালেন!
এই গণগ্রন্থাগারের সিঁড়ি তো বিখ্যাত হয়ে আছে নব্বইয়ের দশকে বিটিভিতে প্রচারিত ধারাবাহিক বা সাপ্তাহিক নাটকের কল্যাণে। এর সিঁড়িতে বসে তৌকীর আহমেদ, বিপাশা হায়াত, জাহিদ হাসান, শমী কায়সারেরা কত যে প্রেম করেছেন! গ্রন্থাগারের পাঠকক্ষে বই সরাতে গিয়ে কত নায়ক-নায়িকার চার চোখের মিলন হয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। নব্বইয়ের দশকের বিটিভি নাটকে থানা বলতে যেমন শুধু রমনা থানা ছিল, ঠিক তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া নায়ক-নায়িকার আউটডোর (সে সময়ের নাটকে আউটডোর বিষয়টা বেশ কম ছিল) প্রথম সাক্ষাৎ বলতে যে গুটি কয়েক স্থান ছিল, তার অন্যতম এই জাতীয় গণগ্রন্থাগার।
বাস্তবেও কি তা-ই নয়? এর সেই আইকনিক সিঁড়ি কত শত স্মৃতির আকর! কত তরুণ-তরুণী যে এই সিঁড়িতে বসেই প্রণয়কাল কাটিয়ে দিল, কতজন সদ্য পাওয়া কষ্ট ভুলতে এই সিঁড়িতে চুপ হয়ে বসে থাকল, কতজন কিছুই নয়, শুধু সময় কাটাতে সিঁড়িটুকু আঁকড়ে বসে থাকল! মোবাইল ফোন, বিশেষত স্মার্টফোন আসার আগে এই সিঁড়িতে বসে নানা বয়সী মানুষকে বই পড়তে দেখা যেত। বিকেলের দিকে এই সিঁড়ি ঘিরেই জমত আড্ডা। কবি, শিল্পী থেকে শুরু করে ভবঘুরে আড্ডার উন্মুক্ত স্থান ছিল এটি। তবে হুজ্জতও ছিল; নিরাপত্তাকর্মী বা পাঠাগার তত্ত্বাবধায়কেরা মাঝেমধ্যেই এসে আড্ডা দিতে নিষেধ করতেন। তখন কিছুক্ষণের বিরতি। তারপর আবার হয়তো নতুন কোনো আড্ডাবাজ দলবল নিয়ে বসে যেত।
সিঁড়িতে না টিকলেও ক্ষতি নেই তেমন। বকুলঝরা পথ দিয়ে সোজা চলে গেলেই হলো। একেবারে মাথায় ক্যানটিন, যার বাইরে বসবার জায়গা আছে। সেই ক্যানটিনের স্বভাবও প্রায় গণগ্রন্থাগারের মতোই। এর বাইরে বা ভেতরে বসে দীর্ঘ আড্ডায় সাধারণত কোনো বাধা আসত না। শেষ দিকে এর কিছুটা ব্যত্যয় দেখা দিয়েছিল। বাণিজ্যিক দুনিয়ায় পুঁজির চাপে এর অন্যথাও তো হওয়ার কথা নয়। বরং এত দীর্ঘ সময় যে এটি এমনভাবে উদার থাকল, তাই-বা কম কী।
এই ক্যানটিন থেকে বাম দিকে শওকত ওসমান মিলনায়তনের মধ্যকার সবুজ প্রাঙ্গণটি অন্যরকম এক ভালো লাগা তৈরি করে। কত দীর্ঘ দুপুর ও বিকেল যে এখানে কেটেছে! বিকেল থেকেই শুরু হতো মিলনায়তন ঘিরে নানা তৎপরতা। হয়তো কোনো গানের অনুষ্ঠান আছে, অথবা আছে কোনো নাটকের শো, কিংবা স্বল্পদৈর্ঘ্য বা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী। আলোচনা সভাও হতো নিয়মিত। বিকেল থেকেই গমগম করত গোটা প্রাঙ্গণ।
শিশু থেকে বৃদ্ধ—সব বয়সী মানুষের পদচারণে মুখর ছিল যে প্রাঙ্গণ, তা এখন ভাঙা ইট-পাথর ও ধুলার রাজত্ব। এখনো মুখর সেই প্রাঙ্গণ, তবে তা হাতুড়ির শব্দে। প্রায় প্রতিদিনই বাইরে থেকে এই ধ্বংসযজ্ঞের শব্দ কানে আসে। ধুলার অত্যাচারে শ্বাস জানান দেয় কিছু একটা ভেঙে পড়ছে। সেদিন ভেতরে ঢুকে পুরো বিষয়টা দেখার ইচ্ছা হলো। দেখা গেল শওকত ওসমান মিলনায়তনের এক পাশ ভেঙে ফেলা হয়েছে এরই মধ্যে। জমে থাকা বর্জ্য সরাতে কাজ করা হচ্ছে। ক্যানটিন ও মিলনায়তনের মাঝখানের প্রাঙ্গণটায়, যেখানে আগে বিশেষত তরুণ-তরুণীদের উপস্থিতি ছিল, সেখানে দেখা গেল এক তরুণী বসে আছেন পা দুলিয়ে। বিষণ্ন তাঁর চোখ। নিজের ভেতরে চলতে থাকা নানা ভাবনার ছাপ যেন তাঁর চোখেও দেখা গেল। তাঁর পায়ের তলায়ও যেন বকুল পিষে গেছে অজ্ঞাতে; তাই কী মন খারাপ?
ফিরে এসে আবার সেই সিঁড়ির সামনে দাাঁড়নো গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা শুধু। গোটা কয় ছবি তোলা হলো। মনের ভেতর একটা মোচড় দিয়ে উঠল। বামে তাকাতেই দেখা গেল স্মৃতিময় শিশু-কিশোর পাঠকক্ষটি ভেঙে ফেলা হয়েছে, যেখানে কেটেছে শৈশব-কৈশোরের আশ্চর্য সুন্দর কিছু সময়। স্কুল পালিয়ে কত কী করে মানুষ! আমারা দুই-তিনজন ছিলাম, যাঁরা পালিয়ে আসতাম এই পাঠাগারে। পাশের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা চারুকলায় যাওয়া শুরুও সে সময়েই। কিংবা চলে যেতাম বাংলাবাজার, নীলক্ষেত, পল্টন, গুলিস্তানের বইয়ের দোকানগুলোয়। বইয়ের পোকা ছিল মাথায়। সিনেমা দেখা বা রমনা উদ্যানে ঘুরে বেড়ানো—সে-ও ছিল।
সে যাক। সিঁড়িটি বাদ রেখে মূল ভবনের পেছনের দিকটা ভাঙা হচ্ছে। যাঁরা ভাঙছেন, তাঁদেরও কি মন টানছে না তবে? তাঁদেরও কি কিছু জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে? নাকি এ নিছক কল্পনা?
ছবি তুলতে দেখে আশপাশে ভাঙার কাজে মত্ত পরিশ্রান্ত শ্রমিকেরা আমাকে দেখার ছলেই একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন দেখা গেল। এগিয়ে যেতেই হেসে তাকালেন বয়স্ক একজন। নাম আলতাফ হোসেন। জানালেন, বেশ কিছুদিন ধরে কাজ করছেন। জানতে চাইলাম, কত দিন লাগবে ভাঙতে? হাসলেন। বললেন, ‘তা এক সপ্তাহের মধ্যেই হয়া যাইব।’ মন কেমন করল! কিছুক্ষণ চুপ থেকে আলতাফ হোসেন বললেন, ‘সিঁড়িটা সুন্দর।’ হয়তো আমাকে দূর থেকে সিঁড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করতে দেখেই এমনটা বললেন, হয়তো না। দেখা গেল, পরিশ্রান্ত শ্রমিকদের বেশ কয়েকজন ততক্ষণে সেই সিঁড়িতে গিয়ে বসেছেন। লাল-সাদা সেই আইকনিক সিঁড়ি; ভেঙে যাওয়ার আগেও যে পরিশ্রান্ত ক্লান্ত মানুষদের আশ্রয় দিতে ভুলছে না।
কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে গেলাম। কে জানে, এটাই হয়তো শেষবারের মতো এই সিঁড়ি ভাঙা। মাথার ভেতরে তখন সঞ্জীব চৌধুরী গাইছেন—‘তুমি সিঁড়ি ভাঙো/ কত সিঁড়ি ভাঙো/ ভেঙে ফেলেছ কি স্বপ্নের সিঁড়ি?’ সঞ্জীব সম্পূর্ণ অন্য ভাবনা থেকে গেয়েছেন হয়তো, কিন্তু কেমন মিলে গেল। এ সিঁড়ি তো স্বপ্নেরও। যেকোনো গ্রন্থাগারের সিঁড়িই তা-ই। সে হিসেবে বেশ খাপ খেয়ে যায় সঞ্জীবের গানটি। এ সিঁড়ি আক্ষরিক অর্থেই ভাঙা হবে। এই তো আর কয়েকটি দিন।
খুলনায় অগ্নিকাণ্ডে একটি পাটের বস্তার গোডাউনসহ ১০টি দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে নগরীর বড় বাজারের বার্মাশীল এলাকায় এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
২৫ মিনিট আগেবৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিহত আবদুল্লাহকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে। আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় বেনাপোল পৌর বল ফিল্ড মাঠে গার্ড অব অনার শেষে পাশের বড় আঁচড়া গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হয়।
৪৩ মিনিট আগেপাবনার চাটমোহরে নিখোঁজের ২৪ ঘণ্টা পর গোলজার হোসেন (৫৩) নামের এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। আজ শুক্রবার সকালে উপজেলার বিলচলন ইউনিয়নের খলিশাগাড়ী বিলের কাজীর নালা থেকে ভাসমান অবস্থায় তাঁর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
১ ঘণ্টা আগেঘন কুয়াশার কারণে নীলফামারীর সৈয়দপুর বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ ওঠানামায় বিঘ্ন ঘটছে। আজ শুক্রবার ভোর থেকে ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে রানওয়ে।
১ ঘণ্টা আগে